Saturday 29 April 2017

শ্যামাকালী

শ্যামাকালী (পর্ব- ১)
একি দেখছে শ্যামা? বাবা? বাবা ওর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে? কিন্তু বাবার একি সাংঘাতিক অবস্থা? রুধিরস্নাত দেহ, উদরের মধ্যস্থলে আড়াআড়ি একটা বিশাল ক্ষত, সেখান থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ঝুলছে, বাবা কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। বের হবে কি করে? গলার নলি কাটা যে। বাবা আকুল ভাবে কিছু বলতে চাইছে, দুই চোখে তীব্র আর্তি, কিন্তু পারছে না। এত রক্ত? এত রক্তক্ষরণ হলে বাবা মরে যাবে যে। “নাআআআআ” বলে চিৎকার করে উঠল শ্যামা।
“শ্যামা? শ্যামা? ওঠো। কি হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখলে কি?” পঞ্চানন জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলেন তার নিদ্রিতা অথচ ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে। চোখ খুলেই পঞ্চাননকে আঁকড়ে ধরল শ্যামা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। পৃথিবীতে এই একজনই তো আছে, যে শ্যামাকে ভালবাসে। কেউ কোনদিন ভালবাসেনি শ্যামাকে। জন্ম থেকেই ব্রাত্য শ্যামা।

শ্যামার জন্মের পূর্বে, ওদের গ্রামের বৃদ্ধ হরিদেব ঠাকুর নাকি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, বংশের মুখ উজ্জ্বল করা সন্তান প্রসব করতে চলেছেন, শ্যামার জননী। রায় বংশের ধারক এবং বাহক, যাকে বলে কুলতিলক। এই সন্তানের হাত ধরেই নাকি অমরত্ব পেতে চলেছে শ্যামার পিতা কৃষ্ণদেব রায়।  হরিদেব ঠাকুরের বচন নাকি অব্যর্থ, কখনও মিথ্যা হয়নি। শ্যামার পিতা ভেবেছিলেন, কুলতিলক অর্থাৎ এক যুগন্ধর পুত্র সন্তান প্রসব করতে চলেছেন, ওনার স্ত্রী। সময় ষোড়শ শতক, স্থান আদিসপ্তগ্রামের নিকট এক ছোট্ট গ্রাম স্বপ্নগোপালপুর । শ্যামার পিতা সেখানে সর্বজন পূজিত। স্বপ্নগোপালপুরের বিখ্যাত বৃন্দাবন রায়ের মন্দিরের মূল উপাসক শ্যামার পিতা। বৃন্দাবন রায় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরটিও শ্যামাদেরই এক পূর্বপুরুষ নির্মাণ করেছিলেন। শোনা যায় প্রায় আড়াই তিনশ বৎসর পূর্বে, সেই আদি পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে না জানি কোথা থেকে এখানে এসে হাজির হয়েছিলেন। গন্তব্য ছিল কোথায়, তাও অজ্ঞাত। তখন কোথায় স্বপ্নগোপালপুর  কোথায় কি? গোটা অঞ্চলই আবৃত ছিল ঘন জঙ্গলে। পাশ দিয়েই বয়ে যেত পতিতপাবনী গঙ্গা। পথশ্রমে ক্লান্ত স্বামী স্ত্রী, গঙ্গায় ডুব গেলে, দুটি চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে, এক বিশাল বট গাছের তলায় নিদ্রা যান। কথিত আছে, নিদ্রিত অবস্থায় যুগলে একি স্বপ্ন দেখেন, যে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণ শিশু এসে ওনাদের ধুতি এবং শাড়ি ধরে টানছে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আর কতদিন আমাকে মাটি চাপা থাকতে হবে? মাবাবা আমার খিদে লেগেছে।” ঘুম ভাঙতেই সেই শিশু নির্দিষ্ট অঞ্চল খুঁড়তে শুরু করেন ওনারা, এবং বাস্তবিক মাটি খুঁড়ে বার হয়, এক কষ্টি পাথরের কৃষ্ণ মূর্তি। স্বপ্নে পাওয়া গোপাল, তাই সংলগ্ন অঞ্চলের নাম হয় স্বপ্নগোপালপুর। নিকটবর্তী জমিদার বাসুদেব দত্তমশাইয়ের পূর্বপুরুষদের তত্ত্বাবধান তথা পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে এই মন্দির। রায় বংশের পুত্র তাই এখানে শ্রীকৃষ্ণের নামও বৃন্দাবন রায়।
শ্রীশ্রী   বৃন্দাবন রায়ের প্রধান উপাসক কৃষ্ণদেব রায় যখন জানতে পারলেন, যে ওনার স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তখন বলাইবাহুল্য উনি চূড়ান্ত আশাহত হন। কন্যা? কন্যা কি করে বংশের ধারক ও বাহক হয়? কন্যা কি করে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে? এই কন্যার হাত ধরে উনি অমরত্ব লাভ করবেন? হা হতোস্মি। হতাশার থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ।  কৃষ্ণদেব নাকি নিজের প্রথম সন্তানের মুখদর্শন করতে সম্মত ছিলেন না, যাই হোক সম্মিলিত অনুরোধে, মেয়ের মুখ দেখতে গিয়ে উনি আরও ব্যথা পেলেন। এ কে? কার সন্তান? রায় বংশে সকলেই গৌরবর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, উচ্চ কপাল তথা দীর্ঘ দেহি। কিন্তু এ কি জন্মেছে? শিশুর গাত্র বর্ণ ঘোর কৃষ্ণ, মুখশ্রীও তথৈবচ। বেঁকা বেঁকা পা দুটি জানিয়েই দিচ্ছে, যে এ মেয়ে বেশি লম্বা হবে না। তীব্র বিতৃষ্ণায় কৃষ্ণদেব রায় কন্যার নাম রাখলেন, “শ্যামাকালী”। বৈষ্ণব বংশে কালী এক অতি তুচ্ছা দেবী মাত্র। নিছক অপাংক্তেয়।

জ্ঞান হওয়া ইস্তক শ্যামা জানত, সে অবাঞ্ছিত। পিতা জীবনে শ্যামার সাথে একটি বাক্যবিনিময়ও করেননি। অথচ শ্যামার পরের দুই ভাই কিন্তু পিতার অপার স্নেহ লাভ করেছে। দুই ভাইয়ের সাথে শ্যামাকেও শাস্ত্র চর্চার সুযোগ দেওয়া হয়। কৃষ্ণদেব রায়ের শেষ আশা ছিল, হয়তো শ্যামা এদিকে কোন  কোন অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেবে। কোন নতুন পুঁথি লিখে বংশের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে যাবে। কিন্তু সেখানেও শ্যামা ব্যর্থ হয়।  শ্যামার অন্যান্য সহচরীদের পটাপট বিয়ে হয়ে যেতে লাগল, কিন্তু শ্যামার আর বিয়ে হয় না। কে নেবে, ঐ ঘোর কৃষ্ণবর্না খর্ব অথচ স্থূলাঙ্গী কন্যাকে? মাঝে মাঝে দুপুর বেলা যখন বৃন্দাবন রায়ের মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকত, শ্যামা লুকিয়ে গিয়ে  বৃন্দাবন রায়কে প্রশ্ন করত, “তুমিও কালা, আমিও। তুমি সর্বজন পূজ্য আর আমি কেন নই? যারা তোমার উপাসনা করে, তারাই আমায় ঘৃণা করে কেন? বল প্রভু?” কিন্তু পাথরের বিগ্রহ বরাবর নীরবই থাকত।
শ্যামার যখন প্রায় তের বছর বয়স, তখন নবদ্বীপ নিবাসী বাবু বনবিহারী ভট্ট তাঁর ভাগ্নের জন্য শ্যামার কর প্রাথনা করলেন। কানাঘুষো শোনা গেল, বদলে বেশ কয়েকঘর যজমানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলন, শ্যামার পিতা। বিয়ের পর নৌকা করে নবদ্বীপ পাড়ি দিল পঞ্চানন আর শ্যামা। ঘোমটার আড়াল থেকে অশ্রুসজল চোখে শ্যামা দেখছিল, বাবার চোখ শুকনো খটখটে। নৌকায় ওঠার আগে, যুগলে প্রনাম করল, কৃষ্ণদেব রায়কে। হাসি মুখে আশীর্বাদ করলেন, কৃষ্ণদেব রায়। শ্যামা আর থাকতে পাড়ল না, “বাবা গো!!” বলে আঁকড়ে ধরল নিজের পিতাকে। নাই দেখতে পারুন উনি শ্যামাকে, শ্যামা যে বড় ভালোবাসে তাঁর বাবাঠাকুরকে। দৃশ্যমান আড়ষ্টতার সাথে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কৃষ্ণদেব রায় হাত নেড়ে বরবধূকে ইশারা করলেন, নৌকায় চাপার। মর্মাহত শ্যামা নীরবে নৌকায় উঠলেও পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “ বড় ভুল করলে হে কৃষ্ণ। মাশুল গোনার জন্য প্রস্তুত হও। আমার ভবিষ্যৎ বাণী কখনও মিথ্যা হয় না। ঐ তোমার কুলতিলক।” শ্যামা ঘোমটা সরিয়ে দেখে দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ ঠাকুর মশাই, লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছেন, শ্যামাকে বিদায় জানাতে।

শ্যামাকালী (পর্ব- ২)
তের বছরের শ্যামাকালী আর উনিশ বছরের পঞ্চাননের ফুলশয্যা, শ্বশুর বাড়িতে পদার্পণ করেই শ্যামা বুঝতে পেরেছিল, এখানেও খুব একটা স্বাগত নয় সে। বনবিহারী ভট্টের স্ত্রী চার পুত্র- পুত্রবধূ, গোটা দশেক নাতিনাতনী নিয়ে বিশাল পরিবার, সেখানে পিতৃমাতৃহীন ভাগ্নে পঞ্চানন নেহাতই পরিচারকতুল্য। তার স্ত্রী হিসেবে শ্যামার গ্রহণযোগ্যতা কতটা হতে পারে তা অননুমেয় নয়। ফুলশয্যার রাত্রে পঞ্চানন ও তাই বলেছিল শ্যামাকে, “হ্যাঁ গা তোমার বাপমায়ের কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। হাত পা বেঁধে  এত সুন্দর মেয়েটাকে জলে ভাসিয়ে দিল গা?” সুন্দর! শ্যামা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি, ঘোমটা সরিয়ে তাকিয়ে দেখে পঞ্চাননের মুখে একটুও শ্লেষ বা বিদ্রুপের ছায়াও নেই। নিতান্ত সহজ সরল একজোড়া টানাটানা চোখ, ঘন আঁখিপল্লব গভীর সহমর্মিতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্যামার দিকে। শ্যামা করুণ হেসে বলেছিল, “আমার মত বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।” পঞ্চানন আরো করুণ ভাবে বলেছিল, “হোক না। খেদাক না, তবু তো তোমার মা-বাবা আছেন। আর আমাকে দেখ, জন্মের আগে বাবা নিরুদ্দেশ, গর্ভবতী অবস্থায় মাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল আমার দাদু-ঠাকুমা। মামাদের গোয়ালের পাশে ছোট্ট আঁতুড় ঘরে আমার জন্ম দিয়ে মাও...। সেই থেকে মামার বাড়িতেই পড়ে আছি। লেখাপড়াও শিখিনি কিছু না। বামুনের ছেলে হয়ে ফাইফরমাশ খাটি, গরু বাছুরের দেখাশোনা করি। হাট বাজার করি...। তোমাকেও খাটতে হবে গো। পঞ্চার বউকে এরা বসিয়ে খাওয়াবে না।”

এদিকে যখন স্বপ্নগোপালপুরের শ্যামার সাথে গভীর প্রেমবন্ধনে জড়িয়ে যাচ্ছে নবদ্বীপের পঞ্চানন, ও দিকে তখন বাংলার আফগান সুলতান সুলেমান কারনানীর কন্যা জেব-উন্নিসার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, কলিঙ্গ-উৎকল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবের প্রধান সেনাপতি শ্রী রাজীবলোচন রায়। সুলেমান কারনানী ছিলেন এক অতি বিচক্ষণ শাসক। সুলতান উপাধি নিলেও উনি নিজস্ব মুদ্রা চালু করেননি। ওনার জমানায় জুম্মা বারে মসজিদে মসজিদে তৎকালীন বাদশাহ আকবরের নামে খুৎবা  পড়া হত। ওনার বড় শখ ছিল কলিঙ্গকে বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত করার। সেই উদ্দেশ্যে যতবারই মহারাজ গজপতি মুকুন্দদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, ততবারই পর্যুদস্ত হয়েছেন গজপতি মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায়ের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বীরত্ব তথা রণ কৌশলের কাছে। অবশেষে ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাস্ত হবার পর সুলতান সুলেমান কারনানী এক ফন্দি আঁটলেন। উনি খবর নিয়ে দেখেছিলেন যে রাজীবলোচনের স্ত্রী শৈশবেই পরলোক গমন করে এবং তারপর আর দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেননি রাজীব। বিবাহযোগ্যা হিন্দু মেয়েদের বয়স সাধারণত সাত আট বা খুব জোর দশ। ঐ টুকু বাচ্ছা মেয়ে আর যাই হোক পচিশ বছরের রাজীবলোচনের মানসী হতে পারে না।
ত্রিবেণীর যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি প্রস্তাব আলোচনার জন্য রাজীবলোচনকে নিজের শিবিরে আমন্ত্রণ জানালেন সুলতান। শুদ্ধ উৎকলী ব্রাহ্মণের হাতে তৈরি ভোজন দিয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করলেন, সুলতান। ভোজনান্তে যখন শর্তাবলী নিয়ে দরদস্তুর চলছে, শিবিরের পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করল এক অপরূপা নারী। বয়স বছর উনিশ। তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, তুলি দিয়ে আঁকা একজোড়া চোখ, যার মণির রঙ হাল্কা সবুজ মেশানো নীল। গোটা শরীর আবৃত, মস্তকে খাস ঢাকাই মসলিনের স্বচ্ছ ওড়না। যার রঙ অবিকল নারীর চোখের মণির মত। এ নারী যে মধ্যপ্রাচ্যের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজীবলোচনের চোখের পলক পরছিল না। সুলতান সুলেমান, নীরবে হেসে আলাপ করিয়ে দিলেন, “ জনাব এ হল আমার জান, আমার বেটি। জেবা। জেব-উন্নিসা।” জেবা মৃদু হেসে সালাম জানালো। রাজীবলোচনের মুখে বাক সরল না।
সেদিন সুলতান সুলেমানের শিবির থেকে ফিরে রাজীবলোচন বুঝতে পারল, যে সে মদন দেবের শরাহত। জেবাকে না পেলে ওনার জীবন বৃথা। বেশ কয়েকদিন অন্নজল ত্যাগ করে, বিনিদ্র রজনী যাপন করে, রাজীবলোচন আর পারল না। নতমস্তকে করজোড়ে গিয়ে দাঁড়ালো সুলতান সুলেমানের সামনে। জেবাকে বিবাহ করতে চায় রাজীবলোচন। সুলতান সুলেমান বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললেন, “ জেবাকে পেতে গেলে যে ইসলামকেও কবুল করতে হবে জনাব রাজীবলোচন রায়।” উৎকলী ব্রাহ্মণ রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল, “ কেন? আমি বিধর্মী হব কেন? আপনার কন্যা হিন্দু হবে। স্বামীর ধর্মই নারীর ধর্ম।”  সুলেমান হাসি চেপে বললেন, “যান। আপনাদের রাজামশাই কে জিজ্ঞাসা করুণ আগে। যদি ওনাদের আপত্তি না থাকে আমরা ভেবে দেখব। তবে জেবা প্রাণ থাকতে ইসলাম ত্যাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না।”
রাজীবলোচন দৌড়ে গেল, সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবের কাছে। কিন্তু সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবের মন গলল না। উনি উপহাসের সঙ্গে বললেন, “ রাজীব , তোমার কি শেষে ভীমরতি হল? জান না? হিন্দু হওয়া যায় না। যবনী সংসর্গ করতে চাও, করতেই পার। এতদিন নারী সঙ্গ বিবর্জিত জীবন কাটিয়েছ, আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু ঐ যবনী কিছুতেই হিন্দু হতে পারে না।” রাজীবলোচনের সমস্ত অনুনয় বিনয়, চোখের জল কিছুতেই রাজামশাইয়ের মন গলল না।
ভগ্ন হৃদয়ে রাজীবলোচন ফিরে গেল সুলতান সুলেমানের কাছে। সুলেমান হেসে বললেন, “ কি বললেন তোমাদের রাজামশাই? যবনী সংসর্গে দোষ নেই, কিন্তু সেই যবনীকে বিয়ে করা ধর্মে নিষেধ। তাই তো?”
করমচার মত লাল চোখে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রাজীবলোচন শুধু বলল, “ যবনী সংসর্গ নয়। আমি জেবাকে ভালবাসি। ওকে নিজের ঘরণী বানাতে চাই, নিছক অঙ্কশায়িনী নয়। আমি ইসলাম গ্রহণ করতে তৈরি।”
ইসলাম গ্রহণ করে রাজীবলোচনের নতুন নাম হল, জালালুদ্দিন। কিন্তু সে নামে তাঁকে কেউ চিনত না, রাজীবলোচন ওরফে জালাল ছিল বিশালাকৃতি, পেশীবহুল এবং ঘোরকৃষ্ণবর্ণ। ইতিহাস তথা তৎকালীন সমাজ তাঁকে ডাকতে লাগল “কালাপাহাড়” নামে।
(চলবে)
#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.com

