Saturday 8 April 2017

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৪ঠা সেপ্টেম্বর  ২০১৭


শরতের রোদে কেমন যেন ঝিম ধরে, জাতীয় সড়ক ধরে কখনও হুহু করে ছুটছে গাড়ি, উড়ছে ধুলো, কখনও বা মৃদু মন্থর গতিতে গড়িয়ে চলেছে।  দুপাশে কোথাও মখমলী সবুজ ধান ক্ষেত, কোথাও বা বন্ধ পলেস্তারা খসা দোকানপাট। হাইওয়ের ওপরেই শুকোচ্ছে পাট। হাওয়ায় পাকিয়ে যাচ্ছে কিন্তু উড়ে পালাচ্ছে না। টলটলে নীল আকাশে উড়ছে চিল। হারিয়েই গিয়েছিলাম- মিশে গিয়েছিলাম প্রকৃতির সামনে। হঠাৎ  ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি, দরজা খুলে মুখ গলাল নির্মল,“নামবেন না ম্যাডাম?” পাশ থেকে সুখেন বাবু বললেন,“চলুন ম্যাডাম জুট মিল এসে গেছে। ” ভুলেই গেছিলাম, অন ডিউটি। রাণ্ড্যাম ইন্সপেক্সন চলছে।

গাড়ির দরজা খুলতেই যেন হলকা লাগল। কি গণগণে রোদ, এই রোদে এতটা হেঁটে যেতে হবে ফ্যাক্টরি অফিসে? গজগজ করতে করতে বলতে গেলাম,“পুজোর আগে এই রোদে পোড়ার কোন মানে হয়? সবাই ফেসিয়াল করে, ট্যান রিমুভাল প্যাক লাগাচ্ছে, আর আমাকে পুড়িয়ে কাঠকয়লা বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে। আর আমার এত দামি চুল? এই ধুলো খেয়ে আর বাঁচবে?” কিন্তু বলতে পারলাম কই? চোখের সামনে ভেসে উঠল আগের কারখানাটা, গরম গণগণে আঁচে বিস্কুট তৈরি হচ্ছে।  মিষ্টি গন্ধে সুরভিত।  আর যারা খাটছেন? কত টাকা বেতন পান, প্রশ্ন করেছিল ইন্সপেক্টর-জবাবটা আর নাই বা লিখলাম।  আমরা বারংবার আশ্বস্ত করে এলাম, আমাদের সাথে কথা বলার  আপনাকে যদি  কিছু বলে- তৎক্ষণাৎ এই নম্বরে ফোন করবেন। ইন্সপেক্টর নিজ হাতে আমাদের সবার নম্বর সেভ করে দিল। দিন কয়েক আগেই একটা কুৎসিত অভিজ্ঞতা হয়েছে, নূন্যতম মজুরী পায় কি না, এই আপাত সাধারণ প্রশ্নের জবাব দেবার  এক অপরাধে এক নামি শপিং মল, সিকিউরিটিকে কর্মচ্যুত করেছে। পুজোর মুখে একটি ছেলের চাকরী এভাবে  ছাড়িয়ে দিতে পারে? সুখেন বাবু, ইন্সপেক্টর এবং আমি পর্যায়ক্রমে বললাম, এই দণ্ডেই লিখিত জানান। তারপর দেখছি, কি করা যায়।

