Tuesday 19 July 2016

অনির ডাইরি ১৮ ই জুলাই


( ১৬ ই জুলাইয়ের পর)
আজ ১লা জুলাই, প্রাতরাশ করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম মহীশুরের উদ্দেশ্যে। রাতে বৃষ্টি হলেও, সকালটা বেশ ঝরঝরে। গাড়িতে মালপত্র ওঠানো হচ্ছিল যখন, আমি আর অন্বেষা দুটো বাচ্ছাকে নিয়ে শেষ বারের মত ফার্ন হিলের আশপাশটা ঘুরে নিলাম। শৌভিকের এক দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু বেড়াতে আসার আগে বলেছিল, “তোমরা দার্জিলিং এর রাজ্যের লোক হয়ে, খামোখা উটি যাচ্ছ কেন?” কথাটা হ্যতো সত্যি, কিন্তু উটি আমাদের দারুণ ভাল লেগেছিল। তার মুখ্য কারণ অবশ্যই ফার্ন হিল স্টারলিং রিসোর্ট, শহরের বাইরে, উঁচু নিঃসঙ্গ টিলার ওপর ছবির মত সুন্দর হোটেল। আমার আজ অবধি বেড়াতে গিয়ে থাকা সবথেকে ভাল হোটেলের গুলির মধ্যে অন্যতম। ফার্ন হিলের আর একটা বৈশিষ্ট হল ওদের এলাহি ব্রেকফাস্ট। অধিকাংশ ভাল হোটেলের মত, এখানেও ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। বিশাল ডাইনিং হল জুড়ে, থরে থরে সাজানো নানা ধরণের ব্রেড, যথা- সাদা ব্রেড, মিক্সড গ্রেন ব্রেড, ক্রশা ব্রেড, স্টার শেপড ব্রেড বাকি গুলির তো নামই জানি না। পাশেই টোস্টার রাখা আছে, মনের মত করে সেঁকে নেবার জন্য। একটা বড় কাঁচের বোলে ডুমো ডুমো করে কাটা মাখন, প্যান কেক, ওয়াফ্লস, নানা জাতের কেক, নানা ধরণের জুস (সব্জি এবং ফল), গরম, ঠান্ডা দুধ, মিল্ক শেক, তিন চার রকমের সিরিয়াল যেমন- কর্নফ্লেক্স, ওট ফ্লেক্স, মুসেইলি, তুত্তুরির প্রিয় চকোস্, এছাড়া ডুমো ডুমো করে কাটা দু-তিন রকমের ফল (যেমন- তরমুজ, ফুটি বা পাকা পেঁপে), নানা ধরণের স্যালাড, স্প্রাউট (কলা ওঠা ছোলা ও কাঁচা মুগ), মধু, জ্যাম, সটে ভেজিটেবলস। এছাড়া দেশি যাবতীয় জলখাবার যেমন পুরি- সব্জি, চানা-বাটুরা, ইডলি, সাম্বার, বন্ডা, পাওভাজি, উপমা, উত্তপম, চিঁড়ের পোলাও, পোঙ্গল ইত্যাদি। আমিষ কাউন্টার আলাদা- সেখানে সিদ্ধ ডিম, স্টিমড চিকেন সসেজ, গ্রিল্ড বেকন ইত্যাদি। এতেও না পোষালে, শেফ কাউন্টার আছে, সেখানে হাসি মুখে শেফ দাঁড়িয়ে আছেন, বললেই গরম গরম অমলেট (সাদা বা মশলা যা আপনার রুচি), পুরি বা ধোসা বানিয়ে আপানার টেবিলে পাঠিয়ে দেবেন। চাইলে আপনার মনের মত ব্রেডও পাবেন, ফ্রেশলি ব্রেকড।

