Monday 1 May 2017

তুত্তুরী উবাচ

তুত্তুরী উবাচ ১২ই মে, ২০২০

রাতের বাসন মাজছি, কন্যার প্রবেশ
 -(আদুরে গলায়)মা, অমুকের(জনৈকা মাতৃস্থানীয়া) গাল গুলো না একদম ট্যারান্টুলা মাকড়সার মত-
-(ধড়াম করে হাত ফস্কে একটা বাটি পড়ে গেল) মানে? উনি তোমায় কত ভালোবাসেন আর তুমি ওণার সম্পর্কে এমন কথা বলছ?
 -(হতবাক হয়ে) কি বলেছি? বলছি তো ওর গালগুলো কি দারুণ ফোলা আর কি রোমশ। 
-ট্যারান্টুলার মত গাল বললে কেউ খুশি হয় না বাবু।
-তাহলে কি বলব? পমেরিয়ান পাপির মত থলথলে রোমশ?
- আরে দূরঃ। কোন মহিলার গাল কখনও রোমশ বলতে নেই।  ওটা প্রশংসাসূচক নয়। বলো না।
-(ভাবিত স্বরে) অ। আমি অনেক ভেবে দেখেছি জানো মা, বাচ্ছাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়টাতেই তাদের জ্ঞান থাকে না।
-মানে?
-মানে যখন তারা মায়ের পেটে থাকে, কত ভালো থাকে। সারাদিন খেলে আর ঘুমোয়। (আড় চোখে তাকিয়ে) কেউ পড়তে বসতেও বলে না-
-হুঁ বুঝেছি। এবার ব্রাশ করে চুপচাপ শুয়ে পড়। কাল আবার বেরোতে হবে, বাবা গো।
-(বিরক্ত স্বরে) আরে যাও। যাও। আপিস যাও। আমারও কোনদিন স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। আমি কি তাই বলে ঘ্যানঘ্যান করি?

তুত্তুরী উবাচ ৯ই ডিসেম্বর ২০১৯

শীত যদি পড়ে বৃষ্টি তো পড়বেই裸洛। অঝোরে ঝরবে নাকের পানি। সঙ্গতে ঘঙ্ঘঙে কাশি। চিড়চিড়ে মেজাজ। উষ্ণ বদন। ফলশ্রুতি ইস্কুল কামাই। এবং মায়ের অফিস ও।
এতদসত্ত্বেও কথায় কথায় যথাক্রমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এবং ডুগরে ডুগরে কান্না।
-মাসি খুব বাজে郎। মাসি আমায় চান করাতে গিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে। মাথায় নখ ফুটিয়ে দিয়েছে।
-বাবু,মাসি তোমায় সেই পাঁচ দিন-
-(টলটলে দুই চোখে ঝলসে ওঠে রাগ)মোটেই পাঁচ না। সাত দিন।
-(জিভ কাটে মা) আচ্ছা।  সাত দিন। সেই সাত দিন বয়স থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মাসি কি তোমায় নখ ফুটিয়ে বা আঁচড়ে দিতে পারে? তুমি নিজে বিশ্বাস করো?
-(উদগত্ কান্নার বেগ কিঞ্চিৎ বেড়ে গেল) তুমি আমায় বিশ্বাস করো না蠟? আমার অন্য মাসি চাই।
-আচ্ছা বেশ। তাহলে নমিতা মাসি? (প্রসঙ্গতঃ নমিতা মাসির নামটা বদলে দিলাম বটে,তবে নমিতা মাসিও আমাদের বাড়িতে বছর পাঁচেক তো আছেনই। দিনে দুবার আসেন। ঝাড় মোছ বাসন মাজেন,তুত্তুরীর মাসির সঙ্গে তাঁর সাপে নেউলে সম্পর্ক। দুজনেই দুজনার দোষ ধরেন। সর্বোপরি নমিতা মাসি ভয়ানক নোংরা। ধুয়ে যাওয়া বাসনে হয় এঁটো নয়তো সাবান পাওয়া যায়ই। বলাইবাহুল্য তুত্তুরী মোটেই তার অনুগামিনী নয়। তবে আপাততঃ মাসি ফাঁসির যোগ্য অপরাধ করেছে-। অসুস্থ দুর্বল তুত্তুরীকে স্নান করানোর অছিলায় নখ ফুটিয়ে দেওয়া? এক্কেবারে ক্ষমার অযোগ্য। কি বলেন?
ফর্সা ঈষৎ মলিন দুই গণ্ড বেয়ে টপটপ করে ঝরছে মুক্তোর দানার মত অশ্রু বিন্দু। এরই মধ্যে আসছে মায়ের ফোন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফোঁপানি। বুঝলাম খিদে পেয়েছে। প্রায় জোর করে খেতে বসতে এবং বসাতে হল। একা খাবে না কি তুত্তুরী? শেষে হয়তো বলেই বসবে, আরেকটা মা চাই। 
খেতে বসেই কান্না।
-আমি নাক টানতে পারছি না কেন? ও হো হো। আমার খিদে নেই। এত ভাত দিচ্ছ কেন? ও হো হো। বাবা আমাকে বেশী করে খেতে বলে গেছে। আমি কেন খেতে পারছি না? ও হো হো হো। ভাতের নাম দাও। তবে খাব। ও হো হো হো।
ভাতের নাম? আজ্ঞে হ্যাঁ।  কোন অদূর শৈশবে,শনি-রবিবার যখন তুত্তুরীকে স্বহস্তে খেতে শেখাতাম, ভাত মেখে গাল পাকিয়ে সাজিয়ে রাখতাম চক্রবূহ্যে। তারপর হত তাদের নামকরণ। কখনও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি রাজ্যের নামে নাম হত তাদের। কখনও তারা হত কালানুক্রমে মহান ভারতীয় সম্রাটগণ যথা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা অশোক থেকে ঔরঙ্গজেব। আবার কখনও কোন গল্পের চরিত্র। একঢিলে মারা পড়ত অনেক পাখি। পেট ও ভরত, উপরি পাওনা ইতিহাস ভূগোল বা সাহিত্যচর্চা‍। তাই বলে এই বুড়ো বয়সে? তাই সই। প্রথমে গরম ডাল আর কচি বেগুন ভাজা মাখা ভাতের নাম হল পঞ্চপাণ্ডবের নামে। সাথে জুটলেন দ্রৌপদীও। আমি নামকরণ করার পরও, দুষ্টু পাণ্ডবরা থালায় ছোটাছুটি করে বদলে ফেলল স্বঅবস্থান। এবার চিনব কেমন? চিনতে পারবে কেবল তুত্তুরী।
- কি রে কাকে খেলি?
-উরে বাবারে। মুখের মধ্যে গদা ঘোরাচ্ছে গো। এই ভীম! দাঁড়া! তোকে কচকচিয়ে খাব। ব্যাটা।
(পরের গ্রাস)মা, মুখে তীর ফোটাচ্ছে! এটা অর্জুনই হবে বলো? (পরের গ্রাস) মা নকুলকে চিনব কি করে?
-পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নকুল সবথেকে রূপবান ছিল।
-হুঁ তাই দেখি। এ এত জামাকাপড়- সাজের জিনিস নিয়ে ঢুকেছে। ভালো করে চিবোই ব্যাটাকে।  আর সহদেব কি পারত মা?
-বোধহয় বল্লম চালাতে পারত।
-হুঁ। তাই বলি। এই গালে এত কি ফুটছে। অর্জুনের তীর অনেক সূক্ষ্ম ছিল। এ ব্যাটা তো হেবি মোটা। উ হুহু। দ্রৌপদী বলছে ও একটা স্পাউজ নিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকবে।
- আর কি স্পাউজ বাকি আছে? সব তো তোর পেটে।
- কর্ণ আছে না? (আলু ফুলকপির তরকারী থেকে একটি ফুলকপির ন্যাজ ধরে টেনে তুলে) এই দেখো কর্ণের রথের চাকা।
-টেকনিক্যালি বাবু,কর্ণ ওর স্পাউজ নয়।
-ওঃ। ঐ ভাতটা খাব না। মাছের ঝোল মাখছ কেন? কে খাবে? আমি তখনই খাব যদি ওদের নাম দাও।
- আমার নামের ঝুলি খালি। তুইই দে। কৌরবদের নামে দে।
-আমি কৌরবদের বেশী লোককে চিনি না। 類
-যাদের চিনিস তাদেরই নামে দে। আমি কৌশিক মামার ফোনটা ধরে আসি। ইমপর্টান্ট।