সত্যিই পুজো আসছে।  এদেরও তো পুজো, কিন্তু এ এক অন্য পুজো। শ্রমসেবার(লেবার সার্ভিস) দৌলতে এক দিকে সংগঠিত অপর দিকে অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্র নিয়েই আমাদের কারবার। প্রতিনিয়ত সাধারণ খেটে খাওয়া পাতি শ্রমজীবি মানুষের দুঃখ দুর্দশার হাতে গরম অনুভব হয়।  মাঝে মাঝে অসহায় লাগে জানেন, যখন করুণ গলায় কোন বয়ঃজেষ্ঠ্য  বলেন ,“ আপনি আমাদের একটা চাকরী দেবেন ম্যাডাম?আমাদের তো বউ বাচ্ছা আছে, পুজোর আগে বসিয়ে দিল।  আপনাদের এখানে লোক নেবেন না?” সর্ব ক্ষেত্রে যে প্রতিকারের কোন সম্ভাবনা থাকে তাও নয়, সেটা মুখের ওপর বলতে যে কি হৃদয়বিদারক যাতনা হয় তা ভাষায় অবর্ণনীয়।   প্রতিটি দিনের শেষে নতুন করে আর একবার অনুধাবন করি আমি এবং আমরা এখনও কতটা ভালো আছি।
অনির ডাইরি ১০ই জুলাই ২০১৭
কাল নিরবধি। জীবন যে কত ভেল্কি দেখায় ভাবতে বসলে তাজ্জব হয়ে যাই। এককালে সাদা শাড়ি লাল পাড়, কলা বিনুনী বেঁধে মাথা নীচু করে স্কুল যাওয়া নিছক মুখচোরা ভীতু মেয়েটা আজ লেবার চরায়। অসাধারণ গান গাইত যে মেয়েটি, যার খালি গলায় গাওয়া “মন মোর মেঘের সঙ্গী” শুনলেই ঝরঝর করে হেসে উঠত আষাঢ়ের ঘণ বাদল, সে এখন পদার্থবিদ্যার জটিল তত্ত্ব পড়ায়, গুনগুন করার ও ফুরসৎ নেই তার। ঘণঘণ কাল্পনিক প্রেমিক বদলানো মেয়েটা দিব্যি বাবার পছন্দের স্বজাতীয় পাত্রের সাথে সুখে ঘরসংসার করছে। রোগাপাতলা ছোট্ট খাট্ট মেয়েটাকে দেখতে একদমই বালিকাসুলভ ছিল না, পিতৃমাতৃহীন সেই মেয়ে আজ একার কাঁধে টেনে চলেছে বিশাল সংসারের দায়ভার। চূড়ান্ত অগোছালো  মেয়েটা আজ পরের ঘর গোছানো ইন্টিরিয়র ডেকরেটর। এককালে নেহাত সাদামাটা দেখতে মেয়েটার রূপের ছটা আজ তারাদেরও হার মানায়। পড়াশোনা শেষ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে ইচ্ছুক মেয়েটা, এখন ঘোরতর নারীবাদী।  আজকাল বিয়ের নাম শুনলে ক্ষেপে যায়, বলে ওঠে“ কে বলেছে জীবন কাটাতে গেলে একজন বিশেষ পুরুষের প্রয়োজন?” অসম্ভব কেরিয়ারিস্ট মেয়েটা এক কথায়  চাকরী ছেড়ে দেয় আসন্ন সন্তানের মুখ চেয়ে।  এককালে সবার আগে থাকা মেয়েটা আজ কারো হাত ধরতে চায় না, উচ্চমন্যতা নাকি হীনমন্যতা কে জানে?? আর এরই মাঝে বয়ে চলে সময়, দাবার ঘুঁটির মত খেলে আমাদের নিয়ে- কাল ছিল নেহাৎ  মুখচেনা, আজ বন্ধু, আগামী কাল? কি যে লেখা আছে বিধাতার খাতায় কে জানে? কেই বা পরোয়া করে? এই তো দিব্যি আছি ...

-----–--------------------------------------------------------------------


অনির ডাইরি ৮ই জুলাই ২০১৭


তাহলে? ঘুরে ফিরে সেই ফেসবুক? ফেসবুকই আসল কালপ্রিট কি বলেন? কোথাকার এক ডেঁপো পিছন পাকা ছোকরা ফেসবুকে কি আবোলতাবোল শেয়ার করল, আর অমনি এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। একটা বিশ্রী কালো দাগ পড়ে গেল আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ শান্তির রাজ্যে। আমাদের রাজ্যে এসব কোনদিন ছিল বলুন? যেখানে যত দাঙ্গাহাঙ্গামা হত, আমরাই তো ডাকতাম নিপীড়িত জনগণকে, “আসুন আসুন,আমাদের সোনার বাংলায় আপনাদের কোন ভয় ডর নেই। আমরা হলাম বাঙালি, দা গ্রেট বাঙালি, “ জন্ম থেকেই সেন্টু খেয়ে শহিদ, শহিদ ভঙ্গী, গুলির আগেই সারেন্ডার আর প্রেমের আগেই লেঙ্গী।“ আমাদের গ্যাস। অম্বল, আমাশা, ডেঙ্গু (নাকি ডেঙ্গি?)  অনেক কিছুই আছে বটে, কিন্তু আমাদের কেউ ক্মুনাল বলতে পারবে না বাওয়া।

