Sunday 1 January 2017

বীরভূম ডাইরি

বীরভূম ডাইরি ১০/১২/১৬
বীরভূমের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বেশ গভীর। না আমরা কেউই বীরভূমের বাসিন্দা নই, তবে আমার বড় জেঠু শ্বশুর এককালে সিউড়িতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আমার শ্বশুরমশাই এরও প্রবেশন এবং  ব্লক বীরভূমেই। বাবা মহম্মদবাজারের বিডিও ছিলেন, তারপর সিউড়িতেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বীরভূমে ওনারা প্রায় এগারো বছর ছিলেন, বীরভূম জেলা স্কুল থেকেই শৌভিকের ছাত্রজীবন শুরু। আমার দেওরের জন্মও বীরভূমেই। আবার শৌভিক যখন এই চাকরিতে যোগ দিল, ওরও প্রথম পোস্টিং হল সিউড়িসবথেকে মজার কথা হল, আমার দেওর যখন জানালো যে সে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তখন জানা গেল যে তার হবু স্ত্রী বীরভূমেরই ভুমিকন্যা।
যাইহোক টুকলু অর্থাৎ আমার পুঁচকে দেওরের বিবাহের পর ঊমা মানে আমার দেবরানীদের গ্রামে নববিবাহিত দম্পতির জন্য এক বিশাল ভোজের (কলকাতার ভাষায় রিশেপশন) আয়োজন করা হয়, তাতে নিমন্ত্রিত হিসাবেই আমাদের বীরভূম যাওয়া। সেই সময়ে প্রস্তাবটা দেন আমার শ্বশুরমশাই, “তোরা যখন বীরভূম যাচ্ছিসই তখন ছুটি নিয়ে ভালো করে ঘুরে আয়।” কথায় বলে না, ‘একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ’, শুনেই আমরা নাচতে লাগলাম। সিউড়িতে শৌভিকের ব্যাচমেট আছেন, শ্রী বিল্বদল রায়, ডিএনও এনরেগা (১০০ দিনের কাজ)। উনি প্রায়ই বলেন, “শুধু দিনক্ষণটা ঠিক করে আমায় পাঁচ দিন আগে জানাস, বাকি কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।” আমরাও ভাবলাম, এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়। ইতিপূর্বে বহু বন্ধু বান্ধব আমাদের এভাবে ডাকাডাকি করেছে বা বলা ভালো আজো করেই চলেছে যেমন- মেদিনীপুর থেকে সুকন্যা, মালদা থেকে দেবু, বনগাঁ থেকে অঞ্জন দা, পুরুলিয়া থেকে দেবময়দা তথা অতীতে বাঁকুড়া এবং বর্তমানে এগরা থেকে চিত্রদীপদা। কিন্তু আমরা এতটাই অপদার্থ যে কোন সুযোগেরই আমরা সদ্ব্যবহার করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এবারে আমরা কোমর বেঁধে নামলাম, নাঃ এবার আর এ সুযোগ হারাচ্ছি না।
যাব, মনস্থির করে দুরুদুরু বুকে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করেই, প্রথম ফোনটা করলাম, শ্রী শান্তনু সেনকে। শান্তনুদা বর্তমানে বর্ধমান সাউথের এএলসি। আমরা যুগলে শান্তনুদার বিশেষ স্নেহধন্য। শান্তনুদা বহুবার বলেছেন, “যদি কখনও বীরভূমে যাও, ট্যুর প্ল্যানিংটা আমাকে দিয়ে করিও।” প্রায় একসপ্তাহের জন্য যাব, যথাযথ প্ল্যানিং ছাড়া করবটা কি? শান্তনুদা অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রায় একুশ মিনিট ধরে প্ল্যান বাতলে দিলেন। সেই প্ল্যান প্লাস গুগলের ভরসায় সোমবার ৫.১২.১৬ ভোর বেলা আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।
প্রথম গন্তব্য ঊমাদের গ্রাম একূট। লাভপুরের কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রাম। আমরা এবং নবদম্পতি ছাড়াও, ননদ, পিসি-পিসেমশাই, খুড়শ্বশুর, খুড়শাশুড়িরা ছিলেন। মণি কাকা অর্থাৎ শ্রীঅরুণকান্তি ভট্টাচার্য ছিলেন বরকর্তা তথা আমাদের অভিভাবক। গোটা রাস্তা যে কি আনন্দ এবং হইহই করে কাটল তা ভাষায় অবর্ণনীয়। মাঝপথে শক্তিগড়ের কচুরি আর গুড়ের রসগোল্লা, আহা! ভাবলেই জিভে জল আসে। একূটে পৌছতে লাগল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। বহু বছর বাদে এরকম নিখাদ গ্রামে গেলাম গ্রামবাংলার রূপে মন ভরে গেল। মানুষজন এতো সাদাসিধা, শহুরে পালিশবিহীন, যে দুটি কথায় মন জয় করে নেয়। বিশেষত তুত্তুরীর তো আনন্দের সীমা ছিল না। জীবনে প্রথম মাটির বাড়ি, খড়ের গাদা, মোষের গাড়ি দেখল। মণি ঠাম্মার সাথে ছাগলছানার গায়ে হাত বোলানো, ছোট দাদুর সাথে খেয়ে উঠে পুকুরে হাত ধোয়া, মাছ ধরা দেখা আমার কন্যা তো একেবারে পুলকিত হয়ে গেল। ঊমাদের পরিবারের নিয়ম হল, কন্যা যখন শ্বশুরালয়ে যাবে সাথে মাছ, মিষ্টি এবং দই পাঠাতে হয়। ঊমার শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে বলেই বিশাল একটি কাতলা মাছকে বড় করা হচ্ছিল এতদিন ধরে। আজ তাকে জল থেকে তোলা হল। মাছের সাইজ দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম, এত বড় মাছ খাবে কে? আর কাটবেই বা কে? শেষে নিয়মরক্ষার স্বার্থে মাছটি ওনারা কেটেই দিলেন। সেই মাছ কাটা দেখে তুত্তুরীর আনন্দের আর সীমাপরিসীমা ছিল না। মুড়োর সাইজই এক কেজির বেশি হবে, এবং কাটার পর অন্তত আধঘণ্টা মুড়োটি শ্বাস নিচ্ছিল এই গল্প আমার কন্যা আজো করে চলেছে।