ফোন সেরে বেরিয়ে দেখি,থালা জুড়ে কুরু বংশের রথী মহারথীগণ যুদ্ধে ব্যাপৃত। দুঃশাসনকে শাসন করতে একটু বেশী চিবানো হচ্ছে। দুঃশাসন ছাড়ুন,কন্যার দাঁতের নিরাপত্তা নিয়ে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন বোধ করলাম। যে হারে কটাং কটাং করে চিবানো হচ্ছে। দেখলাম কর্ণ পুনরায় ফিরে এসেছেন কৌরব শিবিরে এবং সর্বোপরি রুই মাছের পেটিটি হয়েছে পিতামহ ভীষ্ণ। কাঁটা গুলি তাঁর শর শয্যার শর। আর মাছের ছালটি তাঁর ধুতি। মারাই যখন গেছেন আর- ইয়ে মানে ঐ আর কি।
উফ্ কে যেন বলেছিলেন,মা হওয়া কি মুখের কথা? হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, ভগবান।

তুত্তুরী উবাচ, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০১৯

-মা, তোমার নতুন লিপ বামটা একটু লাগাব?
-লাগিয়ে দিলাম তো একটু আগে-
- না,আমি নিজে লাগাব।
-একদম না।
-কেন?
-কারণ, আগেরবার একটা গোটা লিপ বাম তুমি খেয়ে নিয়েছিলে।
-অ। সেটা মিষ্টি মিষ্টি ছিল। আমি শুধু নিভিয়ার লিপবাম খাই। মেবিলিন খাই না। 

[গপ্পটা হল,২০১৬সালের কথা (সাল তারিখ তুত্তুরীই ধরিয়ে দিল) শীত পড়ার মুখে মেয়ের খুব ঠোঁট ফাটছিল বলে,ওকে এক টিউব লিপবাম কিনে দেওয়া হয়। শুধু ও ব্যবহার করবে। পরের রাতেই তিনি নিখোঁজ হন। খোঁজাখুজি,ধমক ধামকের পর দলামোচড়া টিউবটা দিনচারেক পর বের হয়। আমাদের ধারণা ছিল ঐ টিউবটি ও রেড্ডিকে মাখিয়েছিল। রেড্ডি একটি রক্তিম বর্ণা তুলোভরা পুতুল ছিল। যাকে তার কদিন আগেই তুত্তুরী এক কৌটো বোরোলীন মাখিয়েছিল। এই নিয়ে মাসি বকতে যাওয়ায় মাসিকে শুনতে হয়,“পুতুল বলে কি রেড্ডি মানুষ না?ওর কি শীত লাগে না? গা ফাটে না?” পরে অবশ্য জানা যায়,বেচারা রেড্ডি নির্দোষ ছিল।]
তুত্তুরী উবাচ-২৮শে নভেম্বর, ২০১৯
-মা জানো, আজ মিস আয়ুষীকে আমাদের পিছন বেঞ্চে বসতে পাঠিয়েছেন।
-ও। তা সেটা ভালো না খারাপ?
-হুঁ। ভেবে দেখতে হবে樂। ভালই বোধহয়।  এতদিন তো আমাদের পিছনে কেউ বসত না-
-মানে? তুই লাস্ট বেঞ্চে বসিস নাকি?廊
-হ্যাঁ। তুমি আর সঞ্চিতা মাসিও তো তাই বসতে?(উঃ ভগবান, কি কুক্ষণে যে নিজেদের মেয়েবেলার গল্প শুনিয়েছিলাম-郎)
-শোনো না মা, আমাদের স্কুলের পাশেই যে বাড়িটা আছে না, ওরা আজ মাটন রাঁধছিল। কি ভুরভুর করে গন্ধ আসছিল-। অমুক মিস তো বেশ কয়েকবার ঐ দিকে তাকিয়ে নাকই টেনে নিল। মানে ঐ স্নিফিং আর কি-
- মিস নাক টানল? আর তোরা কি করছিলি?
-আমরা? আমরা তো চুপটি করে বসেছিলাম। দেখলাম,মিস নাক টানল,জিভ চাটল, তারপর বলল- “এই যা তো,জানলার গ্রীল কেটে ওবাড়ি থেকে একবাটি মাটন নিয়ে আয় তো।”
‍♂️-(বাবা গম্ভীর মুখে রুটি চিবুতে চিবুতে)হুঁ আনতে বলল,মাটন। এল বিফ। (বিফ অর্থাৎ গৌরি। তুত্তুরীর কাল্পনিক গরু। যে সবসময় লতাপাতায় ঘুরে বেড়ায়)
- না গো মা সত্যি। তোমরা তো কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। জানো আজ আরও কি দেখেছি? দেখলাম মৌমিতা মিস আমাদের কাঁচিটা ব্যবহার করে কাগজ কাটছে। (“আমাদের কাঁচি” হল একটি ছোট স্টিলের কাঁচি,যেটিকে হাতের কাজ পরীক্ষার দিন তুত্তুরী স্কুলে হারিয়ে এসেছে। তুত্তুরীর যদিও বক্তব্য মিস ঐটি কেড়ে নিয়েছেন)
-ওটা আমাদের, কি করে বোঝা গেল?樂
-হ্যাঁ মা আমাদেরটাই। মিসের তো একটা লাল কাঁচি ছিল। আমাদের কাঁচি নিয়ে নেওয়া?দাঁড়াও আমিও একদিন চুপচাপ ঐ কাঁচিটা নিয়ে চলে আসব। (প্রসঙ্গতঃ তারপর আমাদের বাড়ি তিন তিনটি কাঁচি কেনা হয়েছে। আর কাঁচি রাখার জায়গা নেই-濫)
-ছিঃ বাবু। না বলে পরের জিনিস নেওয়াকে কি বলে?
-(মাথা নীচু করে) চুরি। 
‍♂️-(বাবা, নিরাসক্ত মুখে রুটি চিবুতে চিবুতে)কিন্তু না বলে নিজের জিনিস ফেরৎ নিয়ে নেওয়াকে চুরি বলে না।
তুত্তুরী ও বিশ্বকাপ ২ ১৬ই জুন ২০১৮
-বাবা বিশ্বকাপ পাঁচ বছর পর পর হয়?
-(বাবা খেলা দেখতে দেখতে) নাঃ। চার বছর। আগেরটা ২০১৪এ হয়েছিল।
-হ্যাঁ আমার মনে আছে। মা বলতো যা বাবার সাথে গিয়ে খেলা দ্যাখ। আর তুমি বলতে যা মাকে গিয়ে জ্বালাতন কর। আর আমি ভাবতাম ওয়ার্ল্ড কাপটা কি রে বাবা? একটা কাপের মধ্যে পৃথিবীটা কি করে ঢুকবে?কাপটা তো ছাতু হয়ে যাবে।
(কিছুক্ষণ পরে)
-মা আমি ইজিপ্টকে সাপোর্ট করছি, তুমি কাকে?
-ইন্ডিয়াকে।
-আহাঃ ইন্ডিয়া তো খেলছেই না। একবার বাবা আর আমি ইন্ডিয়াকে সাপোর্ট করেছিলাম জানো তো, সেবার পাকিস্তান প্রাইজ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।  তুমিও বরং ইজিপ্টকেই করো। ইজিপ্টে পিরামিড আছে। মমি আছে। উরুগয়ায় ওসব নেই। এর আগে নামই তো শুনিনি।