তাই বলে আমরা কেউ রাক্ষস ছিলাম না যে এত কিছু চেখে দেখব। অন্বেষা তো মোটামুটি ফলের ওপর দিয়েই ব্রেকফাস্ট সারত। আর তুত্তুরির ছিল চকোস আর ঠান্ডা দুধ। আর আমার প্রিয় ব্রেকফাস্ট ছিল, হাল্কা করে সেঁকা ক্রসা ব্রেড আর মাখন, সাথে এক টুকরো চিকেন সসেজ বা মশালা অমলেট। শেষে এক গ্লাস মিল্ক শেক যেটার অর্ধেকটা তুত্তুরি খেত। এত ভাল ক্রসা ব্রেড আমি জীবনে খাইনি, আর সত্যি কথা বলতে কি এর থেকেও অনেক বেশি আইটেম হয়তো অন্য জায়গায় পেয়েছি, কিন্তু এত মাখনের প্রাচুর্য কোন হোটেলে পাইনি, সর্বত্রই আপনার টেবিলে বা ওদের কাউণ্টারে সিল করা আমুল মাখনের ছোট কিউব থাকে, ছুরি দিয়ে লাগিয়ে নিতে হয়। কিন্তু ফার্ন হিলেই প্রথম দেখলাম, বড় পাঁচশ গ্রাম আমুল মাখন কে কেটে টুকরো টুকরো করে কাঁচের বাটিতে রাখা থাকত। যার যতগুলি ইচ্ছা নিত, প্রায়ই ব্রেকফাস্ট করে ফেরার পথে দেখতাম, অথিতিরা খেয়ে উঠে গেছেন, প্লেটে পড়ে আছে একাধিক বড় বড় অভুক্ত মাখনের টুকরো। তখন সত্যি দুঃখ হত, হোক কমপ্লিমেন্টারি, তবু আমাদের মত দেশে, এই অপচয় কি সত্যিই মানা যায়?
সাড়ে নটায় উটি ছেড়ে বেরনোর কথা ছিল, বের হতে হতে প্রায় দশটা- সোয়া দশটা হয়ে গেল। যেতে প্রায় চার- সাড়ে চার ঘণ্টা তো লাগবেই। দেবু উৎফুল্ল হয়ে বলল, “লাগুক লাগুক। মাহিশুরের হোটেলে চেক ইন টাইম বেলা দুটো। আগে গিয়ে কি করবি? আর আমরা যাব দু-দুটো ঘন জঙ্গলের (পড়ুন অভয়ারণ্য) মধ্যে দিয়ে, ড্রাইভার সাব জিতনা দের লাগে ঠিক হ্যায়।” সত্যি আমরা দুটি অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে যাব, প্রথমটা তামিলনাড়ুর মুদুমালাই আর দ্বিতীয়টা কর্ণাটকের বন্দিপুর। ড্রাইভার জানিয়েই দিল, এই জঙ্গলে প্রচুর জীবজন্তু আছে, কিন্তু এখানকার সবথেকে হিংস্র জীবটাই আর জীবিত নেই। বছর বারো আগে, তামিলনাড়ু স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গুলি করে মেরেছিল তাকে। তার নাম? কুশ মুনিস্বামী বিরাপ্পন, সেই বিখ্যাত চন্দন দস্যু।
উটি শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা পাহাড়ে উঠল গাড়ি, এদিকে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল, ড্রাইভার সাহেব গাড়ি চালাতে চালাতে জানালেন, যে এই রাস্তায় ৩৬ টা (যতদূর মনে পড়ছে) হেয়ারপিন বেন্ড আছে। শুনেই প্রমাদ গুনলাম, কারণ হেয়ারপিন বেন্ড থাকলে খুব দ্রুত পাহাড়ে নামা বা ওঠা যায় যেমন, তেমনি যাদের বমি করার ধাত থাকে, তাদের কষ্টও বহুগুণ বেড়ে যায়। আমার আজকাল আর হয়না, কিন্তু এদিকে তুত্তুরি আর ওদিকে অন্বেষার খুব কষ্ট হবে। আমার আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে তুত্তুরি যথারীতি দুবার বমি করল, তবে ঐ টুকু ছাড়া আর কোন সমস্যা হয়নি। হুহু করে মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে আমরা নীলগিরি থেকে নেমে এলাম। রাস্তা মসৃণ, অপরূপা প্রকৃতি, তবে যাবার সময় নীলগিরির যে রূপ দেখেছিলাম,সেই সৌন্দর্যের কণা মাত্র এ পথে পেলাম না। প্লেনে নামার সাথে সাথেই সোয়েটার, চাদর খুলে ফেলতে হল, আকাশ ঝকঝক করছে, দেবু আর শৌভিক উল্লসিত হয়ে উঠল, এই রকম আবহাওয়ায় নাকি প্রচুর জন্তু দেখা যায়। দেবুর এক বন্ধু বারংবার বলেছে, মুদুমালাই এর ওপর দিয়ে যাবার সময় সে নাকি প্রচুর জীবজন্তু দেখেছে। দেবু আবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, “ড্রাইভার সাহেব টাইগার দিখেগা?” আমাদের তামিল ড্রাইভার মাথা নেড়ে বলল, “ লাক আচ্ছা হওনে সে জরুর দিখেগা সাব।” মুস্কিল হল, “লাক আচ্ছা”র সংজ্ঞা আমাদের এক এক জনের কাছে এক এক রকম। আমি শৌভিক আর দেবু যেমন মনে প্রানে চাইছিলাম, যেন অন্তত একটি বার বাঘের চন্দ্রবদন দেখতে পাই, তেমনি অন্বেষার ঐকান্তিক প্রার্থনা ছিল আমাদের ইচ্ছা যেন ব্যর্থ হয়।
(চলবে)
#Anirdiary #AninditasBlog
https://amianindita.blogspot.in

No comments:

Post a Comment