Friday 26 May 2017

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি (part 1)২৩মে ২০১৭

এই মে মাসের চাঁদিফাটা দমচাপা গরমে কেউ পুরী যায়? পাগল ছাড়া? দেবশ্রীদি যখন প্রথম প্রস্তাবটা দিয়েছিল এটাই ছিল আমার এবং শৌভিকের যৌথ প্রতিক্রিয়া। দ্বর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলাম আমরা নাচার। প্রথমতঃ শৌভিক ছুটি পাবে না,  দ্বিতীয়তঃ কলকাতার গরমেই অর্ধপক্ক হচ্ছি আর পুরী গিয়ে পূর্ণ পক্ক হবার কোন বাসনা নেই। তাও আবার সাত দিনের জন্য?
দেবশ্রীদি কিন্তু হাল ছাড়ল না। দেখা হলে বা না হলে বারবার বলতে লাগল, “তুমি একটু দেখ। কেন জানি না মন বলছে তুমি চাইলেই যেতে পারবে। ”ব্যাপারটা হচ্ছে গ্রীষ্মের ছুটিতে পুরীতে উজানের সাত দিনের ক্যারাটে স্কুলের সামার ক্যাম্প। উজানকে আত্মনির্ভর করার জন্য এই ক্যাম্পে পাঠাতে ইচ্ছুক হলেও দেবশ্রীদি পুত্রকে একাকী শ্রীক্ষেত্রে পাঠাতে একেবারেই নারাজ। তাই উজান তার গ্রুপের সাথে আসবে, আলাদাই থাকবে কিন্তু উজানের মা ঠিক করল সে আসেপাশেই থাকবে। যাতে সকাল সন্ধ্যা অন্তত এক ঝলকের জন্য ও ছেলেকে দেখতে পায়।  কিন্তু সাত সাতটা দিন একা আলাদা হোটেলে কাটানো অসম্ভব। তাই দেবশ্রীদি তার ঘনিষ্ট বান্ধবীদের প্রস্তাব দেয়, যদি তারাও যেতে রাজি হয় তাহলে সোনায় সোহাগা।
বিদিশা দি এবং সুকন্যা সত্যিই রাজি হয়ে যায়। তারপর সম্মিলিত ত্রিশূল আক্রমণ চলতে থাকে, “ আরে চলোই না। ভালো লাগবে।”
তিনজনই আমার এত প্রিয় যে এদের সম্মিলিত বারংবার অনুরোধ নাকচ করতে খুব খারাপ লাগছিল। শৌভিক বলল,“তুই চলে যা না-মেয়েকে নিয়ে। ” “বাঃ। আর তুই?খাওয়া দাওয়া?” জবাব পেলাম,“ আরেঃ আমার চিন্তা করতে হবে না। কটা দিন আমি দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। তাছাড়া বউ মানেই যে বরের রাঁধুনী বা ধাত্রী নয় এটা যদি তোকে বোঝাতে হয়, তাহলে কাল থেকে নিজেকে ফেমিনিস্ট বলা ছেড়ে দে। ” আঃ এই না হলে আমার বর----
সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু মন যে মানেনা। ভাবলাম একবার মা বাবাকে বলে দেখি। দুজনেরই যা শারীরিক সক্ষমতা এই ধরনের ট্রিপ ওদের জন্য আদর্শ। সাতদিন শুধু সমুদ্র দেখা মন্দ কি?
কিন্তু বাবাকে রাজি করানো আর পাহাড় টলানো প্রায় সমান। বললেই শুনতে হয়, “না মানা। তোরা ঘুুরে আয়। আমাদের আর এই বয়সে কোথাও টানিসনি। আমাদের ঘরই হল অনন্ত শান্তির নীড়। ”
অগত্যা ওরা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে নিজেদের টিকিট হোটেল বুকিং করে ফেলল। আমরা যাচ্ছি না। দেবশ্রীদি অবশ্য এখনও হাল ছাড়েনি ঠিক যে ভাবে হ্যারি পটার পড়ার জন্য আমার পিছনে পড়ে ছিল, যার ফলে আমার জীবনটাই কোথাও বদলে গিয়েছিল তেমনি ভাবেই বলতে লাগল-“একটু দেখ না। একটু চেষ্টা কর না--”

অবশেষে বাবা যখন রাজি হল তখন আর মাসখানেক বাকি মাত্র। দেবশ্রীদি বলল এখুনি টিকিট কাটো। স্টেশনে বা এজেন্ট ধরার আর সময় নেই। সবাব টিকিট দেবশ্রীদিই কেটেছিল কিন্তু সেই মুহূর্তে দেবশ্রীদি যেখানে ছিল সেখান থেকে টিকিট কাটা সম্ভবপর নয়। এইরে আমার আইআরসিটিসি অ্যাকাউন্টটা তো দীর্ঘদিন না ব্যবহারে ঘেঁটে গেছে। বাবার শৌভিকের মেল আইডি দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতোদ্যম হয়ে শেষে আমার বান্ধবীদেরই বললাম, কেউ একটু তার ইউজার আডি আর পাসওয়ার্ডটা যদি দয়া করে শেয়ার করে--।  দয়া শব্দটার জন্য দুটো গালি দিয়ে সুকন্যা তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিল তার আইডি। অতঃপর আর কি? দিদিরা বলল “যাতে পাচ্ছ তাতেই কাটো”। ধুর ছাই কোনো ট্রেনেই কনফার্ম পেলাম না। হয় ওয়েটিং নয় আরএসি। ওরাও পুরী এক্সপ্রেসে কেটেছে জিজ্ঞাসা করে আমরাও কাটলাম। যথারীতি   আরএসি। প্রতিনিয়ত কতবার যে পিএনআর স্ট্যাটাস চেক করতাম তার ইয়ত্তা নেই। হে ভগবান অন্তত দুটো কনফার্ম করে দাও। তুত্তুরী আর আমি না হয় বসে বা একটা বার্থে দুজন শুয়ে চলে যাব কিন্তু ওরা? আর যদি বার্থ পাইয়েই দাও তাহলে লোয়ার বার্থ দও প্রভু। বাবা মা বা তুত্তুরীর পক্ষে আপার বার্থ তো অভিশাপ মাত্র। ২২তারিখ ট্রেনে উঠে দেখি ঠিক দুটি বার্থই কনফার্মড। বাকি দুজনের জন্য একটি বার্থ এবং মজার কথা হল সবকটিই লোয়ার বার্থ। উফঃ কি যে আনন্দ হচ্ছিল শুধু মনে হল পে কমিশনটাও যদি একই সাথে চেয়ে নিতাম----