(কিছুক্ষণ পর)
-মা মরোক্কো  কি ইন্ডিয়াতে?
-না।
-তাহলে ইরান?
-না।
-কোনটাই ইন্ডিয়াতে নয় ঠাকুর। তাহলে আমি ইরানকেই সমর্থন করি? মরোক্কোর লোকগুলোর দাড়ি এবং টাক আছে।আর ওরা বড্ড মারামারি করছে। খালি ইরানের খেলোয়াড়দের গুঁতো মারছে।  চিটিং কি না বলো?
(আরো কিছুক্ষণ পর প্রবল চিৎকার) মার। মার। মার। পা দিয়ে না পারিস মাথা দিয়ে মার। গোলকিপারের মাথায় মেরে ওকে অজ্ঞান করে দিতে পারলেই তো গোল। মারঃ। ইয়েস্ গোওওওল।
-(বাবা পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে)কিসের গোল?ওটা তো আত্মঘাতী  গোল। সেমসাইড।
- যাই হোক গোল তো বটে। মমি স্পেন আর পর্তুগালের মধ্যে আমি এস্পানিয়াকে সাপোর্ট করব। তুমিও কোরো প্লিজ। আর কাল আর্জিণ্টিনা আর আইসল্যান্ডের ম্যাচে যেন আইসল্যান্ডই জেতে ঠাকুর। বাবার টিম যেন না যেতে।
- বাবু বাবার সামনে এসব বলিস না। বাবার মুখের চেহারা দেখছিস? মেরেই দেবে এবার।
-(বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে) তা নয়। অন্য টিমকে সাপোর্ট করাটা অন্যায় নয়। তবে পাশে বসে রানিং কমেন্টারিটা বন্ধ করলে ভালো হয়। শুতে যা।
-সেই ভালো ঘুমিয়ে পড়ি। কাল খেলা দেখব। আইসল্যান্ডের লোকগুলো কোট পরে খেলতে নামবে।
-(বাবা হতভম্ব  হয়ে) খামোকা কোট পরে খেলবে কেন?
-বারে? আইসল্যান্ডে খুব ঠাণ্ডা না?
   
তুত্তুরী ও বিশ্বকাপ ১৪ই জুন ২০১৮
-মা তুমি কার সাপোর্টার? রাশিয়া না আর একটা কি যেন দেশ খেলছে?
-সৌদি আরব বোধহয়।
-হ্যাঁ। তুমি কাকে সাপোর্ট কর মা?
-কাউকেই নয়। আমি কি খেলা দেখছি?
-ও হোঃ। বাবাও বলল কাউকে না। তবুও খেলা দেখছে। (দুঃখ দুঃখ মুখে) মা, রেফারিটা আর্জেন্টিনার। ব্রাজিলের নয়।
-যাঃ বাবা, রেফারি  কোন দেশের তাতে কি আসে যায়?
-তুমিই তো সেদিন বললে, দাদু ব্রাজিলকে সাপোর্ট করে তাই তুমিও- আমিও তোমার দলে,ব্রাজিলকেই সাপোর্ট করি মমি। বাবা খালি আর্জিণ্টিনা।
-(বাবা খেলা দেখতে দেখতে তেতো গলায়) মেলা ভ্যাজোর ভ্যাজোর করিস না তো।
-(বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর) বাইশ জন লোকের একটা বল নিয়ে লাথালাথি করাটা কি ঠিক? বলো মা? আর ঐ লোকটা খামোকা গোল আগলে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
-(বাবা হতভম্ব স্বরে) আরে ওটাইতো ওর কাজ। ও তো গোলকিপার।
-(আবার কিছুক্ষণ পরে)  মাথা দিয়ে বলটাকে মেরে গোলকিপারের মাথাটা ফাটিয়ে দিলেই তো বলটা গোলে পৌছে যাবে। তাহলেই তো গোল।
-(বাবা বিরক্ত হয়ে) উফঃ।
-(বাবাকে মুখ ভেঙিয়ে আমার দিকে ফিরে আদুরে গলায়) গোলকিপারের মাথা ফাটালে ওকে লালকার্ড দেখাবে না তো? রেফারিটা আবার আর্জিণ্টিনার (শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে)।

