Monday 13 July 2015

কণা ও তার মেয়েরা

 তানের কথা
একই সাথে কি একাধিক ব্যক্তিকে ভালোবাসা যায় ? বিশ্বস্ত থাকা যায় প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি? সমাজের রক্তচক্ষু বলে না, তবে জীবন কেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পাঠ দেয়?
কোনমতে স্নাতক হয়েই মাকে জানিয়ে দিলাম, আর নয়।  এবার বাবার নির্ধারিত পাত্রকে বিয়ে করে সুখে ঘরকন্যা করতে চাই। মা করুণ স্বরে বলেছিল,“যারা এই বিপদের দিনে একটা ফোন করেও খবর নেয় না, তারা সেই শৈশবের প্রতিশ্রুতি রাখবে বলে তোর বিশ্বাস হয়?”
আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার  করে তবু  গিয়েছিল মা।  মুখ অন্ধকার করে বাড়ি  ফিরেছিল। তবু বিশ্বাস হয়নি, জয়ন্তকে অফিসে ফোন করেছিলাম।  না করলেই ভালো হত।
 মা দমেনি।  অল্প দিনের মধ্যেই সাধ্যাতীত ধুমধাম সহ রাজীবের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।  জয়ন্তদের তুলনায়  এরা নিতান্তই মধ্যবিত্ত।
বিয়ের  পরই বুঝতে  পারলাম,চরম ভুল করেছি। অন্য কারো সাথে দাম্পত্য  সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব। সব কথা খুলে বললাম রাজীবকে। ও ধৈর্য্য  ধরে সব কথা শুনত। কখনও অহেতুক ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেনি। বারবার  বলত ভুলে যেতে, এমন তো কতই হয়।  সময় সব ক্ষত নির্মূল  করে দেয়।
বিয়ের ঠিক তিন মাস পরে ফিরে এলাম মায়ের কাছে। রাজীব এসেছিল ফিরিয়ে নিয়ে যেতে,যায়নি। করজোড়ে অনুরোধ   করেছি ফিরে যেতে।  শুধু  এই ভেবে চূড়ান্ত  কষ্ট পেয়েছি যে আমার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য এই নিটোল ভালো ছেলেটার গায়ে, “নামমাত্র  বিবাহে ডিভোর্সি ” ছাপ পড়ে গেল।

 বুঝতে   পারলাম আবার  ভুল করেছি। আগে একটা ব্যথা  ছিল,সংখ্যা বাড়ল শুধু।
বিচ্ছেদ হবার পরও ফোন করতাম, রাজীব ভদ্র ভাবেই কথা বলত, খবরাখবর  নিত।  একদিন বলল ওর বন্ধুরা একটি মেয়ের সাথে ব্লাইন্ড ডেটের ব্যবস্থা করেছে। ফোনে প্রচুর উচ্ছাস প্রকাশ করলাম। ফোন রেখে গুম হয়ে গেলাম।
সপ্তাহখানেক পরে, একদিন ফোন করেছি, রাজীব আড়ষ্ঠ হয়ে বলল,“ ব্যস্ত আছি। একটু পরে ফোন করি? ” পরে শুনলাম, সেই মেয়েটির সাথে ছিল, শুভেচ্ছা  জানিয়ে  ফোন রেখেদিলাম। আর কখনও কথা হয়নি।

