Friday 21 July 2017

অনির ডাইরি

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
আজ সকালে আবার সেই মেয়েটার সঙ্গে দেখা। কিন্তু সেই মেয়েটা কি করে হবে? তার সাথে তো বেশ কিছু বছর আগে দেখা হয়েছিল। সেই যে অনাগত ভবিষ্যতকে গর্ভে ধারণ করে,ধর্ষিত মৃত পরিজনদের রক্ত মেখে  দিশাহারা হয়ে ছুটেছিল অঝোর বৃষ্টি,দুর্গম গিরি, অরণ্য, জলপথ বেরিয়ে। এক অনামী  রিফিউজি ক্যাম্পে যে জনৈক প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেছিল এবার কি?
এ এক অন্য মেয়ের কথা, তবু মনে হল যেন তার সাথেই আবার দেখা। মাঝে এত বছরের ব্যবধান কিছুই বদলায়নি। সেই একই গল্প, বিবাহিতা তরুণী,ভাঙাঘর চাঁদের আলো। আচমকা কালো কাপড়ে মুখঢাকা দুর্বৃত্তদের হানা, গ্রামের সব পুরুষকে নির্বিচারে জবাই করে, মেয়েগুলিকে - থাক নাই বা বললাম। গর্ভস্থ চার মাসের ভ্রুণকে বাঁচাতে পালানো ।
অন্ধকার জঙ্গলে দেখা হয়ে গেল আর এক প্রায় সমবয়সী মহিলার সাথে। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ইনিও পালাচ্ছেন। এদের অবস্থা প্রথমার মত অত খারাপ ছিল না। দ্বিতীয়ার স্বামীর সোনার দোকান, দুই শিশু নিয়ে মোটামুটি স্বচ্ছল সংসার। কিন্তু এদের বাড়িতেও হানা দিল ঘাতকদের দল। স্বামীর ওপর চলল অকথ্য নির্যাতন, সোনার লুকানো গয়না গুলির হদিশ তাও বলল না লোকটি। অন্তিম হাতিয়ার হানল ঘাতকরা, চোখের সামনে বাচ্ছাগুলিকে লাথিয়ে মারবে। বুটের আঘাতে নাড়িভুঁড়ি বের করা বাচ্ছাদের মৃতদেহের ছবি দেখছেন নিশ্চয় কয়েকদিন যাবৎ। আতঙ্কে সোনার গয়নার হদিশ গড়গড় করে বলে দিল লোকটি। এবার চোখ বেঁধে লোকটিকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা। স্বামীর পরিণতি অনুমান করে চোখের জল মুছে নিজেকে শক্ত করল দ্বিতীয়া । তারপর নিঃসাড়ে রাতের আঁধারে দুই শিশুর হাত ধরে জঙ্গলে মিশে গেল । মনে ক্ষীণ আশা, যদি লোকটিকে ছেড়ে দেয়, প্রাণে বেঁচে থাকুক অন্তত প্রিয়তম পুরুষ।
ধুর মশাই, একি যশ চোপড়ার ওয়াক্ত সিনেমা নাকি, যে শেষে হারিয়ে যাওয়া স্বামী, স্ত্রী, কুম্ভকে মেলে মে বিছড়ে হুয়ে ভাই সব মিলে মিশে এক হয়ে যাবে। পালিয়ে আসার পথেই নিজের রক্তাক্ত কোপানো বরের মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করল দ্বিতীয়া । বাচ্ছা গুলিও দেখল, তাদের বাঁচাতে গিয়ে মরেছে বাবা।
অন্ধকার বৃষ্টিভেজা জঙ্গলে ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে আরো কয়েকজন দিশেহারা মহিলার সঙ্গে দেখা। সকলেরই এক গল্প। কপর্দকশূন্য,রিক্ত,ধর্ষিত,স্বজনহারা একদল মহিলা। সকলেই রাখাইন এর বাসিন্দা। কি ভাবছেন,সকলের একই ধর্ম তাই তো?  স্বজনহারা,রিক্ত,ধর্ষিত মেয়েদের আবার ধর্ম, তবু বলি মিলিয়ে মিশিয়ে ছিল সবকিছুই, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান।
এদের আমাদের দেশে আশ্রয় দেওয়া উচিত কি উচিত না, এই জটিল তত্ত্বালোচনা আমার জ্ঞানের পরিধির বাইরে। একজন মা এবং একজন নারী হিসেবে আমি শুধু সহমর্মিতাই জানাতে পারি।আপনিই হয়তো ঠিক এই বিপুল শরণার্থীর চাপ নিতে আমরা অপারগ। কিন্তু কি করি বলুন কানের কাছে এক মৃত বৃদ্ধ যে সমানে গেয়ে চলেছে,“বল কি তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী, পার হয় তোমাকে ধরে, দুর্বল মানুষ যদি। ”
অনির ডাইরি ৬ই প্টেম্বর ২০১৭
বেশ কয়েকবছর আগে একটা মেয়ের গল্প পড়েছিলাম। বেশি বয়স নয়, বছর পনেরো ষোলো মাত্র। নিম্নবিত্ত পরিবারে যা হয়, ঋতুমতী হবার সাথে সাথেই তাকে পাত্রস্থ  করার তোড়জোড় শুরু হয়ে হল। বছর উনিশ কুড়ির এক নব্য যুবকের সাথে অচিরে শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হল। উদর শূণ্য তাতে কি হৃদয়ে উছলে গেল প্রেম। ফুটো ছাতের তলায় ঘোলাটে চাঁদের মায়াবী আলোয় রচিত হল স্বপ্নলোক। অতঃপর? মঞ্চে খলনায়কের প্রবেশ। কোন এক কালরাত্রে একদল লোক হঠাৎ হানা দিল তাদের গাঁয়ে। পুরুষগুলোকে কচুকাটা করতে লাগল,মেয়েদের পরিণতি অনুমেয়। স্বামী,শ্বশুর, বাপ, ভাই মুহূর্তমধ্যে   পরিণত হল রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে। শোক ভুলে শুধু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দৌড়ল দিশাহারা মেয়েটি। কতই বা বয়স, ১৫/১৬!!!