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৩মে ২০১৭ (পর্ব ২)
টিকিট তো কাটা হল, এবার হোটেল বুকিং। বুকিং দেবশ্রীদি আগেই করে রেখেছে পুরী হোটেলে কিন্তু আমাদের বিলম্বিত সিদ্ধান্তের ফলে আমরা পড়লাম মহা আতান্তরে। দেবশ্রীদি বারংবার অনুরোধ করতে লাগল, “প্লিজ যাও। পুরী হোটেল বুক করো। আমি কলকাতায় থাকলে না হয় আমিই যেতাম।" কিন্তু সুদূর ফার্ণ রোডে গিয়ে কে বুক করাবে?শৌভিকের এক পরিচিত এজেন্ট চেষ্টা করে বলল ওরা ইমেলের জবাব দিচ্ছে না। যাঃ কি হবে??
চুঁচুড়ায় অফিস করে সপ্তাহের মাঝে কে দৌড়বে ফার্ণ রোড?আর সপ্তাহান্তে গৃহকর্মের যে পাহাড় জমে তা সরিয়ে দৌড়ানো অসম্ভব। অগত্যা সোনালি হোটেলই ভরসা। ম্যাঙ্গো লেনে অফিস, নিউ সেক্রেটারিয়েটে কোন কর্মপোলক্ষে গেলে বুক করানো নস্যি। পেয়েও গেলাম। বাতানুকূল কামরা, মা একদম গরম বরদাস্ত করতে পারে না। তবে সমুদ্রমুখী নয়।

        ইতিপূর্বে সোনালিতে থাকার অভিজ্ঞতা মোটামুটি। তাই বুক করে দিলাম। স্বর্গদ্বারের ওপর। মার পক্ষে বাজার পরিক্রমাও সহজ হবে। টাকা দিয়ে দেবার পর হঠাৎ দেখি ঐ কতৃপক্ষই অপর একটা হোটেল খুলেছে নাম সোনালি রেসিডেন্সি,  পুরী হোটেলের ঠিক পিছনে। ভজহরি মান্নার পাশেই। হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা যাবে না বটে তবে নেমে দু কদম হাঁটলেই তো হল। সর্বোপরি পুরী হোটেলের একদম পিছনে, আমার তিন বন্ধুর পাশাপাশি ও থাকা যাবে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,  সমুদ্র না দেখা গেলে আপত্তি আছে কি না? বাবার জবাব মোটামুটি প্রত্যাশিতই ছিল, “ তোর যা খুশি। ওখানে আমরা যাব শুধু তুত্তুরীর সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে, তুই তোর বন্ধুদের সাথেই সময় কাটাস। ” মহানন্দে সোনালি রেসিডেন্সি বুক করে বাড়ি ফিরলাম। শুধু শৌভিক আর দেবশ্রীদি শুনে বলল, “এত কষ্ট করে পুরী যেতে পারছ আর পুরী হোটেল বুক করাতে পারলে না?”
অধীর আগ্রহে তুত্তুরী দিন গুনতে শুরু করল, আমরা চার সখীও যৎপরনাস্তি উল্লসিত, বাঁধনহীন একটা ট্রিপ শুধু প্রিয় বন্ধুদের সাহচর্য মধুর আহাঃ। বাকি তিনজন টুকটাক জামাকাপড় ও কিনতে লাগল বিচে পরার উপযুক্ত, টি শার্ট,  ট্যাঙ্ক টপ, স্কার্ট, ট্রাউজার,  হাফ প্যালাজো, টিউনিক ইত্যাদি ইত্যাদির ট্রায়াল দেবার ছবিতে ভরে উঠল হোয়াটস্ অ্যাপ। আমি কিছুই কিনছিলাম না শুধু প্রার্থনা করছিলাম হে ঠাকুর আর একটু ইয়ে মানে রোগা করে দাও প্রভু।
যাবার ঠিক এক মাস আগে বিনা মেঘে বজ্রপাত, অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রেনে উঠে হোয়াটস্ অ্যাপ অন করেছি সুকন্যার মেসেজ,  কাকু আচমকা খাট থেকে পড়ে গেছেন এবং ফিমার বোন ফ্রাকচার্ড। পরবর্তী  কয়েকটা দিন যে কি ভাবে কাটিয়েছে সুকন্যা তা শুধু ঐ জানে। প্রথম চোটে মেদিনীপুরের স্থানীয় নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হল,  সু তখনও বলে যাচ্ছে “টিকিট বাতিল করো না। একটু দেখি। ”
ঠিক ছিল পরের দিন অস্ত্রোপচার হবে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কিছু শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে, কাকুকে আনা হল পিয়ায়লেস এ। সফল অস্ত্রপচারের পর ডাক্তার বলেই দিলেন তিন সপ্তাহ সম্পূর্ণ বেড রেস্ট। সু তো জানিয়ে দিল টিকিট ক্যানসেল করে দাও, আমরা কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই হাহুতাশ করে চলেছি, ইশ্ সু থাকলে আরো কত আনন্দময় হতো ব্যাপারটা। উটো অর্থাৎ সু’র সুপুত্র থাকলে এক্ষণে তুত্তুরীর সাথে তাল মিলিয়ে কি তুলকালামই না করত।

দেখতে দেখতে ২১তারিখ এসে গেল, কালই ট্রেন। রবিবার দ্বিপ্রহরে রান্না শেষ করে গলদঘর্ম হয়ে সবে স্নানে যাব, দেবশ্রীদির ফোন, “এই কাল তোমাদের ট্রেন কটায়?”  অবাক হয়ে বললাম, “কেন?পুরী এক্সপ্রেস? রাত সাড়ে দশটায়?” দেবশ্রীদি আতঙ্কিত হয়ে বলল,“সর্বনাশ। আমাদেরও পুরী এক্সপ্রেস। কিন্তু ট্রেন তো সাড়ে আটটায়? এই দেখলাম। বিদিশা তো দিব্যি সাড়ে নটায় হাওড়া স্টেশন পৌছবে বলে বসে আছে?” জটচলদি আইআরসিটিসি খুলে দেখি সত্যিই দুটোই পুরী এক্সপ্রেস। একটা দৈনিক আর একটা সাপ্তাহিক। গণ্ডোগোলটা এখানেই হয়েছে।  যাক কি আর করা? তাহলে আলাদা আলাদাই যাই। বিদিশাদি শুধু সারাদিন আতঙ্কিত হয়ে বারবার বলছিল, “ওরে কি সর্বনাশ হতো রে। ট্রেন মিস করলে মাথা নীচু করে ফিরে আসতাম রে। কি ট্যালারে আমরা। মা বেপোট চেল্লাচ্ছে, কুড়িটা তিরিশ আর বাইশটা তিরিশের তফাৎ বুঝতে পারিনি বা খেয়াল করিনি বলে।” ভয়ে নিজের বাড়িতে আর ঘটনাটা জানালাম না, মায়ের এমনি বদ্ধমূল  ধারণা যে আমি ট্যালা চূড়ামণি, যদি জানতে পারে যে বন্ধুবান্ধবও তথৈবচ তাহলে হয়তো শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসবে। কি দরকার বাপ?এই বেশ ভালো আছি----
অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৩মে ২০১৭ (পর্ব ৩)