রাজীবের খবরটা শুনে মা অসম্ভব  খুশি হয়েছিল।  বলল,“ যাক বাবা  এত ভালো ছেলেটার যেন ভালই হয়। এবার তুইও কিছু ভাব। ”
 কি ভাবি? আজ বহুদিন বাদে আয়নার   সামনে এসে  দাঁড়ালাম।  ঈশ্!!কি চেহারা হয়েছে আমার।  কান্না চেপে সরে এলাম। দাদু বলতো তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তার ওপর পুরু কালির ছোপ । সেই কোমর ছাপানো চুল প্রায় সবই উঠে গেছে অযত্ন আর অবহেলায়।  চর্বির পাহাড়, অত শখের   কোন জামাই আর গলে না।
বড় অবিচার করেছি নিজের প্রতি। ঠিক করলাম কাল থেকে ডায়েটিং করতেই হবে।  শুধু স্যালাড খেয়ে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই আগের মত হয়ে যাব।
মা শুনে  খুব বকাবকি  করল, কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।  এই সময় আর একটা কুৎসিত নেশা আমায় পেয়ে বসল, গুটকার নেশা। পাশের ফ্লাটের কাকিমা খায়, মাঝে মাঝে ওনার থেেক চেয়ে   খেতাম, শেষে মায়ের অগোচরে রান্নার মাসিকে দিয়ে আনাতাম।  মা জানতে পারলে কান্নাকাটি  করত, কিন্তু নিজেকে সংশোধন করা আমার সাধ্যাতীত।
 আজকাল খুব দুর্বল লাগে।  হাঁফ ধরে।  মাকে বলিনি, মা আজকাল  বড় ব্যস্ত থাকে, ফাংশান আর মিউজিক স্কুল নিয়ে।
গান কলেজে পড়ায়।  মা চায় আমিও কিছু করি।  পরিচিত  কয়েকজনকে বলেও রেখেছে, কিন্তু  আমি চাইনা।
মায়ের সাথে আজ খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেল এই নিয়ে।
 মন খারাপ   করে আয়নার  সামনে এসে দাঁড়ালাম, হঠাৎ  দেখি বাবা।  হ্যাঁ  বাবাই তো।  শেষ  বয়সের পক্ককেশ, ক্লান্ত , পরাজিত, নুব্জ বাবা  নয়। ছোটো  বেলার ঋজু  যুবক বাবা।  এক মাথা কালো চুল , চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা , দুধ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, যে ছবিটায় রোজ মালা দেয় মা, সেই বাবা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।  হাউহাউ  করে কাঁদছি, “ বাবা আর চলে যেও না, আমাদের  ছেড়ে। কেউ কথা রাখেনি বাবা।  তোমার মত কেউ ভালোবাসেনি——”  

কণার কথা
রান্নাঘরে   ছিলাম, হঠাৎ ধড়াম করে বিকট আওয়াজ , দৌড়ে এসে দেখি তান মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে, সম্ভবত জ্ঞান হীন।  এত ভারি চেহারা আমি একা সোজা করতেও পারছি না। জীবনে এত অসহায় কখনও বোধ হয়নি।  ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুয়েেছ— কি করি?কাকে ডাকি?আমাদের মা-মেয়ের তো আর কেউ নেই।  দাদারা ষাটোর্ধ, বেশ দূরে থাকে,আর আশুতোষের দিকে তো সব পাট বহুদিন চুকে গেছে। অঝোরে  কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেলাম ল্যান্ডফোনটার কাছে—