কিন্তু এই অপদার্থ গোভূতটা দিল সব শেষ করে।আর তোদেরও বলিহারি যাই বাপ, নাহয় খুব খারাপ কিছু পোস্ট করেইছিল, তাই বলে তোরাও দৌড়বি লুঙ্গি তুলে? একটা মামুলী আচ্ছা চল, চরম অসম্মানজনক পোস্ট  তোদের ধর্মবিশ্বাসে এমন আঘাত করল বাপ, যে শুধু তার বাড়িঘরে আগুন লাগিয়েই শান্তি হল না, তাকে জবাই করাও চাই? পেলি না বলে, দুচারজন নিখাদ গরীবগুর্বো মানুষের বাড়িতেও দিলি আগুন লাগিয়ে?রাস্তা আটকে, টায়ার জ্বালিয়ে, বেছে বেছে বিশেষ সম্প্রদায়ের দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট করে কি লাভ হল? যে বিষ এতদিন তলায় তলায় ছড়াচ্ছিল তা হলাহল হয়ে বেরিয়ে এল। এবার কি হবে? 

বিগত কয়েকদিন ধরে অনেক কিছু পড়লাম। অনেকের লেখা,অনেক গুজব, গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ,অমৃতবাণী, আমার এবং শৌভিকের বন্ধুতালিকায় থাকা বহু ব্যক্তির জ্ঞানগর্ভ পোস্ট সব সব পড়লাম। গোগ্রাসে গিললাম বলা যায়।ফেসবুক আপাতত দুই ভাগে বিভক্ত। একদল সমানে প্রচার চালাচ্ছে,গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না। বিগত কয়েকদিন ধরে বহুল প্রচারিত ছবি এবং ভিডিও গুলি বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন যে সেগুলি আসল নাকি নিছক দাঙ্গা লাগাবার উদ্দেশ্যেই তৈরি। উদ্দেশ্য প্রশ্নাতীত ভাবেই সাধু, কিন্তু কোথাও না কোথাও এদের প্রতিটা পোস্টে লুকিয়ে আছে কেমন যেন “ভাই তুই এটা করতে পারলি?” মার্কা তীব্র অভিমান। নিরপেক্ষ হয়েও কেমন যে পক্ষপাত দুষ্ট। তবু এরাই আমাদের আশার আলো, ঘোর অমানিশিতে এরাই আমাদের জোনাকি।

আর একদল  স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেই চলেছে,” যাঁরা দাঙ্গা করে তারা আমার বন্ধু নয়,নট ইন মাই নেম,দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে আমার নাম জড়াবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।“ পড়তে পড়তে রাগ হয় জানেন, হেব্বি রাগ হয়। সুকন্যার শব্দচয়ন তুলনাহীন, এরা বাস্তবিকই ইন্টেলেকচুয়াল আপদ। ধুর মশাই কে বলেছে আপনি দাঙ্গাবাজদের বুজম ফ্রেন্ড? কে বলেছে আপনি গোরক্ষক বাহিনীর সদস্য নন, সে কথা ফেসবুকে পোস্ট করতে? আমরা কোন ব্যাখ্যা চেয়েছি কি? আর ঐ ধুতিপড়া গোরক্ষক বা লুঙ্গি পর দাঙ্গাবাজরা কি আদৌ আপনার ঐ পোস্ট পড়ার জন্য ফেবু আলো করে আছে?

কিন্তু কেউ কেন একবারও বলছেন না, যে একটা দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র যদি তেমন কিছু ফেসবুকে শেয়ার করেই থাকে, তারজন্য এতবড় অশান্তির কি আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল? সৌভিক বলে ছেলেটির গ্রাম অর্থাৎ মাগুরখালিতেই যখন এই নিয়ে কারো মাথা ব্যথা ছিল না, তাহলে ঐ লুঙ্গিবাজ দাঙ্গাবাজরা এল কোথা থেকে? কেন এল? ফেসবুকে তো আমরা তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় অনেক কিছুই শেয়ার করে বসি, ধর্মবিশ্বাসে এত আঘাত লাগল যে এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল?এত ঠুনকো আপনার আমার ধর্মবিশ্বাস? যে লোকমুখে কে কোথায় কি শেয়ার করেছে শুনেই আপনি লাঠি কাস্তে নিয়ে দৌড়বেন? আর এত দুর্বল আপনার আমার মেরুদণ্ড যে আমরা ঐ সদ্য তরুণ ছেলেটির পোস্ট নিয়ে একটি কথাও বলব না?কত বয়স ওর? আঠারো খুব জোর? আমার আপনার ঘরেওএরকম কেউ না কেউ বড় হচ্ছে। কাল যদি সে যথাযথ গুরুত্ব না বুঝে কিছু শেয়ার করে ফেলে? আমি আপনি জানতেই পারলাম না, কেন, কি বৃত্তান্ত, শুধু ঘুম থেকে উঠে দেখলেন একদল লোক আপনার এবং আপনার নির্দোষতর প্রতিবেশীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে।হতে তো পারে? বলুন না? শুধু তাই নয়, পোস্ট করার অপরাধে তারা আপনার প্রিয় শিশুটিকে পিটিয়ে মারতে চাইছে। কেন না? সে একদল ধর্মোন্মত্ত ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করেছে।