পুরীতে যখন নামলাম তখনও জানি না যে কি ভয়ানক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। সাতটার ট্রেন পুরী পৌছল বেলা নটায়। মাঝরাতে নাকি ট্রেন এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে  ছিল, যদিও আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটো চেপে পৌছলাম সোনালি রেসিডেন্সিতে। বাইরে থেকে মন্দ নয় দেখতে। ভিতরটা অতি সাধারণ,রিশেপসনে সইসাবুদ করার সময় অবাক হলাম কোন আইডি প্রুফ চাইল নাতো? যাই হোক বলা হল তিন তলায় ঘর,রুম নম্বর ৩০২। তিন তলা তা মন্দ কি?লিফট্ আছে নিশ্চয়? রিশেপসনে বসে থাকা ঘন কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তিটি ঘাড় নেড়ে জানালো না লিফট চালু হয়নি। পরে বুঝেছিলাম লিফট্ বসানোর জায়গাই নেই ওদের। সর্বনাশ!লিফট নেই? বাবা এবং মার যা বয়স এবং হাঁটুর যে তথৈবচ অবস্থা ওরা ওঠানামা করবে কি করে?
গজগজ করতে করতে রুমে গেলাম,  বাবা মা ধীরে ধীরে উঠতে লাগল, এবার তো কিছু খেতে হয়।  সকাল থেকে এক কাপ চাও কারো পেটে পড়েনি, ঘড়ির কাঁটা দৌড়চ্ছে সাড়ে নটা থেকে পৌনে দশটার দিকে। ঘরে রাখা ইন্টারকমটি যে শুধু দ্রষ্টব্য বস্তু মাত্র তা বুঝতে বেশি সময় লাগল না। অগত্যা নামলাম একতলায়, তেঁতো মুখে কৃষ্ণকায় রিসেপশনিস্টকে বললাম “  চা আর ব্রেকফাস্ট লাগবে। রুমে পাঠিয়ে দিন। ”লোকটি হেসে উড়িয়া টানে বাঙলায় বলল,“  রুম সার্ভিস তো নেই। বললে বাইরে থেকে চা এনে দেবে। ব্রেকফাস্ট বাইরে গিয়ে করতে হবে। ”
আর নিতে পারছিলাম না। এত অসহায় খুব কমই বোধ হয়েছে। দেবশ্রীদি এবং বিদিশা দি ভোর সাড়ে পাঁচটায় নেমে পুরী হোটেলে চেক ইন করে স্যান্ডউইচ আর চা খেয়ে সমুদ্রে জলকেলি করতে নেমে গেছে আর আমরা? মেসেজ পেলাম ওদের ঘর থেকেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, আর আমাদের ঘরের একদিকে একটা সরু লম্বা বারন্দা যার ও পাশে দু ফুটের একটা এঁদো নোংরা গলি আর তিন ফুটের পাঁচিল টপকালেই আর একটি হোটেলের সরু বারন্দা এবং সারি সারি ঘর। আর ঘরের অন্যদিকে কাঁচের শাটার টানা দরজার ওপারেও একই রকম দুফুট ছেড়ে একটি কদাচার হোটেলের ঘর। শৌভিককে ফোনে বললাম,শৌভিক শুধু বলল,“কোথ থেকে এমন হোটেল জুটিয়েছিস বাপ?”বাবা পাশ থেকে সান্ত্বনার সুরে বলল, “এসি আছে। ” শুনে শৌভিক অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,“এসি তো বাড়িতেই আছে। কষ্ট করে অতদূর যাবার দরকার কি ছিল?”
সত্যিই তাই। বাবা মার কষ্ট দেখে ডাক ছেড়ে কান্না পাচ্ছিল। এখনও চা এনে দেবার লোক পাঠাল না এরা। আবার গেলাম, যে বেয়ারাটি মালপত্র ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল তাকেই ধরলাম। টাকা নিয়ে সে একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে চা আর চারটি কাগজের কাপ এনে দিল। জলখাবার?নীচের রুচিরা নাম্নী রেস্তোরাঁয় খোঁজ নিয়ে জানালো কিচ্ছু নেই। সর্বনাশ বেলা দশটা বাজেনি অথচ প্রাতঃরাশের উপকরণ শেষ?ব্যাগে কেক বিস্কুট ছিল অবশ্য।
দুই দিদিকেই ফোন করলাম, কেউ ধরল না। তীব্র হতাশায় ডুবে ছিলাম বলে এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে এসিটা একদম ঠাণ্ডা করতে পারছে না। বিগত এক ঘন্টা ধরে এসি এবং ফ্যান উভয়েই ঘুরে চলেছে, অন্যত্র হলে চাদর মুড়ি দেবার প্রয়োজন হত, এখানে রীতিমতো ভ্যাপসা  লাগছে। ঘরের থেকেও বাইরের তাপমাত্রা অনেক কম বরং। লোক ডাকলাম, দেখে বলে গেল,“চলিছে তো। ঠাণ্ডা হইছে তো। গরম বড় বেশি কি না?” আমি বাঙাল নই বটে তবে এভাবে হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা মানা যায় না।
কি রকম অদ্ভূত বিষাদ গ্রাস করছিল আমাদের। কি হবে? এই রকম বদ্ধ কূপে কি ভাবে সাতটা দিন কাটাবো আমরা?অ্যাটাচড্ বাথ বলে যেটি আছে তা এতই অপরিসর যে শাওয়ার চালালে শুকনো জামা কাপড় রাখা দায়। কমোড এত অপরিষ্কার যে গা গুলিয়ে ওঠে। নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার আঘের মুহূর্তে মনে হল একবার সোনালি হোটেলে কথা বলে দেখি। সাত দিনের জন্য এত টাকা দিয়ে বুক করেছি, যদি ওরা ঐ বিল্ডিং এ শিফট করে দেয়? অতিরিক্ত টাকা না হয় দিয়ে দেওয়া যাবে। ফোন করলাম। একাধিক বার। কলকাতা অফিস ধরলই না। আর সোনালি হোটেলের ম্যানেজার অত্যন্ত অভদ্র ভাবে জানিয়ে দিল যে ওরা অ্যাডজাস্ট করবে না। অর্থাৎ এখানেই পচে মরতে হবে আমাদের। কেন এলাম?বাবা মাকে কি এই বয়সে নিছক শাস্তি দেবার জন্য নিয়ে এলাম???