(চলবে)
#AninditasBlog
https://amianindita.blogspot.in

জুলাই মাস, দুপুর আড়াইটা, আকাশের মুখ ভার, তাই রোদের সেই তাপ নেই। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে, অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ রিক্সাওয়ালার ডাকে চমকে উঠলাম, “দেখেন দিদি, এই হোটেলটা ঠিক আপনার পছন্দ হবে।” রিক্সায় চড়ার  সময় বলেছিলাম, জনপদ থেকে দূরে, কোন ফাঁকা হোটেল দেখে দিতে। যেখানে নিরিবিলিতে কটা দিন কাটানো যায়। সত্যি কথা বলতে কি জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। একটু শান্তি চাই। মানুষ জন আর সহ্য হচ্ছে না। পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের সাথে কিছু সময় কাটাতে চাই। কিছু বোঝাপড়া করা বাকি।
          অনেক ভেবেচিন্তে এই স্থান নির্বাচন করেছি। এই অঞ্চলটি খুবই স্বল্প পরিচিত এক পর্যটন কেন্দ্র। কয়েক বছর আগেও কেউ এই জায়গাটার নাম জানত না। রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভ্রমণ পিপাসুদের চোখে পশ্চিমবঙ্গকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এইরকম বেশ কয়েকটি স্থানকে সরকারি ভাবে গড়ে তোলা হয়। সেই প্রচেষ্টা খুব যে সফল হয়েছে বলা চলে না, তবে সপ্তাহান্তে কিছু বঙ্গসন্তান অবশ্যই আসে।
          পাছে কোন পরিচিত মুখ চোখে পড়ে যায়, তাই ইচ্ছে করেই সপ্তাহের শুরুতে এসেছি। আজ সোমবার। এক নজরে হোটেলটা মন্দ লাগল না। বরং বেশ ঝকঝকে। ভাড়া কত হবে?  সাধ্যাতীত হয়ে যাবে না তো? ইতস্ততঃ করছি দেখে রিক্সাওয়ালা  অভয় দিল, “ যান না দিদি, এই সময় লোক হয় না বলে, ওরা হাফ-প্রাইসে ঘর দেয়।”
ভাড়া চুকিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। সামনে কেয়ারী করা বাগান, গাড়ি রাখার জায়গা, নুড়ি বসানো পথ ধরে তিনটি সিঁড়ি টপকে রিসেপশন রুম। সামনেই ম্যানেজারের  ডেস্ক, কিন্তু ফাঁকা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, অ্যাকোরিয়ামের লাল-নীল মাছ গুলি ছাড়া অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই। মিনিট তিন চার পরে হাঁফাতে হাঁফাতে এক ভদ্রলোক এলেন, বুশ শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে। প্রৌঢ় মানুষ, মনে হল আমাকে দেখে বেশ হতাশ হয়েছেন। একে তো একলা মেয়ে, তায় পরনে ম্লান সুতির সালয়ার-কামিজ, কাঁধে একটা লাল-কালো কাপড়ের ব্যাগ, তাতে ‘রেমন্ড’ লেখা। সব মিলিয়ে মোটেই আকর্ষণীয় নয়।
জিজ্ঞাসা করলেন, “ক’দিন থাকবেন?” “তিন-চার দিন”। “হুঁ। ভাড়া ১২০০ টাকা, তবে অফসিজিনে ৬০০ টাকা লাগবে, প্রতিদিন। আর হাঁ দিনের বেলা আর রাতে আটটার পর জেনারেটার চলবেনি।” মাথা নাড়লাম। সকাল আটটায় চা, সাড়ে নটায় ব্রেকফাস্ট, রাত আটটায় ডিনার।“ আবার বাধ্য ছাত্রীর মত মাথা নাড়লাম। “নাম ঠিকানা লিখুন।“ ছদ্মনাম ভেবেই রেখেছিলাম, ঠিকানাও। ফোন নম্বরটা ফাঁকা রাখলাম। ওঠা ভুল লেখার রিস্ক নিতে পারলাম না।
          জনৈক আব্দুলকে ডেকে ম্যানেজার বাবু আমায় ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। ঘরে ঢুকে অভিভূত হয়ে গেলাম, আমার জানলা দিয়ে সমুদ্র ডাকছে। হোটেলটিই প্রায় বেলাভুমি ঘেঁষেই উঠেছে। ঠিক নীল দামাল সমুদ্র নয়, কেমন যেন কালচে বুড়ো সমুদ্র। ঢেউ গুলো যেন অসীম ক্লান্তি নিয়ে পাড়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ছে। হোক বুড়োটে, তাও সমুদ্র তো।
          সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ভাল লাগছে কি? কি জানি? সব অনুভূতি কেমন ভোঁতা হয়ে আসছে। আজকাল কিছুই ভাল লাগে না। মাত্র তিরিশেই নিজেকে ফুরিয়ে যাওয়া ক্ষয়াটে বৃদ্ধা মনে হয়। হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল। ঠিক কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ঘোর কাটতে দেখি সূর্য কখন পাটে  বসেছে, সন্ধ্যা নামছে। ফাঁকা ধূধূ বালুকাবেলায় শুধু আমি একা। না ভুল বললাম, দূরে একটা আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে, তা কোন মানব না ছায়ামানব জানি না। কি বা যায় আসে।
          হোটেলে ঢুকতেই আব্দুল বলল, “মেমসাহেব, চা খাবেননি?” ‘মেমসাহেব’?? হাসি চেপে ডাইনিং রুমে বসলাম। ডাইনিং রুমে আরও এক জন বসে আছেন। সম্ভবত বোর্ডার , বেশ সুদর্শন, গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, চোখে রিমলেস চশমা। আমাকে দেখে মৃদু হেঁসে বললেন, “ম্যাডাম কে আজ এসেছেন?” প্রমাদ গুনলাম। এই রে ,এই শুরু। এবার নাম- ধাম, পরিচয় সেখান থেকে কত যে শাখা প্রশাখা বেরোবে? একা মেয়ে দেখে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা না করাটাই অস্বাভাবিক। যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে, সৌজন্যমূলক ভাবে ঘাড় নাড়লাম শুধু। ঊনিও আর কিছু বললেন না। আমিও কথা বাড়ালাম না। তবে অনার আওয়াজ বহুক্ষণ আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, একেই বোধহয় ব্যারিটোন ভয়েস বলে।
          এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নামকাওয়াস্তে থাকে। থাকলেও ভোল্টেজ খুবই অল্প। রাত্রে প্রায় কোনদিনই থাকে না। সপ্তাহান্তে হোটেল ভর্তি থাকলে সাড়া রাত জেনারেটর চলে, না হলে রাত আটটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে, সাড়ে আটটার মধ্যে জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় যে হতভাগ্যরা থাকে, তাদের  হোটেলের তরফ থেকে হ্যারিকেন আর প্রয়োজন হলে টর্চ দেওয়া হয়। নৈশ ভোজ চলাকালীন আমাদেরকেও হাতে হ্যারিকেন ধরানো হল। ওনার টর্চ আছে, তাই আমাকে একটা টর্চ ও দেওয়া হল। খেতে খেতে দেখলাম, ম্যানেজার বাবু আর আব্দুল ওনাকে খুব খাতির করে।
          খেয়ে ঘরে ফিরছি, উনি বললেন, ‘ ম্যাডাম, এখনি ঘরে গিয়ে কি করবেন? চলুন পিছনের আঙিনায় গিয়ে বসি। জোয়ারের সময়, সমুদ্র প্রায় আঙিনা অবধি চলে আসে। কপাল ভাল থাকলে, আপনার পদস্পর্শও করে যেতে পারে। ’ লোভ সামলাতে পারলাম না। পিছনের আঙিনায় বেশ কিছু গার্ডেন চেয়ার পাতা আছে, তার একটায় গিয়ে বসলাম। উনিও বসলেন, তবে আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ঝুপ করে আলো নিভে গেল। নিভু নিভু হ্যারিকেনের  আলোয়, সে এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ। ঝিঁঝিঁর ডাক, আর জলের ছলাৎ ছলাৎ, সাথে শিহরণ জাগানো নোনতা সোঁদা বাতাস। কত ব্যেস হবে ওনার, মধ্য চল্লিশ তো বটেই, পঞ্চাশের কাছাকাছিই হবে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, অন্ধকার চরাচরের সুযোগ নেবেন কি না? কিন্তু উনি কিছুই বললেন না। আমি ঘড়ি পরিনি। উনি টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখে বললেন, “চলুন, এগারোটা বাজে।”
ওনার পিছন পিছন হোটেলে ঢুকলাম। আমাকে শুধু আমার ঘর অবধি এগিয়ে দিলেন তাই না, আমার ঘরের সামনে আমার টর্চ আর হ্যারিকেনটাও ধরলেন, যাতে আমি তালা খুলতে পারি। তালা খুলে, ঘরে ঢুকে ওনার দিকে তাকালাম, উনি একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে, বললেন, “ওককে ম্যাডাম। শুভরাত্রি।“
          দরজা বন্ধ করে পুরো বেকুব লাগছিলো, নিজেকে চড় কসাতে ইচ্ছে করছিল; কি চাইছিলাম আমি? আমাকে পাত্তা দেবেন উনি? আমার সাথে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করবেন? কোন মূর্খের স্বর্গে বাস করি আমি? এককালে আমি মনে করতাম, আমার থেকে কুরূপা কোন মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই, সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে আসছিলো। জীবনে কোন কিছুকেই সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারি না। প্রেম প্রস্তাব কম পাইনি, কিন্তু একটাও বিশ্বাস হয়নি। আমার দৃঢ় ধারণা আমি পুরুষদের অভিসন্ধি খুব ভাল বুঝতে পারি। এই প্রথম হিসেব মিলল না।

          ভোরের নরম আলো মুখে এসে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল। দৌড়ে গেলাম সমুদ্রকে দেখতে। কিন্তু কোথায় সে? ভাটার টানে বেশ পিছিয়ে গেছে। ওনাকে দেখতে পেলাম, প্রাতভ্রমণে বেড়িয়েছেন। ব্যালকনিতে আমাকে দেখে, হেঁসে হাত নাড়লেন। ঈশারায় ডাকলেন, নেমে আসতে। হঠাৎ মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল। দৌড়ে গেলাম সৈকতে ওনার কাছে। ঈশ! কি দামি ট্রাক প্যান্ট আর রাউন্ড নেক টিশার্ট পরেছেন। হাতের ঘড়িটাও দুর্মূল্য, সুইস তো বটেই। ওনার পাশে কি অস্মভব বেমানান আমি। দু একটা ভালো জামা কাপড় ও আনিনি। মনটা আবার তেতো হয়ে গেল।

প্রাতঃরাশের সময় উনিই প্রস্তাব দিলেন, কাছাকাছি কয়েকটা মন্দির আছে, দেখতে যেতে ইচ্ছুক কি না। মন্দির? আমি আস্তিক বটে, তবে আমার বয়সী অন্যান্য মেয়েদের মতই মন্দির- পুজো এসব থেকে দুরেই থাকি। দুর্গাষ্টমী আর সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করি না। কিন্তু ওনার আকর্ষণ এড়ানো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া সময়টা তো কাটবে। না হলে সারাদিন বদ্ধ ঘরে একা বসে বসে স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া কি বা করার আছে? আর স্মৃতি মানেই তো সব ভেস্তে যাওয়া, তাসের ঘরের স্মৃতি। সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করা। ভাবতে বসলেই বুকে চাপ ধরে,হাঁসফাঁস করে উঠে জানালাম, যাব। 

 কি যে ছাই পরে যাই? তেমন কিছুই তো আনিনি।নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বেরিয়েছিলাম, তাই কয়েক জোড়া সস্তা সুতির সালওয়ার আর অতি সামান্য প্রসাধনী ছাড়া কিছুই আনিনি। কি হবে ঐ ভার বহন করে? কে দেখবে আমায়?ভাবিনি ওনার সাথে দেখা হবে, খুব আফসোস হচ্ছে এখন। যাই হোক, যা আছে, তাই পরলাম, চুলে চিরুনি চালিয়ে কি মনে হল, চোখে হাল্কা করে কাজলের রেখা টানলাম আর কপালে একটা কালো ছোট টিপ।লিপস্টিক নেই, অগত্যা ঠোঁটে একটু লিপ বামই ঘষে নিলাম। হাল্কা লালচে একটা আভা এল। আয়না অন্য কিছু বলতে গেল, ধ্মকে বললাম, “ভালোই লাগছে তো?”
 নীচে উনি অপেক্ষা করছিলেন, হাসি হাসি মুখে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, উনি একবার তাকিয়েই রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “চলুন। ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে।“ বুকের মধ্যে গরম লৌহ শলাকা ঢুকিয়ে দিল কি কেউ? এত কান্না পাচ্ছে কেন? কি ভেবে ছিলাম? উনি আমাকে দেখে গলে যাবেন? উনি এগিয়ে যেতেই রুমাল দিয়ে মুছে দিলাম লিপবাম। কড়ে আঙুলের ডগা দিয়ে ফেলে দিলাম সস্তা সোয়েটের টিপ। আলতো করে চোখের জলের সাথে সাথে মুছে দিলাম কাজল, সম্পূর্ণ ওনার অগোচরে। কি হবে? কে দেখবে আমায়? 