তুত্তুরী উবাচ ২রা মে ২০১৯
-মা, মে দিবসে কি হয়েছিল গো? ঐদিন বিদ্যাসাগর মেয়েদের অনেক সম্মান দিয়েছিলেন?
-(বাবা পাশ থেকে ব্যঙ্গের সুরে) ওটা মেয়ে দিবস নয় রে হোঁদল-কুৎকুত। মে দিবস। মে মানে মাস। ঐ দিনে অনেক কিছু হয়েছিল, একটু লেখাপড়াটা শেখ তবে না জানতে পারবি।
-(খানিক ভাবনা চিন্তা করে) তুমি আমাকে অশিক্ষিত বললে নাকি?
-(বাবা) অশিক্ষিত না হলেও কোন মতে সাক্ষর তো বটেই।
-(বাবাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে) মা, বিদ্যাসাগর মেয়েদের বেশী সম্মান দিয়েছিলেন না রামমোহন রায়?
-(বাবা একগাল হেসে)এটা কি মায়ের ওজন নাকি যে তুলাদণ্ড দিয়ে মেপে বলবে।  হেঁ হে মানে বলছিলাম আর কি- (এরপরের গৃহযুদ্ধটা একান্তই ব্যক্তিগত )

তুত্তুরী উবাচ ২১শে এপ্রিল,২০১৮
-মা খেতে বসে তোমরা খালি নিজেদের মধ্যেই কথা বল, আমার কথাটা কেউ শুনছ না।
-আচ্ছা বল। কি বলবি।
-রোজ তো তুমি আমায় অঙ্ক করাও,আজ আমি তোমাকে একটা অঙ্ক করতে দি বরং।  মেন্টাল ম্যাথ কিন্তু মা। খুব শক্ত। খাতা পেন্সিল ব্যবহার করতে পারবে না।
-সে তো এঁটো হাতে এমনিই পারব না।
-হুঁ। তবে থালায় আঙুল দিয়ে হিসেব কষতে পারো।
-(বাবা, অধৈর্য স্বরে) উফ্! এত ভ্যানতাড়া না করে, প্রশ্নটা বরং করেই ফেল। মা কি ভাবে করবে, মা বুঝবে।
-হুঁ। খুব শক্ত কিন্তু মা। তুমি মনে হয় পারবে না।
-ছেড়ে দে। তাহলে আর বলে লাভ নেই।
-বাঃ। তাই বলে চেষ্টা করবে না? আমাকে যে বলো,চেষ্টা করলে সব হয়। তুমিও চেষ্টা করেই দেখো না। 
-(মা, ক্লান্ত স্বরে)ওরে বাবা রে। হয় কর, নয়তো ছাড়।
-করছি। করছি। বলো তো, আমি যদি এক হাতা চাউমিন খাই, তুমি যদি দুই হাতা চাউমিন খাও, তাহলে বাবা ক হাতা চাউমিন খাবে?


তুত্তুরী উবাচ ১৯শে এপ্রিল, ২০১৮
-একি রে? প্লাস্টিকের ব্যাঙটাকে এক বালতি জলে ডুবিয়ে রেখেছিস?
-(কার্টুনের মত হেসে উঠে)হিঃ হিঃ। হ্যাঁ মা। যাতে ও জলে ভাসতে শেখে। সাঁতার কাটতে শেখে।
-বাঃ। কি অসাধারণ বুদ্ধি। প্লাস্টিকের ব্যাঙকে এক বালতি জলে চুবিয়ে সাঁতার শেখানো।
-(পাশ থেকে বাবা,নিস্পৃহ স্বরে) আর আমার সাথে যা করেছে, সেটা যদি বলি তো মা তোকে কেটেই ফেলবে।
-(মা-মেয়ে দুজনে সমস্বরে) কি? কি করেছে/করেছি?
-(বাবা রহস্যময় স্বরে) আমার অফিস পরে যাবার কচি কলাপাতা সবুজ শার্টে কে ফেভিকল মুছেছে?
-(মা রাগত স্বরে)সে কি রে?বাবার অফিস যাবার জামায় ফেভিকল?
-(ভিজে বেড়ালের মত মুখ করে)হ্যাঁ। তুমিই তো সকালে বাবাকে বলছিলে, ঐ জামাটা এবার বাতিল কর। বালতি কিনব। বাবা শুনল না। তাই আর কি-
-(মা রাগত স্বরে) তো তাতে ফেভিকল লাগাবি?
-(ভাজা মাছটি উল্টে না খেতে জানা নিষ্পাপ মুখে) না মা। লাগাতে চাইনি। সত্যি। টেবিলে বোতলটা উল্টে গিয়েছিল তো, তাই ভাবলাম-(ঢোঁক গিলে) তুমি বকবে, তাই হাতের কাছে যা পেলাম তাই দিয়ে মুছেদিলাম।
-(বাবা একঘড়া কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন পূর্বক) তাই বলে আমার দামী শার্ট?ভেউ, ভেউ,ভেউ।
-(একপ্রস্ত বকুনি খাবার পর রাগত স্বরে মায়ের উদ্দেশ্যে)খালি বকা আর বকা। সকাল থেকে আমি কত কাজ করি, ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাই, আর তুমি?খালি অফিসে গিয়ে চেয়ারে পা তুলে বসে সবাইকে বকাবকি করো। (মাকে নকল করে,ডাইনিং চেয়ারে বসে)প্রীতি এটা কই?কৌশিক এটা কেন হয়নি?অরিন্দম ফোন কর। (মুখ বেঁকিয়ে )হুঃ। বাড়িতেও বকো। অফিসেও বকো।
-বেশ করি। বকার জন্যই মাইনে পাই তো।
-(সিরিয়াস গলায়)সত্যি মা?বকার জন্য টাকা পাওয়া যায়?
-হঁ। পাই তো। মাইনে।
-কে দেয়?মূখ্যমন্ত্রী?
-হুঁ। তা বলাই যায়।
-কত টাকা দেয় মা?পনেরো ষোল টাকা?
-অা না, তার থেকে একটু বেশীই দেয়।
-ও হ্যাঁ। তুমিতো অনেক লোককে বকো। তাহলে কত দেয় মা?দু-তিন কোটি?
-(বাবা পাশ থেকে ফোড়নের সুরে)তোর মা যে রেটে বকে, আরটু বেশীই দেয় বোধহয়, না রে?
   