সন্ধ্যাবেলা সকলকে কাঁদিয়ে ঊমা চলল শ্বশুরবাড়ি। ঊমার বৃদ্ধা দিদিমা, অশ্রুসজল চক্ষে নিখাদ সরলতার সাথে করজোড়ে বললেন, “একটু দেখ বাবা। সেই দেড়দিন বয়স থেকে আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি।” এত বছর আমরা স্বাধীন, আজোও মেয়ের বাড়ির লোককেই এই সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে হয়। নবদম্পতিসহ শ্বশুর-শাশুড়িদের বাসে তুলে দিয়ে আমরা উঠে বসলাম ডিএনো সাহেবের পাঠানো গাড়িতে, তখন সন্ধ্যা নামছে। পরবর্তী গন্তব্য বোলপুর।

বীরভূম ডাইরি ১০/১২/১৬ (পর্ব ২)
৫ তারিখ রাতটা বোলপুরে কাটিয়ে, ৬ তারিখ সকালে পুরি-সব্জি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে ১০টার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। শান্তনুদা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, “গাইড নিয়ে ঘুরো।” শান্তিনিকেতন আমি ইতিপূর্বে একবারই গেছি, শৌভিক বোধহয় এগারো বছরে পঞ্চাশ বার গেছে, তবু আমরা শান্তনুদার কথার অবাধ্য হতে সাহস পেলাম না। শান্তনুদা বলেছিলেন, গাইড নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা লাগবে, আর মিউজিয়াম দেখতে আরো ঘণ্টা দেড় দুই। গাড়ি তৈরি ছিল, কালকের গাড়িটাই, ড্রাইভারের নাম গণেশ, সিউড়ির বাসিন্দা।
গাড়ি শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক বট গাছের কাছে গিয়ে থামতেই জনা দুই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ওনারাই গাইড। পাঁচশ টাকার বিনিময়ে গোটা শান্তিনিকেতন ভালো ভাবে ঘুড়িয়ে দেবেন। দরদস্তুর করে সাড়ে তিনশত টাকায় রফা হল। বেশ বুঝতে পারলাম, মঙ্গলবার বলেই সাড়ে তিনশ’য় রাজি হলেন। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ভ্রমণপিপাসু ত্রিসীমানায় নেই কিনা। গাইড বললেন, “বেলা একটা অবধি গাছের তলায় ক্লাশ চলে, তখন বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। চলুন আমরা গাড়ি করে অন্যান্য অঞ্চল গুলি ঘুরে আসি।” প্রথম দ্রষ্টব্য ‘প্রতীচী’ অমর্ত্য সেনের বাড়ি। বাইরের দরজা খোলাই ছিল। সারাইসুরাই এর কাজ চলছে। গাইড বললেন, “অমর্ত্য সেন এলে এখনও এখানেই থাকেন। বছরে এক থেকে দুই বার অবশ্যই আসেন এবং এলে সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ান। এখানে কাছেই “কালো”র চায়ের দোকানে ওনার ঠেক। কালো মারা গেছে, তবু উনি ওখানে যান এবং আড্ডা মারেন।” আমরা যুগলে সসম্ভ্রমে দেখছিলাম সবকিছু, তুত্তুরী শুধু বলল, “এই লোকটা এত বকছে কেন?”
শৌভিক কিছু ছবি তুলল, ও যেখানেই যায়, সবকিছুর ছবি তুলে আনে। ওর বাবা এবং মাকে দেখানোর জন্য। শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য বাবা-মা দীর্ঘ দিন কোথাও যেতে পারেন না, আমাদের তুলে আনা ছবিতেই ওনাদের ভ্রমণের স্বাদ মেটে। কিচ্ছু বাদ দেয় না শৌভিক। গাইড বোধহয় ভেবেছিলেন এরা শহুরে দম্পতি সাথে ছোট্ট বাচ্ছা কতটুকু আর দেখবে, তাই কিঞ্চিৎ করুণা ভরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখবেন নাকি?” আমাদের মাথা এসব ক্ষেত্রে কেবল একদিকেই হেলে। যেতে গিয়ে দেখা গেল, পথটা গাইড মশাইয়েরও ভালো জানা নেই। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম আনন্দধারায়। এককালে কণিকা বন্দোপাধ্যায় থাকতেন, এখন গোরা সর্বাধিকারি থাকেন। ফাঁকা নিঝুম লাল মাটির রাস্তার পাশে, ঘুমিয়ে পড়া এক অট্টালিকা। সত্যি এখানে একদিন ধ্বনিত হত, “নিরালায় তোর বনেরও মাঝে, সেথা কি এমন নূপুর বাজে? এমন মধুর গান” ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। অদূরেই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের তালাবন্ধ কুঠি।
পরের গন্তব্য ইস্টার্ন যোনাল কালচারাল সেন্টার। ডিএনও সাহেব পূর্বেই বলেছিলেন, ওটা যেন অবশ্যই দেখা হয়। বিশাল এলাকা সমান ভাগে ভাগ করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, আন্দামান আর নিকোবরের মাঝে। প্রতিটি খন্ডে আবার এক বা একাধিক মাটির কুটির রয়েছে, স্থানীয় আদিবাসী গৃহের ধাঁচে।জুতো খুলে ঢুকতে হয়। প্রতিটা কুটির ভর্তি রয়েছে, স্থানীয় হস্তশিল্প, আদিবাসী পোশাক, গয়না এবং যন্ত্রপাতিতে। ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের মাটির কুঁড়েঘর গুলি অপূর্ব চিত্রাঙ্কিত। তুত্তুরীর আনন্দ দেখে কে? জীবনে প্রথম টোকা, বেতের ঝুড়ি, কুনকে, আদিবাসী তীরধনুক, ছিপ তথা মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম, তাঁতযন্ত্র দেখল। সপ্তাহের শুরুতে বলে কি না জানি না, আমরা ছাড়া আর কোন দর্শকই ছিল না প্রায়। দূরে বিশাল ঝিল, তাতে লম্বা লম্বা গাছের ছায়া পড়েছে, তারই কিনারে বসে এক আনমনা বাউল আপন মনে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। শুনে মনে হল, এখানেই আসনপিঁড়ি পেতে বসে যাই, আর কোথাও যাবার প্রয়োজন কি?