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৩মে ২০১৭ (পর্ব ৪)

চূড়ান্ত মন খারাপ করে বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছিলাম। কি করি?হোটেল পাল্টাবো কি?ঘর পাব কি, পুরীতে এমনিতেই পর্যটক গিজগিজ করছে। আর সবথেকে বড় কথা এরা একটা টাকাও ফেরৎ দেবে না। আমার প্রায় সাতদিনের পুরো ভাড়াই দেওয়া আছে, পুরোটাই লস্ হয়ে যাবে। এমন সময় বিদিশা দির ফোন, স্বভাব সিদ্ধ উচ্ছাসের সাথে জিজ্ঞাসা করল আমরা কোথায়? সমুদ্রস্নানে গেছিলাম কি না?ওরা এই সবে দীর্ঘক্ষণ সমুদ্রে মাতামাতি  করে ঘরে ঢুকেছে। সব বললাম। সমুদ্র দর্শনে গিয়েছিলাম বটে তবে হোটেল সংক্রান্ত তিক্ত কটু অভিজ্ঞতার জন্য মেজাজ এতটাই খারাপ ছিল যে কিছুতেই সমুদ্রটাকে ভালো লাগাতে পারিনি। দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঘরে ফিরে এসেছিলাম।
হোটেলে ফিরে একটানা এতটা হেঁটে এসে তিনতলায় উঠতে পারবে না বলে বাবামা নিচের লাউঞ্জে বসে ছিল, তখন দেখলাম আরো একটা পরিবারও প্রবল ঝগড়া বিবাদের পর টাকা পয়সা না দিয়েই হোটেল ছেড়ে চলে গেল।
বিদিশাদির সাথে কথা বলতে বলতেই দেবশ্রীদি স্নান সেরে বেরিয়ে এসে সব শুনে জিজ্ঞাসা করল ওরা খোঁজ নিয়ে দেখবে কি, পুরী হোটেলে কোন ঘর খালি আছে কিনা?হাতে চাঁদ পেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঘর আছে। সমদ্রমুখী বাতানুকূল ঘর। দেখতে গিয়ে দেখলাম এটাও তিনতলা এবং লিফট নেই। তা হোক। ঘরের দরজা খুলতেই কনকনে ঠাণ্ডা সামুদ্রিক হাওয়া সব তিক্ততা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। খোলা বারন্দা দিয়ে উত্তাল নীলচে অমরেন্দ্র বাহুবলী মার্কা সমুদ্র দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে, বাথরুমটা তুলনায় বেশ বড় এবং পরিষ্কার। এসিটাও চলছে বলেই মনে হল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
ঠিক হল দ্বিপ্রাহরিক আহার ভজহরি মান্নায় সেরে সবাই এই হোটেলেই চলে আসব। একটু রেস্ট নিয়ে মালপত্র আনতে যাব সন্ধ্যা বেলায়।
আমি আর টাকাপয়সা ফেরৎ পাবার আশা না করলেও আমার দুই বান্ধবী এত সহজে ছাড়তে নারাজ। দেবশ্রীদি এবংবিদিশা দি বলল,“তুমি না বলতে পারলেও আমরা বলছি চল। এতগুলো টাকা ইয়ার্কি নাকি। অন্তত গলা  ফাটিয়ে ঝগড়া তো করাই যায়। ” সত্যি ওরা ঐ রোদে আমার সাথে হোটেলে এল। বাবা এবং ওদের মতে আমার হোটেলর রুমটা ছেড়ে দেওয়া অনুচিত। থাক না সাতটা দিন ঘরটা বন্ধ হয়ে। কিন্তু আমার আর একবিন্দুও ওখানে থাকার ইচ্ছা ছিল না।

ওরা সত্যিই ঐ রোদে আমার হয়ে গলা ফাটাতে এল। প্রচুর কথা শোনানো হল, শুনবে কে?হাবাগোবা রিশেপসনিস্ট শুধু একটা কথাই বলতে শিখেছে,“ কেন যাবেন? এসি তো দিব্য চলছে। টাকা কিছু ফেরৎ হবে না। ”
ধুত্তোর বলে বাবা মা আর তুত্তুরীকে নিয়ে গিয়ে উঠলাম পুরী হোটেলে। দুই প্রাণাধিক সখী বলল,“কোন চিন্তা নেই। মালপত্র নিতে যখন আসবে কাকু কাকিমার আসার দরকার নেই। আমরাই আসব সব গুছিয়ে নিয়ে যাব। এবং আর এক প্রস্থ ঝগড়া করে যাব। ”
সত্যিই তাই বিকালে তিনজনে গিয়ে অগোছালো মালপত্র পুনরায় গেছিয়ে নিলাম এবং আর এক দফা আশ মিটিয়ে কথা শুনিয়ে এলাম। আমরা সোশাল মিডিয়ায় দেব। আমরা জনে জনে নিষেধ করব, কেউ যেন সোনালিতে না আসে। আমরা কনজিউমার ফোরামে যাব ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য কোন কিছুতেই ওদের কিছু যায় আসে না বেশ বোঝা গেল।