 গানের   কথা
কি আরামে  ঘুমোচ্ছিলাম, বাইরের রোয়াকে  পৌষ মাসের নরম রোদে, কাঁথা মুড়ি দিেয়। পাশ থেকে   মা যে  কখন নিঃসাড়ে চলে গেছে জানতেই পারিনি।  কেউই  দেখেনি মাকে চলে যেতে।  বাবা  গান  শেখাতে বেড়িয়েছিল আর পিসি কলেজে।  ঠাকুমা প্রথমে বড়লোকের কাণ্ডজ্ঞানহীন  মেয়ের খুকিপণা ভেবে বিশেষ পাত্তা  দেয়নি।  বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়ে সন্ধ্যা  নামার সাথে সাথেই চড়ছিল উদ্বেগের পারদ। রাত দশটা নাগাদ  ক্লান্ত শরীরে বাবা বাড়ি ঢুকতেই ঠাকুমা উপুড়  করে দিয়েছিল অভিযোগের  ঝুড়ি ।
 সব শুনে দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য  হয়ে বাবা দৌড়ে ছিল মায়ের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে ।  মামার বাড়ির গলির মুুখে বাবার পথ আটকে ছিল ছোটো মামা ।  দিদিমার নির্দেশে বাবার জন্য সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা  করছিল।  ছোটো মামা করজোড়ে বাবাকে অনুরোধ করে ফিরে যাবার জন্য।  মা নিরাপদেই আছে।  মাথা ঠান্ডা  হলে দিদিমা কথা দিয়েছে মাকে বুঝিয়ে  শুনিয়ে ফেরৎ পাঠাবে।
 আমার মাতামহের আসন্ন অপমানের হাত থেকে ‘জামাই মানুষকে’ বাঁচাতে দিদিমার এই মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে বাবা বুঝতে পারছিল না, হাসবে না কাঁদবে! জামাই? আমাদের এই মফঃস্বল শহরের অন্যতম অভিজাত দত্ত বাড়ির সুন্দরী মেয়ে যখন পালিয়ে তার গানের মাষ্টারকে কালিঘাটে বিয়ে করেছিল, সেদিন থেকেই সবাই  মায়ের সংস্রব  ত্যাগ করেছিল।  এমনকি আমার  জন্মের খবরপেয়েও কেউ দেখতে আসেনি, শুধু দিদিমা ছাড়া।  তাও লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে।
ছোটো  মামার কথা ফেলতে না পেরে বাবা মাথা নীচু করে ফিরে আসে।  বাবার মুখে সব শুনে, ঠাকুমা হিসহিসিয়ে বলেছিল , “ অ! পালিয়েছে।  তা এই পাপটাকে ফেলে গেল ক্যান্? যা দত্ত বাড়ির চৌকাটে ফেলে আয় এটাকে। ” এটা অর্থাৎ  আমার বয়স তখনও পাঁচ মাস হয়নি।
ঠাকুমার মুখে ঐ কুরুচিকর কথা শুনে তীব্র  ঘৃণায় কুঁচকে গিয়েছিল বাবার মুখ, শুধু বলেছিল “ছিঃ”!  আমি জানলাম কি করে? ঠাকুমা এই অসম্মান  কখনও ভোলেনি, নাই আমায় ভুলতে দিয়েছে।  সত্যি কথা বলতে কি, আমার  প্রতি কর্তব্যে ঠাকুমা-পিসি কোন খামতি  রাখেনি, তবে তাতে কখনই কোন স্নেহের স্পর্শ  ছিল না। বাবার অসাক্ষাতে ওরা আমাকে কালনাগিনীর বাচ্ছা  বলে সম্বোধন  করত, যদিও  তার তাৎপর্য  বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি।
আমাকে বলা হয়েছিল মা পড়তে   গেছে শান্তিনিকেতনে।  কথাটা মিথ্যে ছিল না।  দত্তমশাই অর্থাৎ  আমার মাতামহ সত্যিই সঙ্গীত শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে  ছিলেন।
আমি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতাম কবে মা আসবে।
 তখন আমার বছর  পাঁচেক বয়স, পাশের বাড়ি খেলতে গিয়ে ছিলাম, হঠাৎ  ঠাকুমার তীব্র আর্তনাদ শুনে দৌড়ে এসে দেখি, ঠাকুমা অত্যন্ত  অশ্লীল ভাবে মাটিতে বসে বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, আর পিসি  কর্কশ স্বরে কাউকে গালিবর্ষণ করে চলেছে।  বাবা উঠোনের এককোণে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে, আমাকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকতে দেখে যেন হুতাশনে ঘি পড়ল।  পিসি তেড়ে এসে বলে উঠল, “ছেনাল মাগী পাপটাকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে!”
আর কিছু বলার আগেই বাবা আমাকে কোলে তুলে ভোঁ দৌড়। সে দিন বাবা আমাকে গলির মুখে বলাই এর দোকানের মাখন পাউরুটি আর গরম ডিমভাজা খাইয়ে  গড়ের মাঠে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল।  প্রথম ট্রামে চাপা ও সে দিন।  ফাঁকা  ট্রামে সুযোগ বুঝে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে যাব, তার আগে বাবাই খবরটা দিল।  গতকাল  জনৈক বিরাট বড়লোকের সাথে মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ঐ বয়সে তার তাৎপর্য না বুঝলেও, জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা তোমার মনখারাপ? ” বাবা মৃদু হেসে  বলল,“ নাঃ।  বরং হাল্কা  লাগছে।  শুধু  কি অপরাধে ফাঁসির সাজা হল, সেটা যদি  জানতে পারতাম”।