আমরা যাই বলি না কেন সত্যিটা হল বাঙালি মোটেই শান্তিপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ জাত নয়। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা স্বাধীনতা অব্যবহিত পরবর্তী দাঙ্গার কথা সুকৌশলে আমার আপনার কাছে গোপন করা হয়েছে, যাতে সেই বিষ আমাদের শিরা ধমনিতে না ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিষ কি সত্যিই ঐভাবে চেপে রাখলে চাপা থাকে? দিনকাল খুব খারাপ আসছে দাদা। আমাদের মত মধ্য তথা নিম্নমেধার নিছক খেটে খাওয়া লোকজনের মনে প্রতিনিয়ত জমছে অজস্র প্রশ্ন। জন্ম নিচ্ছে ভয়। তৈরি হচ্ছে অবিশ্বাস। বাড়ছে ফাটল। আর এই ফাটল ওরা কিছুতেই ভরাট হতে দেবে না, এই অবিশ্বাসের জমিতে চাষ করবে ভয়ের ফসল।

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৩রা জুলাই ২০১৭


আজ টমেটোর সাথে দেখা হল। “টমেটো?” টমেটো কে চেনেন না বুঝি? য্যাঃ তাহলে আপনি বাঙালিই নন মশাই। সেই যে টমেটো, যে অবিবাহিত ধনী যুবক বিকাশ রায়কে “বাবা” বলে হঠাৎ আঁকড়ে ধরেছিল? ততোক্ষণ ছাড়েনি যতক্ষণ  না বিকাশ রায় এবং অরুন্ধতী দেবীর প্রণয় যথার্থ পরিণতি পায় এবং তাঁরা যুগলে টমেটোকে তাদের পুত্ররূপে স্বীকার করে নেয়। এবার বুঝেছেন তো? আজ্ঞে হ্যাঁ।  “ছেলে কার” সিনেমার টমেটোর কথাই বলছি।
সেই টমেটো না হলেও  আলুবোখারা তো বটেই। কাজকর্ম, উল্টোরথের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে শৌভিক আর আমি দিব্যি খুনসুটি করতে করতে যখন ৬-৪২ এর নৈহাটি লোকালে উঠলাম, ততোক্ষণে সব জানলার ধারের আসন ভর্তি হয়ে গেছে। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল একটি জানলার ধারে একটি অল্প বয়সী, বছর আট নয় বছরের বালক বসে আছে। তারপাশেই বসলাম দোঁহে। একটু জায়গা ছেড়েই বসলাম, নির্ঘাত বাবা মা কেউ সঙ্গে আছে। যদিও জায়গা রাখা নেই।
ট্রেন ছেড়ে দিল, কেউ এল না। ছেলেটি মাঝে মাঝে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দেখছে-- শৌভিক ফিসফিস করে বলল,“এই গণুটার সঙ্গে কেউ নেই নাকি?” গণু?আমাদের চয়ন করা নিজস্ব কিছু শব্দ আছে। যার মানে শুধু আমরাই জানি। যেমন গণু। সাধারণত আমরা বাচ্ছা বা শিশু বলতে আদর করে গণু বলি। আমাদের বিয়ের পর বাবা-মা একটা তুলো ভরা “বাল (শিশু) গণেশ দিয়েছিল। যাকে বলে স্টাফড্ গণেশ। যখন জানা গেল আমাদের দুজনের মাঝে কোন এক তৃতীয় ব্যক্তি আসতে চলেছে, তখন সেই অচেনা ব্যক্তিকে আমরা আদর করে গণু বলে ডাকতে থাকি। ধীরে ধীরে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে কোন শিশুকেই আমরা গণু বলে ডাকি। যেমন- আজ ট্রেনে একটা গণু উঠেছিল, পাশের বাড়ির গণুটা কি হল্লা জুড়েছে মাইরি। এমনকি মনুষ্যেতর প্রাণীর শিশুকেও--- যাক গে ছাড়ুন।
তো যাই হোক, শৌভিক বলল, “ এই গণুটা কি একাই যাচ্ছে?” শুনেই হঠাৎ ছেলে কার সিনেমাটার কথা মনে পড়ে গেল। এই রে? এবার নির্ঘাত বাবা-মা বলে জড়িয়ে না ধরে? একটা বাদামওলা উঠল টমেটো বাবু গম্ভীর মুখে আমাদের দেখতে দেখতে বাদাম কিনল এবং পকেট থেকে পয়সাও বার করে মূল্য চোকালো। সত্যি বলছি বেশ হতাশ হলাম। এটা মোটেও টমেটো সুলভ কাজ নয়। আমরা কোথায় ভাবছি সত্যিই যদি ওকে বাড়ি নায়ে যেতে হয়, তুত্তুরী কি বলবে? “চাইছিলাম একটা ল্যাব্রাডর, নিয়ে এলে একটা দাদা?” যদিও টমেটো বাবুকে মোটেই আমাদের মত দেখতে নয়, কিন্তু কোথায় লেখা আছে গৌরবর্ণ(?) পিতামাতার শ্যাম বর্ণ পুত্রকন্যা হতে পারে না?জামাকাপড় ও একটু না হয় মলিন, তাতে কি? সারাদিন ধুলাবালিতে  নোংরা হয়ে যেতেও পারে। মাঝে মাঝে বিবর্ণ জামা তো আমিও পড়ি। বাচ্ছাটা চোখ গোল গোল করে একটা একটা বাদাম খাচ্ছে আর গম্ভীর ভাবে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে। একবার জুতো সমেত উল্টোদিকের সিটে ঠ্যাং তুলল, শৌভিক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,“এই টমেটোটা জুতো পরে সিটে পা তুলছে কেন?” বেশ চলছিল ব্যাপারটা। হঠাৎ বেলঘরিয়া আসতে একটা মাথায় ঝুঁটি বাঁধা লোক এসে ডেকে নিয়ে চলে গেল আমাদের টমেটোকে। বিশ্বাস করুন খুব রাগ হচ্ছিল লোকটার ওপর, এমন বিশ্রী যবনিকা পাত?এতোক্ষণ কোথায় ঘাপটি মেরে বসেছিল কে জানে? আর টমেটো তুই? এটা করতে পারলি?