তুত্তুরী উবাচ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮
-(খাবার টেবিলে) মা একটা গল্প বলি শুনবে?
-বল।
-একটা শৌভিক বলে লোক ছিল। (বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি,বাবা একমনে রুটি চিবিয়ে যাচ্ছে,পাত্তা না পেয়ে আবার মায়ের দিকে ফিরে) সে একদিন অনিন্দিতা বলে একজনকে বিয়ে করল, আর তাদের একটা মেয়ে হল। তার নাম বুজু। বুজুর মা এই একটু চাষটাস করে আর কি)
-(বাবা গম্ভীর ভাবে) কোথায়?
-এই বারন্দাতেই করে (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) তো যা বলছি,রোজ তোতাপাখি এসে বুজুর মায়ের ভুট্টা খেয়ে যায়। আর বুজুর মা চিৎকার করে,“দাঁড়া। ধরতে পারলে, ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব। ”
-(বাবা গম্ভীর ভাবে উল্টোদিক থেকে আমাকে) তুই কি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে চিনিস?)
-(কোন মতে হাসি চেপে অভিমানী ঠোঁট ফোলানো মেয়ের উদ্দেশ্যে বললাম) বাবার কথা ছাড়, তুই বল।
-হ্যাঁ যেমন বাবা রোজ মশাগুলোকে বলে না?ধরতে পারলেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব?তেমনি বুজুর মাও বলত। একদিন একটা লেপার্ড-
-(বাবা হতভম্ব হয়ে) লেপার্ড আবার কোথা থেকে এল?
-সুন্দরবন থেকে।
-(বাবা ফোঁৎ করে)সুন্দর বনে লেপার্ড?
-হুঁ। লেপার্ডটা এসে বলল,“বুজুর মা,এই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধনটা কেমন একটু দেখাও দিকি?”বুজুর মা তো খুব ভয় পেল, কিন্তু মা দুর্গাকে ডেকে বলল, “ দেখাব। আগে একটা থলে, কিছু মুগুর আর একটা দড়ি নিয়ে এস।” তো বাঘটা মার্কেটে গিয়ে স্টাইলে বলল,“হ্যালুম”।
-(বাবা) আবার বাঘ কোথা থেকে এল?লেপার্ড ছিল তো?
-ও সরি। সরি। লেপার্ড আর বাঘ একই রকম লাগে দেখতে কি না। যাই হোক,ঐ  স্টাইলে হ্যাল্লুম শুনে সবাই পড়ি কি মরি করে কেটে পড়ল। তখন বাঘটা মামুলী থলে না নিয়ে একটা ব্বড় ব্যাগ নিয়ে এল। তারপর গিয়ে কাকাই এর ভারি ডাম্বেলগুলো নিয়ে এল। আর হাওড়ায় গিয়ে বাদলের দোকান থেকে একটা সাদা দড়ি নিয়ে এল।
-(বাবা উপহাসের ছলে)দড়ি আনতে হাওড়া?
-(বিরক্তি সহ) উফ্। খালি বিরক্ত করে বাবাটা। হ্যাঁ বাদলের দোকান থেকে দাদু সিগারেট আর দড়ি কেনে। সেই সাদা সাদা দড়ি যেগুলো পাজামায় পড়ে। হ্যাঁ তো মা, এইসব কিনে বাঘটা তো বুজুর মাকে দিল। বুজুর মাও ওমনি,ব্যাগের ভিতর বাঘটাকে ঢুকিয়ে মুগুর দিয়ে-গদাগুম গদাগুম। বাঘ ও ক্যাঁওম্যাঁওঘ্যাও করছে, প্রবল আওয়াজে নিচে থেকে আন্টি(আমাদের তলার ফ্ল্যাটের কালো মেম আন্টি) ছুটে এল। “অ্যাই হোয়াট হ্যাপেন্ড?”বুজুর মা তখন বলল, দেখতে চাও?তাহলে ব্যাগে ঢোকো। আর যেই না আন্টি ব্যাগে ঢুকল- ওমনি গপ্।
-(বাবা) আন্টি বাঘটাকে খেয়ে ফেলল?
-উফ্ বাবা কি বোকা। আন্টি তো ভেজিটারিয়ান। বাঘটাই-।  তারপর বুজুর মা আবার বাঘটাকে উত্তমমধ্যম দিল। তারপর ধোপা মানে ধোপারা যেখানে কাপড় কাচে, সেখানে ফেলে দিয়ে এল আর সুকন্যা মাসিকে ফোন করে দিল?
-(বাবা)আবার সুকন্যা কোথা থেকে জুটল। তোর মায়ের একা পিটিয়ে সাধ মেটেনি বুঝি?
- আঃ সুকন্যা মাসিই তো বনদপ্তরে খবর দেবে। (প্রসঙ্গত সুকন্যার বর বনদপ্তরের বড় সাহেব) যাইহোক একটা মোটকা ধোপা
-(বাবা)তোর মায়ের থেকেও-
- উফ্ বাবা চুপ। একটা ধোপা ভেবেছে অনেক কাপড় আছে বুঝি, কাচবে বলে যেই দড়ি খুলেছে,ওমনি গপ।
-(বাবা)কে কাকে খেল?
-বাঘ ধোপাকে গপ্।
-(ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা দশের ঘর ছুঁচ্ছে, তাড়া লাগালাম বাপমেয়েকে) আর নয়। এবার মুখ বন্ধ। খাওয়া শেষ করো।
-হুঁ। কিন্তু গল্পটা কেমন হয়েছে বলো?
-(আমি বলার আগেই বাবা গম্ভীর মুখে) ভি ই আর ওয়াই জি ও ও
-(একগাল হেসে)ভেরি গুড বাবা?
-(বাবা) ডি টা তো বলিনি।
-তাহলে?ভেরি গু? তার মানে?মা দেখো বাবা আমার গল্পকে কি যাতা বলছে--
তুত্তুরী উবাচ ২০শে ডিসেম্বর ২০১৭
-বাবা গরুরা খড় খায় কেন?তুমি জানো?
-না।
-হুঁ। একদিন একটা গরুকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে।
-আচ্ছা এবার বাইরে গিয়ে খেলা কর
- (অল্পক্ষণ পরে)কেঁউ কেঁউ কেঁউ কেঁউ
-কি হল রে?কুকুরের ডাক ডাকছিস কেন?
-এই দেখ না বাবা,কুকুর ছানাগুলো দিব্যি আমার সাথে খেলছিল, আচমকা আমার পা থেকে চটিটা খুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। বললাম,‘এই ওমন করিস না। দে। দে আমার চটি ফিরিয়ে দে’। কথা কানেই নিল না। ইংরেজীতেও বলে দেখলাম কত কিছু। কিছুই বোঝে না। তাই ওদের ভাষায় বলছি, আমার জুতো ফেরৎ দে। কামড়াস না জুতোটাকে। ছিঁড়ে গেলে মা মারবে-কেঁউ কেঁউ কেঁউ