একটা ভ্যানে করে চলেছি দুজনে। উনি মাঝে মাঝে কথা বলছেন, আমি হুঁ-হাঁ করে জবাব দিচ্ছি। আজ আকাশে মেঘ থাকলেও সূর্যি মামার তেজ কিছু কম নেই। ওনার মূল্যবান চশমা রোদের তাপে কালো হয়ে গেছে। ইশ্ একটা গগলস ও আনিনি। প্রথম মন্দিরটি শিবের। কিন্তু মন্দিরে কোন শিবমূর্তি নেই। শিবলিঙ্গ আছে বটে, তবে আসল পূজ্য হল দুটি পাথরের ভাঙা পা। অনেক গভীরে মাটিতে প্রথিত হাঁটুর একটু নীচে থেকে ভাঙা দুই অতিকায় পাথুরে পা। তাকেই মহাদেবের শ্রীচরণ বলে উপাসনা করা হয়। চারিদিকে পাতকুয়ার মত উঁচু বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। আমাদের অসম বয়স দেখে পুরোহিত একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, তার ওপর আমরা একে অপরকে আপনি-আপনি করছি, বেচারা পুরোহিতের অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিল। উনি অবশ্য আদপেই পুজো দিতে উৎসাহী ছিলেন না। নাস্তিক কি না বুঝলাম না। ওনার মূল উৎসাহ এই মন্দিরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব খোঁজায়। ওনার বদ্ধমূল ধারণা, এই দুটি ভাঙা পা আসলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোন বুদ্ধ মূর্তির। মন্দিরের মুখ্য দ্বারের দু পাশে দুটি সিংহ মূর্তি রয়েছে, দেখতে অনেকটা চীনা ড্রাগনের মত। উনি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন, সাগ্রহে বললেন, “দেখছেন ম্যাডাম, এই হল ‘মার’, ‘মারের’ মূর্তি। বিশ্বাস হল আমার কথায়?” অস্বীকার করব না, সত্যি আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, কত বৎসর ধরে কত ইতিহাস, কত ভাঙা গড়ার সাক্ষী এই ‘মার’ দুটো।ভাবতেই রোমাঞ্চ জাগে। নিজেকে, নিজের সমস্যা গুলিকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

 আবার অন্য মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রোদ নেই, তবে তাপটা ভালোই। ছাতা খুললে ভালোই হয়, কিন্তু কি অদ্ভুত সঙ্কোচে খুলতে পারছি না।উনি কি ভাববেন? হাসিও পাচ্ছে, আমি ছাতা খুলব কি না, তাই নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? বরাবরই নিজেকে অহেতুক গুরুত্ব দি। উনি মাঝে মাঝে কথা বলছেন, মাঝে মাঝে নীরব। দুপাশে চাষের জমি, কাজু বাদাম গাছের বাগান দেখতে দেখতে যাচ্ছি, হঠাৎ উনি বললেন, “অখন্ড বাংলাদেশের সব মন্দিরই যে বৌদ্ধ মন্দির ভেঙে তৈরি, তা বলা যায় না।তবে বৌদ্ধ প্রভাব সুস্পষ্ট। ইতিহাস অনেক কথাই সোচ্চারে বলে না, আর সব ইঙ্গিত আমরা ধরতে পারি না। ছাতাটা বরং খুলেই ফেলুন।“
 হেসে ফেললাম। আমি যে অন্যমনস্ক ভাবে ব্যাগে হাত বলাচ্ছিলাম,সেটা ওনার নজর এড়ায়নি।উনিও হাসলেন, একটু থেমে বললেন, “বাংলায় একটা কথা আছে, জানি না আপনাদের প্রজন্ম তা জানে কি না?” আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, “কোনটা বলুন তো?” উনি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, “মুখ হল মনের আয়না।এই কথাটা এই ভাবেও বলা যায় যে, আপনার আয়নাটা যদি ঝকঝকে থাকে, তাহলে কোথাও তা আপনার মনের মালিন্য তা কাটাতেও সাহায্য করে।“ কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না, উনি মৃদু হেসে বললেন, “স্বল্প প্রসাধন কিন্তু মন্দ নয়।“ লাল- গোলাপি- বেগুনী হয়ে গেলাম। কিছুই ওনার নজর এড়ায় না।
#AninditasBlog

 

Monday 17 April 2017

আমাদের গপ্প

আমাদের গপ্প ৬ই এপ্রিল ২০১৭#1

যদি কাউকে সাড়ে দশটায় মেসেজ করা হয়,“ধুৎ! গাড়ি আসেনি। লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে আছি। ” সেই মেসেজ সে বেলা সাড়ে বারোটায় পড়ে এবং পড়া মাত্র উদ্গ্রীব হয়ে ফোন করে, এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি কি না জানতে(?) তাহলে কি বুঝব? ভালবাসা নাকি মরিচীকা?

আমাদের গপ্প  ১৭ই এপ্রিল ২০১৭ #2
-তুই একদম আমার বাবার মত নস্!
-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
-বাবা হলে কখনওই আমাকে ফেলে সিগন্যাল গ্রীণ দেখলে ল্যাজ তুলে দৌড়ত না।
-ভাগ্যিস্।
-বাবা হলে কখনই ভিড় বাসে, আমি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও সিট পেলেই, থপ করে বসে পড়ত না।
-যাঃ বাবা। তুই এই দিকের সিটে বসবি কেন?
-আহাঃ! কি যুক্তি! যেন ওটা জেন্টস্ সিট, জেনারেল সিট নয়?
-একটু পরেই তো সিট পেলি রে বাবা--
-তাতে কি? তুই সেই ভাল্লুকের গল্পটা জানিস তো?
-কোন ভা- ল্লু- ক?ও সেই গল্পটা যেখানে ভাল্লুক বলবে এত চর্বি ওলা লোক খাই না! বলে চলে যাবে?
-ইশ্!!!!!ভালো হবে না বলছি---

আমাদের গপ্প #৩ 20.07.2017
-অমুকের ঘাড়ে চাপতে গেলি কেন খামোখা?
-কিঃ?খামোখা তুই ছাড়া অন্য লোকের ঘাড়ে চাপতে যাব কেন?
-মেসেজ করলি যে? অমুক অফিসারের ঘাড়ে।
- সত্যি মাইরি ।  লিখলাম অমুকের ঘরে (ghare)। ঘাড়ে নয়। মানছি ইংরাজি হরফে বাংলা তাই বলে এত সাংঘাতিক ভুল কেবল তুই ই বুঝতে পারিস।
-না মানে, ঘাড়ে চেপে ভেজা খাওয়া তোর স্বভাব কি না--- তাই ভাবলাম আর কি--
#Aninditasblog #আমাদের_গপ্প
https://amianindita.blogspot.com

Thursday 13 April 2017

অনির ডাইরি

অনির ডাইরি ২৫শে জুন ২০১৭

জানি না কাল চাঁদ দেখা যাবে কি না, জানি না কাল ঈদ হবে কি না, কিন্তু ঈদ এলেই চার্চ লেনের কথা খুব মনে পড়ে যায়, এবং হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর কাটিয়েছি চার্চ লেনে, কত সুখ দুঃখের সঙ্গী। সেসময় মাহে রমজানে চার্চ লেনের রোশনাই ছিল আলাদা। হবে নাই বা কেন, আমার দুই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু শ্রীআবুল ফজল নাজিমুদ্দিন আহমেদ এবং শ্রীনজরুল ইসলাম সাহেব তখন ঝকমক করছেন চার্চ লেনের আকাশে। আর বস ছিলেন তৎকালীন জয়েন্ট লেবার কমিশনার মহম্মদ আমানুল হক সাহেব। হক সাহেবের সেই বিক্রম যারা দেখেননি তারা জানেন না, গোটা চার্চ লেন থরহরি কম্প দিত ওনার ভয়ে। ভয় করতাম না একমাত্র আমি। প্রায় দিনই ঝামেলা হত আমার সাথে, স্যারের যত বিক্রম সবই ছিল আমাদের ওপর, জেলা থেকে রিপোর্ট পাঠায়নি, কি ইউসি পাঠায়নি, কি কোন ভুল তথ্য এসেছে, তাই জন্য রিপোর্ট বানাতে দেরী হলে বা টাকা না ছাড়লেও স্যার আমাদের বকতেন। জীবনেও জেলার অফিসারদের কিছু বলতেন না,এ নিয়ে অনুযোগ করলে বলতেন, “আহাঃ ওদের কি চাপ তোমরা বুঝবে না?” হয়তো কারো নামে আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে অভিযোগ দায়েব করলাম, স্যার ও উত্তেজিত হয়ে ফোন তুলে নিলেন, আঃ এবার নির্ঘাত ঝাড়বেন। স্যারের সংলাপ শুনে বুঝতে পারতাম না, হাসব না কাঁদব? “হ্যালো, অমুক? কোথায় আছ ভাই? অফিসে? আচ্ছা একটু রিপোর্টটা যে পাঠাতে হবে ভাই। এই দেখো না, অনিন্দিতা কি বকান বকছে আমাকে...”। বোঝ? কি কারণে স্যার প্রচণ্ড বকেছেন, চূড়ান্ত অভিমানে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে, বেরিয়ে এসে নিজের চেম্বারে হাঁড়িমুখ করে বসে আছি, স্যার ডেকে পাঠালেন, তেতো মুখে গেলাম, স্যার গলা ঝেড়ে বললেন, “শোন। আমি বকলে অত দুঃখ পেয়ো না। আমরা বকি বটে, তবে বাবা-কাকাদের জায়গা থেকে বকি...”। তবে স্যার জীবনেও রোজা রাখতেন না এবং ঈদের পর স্যারের পকেট কাটা ছিল দুঃসাধ্য।
সে ছিল আমাদের নাজিম সাহেব।না চাইলেও পকেট উল্টে দিতেন। সত্যিই ঈদকে খুশির ঈদ বানাতে জানতেন ভদ্রলোক। নাজিমুদ্দিন সাহেব ছিলেন অভিজাত,অসম্ভব সুদর্শন এবং সুপুরুষ।অনেকটা রইস জমিদার টাইপ। ধুতি পাঞ্জাবি আর গড়্গড়া ধরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।  সাথে সাথে  চূড়ান্ত পরিশীলিত , মার্জিত। অনেকটা শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট বাড়ির বড়কর্তা সুলভ। প্রায় বলতাম,“আপনি টলিগঞ্জে যাচ্ছেন না কেন মশাই? কখনও ‘জলসাঘর’ সিনেমার রিমেক হলে ছবি বিশ্বাসের রোলটা আপনার বাঁধা । ” উনি প্রাণখোলা হাসি হাসতেন। কথাগুলি যে উনি উপভোগ করতেন তা বলাই বাহুল্য। নাজিম সাহেবের আর একটা গুণ ছিল, উনি ছিলেন অসম্ভব ভালো বাজারু। রোজ আমাদের টিফিন টাইমের গল্পের কিয়দংশ জুড়ে থাকত, আজ উনি কি বাজার করেছেন, কি মাছ কিনেছেন। শুধু তাই নয়, আমাকেও শোনাতে হত, এবং পরিশেষে প্রত্যেকে দিনই উনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন, আমি একটি গোবরগণেশ। এতদিন ওনার সংস্পর্শে থেকেও রুই কাতলার তফাৎ চিনতে শিখলাম না। আর যথারীতি মাছওয়ালা এবং বাজারওয়ালা আমাকে ঠকাবে বলেই সকাল সকাল পসরা সাজিয়ে বসেছিল।

আর নজরুল সাহেব? নজরুল ইসলাম ছিলেন আদ্যন্ত সরল, আবেগপ্রবণ মাটির মানুষ। এত অসম্ভব বর্ণময় চরিত্র বাস্তবে দুর্লভ । গরিব পরিবহন শ্রমিকদের টাকা পাইয়ে দেবার জন্য উনি সমস্ত নিয়ম ভাঙতে সদা প্রস্তুত থাকতেন। সরকারী কর্মচারী মাত্রই অডিটকে যমের মত ভয় পায়। উনি তাতেও কাবু ছিলেন না। পেনশন বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে ভয় দেখালে, উল্টে জ্ঞান দিতেন,“এই গরিব লোকগুলোকে দেখলে ঈশ্বর দেখবেন আমায়। ” কিন্তু ঈশ্বরের ওপর এত ভরসা করতে পারলাম কই? ফলতঃ কলহ অনিবার্য ছিল। আজো মনে আছে প্রথমবার ওনার সাথে ঝগড়া করে নিজের চেম্বারে এসে বসেছি, উনি সন্তর্পণে এসে বসলেন আমার সামনে। অপরাধ বোধে ভুগছিলাম। এতক্ষণ একাই চিৎকার করেছি, উনি দুর্বল ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টাই করে গেছেন শুধু। যাই হোক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি আমতা-আমতা করে জিজ্ঞাসা করলেন,“আচ্ছা তোমার কি কোন কারণে মন ঠিক নেই। টেনশন আছে কিছু?” উত্তর দিতে যাব, উনি আবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা তোমার বয়স কত?”
ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছি, উনি শিশুর সরলতা নিয়ে বলে উঠলেন,“আমার মেয়ের বয়স ২৮। তোমাকে দেখলেই কেন জানি না আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ”
হতবাক হয়ে নিজের রূঢ় ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতে যাব, উনি বলে উঠলেন,“ দূর। দূর। তোমার কথায় আমি কিছুই মনে করি না। ”বলেই ধড়মড় করে বেড়িয়ে গেলেন।