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৮ই এপ্রিল ২০১৭


প্রতিদিন কত কিছু ঘটে যায়, কত মজার ঘটনা, মনে মনে নোট নি, এটা লিখতেই হবে, কিন্তু দুষ্টু সময় কিছুতেই বাগ মানে না। যেমন কাল, চুঁচুড়ায় সুতপাদির অন্তিম দিন ছিল। বহুদিন ধরে আমরা দুই এএলসি প্ল্যান করছিলাম, একদিন ধনিয়াখালি যাব, শাড়ি দেখতে এবং কিনতে। ধনিয়াখালি চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত একটি ব্লক। শাড়ির জন্য সুপ্রসিদ্ধ।  যেদিনই যাব বলে মনস্থির করি,  আচমকা উটকো ঝামেলা চলে আসে, আজ যাব, কাল যাব করে পিছোতে পিছোতে দেখি আর সময় নেই। আজকের পর আর সুতপাদি থাকবে না---
দুদিকে চোখ জুড়ানো গালিচার মত সবুজ ধান ক্ষেত,  মাঝখান দিয়ে ঝাঁ চকচকে রাস্তা, মাঝে মাঝে দু একটা সাবেকী একচালা মন্দির হাঁ করে গিলতে গিলতে গিয়ে হাজির হলাম ধনিয়াখালি। কৌশিক অর্থাৎ স্থানীয় এসএলওর স্বামী পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল তাঁতীর বাড়ি। তাঁতীর বাড়ি শুনে চমকাবেন না, রীতিমত ঝিনচ্যাক দোতলা বাড়ি। একতলায় দোকান শাটার টানা। বিরক্ত হয়ে ভাবলাম কোথায় আনলো রে বাবা কৌশিক? কৌশিক হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করল। নিঝুম ফাঁকা গনগনে দুপুরে  কৌশিকের পিছু পিছু বন্ধ দোকানের পাশের সরু গলি দিয়ে ঢুকলাম বাড়ির ভিতরে। জানলা দরজা বন্ধ বলে বেশ ঠাণ্ডা ভিতরটা। টাক মাথা, মাঝারি উচ্চতা, চশমা পরা নিরীহ দর্শন এক ভদ্রলোক নিজে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গিয়ে বসালেন। মার্বেলপাতা মেজেতে বিশাল মাদুর পাতা। চারপাশে থরে থরে সাজানো শুধু শাড়ি আর শাড়ি। টুল আর চেয়ার দেওয়া সত্ত্বেও আমরা মাটিতে বসলাম। শুরু হল শাড়ি দেখানো। সাবেকী বাঙালি তাঁত। ওরা বলে একশ সুতোর শাড়ি। প্রচুর শাড়ি দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক, আমার আব্দার সাদা শাড়ি চাই। শাশুড়ি মা সাদা ছাড়া পরেন না। উনি আনতে গেলেন বাইরে থেকে, এমন সময়,  কৌশিক দুটো ডাব নিয়ে হাজির। গাছের ডাব,  খেতেই হবে। আপত্তি চলবে না। কি মিষ্টি ঠান্ডা ডাবের জল।কিন্তু এত শাড়ি খোলা আছে যদি দাগ লেগে যায়? ভয়ে ভয়ে আমরা একটু সরে বসলাম শাড়ির  থেকে। ভদ্রলোক কয়েকটা সাদা শাড়ি নিয়ে ঢুকলেন যখন,  সুতপাদি একটা কম দামী শাড়ির নীচে হাত রেখে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা দাদা জল পড়লে কিছু হবে না তো?”
ভদ্রলোক নার্ভাসভাবে  চশমাটাকে নাকের ওপর তুলে দুবার ঠোঁট চেটে হাত কচলে বললেন,“ এজ্ঞে, জল? তা জল পড়লে একটু  দাগ হবে। ” আমিও একটা শাড়ি দেখছিলাম, ফট করে হাত সরিয়ে নিলাম। সর্বনাশ জল পড়লে দাগ হবে? মানে কি? পাড়ের রঙ খোলে লেগে যাবে? ভদ্রলোক একই রকম নার্ভাসভাবে  বললেন, “কাচলেও উঠবে না। মনে হয় আজ্ঞে। ডাবের জল তো!” আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম, আর সুতপাদি কপালে করাঘাত করে বললেন, “হে ভগবান সে নয়। ডাবের জলের কথা কে জিজ্ঞাসা করেছে,  বলছি জল- জল । জলে কাচলে খারাপ হবে না তো?”