বাবা ছাড়া আমাকে একজনই ভালোবাসত, আমার দিদিমা । ঠাকুমা প্রায়ই অনুযোগ করত, যে দরিদ্র ঠাকুমার থেকে  ধনী দিদিমাই আমার অধিক  প্রিয়, কথাটা আদপেই মিথ্যা  ছিল না।  শুধু  ধনী  অংশটুকু বাদে। দিদিমা কাঙালেরও অধম ছিল।  দিদিমার সবথেকে বড় অপরাধ ছিল, জন্মের  পর আমাকে দেখতে এসে নিজের গলার সোনার হার খুলে আশির্বাদ করে যাওয়া। হারটা ছিল ওণার স্বর্গীয় মা কুসুমকুমারী দেব্যার।  বলাইবাহুল্য, অভাবের তাড়নায় মাস তিনেকের মধ্যেই বাবাকে হারটা বেচতে হয়।  তখন মা নিজ হাতেই হারটা বাবার হাতে তুলে দিলেও , ফিরে গিয়ে কথাপ্রসঙ্গে  দত্তমশাইকে বলে বসে। ফলশ্রুতি?? দিদিমার হাত থেকে সংসার খরচের সব টাকা কেড়ে নেওয়া হয়।
তবে দিদিমাও ছিল অদমনীয়।  গয়লার সঙ্গে সাট করে কম দুধ নিয়ে তাতে জল মেশানো, বাজারের নির্ধারিত পয়সা থেকে  কিছু সরানো, সুযোগ পেলেই দাদুর  পকেটমারা ইত্যাদি যাবতীয় উঞ্ছবৃত্তি করে দিদিমা সারাবছর পয়সা জমাতো। শুধুমাত্র আমার জন্য।  আমার জন্মদিন আসলে কাঁপা হাতে লেখা ভুল বানানে ভরা একটি চিঠি আর আর রুমালে মোড়া পয়সাগুলো বাবাকে পাঠাতো একটা জামা কিনে দেবার জন্য। শুধু কি তাই? পাশের বাড়ির বেলি পিসির হাত দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কত কি যে পাঠাতো, নিজের ভাগের এক টুকরো  ইলিশ  মাছ, দুটো আম, চারটে ভাজা পিঠে, একটু পায়েস, দুটো দানাদার ইত্যাদি ইত্যাদি ।  পুজোয় কিছু  দিতে পারত না বলে নিজেও শাড়ি ভাঙত না আমার  দিদিমা ।
দিদিমার সাথে দেখা করাটা ছিল অভিসারের সামিল।  পূর্বনির্ধারিত দিন ক্ষণ অনুসারে মন্দিরের পিছনে দেখা হত আমাদের।  মায়ের খবর পেতাম।  দিদিমাই বলেছিল , আশুতোষ বাবুরা গুয়াহাটির অভিজাত বড়লোক।  একাধিক চা বাগানের মালিক ওঁরা।  বেতারে মায়ের গান শুনে উনি মুগ্ধ হন।  পরে কোন অনুষ্ঠানে মাকে দেখে উনি সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করলে আমার মাকেই করবেন।  সব খোঁজখবর নিয়েই উনি দত্তমশাই এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। উনি নাকি আমাকে ও দত্তক নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। সব শুনে বাবা বলেছিল, “লোকটা ভালো বলতে হবে। ”
তানের জন্মের  খবরটাও দিদিমাই আমায় দেয়। আমার তখন সাত।
তান হবার পর মা কিছুদিন মামার বাড়িতে ছিল।  আমি প্রায়শই  লুকিয়ে চুরিয়ে মামার বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর   করতাম, মাকে একঝলক দেখব বলে।  মাঝে মাঝে তানকে কোলে নিয়ে বারন্দায় এসে   দাঁড়াতো মা, ঝলমলিয়ে উঠত চারদিক ।  কি অসম্ভব রূপসী ছিল আমার মা। কাঁচা সোনার মত রঙ, কোমর ছাপানো লালচে ঢেউখেলান চুল, নিটোল গঠন, প্রতিমার মত মুখশ্রী — মন খারাপ হয়ে যেত। আমাদের  ঐ বাঙাল কলোনীর ছিটেবেড়ার ঘরে কি অসম্ভব বেমানান। তানও ছিল ততোধিক সুন্দর । খুব আদর করতে ইচ্ছে করত।আমরা তো সহোদরা ।

একদিন স্কুল থেকে  ফিরছি, দত্তমশাই তখন তানকে কাঁধে চড়িয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছে, আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “একে চিনিস? ” আগে  ভয় পেতাম, কেন জানি না সেদিন কোথা থেকে   এত সাহস পেলাম, চোখে চোখ রেখে কেটে  কেটে  বললাম, “কেন চিনব না? আমার  বোন তান। ” তানও কোল থেকে ঝুঁকে পড়ে আমার চুল টেনে, নাক খামচে, মুখ চেটে সমর্থন জানালো।  দত্তমশাই কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়ে, “ছিঃ দিদি।  নোংরা।   নোংরা। ” বলে তানকে টেনে   নিয়ে হনহনিয়ে পালালেন।  সেদিন রাত্রে বাবা আর আমি খুব হেসেছিলাম।