তুত্তুরী উবাচ ১৮ই নভেম্বর ২০১৭
(কালী পুজোর প্রাক্কালে)
-মামমাম(দিদা) বলছি কি না, যে মহিলা এত গয়না কিনতে পারে,সে একটা শাড়ি কিনতে পারে না? মা কালীর কথা বলছি।
আচ্ছা দাদু মা কালী সবসময় নাঙ্গুপাঙ্গু থাকে কেন বলো তো? দাঁড়াও তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলছি,শোন, রাত্রিবেলা মা দুর্গা শোবার আগে গয়না খুলতে গিয়ে মনের ভুলে শাড়িটাও খুলে ফেলেছিল। ঠিক এই সময় শিব এসে বলল,‘আমার গাঁজার কল্কেটা দাও তো”।  বলতে এসে জগজ্জননীকে ঐ অবস্থায় দেখে শিব অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। শিবকে তাড়াতাড়ি করে তুলতে গিয়ে ভুল করে আবার শিবের বুকেই পা দিয়ে ফেলল অন্ধকারে,তাই তো মা দুর্গা অ্যাল করে এক গলা জিভ কাটল। বুঝলে তো মামমাম,অন্ধকার বলেই মা দুর্গাকে অমন কালো দেখায়।

(সাম্প্রতিক ডেঙ্গু উপলক্ষে)
-(বাবা গম্ভীর মুখে)সারা দিন ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে রাখবি। মশা যেন একদম না কামড়ায়। মশা কামড়ালেই কিন্তু? কি? ডেঙ্গু।
-(তুত্তুরী অবাক হয়ে) তো আমাকে বলছ কেন?মশাকে বল।

তুত্তুরী উবাচ ১৮ই অক্টোবর ২০১৭
(সময় গতকাল রাত সাড়ে দশটা)
-হ্যালো তুত্তুরী, কি করছ মা?
-কিচ্ছু না মামমাম(দিদা), এই একটু ভূত নামাচ্ছিলাম।
-অ্যাঁ?সেকি কেন?
-কাল ভূত চতুর্দশী তো তাই। তুমিও ভূত নামাও মামমাম।
-না বাবু, আমি ওসব পারি না। (শেষ পর্যন্ত তুত্তুরীর আব্দারের কাছে নতি স্বীকার করে)আচ্ছা তুমি যখন জেদ করছ,‘আয় ভূত, আয়। নাম নাম নাম। ’
-আঃ মামমাম। নাম নাম করলেই নেমেছে আর কি। ওকে কোলে করে নামাও।
- ছি ছি ছি। ভূতকে কোলে নিতে আমার বয়ে গেছে। আমি তোমায় ছাড়া আর কাউকে কোলে নেবো না।
-উফ্ মামমাম। আমি এতঃ ভূত নামিয়েছি, আর তুমি একটাকে নামাতে পারলে না?দাঁড়াও আমিই বলে দিচ্ছি, এই ড্যাবাড্যাবা চোখ ওলা একটা ভূত, ঐখানে আমার মামমাম তোকে ডাকছে, ওর হাত ধরে নেমে পড়।
ঐ যাঃ দুষ্টু ভূত নামার আগে আবার আমার ঘাড়ে একটুু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল।

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
-মা,তোমার ফোনটা একটু দেবে?বাবারটা তো লক করা তাই।
-আমারটাও তো লকড্।
-ওটার পাসওয়ার্ড আমি জানি। তুমি ফোন খোলার সময় অনেক সময় মুখে বলে বলে খোলো কি না-৯ ৫ ৪৭ এই রকম করে।
-সে যাই হোক। ফোনে হাত দিও না। বলেছি না ফোনে ব্লু হোয়েল আছে। বাচ্ছা পেলেই কচকচিয়ে খেয়ে নেয়।
-সেই জন্যই তো চাইছি মা। আমি একটা রেড হোয়েল বানিয়েছি, তোমার ফোনে ছেড়ে দেব। ঘাপটি  মেরে বসে থাকবে, যেই ব্লু হোয়েল তোমার ফোনে ঢুকতে যাবে, কচকচ করে ওকে কেটে ভেজে খেয়ে নেবে। তুমি ফোনটা তো দাও-দেখাচ্ছি মজা দুষ্টু ব্লু হোয়েলটাকে।
তুত্তুরী উবাচ ২৯শে জুলাই ২০১৭
- মা, জানো তো কাল না মিস খুব হাসছিল, আমার কথা শুনে।
- কাল তো পরীক্ষা ছিল, কি বলেছিস রে যে মিস হাসছিল?
- আরে না না। পরীক্ষার জন্য নয়, এমনি মিস অ্যানিম্যাল কিংডম পড়াতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল, “ পুরোযা ডু ইউ হ্যাভ আ পেট অ্যানিম্যাল?” আমি বললাম, “নো!” তখন মিস জিজ্ঞাসা করল, “ হুইচ অ্যানিম্যাল উড ইউ লাইক টু হ্যাভ অ্যাজ ইয়োর পেট?” আমি বললাম, “আই লাইক টু হ্যাভ আ ডগ।“
- ঠিকই তো বলেছিস। এতে হাসার কি হল?
- আঃ শোনোই না। তারপর আমি বললাম, “ আই লাইক টু হ্যাভ আ ডগ, বাট নট এ নেড়ি ডগ”।
- ওরেঃ বাপরে বাপ। হেসে হেসে পেট ব্যথা হয়ে গেল।
- হ্যাঁ মিস ও খুব হাসছিল, তারপর চশমা খুলে চোখ মুছে বলল, “ বাট হোয়াই নট আ নেড়ি ডগ?” আমি বললাম, “ নেড়ি ডগ আর ঘেউঘেউয়ে। এন্ড দে গেট ম্যাড ইন সামার অ্যান্ড ট্রাই টু বাইট আস।“
- উফঃ মাগো। এবার থাম বাবু।