---------------------------------------------------------------------------


অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৯ই এপ্রিল ২০১৭


গ্রাজুয়িটি এ্যাক্টে আমরা এএলসি রা হলাম কন্ট্রোলিং অথোরিটি। অর্থাৎ আপনি যদি কোন প্রাইভেট সংস্থায় কর্মরত হন এবং কর্মজীবনের অন্তে আপনি আপনার প্রাপ্য গ্রাচুয়িটি না পান বা ন্যায্য  প্রাপ্যর থেকে কম টাকা পান, তাহলে আপনাকে আমাদের কাছেই আসতে হবে। এমনকি এ বিষয়ে আপনি যদি আমাদের কাছে না এসে সরাসরি আদালতের দ্বারস্হ হন, তাহলেও মহামান্য আদালত পত্রপাঠ আপনাকে ফেরৎ পাঠাবে আমাদের কাছে।
লেবার সার্ভিসের যে সব অফিসার যত বেশি গ্রাচুয়িটি কেস সামলেছেন, সু অফিসার হিসাবে তাঁদের সুনাম ততোবেশী। দুর্ভাগ্যবশত আমি ইতিপূর্বে একটিও গ্রাচুয়িটি কেসের সম্মুখীন হইনি। চুঁচুড়াই প্রথম।
এক একদিনে তিনটি চারটি কেসের হিয়ারিং থাকে। একদম কোর্ট কেসেরই মতো। অ্যাপিয়ারেন্স, স্টেটমেন্ট, এভিডেন্স,উইটনেস (ক্ষেত্র বিশেষে), ক্রশ, আর্গুমেন্ট সব কটি সিঁড়ি ভাঙতে পারলে তবেই অর্ডার দেওয়া যায়। বাদী এবং বিবাদী চাইলেই অভিজ্ঞ আইনজীবী  নিয়ে আসতে পারেন, তাঁর হয়ে সওয়াল জবাব করার জন্য।
টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। জন্মলগ্ন থেকেই দৃঢ় বিশ্বাস,  শ্রমিক মানেই অত্যাচারিত এবং মালিক মানেই অত্যাচারী। পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটানো সাড়ে চার বছর সেই ধারণাকেই দৃঢ় করেছে মাত্র। মালিকের থেকেও খারাপ যদি কেউ থাকে তবে তারা হল মালিকের পেটোয়া ম্যানেজারের দল।মালিক যদি একশ টাকা বেতন বৃদ্ধিতে রাজি হয়, এরা সেটা কুড়ি টাকার বেশি কিছুতেই বাড়াতে দেয় না।  খড়্গপুরে একবার এক বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা সংক্রান্ত ডিসপিউটের মিটিং এ জানতে পেরেছিলাম, যে বেরোজগার শ্রমিকদের অবস্থা এত খারাপ যে তারা অর্ধাহারে আছে। কয়েকজন সপরিবারে প্রতিদিন স্থানীয় এক লঙ্গরখানায় খেতে যায়। আর শয়তান মালিক কারখানার জমি এবং শেড বেচে দিয়ে পাওনাগণ্ডা  না মিটিয়ে কেটে পড়ার তালে আছে। এবং যাতে কেউ না জানতে পারে তাই তার দুষ্টু ম্যানেজার প্রতিদিন মিটিং এ আসেন আর ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলেন।
যাই হোক। হুগলীতে এসে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন । এখানে যে সমস্ত ম্যানেজাররা মিটিং এ আসেন, তাঁরা অত্যন্ত  সংবেদনশীল । প্রায় সকলেই বলেন,“ম্যাডাম ওদের কষ্ট আমি বুঝি। আমিও তো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই আসছি। ” নিছক গল্পের আবহাত্তয়ায় কেস চলে। সেদিন যেমন একটা কেস এল শ্রমিক সই করে গ্রাচুয়িটির টাকা নিয়ে নিয়েছে। তাতে ইংরাজিতে লেখা ছিল ফুল পেমেন্ট, কিন্তু এখন সে বলছে, কিসে সই করেছি বুঝিনি,  কিন্তু আমি আরো টাকা পাব। কেসটা আমার পূর্বসুরীর কাছে চলছিল। নিয়ম মোতাবেক চেকটা ওর সামনেই দেবার কথা।  ওকে না জানিয়েই বাদী-বিবাদী মিটমাট  করে নিয়েছিল। এখন ঝামেলা বাঁধাতে আবার আমার দ্বারস্থ হয়েছে।
প্রচণ্ড ধমকালাম দুপক্ষকেই। ম্যানেজার সাহেব শুকনো মুখে জানাল, “অন্যায় হয়ে গেছে ম্যাডাম। ” দুজনকেই এভিডেন্সের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে ফাইল বন্ধ করতে যাব, ম্যানেজার সাহেব বললেন, “ম্যাডাম একটা গল্প শুনবেন। আমি তখন লেবার অফিসার হিসাবে সদ্য জয়েন করেছি। একটি ছেলে,  আমাদেরই কর্মচারী, একদিন এসে বলল, ‘স্যার। আমার ভাইকে একটা চাকরী দেন। ’ হাত নেড়ে জানালাম আমি পারব না। আমার সে ক্ষমতাই নেই। আবার কিছুদিন পর এল,  ছেলেটি। সেই একই কথা। আমারও সেই একই জবাব। এরপর দেখলাম ও দমল তো নাই, বরং আরো ঘনঘন আসতে লাগল। একদিন আমি বিরক্ত হয়ে ওকে মারব বলে উঠে দাঁড়িয়েছি, দেখি ও কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমার নাম করে ইউনিয়ন লিডার ওর থেকে ৩০০০০টাকা ঘুষ নিয়ে নিয়েছে। মায়ের গয়না বেচে সেই টাকা দিয়েছে ওরা। এবার চাকরি না দিলে, ধনে প্রাণে মারা যাবে। আমি শুনে চুপ করে গেলাম। তারপর বললাম, যেমন ভাবে আমি  তোর কলার চেপে ধরেছি, ঠিক এইভাবে গিয়ে সেই লোকটার কলার চেপে ধর। বল তোর টাকা ফেরত দিতে। যদি আদায় করতে পারিস, আসিস আমি দায়িত্ব নিলাম। ওরা চলে গেল, আমি পিছনে লোক লাগালাম। খবর পেলাম প্রচণ্ড ঝামেলা হয়েছে। নেতামশাইকে ভালই জব্দ করেছে। সে বলেছ একটু একটু করে টাকা দিয়ে দেবে।
তিন মাস পরে ছেলেটি এসে বলল, ‘স্যার। ১৮০০০ টাকা পেয়েছি। বলছে আর পারবে না দিতে। ’ খবর ছিল। জানতাম ও আর দিতে পারবে না। চেয়ার ছেড়ে উঠলাম,  ছেলেটির ভাইয়ের হাত ধরলাম, নিয়ে গেলাম মালিকের ঘরে, বললাম, চাকরি দিতেই হবে। আমি কথা দিয়েছি। চাকরি হয়েছিল ম্যাডাম। এখনও চাকরি করে ছেলেটি। এখন তো বুড়ো হয়ে গেছে।
যাই হোক ম্যাডাম আমার কথার দাম আছে।  একটু সময় দিন, আমি দেখছি। কি করতে পারি। ” দিলাম সময়। আগে দেখা যাক---