মামার বািড়র সদর দরজা  দিয়ে প্রবেশের অনুমতি  যখন পাই ততোদিনে আমি কলেজে উঠে গেছি।  দত্তমশাই এর মৃত্যুর পর দিদিমার জেদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় দত্তপরিবার।  অবশ্য আমাকে খোলা মনে কেউই মেনে নেয়নি।  দিদিমার অগোচরে প্রকাশ্যে তানের সাথে আমার তুলনা করা হত।  তান তখন ষষ্ট বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, মায়ের রঙ-রূপ আর আশুতোষ বাবুর উচ্চতা মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো রূপসী।  খুব নামি এবং দামি স্কুলে পড়ে, ফড়ফড় করে সাহেবী উচ্চারণে ইংরাজী বলে যার অধিকাংশই আমার মামা মাসীরা বোঝে না।  আশুতোষ বাবুর কোন ধনী বন্ধুপুত্রের সাথে তানের বাগদানও সম্পূর্ণ ।  তার পাশে আমি ? কিছুতেই ওরা বুঝতে   চাইত না, উচ্চমধ্যবিত্তের সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির হাবাগোবা মেয়ের তুলনা করাটা অসঙ্গত । আমার পিসি  যদি না বিয়ের  পরেও তার উপার্জনের সিংহভাগটাই আমাদের সংসারে ঢালত তাহলে আমরা আজও নিম্নবিত্তই থেকে যেতাম।
আমার পোশাক পরিচ্ছদ নিয়েও সমালোচনার অন্ত ছিল না।  কেন আমি শাড়ি পড়ি? তাও মঙ্গলা হাট থেকে কেনা সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি? কেন ম্যাচিং ব্লাউজ  না পড়ে লাল শাড়ির সাথে হলুদ ব্লাউজ  পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি । কি করে বোঝাই  যে দিদিমার অনুরোধে মাঝে মাঝে দত্ত বাড়িতে থেকে যেতে হত, বাড়িতে পরার জামা কাপড়গুলি তো আর ও বাড়িতে পড়া যায় না।  তাই টিউশনির পয়সায় হাট থেকে ঐ শাড়িগুলো কিনেছিলাম। শাড়ির ভিতরে যা পড়তাম তা সবি পুরানো তাপ্পি  মারা, তাই বাসি কাপড় কেচে লুকিয়ে   চিলেকোঠার ছাতে শুকোতে দিয়ে আসতাম। মেজ মামির ছিল সন্দেহ বাতিক, আমাকে অনুসরণ করতে গিয়ে উনিই প্রথম আবিষ্কার  করেন, আমার তালি মারা শায়া আর গিঁট  বাঁধা অন্তর্বাস । আমার জরাজীর্ণ পরিচ্ছদ গুলোই সবার চোখে আমায় খলনায়িকা থেকে  নায়িকা বানিয়ে দিল আর নতুন খলনায়িকা হল তান।

ওদের সময়টাও খুব ভালো যাচ্ছিল না।  দিদিমার মুখে ভাসা ভাসা শুনতে পেতাম সেই বৈভব আর নেই।  সম্পত্তিগত বিবাদের ফলে ওরা নিউআলিপুরের বিরাট বাড়ি ছেড়ে নাকতলায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেছে। টানাটানির  জন্য তানকে দামি স্কুল ছাড়িয়ে  মধ্যবিত্ত মানের নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে। আমি তখন এম এর ফাইনাল ইয়ার, তান মাধ্যমিকে অঙ্কে ফেল করল।  কি করে হল জানি না, ও প্রাক্তন স্কুলে বরাবর একশোয় একশো পেত। মামার বাড়িতে সেদিন অঘোষিত  উৎসব। কতখানি ঈর্ষা করত ওরা ভেবে বাবা আর আমি হতবাক হয়ে  গিয়েছিলাম।