এরপর কোপাই। ফাঁকা ধু ধু কোপাই এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে        , শ্মশানের পাশ দিয়ে। অদূরেই আমার কুটির। গাইড সাহেব বললেন, এই কোপাই দেখেই নাকি রবি ঠাকুর “আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে” লিখেছিলেন। সত্যি মিথ্যা জানি না। উনি আরও শোনালেন, যে সারা বছর নাকি কোপাই নদীতে জল থাকে। তীব্র দাবদাহে যখন বীরভূমের সব নদনদী খালবিল শুকিয়ে যায়, তখনও নাকি কোপাই বইতেই থাকে। বিহারে নাকি এই নদীই “শোন” নামে পরিচিত। যদিও গুগল এই ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করতে পারল না। বরং দেখলাম কোপাই আসলে ময়ূরাক্ষীর এক উপনদী মাত্র। শীতের মিঠে রোদে আঁকাবাকা  কোপাই অপরূপা, আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু সেই মুগ্ধতা আক্ষরিক অর্থে চটকে দিল দালের মেহেন্দি। কর্ণপটহ বিদারক স্বরে, “বোল তারা রা রা” গেয়ে উঠে। মাত্র জনা দুই নব্য যুবক, একটি বক্স আর চার বোতল মদ, কোপাই এর সৌন্দর্যে অ্যাসিড ক্ষত সৃষ্টির জন্য এই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের জাতের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত, “চার বোতল ভদকা”।
[চলবে]    
বীরভূম ডাইরি ১১.১২.২০১৬ (পর্ব-৩)
অতঃপর খোয়াই। খোয়াই মূলতঃ প্রসিদ্ধ শনিবারের হাটের জন্য। যাবার সময়ও আমি মৃদু ঘ্যানঘ্যান করছিলাম, আজ আর খোয়াই গিয়ে কি হবে? শনিবার অবধি তো আমরা এখানে থাকছি না। কিন্তু পৌঁছে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। খোয়াইয়ের আসল রূপ দেখতে হলে শনিবার ছাড়া অন্য যে কোন দিন যাওয়াই ভাল। ধুধু করছে ফাঁকা খোয়াই আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। এখানেও একজন উদাস বাউল আপন মনে গান গেয়ে চলেছে, ইজেডসিসির বাউলের মত অতটা সুরেলা গলা নয় যদিও তবু শুনলে মন ভরে যায়। গাইড বললেন,” যান ঘুরে আসুন, তবে বাচ্ছা সামলে, ধারে না যায়।” বরষার জল ভূমিক্ষয় করে যে এরকম অপরূপ সুন্দর দৃশ্যপট সৃষ্টি করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তার সাথে অপরূপ নিস্তব্ধতা রীতিমত মনকাড়া। সূর্য ইতিমধ্যে মধ্য গগনে, তীব্র গায়ে জ্বালা ধরানো রোদ, তার ওপর তুত্তুরীর কেবল ধারে যাবার প্রবণতা, মুগ্ধতা কাটিয়ে দেবার জন্য অবশ্য এগুলিই যথেষ্ট। গভীর খাদ, নীচে পড়লে, কোন রাস্তা দিয়ে যে তুলে আনব জানি না। তুত্তুরীকে যদিও বা ধমকধামক দিয়ে সামলানো যায়, শৌভিককে সামলাবে কে? ছবি তোলার এমন নেশা, যে রীতিমত আতঙ্কিত বোধ করছিলাম, যে ছবি তুলতে গিয়ে খাদে না নেমে পড়ে।
এরপরের গন্তব্য, বিশ্বভারতী। সেই শদুয়েক বছরের পুরাতন বট গাছ থেকে শুরু করে, পর্যায়ক্রমে দেহলী, নতুনবাড়ি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি, শান্তিনিকেতন কুঠি, সুরুল কুঠি, মহুয়া কুঠি,পূর্ব তোরণ, পশ্চিম তোরণ, ছাতিমতলা, কালো বাড়ি। শান্তিনিকেতন তো শুধু চর্ম চক্ষে দেখার নয়, বরং অনুভবের বস্তু। আমরা যুগলে মন্ত্র মুগ্ধের মত দেখছিলাম এবং শুনছিলাম, কত বছর হয়ে গেল তিনি নেই, অথচ কি ভীষণ ভাবে বিরাজমান। কায়াহীন দাড়িবুড়োর উপস্থিতি অনুভব করে বুঁদ হয়ে ছিলাম আমরা। তিনি নেই, অথচ তার সেই আসনটি যেখানে বসে একদা তিনি ক্লাস নিতেন আজো রয়েছে, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। শৌভিকের অনুমতি নিয়ে ওনার আসনের উল্টোদিকে বসলাম, যেখানে ছাত্ররা বসে। উনি শিক্ষক আমি ছাত্রী কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হলাম, আমার কন্যাকেও বললাম, “বাবু বসো। দেখ ঐ আসনে এককালে রবি ঠাকুর বসতেন।” তুত্তুরী কান্না চেপে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “ আমি আর যাব না। শান্তিনিকেতন বিচ্ছিরি জায়গা। আমি আর হাঁটতে পারছি না। আর ঐ লোকটা এত বকছেই বা কেন?” বেচারা, সেই সকাল থেকে ঘুরছে, এবং এরকম এক লাল মেঠো পথে বাবা মা কেন যে উন্মত্তের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে, তা অনুধাবনের বয়স সত্যি ওর হয়নি। তার ওপর একটু আগে আম্রকুঞ্জে একটি টিয়া পাখি দেখতে পেয়েছিল, যেই তাকে ধরতে গেছে সে ওমনি ফুর করে উড়ে গেছে। তার পিছন পিছন ধাওয়া করার প্রবল বাসনাও চরিতার্থ হয়নি আমাদের উৎপাতে। কাজেই মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।