তুত্তুরী উবাচ ২২শে জুলাই ২০১৭
-বাবা, একটা কথা বলব?
-কি?
-তুমি প্লিজ একবার আমাদের টিচার ইনচার্জের কাছে যাবে?
-কেন রে? এই তো মা মঙ্গলবারই গেল পেরেন্ট টিচার মিটে।
-তা হোক। তুমি যাবে গিয়ে বলবে তুমি স্বর্ণাভ আর গৌরবের বাবা।
-অ্যাঁ? তারা কারা?
-আমার ক্লাসের দুই অতি নচ্চার বদমাইশ। আমায় খুব বিরক্ত করে?
-বিরক্ত করে মানে?
-মারে।
-তুই ও তো মারিস?যে ভাবে ধুলোমেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফিরিস!
-হ্যাঁ আমিও দি ঘা কতক। কিন্তু এভাবে কতদিন মারামারি  করব?তাই তুমি গিয়ে বলবে তুমি স্বর্ণাভ আর গৌরবের বাবা। বলে মিসের ছড়িটা কেড়ে নিয়ে ওনাকে বেশ কয়েক ঘা মেরে পালিয়ে আসবে।
-(বাবা প্রবল হাসি চাপতে গিয়ে কেশেই ফেলল) তাতে কি হবে?
-মিস ওদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, আর দেবার আগে  সবার সামনে ওদের পিছনে ছড়ি দিয়ে বেদম মারবে---- কেমন মজা হবে?

তুত্তুরী উবাচ ৪ঠা জুলাই ২০১৭
-মা, জানো তো আমরা স্কুলে ইংলিশে আমপাতা জোড়া জোড়া খেলি।
-ইংলিশে? সে আবার কি? রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস্ নাকি?
-না। না। ওটাই ইংলিশে খেলি। ঈশাণী বলল,“রোজ তো বাংলায় খেলি, চল আজ ইংরাজি তে খেলি। ” তাই আমরা ওটাকে ইংরাজি করে নিলাম। মানে যে কটা শব্দ আমরা জানি সে গুলো দিয়েই আর কি।
-কিছুই বুঝলাম না। কি করে?
-শুনবে? ম্যাঙ্গো লিফ জোড়া জোড়া
মারব চাবুক ছুটবে হর্স।
ওরে বিবি ওয়েট।
মাই ম্যাড হর্স ইজ কামিং।
ম্যাড হর্স রান এন্ড শট গান।
অলরাইট ভেরিগুড্।
মেম ইজ ইটিং টি বিস্কুট। হিঃ হিঃ হিঃ। কেমন মা?
- ওরে আমার ট্যাঁশ গরুরে।

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই জুন ২০১৭
-গরমের ছুটিটা পুরো নষ্ট করলি বাবু?এখনও টু থ্রী ফোর এর টেবল মুখস্থ  হল না?
-হয়েছে তো মা। প্রশ্ন কর না?
- সে তো তুই মনে মনে যোগ করে করে বলছিস।
-তো?পারছি তো। আমি তো এক কোটির টেবল্ ও বলতে পারি।
-অ্যাঁ!!! মানে??
-এক কোটি ওয়ানজ্ আর এক কোটি, এক কোটি টুজ্ আর দু কোটি,এক কোটি থ্রীজ্ আর তিন কোটি----
-ওরে থাম বাবা। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল।
-হেহে আচ্ছা মা, বিসেকসি মানে কি?
-বি--সে-ক-সি? কে জানে?জীবনেও শুনিনি। যারা বি সেকশনে পড়ে তারা নাকি?
-ও। তাহলে মেরি প্যান্ট বিসেকসি মানে কি?
(প্রমাদ গুনলাম। দিন দুয়েক আগে এক বহু প্রাচীন বন্ধু এসেছিল, তুত্তুরী যখন তার কন্যার সাথে ক্রিড়া মগ্ন, দুই মা তখন গপ্প করতে করতে টকিং টম নিয়ে খেলছিলাম। আমাদের বর্ণিত সব গপ্পই টম পুনরায় তার কমিক আওয়াজে আমাদের শোনাচ্ছিল। তখনই কার মাথায় যে দুর্বুদ্ধিটা এল, টমকে গোবিন্দার সেই বিখ্যাত “মেরি প্যান্ট ভি সেক্সী,মেরি শার্ট ভি সেক্সী” গানটি শেখানোর কথা, কে জানে। শিক্ষানবিশী অন্তে টম যখন প্রবল বিক্রমে ঐ গানটি গাইছিল, তুত্তুরী সেই সময় ঘরে এসেছিল বটে, টমের ঐ ভয়ানক গান শুনে প্রবল হেসেওছিল। আজ যে এই পরীক্ষা দিতে হবে কে জানতো?)

তুত্তুরী উবাচ ৩রা জুন ২০১৭
-মা রামায়নের শেষটা আমার একদম ভালো লাগে না।
-কেন?
-রামের জন্য। রাম অহল্যাকে মুক্তি দিল, আর নিজের বউকে বনবাস দিল?
-মানে?
-মানে, অহল্যাকে যখন গৌতম মুনি অভিশাপ দিয়ে পাথর বানিয়ে দিয়েছিল, তখন রামই তো তাকে মুক্তি দিল? পরের বউকে উদ্ধার করে যে, সে কেন নিজের বউকে বনবাসে পাঠাবে?
-বাপরেঃ। তুই তো আমার থেকেও বড় ফেমিনিস্ট হবি বাবু। চালিয়ে যা।

তুত্তুরী উবাচ ১৯মে ২০১৭
-(বাবা রাগত স্বরে) তুই একটা অসভ্য গোভূত।ভদ্র সমাজে মেলামেশার  উপযুক্ত নস্। 
-কেন?
-আবার কেন?খাটের আড়ালে লুকিয়ে নাক খুঁটছিস আবার কেন?
- নাক চুলকোচ্ছে তো?
-আআআঃ। তাই বলে জনসমক্ষে চুলকাতে হয়? বাথরুমে গিয়ে চুলকে হাতে সাবান দিয়ে আসতে হয়।
-শোন বাবা, যার নাক থাকে, সেই নাক খোঁটে। হ্যাঁ শূর্পণকা নির্ঘাত নাক খুঁটত না। কারণ খুঁটতে পারত না।
-