আমার এম এ পাশ করার মাস ছয়েক পরই দিদিমা  মারা যায়। শেষ যে রাতটা আমরা একসাথে কাটিয়েছিলাম দিদিমা  আমায় খুব আদর করছিল।  বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছিল আর মাঝে আমার মাথা শুঁকছিল।  আমিও প্রাণভরে দিদিমার আঘ্রাণ নিচ্ছিলাম।  এককালে এই বিরাট খাটে দত্তমশাই মা আর দিদিমা শুত। আমি চোখ বন্ধ করে দিদিমার মধ্যে মাকে খুঁজছিলাম, জানি দিদিমা ও আমার মধ্যে মাকেই খুঁজছিল। সেই যে কবে মা আমাকে ফেলে চলে এসেছিল, তার পর থেকে ওদের সম্পর্ক কখনও স্বাভাবিক হয়নি।  হঠাৎ  দিদিমা জিজ্ঞাসা করল, “ হ্যাঁ রে তুই নাকি চাকরি করবি?” অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, “ হ্যাঁ ।  তোমাকে  তো অনেকবার  বলেিছ। ” দিদিমা বলল, “পাবি? সত্যি?” হাসলাম।  কিছুক্ষণ নীরব থেকে  দিদিমা বলল,“পেলে আমায় কিছু টাকা দিবি? ” দিতে আর পারলাম কই? সেটাও পৌষ মাস, নিউমোনিয়া কেড়ে নিল আমার দিদিমাকে। সাথে সাথেই মায়ের খবরাখবর  পাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল।

 চাকরি পেলাম।  বিয়ে ঠিক হল।  ভেবেছিলাম মা আসবে।  কিন্তু নিমন্ত্রিতদের তালিকায় মামার বাড়ি থাকলেও মা বাদ। বাবা বলেছিল, পিসি-ঠাকুমা তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেয়।  বিয়ের সব দায়িেত্ব পিসি একা।  বাবার তীব্র আপত্তি ছিল।  পিসি ফুৎকারে উড়িয়ে  বলেছিল ,“  বেশি বাপগিরি করতে আসিস না। ওর জন্মের পর থেকে আমি ওর বিেয়র জন্য পয়সা জমাচ্ছি। ” বিয়ের পর দিন যখন চলে আসব, সেই আমার পাঁচ বছর বয়সের দৃশ্য গুলির পুনরাভিনয় দেখলাম।  ঠাকুমা সেই একই ভাবে মাটিতে বসে ’দ্যাশের’ ভাষায় বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, পিসি শুষ্ক চোখে কর্কশ কন্ঠে বাবা আর ঠাকুমাকে ধমকাচ্ছে আর বাবা খালি খালি  ধুতির খুঁটে চোখ মুচছে। পিসি লাল চোখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখ আমার আদিখেত্যা আসে না।  তুই আমার প্রথম সন্তান । ” হেসে ফেললাম।  পিসির হাতটা ধরে বললাম, “বাবাকে—— ” সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরোনো পিসি ফিরে এল।  মুখ ঝামটা মেরে বলল, “এতদিন তোর বাপকে কে দেখল রে হারামজাদী। ”
মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমিই বাড়ি ছেড়ে এলাম।

সেদিন যখন ফোনটা এল, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুচ্ছে, নৈশভোজ সমাপ্ত করে তখনও আমরা এঁটো হাতে গল্প করছি।  আমিই ধরেছিলাম ফোনটা। হ্যালো বলাতে কোন প্রত্যুত্তর আসেনি, শুধু  মৃদু ফোঁপানোর শব্দ ছাড়া।  মুহূর্তমধ্যে ঐ ফোঁপানি সংক্রামিত  হল আমার মধ্যে।  বন্য হস্তীর মত আর্তনাদ করে হাউহাউ করে কাঁদছি।  সবাই ছুটে এসেছে।  সম্মিলিত প্রশ্নের মুখে আমি  শুধু  একটা কথাই বলতে পারলাম ,“মা কাঁদছে।  ”

