Saturday 12 November 2016

স্বপ্ন



স্বপ্ন দেখলাম, পালিয়ে বেড়াচ্ছি।  কার ভয়ে? ইংরেজদের নাকি মুঘলদের জানি না।  আমি একা নই।  রাজা নাকি বাদশাহ জানি না, লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সপরিবারে সাথে কেবল একদল বিশ্বস্ত সৈনিক আর স্বল্প সংখ্যক পরিচারক পরিচারিকার দল। রাজার মাথায় বিঁড়ের মত রাজ উষ্ণীষ ঠিক যেমন টিপু সুলতান পড়ত।রাজা ঠিক লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন না উনি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন সেই সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে ।  সারা দেশ যার কাছে মাথা নত করেছে এক তুচ্ছ রাজার সাধ্য কি তার সাথে লড়ে? পরিণতি অবোধগম্য নয়। রাজা হারছেন বারবার।  আপাততঃ নতুন বাহিনী  গড়ে তোলার মত রসদ রাজার নেই।  তাই কিছুটা মনখারাপ সকলের।  রাজার এক পুত্র। হতে পারে এইটি সদ্য সাবালক হয়েছে বাকি গুলি এখনও দুগ্ধপোষ্য। রণক্লান্ত সেপাহি এবং পালিয়ে বেড়ানো পরিজনদের মনে আনন্দ দেবার জন্য রাজা হঠাৎ  ঘোষণা করলেন পুত্রের বিবাহ দেবেন। পাত্রী কৈ? পাত্রী ঐ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতেই মওজুৎ আছে, নাম “তারা”।  তারা মূলতঃ রাণীমার ঘর এবং হেঁসেল সামলায়। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত চঞ্চলা কিশোরী। তারা মত সাধারণ কূলশীলের মেয়ের সাথে নিজ পুত্রের বিবাহ দিতে রাণীমার কিঞ্চিৎ  আপত্তি ছিল। তাছাড়া তারা বয়সেও একটু বড়। প্রায়ই রাণীমার অগোচরে ধমকধামক দেয় রাজপুত্রকে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া না করলে বা জিনিসপত্র অগোছালো  করে রাখলে। যদিও সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা বড়কুমারের জগৎই তো তারাময়। মহল ছেড়ে যেদিন পালাতে হয়েছিল কুমার সেদিন নিজের পাদুকা নিজে পড়তে জানত না।  চতুর্দিকে পালাও পালাও রব।  সব ছুটে পালাচ্ছে, রাজা এবং রাণী পর্যায়ক্রমে কোষাগার এবং শিশু কুমার কুমারীদের সামলাতে ব্যস্ত। বাকি বিশ্বস্ত দাসদাসীরা ঘোড়া হাতি তথা অন্যান্য গৃহস্থালি সামলাতে ব্যস্ত।  কেউ কেউ সুযোগ বুঝে কিছু হাতিয়ে পালাতে ব্যস্ত কিন্তু কেউ বড় কুমারের খোঁজ নিচ্ছে না।  বড়কুমার অস্থির হয়ে পায়ে পা ঘষে চলেছে পায়ের সামনেই হীরক খচিত পাকুদাদ্বয় ব্যগ্র ভাবে কুমারের প্রতিক্ষারত। কিন্তু আজন্মলালিত অভ্যাস কেউ স্বহস্তে  ঐ জুতা রাজকুমারকে না পরিয়ে দিলে সে পরে কেমনে। দূরে বিজয়ীশক্তির পদধ্বনি ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কুমার কি করে? এমন সময় দৌড়ে এল তারা, কোমরে হাত দিয়ে বলল, “যা ভেবেছি।  নিজের পাদুকা নিজে পরা অভ্যেস কর সোনা। ঝুঁকে হাত দিয়ে পায়ের কাছে টেনে নাও আর পা গলাও। দিন পাল্টাচ্ছে সোনা।  নিজেকে না বদলাতে পারলে পচে মরবে। ” চোখ বন্ধ করে তারার নির্দেশ পালন করেছিল কুমার।  এমন কিছু খারাপ লাগেনি তো। বংশের মাথানত হয়েছিল বলেও মনে হয়নি।
আর সেবার? সদ্য যুদ্ধে যাবে কুমার। জীবনের প্রথম যুদ্ধ তাও সেই সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে ।  যুদ্ধ বিদ্যার পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পালিয়ে আসতে হয়েছিল রাজ্যপাট ছেড়ে। শিবিরে নিয়মিত অস্ত্রবিদ্যার অনুশীলন তো হয় কিন্তু লড়াই করার মানসিকতাই যে নেই কুমারের। কুমার ভালবাসে চাঁদনী রাতে বাঁশি বাজাতে, ভালবাসে উদ্দেশ্যহীনভাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। কাঁচা সোনা রোদে মাঠে শুয়ে নীল  আকাশে সাদা মেঘের কারিকুরী দেখতে। ভালবাসে তারার বকুনি  খেতে। ভালবাসে ছোট ছোট ভাইবোনের সাথে অহেতুক  খুনসুটি করতে। যুদ্ধ, হত্যা,রক্তপাত সইতে পারে না কুমার। তারা বর্ম পরাচ্ছিল এক্ষুণি রাণীমা আসবেন বরণ করতে রক্ততিলক পরাতে। আচমকা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল কুমার। পারবে না, কুমার পারবে না লড়াই করতে।  স্নেহময়ী ধাত্রীর মত কুমারের অশ্রুসিক্ত গালে চকাস করে একটা চুমু খেল তারা। তারপর বলল,“ দেখে নাও কি ভাবে বর্ম বাঁধছি। যদি দেখ পরাস্ত হতে চলেছ, সোজা বর্ম খুলে উষ্ণীষ খুলে এক খাবলা মাটি মুখে হাতে ঘষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেও। মিশে যেও সাধারণ মানুষের ভিড়ে।” কুমার শিউরে উঠে বলল,“ তারা তুই আমায় রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে বলছিস? তাহলে তো সবাই আমায় কাপুরুষ বলবে?” তারা ফোৎ করে একটা বিদ্রুপাত্মক শ্বাস ছেড়ে বলল,“ বলুক গা।  ওরা ভারি বীর পুরুষরে। তোমার বাবার ওপর শত্রুপক্ষের  সাংঘাতিক রাগ। আসমুদ্রহিমাচলে একমাত্র আমাদের রাজামশাই ই ওদের বশ্যতাস্বীকার  করেনি। আমাদের রাজামশাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে গোটা দেশ মান্যিগণ্যি করে। তলায় তলায় বহুলোক প্রস্তুত হচ্ছে ওদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য। তোমাকে যদি ওরা একবার পায় কি হবে বুঝতে পারছ? চোখ গেলে দেবে, জিয়ন্ত গায়ের চামড়া খুলে নেবে, ফুটন্ত  তেল ঢেলে দেবে গায়ে। যদি দেখ না পালাতে পারছ ঐ তরোয়াল দিয়ে নিজের গলা নিজে কেটে ফেল তবু ঐ শকুন গুলোর হাতে ধরা পড় না। ”