পুরী হোটেলে পৌছে দেখি তুত্তুরী বারন্দায় বসে প্রবল চিৎকার করে উট ডাকছে। উটের পিঠে চাপবে বলে। পুরীতে তখন সন্ধ্যা নামছে আমরা তিন সখী তুত্তুরীকে নিয়ে হাজির হলাম বালুকাবেলায়। চতুর্দিকে জনারণ্য তবুও মন্দ লাগছিল না। প্রবল হাওয়ায় অবিন্যস্ত জামাকাপড় এলোমেলো চুল তবু পুরী তো বটে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাও কি মনোরম।
একট উটকে ডাকা হল, উটের গায়ে মই ঠেকিয়ে তুত্তুরী চটপট উঠে গেল। এবার উটওলা নব্য যুবক আমাকে বলল,“তুমিও উঠো। নাহলে বাচ্ছা পড়ে যাবে যে। ” ভালো কথা, বললাম তোমার উটকে বসতে বলো, যেমন লালমোহন বাবু চড়েছিলেন সোনার কেল্লায়, তেমন করে চড়তে পারি, ঐ সটান দাঁড়িয়ে থাকা উটের গায়ে ঠেকানো মই বেয়ে কে উঠবে? জবাব পেলাম, ওর উট বসে না। এভাবেই চড়তে হবে। জননী হবার জ্বালা কিছু কম না। কি করে মেয়েকে একা অচেনা উট এবং উটওয়ালির সাথে ছাড়ি রে বাবা। অগত্যা উটে উঠতে গেলাম। দামাল হাওয়ায় এলোমেলো স্কার্ট সামলে সরু বাঁশের মইয়ে তিন ধাপ চড়ে আর না পারছি উঠতে না নামতে। আরো উপরে উঠব কি করে, ধরব কি?উটকে ধরতে গেলেই সে নড়ে উঠছে। বিদিশা দি হাসতে হাসতে বলল,“ তুমি নামো। আমি চড়ছি তুত্তুরীর সাথে।  ” নামব কি করে রে বাবা? যতই পা ঝোলাই কিছুতেই আর নীচের ধাপে পা পৌছয় না। বিদিশা বললো জাম্প্। ইল্লি আর কি? এত উঁচু থেকে বালিতে লাফালে আর দেখতে হবে না। হাঁটু ছড়ে কেটে পা মচকে কি যে হবে? উটওয়ালা শেষে পা ধরে টানতে লাগল, যাতে নীচের ধাপে পা দিতে পারি। সে কি কেলো। চূড়ান্ত রেগে গিয়ে বললাম হয় পা ছাড় নয় পদাঘাতে তোকেই মাটিতে ফেলে দেব। শেষে কি ভাবে যেন নামলাম বাপরে বাপ। বিদিশা দি চট করে উঠে গেল। আর মরুভূমির জাহাজ ও মসৃণ ভাবে বালির উপর দিয়ে চলতে লাগল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাপসঃ।

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৪মে ২০১৭ (part 5)
পুরীতে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। দেবশ্রীদি ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে হাজির সমুদ্র সৈকতে। ঠিক ঐ সময় থেকে বালুকাবেলায় উজানদের ক্যারাটে প্র্যাকটিস শুরু হয়। আমি আর বিদিশা দি ঠিক করলাম আমরাও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠব। সাড়ে পাঁচটা না হলেও অন্তত ছটায় উঠে বারন্দা থেকে এক প্রস্থ উজানদের ক্যারাটে অভ্যাস দেখব এবং তারপর সাড়ে ছটা বা সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব মোহনার উদ্দশ্যে। যাবার সময় পদব্রজেই যাব। ফেরার সময় না হয় অটো নেওয়া যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অ্যালার্মকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে যখন চোখ মেললাম ঘড়ি বলছে সময় সাড়ে সাত। তড়িঘড়ি বারন্দায় ঘিয়ে উজানদের প্র্যাকটিস দেখতে দেখতে বিদিশাদিকে ফোন করলাম। তিনতলার বারন্দা থেকে মনে হচ্ছিল সৈকতে একদল সাদা পোশাক পরা পিপিলীকা নৃত্য করছে। চশমা ছাড়া চোখ রগড়ে ভালো করে উজানকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বিদিশাদি আশ্বস্ত করল, ও নিজেই সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছে।
প্রাতঃরাশান্তে দেবশ্রীদিও পুত্রের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফিরে এল। উজান দিব্য মানিয়ে নিচ্ছে পরিস্থিতির সঙ্গে। গতকাল সন্ধ্যাবেলাও ওর মন বেজায় খারাপ ছিল,  বাড়ির লোকের জন্য এবং অবাতানুকূল কামরা তথা ইন্ডিয়ান স্টাইল ইয়ের জন্য। তারওপর একঘরে পাঁচজন ছেলেকে রাখা হয়েছে। যাদের মধ্যে একটি ভারি দুষ্টু , উজান টয়লেটে গেলেই আলো নিভিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল। তবে আজ শুনলাম একটু ধাতস্থ।
এরপর তুত্তুরীকে নিয়ে তিন সখীর সমুদ্রস্নানে যাওয়া ছাড়া আর কি বা বাকি থাকে? পুরীর সমুদ্র আর পাঁচটি বাঙালির মত আমারও ভীষণ প্রিয়। প্রতিবারই গিয়ে দেখি দামাল থেকে দামালতর হয়ে গেছে এবং প্রতিবারই শুনি কোন বাঙালি কাকু বঙ্গীয় টানে হিন্দি ভাষায় নুলিয়াকে প্রশ্ন করছে,“ইয়ে কেয়া সুনামি কা এফেক্ট হ্যায়?” এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। গাঢ় শ্লেট আর ধুসর বর্ণ বাহুবলী মার্কা সমুদ্র তীব্র  বেগে আছড়ে পড়ছে তটভূমিতে। প্রতিবারই বেশ কিছু সংখ্যক মহিলার বস্ত্রহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। কেন যে এরা শাড়ি পরে সমুদ্রে নামেন?অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়া। হয়তো এনাদের শাড়ি ভিন্ন অন্য বস্ত্রসম্ভার নেই। কিন্তু শাড়ি পরে সমুদ্রে নামলে ভালো হয় যদি পাড়ে বসে থাকেন। জলকেলি করতে নেমেছেন কি সমুদ্র আপনার শাড়ি খুলে দেবে। শুধু শাড়ি খুলেই ছাড়ে না বাকিটা ধরেও খামোকা টানাটানি করে। আর সবথেকে ভয়ানক হয় যারা নাইটি পরে নামেন। উফ্ ভগবান। গোটা পুরী জুড়ে শুধু নাইটি পরা মহিলা। কেউ গলায় ওড়না দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ বা একটা হাউসকোট চাপিয়ে ঘুরছেন। কেউ কেউ এমনি ঘুরছেন এবং এমনি এমনি সমুদ্রেও নেমে পড়ছেন।
আমি তুত্তুরী এবং দেবশ্রীদি পাড়ের কাছাকাছি থেকে  বেপোট সমুদ্র স্নান করলেও বিদিশাদি মাঝ সমুদ্রে সাঁতার কেটে এল নুলিয়ার সহায়তায়। অতঃপর তুত্তুরীও একই নুলিয়ার সাথে টিউবে চড়ে বেশ ভালো করে সমুদ্রকেলি করে এল।
দুপুরে জম্পেশ করে ভাতঘুম দিয়ে দেবশ্রীদি দৌড়ল উজানের সামার ক্যাম্পে। আর আমরা পুরী হোটেলের সামনের বালুকাবেলায় ঘুরঘুর করতে লাগলাম। সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ দেবশ্রীদি ফিরলে তুত্তুরীকে মা বাবার জিম্মায় গছিয়ে আমরা তিন সখী হাঁটতে লাগলাম অন্ধকার সমুদ্রের কিনারা বরাবর। জনাকীর্ণ  অঞ্চল পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা বালুকাবেলায় বসলাম তিনজনে। কত গল্প জমে আছে, কত তিক্ততা,  কত মেজাজ হারানো মন খারাপ করা গল্প। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে বিশাল উদার প্রকৃতির সামনে যে কিছুই মনে পড়ছে না। উদ্দাম হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে জামাকাপড়, উড়ে যাচ্ছে সব মনখারাপ। মাঝে নৈশভোজ করে আবার গিয়ে বসলাম সমুদ্রের ধারে। তুত্তুরী নিষেধ অমান্য করে দুহাতে খুঁড়ে যাচ্ছে বালি আর আমরা তন্ময় হয়ে যাচ্ছি এই নিশি আর সমুদ্রের মিলনে। সাড়ে এগারোটায় বন্ধ হয়ে যায় পুরী হোটেলের গেট। নাইটগার্ড গিয়ে খুঁজে না আনলে তুত্তুরী বোধহয় একটা পাহাড়ই বানিয়ে ফেলত। ভূস্বর্গ বোধহয় আমরা চাইলেই সৃষ্টি করতে পারি।