কণার কথা—
মধ্য রাতের নিয়নজ্বলা কলকাতার রাস্তায় উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স।  একটা হাতে গানের হাত ধরে আছি, অন্য হাতে তানের।  আমার কাঁধে মাথা রেখে সমানে ফুঁপিয়ে  চলেছে গান।  তান নিথর।  হাসি হাসি মুখে যেন কোন সুখস্বপ্নে বিভোর।  আধো আলোছায়াতে চেনা দুষ্কর কোনটা কে।  যেন একজোড়া গান বা একজোড়া তান, নাকি দুটুকরো আমি ? একটা লড়াকু, বারংবার হেরেও হার না মানা  আর একটা অলস সংগ্রাম বিমুখ হেরে যাওয়া আমি।
গানকে যখন ছেড়ে এসেছিলাম তখন আমার কতই বা বয়েস।  বড় আশা নিয়ে বাসবকে বিয়ে করেছিলাম।  সঙ্গীতের মূর্ছনায় উচ্ছল হয়ে উঠবে জীবন।  বাবার নয়নমণি ছিলাম, সেই বাবা আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক  ত্যাগ করল।  কি অসম্ভব কষ্ট হত বাবার জন্য, লুকিয়ে কাঁদতাম।  বাবা বলেছিল “ ভুল করছ। এর মাসুল তোমাকেই গুনতে হবে। ” ভুল মানে? উফ্ সে কোন পৃথিবী।  বাসবের মা- বোন আমাকে সহ্য করতেই পারত না।  বিবিহযোগ্যা বোন থাকতেও বাসব কি করে আগে বিয়ে করল? নির্ঘাত আমরা তুক্ করেছি, এইরুপ নিম্নরুচির আলোচনা হত, আমাকে শুনিয়ে।  একটা মাত্র ঘর, তাতে একটা তক্তোপোশ। ওপরে শুতাম আমরা, মাটিতে জটিলা কুটিলা।  বাসবের সাথে দেখা হত দিনান্তে। দুটো কথা বলারও অবকাশ ছিল না। প্রেমালাপ দূরে থাক,  রাতে দুটো ফিস্  ফিস চরে কথা বললেও ধমক খেতে হত।
আজ ও মনে আছে, সেদিন ভীষণ মনখারাপ ছিল বাবার জন্য, ভাবলাম একবার দেখেই চলে আসব। গানকে ঘুম পাড়িয়ে নিঃসাড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বাবা বাইরের ঘরে একা উদাস  হয়ে বসেছিল কি জানি হয়তো আমারি প্রতীক্ষায়।  ডুকরে কেঁদে উঠলাম।  বাবাও কাঁদছিলো।  তারপর যে কি হল, আজ আর মনে পড়ে না।একটাই আফ্শোস ছিল, বিদায় জানিয়ে আসার সুযোগ পাইনি।

গানের  কথা -
তান চলে গেল।  দুদিন ভেন্টিলেটরে রেখেও বাঁচানো গেল না।  মাল্টিপল অর্গ্যান ফেলিয়র।  বাবাকে খবরটা দিলাম, বাবা বলল,“মাকে একা ছাড়িস না।  বড় অসহায় ও । ” মাকে ছাড়িনি আমি।  জড়িয়ে আছি সবসময়।  নিমতলা মহাশশ্মান, তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছি আমরা,মা বারবার ওর হিমশীতল ঠোঁটে চুমু  খাচ্ছে, খুব আদর করছে ওকে, হঠাৎ   ধড়মড় করে উঠে পড়ল মা।  আলুথালু  অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ালো এক সুবেশ যুবকের সামনে।  বহুক্ষণ ধরেই ছেলেটিকে দেখছি। উত্তেজিত হয়ে মা কিছু বলছে।  ছেলেটি মাথা নীচু করে চলে গেল।  মা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসে বলল, “ হারামজাদা।  দেখতে এসেছে আমার মেয়ে সত্যি মরেছে কি না। ” ভাবলাম তানের প্রাক্তন স্বামী  হবে। একটু পরেই ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল অপর এক যুবা।  তাকে দেখে মা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।  মাই পরিচয় করিয়ে দিল রাজীবের সাথে।  হতবাক্  হয়ে গেলাম।  এ যদি তানের বর হয় তবে ওকে ছিল? পরে রাজীবই বুঝিয়ে  দিল, ওটা ছিল জয়ন্ত।  ওর সাথেই আশুতোষ বাবু তানের বিয়ে ঠিক করেছিলেন শৈশবে। রাজীব ও মায়ের সাথে একমত, জয়ন্তর দেওয়া হৃদয়ভঙ্গের বেদনা সহ্য করতে না পেরেই---।  জয়ন্ত কিন্তু  চলে যায়নি।  দাহ করে ফেরার সময়ও আমি ওকে দেখেছি।  ভীড়ে লুকিয়ে ছিল।

ছমাস পর—
 মা নাকতলার ফ্ল্যাটে একাই থাকে।  আমি নিয়মিত খবরাখবর  নিই।  আরো একজন খোঁজ নেয়।  আমার বাবা ।  মা ও সসঙ্কোচে এদিকের খবর জানতে চায়।  আমি দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছি ——— স্বপ্ন কি কখনত্ত সত্যি হয়???

Image courtesy- Google

2 comments: