Monday 15 May 2017

সেন দের একদিন


(পর্ব ১)
“পায়েসটা কেমন হয়েছে?” লোভী লোভী চোখে প্রশ্ন করল তৃণা। দিনের বেলাটা যেমন তেমন করে কাটলেও, রাতের খাবারটা ওরা সাধারণত একসাথেই খায়। ওরা অর্থাৎ সোমনাথ, তৃণা, ওদের বছর বারোর পুত্র ঋক এবং বছর সাতেকের কন্যা তনয়া ওরফে মাম্পি।সোমনাথ এক নামি বেসরকারি জীবন বীমা সংস্থায় কর্মরত। তৃণা শিক্ষিকা। ঋক এবং মাম্পি ঠাকুমার হাতেই মানুষ। ঠাকুমা অর্থাৎ রুমেলা দেবী নিজেও শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে কন্যার অর্থাৎ তৃণার ননদের বাড়ি কটা দিনের জন্য বেড়াতে গেছেন। তৃণাদের সরকারি স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। যদিও ঋক মাম্পির বেসরকারি স্কুল এখনও ছুটির নামগন্ধ করছে না।
যাইহোক পরম যত্নে পায়েস বানিয়েছে তৃণা। বর-ছেলে-মেয়ে তিনজনেরই ভীষণ প্রিয়। বানাতে বানাতেই বুঝতে পেরেছে, দুধের তুলনায় চালটা একটু বেশিই পড়ে গেছে আজ। তবু যদি ওদের ভালো লাগে, তাই প্রশ্নটা করল তৃণা।মাম্পি এঁটো মুখেই চকাস করে মায়ের বাজুতে একটা চুমু খেয়ে দুআঙুলে দেখালো, “এক্সেলেন্ট”। সোমনাথ মাথা নেড়ে শারীরিক বিভঙ্গে বোঝাল, “গুড”। ঋকের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলাতেই এক চোট ধুন্ধুমার হয়ে গেছে মায়ের, ফলে এমনিতেই চটে ছিল, মাথা নিচু করে চামচ নাড়তে নাড়তে গোঁজ হয়ে বলল, “ভালোই। তবে ঠাম্মার মত নয়।“
মুহূর্তের মধ্যে গোলাপি মুখটা ব্যথায় কালো হয়ে গেল তৃণার। ভালো হয়নি বললেই পারত। তাই বলে ঠাম্মার সাথে তুলনা? সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “না।না। ভালোই তো হয়েছে।“ ব্যথা পরিণত হল নিদারুণ ক্ষোভে, সেখান থেকে পলকে জন্মালো দুর্নিবার ক্রোধ। গলায় বিষ ঢেলে তৃণা বলল, “থাক। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।“ “যাঃ বাবা!! ভালো কথাই তো বললাম?” হতভম্ব হয়ে বলল সোমনাথ। “ অত ভালোর দরকার নেই বুঝলে। বাঙালরা নাকি আবার ভালো হয়?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তৃণা। “এর মধ্যে বাঙাল ঘটি এল কোথা থেকে? আর তাছাড়া তোমার বাবা তো জেনে শুনেই আমাদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন না কি? বৈদ্য ঘটি সুপাত্র জোটে ইয়ে মানে পাননি তাই।“ মুখ ফসকে বলে ফেলেই প্রমাদ গুনল সোমনাথ।
“ও আমার বর জুটছিল না? তুমি দয়া করে বিয়ে করে আমার বাপকে উদ্ধার করেছ নাকি?” ঝগড়া গড়ালো কান্নাকাটিতে। ক্ষণেক পর আবার ঝগড়া, আবার কান্নাকাটি। মায়ের হয়ে বরাবরের মত গলা ফাটালো মাম্পি, বাবার হয়ে ঋক। ডাইনিং রুম হয়ে দাঁড়ালো যুদ্ধক্ষেত্র। ভাইবোনের এক প্রস্থ হাতাহাতির পর, মাম্পিকে নিয়ে স্টাডিরুমে খিল লাগালো তৃণা।ঋক শুলো বাবার সাথে বেডরুমে।
শুয়ে শুয়ে গজগজ করতে লাগল মাম্পি। “দাদাটা খুব বাজে ছেলে মা। একদম বাবার মতো। তুমি বাবাকে ডিভোর্স করে দাও। কেন বিয়ে করেছিলে এমন বাজে লোককে।“ তৃণার মাসতুতো ভাই আর সোমনাথের খুড়তুতো বোনের সাম্প্রতিক বিবাহ বিচ্ছেদের দরুন ডিভোর্স শব্দটা মাম্পি ঋকের কাছে অপরিচিত নয়। মাম্পি বলেই চলেছে, “ চলো বাবাকে ডিভোর্স করে তুমি আর আমি দাদান-দিদানের কাছে গিয়ে থাকি? অ্যাঁ মা?”মাম্পি দাদু-দিদা অন্ত প্রাণ। বাবা মায়ের ঝগড়া হলেই ডিভোর্সের প্রস্তাব দেয়। যাতে মা, দাদুদিদাকে এক সাথে পেতে পারে। তৃণা মেয়ের শুকনো ঠোঁটে চুমু দিয়ে ভাবতে লাগল, সত্যি যদি বিচ্ছেদ চায়? সোমনাথ আপত্তি করবে না, এটুকু নিশ্চিত। মাঝে মাঝেই তো বলে, আজও বলল, “না পোষালে চলে যাও।“ এতদিন ভাবত, ঝগড়ার সময় রাগের মাথায় বলে, আজ ভুল ভাঙল। চলেই যাবে তৃণা। কিন্তু একার মাইনেতে চলবে কি? দুদুটো বাচ্ছার পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ। সোমনাথ কিছু তো দেবে? নিতে যতই ঘৃণা লাগুক, ও নেবেই। কিন্তু থাকবে কোথায়? দুদুটো বাচ্ছা সমেত ডিভোর্সি মহিলাকে কে বাড়ি ভাড়া দেবে? বাবা মার কাছে থাকা যাবে না। আত্মীয়স্বজন তাহলে আর বাঁচতে দেবে না। সবার কাছে কি যে খোরাক হবে, অনেকেই উল্লসিত হবে, ওর সর্বনাশের খবরে। আসলে সবাই খুশি হবে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীবৃন্দ কে হবে না? বলবে বড় বাড় বেড়েছিল, পয়সার দেমাক, রূপের দেমাক সইল না তো? অথচ ঈশ্বর জানেন তৃণার কোন দেমাক নেই। সহকর্মীরা নির্ঘাত তৃণার পুরানো ভেঙে যাওয়া প্রেমের উপাখ্যান বিশ্লেষ করে বলবে, “তৃণা বউ মেটিরিয়ালই নয়। ফুলে ফুলে মধু খাওয়া টাইপ। অথবা সোমনাথের নির্ঘাত কোন অ্যাফেয়ার চলছে?” অ্যাফেয়ার? সোমের ভাবতেই হাসি পায় তৃণার। ঈশ্বর জানেন ওরা কতটা ভালোবাসে একে অপরকে। আচ্ছা বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও সোম ওর বন্ধু থাকবে তো? সোমের থেকে ভালো বন্ধু তো তৃণার কেউ নেই, কোনদিন ছিল না। সমস্যায় পড়লে তৃণা কাকে ফোন করবে? সোমকে করলে সোম ধরবে তো? এত বড় সহমরমী তৃণা আর কি কাউকে কোনদিন পাবে? ভাবতে ভাবতেই ঘুমন্ত মেয়েকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল তৃণা। সোম না থাকলে সমাজের কুকুর বেড়াল গুলো ওকে ছিঁড়ে খেতে আসবে, সব থেকে বড় কথা, ওকি সোমকে ছেড়ে থাকতে পারবে? রাতে সোমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে না শুলে, সোমের গায়ের গন্ধ নাকে না এলে যে তৃণা ঘুমোতে পারে না। কি হবে?
সেন দের একদিন (পর্ব- ২)
রাগের থেকে বিরক্তি লাগছিল সোমনাথের। মধ্য চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছেও তৃণার এই ছেলেমানুষি গুলো আর নেওয়া যাচ্ছে না। কবে সোমনাথের ঠাকুরদার বাবা কর্মসূত্রে এপাড়ে বাসা বেঁধেছিলেন, দেশভাগ তখন দূর অস্ত। ঠাকুরদা, বাবা সবার জন্ম এ দেশে।ঠাকুমা বর্ধমানের মেয়ে ছিলেন, বোনের বিয়ে হয়েছে ঘটি বাড়িতে আর মা আর তৃণা এখনও ঘটি বাঙাল নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। মা শুরু করে, তৃণা ঘরে এসে ধুন্ধুমার বাঁধায়। আর আজ তো মাও ছিল না। আগামি কাল শনিবার, কোথায় এক পাত্র নিয়ে বসবে, সারা সপ্তাহের না বলতে পারা অজস্র কথা জমে আছে দুজনেরই, তারপর একটা বই পড়বে, শোবার আগে আর এক পাত্র, সব ঘেঁটে দিল মেয়েটা ধুৎ। বইটা নিয়ে শুয়েছে অবশ্য, তবে একটা পাতাও শেষ করতে পারেনি, মাথায় হয়তো ঢুকতও, যদি ঋক বকবকটা থামাতো।

“বিলিভ মি বাবা, শি ইজ জাস্ট হরিবল্। আমাকে কথায় কথায় বলে, বাবামা মুখের রক্ত তুলে বড় করবে, আর তারপরই নাকি আমি ভালো চাকরি পেয়ে ফুড়ুৎ--। বিয়ে করলেই নাকি আমি আর তোমাদের চিনতে পারব না। পর হয়ে যাব। আর বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসব। ব্লা ব্লা ব্লা। ক্যান ইউ ইম্যাজিন?” চরম বিরক্তিতেও হেসে ফেলল সোম। তৃণার কল্পনাশক্তি তুলনাহীন। অবশ্য এই সব কথাই ওর মাও ওকে বলেছে কখনও না কখনও। এ গুলো হল টিপিক্যাল বাঙালি মায়েদের ইন্সিকিউরিটি। তৃণা ঋককে অসম্ভব ভালোবাসে বলেই, সর্বদা হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে থাকে। মাম্পিকে নিয়েও ত্রাসে থাকে তবে তা অন্যরকম আতঙ্ক। ভালো তো সোমনাথকেও বাসে তৃণা, মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা, তাই এত আঘাত করে। মেয়েরা যে কেন এমন হয়? যাকে ভালোবাসে তাকেই আঘাত করতে ভালোবাসে। তৃণার আঘাতে অবশ্য বিরক্তি ছাড়া আর কোন বেদনাই বোধ হয় না সোমনাথের।

ঋক বাবার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল, “ তুমি কি করে সহ্য করো বাবা? ঐ জন্যই তো অমুক নায়ক এবং তমুক গায়ক আর গেটিং ডিভোর্সড। অমুক খেলোয়াড়ের ও শুনছি জলদি ডিভোর্স হতে চলেছে। এভাবে থাকা যায় নাকি? রোজ রোজ ঝামেলা করার থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যাওয়া ফার বেটার। কি বলো বাবা, অ্যাঁ? আই তো হ্যাভ ডিসাইডেড, আমি বিয়ে করছি না। রোজ রোজ মায়ের সাথে খিটপিট খিটপিট কে সইবে? তবে বাবা বুঝলে লিভ ইন ব্যাপারটা মন্দ নয়।“ সোমনাথ দড়াম করে বই বন্ধ করে হাঁ করে ছেলের দিকে তাকালো, ঋক করুণার দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “লিভ ইন ইউ নো। বিয়ে শাদি না করেও একসাথে থাকা। পোষালে থাকো না পোষালে বাইবাই। তবে একটা স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড চাই। মধুজা টাইপ।“

“বাপরে। এত কিছু শিখলি কোথায় রে? মধুজা টাইপ অ্যাঁ? তাই জন্যই মা বলছে কদিন ধরে ছেলেটা গোল্লায় গেছে তুমি একটু দেখো। মধুজার বাবামায়ের থেকে যদি একটা কমপ্লেন এসেছে, বা স্কুল থেকে, আমি তোমার ছাল ছাড়িয়ে ডুগডুগি বানাব। মাও বাঁচাতে পারবে না। বাবা মায়ের ডিভোর্স? অ্যাঁ? স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাঁ? মধুজা? অ্যাঁ? চল মায়ের কাছে----“। চরম নাস্তিক হয়েও মনে মনে  ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো সোমনাথ। এই সুযোগ ছাড়া চলবে না। এই সব নিয়ে ঋককে ভিলেন বানিয়ে আগে বউকে তো পটানো যাক, তারপর ঋক কি করল মধুজা না আয়েশাকে পটাল নাকি তাও পারল না ঢ্যাঁড়শ ছেলে টা তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয় সোমনাথ সেন।

ছেলের কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে স্টাডির দরজায় টোকা দেবার আগেই দরজা খুলে দিল তৃণা। কোলে ঘুমন্ত মাম্পি, কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তৃণার মনে হল, “এত ভালোবাসা! এত ভালোবাসা দিয়েছ প্রভু?” আর সোমনাথ ভাবল, “যাক আজকের মত শান্তি। এখনও সময় আছে, তৃণা যদি খেপে না যায়, এক পাত্র হতেই পারে?”



No comments:

Post a Comment