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৫শে মে ২০১৭ (পর্ব ৬)
আজকের দিনটাও কালকেরই মত শুরু হল। আয়েশ করে একটু বেলা অবধি ঘুমানো। বারন্দা থেকে উজানদের প্রাত্যহিক কসরত দেখা, দেখতে দেখতে পুরী হোটেলের ভয়ানক ফোটানো চা খাওয়া। সাতদিন ধরে সকালবিকাল ঐ সাংঘাতিক চা খেয়ে নির্ঘাত পাকস্থলী এবং অন্ত্রে কালো ছোপ পড়ে গেছে। প্রাতরাশ বলতে হয় পুরী হোটেলের লুচি তরকারি মিষ্টি না হলে হোটেল থেকে বেরিয়ে মিও আমোরের স্মোকি চিকেন রাপ(wrap)। পুরী হোটেলের লুচি তরকারিটা মন্দ হয়। বেশ বড় বড় চারটে লুচি থাকে। আদতে পুরি বলাই সঙ্গত। সাথে ভয়ানক লাল রঙের একটা আলুর তরকারি। যাতে পেঁয়াজ এবং টমেটো কেচাপ ছাড়া অন্য মশলা বোধহয় পড়ে না। খেতে মন্দ না। আর একটি করে রসগোল্লা। একটা প্লেটে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক স্বচ্ছন্দে প্রাতরাশ  করতে পারে। এছাড়া ওদের মশলা ধোসাও বেশ ভালো। আমি অবশ্য খাইনি। মা বাবা খেয়েছিল এবং সেদিন আর দ্বিপ্রাহরিক আহারের প্রয়োজন বোধ করেনি। আলুর পরোটা এবং মুগলাই পরোটাও পাওয়া যায়। যা আমরা ভয়ে কখনও অর্ডার করিনি। তবে ভূলেও ওদের ব্রেড বাটার বা ব্রেড জ্যাম বা কোন স্যান্ডউইচ  অর্ডার করবেন না। বিদিশাদিরা ভেজ স্যান্ডউইচ অর্ডার করে ঠকেছিল এবং আমরা মাখন পাউরুটি। দামের তুলনায় ভয়ানক সাধারণ এবং পরিমাণেও অতি কম।
সমুদ্র স্নান ছিল আবশ্যিক প্রাত্যহিক কর্ম। মাঝে একদিন অমাবস্যা ছিল সেদিন এবং তার পরের দিনের ভরা কোটালে সমুদ্রের রুদ্র  রূপ দেখে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও তুত্তুরীকে সমলানো যেত না। পিলপিল করে লোক আসত পুণ্যস্নানে।    কিন্তু যত ভিড় বাড়ত সমুদ্র এবং বেলাভূমি ততো নোংরা হয়ে উঠত। জনগন আইসক্রীম খায়, কাঠি ভাসায় সাগরে। মিনারেল ওয়াটারের বোতল তো হরদম ভাসছে। নোংরা প্লাস্টিক ও তাই। মাঝে মাঝে এসে পায়ে জড়িয়ে বিবমিষা জাগায়। একদিন ডাইপার ভাসতে দেখে বিদিশা দি না স্নান করেই পাড়ে বসেছিল। সমুদ্র স্নানে না গেলেও দেবশ্রীদিদের সাততলার ঘরের খাটে হাফ প্যান্ট পরে গড়াগড়ি দিয়ে আড্ডাটাও ছিল অসাধারণ রিলাক্সিং। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে সমুদ্রকে দেখতাম। কোথাও শ্লেট কোথাও ধুসর, কোথাও নীলচে জেড গ্রীণ। বড় বড় ঢেউয়ের মাথায় ঘন মায়াবী থকথকে সাদা ফেনা। মনে হত স্বর্গে আছি। শুধু তুত্তুরীকে বলতে হত আজ সমুদ্রে নামলে পুলিশে ধরবে তাই নামছি না ।