নজরুল সাহেব রক্তিম ইসলাম ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। ওনার কবিতা জন্মাতো টিফিন টাইমে। কখনও ছেঁড়া ঠোঙার ওপরে, কখনও বা বাতিল মলিন বিবর্ণ নোটশীটে। আর সেই সব সদ্যোজাত কবিতার প্রথম পাঠিকা ছিলাম আমি। যত বলতাম, “ছেড়ে দিন কেঁদে বাঁচি। আমি কবিতা বুঝি না। ” ততো উনি চেপে ধরতেন। বলতেন, “বোঝার নয় কবিতা অনুভবের বস্তু। ” সত্যি বলছি উনি কান ধরে না পরালে কবিতার সাথে আলাপ জমতই না।
নাজিম সাহেব যতটা সমজদার ছিলেন, ততোটাই শিশুসুলভ ছিলেন নজরুল সাহেব। পান থেকে চুন খসলেই অভিমান হত ওনার। কর্মসূত্রে শৌভিক আর আমি তখন আলাদা আলাদা থাকি। সপ্তাহান্তে দেখা হয়। তবে কোন কারণে হাইকোর্টে হাজিরা দিতেহলে শৌভিক আমার অফিসেও এসে হাজির হত। তা সে যত অল্পক্ষণের জন্যই হোক না কেন। শৌভিক এসেছিল অথচ ওনার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে যায়নি, এই গর্হিত অপরাধে উনি বেশ কিছুদিন আমার সাথে বার্তালাপই বন্ধ করে দেন। হাতে পায়ে ধরে সে যাত্রা ওনাকে মানাই। পরের বার শৌভিক আসতেই পাকরাও করে নিয়ে গেলাম ওনাদের কাছে। পরিচয় দিলাম। নাজিম সাহেব উঠে করমর্দন করলেন। নজরুল সাহেব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর প্রায় আলিঙ্গন করে বললেন,“আসুন আসুন। কি যে অসম্ভব ভাল লাগছে আপনার সাথে আলাপ হয়ে। আমরা ভাবি জানেন! আমরা স্বপ্ন দেখি। আমাদের অনিন্দিতার বর কেমন হবে। আপনি অনেকটা সেই রকমই। ”এত ভালবাসা জীবনে এত অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে পেয়ে গেছি না, যে জীবনের অমৃতকলস প্রায় টইটুম্বুর। সমস্ত সুখ-দুঃখ,দুশ্চিন্তা, উৎকন্ঠা নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিতাম আমরা। দুটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দুজনের সজল আঁখি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সৌভাগ্য এই কারণে যে খুব কাছের লোক ছাড়া আমরা কারো কাছে এতটা অকপট হতে পারি কই?
নজরুল ইসলাম সাহেবও নিয়মিত রোজা রাখতেন না। নাজিম সাহেব আবার অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। ওণাদের থেকেই শিখলাম, “ মাহে রমজান” হল রমজান মাস। মাহে রমজান আসার আগে থেকেই কত শত জল্পনা শুরু হয়ে গেল, কত টাকার ফল কেনা হবে, আত্মীয় স্বজনের জন্য কি কি উপহার কেনা হবে। সে বছর ইদের মাস খানেকের মধ্যেই দুর্গোৎসব ছিল, ফলে একত্রে পরিকল্পনা হত। দেখতে দেখতে রমজান এসে গেল। নজরুল সাহেবও অনুপ্রাণিত হয়ে কঠোর রোজা রাখতে শুরু করলেন। অফিসে ঢুকেই আমার প্রথম কাজ ছিল গতকাল কে কি খেয়ে রোজা ভেঙেছেন এবং সকালে কি সেরগি সেরেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ নেওয়া। আমার উৎসাহ দেখে নাজিম সাহেব ঠাট্টা করে বলতেন, “ এক কাজ করেন, আপনিও বৃহস্পতি আর শনিবার উপবাস শুরু করেন। তাতে ওজন টাও কমে!!!” একদিন চা ওয়ালা চা দিয়ে গেছে, আমরা তিনজন একত্রে কাজ করছিলাম, কথা বলতে বলতে যেই চা টা মুখে তুলেছি, নজরুল সাহেব হাঁহাঁ করে উঠলেন, “ কর কি? রোজাদারের সামনে কিছু খাওয়া কিন্তু গুণাহ। ”

প্রকৃত খুশির ঈদ এলেই নাজিম বউদি আমাদের জন্য মিষ্টি পরোটা আর চিকেন পাঠাতেন। সাদা ময়দাতে খাঁটি গাওয়া ঘির ময়ান আর দুধ দিয়ে মাখা, তারপর ভাজা। সাথে সরু সুতোর মত সিমুই। ঘিয়ে ভাজা, কাজু কিশমিশে সম্পৃক্ত। সে স্বাদ আজো মুখে লেগে আছে। এই দেবভোগ যে শুধু আমাদের তিনজনের জন্য আসত তা নয়, শ্রী অঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের জন্য ও আনতেন নাজিম সাহেব। দুর্ভাগ্যবশত অঞ্জনদা একবার অনুপস্থিত ছিল। পরের দিন সব শুনে এক প্রস্থ কপাল চাপড়ে, নাজিম সাহেবকে ধরলেন, ‘বড়খাসি’ খাওয়াতে হবে। নাজিম সাহেব কিছুতেই রাজি নন। অঞ্জনদাও নাছোড়বান্দা। শেষে নাজিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,“ধুর মশাই । আপনার ধর্মে তো একটি জিনিসই খাওয়া নিষেধ। সেটা মানুন না। তাছাড়া কোন মুসলমান বাড়িতে আপনাকে গরুর মাংস দেওয়া হবে না। ”আমি আর অঞ্জনদা সমস্বরে বলে উঠলাম, “কেন?” “ কারণ আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে। কারো ধর্মে নিষেধ থাকলে, তাকে ঐ জিনিস খেতে দেওয়ার অর্থ গুণাহ।”

গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে অনেকে অনেক কিছু লিখে ফেলেছেন, আমি শুধু আমাদের হুসেন মিয়াঁর একটা কথা লিখে শেষ করব।হুসেন মিঞা ছিল আমাদের অবসর প্রাপ্ত ক্লার্ক। রিএমপ্লয়মেন্টে ছিলেন। আমি বলতাম উনি আমার অভিভাবক। রোজ কিছু না কিছু ফেলে আসতাম অফিসে। পেন ড্রাইভ, চশমা, হেড ফোন মায় হাতঘড়ি পর্যন্ত । হুসেন মিঞা যত্ন করে তুলে রাখেন। অনেক রাত পর্যন্ত ফাঁকা অফিসে একা কাজ করতাম জানতাম হুসেন আছে। চার বার দেখে যাবে, কি করছি। অথচ পান থেকে চুন খসলে কি বকুনি না খেত। ক্ষমা চাইলে বলত, “ধুর বাবা। আপনি আমার মেয়ের মত। কতবার বলব? আপনার কথায় কি মনে করব। ” সেবার বকরিদ্ এর পর হুসেনের সাথে কথা হচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করলাম,“কোরবানিতে কি দিলেন? ”
“ঐ যে বড় বড় খাসি গুলা হয় না। ”
“অ। গরু?”
“না। না। খাসি-খাসি। গ্রামের দিকে বড় বড় খাসি হয় না? ঐ গুলা”
“ দুম্বা ? ঐ গুলোকে দুম্বা বলে তো?”
“উফ। আপনি কিচ্ছু চেনেন না। বলছি খাসি। গরু, দুম্বা কি সব বলছেন” হাসতে হাসতে বললেন হুসেন মিঞা।
“ মানে, ছাগল তাই তো?”
“ হ্যাঁ রে বাবা। ”
“ না খাওয়ালে বুঝব কি করে?” হেসে উঠলাম উভয়েই। জিজ্ঞাসা করলাম,“গরু কেউ দেয়?”
“ দেয় ম্যাডাম। গরিব মানুষ দেয়। দুচারজন মিলে দেয়। মাংসটাও অনেকটা হয় কি না”। মনটা হঠাৎ ভারি হয়ে উঠল। যে দেশে মানুষ অনাহারে মরে, তারা লড়ে যাচ্ছে কি নিয়ে?
যাই হোক কাল খুশির ঈদ। খুব খুব ভালো কাটুক সকলের। ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল সকলের জন্য। আর আমার দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু, আমার প্রাক্তন বস আর আমার হুসেন মিয়াঁর জন্য রইল অনেক ভালবাসা। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, এই আসন্ন ঘোর মহানিশায় আপনার আমার মত সাদা বোকাসোকা মানুষের বড় প্রয়োজন।
#ঈদ_মোবারক
অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬
আমাদের বাড়িটা বেশ পুরানো। বাবার ঠাকুরদা যখন বানিয়েছিলেন তখন বাস্তুভিটা সহ সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত বিঘা। যার মধ্যে দুটি বিশাল পুকুর ছিল, একটি সর্বসাধারণের জন্য এবং অপরটি বাড়ির মেয়েদের জন্য খিড়কি পুকুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে যখন ভাঙন ধরল, তখন অনেকটা জমিই বিক্রি করে দেওয়া হল। আমাদের জ্ঞানত শুধু বাস্তুভিটাটুকুই ছিল, যার পরিমাণও কিছু কম ছিল না, খাতায় কলমে চোদ্দ কাটা। যদিও পরবর্তীকালে মেপে এগারো কাটা পাওয়া গিয়েছিল, বাকি তিনকাটা জমি কবে যেন চুরি হয়ে যায়।

এতবড় বাড়িতে যত না মানুষ, তার থেকে অনেক বেশী ছিল গাছপালা। সুউচ্চ সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ত এক বিশাল কাঁঠাল গাছ। আমাদের বাড়ির নামই ছিল “কাঁঠালগাছওয়ালা বাড়ি”। কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে এগিয়ে এলেই অতিকায় শান বাঁধানো উঠোন। উঠোনের পূর্ব দিকে ছিল একটা আম গাছ, এত মিষ্টি আম আমি জীবনে খাইনি। তার পাশে ছিল একটা নাগকেশর গাছ, উঠোনের পশ্চিম কোনে ছিল বিশাল বেল আর পেয়ারা গাছ। আবার বলছি এত মিষ্টি পেয়ারা খুব কম খেয়েছি। এই আম এবং পেয়ারার লোভে আসত হনুমানের দল। আমাদের বাড়িতে হনুমানের উৎপাত ছিল প্রবাদ প্রতিম।
তখনও চাটুজ্জে বংশের দুর্দিন শুরু হয়নি। দাদু ছিলেন খুব শৌখিন।দোতলার দালানে বিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না ওলা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতেন। টেবিল ভর্তি থাকত দামি দামি ফরাসি আফটার শেভ আর পারফিউমের বোতলে। সেসব কাটগ্লাসের বোতলের ভগ্নাংশ মাত্রই আমরা দেখেছি। যাই হোক দোতলার দালান জুড়ে ছিল ৯টা গারদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডো।  পাশেই ছিল আম গাছটা, একদিন হনুমান ঢুকে দাদুর দামি আফটার শেভ খেয়ে নিয়েছিল। তারপর সেই মাতাল হনুমান নাকি শোলের ধর্মেন্দ্রর মত দোতলার বারন্দা থেকে “সুসাইড” করতে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মেজদাদু আর ছোটদাদু নীচে শতরঞ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মাতাল হনুর মাৎলামির গল্প আমরা রোজ একবার করে ঠাকুমার কাছে শুনতে চাইতাম।
জেঠুর সাথে হনুমান গুলোর ছিল বেজায় দোস্তি। দোতলার বারন্দায় দাঁড়িয়ে, জেঠু উদাত্ত গলায় ডাকত, “আয়-আয়-আয়-আয়-আয়”। অমনি দুদ্দাড় করে ছুটে আসত হনুমানের দল। জেঠু একটা একটা করে কলা বাড়িয়ে দিত, ওরাও লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এসে একে একে নিয়ে যেত। এরকমই একদিন জেঠু হনুমানকে কলা  খাওয়াচ্ছিল, উল্টো দিকে রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে বসে বাবা ভাত খাচ্ছিল, পাশে ঠাকুমা বসেছিল। শেষ পাতে দুধভাত খেতে খেতে হঠাৎ কি ভাবল বাবা কে জানে, এক গাল দুধ ভাত নিয়ে ওপর দিকে দেখিয়ে বলল, “খাবি?”হনুমানটা তৎক্ষণাৎ কলার খোসাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সড়সড় করে নেমে এসে সোজা বাবার কোলে। কোলে বসে হাত বাড়িয়ে দিল, হনুমানের গায়ে নাকি সাংঘাতিক দুর্গন্ধ হয়, বাবার অন্নপ্রাশনের ভাত গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল, তারওপর হনুমানের বিখ্যাত চড়ের ভয়। ভয়ে বাবার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না, কোনমতে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কি করব?” ঠাকুমার বরাবরই ভয়ানক সাহস,  নির্বিকার চিত্তে বলল, “ডেকেছ যখন, ওর হাতে ভাতটা দাও।“একগাল ভাত খেয়েই কিন্তু হনুমানটা বাবার কোল ত্যাগ করে, আর জ্বালায়নি।
আমার মা এবং কাকিমা দুজনেই চাকুরীরতা ছিলেন। আমরা তিন জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন ঠাকুমা-পিসির কাছেই মানুষ। তারমধ্যে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন হলাম কয়েক মাসের ছোটবড়। দুটো সমবয়সী বাচ্ছার দেখাশোনা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। বাচ্ছা দেখার কোন লোক ঠাকুমা রাখতে দিত না, বিশাল সংসার এবং দুটো দুধের বাচ্ছার দায়িত্ব একাহাতে সামলাতে হত ঠাকুমা-পিসিকে। দুপুর বেলা খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমাকে রেখে আসা হত দোতলার উত্তর পশ্চিমের ঘরে, ঠাকুমার বিয়ের বিশাল উঁচু খাটে, চারদিকে বালিশ দিয়ে ঘিরে। আর ভাইকে শোয়ানো হত একতলার দক্ষিণ পশ্চিম দিকের ঘরে একই ভাবে। মাঝে মাঝে পিসি এসে দেখে যেত ঘুম থেকে উঠেছি কি না। একদিন এরকমই দেখতে এসে দেখে দুটি অতিকায় কালো মুখো হনুমান আমার পাশে খাটে বসে আছে। পিসিকে দেখেই দুজনে দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছে, ভয়ে পিসি তো প্রবল চিৎকার জুড়ল। কি ভাগ্যি সেদিন ও জেঠু বাড়িতে ছিল, ঝুল ঝাড়া নিয়ে দুটোকে তাড়া না করলে কি হত কে জানে। আমৃত্যু অবশ্য জেঠু আমাকে খেপাত যে আসলে ওটা ছিল হনুমান রুপী রাজপুত্র। জেঠু অবশ্য সর্বত্রই আমার জন্য ছদ্মবেশী রাজপুত্র দেখত। আমাদের একটা বিশাল হুমদো হুলো ছিল। তাকে দেখলেই ভয় করত। নাম ছিল “অমিতাভ”। মাঝে মাঝেই সে চার হাতপা উল্টে মরার ভান করে পড়ে থাকত। গোটা বাড়ির লোক এককাট্টা হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিত, যে এই মরা বিড়ালটাকে কে কোথায় ফেলতে যাবে, অমনি তিনি আড়ামোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেন। যখনি আমি একা দোতলা থেকে একতলায় নামতে যেতাম, ঠিক তখনি তার একতলা থেকে দোতলায় ওঠার প্রয়োজন পড়ত, মাঝপথে দেখা হত দুজনার, অমিতাভ মুচকি হাসত, মানে হাসত কিনা জানি না,মনে হত। আসলে আমি তখন বড়ই ছোট, আমি কিছুতেই  হাসতে পারতাম না, উল্টে চিল চিৎকার জুড়তাম, যতক্ষণ না সকলে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে আসত এবং অমিতাভ সিঁড়ির জানলা গলে ফুড়ুৎ হত। প্রতিবারই জেঠু বলত, “এ হে হে, ভয় পেলে হবে? ওটা বেড়াল ছিল না, ওটা ছিল বেড়াল রূপী রাজপুত্র।“ সত্যি কি মিথ্যা অবশ্য শৌভিক ভট্টাচার্যই বলতে পারবে।
(চলবে?)