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ১০ই এপ্রিল ২০১৭


কি বিশ্রী প্যাচপেচে  গরম। যদিও জানলার ধারের সিট, এক ফোঁটাও হাওয়া আসছিল না। তবে যতবার ট্রেনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়াচ্ছিলাম, দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল সোনার থালার মত এত ব্বড় চাঁদ। কি মোহক জোছনা। মহানগরের কন্ক্রীটের জঙ্গল, আবর্জনার স্তুপ বা উজ্জ্বল হ্যালোজেন আলোর সাধ্য কি তাকে দমায়। এক ঝলকেই নেশা ধরে যায়।
চন্দ্রাহত হয়ে নামলাম উল্টোডাঙা স্টেশনে। আর চাঁদ নেই। তাতে কি ক্ষণিক পূর্বের নেশায় মত্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম অটো স্ট্যান্ডের দিকে, হঠাৎ  কানে এল , এক মধ্যবয়সী মহিলা বলছে,“ চাঁদ দ্যাখ।  উই দ্যাখ চাঁদ। বড়লোকের ঘরে। ” চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি নিকটবর্তী ঝুপড়িবাসী এক মহিলা একটি অর্ধনগ্ন অবাধ্য অপরিচ্ছন্ন শিশুকে চাঁদ দেখাবার চেষ্টা করছেন।  জোছনা কি একটু ম্লান  হয়ে গেল কে জানে? শুধু মনে হল, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি---”।

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৬ই জানুয়ারী২০১৭

কি ভুলভাল দিন মাইরি। সকাল থেকে ট্রেনের গণ্ডোগোল। সকালে বলল কালিনারায়ণপুরে মালগাড়ি উল্টেছে, তাই কল্যাণীর পর আর ট্রেন যাবে না। এ বেলা কোথায় কি উল্টেছে কে জানে?থিকথিক করছে ভিড়। গুতোগুতি করে তিনজনের সীটে চারজন বসেছি। পুরো নিমপাতা চিবানো মুখ করে বসে আছি।  এমন সময় চতুর্থ জন বলল,“ আর একটু চাপা যাবে না?আমরা কেউই তো তেমন মোটা নই। চারজনের আরামসে ধরে যাবে।” ঠিক শুনলাম কি? কেউই তেমন কি নেই? থাক আর বলতে হবে না।  যতদূর সম্ভব হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বসলাম। 

চেপে চুপে বসে আছি, দেখি কে যেন মাথায় হাত বোলাচ্ছে তাকিয়ে দেখি জনৈক বৃহন্নলা! আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল,“সুন্দরী!এ্যাই সুন্দরী দুটো টাকা দে না”। সুন্দরী!!! নাঃ একটু আগেও পরিস্থিতি যতটা নারকীয় মনে হচ্ছিল এখন আর ততোটা লাগছে না। ভালোই তো বেশ। 😊😊😊😊😊


No comments:

Post a Comment