যখন ভয়ানক ক্ষিদে পেত তখন পাশ থেকে ভজহরি মান্না কেমন যেন সম্মোহিনী জাল বিছাতো। পুরী যাবেন অথচ ভজহরিতে খাবেন না এটা অমার্জনীয় অপরাধ। এই অমৃতের স্বাদের সন্ধান দেবার জন্য আমরা সুকন্যার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। কলকাতাতেও ভজহরির খাবার খেয়েছি কিন্তু পুরীতে তার স্বাদ অন্তত দেড়গুণ বেশি। বিশেষতঃ মাছের পদ গুলির।  সে পাবদা মাছের ঝালই বলুন বা সর্ষে দিয়ে পার্শে, বা ভেটকি মাছের ঝাল, টাটকা ভেটকি মাছের ফিশ ফ্রাই, তেল কৈ, চিতল মাছ,কাতলা মাছের ঝাল, জাম্বো চিংড়ির মালাইকারি, ডাবচিংড়ি, মাটন ডাকবাংলো সবপদই দেবভোগ্য।  এমনকি শুক্তো, ছানার ডালনা, ঝিঙে পোস্তোর মত নিরামিষ পদ ও তো তুলনারহিত। প্রতিটা মাছ এত টাটকা খেয়ে এক ফোঁটাও শরীর বিগড়োবে না। তবে সবার রাণী ছিল নলেন গুড়ের আইসক্রীম।ছোট প্লাস্টিকের বাটিতে দু স্কুপ আইসক্রীম। মুখে দিলেই খোয়ার অমৃতমধুর স্বাদে চোখ বুঝে আসবে আর নাকে ভুরভুর করবে নলেন গুড়ের সুগ্ধ।  পুরো নেশা ধরে গিয়েছিল সকাল বিকাল ঐ আইসক্রীম খাবার। পুরী হোটেলের খাবার ও মন্দ নয়। ওদের বাটার নান তো বেশ ভালো লাগত।ওদের ফ্রুট কাস্টার্ডের প্রেমে হাবুডুবু খেতাম। কিন্তু ব্যাটারা রোজ বানায় না। ক্যারামেল পুডিং ও বেশ ভালো। চিকেন ভর্তা আর পনির বাটার  মশালাও অতি সুস্বাদু। তবে ওদের চিংড়ি দিয়ে ঝিঙে পোস্ত খেয়ে দেখার দুঃসাহস জোটাতে পারিনি। আর  জাম্বো প্রনে কেমন যেন বাসি গন্ধ ছিল।

বিকাল বেলায় দেবশ্রীদি উজানদের সৈকতে ক্যারাটে অভ্যাস দেখতে যেত। আমরাও সুউচ্ছ বারন্দা থেকে তীব্র কৌতুহল নিয়ে পরিদর্শন করতাম ওদের নানাবিধ কসরত। উজানরা ক্যাম্পে ফিরে গেলে আমরা ঘুরতে বেড়াতাম। স্বর্গদ্বারের বাজার সবসময় বাড়ির পাশের বাজারের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আমার যেমন কদমতলা বাজারের কথা মনে হয়।  ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় পাড়াতেই তো আছি।প্রতিটা দোকান থেকে সেই একই আন্তরিক সুরে আহ্বান,“দিদি, বড়দি বৌদি, দাদা,  মাসিমা আসেন না।” এবং সাথে সাথেই পিলপিল করে দিদি বৌদি এবং মাসিমারা দোকানে ঢুকেও পরে এবং বিগত বহুবারের মত  সেই একই দ্রব্যাদি কিনে বাক্স বোঝাই করে ফেরে। প্রতিটা দোকানের সামনেই একাধিক রাগী দাদা বা মেসোমশাই বউয়ের মুণ্ডুপাত করে এইসব ছাইভস্ম কেনার জন্য, কি মাসিমারা মহানন্দে কেনাকাটা করে।
পুরীর বাজারের সাথে হরিদ্বারের বাজারে ঘোরা আমার একই রকম বোধ হয়। আদ্যিকালের জামা গুলিই ঝোলানো আছে যা কখনও মাসিরা আমায় কিনে দিত। এখন এলেই তুত্তুরীর জন্য কিনে নিয়ে যায়। সেই একই মুক্তোওলা, যতই বলি কিনব না বাপ মাফ কর, তাও পশ্চাদানুসরণ করে। স্তুপাকৃতি জিভে জল আনা খাজা বা গজার দোকান।শোকেসে শোকেসে রঙবেরঙের কটকী, সম্বলপুরি, ইক্কত, বোমকাই শাড়ি,পাঞ্জাবি, লঙ্ স্কার্ট, চাদরের বাহার। স্তুপাকৃতি পুরীর নানা রকম ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। হাঁ করে দেখতে বা বলা যায় গিলতে গিলতে যেতাম। মনে হত এই তো বেশ ভালো আছি। না হয় নাই ফিরলাম এই জনাকীর্ণ মহানগরের বিস্বাদ কর্মব্যস্ততায়---