অনির ডাইরি ১৫ই জুন ২০১৭
কি যে ভারতের খেলা চলছে, অফিস থেকে ফিরে বর একদম টিভির সাথেই চিপকে আছে। এই সময় দোকান যাবার কথা বললেই দাম্পত্য  কলহ অনিবার্য। অগত্যা তুত্তুরী আর আমাকেই নামতে হল। রাত হয়ে গেলেই হাউসিং এর কুকুর গুলো এমন ঘেউঘেউ জোড়ে যে কি বলব।
সওদা করে মেয়ের সাথে খোশ গল্প করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে উঠে ফ্ল্যাটের বেল বাজালাম। ও মা নীচের তলার মালয়ালি আন্টি দরজা খুলে দিলেন। সেই যে আন্টি, যিনি এককালে এক নামী কনভেন্ট স্কুলের বড় দিদিমণি ছিলেন।  যাঁর বয়স সত্তর কিন্তু তাঁকে নাকি দেখে পঞ্চাশ মনে হয়। যিনি শর্ট মিনি ড্রেস আর ধোপ দুরস্ত ট্রাউজার্স ছাড়া কিছু পরেনই না। যাঁর প্রতিটি সুপ্রভাত হয়, স্কুল যাবার জন্য আমার সদ্যোত্থিত কন্যার চিল চিৎকারে। অতঃপর আন্টি তাঁর ঝিঙ্কু নাইটড্রেস আর তুলতুলে স্লিপারস্ সামলে গটগট করে ওপরে উঠে আসেন, এবং অবোধগম্য বিলায়ইতি অ্যাকসেন্টে আমাকে বকতে থাকেন, যতক্ষণ  না মাকে জব্দ হতে দেখে আমার কন্যার মুখে হাসি ফুটছে।

যাই হোক, এতরাতে আন্টি কি করতে এসেছেন রে বাবা? আর উনিই বা দরজা খুলে দিচ্ছেন কেন? আমার বরটি কি এতক্ষণে যথার্থই  টিভির মধ্যে ঢুকে গেছে? আন্টি দরজা আধখোলা করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলেন, “ইয়েস মাহ্ ডিয়ার?”মুখে দেখন হাসি হাসলাম বটে, মনে মনে বললাম, “এতরাতে কেন জ্বালাতে এসেছ বাপু?এসেই যখন পড়েছ, দরজাটা তো ছাড়?দেখছ হাতে ভারি মাল আছে--”।  যেমন ভাবা তেমন কাজ, আন্টিকে আলতো করে ঠেলে ঢুকতে গিয়ে চমকে উঠলাম, আমাদের ড্রয়িং রুমটা হঠাৎ  পাল্টে গেল কি করে?এত অন্ধকারই বা কেন?  কি সন্দেহ হতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি লেখা আছে,‘সিসিল ডিসুজা’। সর্বনাশ!ভুল করে আন্টির দরজার বেল বাজিয়ে ফেলেছি। আসলে ঠিক তলার ফ্ল্যাট কিনা, বকতে বকতে ঠিক খেয়াল করিনি কত তলা উঠেছি। আটটা বেজে গেছে বেচারা আন্টি দরজা জানলা বন্ধ করে নির্ঘাত ঘুমিয়ে পড়েছিল গো। কি বলি? কপালে আজো খটমট ইংরেজি গালি লেখা আছে---অর্ধেক বুঝব না এই যা শান্তি।

অনির ডাইরি ১০ই জুন ২০১৭
আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল বড়। সাবেকী কড়ি বরগা, আর্চওলা, পূব, পশ্চিম, দক্ষিণে বাগানওয়ালা হাওয়া মহল। প্রচুর আলো, প্রচুর হাওয়া, প্রচুর লোকজন। কিন্তু বেলা দশটা বাজলেই কেমন যেন ঘুমন্ত দৈত্যপুরী হয়ে যেত বাড়িটা। জেঠু ছিল পাক্কা সাহেব, সাড়ে আটটার মধ্যে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়ত। নটা থেকে সাড়ে নটার মধ্যে যুগলে বেরোত বাবা এবং মা, এরপর জাভা মোটরবাইক ফটফটিয়ে জগাছা হাইস্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত ছোটকাকু। সবথেকে শেষে বেরোত ছোট কাকীমা।
সাথে সাথেই ঝুপ করে নেমে আসত অসীম নীরবতা। গোটা পাড়াটাই যেন জাদুকাঠির স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়ত। দোতলার বিশাল দালান জুড়ে ছিল ন খানা অতিকায় ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। সেই বন্ধ কাঁচপাল্লার ভিতর দিয়ে রোদ ঢুকে আজব আঁকিবুকি কাটত।সেই সোনালী রোদে গড়াগড়ি খেতে খেতে চূড়ান্ত অলস ভঙ্গীতে আড়ামোড়া ভাঙত জেঠুর পোষা মার্জারকূল, দিশাহীন ভাবে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াত একদল চড়াই, মুখে খড়কুটো নিয়ে কোন জানলা দিয়ে ঢুকে কোন জানলা দিয়ে যে বেরোত কে জানে? মাঝখান থেকে আতঙ্কে পাখা বন্ধ করে বসে থাকতাম আমি, যাতে ব্লেডে না কাটা পড়ে। আর ছিল গুচ্ছ খানেক কাক,  পায়রা আর অত্যধিক রাশভারি গুটিকয় ঘুঘু।সময় যেন আর কাটতেই চাইত না।
সেই থেকেই বোধহয় তৈরি হয়েছিল অভ্যাসটা।  এখনও যায়নি। বরং দিনদিন ব্যাপারটা বেশ চিত্রাকর্ষক হয়ে উঠছে। আমি সবার সাথে কথা বলি, কখনও অনুচ্চ স্বরে, কখনও বা তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে। যেমন আজ সকালে, লাইটারের ওপর এক প্রস্থ চিৎকার করলাম, “কোথায় গেলি?দেখছিস তাড়া আছে, ঠিক এই সময় লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছে হল বাবা?” পরবর্তী বাক্যালাপ, ভেটকীর সাথে,“ভাঙিস না সোনা। ভাঙিস্ না বাপ। প্লিজ্। অন্তত মেসোমশাইয়ের পিস্ টা ভাঙিস না। ধুৎ মান সম্মান আর রাখলি না দেখছি। ছিঃ। ” এরপর পার্শের পালা, “দেখিস ওল্টাবার সময় ছাল খুলে ফেলিস না যেন। যাঃ সেই ছাল খুলে ফেললি? ধুৎ । ”এটাই বোধহয় এই ডিজিটাল দুনিয়ায় আমার নিজস্ব অ্যানালগ কল্পনার জগৎ। বয়স বেড়েছে কিন্তু জগৎটা পাল্টায়নি। মন্দ নয় বরং বেশ কৌতুকপূর্ণ।
অনির ডাইরি ৯ই জুন ২০১৭

আচ্ছা তাহলে আপনার একজন মহিলার ওপর গোঁসা হয়েছে। নাকি গরম ফুলকো লুচির মত হাল্কা ফুল্কো অভিমান? যাই হোক সবই তো সাময়িক ব্যাপার মশাই। কাল হয়তো ঘটনাটি আপনার মনেও থাকবে না, সময়ের ধুলি জমতে জমতে হারিয়ে যাবে মনের কোন গোপন অলিগলিতে। কিন্তু আজ?আজ আপনার রক্ত ফুটছে, গলা ইস্পাতের মত গরম ক্রোধ আপনার শিরা-ধমনীকে ব্যতিব্যস্ত  করে তুলছে। অথচ সেই আঘাতকারীনীকে পাবেন কোথায়?হয়তো সেই নির্লজ্জা লেডিজ সিট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও জেনারেল সিটে পুরুষ বন্ধুর বা বৃদ্ধ বাবার বাহুলগ্না হয়ে বসেছিল। আপনি তাকে স্বনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন লেডিজ সিটে সরে যেতে, সেই মহিলা সদর্পে আপনাকে জবাব দিয়েছিল, এটা সর্বসাধারণের সিট, পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত তো নয় মশাই। ব্যস্ ঐ যে কি বলে, যত বড় মুখ নয় ততো বড় কথা?ক্ষোভ ওগরাবেন কোথায়?কেন?ফেসবুক আছে তো?দিন মশাই একটা জম্পেশ স্ট্যাটাস্। দাঁড়ান শুধু এক অপরিচিতা আধুনিকা উচ্চ শিক্ষিতা(?) জন্তুকে খিস্তি মেরে কি ঠিক আরাম হল? নাঃ আরে সেই জন্যই তো,  ফেমিনিজম্ শব্দটা ভুলে গেলেন? দিন। এক্ষুনি গালি দিন। আরে এত রকমের ইজম্ আছে, কম্যুনিজম্, সোশালিজ্ম্, সেকুইজম্, ফেকুইজম ইত্যাদি ইত্যাদি। তা নয় ফেমিনিজম্?ইশ্ ছিঃ। ওয়াক্ থুঃ।
ফেমিনিস্ট বলে গালি দেবেন তবে না শান্তি। একজন অভব্য মেয়ের জন্য সমগ্র মেয়েজাতিকেই গালি না দিলে চলে? তারপর ধরুন কোন মহিলা,  বিগত দিনে হয়তো তিনি আপনার পরম সুহৃদ ছিলেন, আপাততঃ কোন তুচ্ছ বা অনতুচ্ছ কারণে আপনার ওপর চটে গিয়ে দিলেন একটা আক্রমণাত্মক পোস্ট করে। এবার আপনার পালা, আপনি ভাবছেন ভাবছেন ভাবছেন--- তারপর লিখছেন লিখছেন লিখছেন। আঃ দারুণ। কি দিলেন মশাই। পুরো মাখন। পুরো চাবুক।
ব্যস্ শেষ? নাঃ। দাঁড়ান এ তো হল পোস্টের জবাবে পোস্ট। কিন্তু নারীজাতি?তাদের জবাব দেবেন না? দিন না মশাই। ফেমিনিজম্ তুলে খিস্তি মারুন। হতচ্ছাড়া ফেমিনিস্ট গুলোর জন্য দেশটা উচ্ছন্নে গেল গো। কি যেন বলে ঐ ফেমিনিস্ট গুলো একজন মেয়ে আদৌ সন্তানধারণ করবে কি না সেটা সে সিদ্ধান্ত নেবে? এতবড় স্পর্ধা? মাতৃত্ব বলে এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখ। নাহলে মেয়েদের প্রয়োজনটা কি?বাজে মেয়েরাই তো ফেমিনিস্ট হয়। এই যে গুরুগ্রামের মেয়েটা নির্ঘাত ফেমিনিস্ট ছিল। তাই তো বরের সাথে ঝগড়া করে মধ্যরাতে গৃহত্যাগ করেছিল। কি সাহসরে মেয়ে তোর?নিকষ রাতে দুজন অপরিচিত পুরুষের মাঝে বসে বাপের বাড়ি যাবি?পেলি তো উচিত শিক্ষা? ঠিক হয়েছে। ফেমিনিস্টদের এটাই হওয়া উচিত। মাঝখান থেকে শুধু ছয় মাসের বাচ্ছাটাই---সেটাও অবশ্য মেয়েই ছিল।

অনির ডাইরি ২১মে ২০১৭
মায়ের অনেক চুল ছিল। ঘণ কালো, ঢেউ খেলানো, কোমর ছাপানো চুল। মা চুল খুলে শুত, চুলের গোছা মাটি স্পর্শ করত। আমাদের খাটটা কিন্তু অনেক পুরাণো, ঠাকুমার বিয়ের খাট। আসলে খাটটা ছিল ঠাকুমার ঠাকুরদাদার। ওণার অন্তিম ইচ্ছা মোতাবেক নাতনীর বিবাহের সময় সাবেকী আবলুস কাঠের জম্পেশ খাটটিকে পালিশ করে যৌতুক দেওয়া হয়। সেই বিশাল উঁচু খাট থেকেও মায়ের চুল মাটি চুম্বন করত।
কানাঘুষো শোনা যায় যে মায়ের উদারতা এবং গুণমুগ্ধতার পাশাপাশি মায়ের কাজল কালো আয়ত চক্ষু এবং কেশদামই বাবাকে অনুরক্ত করে তুলেছিল। ঠাকুমা কদাচিৎ পুত্রবধূদের প্রশংসা করতেন, কিন্তু তিনিও বলতেন আমার মা হল কুঁচবরণ কন্যা যার মেঘবরণ কেশ।

মা শুধু নয়, মাসিদেরও ছিল সাংঘাতিক চুলে মাথা। বিশেষতঃ সেজ মাসির। সাটিনের মত মসৃণ সোজা কোমর ছাপানো চুল। চুলের রঙ হল অদ্ভূত লাল। আমরা একগাদা অর্থ ব্যয় করে ঐ রকম রঙ করাই। কেউই খুব একটা চুলের যত্ন করত না বা করেও না। বিগত বিশ বচ্ছর ধরে রোজই মায়ের থোকা থোকা চুল ওঠে, কিন্তু তাও তা কোমর বা কামরা যাই হোক স্পর্শ করে।
মা বলত বা এখনও বলে তেলে জলে চুল। অর্থাৎ রোজ চুলে তেল দাও এবং মাথা ভেজাও। আর রাতের বেলা গোড়া এঁটে শোও, অর্থাৎ দড়ি দিয়ে চুল বেঁধে শোও না হলে চুলের গোড়া আলগা হয়ে যায় এবং বালিশে ঘষা খেয়ে ডগা ফেটে যায়।
মাথায় নিজে নিজে তেল মাখলে হবে না, কাউকে ঘষে ঘষে মাখাতে হবে। কে মাখাবে ঠাকুমা ছাড়া? ঠাকুমারও অনেক চুল ছিল,  একদম আমার মত কোঁকড়া চুল। ঠাকুমার কাছে তেল মাখা ছিল এক বিড়ম্বনা। শালিমারের নারকোল তেলের টিনকে ফুটো করে কাঁচের শিশিতে তেল ঢেলে রাখত ঠাকুমা। সেই তেল বিলি কেটে কেটে গোটা মাথায় জবজবে  করে লাগানোর পর, বেশ খানিকটা তেল হাতে নিয়ে চুলের ডগা ভেজাত। বাপরে বাপ। শ্যাম্পুকে বলা হত মাথা ঘষা এবং তা শুধুমাত্র  রবিবারে করার অনুমতি জুটত। ফলে সহজেই বোধগম্য হয় যে  ঠাকুমার কাছে একেবারেই তেল মাখতে ইচ্ছুক হতাম না। পিসির দায়িত্ব ছিল সন্ধ্যা নামার আগে চুল বেঁধে দেওয়া। একদম ছোটবেলায় লাল ফিতে দিয়ে বেড়া বা কলা বিনুনি   এবং একটু বড় হতে কালো দড়ি দিয়ে খোঁপা। জেঠাইমা দিদিভাইয়ের আইবুড়ো বেলার একরাশ প্লাস্টিকের কাঁটা বার করে দিয়েছিল যাতে আমার মাথায় না ব্যথা লাগে। চুল কাটলেই বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত। মা একবার সদ্যখোলা এক পার্লার থেকে চুল কাটিয়ে আনায় জেঠু এমন রাগারাগি করেছিল যে আর কেউ আমার চুলে হাত দেবার সাহস পেত না। দিদিভাই অর্থাৎ আমার জেঠতুতো দিদির ও একরাশ চুল ছিল,  বিয়ের পর টুলটুল দাদা অর্থাৎ জামাইবাবুর আব্দারে দিদি যখন ঐ কেশরাজিতে কাঁচি চালালো বাড়িতে প্রায় কান্নার রোল উঠেছিল। আর লকস্ কাটা তথা ভ্রু প্লাক্ করার পর জ্যাঠাইমা যে ভাষণে দিদিভাইকে সম্ভাষিত করেছিল তা আর জনসমক্ষে প্রকাশ করছি না। একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন শৌভিকের আব্দারে আমি চুল ছোট করেছিলাম গত পূজায়। মা জ্যাঠাইমা সম্মিলিত ভাবে হাউমাউ  জুড়ে দিয়েছিল। শৌভিকের নাম করতেই সব শান্ত। বাবা শুধু ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছিল, “তোমার বর সব বোঝে। যাক কি আর করার আছে? এবার বরং নীলাচলে মহাপ্রভু কাট্ টাও দিয়ে নাও। ”