তুত্তুরী উবাচ ১১ই মে ২০১৭
-মা দেখো দেখো, কি ভালো সই করেছি মাইরি।
-(বিষম খেয়ে) কি? কি বললি?
-কি ভালো সই করেছি মাইরি। উরিঃ শালা।
-ছিঃ।  কোথা থেকে এত খারাপ কথা শিখছ?
-তোমার থেকে।
-অ্যাঁ?
-তুমি তো সেদিন বাবাকে বলছিলে, কি জঘন্য খেতে মাইরি। আর দাদু তো সেদিন খেলা দেখতে দেখতে চিৎকার  করে উঠল, “উরিঃ শালা। ” আমি বললেই দোষ? দাদু বলেছে, সব শিখে রাখো। সময় বুঝে ঝাড়বে,  তবে বাইরের লোকের সামনে নয়।
- ভগবানঃ। একে রামে রক্ষে নেই দাদু দোসর।

তুত্তরী উবাচ ৯ই মে ২০১৭
-তুত্তুরী খাবে এস।
-না মা। তুমি প্লিজ আমায় খেতে বোলো না। আমার একদম ক্ষিদে নেই।
-এই গরমে কারোরই ক্ষিদে নেই। খেতেই হবে। কোন কথা শুনব না।
-(অভিযোগের সুরে) বাবাআআ! দেখো না বলছি ক্ষিদে নেই। মা তাও শুনছে না।
-(বাবা ট্যাবে বই পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হয়ে) কেন ক্ষিদে নেই কেন? অল্প কিছু খেয়ে নে। মা এত কষ্ট করে রান্না করেছে--
-খেতে পারব না বাবা।  আমার পেটে একটা বাচ্ছা ঢুকেছে। তাই পেটটা ভর্তি। খাবার এতটুকু জায়গা নেই।
- বার করে দে।
-কি করে বার করব বাবা? পেট কাটতে হবে যে?
-যে ভাবে ঢুকিয়েছিস, সে ভাবেই বার করে দিয়ে খেতে বস।
-(হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার মুখে)কি শুরু করেছিস রে ভাই তোরা বাপমেয়ে তে।

তুত্তুরী উবাচ ১লা মে ২০১৭
যারা তুত্তুরী উবাচের পুরানো পাঠক, তারা জানেন যে তুত্তুরী এককালে নিজেকে জগজ্জননী বলে দাবী করত। আমাদের গৃহ পরিপূর্ণ থাকত গেঁজেল জামাই,দুই জোড়া নাতি নাতনী এবং তাদের বাহনাদি দ্বারা। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল, তুত্তুরী আর জগজ্জননী নয়। মা দুর্গার নির্দেশে তুত্তুরী আপাততঃ ‘মদনপুরের পক্ষীরাণী। ” মদনপুর কোথায়?চেনেন না বুঝি? মাসাইমারা থেকে ৪৫কিলোমিটার দূরে তুত্তুরীর নিজস্ব জগৎ মদনপুর। গহীন জঙ্গল। যেন জীবজন্তু নেই যে ওখানে পাবেন না। বাঘ, সিংহ, হাতি ছাড়ুন ক্যাঙারু, প্যাণ্ডা, কোয়ালা এমনকি পেঙ্গুইন পর্যন্ত আছে মদনপুরে। এবং এই সমস্ত জীবজন্তুর দেখাশোনার দায়ভার তুত্তুরীর। তাই তো দাদু তুত্তুরীর নাম দিয়েছে, “লক্ষ্মী মেয়ে পক্ষীরাণী। ” মদনপুরে প্রবেশাধিকার শুধু আমার পিতা এবং আমার কন্যার। দাদুই তো মূখ্য পরামর্শদাতা। না হলে এই যে ক্যাঙ্গারুর  বাচ্ছা গুলো এই গরমে কিছুতেই মায়ের পেটের থলি তে ঢুকছিল না, দাদুর কথা মত তুত্তুরী সোনার অঙ্কুশ নিয়ে তাড়া করল বলেই না-_-_--

সারাদিন আমাদের বাড়িতে মদনপুরের গপ্প চলে। বেঁচে থাক মুকেশ আম্বানী আর জিও কানেকশন,না হলে ফোন বিল দিতেই ফতুর হতাম আর কি। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। আজ আবার দাদু-মামমামের অ্যানিভারসারি। মানে বিয়ের জন্মদিন আর কি। গতকাল মধ্যরাতে অভিনন্দন জানানোর পরও তুত্তুরীর শান্তি নেই। ঘুম থেকে উঠেই দাদুকে ফোন--

-হ্যালো দাদু। আজ তো তোমাদের বিয়ের জন্মদিন। আমি তোমাদের তিনটে গোলাপী মুক্তো দিলাম। হুঁ হুঁ মদনপুরের শুক্তির মুক্তো বাবা। একটা দিয়ে তুমি আঙটি করে পরো আর দুটো মামমামের কানের দুল বানাতে বলো।
- বাঃ।
-মামমাম কোথায়? হ্যালো মামমাম? তোমায় একটা সরু সোনার ছাগল (গোট) হার দিলাম। গোটা হার জুড়ে ছোট ছোট সোনার ছাগল। কি পছন্দ?
-হ্যাঁ মা খুব পছন্দ।
-বাঃ। এতে কি হবে? ৪৩ বছরের বিয়েবলে কথা। দাঁড়াও তোমাদের একটা সোনার দোলনা দি। আগে আমি চড়ে দেখি ছেঁড়ে কি না। ক্যাঁচকোঁচ   ক্যাঁচকোঁচ। নাঃ ছিঁড়ল না। দাদু এস। এবার তুমি আর আমি চড়ব।  ক্যাঁচকোঁচ ক্যাঁচকোঁচ। বলো?
-(দাদু অসহায় ভাবে) তা বেশ তো ক্যাঁচকোঁচ। ক্যাঁচকোঁচ।
-হয়েছে। এবার মামমাম এস। বলো ক্যাঁচকোঁচ। 
-স্কুল কেমন চলছে সোনা? পড়তে বসেছো?
-আঃ মামমাম আবার স্কুল টুল কেন।  যাকগে অত গিফট্ দিলাম-- এবার তোমরা আমায় কিছু দেবে না?
- (দাদু মামমাম সমস্বরে) তোমার কি চাই সোনা?
-আ মা র? আমার আবার কি চাই? তোমরা গরীব মানুষ যা দেবে তাই হাত পেতে নেব।
(অতঃপর ফোনটা কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর গতি ছিল না।)
   

No comments:

Post a Comment