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি (অন্তিম পর্ব) ২৯ শে মে ২০১৭
আজ আমাদের ফেরার দিন। এতদিন ধরে যাঁরা ধৈর্য ধরে অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি পড়ে আসছেন তাঁদের সকলকে অজস্র ধন্যবাদ। লিখে গেছি নিখাদ লেখার আনন্দে। ভাবিনি কেউ সময় অপচয় করে আদৌ তা পড়বেন। না হলে পুরী কে না গেছে? বরং অনেকের কাছেই পুরী দ্বিতীয় ঘরবাড়ি। তবু যে পড়েছেন এবং আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে একাত্ম বোধ করেছেন তার জন্য আমি বাস্তবিকই আপ্লুত।
যাই হোক বাকি দিনগুলির আর পুঙ্খানুখ বর্ণনা দিচ্ছি না। মোটামুটি  একই গৎ এ বাঁধা। শুধু দুটি ঘটনার কথা না বললে এই ডাইরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে--প্রথমটা হল একদিন রাতে জমজমাট ভূতের গল্পের আসর। সম্ভবতঃ সেটা দ্বিতীয় দিন। জম্পেশ নৈশ ভোজের পর আমরা ছয়জনেই পুরী হোটেলের  আঙিনায় গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ঘড়ির কাঁটা সবে এগারোটা ছাড়িয়েছে। বাইরের শোরগোল সম্পূর্ণ স্তিমিত, আঙিনার আলো গুলিও নিস্তেজ হয়ে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে। বাইরে  থেকে উত্তাল কালো সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে আর দামাল হাওয়া। বাবাই প্রথম ভূতের প্রসঙ্গ আনল। এতবড় এবং এত পুরাণো হোটেল, নিশ্চয়ই একাধিক ব্যক্তি এখানে মারা গেছেন। কেউ কেউ হয়তো আত্মহত্যাও করেছেন। তাদের প্রেতাত্মা নিশ্চয় আজো এই হোটেল চত্বরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। বলা মাত্রই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া মজ্জা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।  সবাই সমস্বরে আপত্তি করলাম ভূতের গল্প শুনব না। বাবাকে থামায় কে? বাবা নাকি রিশেপশনে কার মুখ থেকে শুনেছে আমাদের ঘরেও এরকম এক বৃদ্ধ বৃদ্ধা একবার ছিলেন এবং বৃদ্ধ হৃদরোগে মারা যান। তারপর নাকি বেশ কিছুদিন ঐ ঘরটা কাউকে দেওয়া হয়নি। মাঝরাতে নাকি এখনও বৃদ্ধ ঘরের দরজা ধাক্কে খোলার চেষ্টা করেন। সত্যি মিথ্যা জানি না সেই মুহূর্তে হাড়ে কম্প দিচ্ছিল আতঙ্কে। তবে সব থেকে ভালো ভূতের গল্প শোনালো দেবশ্রীদি। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের “পিন্টু”। যাঁরা পড়েছেন জানেন যে পিন্টু ছিল এক নেহাৎ  ভিতু নেড়ি কুকুর। পিন্টুর কাজ ছিল তার মালিকের সাথে শিকারে গিয়ে মরা পাখি খুঁজে বার করা। এক পূর্ণিমার রাতে পিন্টুর মালিক সকলের অনুরোধ উপদেশ নির্দেশ অমান্য করে এক নির্জন জলায় পাখি শিকারে গিয়েছিল। লোকটি ছররা-বন্দুক চালাতেই একটা পাখি ঝপ্ করে একটা ঝোপে গিয়ে পড়ল। পিন্টু দৌড়ল পাখি তুলে আনতে,কিন্তু খানিক গিয়েই দৌড়ে ফিরে এল তার প্রভুর কাছে।আতঙ্কে পিন্টুর সব রোম খাড়া হয়ে গেছে, শারিরীক  বিভঙ্গে সে বারংবার মালিককে অনুরোধ করতে লাগল,“ফিরে চল। ” কিন্তু মালিক নাছোড়বান্দা। পিন্টুকে ভিতু বলে গালি দিয়ে নিজেই অগ্রসর হল সেই কাঁটা ঝোপের দিকে। হঠাৎ দেখল সেই ঝোপ থেকে এক ধপধপে সাদা মূর্তি সেই মরা পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে উঠে আসছে, আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে রক্ত জল করা এক তীব্র আর্তকান্না “আ-হা-হা”। তারপর কি হল জানতে অনুগ্রহ করে পড়েই নিন। শরদ্বিন্দু অমনিবাসের চতুর্থ খণ্ডে পেয়ে যাবেন। এটুকুই শুধু বলব সেদিন রাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে,ভয়ে চোখ খুলিনি। খালি  মনে হচ্ছিল চোখ খুললেই দেখব এক শ্বেত মূর্তি “আ- হা-হা”করে কাঁদছে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটি হল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পদব্রজে গিয়ে মোহনা দর্শন। গুগল ম্যাপ বলছে পুরী হোটেল থেকে স্টার্লিং হোটেল সাড়ে চার কিমি। স্টার্লিং এর উল্টোদিকে একটু গেলেই ধাওদিয়া নদীর মোহনা। আমরা যখন রওনা দিলাম ঘড়ির কাঁটা সোয়া চারটে সবে টপকেছে। সূর্য দেব মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন যেই রওনা দিলাম ওমনি স্বমহিমায় ফিরে এলেন। বেশ চড়া রোদে সমুদ্রের লাগোয়া বাঁধানো ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোকোপাম রিসর্টের পর রাস্তায় নেমে এলাম। কারণ ফুটপাথ শেষ। এবার ভাঙা এবড়োছেবড়ো সরু পিচের রাস্তা। আমরা রাস্তা থেকে সটান নেমে গেলাম বালির ওপর দিয়ে সমুদ্রের পাশে। ভেজা বালির ওপর দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি, আমাদের মতই দু চারজন ভবঘুরে ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। শয়ে শয়ে বালি রঙের কাঁকড়া আমাদের দেখে দৌড়ে গর্তে লুকিয়ে পড়ছিল। আবার কেথাও একঝাঁক কাঁকড়া উঁকি মেরে দেখছিল আপদ গুলো বিদেয় হল কি না। সবে বলেছি এখানে লাল কাঁকড়া পাওয়া যায় না, ওমনি সারি সারি লাল কাঁকড়ার দল কোথা থেকে এসে গুড়গুড় করে গর্তে ঢুকে গেল। জনমানবশূণ্য ভিজে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে অসাধারণ লাগছিল,  ভাঁটা চলছিল বলে সমুদ্র অনেকটা পিছিয়ে গেছে। এখানকার সমুদ্র মোটেই পুরীর মত দামাল দুরন্ত নয়। বরং বেশ ভদ্র সভ্য । জলের রঙ গাঢ় অথচ স্বচ্ছ জেড্ গ্রীন। জেড্ গ্রীন রঙের ঢেউ গুলি গাঢ় সোনালি বালুকাবেলায় আছড়ে পড়ে দুধ সাদা ফেনা তৈরি করছে।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়বে পড়বে করছে যখন আমরা গিয়ে পৌছলাম মোহনায়।
মোহনায় পৌঁছে হতবাক হয়ে গেলাম। এই তো দুবছর আগেই এসেছিলাম, বেশ চওড়া নদীর খাত গিয়ে মিশেছিল সাগরে। শুনেছিলাম কাছেই লকগেট। জলস্রোত সেখানে বন্দী। খাত প্রায় শূণ্য। জোয়ারের সময় অল্প অল্প সমুদ্রের  জল মোহনা বরাবর ভিতরে ঢুকে আসে। স্পষ্ট মনে আছে, দেবু আর শৌভিক গোড়ালি ঢোবা জলে নেমে ছবি তুলছিল। তুত্তুরীও চটি খুলে খাতে নেমেছিল, কোথায় সেই খাত? মোহনা বস্তুটিরই আর কোন অস্তিত্ব নেই। উঁচু বালির বাঁধ আড়াআড়ি চলে গেছে সমুদ্র বরাবর। উল্টোদিকে স্বচ্ছ পুকুর। হয়তো মাছ চাষ হয়। জনমানব নেই, কাকে জিজ্ঞাসা করব? দুবছরে কি করে চুরি হয়ে গেল মোহনা? কোথায় হারিয়ে গেল নদী। বালির চরে বসেছিলাম তিনজনে বেশ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা নামার মুখে উঠলাম। আবার কাঁকড়াদের দুষ্টুমি দেখতে দেখতে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে ফেরা।
আর কি? এবার ঘরে ফেরার পালা। এবারও আরএসি। এবারও আকুল প্রার্থনা এবং সকলের বার্থ পেয়ে যাওয়া এবং এবারও পে কমিশন চাইতে ভুলে যাওয়া।
(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment