Saturday 16 July 2016

অনির ডাইরি ১৬ ই জুলাই


( ১২ ই জুলাইয়ের পর)
৩০শে জুন, আজই উটিতে আমাদের অন্তিম দিন, গতকাল সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে, তাও সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ। কালকের ভেজা জুতো আর গরম জামা সারা রাত রুম হিটার চালিয়ে শুকানো হয়েছে। আজ আবার ভিজতে হবে ভাবলেই কান্না পাচ্ছে। অন্বেষা তো বলেই দিল আজ আর বেরোবে না। পুটপুট আর তুত্তুরিকে নিয়ে হোটেলেই থেকে যাবে, আর তাছাড়া যাবেই বা কি করে, আমাদের সব কটা শৌখিন থ্রি ফোল্ড ছাতাই তো ভেঙে বসে আছে। শেষ পর্যন্ত অন্বেষারই উদ্যোগে হোটেল থেকে একটা বিশাল ছাতা যোগাড় হল, পৌনে দশটা নাগাদ আমরা যখন বেরলাম, তখনও আকাশের মুখ ভার, তবে বৃষ্টি ধরেছে। আজ আর দূরে কোথাও নয়, উটি শহরেরই আসে পাশে ঘোরা। শৌভিক আর দেবু হিসেব কষছিল, আমরা যেদিন উটিতে এলাম সেদিন ঠিক মধ্যাহ্নে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল এবং কালকেও মোটামুটি ঐ একই সময় থেকেই প্রবল বৃষ্টি এসেছিল। সুতরাং যা যা দেখার আছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য গুলি, প্রথমে দেখে নেওয়াই নিরাপদ। সেইমত ড্রাইভারকে নির্দেশ দেওয়া হল, প্রথমেই ডোডাবেতা পিক এ নিয়ে যাবার জন্য। ডোডাবেতা নীলগিরির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, উটি শহর ছাড়িয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সদ্য বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া ঘন সবুজ নির্জন, গা ছমছমে জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছে মন খুশি হয়ে যায়। খুশির চোটে দেবু তো বলেই ফেলল, “দেখছিস, কি রকম সময়ে এসেছি, টুরিস্ট নেই প্রায়। একটাও বাঙালি পাবি না, আসে পাশে।” । কিন্তু সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না, ডোডাবেতার মাথায় পৌঁছে দেখা গেল, প্রচুর গাড়ি এবং ততোধিক লোক। স্থানীয় লোকজন পসরা সাজিয়ে প্রায় বাজার বসিয়ে ফেলেছে। গাড়ি যেখানে নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে পাথরের চওড়া চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে, সিঁড়ির দুদিকে হরেক রকম পসরার বাজার। কেউ বিক্রি করছে গরম পোশাক, কেউ বা বাচ্ছাদের খেলনা, কোথাও কাঁচা আম বিক্রি হচ্ছে, কোথাও বা স্থানীয় বিশাল বিশাল গাজর। এছাড়া চানা, বাদাম তো আছেই। তবে এ সব জায়গায় সাধারণত প্রচুর বাঁদর বাঁ হনুমানের উৎপাত থাকে। ডোডাবেতায় তেনাদের একটিকেও দেখতে পেলাম না।
চারিদিকে ঘন মেঘের চাদর, তীব্র বেগে হাওয়া বইছে, অন্বেষা নামল না। তুত্তুরিকেও আমরা আর নামালাম না, যা হাওয়ার বেগ, যদি উড়ে যায়। আমি, শৌভিক আর দেবু দৌড়লাম সিঁড়ি ভেঙে। ডোডাবেতার মাথায় পৌঁছে বেশ হতাশ হলাম। পার্কের মত ফাঁকা বাঁধানো জায়গা, মাঝে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। আমাদের ঘরের পাশের টাইগার হিলের স্মৃতি উস্কে দেয়, যদিও টাইগার হিল অনেক বেশি রাজকীয়। ডোডাবেতার মাথায়ও প্রচুর দোকান পাট, আইসক্রিম পার্লার, যদিও সবই বন্ধ। নীচে যত গাড়ি বা লোক দেখে এলাম তার দশ ভাগের এক ভাগও ওপরে নেই। হাওয়ার তীব্র দাপটে সবাই গিয়ে জড় হয়েছে, ওয়াচ টাওয়ারের ভিতর। ফাঁকা ধুধু ডোডাবেতায় আমরা চারদিক ঘুরতে লাগলাম। রুক্ষ পাথুরে চুড়া চূড়ান্ত নির্জন চারদিকে ঘন জঙ্গল, মেঘে ঢাকা। খানিক ক্ষণ ঘোরাফেরা করে, কাঁচামিঠে আম খেয়ে আমরা চললাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। জনবহুল এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ি আবার জঙ্গলে ঢুকল। দেবু বিরক্ত হয়ে বলল, “যেখানে পাহাড়ের মাথা অবধি গাড়ি যায়, সেখানে আর কি বা আশা করি? ট্রেকিং না করলে আবার পাহাড়ে চড়া কিসের?” শৌভিক প্রস্তাব দিল, “ আমরা বরং এই জঙ্গলের মধ্যেই খানিকটা হাঁটি, দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে মিটবে।” গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল, তুত্তুরিকে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গভীর জঙ্গল, পাখির ডাক ছাড়া আর মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে এক-আধটা গাড়ি চলে যাবার আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই, গাড়ি থেকে রাস্তা যত ভাল মনে হচ্ছিল, নেমে দেখলাম ততোটাও ভাল নয়। মাঝে মাঝেই খানা খন্দ রয়েছে, রাস্তায় এর মধ্যেই শ্যাওলা পড়ে গেছে, এখানে বাতাসের বেগ প্রায় নেই বললেই হয়। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে জল পড়ছে, মাঝ খান দিয়ে বেশ খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম আমরা। একজায়গায় এসে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। কোন দিকে যাই? গাড়ি টাকে ডেকে নেওয়াই ভাল। ফোন করতে গিয়ে দেখা গেল, কারো ফোনেই টাওয়ার নেই। অগত্যা দেবু দৌড়ল গাড়ি ডাকতে, আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স রয়ে গেলাম জঙ্গলের মধ্যে একা। কিছু ক্ষণ পরেই শুরু হল হাওয়ার অত্যাচার, সে কি হাওয়া, হাড় পর্যন্ত কাঁপতে লাগল হিহি করে। সাথে শুরু হল টিপটিপ বৃষ্টি। দৌড়তে লাগলাম আমরা, প্রায় মিনিট দশেক পর, আমাদের গাড়ির দেখা পেলাম, মজার কথা হল, যেখানে আমরা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে গাড়িতে মিনিট পাঁচেক গেলেই উটি শহর। শহরের এত কাছে ছিলাম, অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।
পরবর্তী গন্তব্য টি ফ্যাক্টরি। যত বলি নারে বাপু, আমরা দার্জিলিং এর রাজ্য থেকে আসছি, খামোখা নীলগিরিতে এসে কেন চা এর কারখানা দেখতে যাব, ড্রাইভার বুঝলে তো? অগত্যা যেতেই হল, পাহাড়ের কোলে মাঝারি মাপের কারখানা। পাশেই পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে চায়ের বাগান। কোন এন্ট্রি ফি নেই, উল্টে ওঁরাই কমপ্লিমেন্টরি চা খাওয়ান। গাইড ভদ্রলোক অত্যন্ত যত্ন করে একটা একটা চা গাছের ডাল নিয়ে বোঝালেন, চা পাতা প্রসেস করলে প্রথমে পাওয়া যায় হোয়াইট টি। যা প্রায় সবটুকুই বিদেশে রপ্তানি করা হয়, এর উচ্চ ঔষধি গুণাবলীর জন্য। হোয়াইট টি নাকি, একই পাতা সকাল, বিকাল সন্ধ্যে তিনবেলা ব্যবহার করতে হয়, এবং শেষবার চা করার পর ঐ পাতা না ফেলে দিয়ে চিবিয়ে খেতে হয়। হোয়াইট টিতে দুধ বা চিনি মেশাতে নেই। হোয়াইট টির পর পাওয়া যায় গ্রিন টি। ওনার বক্তব্য অনুসারে, গ্রিন টির ক্ষেত্রেও একই টি ব্যাগ তিনবার ব্যবহার করা উচিৎ। যদিও এ ক্ষেত্রে পাতা চিবিয়ে খেতে হয় না। শেষে বিভিন্ন ফ্লেভার যুক্ত সাধারণ চা পাওয়া যায়। চা ফ্যাক্টরি থেকে গোটা উটি শহর দেখা যায়, নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। গাইড ভদ্রলোক আমাদের মহা সমাদরে নিয়ে গেলেন চা খাওয়াতে, খেয়ে ভাল লাগলে ওঁদের বিপণি থেকে কেনাও যায়। ওঁদের চা এই বিপণি ছাড়া এমনি বিক্রি হয় না, মূলত এক্সপোর্ট হয়।
ওনার বক্তব্য সবথেকে মন দিয়ে আমিই শুনেছিলাম বা বলা যায়, পুরোটা শুনেছিলাম বলেই কি না জানি না, উনি আমাকে হোয়াইট টি খাইয়েই ছাড়লেন। সে যে কি কদাকার খেতে, মনে হচ্ছিল কাগজের কাপে ঈষৎ উষ্ণ গরম জল খেলাম। বাকিরা সকলে মহানন্দে দক্ষিণ ভারতীয় সুগন্ধি কার্ডামম চা খেল। আমি বোধহয় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, তাই শেষ পর্যন্ত এক কাপ আমারও জুটল। যেমন মিষ্টি তেমনি সুন্দর গন্ধ।

এরপর গন্তব্য উটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। পরিশেষে উটি লেক। উটি লেক প্রাকৃতিক লেক নয়। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধার। তবে বেশ বড় এবং সুন্দর। এখানে লোকজন বেশ ভাল ইংরাজি এমনকি ভাঙা ভাঙা হিন্দিও বোঝে। বেশ খানিক ক্ষণ বোটে চড়ে আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে। ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে গেছে, রাস্তা ঘাট শুকনো। আজ শুধু রেস্ট নেওয়া, আর ব্যাগ গোছান, কাল সকালে প্রাতঃরাশ করেই আমরা বেরিয়ে পড়ব, পরবর্তী গন্তব্য মহীশুর।
(চলবে)
#AnirDiary #AninditasBlog
https:amianindita.blogspot.in

No comments:

Post a Comment