বলাইবাহুল্য যে বিদ্যালয় জীবনে কিছুটা  নিয়ম মেনে চললেও মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশের সাথে সাথে মহা পাখনা গজালো। তেলের ছুটি, মাথায় বাঁধার দড়ি যে কোথায় হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল কাঁটা গুলোও। চুলের গোছাও হাল্কা হতে লাগল। মহিলা শ্রমিক হবার সাথে সাথেই কোঁকড়ানো কেশগুচ্চ সোজা করে ফেললাম, একগাদা কেমিক্যাল প্রয়োগে। তারপর চুল হয়ে উঠল গিনিপিগ। কখনও কালো, কখনও লাল বা সোনালী। আর আজ? আজ আবার ফিরে গেছি সেই পুরাণো রুটিনে,  ছুটির দিন মানেই ভালো করে তেল মাখা। মেয়েকেও মাখাই জবজবে করে।ঐ অবস্থায় স্কুলেও পাঠাই।  এখন মাখে, কথা শোনে, জানি শুধু ডানা গজানোর অপেক্ষা তারপর ইতিহাস আবার পুনরাবৃত্ত হবে। কি করা? এই তো জীবন মা--_
#অনির_ডাইরি  #Aninditasblog

অনির ডাইরি ১৬ই মে ২০১৭
থেকে থেকে কেন যে মন খারাপ হয়? একেই কি ক্যাথারসিস বলে? ভিতরের সব তিক্ততা, সব নেতিবাচক অনুভূতি চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়? আজই যেমন, সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফিরছি,  মেঘলা ভোর, ক্লান্তির চাদর সরিয়ে তখনও ঘুম ভাঙেনি এই শহরেরে,  হঠাৎ  চোখের সামনে ভেসে উঠল, আমাদের সাবেকী বাড়ির ছবিটা। এককালে গমগম করত। ঠাকুমা, মেজপিসি, বাবারা তিনভাই,  মায়েরা তিন বউ,  আমরা তিন ভাইবোন। এছাড়াও দু দুজন ছিলেন যাঁদের আমরা আজ ও গৃহপরিচারিকা বলে ভাবতে পারি না। এছাড়াও সবৎসা দিদিভাই আর পিসিদের আনাগোনা লেগেই থাকত। দিদিভাই অর্থাৎ আমাদের জেঠতুতো দিদি বেশ কিছুদিন বাপের বাড়ি না এলে, বাবা বা ছোটকাকুর সাথে গিয়ে আমরা হামলা করতাম দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদি না আসতে পারলে বোনঝি কেই তুলে নিয়ে আসা হত। সারাক্ষণ সরগরম থাকত বাড়ি। মা এবং কাকিমা দুজনেই চাকুরি করতেন, ফলতঃ গরমের ছুটি পড়ুক আর নাই পড়ুক যেই মায়েরা বেরিয়ে যেত আমরা শুরু করতাম উদ্দাম দুষ্টুমি। ঠাকুমা বলত, “বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর। ”
বাড়িতে প্রচুর গাছ ছিল, উঠোনের ওপর দক্ষিণে ছিল একটা বিশাল কাঁঠাল  গাছ, আমাদের বাড়ির নামই ছিল কাঁঠাল গাছ ওলা বাড়ি। এছাড়াও বাগান ভর্তি ছিল আম, নাগকেশর, পেয়ারা, বেল, যজ্ঞিডুমুর, ডুমুর গাছে।  একটা বট আর একটা অশ্বত্থ গাছ জড়াজড়ি করে উঠেছিল। নিম গাছ ও ছিল। বাবা ভয় দেখাতো, ওটা নাকি পঞ্চমুণ্ডির আসন। ওর নীচে দুষ্টু ছেলেদের কাটা মুণ্ডু পোঁতা আছে। কোন শনিবার যদি অমাবস্যা পড়ে, সেই কাটা কবন্ধ গুলো আসে নিজেদের মুণ্ডু খুঁজতে। আজ এই বৈদ্যুতিন আলোতে লিখতে যতই হাস্যকর লাগুক আমরা তিন ভাইবোন যমের মত ভয় পেতাম। যেদিন আমাদের দুষ্টুমি মাত্রাছাড়া হয়ে যেত,  ঠাকুমা বাবাকে নালিশ করত চুপি চুপি। ভূলেও মায়েদের করত না অবশ্য, কারণ মায়েরা সারাদিন অফিস করে ফিরে শাশুড়ির মুখে এই নালিশ শুনলে সোজা চামড়া ছাড়িয়ে ডুগডুগি বানাতো। বাবার মাথা বরাবর ঠাণ্ডা, বাবা শুধু তিনটেকে ছাতে নিয়ে গিয়ে ভূতের গল্প শোনাতো। তাতে যথাযথ সঙ্গত করত জেঠু। এমন রহস্যময় ভঙ্গীতে ভূতের গল্প জীবনে কাউকে বলতে শুনিনি। ভূতের সঙ্গে প্রীতি বোধহয় সেদিন থেকেই।
গরম কালে ভয়ে মরতাম তাও ছাতে শোবার লোভ সামলাতে পারতাম না। তখন রাতের পর রাত লোডশেডিং থাকত। নিশ্ছিদ্র  অন্ধকার চরাচরে, একটা নিভু নিভু হ্যারিকেনের আলোয় ছাতে জমাটি আড্ডা, যার মূখ্য বস্তু তথা চরিত্র হল ভূত। আমাদের দেড় দুশো বছরের পুরানো বাড়িতে এমনি ভূতের অভাব ছিল না তার ওপর আমরা তিন ভাইবোন তো ছিলামই।
কি মজা, হৈচৈ এ কেটে গেল আশি নব্বইয়ের দশক। সবার বয়স বাড়ছিল, কিন্তু কেউ যেন পাত্তাই দেয়নি। সুগার প্রেসার কোলেস্টেরল চাটুজ্জে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোলেও শুধু নামমাত্র ছিল। ২০০৫এ ঠাকুমার মৃত্যুটা ছিল যাকে বলে কফিনে শেষ পেরেক। ঠাকুমা বলত, “আমি যতদিন বেঁচে আছি আমার পরিবারের কাকো কোন ক্ষতি হতে দেব না”।  কি অব্যর্থ ছিল ঠাকুমার ভবিষ্যৎ বাণী ঠাকুমার মৃত্যু ধসিয়ে দিল বালির বাঁধ। বিগত বারো বছরে ঝপাঝপ চলে গেল জেঠু,  কাকু,  বড় পিসি,  দুই পিসেমশাই। কি জলদি থপথপে অথর্ব হয়ে পড়ল বাকিরা। আমাদের সেই সরগরম বাড়ি, আজ শান্ত প্রাসাদপুরী। ছাতে বহুদিন কেউ ওঠে না। কে উঠবে?দোতলায় উঠতেই ওদের হাঁটু মচমচ করে তিনতলায় ওঠার লোক কই? অধিকাংশ জানলা খোলাই হয় না, বিশাল দালান জুড়ে ছিল ন খানা খোলা অতিকায় ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। আজ নিরাপত্তার স্বার্থে তা গ্রীলের বাঁধনে আবদ্ধ।
আজন্মলালিত বাড়িটায় গেলে মন ভারি হয়ে যায়। হয়তো এরই নাম জীবন। যা হারিয়ে যায় তা আর ফিরে আসে না, আর যেটুকু পড়ে থাকে তাকেই আঁকড়ে বেঁচে থাকি আমরা আর রোমন্থন  করে যাই সুখস্মৃতির।

https://amianindita.blogspot.com

অনির ডাইরি ১৪ইমে ২০১৭
আজ মা দিবস। সকাল থেকে বা বলা যায় কাল মধ্যরাত্রি থেকে যাঁরা মেসেঞ্জার হোয়াট্সঅ্যাপ ইত্যাদি ইত্যাদির মাধ্যমে আমাকে শুভেচ্ছা  জানিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে অজস্র ধন্যবাদ। যদিও আমি তাদের কারোরই জননী নই,  তবু আশির্বাদ করি বেঁচে থাকো বাবা মায়েরা। সুখে থাকো।

আজ ফেসবুক ভর্তি শুধু মায়েদের ছবিতে। অনেকেই মায়ের সাথে সেল্ফি পোস্ট করেছেন। কেউ আবার সন্তানের সাথে। আমার এক বন্ধু তো বউ ছেলের ভিডিওই পোস্ট করে দিয়েছে। খুব ভালো লাগল দেখে।  আমার ও ইচ্ছা করছিল, প্রবল ইচ্ছা এখনও করছে একটা ছবি অন্তত--- শৌভিক খিল্লি করলে করুক। কিন্তু একে তো তুত্তুরী নেড়ি তায় ফোকলা। আর আমি ? এক গা কালিঝুলি নুন হলুদ মেখে রান্না করছি কি না। পুরানো অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি অবশ্য আমাদের আছে, তবে আমি যে প্রবল বেগে মোটা থেকে আরোও মোটা আরোও বেশি মোটা হতে থাকি, ওসব ছবি লাগালে নাও চিনতে পারেন। আর মা? মায়ের সাথে সেল্ফি আমার প্রায় নেই। মা প্রথমতঃ সেল্ফি বস্তুটি কি তাই বুঝতে চায় না। মা শুধু বোঝে মোবাইলে ছবি তোলা যায়। নিজস্বী না হয়ে নাহয় পরস্বীই হোক। তাতেও মায়ের কোন উৎসাহ নেই। আর মা কখনই ফোটো রেডি থাকে না। হয় রান্না করছে, নয় বাসন ধুচ্ছে, নয় ঝাড়পোচ করছে। যদিও বা কখনও ঠিকঠাক থাকে, ছবি তুলব বললেই মা এমন ভয়াবহ মুখবিকৃতি  করে,  যে -----।  সে তুলনায় বরং বাবার উৎসাহ বেশ বেশী ।
আর মাকে হ্যাপি মাদার্স ডে উইশ করলে কি হবে? মা সঙ্গে সঙ্গে করুণ সুরে বলবে, “আজ মাদার্স ডে? আর আমার মাটাই নেই?” দিদা মারা গেছেন ১৯৯৮ সালে। শুধু শুধু তাঁর কথা মনে করিয়ে মাকে দুঃখী করে লাভ নেই।
যদি বলি, কি উপহার চাও? না জিজ্ঞাসা করে কিনে দিলে যে কুরুক্ষেত্র হবে, শেষে সেটা আমাকে বা বাবাকে ব্যবহার করতে হবে হয়তো, তাই প্রশ্ন করি। জবাব একটই। “ আমার কিছু চাই না। কি হবে?” খুব চাপাচাপি  করলে, বলবে,“বরং তুত্তুরীকে একটা জামা কিনে দে। আমি টাকা দিয়ে দেব। ওর একটা জামাও আর ভালো নেই--”। বোঝো। এটা মাদার্স ডে না ডটার্স ডে? জানি যে আমার সব বন্ধুর মা’রাই বোধহয় এরকম। এটাই বুঝি মায়েদের স্বভাব। মা শব্দটা শুনলেই তো এটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে,  এক আপনভোলা নারী। যে সন্তানের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গীকৃতপ্রাণা। যার প্রায় ছেঁড়া তেল হলুদের গন্ধ ওলা আঁচলের থেকে নিরাপদ স্থান পৃথিবীতে নেই। আর যার বুকের ভিতরটা ঠিক কি দিয়ে যে তৈরি--- ভালো থাকুক সব মায়েরা। তবেই ভালো থাকব আমরা। মা মানেই যে অ্যাটলাস্, আর কে বইতে পারবে আমাদের ভার?

অনির ডাইরি ৯ই মে ২০১৭
রবি ঠাকুরকে নিয়ে কিছু লেখার মত যোগ্যতা বা ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে রবি ঠাকুর হলেন প্রাণের কবি, রাজার রাজা। তাকে তো প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতো করে খুঁজে পায় বা খুঁজে নেয়। প্রথম পরিচয়, সেই শৈশবে মায়ের হাত ধরে। মা ছিলেন সেই যুগের কর্মরতা গৃহবধূ। চাকুরীরতা হলে কেন যে গৃহবধূ হওয়া যায় না, তা আমি সেদিনেও বুঝতাম না, আজ ও বুঝি না। শুধু এটুকু বুঝতাম, সমসাময়িক অন্যান্য মহিলাদের তুলনায় মায়ের জীবন একটু বেশিই জটিল। অফিসে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ এবং বাড়িতে খুড়তুতো পিসতুতো মিলিয়ে একাধিক শাশুড়ি, ননদ, ভাশুর, দেওর, জা সবার সাথে মানিয়ে বা বলা যায় সবার মন জুগিয়ে চলতে হত মাকে।ভোর পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা অবধি দৌড়েই যেত মা, আর মুখে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। মা বলত, “রবি ঠাকুর হলেন দুঃখ নদীর কাণ্ডারি। ন্যুব্জ, বক্র শিরদাঁড়াকে এক লহমায় ঋজু করে তুলতে তিনি অপ্রতিরোধ্য”।

রবি ঠাকুরকে নতুন করে চেনালো আমার বর। নতুন করে আলাপ জমিয়ে দিল দেবব্রত বিশ্বাসের সাথে। পরিচয় তো আগেও ছিল, কিন্তু জীবন যে ছিল নিষ্প্রেম। এ সম্পূর্ণ ভিন্ন আলাপ। কি যে ছিল ভদ্রলোকের স্বরতন্ত্রীতে? যে কোন মুহূর্তে সৃষ্টি করতে পারেন মায়াজাল। কি হেলায় খেলা করতে পারেন মানবিক অনুভূতি গুলিকে নিয়ে। চরম দুঃখের মুহূর্তে জাগাতে পারেন নিবিড় প্রশান্তি, আবার পরম আনন্দেও হৃদয় নিংড়ে তুলে আনতে পারেন গভীর বেদনা। সত্যি রাজার রাজা। দুজনেই। এঁরা না থাকলে “রোমান্স” শুধু বোধহয় একটা শব্দ হয়েই থেকে যেত আমাদের জীবনে।

রবি ঠাকুরের সাথে আরো নিবিড় আলাপ আমার দুই নম্বর বাবা অর্থাৎ আমার শশুর মশাই এর মাধ্যমে। যেমন কান ধরে মার্কেজ পড়িয়েছিলেন তেমনি রবীন্দ্রসাহিত্য। একেবারেই অপদার্থ পুত্রবধূ আমি। সব যথারীতি পড়ে উঠতে পারিনি। যা পড়েছি, খোলাখুলি আলোচনা করতাম বাবার সাথে। কিছু ভালো লাগত, কিছু মন্ত্রমুগ্ধ করে দিত। কিছু আবার ভালো লাগত না। যা ভালো লাগেনি, তা নিয়ে কখনও বাবা আমার বুদ্ধিমত্তা বিচার করতে বসতেন না। বরং মাঝে মাঝে সহমত পোষণ করতেন। উৎসাহ দিতেন। আজো দেন আরো আরো পড়ার জন্য। একই কথা প্রযোজ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও। কিছু গান যেন কিছুতেই ভালো লাগত না। বাবা যে কেন সেই গুলিই বেশী করে শুনতেন কে জানে। শুধু শোনা নয়, শোনাতেন এবং গাইতেনও। এমনি একদিন পার্ক সার্কাস ফ্লাই ওভারের জ্যামে ফেঁসে আছি। বাতানুকূল গাড়িতে যথারীতি রবি ঠাকুরের গান বাজছে। শুরু হল, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে, “ আমার সকল নিয়ে বসে আছি---“। জানতাম বাবার অন্যতম প্রিয় গান। দিনে কতবার যে শুনতেন বা শোনেন তার ইয়ত্তা নেই। একদম সহ্য হত না গানটা। অশোকতরু গেয়েই চলেছেন। আমার মুখভঙ্গীতে বোধহয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল, বাবা সস্নেহে বললেন, “কথা গুলো শোনো।সুরে না পারলে বাণীতে মন দাও। কি ভয়ংকর কথা বলেগেছেন কবি। আমার সকল নিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়--।“এতদিনে কান পাতলাম-
“ যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে- ভালোবাসে আড়াল থেকে-
আমার মন মজেছে সেই গভীর গোপন ভালোবাসায়—“।

আমার জীবনে রবি ঠাকুরের কথা লিখতে বসলে একজনের কথা না লিখলে এ লেখা অসমাপ্ত থেকে যায়, সে হল আমার বান্ধবী দেবারতি। দেবার কাছে রবি ঠাকুর ছিলেন প্রাণের ঈশ্বর। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, রবি ঠাকুর হলেন দেবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। রোজ সকালে আমার আর চৈতালির ইনবক্স ভরিয়ে দিত রবি ঠাকুরের কবিতায়, গানে। নিয়ন জ্বলা সন্ধ্যার নন্দনে দেখা হত আমাদের তিনজনের। অফিস সংসার ভুলে উদ্দাম আড্ডায় মাততাম আমরা, মাঝে ভাগ করে খাওয়া হত কখনও এক ঠোঙা ঝাল্মুড়ি, লেবু চা, একটি দুটি আইসক্রিম অথবা নন্দন ক্যান্টিনের চিটচিটে মালপো। এত অসম্ভব হাহা হিহি করতাম আমরা যে আশেপাশের প্রেমালাপী যুগলরা আমাদের দেখলেই সরে যেত। দেবা চাইত রবিঠাকুরকে ছড়িয়ে দিতে। এই হিংসা, দ্বেষ, কলুষে পূর্ণ ধরাকে একমাত্র ত্রাণ করতে পারেন তিনিই। চৈতালি একবার বলে ফেলেছিল, “রবি ঠাকুর কি মশা মারার তেল? যে ছড়িয়ে দিবি?” তারপর যে প্রবল কলহ বেঁধেছিল তা আর বলছি না। সময় কেটে যায়। আজ কে কোথায় ছিটকে গেছি, শুধু স্মৃতিটুকুই আছে আর আছেন তিনি, রবি ঠাকুর। রাজার রাজা।

অনির ডাইরি ৫ই মে ২০১৭
একটা নেশা চাই। যাতে সম্পূর্ণ বুঁদ হয়ে থাকতে পারি। প্রাত্যহিক  থোড় বড়ি খাড়া থেকে পালানোর একটা মাধ্যম আর কি। রোজ রোজ মদ গাঁজা ভাঙ তো আর খেতে পারি না। একে কূলবধূ মা তায় মা আর সর্বোপরি সরকারী আধিকারিক। তাছাড়া আমার এমন নেশা লাগে,   যার খোঁয়াড়ি কাটার জন্য ২৪ঘন্টা ও যথেষ্ট  নয়।
২০১৬র শুরুটা একাই টেনে দিয়েছিল হ্যারি পটার। যাঁরা পড়েননি, সিনেমা দেখেছেন বা দেখেননি তাঁরা ভাবতেও পারবেন না কি স্বাদে বঞ্চিত আপনার জীবন। আমিও প্রথমে পড়তে চাইনি বিশ্বাস করুন। কেন পড়ব? কতবার দেখেছি। প্রতিটা দৃশ্য ঠোঁটস্থ। তাও পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম দেবশ্রী দি অর্থাৎ শ্রীমতী দেবশ্রী রায়ের অনুরোধ ফেলতে না পেরে।

পড়তে শুরু করে অনুভব করলাম, এ এক অন্য জগৎ। সিনেমার পর্দায় একে তুলে আনা সম্ভবই নয়। জাদুর আড়ালে লুকানো চেনা অচেনা মানবিক অনুভূতির প্রকৃত মায়াজাল।  যা পাঠককে আপ্লুত করার সাথে সাথে ঋদ্ধ করে। পাঠকের ক্যাথারসিস্ হতে বাধ্য।

হ্যারি পটার শেষ হয়ে যাবার পর যে শূন্যতা আমায় গ্রাস করেছিল, তা ভাষায় বোঝাতে আমি অপারগ। কি পড়ি? কি করি?হঠাৎ কি অসম্ভব বিবর্ণ বিস্বাদ হয়ে উঠেছিল আমার জীবন। সুক্ষ্ম - স্থূল কোন অনুভূতিই আর আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না। এমনকি চিরপ্রিয় শরদ্বিন্দু ও মন ভোলাতে পারেনি। বেশ কিছুদিন এই বই সেই বই ঠুকরে বেড়ালাম। অবশেষে মঞ্চে গেম অব থ্রোনস্ এর প্রবেশ। ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমায়। ডুবিয়ে দিল আকন্ঠ। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম জগৎ ও জীবন থেকে। নিন্দুকে বলে জিওটিতে যৌনতা এবং হিংস্রতা মাত্রাতিরিক্ত। একদম ঠিক কথা। সাধারণতঃ ভায়োলেন্স আমি হজম করতে পারি না। কিন্তু জিওটি অতুলনীয়। আজো আমি নিজেকে হাউস স্টার্ক বলে শ্লাঘা বোধ করি। যারা জিওটি এইচবিও তে দেখেছেন তাঁদের জন্য সত্যি করুণা হয়। কারণ এর উপর একবিন্দু কাঁচির দাগ মানা যায় না। আর প্রসার ভারতীর আনুকূল্যে কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

বিগত পুজোটা কেটেছিল পাইন ট্রিলজি আর গার্ল অন দা ট্রেন পড়ে। কিছুতেই তৃপ্ত হতে পারছিলাম না। লুসিফার দেখলাম কিছুদিন। খুব ভালো যে লাগত তা নয়। বরং বেশ সাদামাটা । দেখতাম তো শুধু লুসিফার রূপী ব্রিটিশ অভিনেতা টম এলিসকে। বাকি গল্প গোল্লায় যাক।
শেষ হবার পর আবার বিস্বাদ জীবন। কি দেখি? কি পড়ি? ডিসেম্বর থেকে ধরলাম সুপারন্যাচারাল।  এককালে আমার অন্যতম প্রিয় শো ছিল। ছয় নম্বর সিজন অবধি দেখেছিলাম। তারপর যা হয় আর কি। এতদিনে ১২ টা সিজন হয়ে গেছে। প্রতিটা সিজনে ২৩খানা করে এপিসোড। হোক, তবু দেখতে লাগলাম। বেঁচে থাক জিও কানেকশন আর অ্যামাজন প্রাইম। দুই উইনচেস্টার ভাইয়ের কাণ্ডকারখানায় বুঁদ হয়ে বেশ কাটছিল জীবন। পোড়াকপাল আমার পরশুরাতে শেষ হয়ে গেল। এবার? কি করি? কি করি? কি পড়ি?কি দেখি?

অনির ডাইরি ৪ঠা মে ২০১৭
কর্কশ অ্যালার্মকে দশটা মিনিটের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার আনন্দ- বোধহয় একজন মা’ই সবথেকে বেশী অনুভব করতে পারে। এ যেন সময় নামক পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরা-- যদিও বৃথা প্রচেষ্টা, তবু কিছুটা সময়ের জন্য অন্তত স্তব্ধ হও জীবন। আর দশটা মিনিট -- শুধু দশ। তারপর তো একসাথেই দৌড়ানো-- পারি বা না পারি।

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৫শে এপ্রিল ২০১৭

চোখেও দেখি না। চশমাও পড়ি না। ব্যাগে আছে অবশ্য। আজ যা গরম,  মনে হচ্ছে চশমা পড়লে গরম বেশি লাগবে। আর ফিরছি তো ট্রেনে চশমার দরকারটাই বা কি শুনি? শুধু কোন স্টেশন এল আর কোনটা গেল এটা বোঝাই একটু ইয়ে কি বলে চাপ। ফলতঃ ভয়ানক চোখ মুখ কুঁচকে দেখার বা বলা যেতে পারে অনুধাবন করার চেষ্টা করছি কি লেখা আছে, ওটা কি প? নাকি দ? নাকি উ? ধুত্তোর !!!!!

অনির ডাইরি  ২৪শে এপ্রিল ২০১৭

প্রথম দেখা এক পড়ন্ত বিকালে। আজ তার প্রেমে হাবুডুবু খেলেও সেদিন তাকে পাত্তা ও দিই নি। তার সঠিক মূল্যায়ন তো দূর অস্ত।  মাত্র আট ন মাস হয়েছে আমি কলকাতায় বদলী হয়ে এসেছি। হক সাহেব যেন সেদিন কোথায় গিয়েছিলেন। ‘বামুন গেল ঘর’ বলে আমি এবং শ্রী অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, দুই স্থূলাকায় এএলসি বেরিয়ে পড়লাম যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে। চার্চ লেন যেখানে কিরণশঙ্কর রায় রোডে মিশেছে, আচমকা দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে। দর্শনে আমার বিন্দুমাত্র পুলক না জাগলেও অঞ্জনদার আদিখ্যেতার আর সীমা ছিল না।
কোথায় ফুটপাতে পেতে রাখা নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে গুড়ের গন্ধওলা ধূমায়িত এক কাপ কফি খাব, তা না অঞ্জনদা লাফিয়ে উঠলেন তাকে দেখে। “কফি ছাড়ো। ঐ দেখো--”।
পাক্কা বাজাড়ুদের মত করে উবু হয়ে বসে একটি একটি করে বাছাই করে কিনলেন, আমাকেও গছালেন গুটি কয়। বেজার মুখে বাড়ি নিয়ে গেলাম। পরদিন দেখা হতেই অঞ্জন দা সোৎসাহে বললেন,“কেমন লাগল বল?” “কি” ভ্যাবাচাকা খেতে খেতেও খেলাম না। “অঃ। জানি না তো। মা এখনও অম্বল রাঁধেনি। ”
“অ-ম্ব-ল” এত ব্যথিত অঞ্জন দাকে কখনও দেখিনি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ক্ষোভ, ক্রোধ, বেদনা এবং করুণা খেলে গেল ওনার চোখে। শেষে প্রকাণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“কাঁচামিঠে আমের অম্বল? ভালই হয় বোধহয়। ”
দ্বিতীয় সাক্ষাৎ বছর খানেক পর, খর দ্বি প্রহর, লাল দীঘির ধারে। পূর্ণেন্দু বসু তখন আমাদের মন্ত্রী। রাইটার্স বিল্ডিং এ ওনার চেম্বারে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডের মিটিং ছিল। মিটিং ভালভাবে মিটে যাবার পর, হক সাহেব অত্যন্ত প্রীত হয়ে রজত দা(তৎকালীন অ্যাডিশনাল সিইও) এবং আমাকে বললেন,“চল তোমাদের কিছু খাওয়াই। ” অন্য কেউ এই প্রস্তাব দিলে ধন্য হয়ে যেতাম। কিন্তু স্যারের খাওয়ানো মানে হয় নুন ছাড়া কলা ওঠা ছোলা, না হলে ডাঁশা পেয়ারা, কাঠালী কলা আর তিতকুটে কালো চা। বাপরে !!! আমাদের প্রবল আপত্তিতে কর্ণপাত না, কিনে বসলেন দুটি কাঁচা মিঠে আম। ভালো করে ধুয়ে ছাল ছাড়িয়ে, ফালি ফালি করে, ঝালনুন মাখিয়ে শাল পাতায় মুড়ে ধরিয়ে দেওয়া হল আমাদের হাতে। স্যারের অনুরোধে ঢেঁকি গিললাম। এক টুকরো মুখে দিতেই সব বিতৃষ্ণা ফুঃ। কি অপরূপ স্বাদ। না টক, না মিষ্টি আর তেমনি সুগন্ধ। আর একটুকরো চেয়ে নিলাম, স্যার যে কি খুশি হলেন, তা কহতব্য নয়।
সেই শুরু। তারপর থেকে গ্রীষ্ম মানেই কাঁচামিঠে আম। লিট্টি মাসির প্রতি প্রেম, কাঁচামিঠের আগমনে ফুৎকারে উড়ে গেছে। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরি শুধু কাঁচামিঠের টানে।

আহাঃ আমাদের আবাসনের নীচেই যে এই অমৃতের খনি তা কি ছাই আগে জানতাম? কি ভাল করেই যে মেখে দেয় ছেলেটা-- বিট লবণ, কাঁচা লঙ্কা আর কাসুন্দি দিয়ে-- উফ্ লা জবাব।

অনির ডাইরি ২১শে এপ্রিল ২০১৭
চোখের জল আমার কিছুতেই বাগ মানে না। হৃদয়ের তন্ত্রীতে  সামান্য হিল্লোল ঝরঝরিয়ে ঝরে পরে দুই চোখ দিয়ে। অবাধ্য, অপরিশীলিত অশ্রু কিছুতেই স্থান কাল পাত্র মানতে চায় না। প্রাকবিবাহ প্রণয় পর্বে কোন এক পড়ন্ত বিকালে শৌভিক একবার বলেছিল, “চোখের জল খুব মূল্যবান। তুচ্ছ কারণে তা নষ্ট করতে নেই।তাহলে আর অশ্রুর মান থাকে না। ” এত ভাল কথা কখনও কারো মুখে ইতিপূর্বে শুনিনি। মন ভরে গিয়েছিল।

কিন্তু আমি নাচার। আজো ট্রেন/বাস/লঞ্চ মিস্ করলে আমার কান্না পায়, লিফটে জায়গা না হলে কান্না পায়, রোজ সকালে ঘুমন্ত মেয়েকে ফেলে অফিস যেতে কান্না পায়। প্রতিবার বাপের বাড়ি ছেড়ে বৃদ্ধ বাবা-মা-পিসিকে ফেলে শ্বশুর বাড়ি আসতে কান্না পায়। প্রিয়বন্ধুর সাথে হোয়াট্স অ্যাপে ই-ঝগড়া করে কান্না পায়,গল্পগুচ্ছ পড়লে কান্না পায়, সিরিয়াস ব্ল্যাক- প্রফেসর লুপিন এবং ডাম্বেলডোরের মৃত্যুতে কান্না পায়, শ্লিন্ডার্স লিস্ট দেখলে কান্না পায়।ডিএম সাহেবের ধমকে কান্না পায়।  কি করি? সুদূর মুর্শিদাবাদের ঘোষ বাড়ির রক্ত আছে আমার শরীরে, ঘোষ বড়ির মেয়েরা পান থেকে চুন খসলেই কেঁদে ভাসায়। সবাই নয় অবশ্য। আমার বড় এবং ছোট মাসি যাকে বলে “আয়রন লেডি”। কিন্তু মা এবং অন্যান্য মাসিরা?? অনু মাসি, অর্থাৎ মায়ের খুড়তুতো বোন, বর্তমানে বাঁকুড়ায় থাকেন। অনু মাসিও আয়রন লেডি, কিন্তু সামান্যতম দাম্পত্য কলহ হলেই মেসোমশাই হাঁক পাড়েন,“ওরে বালতি নিয়ে আয়। কর্পোরেশনের কলে জল এসেছে”। প্রথমবার শুনে খুব হেসেছিলাম, কিন্তু শৌভিক যখন তিতিবিরক্ত হয়ে বলে, “এবার কাঁদলেই মারব!!” তখন মেসোমশাই এর অবস্থাটা খুব ভালভাবে অনুভব করতে পারি।
কালরাত্রে যেমন, কান্নার কোন কারণ ছিল না, দিনান্তে তুত্তুরী তার দাদুর ফোনে গল্প শুনতে মশগুল ছিল, শৌভিক ট্যাবে বই পড়তে ব্যস্ত ছিল। হাঁপ ছেড়ে কানে হেড ফোন গুজলাম, এইটা আমার নিজস্ব সময়। এই সময় আমি কারো কেউ নই। কি দেখি?কি শুনি? ভাবতে ভাবতে কখন যে আঙুল কি স্পর্শ করেছে, সুরেলা মধুঢালা কণ্ঠে এলভিস গেয়ে উঠল, “লং ডিসট্যান্স ইনফর্মেশন,গিভ মি মেমফিস্ টেনেসী----”। নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম, কখন যে হৃদয় ফুঁড়ে বেরিয়ে এল শয়ে শয়ে বেদনা, এলভিস গেয়েই চলেছে,

“দা লাস্ট টাইম আই স মারি, শি ওয়াজ ওয়েভিং মি গুডবাই-
উইথ হারি হোম ড্রপস্ অন হার চিক্, দ্যাট টিকলড্ ফ্রম হার আই।
মারি ইজ ওনলি সিক্স ইয়ারজ্ ওল্ড, ইনফরমেশন প্লিজ-
ট্রাই টু পুট মি থ্রু টু হার ইন মেমফিস টেনেসী। ”

সন্তানবিচ্ছিন্ন বাবার হৃদয়ের বেদনা বোধহয় এলভিস ছাড়া আর কেউ এত ভালো ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারত না। এলভিস গেয়েই চলেছে, মাত্র আড়াই তিন মিনিটে সব বলে দিল, কিভাবে তিনজনের সুখী গৃহকোণ আচমকা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল-- আলাদা হয়ে গেল বাবা-মা।  প্রাণাধিকা আত্মজা, আক্ষরিক অর্থে নাড়ি ছিঁড়ে না জন্মালেও নাড়ি ছেঁড়া ধনকে কে ছেড়ে যেতে হল বাবাকে।মাঝে সময় বয়ে গেল নিজস্ব ছন্দে, ছয় বছরের শিশুকন্যা হঠাৎ একদিন থাকতে না পেরে ফোন করে বসল তার বাবাকে। কপালের এমন ফের, ঠিক সেই সময়েই বাড়িতে ছিল না বাবা। বাড়ি ফিরে হতভাগ্য  বাবা জানতে পারে মেমফিস টেনেসী থেকে তার ট্রাঙ্ককল এসেছিল। যে করেছে সে গুছিয়ে কিছু বলতে পারেনি, নিজের নম্বর ও দিতে পারেনি।  মেমফিস টেনেসী থেকে ফোন এসেছিল বলতেই বাবার বুঝতে বাকি থাকে না, কে করেছিল--- । অতঃপর বাবা পাগলের মত  ওপারেটরকে অনুরোধ করতে থাকে, “দয়া করে আমার মারির সাথে যোগাযোগ করে দাও।  মারি নিজের নম্বর দিতে পারেনি।  কি করে পারবে? আমার মারির বয়স যে মাত্র ছয়।শেষ বার মারিকে যখন দেখেছিলাম, ও হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছিল। ওর চোখ ছাপিয়ে দুই গাল বেয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছিল মুক্তোবিন্দু। আমার মারিকে প্লিজ খুঁজে দাও--”।
এই গান শুনে না কেঁদে থাকা যায় বলুন তো?  অতএব ভেউ ভেউ এবং শৌভিক যথারীতি  ট্যাব বন্ধ করে বলল, “আবার??? এবার কিন্তু সত্যি মারব। ” আমার কপাল। ইমোশন মানেই ইমোশনাল অত্যাচার...
............................................................................

অনির ডাইরি ১৩ই এপ্রিল ২০১৭

৮০-৯০ এর দশক ছিল যথার্থই সোনার সময়। কি অপরিসীম শান্তির মধ্যে বড় হয়েছি আমরা। কম্যুনাল টেনশন শব্দদ্বয় ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। হ্যাঁ ১৯৯২এ বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল বটে, দেশজুড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছিল, আমাদের হাওড়াতেও বেশ কিছুদিন কার্ফু চলেছিল। মিলিটারি সাঁজোয়া গাড়ি রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াতো। দেখতে পেলেই গুলি করা হবে, ঘোষণা করা হত, তবু বাবা আর সন্তোষ জেঠু (প্রবাদপ্রতীম নকশাল নেতা সন্তোষ মিত্র) জনমানবশূন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। গাড়ির আওয়াজ পেলেই দৌড়ে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ত। আর হাওড়ার গলি? কাশীকেও লজ্জা দেবে। ব্যাস অল্পদিনের মধ্যেই কার্ফু উঠে গেল, জীবন আবার স্বাভাবিক।

কি যে ভালো ছিল আমাদের ছোটবেলার শহরটা, অনেকটা শীর্ষেন্দু বাবুর গল্পে আঁকা শহর গুলোর মত। চরম বিলাসিতা বলতে ঠাকুমার কিনে রাখা দানাদার, ঠেলা গাড়িতে করে বিক্রি করা ২৫পয়সার আম বা একটাকার চকলেট আইসক্রীম। ছোটবেলায় কটা ক্যাডবেরী পেয়েছি বা খেয়েছি হাতে গুনে বলতে পারি। লজেন্স বলতে ছিল খড়মড়ে প্লাস্টিকে মোড়া পাঁচ দশ পয়সার লজেন্স (যার ভিতরে মধুর মত তরল কিছু থাকত),  আর লাল ললিপপ। দিদিভাই মানে আমাদের জেঠতুতো দিদি যখন বাপের বাড়ি আসত , খুশির আর সীমা থাকত না। সব কুঁচোকাঁচা গুলোকে বিকাল বেলা লাইন দিয়ে ঘুঘনি আর আলুর দম খাওয়াত দিদিভাই। ঘুঘনীকে আমরা বলতাম চটপটী। মাঝে মাঝে দুটো মিশিয়েও খাওয়া হত। সেই টকটক ঝালঝাল স্বাদ আজো মুখে লেগে আছে। লুকিয়ে পাতা চাটার নিষিদ্ধ আনন্দ ভাষায় অপ্রকাশ্য । সেই গোপন আনন্দের স্বাদ ভাগ করে নেবার আশায় মেয়েকে একদিন খাওয়ালাম,  লুকিয়ে যদিও নাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের সমূহ সম্ভাবনা ছিল, তুত্তুরী এক চামচ খেয়েই বলল,“ আর খাব না। বাজে খেতে। ” এত দুঃখ আমি মেয়ের কাছে জীবনে পাইনি।
আজ নীল। আমরা বলি নীলষষ্ঠী। ছোটবেলায় নীল ছিল এক বিশাল আনন্দের ব্যাপার। নীল মানেই লুচি ছোলার ডাল। নীল মানেই মায়ের হাফ ডে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরা। আর ভর দুপুরে মায়ের সাথে মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া। নীল মানেই ঠাকুমার হাতের বেলের পানা। কি অসাধারণ বেলের শরবৎ বানাত ঠাকুমা। বাড়ির গাছের বেল, সাবধানে ফাটাতে হত, মাটিতে আছড়ে ফাটাতে নিষেধ ছিল। বলা হত চৈত্র মাসে মাটিতে বেল ঢুকলে, শিবের মাথায় চোট লাগে। খামোকা শিব ঠাকুরের মাথায় আলু করতে যাব কেন? আমরা ভাইবোনেরা অবাক বিস্ময়ে দেখতাম,  কাটারী দিয়ে সমান দুটুকরো করে বেল ফাটিয়ে,  চামচ দিয়ে কুড়ে কুড়ে, তাতে কুঁজোর ঠাণ্ডা জল আর চিনি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হত। মায়েরা খর দ্বিপ্রহরে খালি পেটে এবং খালি পায়ে পুজো দিয়ে ফিরলে, সাদা কাপড়ে ছেঁকে, পাতিলেবুর রস মিশিয়ে গ্লাসে করে ধরিয়ে দেওয়া হত। তখন ফ্রীজ কোথায়? মহল্লায় একটা ছিল কিনা সন্দেহ। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা, মিষ্টি বেলের পানার স্বাদ আর কোনদিন কোথাও পাইনি। হয়তো সবটাই ঠাকুমার হাতের জাদু ---
কত বছর কেটে গেছে। বারো বছর হল ঠাকুমা নেই। জেঠু কাকু দুজনেই চলে গেছে। বাবা-মা, কাকীমা-জেঠিমা, পিসি এখনও টিমটিম করে টিকে আছে। নীলষষ্ঠী এলেই, যেখানেই থাকি না কেন,  ছুটে আসি হাওড়ায়। প্রিয়জনদের সাথে কাটাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। আমি আসছি জানতে পারলেই, একঝলক খুলির হাওয়া বয়ে যায় চাটুজ্জে বাড়িতে। আশি উত্তীর্ণ  পিসি থপথপ করতে করতে দৌড়য়, পুজোর সামগ্রী কিনতে, ছয় রকমের ফল, ফুল, আকন্দ ফুলের মালা, সিদ্ধি পাতা, ধুতরো ফল, ধূপ, বাতি, পৈতে, মিষ্টি -খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যোগাড় করে প্রতিটা উপকরণ। আর নীলের দিন ভোর থেকে শুরু হয় ডাকাডাকি। “ওঠরে। চান করে নতুন শাড়ি পরে মন্দিরে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি শিবের মাথায় জল ঢালবি, তুই ও চা-জল  খেতে পারবি। তোরা কি আর মায়েদের মত দ্বিপ্রহর পর্যন্ত জলগ্রহণ না করে থাকতে পারবি বাবা?”
এই ভালবাসা অমূল্য, শুধু বুঝতে বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে যায়। সময় বড় নিষ্ঠুর, কিছুতেই আর পিছনে ফেরে না।
অনির ডাইরি ১৯শে এপ্রিল ২০১৭
প্রতিটা বড় মিটিং এর আগেই আমার কান্না পায়। কি পরে যাব? এইসব মিটিং এর প্রাক্কালে প্রায়শই মনে হয়, ওপরওয়ালারা যদি, এই অধমদের মিটিং প্রতি একটা ড্রেসিং অ্যালোয়েন্স দিতেন!!কি ভালোই না হত। নানা সবাইকে দেবার দরকার নেই, পুং রা বাদ। শুধুমাত্র মিটিং এ উপস্থিত মহিলা অফিসার বা কর্মচারিগণকে দিলেই চলবে।

আগে এতটা মনে হত না। কারণ খাস কলকাতায় অধিষ্ঠানের মজাই আলাদা। তিন মাসে,ছ মাসে বস ম্যানেজ করে এক-আধবার নিউ মার্কেট বা গড়িয়াহাট ঘুরে আসাই যেত। নিদেনপক্ষে বাড়ির কাছের সিটি সেন্টারে তো হরবখত যেতাম। আর এখন?? সপ্তাহব্যাপী ইঁদুর দৌড়ের পর আর ভালো লাগে না। ছুটি মানেই, স্বহস্তে রাঁধা জম্পেশ মধ্যাহ্ন ভোজনান্তে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে,  মেয়েকে জড়িয়ে জমজমাট দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা।

সপ্তাহের মাঝে ডাকা বড়সড় মিটিং গুলো তাই পড়ে পাওয়া চোদ্দ  আনা। একে তো সব প্রিয় লেবারগুলোর (বন্ধু, দাদা-দিদি, ভাইবোন) সাথে দেখা হয়, সাথে জমিয়ে ভুঁড়িভোজ।  তিনটের মধ্যে মিটিং ইটিং পর্ব মিটতেই বন্ধুদের তীব্র আহ্বান উপেক্ষা করে দৌড় লাগালাম বাড়ির দিকে। আহাঃ ওদের সাথে যেতে পারলে কি ভালোই না হত। কিন্তু মা হবার যে বড় জ্বালা। বাড়িতে একটা দেড় ফুটিয়া (বাবার ভাষায়)যে পথ চেয়ে থাকবে। মা বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে মিটিং এ গেছে,  তার মানে নির্ঘাত বেকড্ রসগোল্লা খাচ্ছে--।এমতবস্থায় খালি হাতে বাড়ি ঢোকা মানে, প্রবল গৃহযুদ্ধ। এই খর দুপুরে বাড়ির রাস্তায় বেকড্ রসগোল্লা কোথায় পাই? প্রতিবার এই একই  ঘটনা ঘটে, প্রতিবার সোচ্চারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই, তুত্তুরীকে ছাড়া কিছুতেই আর বিসিসিআই এ মিটিং এ যাব না।  যাবই না। বড়সাহেব, মন্ত্রীমশাই যেই ডাকুন না কেন-- তুত্তুরীর মা যাবে না। আর যদি যায়, তাহলে একটা ইয়ে মানে টিফিন বক্স নিয়ে যাবে--- ।
আসন্ন যুদ্ধ ঠেকাতে তাই গোটা দুই পুঁচকে জলের বোতলই ব্যাগে ঢোকালাম। রসগোল্লা না পারি, ইয়ে মানে কিছু তো এনেছি মনে করে। তাছাড়া দামী ব্যাগ, প্যাড, পেন এসব ও তো তুত্তুরীর জন্যই দিয়েছিল। দুপুর সাড়ে তিনটে চারটের রোদে পোড়া শুনশান রাস্তায় আর কি পাই? ভাবতে ভাবতে দেখি বাড়ির সামনেই এক আইসক্রীম ওলা, কানে হেড ফোন গুঁজে বসে আছে। একটাও খরিদ্দার নেই। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই তো চারটে নাগাদই অাসতো আইসক্রীমওলারা। আর আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন কান খাড়া করে থাকতাম। কি অদ্ভূত  মাদকতা মিশিয়ে হাঁকত, “আ -ই -স কি-রি-ম। কা-ঠি ব-র-ফ। ” নিশির ডাক বুঝি এমন হয়? ঠাকুমা পিসির বকুনী উপেক্ষা করে পাঁইপাঁই করে দৌড়তাম আমরা। কুড়ি পয়সার সবুজ ম্যাঙ্গো আইসক্রীম-- কমলা অরেঞ্জ। খানিক চুষলেই সাদা বরফ বেরিয়ে যেত। বড়রা বলতো নর্দমার জল তুলে বানায়, অত কথা কানে দিলে কি আর শৈশবের আনন্দ উপভোগ করা যায়? মেয়ের জন্য কিনতে গেলে ভয় লাগে। ওর কাছে আইসক্রীম মানেই ম্যাগনাম, ফিস্ট, কর্ণেটো---। এই কমলা সবুজ আইসক্রীম কি ভালো লাগবে? যদিও কোয়ালিটির তবু ??? সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে কিনেই ফেললাম, তিনটি। মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, কুড়ি পয়সার আইসক্রীমের দাম এখন কুড়ি টাকা। ভয় পাচ্ছিলাম, পছন্দ হবে কি না, একবার মুখে পুরেই, সবুজ জিভ বার করে  একগাল হেসে তুত্তুরী যখন বলল, “ থ্যাঙ্কু মা।  কি ভালো খেতে---। ”মনে হল রিওয়াইণ্ড করে দেখছি না তো, “আমার ফেলেআসা মেয়েবেলা”?
#অনির_ডাইরি #Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.com