তারাকে বিয়ে করতে একফোঁটাও আপত্তি ছিল না কুমারের। বিয়ের দিন লুকানো শিবিরে সীমিত  সামর্থ্যের  মধ্যে এলাহি ব্যবস্থা করলেন রাজাজী। বাইরের নিমন্ত্রিত বলতে শুধু দুজন। একজন বড় রাজামশাই, আমাদের রাজার দাদা। শত্রুপক্ষের প্রিয়পাত্র। ওণার রাজ্য শত্রুপক্ষই চালায়, উনি সুরা এবং নারীতে মত্ত। শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে মাত্র গোটা পনেরো দেহরক্ষী নিয়ে উনি কি করে এসেছেন জানি না। বিশাল মোটা ঘোড়ায় চাপলে বেচারা ঘোড়া না দেহরক্ষা করে। আর দ্বিতীয় নিমন্ত্রিতা হলেন রাণী পিসিমা।  রাজা মশাইয়ের একমাত্র ভগিনী । ওণার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে শত্রুপক্ষের রীতিমত দহরমমহরম চলে। রাজামশাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওনাদের পরিবার প্রতিবার শত্রুপক্ষের দল ভারী করে। উনি এসেছেন মাত্র চারজন সখী তথা দেহরক্ষীণীকে নিয়ে। এককথায় উনি অপরূপা।  দুধের সরের মত গাত্রবর্ণ । শাঁখের মত টানাটানা দুটি চোখ।  আধেক শুকনো গোলাপ পাপড়ির মত দুটি ঠোঁট। বিধবা তাই পরণে একটিও গহণা নেই।  শুধু দুধসাদা মখমলী শারারা আর মাথায় ওড়ণা যা উর্ধাঙ্গকে ও আবৃত করে রেখেছে।

বিবাহ শুরু হল। তারাকে স্বল্প অলংকারে সাজানো হয়েছে।  বেশ সাধারণ দর্শনা তারা, বিশেষত রাণী পিসি বা আমাদের রাণীমার কাছে। হোক তবু বিয়ের কনে হিসাবে ঝলমল করছে আমাদের তারা। বিয়ের রীতি অনুসারে বড় রাজা অর্থাৎ কুমারের জেঠামশাই একটা হীরকখচিত সোনার টিকুলি পরিয়ে দিলেন তারার মাথায়। বংশের জেষ্ঠ পুত্রবধুর প্রাপ্য ঐটি। জেঠা রাজার কোন ছেলে নেই। তারাই বড় বউ। রাণী পিসি এসে শিরচুম্বন করলেন।নিজের গলা থেকে সাতছড়া হীরের ঝাপটা খুলে পরিয়ে দিলেন তারার গলায়। ভারি হারে একটু কি কুঁজো হয়ে গেল তারা? বীণার মত মিষ্ট সুললিত  স্বরে রাণী পিসি বললেন,“ তোমরা বংশ পরম্পরায় আমাদের সেবা করে আসছ। আশা করব আমাদের কুলতিলকের কোন রকম অযত্ন হবে না। প্রাণ দিয়েও ওকে রক্ষা কর তারা। ”
শুরু হল উৎসব। যে যা পারল তারাকে উপহার দিল। বেশির ভাগই শুভকামনা জানালো। পালিয়ে বেড়ানো লোকজনের দেবার মত কি বা আছে? যেমন আমি। আমি রান্নাঘরে তারার সহযোগী । তারা বাটনা বাটে আমি শিল ধুই। তারা রান্না করে আমি উনুন নিকোই। আজ কেন জানি না প্রচণ্ড  কান্না পাচ্ছে, কান্নার দমক চাপতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছি। এবার আমার পালা নববধূকে উপহার বা শুভকামনা জানানোর। তারার কাছে গিয়ে আর চাপতে পারলাম না।  কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “ তুমি জানো তো? আমরা কেউ বাঁচব না।” তারা স্বভাবসিদ্ধ হেসে বলল,“জানি। তাই বলে বাঁচব না?”
#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

No comments:

Post a Comment