ফোঁপানি ক্রমেই কান্নায় রূপ নিচ্ছিল, এদিকে ঘড়ির কাঁটাও দেড়টার ঘর ছাড়িয়েছে, ফলে ভগ্ন হৃদয়ে আমরা বিশ্বভারতীকে বিদায় জানাতে উদ্যত হলাম। তবে কলের বাঁশি না দেখে কি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করা যায়? রামকিঙ্কর বেজের একাধিক অমর সৃষ্টি বিশ্বভারতী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। যার কিছু আপাতত সংস্কারের জন্য পর্দাবৃত, যেমন গৌতম বুদ্ধ এবং সুজাতা।  মহাত্মা গান্ধী,কলের বাঁশি আর সাঁওতাল পরিবার  এখনও সংস্কার হয়নি, তবে কেন জানি না দেখে মনে হল আশু সংস্কার জরুরী। সাত বছর পর দেখলাম কেমন যেন বিবর্ণ, ভঙ্গুর লাগল সবকিছু। মহাত্মা গান্ধীর পদতলের করোটির গায়ে যেন শ্যাওলা পড়েছে মনে হল। ২০০৯ এ যিনি আমাদের গাইড ছিলেন, উনি বলেছিলেন, মহাত্মা জী কোপাই নদীর তীরে পরিভ্রমণে গিয়ে না দেখে কোন করোটির ওপর পা দিয়ে ফেলেছিলেন, কাছেই শ্মশান কি না। কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল শুনে। এবারের গাইড বললেন, “নোয়াখালীর দাঙ্গার পর, মহাত্মা জী যখন সেখানে যান, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ পড়েছিল। এখানে নোয়াখালীর সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার স্মৃতিকেই স্মরণ করা হয়েছে।” কে জানে? কোনটা সত্যি, কোনটা নয়। তবে দেশের জনকের চরণতলে নরকরোটি দেখলে কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে।
বিশ্বভারতী ত্যাগ করার পর দ্বিপ্রাহরিক আহারের পালা। বিগতবার শান্তিনিকেতন ভ্রমণকালে এই মধ্যাহ্ন ভোজ নিয়ে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার আমরা টুরিস্ট লজেই ছিলাম, টুরিস্ট লজের খাবার যেমন বিস্বাদ, তেমনি দুর্মূল্য। ভ্রমণের অন্তিম দিনে আমরা ঠিক করেছিলাম আজ আর টুরিস্ট লজে খাব না, বাইরে কোথাও খাব। সেই মোতাবেক একটি ভালো হোটেল দেখে সেখানেই মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয়। রান্না এমন কিছু আহামরি ছিল না বটে, তবে আমার বন্ধু সঞ্চিতা তার ভাতের মধ্যে একটি মাছের আঁশ খুঁজে পায়। তার পর সব খাবারেই আমাদের ভয়ানক আঁশটে গন্ধ লাগতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাড়ি ফেরার পথে, গোটা রাস্তা সঞ্চিতার গা গুলাতে থাকে, আর আমার বাবা তো রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বমি করতে বাধ্য হয়। ফলে বোলপুরে খাওয়া নিয়ে আমি বেশ আতঙ্কিত ছিলাম। শৌভিক যদিও বারবার আশ্বস্ত করছিল, “ ওরে ২০০৮ এর পঞ্চায়েত ইলেকশনে আমার বোলপুরে ব্লক অ্যাটাচমেন্ট ছিল। বেশ কিছুদিন ছিলাম। এত খারাপ ও নয়।” তারওপর ডিএনও সাহেব ও ফোন করে বলেদিয়েছিলেন, বোলপুর সার্কিট হাউসের কাছেই একটি ভালো রেস্তোরাঁ আছে, নাম “ঘরে বাইরে” ওখানেই ভোজনপর্ব সারতে। মন্দ নয় রেস্তরাঁটা। বাটিকের পাঞ্জাবি পরা ওয়েটর এসে অর্ডার নিয়ে গেল, সিরামিকের থালা, বাটি, ভাঁড়ের মত দেখতে গ্লাসে জল। খাবারও যথাযথ, বরং পূর্বের অভিজ্ঞতার তুলনায় অভাবনীয়। ড্রাইভার গণেশ বাবুও বললেন, “সরকারী প্রোগ্রাম হলে এখানেই খাওয়া দাওয়া হয় ম্যাডাম।”
লাঞ্চের পর কি করব? এটা আমাদের প্ল্যানে ছিল না। সন্ধ্যার মধ্যে সিউড়ি ফিরতে হবে, সিউড়ি সার্কিট হাউসে রাত্রিবাস। ঘড়িতে সবে তিনটে বাজছে। কি করা যায়? শৌভিক বলল, “কেদুলি যাবি? গণেশ কেদুলি যেতে কতক্ষণ লাগবে?” গণেশ মাথা চুলকে বলল, “স্যার যেতেই পারেন, কিন্তু এখন তো মেলার সময় নয়। জয়দেব পদ্মাবতীর একটা মন্দির ছাড়া ওখানে কিছুই দেখার নেই।” শৌভিক হাল ছেড়ে বলল, “তাহলে তুমিই বল। কোথায় যাওয়া যায়?” “আমখই যাবেন স্যার?” আমখই কি? কোথাও তো শুনিনি এর নাম। গণেশ বলল, “ওখানে কি যেন পাওয়া গেছে স্যার। ডিএম এডিএম সাহেব মাঝে বেশ কয়েক বার গেছেন। ইলামবাজারের জঙ্গলের মধ্যে একটা আদিবাসী গ্রাম।” জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী গ্রাম? আহাঃ। আর কি চাই? “চল” আমরা একসাথেই বলে উঠলাম প্রায়।
বীরভূম ডাইরি ১২.১২.২০১৬ (পর্ব-৪)
আমখই যাবার পথটা ভীষণ সুন্দর। গহীন শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা, খুব চওড়া নয়, যদিও তবু আমাদের গাড়ি বেশ অনায়াসেই  পাকা রাস্তা থেকে ঐ পথে নেমে পড়ল। চারপাশ নিঝুম, অপরাহ্ণের হলুদ সূর্যের আলোয় রহস্যময় প্রকৃতি। বেশ খানিকটা শুনশান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার পর আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আচ্ছা, এই জঙ্গলে কোন জানোয়ার নেই?” শৌভিক হাসি চেপে বলল, “ জানোয়ার মানে? বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার নেই। বেঁজি শেয়াল এই সব থাকতে পারে।” গণেশ বাবু ও ইতস্তত করে বললেন, “আদিবাসী গ্রাম কাছেই, এখানে কোন বড় জন্তু নেই ম্যাডাম।”  সত্যি একটু পরেই দেখলাম, একজন সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন আমাদের পাশ কাটিয়ে।
মিনিট পাঁচ সাত পরে গাড়ি গিয়ে থামল, একটা ফাঁকা জায়গায়। নেমে বেশ হতাশ হলাম, কিছুই তো নেই। কোন ভাঙা মন্দির টন্দির বা মাটি খুঁড়ে পাওয়া কোন মূর্তি, বাসনকোসন বা কোন কিছু। কারণ গোটা পথ শৌভিক গণেশ বাবুকে আমখই নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছে, আর প্রতিবারই গণেশ বাবু টাক চুলকে বলেছেন, মাটির তলা থেকে কি সব নাকি পাওয়া গেছে। পশ্চিমমেদিনীপুরের মোগলমারির মত কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাব আশা করেছিলাম। সে গুড়ে বালি। জায়গাটা খুব সুন্দর, শান্ত, বড় বড় বট, অশ্বত্থ আর কাঁটাল গাছ দিয়ে ঘেরা (ঐ কটি গাছই চিনি কি না)। কাছেই একটা সদ্য খনন করা পুকুর, যার জল এখনও ঘোলা। কয়েকটা ছাগল চরছে দেখে আমার মেয়ের তো আর আনন্দ ধরে না। কি যে কাকিমাদের গ্রাম থেকে ছাগল প্রীতি নিয়ে ফিরেছে। জনা পাঁচেক লোক কাজ করছে, কালো ছোট নুড়ি দিয়ে মার্কা করা আছে, এঁকে বেঁকে রাস্তা তৈরি হবে। বেশ কয়েকটা সিমেন্টের বাঁধানো বেদীর ওপর গাছের গুড়ির টুকরো রাখা আছে। গণেশ বাবু ইশারায় দেখালেন, “স্যার ঐ খানে লিখা আছে।” সত্যি দুটি বড় বড় বোর্ডে বাংলা এবং ইংলিশে লেখা আছে। বাংলাটাই পড়লাম, পড়ে যা বুঝলাম, এখান থেকে পাললিক জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, যার আনুমানিক বয়স দেড় কোটি বছর। দেড় কোটি বছর আগেকার গাছের গুঁড়ি বন্যার জলে ভেসে এসেছিল তৎকালীন রাজমহল পাহাড় থেকে, এবং দীর্ঘদিন মাটির নীচে থেকে তা ফসিলে পরিণত হয়েছে। যার টেকনিক্যাল নাম হল, “পেট্রিফায়েড উড”।
মোটা মাথায় ভালো ঢুকল না, ভাবলাম, যেমন পাথরে জীবাশ্ম পাওয়া যায়, তেমনি হয়তো কাঠে পাওয়া গেছে। যতদূর পারা যায়, মনোযোগের সাথে দেখার চেষ্টা করলাম, কোথাও আরকেওপ্টেরিক্স মার্কা কিছু আছে কি না। নিদেন পক্ষে মাছি, মশা কিছুতো থাকবে। কিছুই খুঁজে পেলাম না, শুধু মাকড়সার জাল ছাড়া, যার বয়স দেড় দিন হতে পারে, কোটি টটি নয়। খুঁজতে গেলে মনঃসংযোগ করতে হবে, আর মন বসাব কি করে? আমার কন্যা ততোক্ষণে ছাগল ছেড়ে, প্রায় ওর সাইজের এক বিশাল মোটকা মুরগীর পিছে ছুটতে লেগেছে। মুর্গীটা প্রবল চিৎকার করে দৌড়চ্ছে, পিছে পিছে আমার মেয়েও। আমি ধরতে না ধরতেই দুবার আছাড় খেল। শখ করে শান্তিনিকেতন ঘুরব বলে শাড়ি পড়েছিলাম, তাও সাদা। মেয়েকে সামলাতে গিয়ে দুজনেই লালচে হয়ে গেলাম।
মেয়েকে ধমকাতে ধমকাতে তকিয়ে দেখি শৌভিক গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছে। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু পেলি? জীবাশ্ম টিবাশ্ম?” শৌভিক অবাক হয়ে বলল, “হু। এগুলোই তো! ফসিলাইজড উড। দেখতে কাঠ, কিন্তু আসলে পাথর।” এতক্ষণে জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হল। সত্যি তো । হাত দিয়ে দেখলাম, সব কাঠের টুকরো গুলি আসলে পাথর। কি অপরূপ দেখতে।
আমখই থেকে পরিতৃপ্ত হয়ে যখন আমরা আবার পাকা রাস্তায় উঠলাম, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে, রোদের রঙ কমলা মেশানো সোনালী। গণেশের প্রস্তাবমত পরবর্তী গন্তব্য হেতুমপুরের রাজবাড়ি। আমরা এটা কাল যাব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু গণেশ বাবু বললেন, আজই সেরে ফেলা যাবে। আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির কে যেন হেতুমপুরের মহারাণী ছিলেন। ছোটবেলায় এই কথাটা শুনলেই আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন খুব হাসতাম। হেতুমপুর? হেতুমপুরের মহারাণী J J Jবড় হয়ে যখন জানতে পারলাম, সত্যি এরকম এক রাজা এবং তাঁর রাজত্ব ছিল, তখন নিজেদের নির্বুদ্ধিতা তথা বালখিল্যপনায় অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলাম। সন্দীপ রায়, তাঁর ফেলুদা সিরিজের “ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা” এখানেই স্যুট করেছিলেন।  টিভিতে হেতুমপুরের রাজবাড়ী দেখে সম্পূর্ণ মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গণেশ বাবুর ভাবভঙ্গীতে মনে হল, খুব একটা দর্শনার্থীদের ভিড় হয় না। অত পোক্ত ড্রাইভারও জানেন না, রাজবাড়ি কোনটা। জোড়া হাতিখচিত একটা তোরণদ্বারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, “স্যার এটাই রাজবাড়ির গেট।” ভালো কথা। রাজ বাড়ি কই? গেটের ভিতর অনেকগুলি হলুদ রঙের একতলা দুতলা বাড়ি। এককালে রাজবাড়ির অংশ হলেও এখন ওখানে স্কুল বসে। আরও খানিকটা এগিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে একটা বড় বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালেন, এখন ঐটি কলেজ। এককালে রাজবাড়ির অংশ ছিল হয়তো, কিন্তু এটা কিছুতেই রাজবাড়ি নয়। আমার চোখে ভাসছে ঘুরঘটিয়ার ঘটনা। এটা সে বাড়ি নয়। শৌভিক হতোদ্যম হয়ে বলল, “চল হয়ে গেছে। এখনও সময় আছে। মামা-ভাগ্নে পাহাড়টা ঘুরে আসা যাবে।” আমি কিছুতেই যাব না।
বীরভূম ডাইরি (পর্ব- ৫) ১৪/১২/১৬
হেতুমপুরের রাজবাড়ি না দেখে যাবই না, আমার এই নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে, ড্রাইভার গণেশ বাবু আসেপাশের আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে অবশেষে একটা লাল দরজার সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন। অনেকটা চার্চের মত দেখতে বেশ বড় লাল দরজা, মাথার ওপর কোন এককালে একটা ঘড়ি ঘর ছিল, আজ শুধু তার কঙ্কালটুকুই অবশিষ্ট আছে। আধভাঙ্গা বিশাল মরচে ধরা বিবর্ণ গ্রীলের গেট, কব্জা থেকে ঝুলে পড়েছে। দরজার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বহুদূরে বিস্তীর্ণ মোরামের মাঠের (এককালে হয়তো বাগান ছিল) ওপারে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে, এই তো সেই বাড়িটা। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। এই তো এই বাড়িটার সামনেই জীপ (খুব সম্ভবত) থেকে লাফিয়ে নেমেছিলেন ফেলুদা আর তপসে। এখানেই একটা টিয়া পাখি ছিল, যে কারণে অকারণে খালি বলত, “ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন, একটু জিরো”
বিশাল অট্টালিকা। সমান দুই খণ্ডে বিভক্ত। সে বিভাজন শরীকি কি না, জানি না। একাংশে কলেজ, সেই অংশটি সযত্নে রক্ষিত। দেওয়ালে জানলায় দরজায় চকচকে নতুন রঙ। তবে ঐ অংশের সামনের মাঠটির অবস্থা চোখে দেখা যায় না। গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ, এত গাড়ি পড়ুয়াদের বলে মনে হয় না। দুই অংশের বিভাজন এককালে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে তারের জাল দিয়ে করা ছিল, যা বর্তমানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন। জাল বরাবর বেশ কিছু গাছও বসানো ছিল, যার অনেকগুলিই আজ মহীরুহে পরিণত।
যে অংশে আমরা প্রবেশ করলাম, সেটি জনহীন। সামনের মাঠের কিছুটা অংশ ঘিরে একটা নির্মীয়মাণ চিল্ড্রেন্স পার্ক। এই ভাবগম্ভীর পরিবেশ যা সাংঘাতিক বেমানান। তবু এই ভেবে শান্তি পেলাম, যে তুত্তুরীর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে সাময়িক ভাবে মুক্তি পাব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা দোলনাও এখনও টাঙানো হয়নি এবং স্লিপ গুলির অবস্থাও অকহতব্য। সমস্ত কিছুই ধুলোর চাদরে আচ্ছন্ন।
রাজবাড়ির রূপ এবং গাম্ভীর্য ভাষায় প্রকাশে আমি অপারগ। অপার মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসার সময় শুধু দুঃখ হচ্ছিল, যে আমাদের রাজ্যে এত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা রয়েছে, এগুলিকে হেরিটেজ হোটেল বানিয়ে প্রমোট করতে পারলে কি ভালোই না হত। দিনের শেষ দ্রষ্টব্য, দুবরাজপুরের মামা-ভাগ্নে পাহাড়। শ্বশুর মশাই নিষেধ করেছিলেন যদিও তবুও ড্রাইভার গণেশ বাবুর উৎসাহেই যাওয়া। গিয়ে মনে হল, না গেলেই ভাল হত, বুঝি। মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের যে রূপ অভিযান সিনেমায় দেখেছিলাম, আদপে তার সিকি ভাগও সুন্দর নয় জায়গাটা। বেশ কিছ ক্ষয়প্রাপ্ত গোল গোল পাথর, যেমন নোংরা, তেমনি জনাকীর্ণ। প্রতিটি পাথরের গায়ে, প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের নাম খোদাই করে গেছে। সামনেই দুটি মন্দির, একটি সংকটমোচন হনুমানজীর অপরটি পাহাড়েশ্বর শিবের। মন্দিরগুলির নাকি এ বছরেই দ্বারোদঘাটন হয়েছে, এবং ফলতঃ মোদোমাতালের উৎপাত নাকি একটু কমেছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই আমরা রওনা দিলাম, সিউড়ির উদ্দেশ্যে। সিউড়ি সার্কিট হাউসেই রাত্রিবাস। গাড়িতে ওটার আগেই ডিএনও সাহেবের ফোন, অভিভাবকের মত জানালেন যে সার্কিট হাউসে সব বন্দোবস্ত করা আছে, প্রশ্ন করলেন রাতে আমরা কি খেতে চাই, সেই মত ব্যবস্থা হয়ে যাবে এবং পরিশেষে জানালেন, যে অফিস থেকে নিস্তার পেলেই উনি আসছেন, সার্কিট হাউসের লাউঞ্জে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে। আমরা দুজনেই অনুরোধ করলাম যদি উনি একা না এসে সপরিবারে আসেন, তাহলে একজন বন্ধু পেয়ে তুত্তুরীর ঘ্যানঘ্যানানি যদি কমে। ডিএনও সাহেবের গিন্নী অর্থাৎ প্রিয়াঙ্কার সাথে বেশ কয়েকবছর আগে সুন্দরবন ভ্রমণকালে দেখা হয়েছিল এবং বেশ ভাব জমে গিয়েছিল। তুত্তুরীর সাথে ওনার কন্যা “কেটলু” ওরফে “প্রিয়দর্শিনীর”ও জব্বর দোস্তি জমে গিয়েছিল। জানতাম প্রিয়াঙ্কা অবশ্যই আসবে, এবং প্রিয়াঙ্কা ও কেটলু আমাদের আশাহত করেনি। সেদিন সিউড়িতে গানের বড় অনুষ্ঠান ছিল, একাধিক নামী  শিল্পীর আসার কথা, কিন্তু আমাদের সাথে আড্ডা মারার জন্য কেটলু এবং তার জননী সেই অনুষ্ঠান মাঝ পথে ত্যাগ করেই এসে হাজির। প্রাণ খুলে আড্ডা হল প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত, রাত দশটায় আমাদের নৈশাহার সাজিয়ে দেওয়া হল টেবিল, ডিএনও সাহেব স্বয়ং তদারকি করলেন। বেচারা কেয়ারটেকার(?) একচোট বকুনিও খেল রাতে বাঁধাকপির তরকারী রান্নার জন্য, যদিও তা খেতে বেশ ভালোই লাগল। অবশেষে আমাদের খেতে বসিয়ে তদারকি করে কেটলু এবং তার পিতামাতা বিদায় নিল। আমরাও তৃপ্ত উদর তথা ততোধিক পরিতৃপ্ত হৃদয়ে গেলাম শুতে। কাল সকালে ম্যাসাঞ্জোর। নাকি বিকালে? সেটা কাল সকালেই ভাবব, সারাদিনের ক্লান্তিতে আপাতত চিন্তা এবং চেতনা আচ্ছন্ন।  
বীরভূম ডাইরি ১৫/১২/১৬ (পর্ব- ৬)
বীরভূমে সেই অর্থে আজ আমাদের তৃতীয় দিন। আজ বুধবার, ৬/১২/১৬। আজকের গন্তব্য মাসাঞ্জোর। ডিএনও সাহেব এবং ওনার গিন্নী উভয়েই জানিয়েছিলেন, যে মাসাঞ্জোর যদি যেতেই হয়, তাহলে বিকাল বেলা যাওয়াই ভালো। ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর একটা বাঁধের নাম মাসাঞ্জোরমাসাঞ্জোরে সূর্যাস্ত নাকি অত্যন্ত মনোরম। কিন্তু ড্রাইভার গণেশ বাবু এবং আমার শ্বশুরমশাই এর মতে মাসাঞ্জোরে সকাল বেলায় যাওয়াই ভালো। বাবা বললেন, “মাসাঞ্জোরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। চেতাকে (অর্থাৎ তুত্তুরীকে) নিয়ে গেলে, গোটা অঞ্চল তথা আসেপাশের পাহাড়গুলি ঘুরে দেখার আগেই অন্ধকার নেমে যাবে।” যুক্তি অকাট্য, কাজেই আমরা সকাল সকাল লুচি তরকারী দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম মাসাঞ্জোরের উদ্দেশ্যে। সার্কিট হাউসের লুচির একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, বহু বছর পর, আটার গুঁড়ি দিয়ে বেলা লুচি খেলাম। তেলে কড়করে করে ভাজা লুচির গায়ে গুড়িগুড়ি ভাজা আটা বা ময়দা, আহাঃ।
 যারা মাইথন গেছেন, তাদের মাসাঞ্জোরকে একনজর দেখলেই মনে হবে মাইথনের ছোট ভাই। তবে দুই পাড় ঐ রকম পাথরের বোল্ডার দিয়ে বাঁধানো নয় (যতটুকু মনে আছে)। বাঁধের ওপর চওড়া ব্রীজ। ব্রীজের ওপর দিয়ে গাড়ি যায় না। পায়ে হেঁটে ব্রীজ পেরোতে হয়। ব্রীজের ওপর দাঁড়ালে একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, ওপরদিকে শুকনো খাত। সব কটা লকগেট বন্ধ কি না। ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে গেলে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হল, রাশি রাশি টিয়া পাখি। ঘন সবুজ ডানা মেলে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়ে যাচ্ছে।  কখনও কখনও ব্রিজের রেলিং এর ওপর ও এসে বসছে। তুত্তুরী যেই ধরতে গেল ওমনি ফুরররর।
যত জনসমাগম সবই এই পাড়ে, ওপারে তেমন কিছুই নেই। গোটা দুয়েক চায়ের দোকান, যাদের বয়ামে রাখা লেড়ো বিস্কুট গুলিকে দেখেই বিক্রি বাটা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। আর আছে এক ফটোগ্রাফার (ক্যামেরা দেখলাম না যদিও), যিনি নকল ফুলের নানা ফ্রেম সাজাচ্ছিলেন, যা দেখেই বোঝা যায়, যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের সেলফি তোলার জন্য। হেঁটে ব্রীজ পেরোতে গিয়ে প্রচণ্ড রোদে প্রায় ঝলসে গিয়েছিলাম আমরা, ওপারে ক্ষয় প্রাপ্ত পাহাড়ের ঢালে গিয়ে বেশ আরাম লাগল। উচ্চাবচ সরু পিচ ঢালা রাস্তা, দুপাশে লাল মোরাম উকি মারছে। একটু হাটার পর দেখি একদল ছেলে মেয়ে একটা টিলার ওপর থেকে নামল। শৌভিক ছবি তোলা থামিয়ে ওদের জিজ্ঞাসা করল, “এই ওপরে কি আছে গো?” ওরা জানালো তেমন কিছুই নেই। শুধু জঙ্গল। ওরা দৃষ্টির অগোচর হতেই শৌভিক বলল, “যাবি?” পরেছি তো লং স্কার্ট এবং চপ্পল, এই পরে আর যাই হোক পাহাড়ে চড়া যায় না। তবু সাহস করে রাজি হয়েই গেলাম। বেশ চড়াই, ধরারও কিছু নেই। অনেকটা উঁচুতে ওঠার পর দেখলাম আর পায়ে চলা পথ নেই, এবার ঘন জঙ্গল। ওপর থেকেও দৃশ্য এমন কিছু আহামরি নয়, তবুও চড়তে পেরে বেশ আনন্দ হচ্ছিল, এই চেহারায়, এই ঝলঝলে জামা কাপড় এবং শৌখিন চটি পরেও যখন পাহাড়ে চড়তে পারলাম, আর কে আমায় ট্রেকিং করা থেকে আটকাচ্ছে। আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু তথা ব্যাচমেট শ্রীমান দেবু কর, মাঝেমাঝেই ওসকায়, “চল অনি, ট্রেকিং করে আসি।” মন তো চায়, কিন্তু যতবার প্রসঙ্গটা ওঠে, তুত্তুরী সাফ জানায়, “বাবা যাক। তুমি যাবে না।”
চড়া তো হল, এবার নামার পালা। নামতে গিয়ে দেখলাম, নামাটা বেশ কঠিন। শৌভিক এবং তুত্তুরীর বাঁধা জুতো,ওরা টরটর করে বেশ খানিকটা নেমে গেল। আমি গেলাম আটকে, কিচ্ছু ধরার নেই, নামতে গেলেই ভয় হচ্ছে গড়িয়ে যাব এবং গড়াতে গড়াতে সোজা খাদে। জানতাম আওয়াজ দেবে, তবু প্রাণ বাঁচাতে শৌভিকেই ডাকলাম, “একটু হাতটা ধরবি। জাস্ট একটা স্টেপ।” শৌভিক গজগজ করতে করতে হাতটা তো বাড়িয়ে দিল, মুখে শুধু বলল, “তুই করবি ট্রেক? দেখছিস তো ব্যাপারটা যত রোম্যান্টিক মনে হয়, আদপে অতটা নয়।”
নীচে নেমে আমরা আরো খানিকটা হাঁটাহাঁটি করলাম, ফাঁকা ঢেউ খেলানো রাস্তা দিগন্ত রেখা অবধি বিস্তৃত। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পর্যটক নেই। সত্যি ঝাড়খণ্ড অপরূপা।
আবার রোদে পুড়তে পুড়তে ব্রিজ পেড়িয়ে গাড়িতে ওঠা। গণেশ বাবু বললেন, “জলের কাছে যাবেন স্যার?” সদ্য তৈরি ইউথ হোস্টেলের পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা সটান নেমে গেছে জলের কাছে। চোখ ধাধিয়ে গেল, মাসাঞ্জোরের সৌন্দর্যে, যতদূর চোখ যায় জল আর জল, দুদিকে দুটি ব্রীজ অনেকটা এগিয়ে গেছে জলের মধ্যে, ব্রীজের শেষে সাবেকি লাইট হাউসের মত দেখতে দুটি কুঠি,তবে অত উচু নয়। একনজরে মনে হবে, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডে এসে গেছি। প্রচুর ছবি তুলে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে রওনা দিলাম সিউড়ি সার্কিট হাউসের দিকে। সূর্য তখন মধ্য গগনে, এবার লাঞ্চের পালা, লাঞ্চ সেরে বিকালে যাব রাজনগরের মসজিদ আর ভাঙা রাজবাড়ি দেখতে।
বীরভূম ডাইরি ১৬/১২/১৬ (পর্ব- ৬)
মাসাঞ্জোর থেকে সিউড়ি ফিরে, বেশ একটা জম্পেশ লাঞ্চ আর আধ ঘণ্টার একটা ছোট্ট দিবানিদ্রা দিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ আমরা রওনা দিলাম, রাজনগরের উদ্দেশ্যে। ইন্টারনেট ঘেঁটে রাজনগরকে খুঁজে বার করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার। সপ্তাহব্যাপী বীরভূম ট্যুরে কি কি দেখা যেতে পারে, তাই নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি রাজনগরে এক বহু পুরানো মসজিদ আছে। তার ভাঙা প্রবেশদ্বারের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বীরভূমে পৌঁছে দেখলাম, স্থানীয় বাসিন্দারা কেউই রাজনগরের মসজিদের খবর জানে না। তবে আমার এক খুড় শ্বশুর জানালেন, যে রাজনগরে নাকি বিশালাকৃতি রসগোল্লা তৈরি হয়, ঠিক যেমন গুপি-বাঘা খেত।
গণেশ বাবু আমাদের নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন, এক বিশাল মাঠের মাঝে, মাঠের এক পাশে বিশাল জলাশয় এবং সেই জলাশয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, সদ্য চুনকাম করা এক ইমামবাড়া। হুগলী ইমামবাড়ার কাছে, তা নেহাত দুগ্ধপোষ্য শিশু। সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। আমরা যখন উঠছি, একদল বাচ্ছা মাঠে ফুটবল খেলছিল, চেঁচিয়ে বলল, “জুতো খুলে।” আমরা সসম্ভ্রমে জুতো সিঁড়ির ওপর রেখে ঢুকলাম। খোলা ছাদ, অত্যন্ত নোংরা, নুড়ি পাথর, প্লাস্টিকের প্যাকেট পড়ে রয়েছে। বেশ অদ্ভুত ইমামবাড়াটা। দুই দিকে প্রাচীর, প্রাচীর গাত্রে মুখমুখি বড় বড় তিন জোড়া খিলান, কিন্তু দুই প্রাচীরের মাঝে কোন ছাত বা মেঝে নেই। একদম ফাঁকা। কোনকালে কোন স্থাপত্য থাকলেও আজ তার ভগ্নাবশেষটুকুই অবশিষ্ট রয়ে গেছে এবং তা বেশ রহস্যময়।  

ইমামবাড়াটা খুবই সুন্দর, বিশেষত বিশাল ঝিলের ধারে, ঝিলের নাম বড় কালিদহ। কিন্তু যে মসজিদের টানে আমরা ছুটে এসেছি, সেটা কই? ইমামবাড়ার সামনের বিশাল মাঠে নাকি বাজার বসে। অসম্ভব ধুলো। ঐ মাঠের এক কোনে একটা ভাঙা গেট আছে বটে, কিন্তু তার সাথে ইন্টারনেটে দেখা মসজিদের গেটের সাদৃশ্য থাকলেও তা অত্যন্ত সাধারণ। চূড়ান্ত হতাশ হয়ে আমরা ঐ ধুলোয় ভরা মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যখন চক্কর কাটছি, গণেশ বাবু বললেন, স্যার ঐ বড় কালিদহের মাঝে রাজাদের হাওয়ামহলের ধ্বংসাবশেষ আছে, আর ঐ দিকে রাজাদের ভাঙা বাড়িটাও দেখতে পাবেন। আদপে তুত্তুরী    (চলবে) 

No comments:

Post a Comment