আমাদের এই সুবিশাল উপমহাদেশের কোন এক উদ্বাস্তু শিবিরে জনৈক প্রতিবেদক যখন সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, ততোদিনে মেয়েটি কান্না ছাড়ুন, ভালো করে কথা বলতেও ভুলে গেছে। সদ্য জানতে পেরেছে একা পালিয়ে আসেনি, আসার সময় গর্ভে ভরে এনেছে মৃত স্বামীর স্মৃতি, এক অনাগত ভবিষ্যৎ।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে যখন যা পড়েছি, ঐ অচেনা মেয়েটির কথা মনে পড়েছে। যে প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেছিল, এবার কি করবে? আত্মহত্যা করলেও মারা যাবে দুটি প্রাণ, আর না করলেও তাই তো অন্তিম পরিণতি। আর সাম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গাদের উপর যে অমানবিক অত্যাচার হয়েছে, একজন সংবেদনশীল অতি সাধারণ মা হিসেবে, আমি তা পড়তে পারিনি। পদাঘাতে মৃত পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি বেরোনো শিশুর মৃতদেহ দেখা বা ঐ খবর পড়া আমার সাধ্যাতীত।

একজন সাধারণ ভারত বাসী হিসেবে আমিও চাই না, আমদের দেশের ঘাড়ে নতুন করে কিছু মানুষের দায়িত্ব চাপুক। আপনিই খেতে পায় না, শঙ্করাকে কোন দুঃখে ডাকতে যাব? কিন্তু তা সত্ত্বেও তো আমরা নির্যাতিত প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াই। আগেও তো এর নজির রয়েছে।সত্তরের দশকই তো তার সাক্ষী।

সবর্দা যে পাশে দাঁড়াতেই হবে তাও তো নয়, কিন্তু সামান্যতম সংবেদশীল হওয়াটাও কি এতই কঠিন?গতকাল দেখলাম জনৈক ফেবু বন্ধু যাঁরা রোহিঙ্গাদের সমর্থনে কুম্ভীরাশ্রু রোদন  করছে, তাঁদের সামাজিক কর্তব্যপরায়নতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।  ফেবুতে বাদানুবাদ বা মতান্তরে জড়িয়ে পড়তে বড় বাজে লাগে।বন্ধু যথেষ্টই সংবেদনশীল, যতটুকু আমি তাঁকে চিনি, তাই একটা কথাই বলব,“ মানুষ যদি গো না হয় মানুষ, দানব কখনও হয় কি মানুষ? যদি দানব কখনও হয় গো মানুষ, লজ্জা কি তুমি পাবে না?”

অনির ডাইরি ৫ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
স্বয়ং মা বলে কোলে ঝোল টানছি না, একথা অনস্বীকার্য যে একজন সন্তানের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক তার মা। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে আমার এই শিক্ষক বড়ই মারকুটে ছিল। আশি নব্বইয়ের দশকটাই ছিল অন্য রকম, বাচ্ছাকে উদোম ঠেঙিয়ে হাত সুখ করা ছিল মায়েদের অধিকার তথা চিত্তবিনোদন। হায়রে, কোথায়ই বা শিশুর অধিকার নিয়ে সরব জনগণ কোথায়ই বা সোশাল মিডিয়া। তুলনায় বাবার কাছে পড়া ছিল অনেক মজার।  পৃথিবীর তাবড় বিষয়ে গপ্প হত কেবল পড়া ছাড়া।

অফিস এবং যৌথ সংসারের দায়দায়িত্ব  সামলে আমার পড়ার পিছনে যথেষ্ট সময় দেবার অবকাশ বা সামর্থ্য বাবা বা মায়ের থাকত না। ফলে অচীরেই আমার জন্য এক শিক্ষিকা নিযুক্ত হলেন। পুষ্প দিদিমণি। নিপাট সাধারণ, এক মধ্যবয়সী গৃহবধু। মাটির মানুষ। ওণার স্বামীকে আমরা দাদামণি বলে ডাকতাম। এককালে বাবার বিশাল মণিহারি দোকান সামলাতেন, কিন্তু দিদিমণির শ্বশুর মারা যেতেই দোকান লাটে ওঠে। ফলে দাদামণি হয়ে পড়েন কর্মহীন। ছোটখাটো ব্যবসা করার মত পুঁজিও ছিল না। দিদিমণির গহনা বেচে কিছুদিন চলে, অতঃপর দিদিমণিই বেরিয়ে পড়েন উপার্জনে জন্য।
আমি বোধহয় ওণার দ্বিতীয় ছাত্রী ছিলাম। মাঝে মাঝে ওণাদের বাড়িতে যেতাম পড়তে।ভাঙা, রঙ চটা, পলেস্তারা খসা দেওয়াল, ছাত দিয়ে জল পড়ত। দিদিমণির হাতের গুণে যেন সব ঝকঝক করত। শত অনটনেও যে ভালোবাসা মরে না, দুচারটে শিশি বোতল নিয়েও যে কি গুছিয়ে সংসার করা যায় তা দাদামণি-দিদিমণির সংসারে না গেলে বুঝতেই পারতাম না।
দারুণ গল্প বলতেন দিদিমণি। শরৎচন্দ্রের সাথে আলাপ ওণার মাধ্যমেই। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বিশাল ভক্ত ছিলেন। উত্তম সুচিত্রার সব সিনেমার সব ডায়লগ ছিল ওণার ঠোঁটস্থ। যমালয়ে জীবন্ত মানুষের গল্প সপ্তাহে একদিন তো বলতেনই।
কিন্তু রোজ দিদিমণির পড়াতে আসাটা ছিল অসহ্য। মায়ের সাথে দিদিমণির দোস্তি ছিল দারুণ।  না পড়া করলেই নালিশ আর উত্তমমধ্যম।  মাঝে মাঝে দিদিমণির হাত থেকে বাঁচতে ঝুটমুট অজ্ঞান হয়ে যেতাম। সেদিন তুত্তুরী জানতে চাইছিল, “মা অজ্ঞান হয়ে গেলে কি নিশ্বাস বন্ধ থাকে?” মনে মনে প্রমাদ গুণলাম, সর্বনাশ। আমার জুতোয় পা গলাতে আর একজন তৈরি হচ্ছে।

সময়ের চাকা থামে না, কবে যে দিদিমণির হাতটা ছেড়ে গেল বুঝলাম কই? এবারে আর হাত নয় সোজা কান ধরল বড়দা। আমার জীবনের প্রকৃত শিক্ষা গুরু। বড়দার ছিল অসীম অধ্যবসায়, অশেষ সংযম। খেলা আর খবর ছাড়া টিভির চৌকাটও মাড়াত না। বুধবারের চিত্রহার, সোমবারের সুপারহিট মুকাবিলা, শনিবারের হিন্দি চলচ্চিত্র সবই মায়ের ভোগে।  পাশের ঘর থেকে মহঃ রফি সুরেলা গলায় ডাকত, “তুম সা দেখি দেখা”।  আর এদিকে বড়দা কান ধরে কোণ আঁকা শেখাত। সে যে কি দুর্ঘট ব্যাপার কি বলি। দ্বাদশ শ্রেণীর পর দাদা হঠাৎ  একদিন কানটা ছেড়ে দিল, সে যে কি মন খারাপ, এত অসহায় অবলা জীবনে বোধ হয়নি।

শেখার যেমন কোন শেষ নেই, শিক্ষাগুরুর ও তেমনি শেষ নেই। জীবনের কোন মোড়ে কে যে আপনাকে কি শিখিয়ে দিয়ে যাবে, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সবথেকে বড় শিক্ষক বোধহয় জীবন স্বয়ং। আমরা যত অমনোযোগী ছাত্রই হইনা কেন, জীবন শিক্ষা দিয়েই ছাড়ে। শিখতে পারলে আপনি একধাপ এগিয়ে গেলেন, আর না পারলে?জীবন ক্ষমা করে কই? বড় নিষ্ঠুর নির্মম এই শিক্ষক।
হ্যাপি টিচারস্ ডে।

অনির ডাইরি ৩১শে অগস্ট ২০১৭
আজ সকালে দুজনের থেকে এই মেসেজটা পেলাম, “হুঁশিয়ার

দুষছ কাকে  নীল তিমি কে?
ভয়টা কিসের ডিপ্রেসনের?
ছুটছো কোথায় টেক্কা দিতে?
মারছ চাবুক কাদের পিঠে?

সরল চোখে জ্বালছ আগুন
পিঠের বোঝায় পুড়ছে ফাগুন
মায়ের আদর ভিডিও চ্যাটে
বিকেল ফুরোয়ে বন্দি ফ্ল্যাটে

হিসেব মেলাও শপিং মলে
ঘুমপাড়ানী নেটের জালে

জাগছে শ্বাপদ নরম তালে
চোখের কালি কার্টুন গেলে
ভবিষ্যতের নেশার চুমুক
মানুষ হবার শর্ত ভোলে

সামলে যাবার সময় হল
মাখাও ওদের খুশির ধুলো
সম্পর্কের আলগা দড়ি
মায়ায় বেঁধে সঙ্গে চলো

নেকড়ে তিমির সাধ্য কোথায়
তোমার স্নেহের গন্ডি পেরোয়
টেকনোলজির গোলকধাঁধায়
ভালবাসার তিহার গড়ো”-    এখনও ফেবু চেক করিনি, হয়তো ইতিমধ্যেই স্বনামে বা সংগৃহীত  বলে কেউ শেয়ার করে ফেলেছেন। খুব ভালো। অতি উত্তম। নীল তিমি আতঙ্ক কি সাংঘাতিকভাবে যে মধ্যবিত্তকে গ্রাস করেছে, তা তো প্রতিদিনের নিউজ ফিডই বলে দেয়। জীবনমরণ সমস্যা। ভণ্ড সাধুকেও দশ গোল দিয়েছে আপাততঃ । গরু ভেড়া ছাগল মুরগী,চাড্ডিবাড্ডি-ধুতি-শেরওয়ানি, বন্যা-খরা-শিশু মৃত্যু,মূল্যবৃদ্ধি, ৫৪শতাংশ ৫৬ ইঞ্চি সব আপাততঃ পিছন বেঞ্চে, দাঁড়ান-দাঁড়ান আগে এই নীল তিমিকে তো সামলাই।
তা সামলান না। কে নিষেধ করছে? কিন্তু এই সমস্যার সমাধানটা আপনি কি বার করলেন? একটু ওপরের কবিতাটাই দেখা যাক, “মায়ের আদর ভিডিও চ্যাটে/ বিকেল ফুরোয়ে
বন্দি ফ্ল্যাটে/হিসেব মেলাও
শপিং মলে ঘুমপাড়ানী নেটের জালে।  ” মায়ের আদরটা দেখলেন? অর্থাৎ মায়ের আদরের অভাব,পাহাড় প্রমাণ প্রত্যাশার চাপ, মায়েদের শপিং মলে স্বেচ্ছাচার,স্বাধীনভাবে ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকার দুর্দম ইচ্ছা,সোশাল মিডিয়ায় ইয়ে -এইসব কারণেই বাচ্ছা গুলো বখে যাচ্ছে, মানসিক অবসাদে ভুগছে এবং পরিশেষে নীল তিমিতে শান্তি খুঁজে বেরাচ্ছে।
কি অসাধারণ মশাই। সত্যিই তো মায়েরা কোন সাহসে স্বাধীনচেতা,স্বনির্ভর হয়?ফ্যাশানেবল জামাকাপড় পরতে চায়?মায়েদের বন্ধুবান্ধব কেন থাকে?তাদের সাথে হাহাহিহি কেন করে?আহা মায়েরা যদি বাড়িতে থাকত, ধরিত্রীর মত সহনশীল হয়ে, যৌথ পরিবারকে টিকিয়ে রাখত, বছরে দুজোড়া কাপড় আর দিনান্তে হাঁড়িচাঁচা ভাত বা উচ্ছিষ্ট অন্ন গ্রহন করত, তাহলে থোড়াই আসতে পারত এইসব নীল তিমি কালো কাতলা। অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নারী কোন সাহসে সবলা হতে চায়। নারী যদি সুবোধ হত,নতমস্তকে বরানুগামিনী হত, তাহলে কি আর এই দিন দেখতে হত? এই মা গুলো তো বাচ্ছা মানুষ করতেই জানে না। এই মা গুলোই অপদার্থ। যত দোষ সবই এই অকালকুষ্মাণ্ডী গুলোর---- জগৎ সংসার উচ্ছন্নে গেল এই পাপিষ্ঠাদের জন্য।

অনির ডাইরি ২৮শে অগস্ট ২০১৭
মন খারাপ হয় জানেন। ভীষণ, ভীষণ মন খারাপ হয়। বিশেষ করে এই রকম মেঘলা দিনে, খুব ইচ্ছে করে, তাকে একটি বার দেখতে। ব্যস্ত কু্টিল জীবনের ফাঁক গলে আরো একটি বার তাকে জড়িয়ে ধরে বুক ভরে তার আঘ্রাণ নিতে। ঘাম-তেল-হলুদ আর হাল্কা মেছো আঁশটে গন্ধ মিলে মিশে তৈরি সেই বহুচেনা মনকেমন করা গন্ধ। আমার মা।

চিরদিন বাবার দুলালী ছিলাম। মহাভারত থেকে ওডিসি হয়ে, কুওভ্যাডিস থেকে ব্ল্যাক অ্যারো হয়ে টয়লার্স অব দা সি এমনকি মাইকেল কর্লিয়নির সাথে পরিচয়ও বাবার হাত ধরে।  পথের পাঁচালি থেকে গন উইথ দা উইণ্ড হয়ে সেভেন সামুরাই বা রশোমন এমনকি ব্যাটেলশীপ পোটেমকিন বা নানুক অব দা নর্থ, বাবাই কান ধরে দেখিয়েছিল। জীবনে প্রথম সিগারেটের সুখটান (মোটেই সুখকর নয়, কেশে কেঁদে হাট করেছিলাম) সেটাও বাবার কাউন্টার থেকে।

এতকিছুর মাঝে মা বরাবর নীরব দর্শক ছিল। বাপ মেয়ের দুর্নিবার দোস্তির মধ্যে মা কোনদিন হাড্ডি হয়নি।  বিয়ের পর যখন শ্বশুরবাড়ি গেলাম, প্রথম বুঝলাম মা আমার স্বত্ত্বার ঠিক কতখানি জুড়ে আছে। সমগ্র মন খারাপ জুড়ে ছিল শুধুই মা। মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটা মতান্তরের স্মৃতি তীব্র কশাঘাত হয়ে ফিরে আসত।

এটা শুধু আমার নয়, সব বিবাহিত মেয়েদেরই বোধহয় গল্প। আমার এক ঘনিষ্ট বান্ধবী একবার বলেছিল,বিয়ের পরদিন কনকাঞ্জলির সময় তার মায়ের আকুল কান্না দেখে তার নিজের সদ্য পরিণীত বরের ওপর এমন প্রচণ্ড  ক্রোধ জন্মেছিল যে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সেফটি পিন দিয়েই বরকে খুঁচিয়ে মারবে বলে মনস্থ করেছিল। “এই হতচ্ছাড়া লোকটার জন্য মাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে” এটাই ছিল বেচারা বরের অপরাধ।  এইরকম ক্রোধ আর কারো জন্মেছে কি না জানি না, কিন্তু বিয়ের প্রায় এক দশক পরেও বাপের বাড়ি ছেড়ে আসতে আমার কান্না পায়। ভয়াবহ বিষাদ হয়, বৃদ্ধ বাবামাকে ছেড়ে আসতে, প্রতিবার।

এই বিষাদই তো ভালোবাসা। তীব্র সময়াভাব, দায়িত্বভারের পাহাড়, দমবন্ধ পারিপার্শ্বিক চাপ সত্ত্বেও যা আপনাকে জুড়ে রাখে আপনার মূলের সাথে।
তাই যখন দেখি কেউ স্বহস্তে  সেই মূল উৎপাটন করেছে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। লজিক কাজ করে না। ভয়াবহ রকমের আতঙ্ক এবং তার থেকেও তীব্র বিষাদ হয়। আজকে কাগজে যখন দেখলাম, এক কন্যা  সম্পত্তির লোভে বরের সহায়তায় বৃদ্ধা বিধবা মাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে, হতবুদ্ধি  হয়ে গেলাম। ধরিত্রী কেন দ্বিধা হয় না? পড়তে না চাইলেও চোখ ফেরাতে পারলাম না, হয়তো নিজেকে ক্ষতবিক্ষত  করার জন্যই।  মাকে হত্যা করার পূর্বে মহিলা নিজের চার বছরের শিশু পুত্রের খাতার পাতা ছিঁড়ে বৃদ্ধা মাকে দিয়ে বলপূর্বক  সুইসাইড নোট লিখিয়ে নেয়, আর পড়তে পারলাম না। কোন আইন আদালতে এদের বিচার হতে পারে আমি জানি না, কোন ধরণের জেনেটিক অবক্ষয় হলে মানুষ এইরূপ গর্হিত অপরাধ করতে পারে সত্যি বুঝলাম না।  বহুবছর আগে এক স্কুলের ছাত্রী নিজের প্রৌঢ় শিক্ষকের সাথে হাত মিলিয়ে বাবা-মা সহ পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিল। কিন্তু সে ছিল প্রেমে অন্ধ এক অল্প বয়সী অপরিণত অনুঢ়া তরুণী, কিন্তু একজন মা, কি করে পারে? নিজের সন্তানের জন্য কোন আদর্শ রেখে যেতে চায় এরা?

অনির ডাইরি ২৫শে অগস্ট ২০১৭
আচ্ছা আপনাকে যদি একটা সুযোগ দেওয়া হয়, আদিমতম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার, আপনি কি করবেন? কাউকে বাঁশ দেবেন? দিন না। স্বচ্ছন্দে দিন, কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির আড়ালে লুকিয়ে কাঠি করার প্রয়োজনই পড়বে না, সোজা নিজে হাতে বাঁশ কাটুন, এবং মনোমত ব্যক্তিকে পিটিয়ে ছাতু করুন। কেউ কিচ্ছু বলবে না।
অথবা আপনার যদি ইচ্ছা হয়, মানুষের ওপর চাঁদমারী করবেন, তাও করতে পারেন। ভরা বাজারে ঢাঁই ঢাঁই ঢাঁই। কাটা কলা গাছের মত লুটিয়ে পড়তে থাকবে মানুষ। পালাবার, লুকোবার চেষ্টা করবে- পারবে না।
অথবা যদি চান “তেরি মা কি, তেরি বেহেন কি-” তাও করতে পারেন। যদি চান কারো চোখের সামনে গব্বরের মত তার পরিবারকে একে একে শেষ করবেন, কেউ বাধা দেবে না। মানে বাধা দেবে তো বটেই কিন্তু তাদের গুলি গোলা ছুরি ছোরা কিছুতেই আপনার কোন ক্ষতি হবে না।
ভয় পাচ্ছেন? তাহলে এই খেলা আপনার জন্য নয়। আর যদি বেড়ে লাগে, তাহলে একবার ওয়েস্টওয়ার্ল্ডে ঢুঁ মারতে পারেন। তবে পকেট ভারি হতে হবে কিন্তু। ফাঁকা পকেটের লোকজনের ওখানে প্রবেশ নিষেধ।
ওয়েস্টওয়ার্ল্ড আসলে ভবিষ্যতের অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। যেখানে কয়েক হাজার অটোমেটন (বহুবচনে অটোমাটা) ছাড়া রয়েছে। যারা দেখতে,স্পর্শ করতে, উপভোগ করতে,অত্যাচার করতে অবিকল মানুষের মত। হাসি-কান্না-বেদনা-উল্লাস অবিকল মানুষের মত প্রোগামড্।এমনকি গুলি খেলে দেহাংশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, একই রকম রক্ত মাংস মজ্জা ঘিলু বেরিয়ে আসে,  কিন্তু চুপি চুপি বলি তা সবই নকল, কি যেন বলে আর্টিফিশিয়াল।
রুক্ষ অ্যারিজোনার প্রান্তর স্বরূপ এই পার্কে প্রবেশ করলে আপনি “কাউবয়”দের দেশে পৌছে যাবেন। তারপর যা খুশি করুন। আপনাকে উত্তেজিত করার জন্য না না রকম প্লট ফাঁদা আছে। অটোমেটনরাও অটোমেটনদের মারধর খুন জখম করে, প্লট মোতাবেক। যাতে আপনি ত্রাতা হিসাবে অবতীর্ণ  হতে পারেন। ধনী আমেরিকানদের অবকাশ বিনোদনের প্রিয় স্থান এই ওয়েস্টওয়ার্ল্ড পার্ক।
দিনান্তে অটোমাটা গুলিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে, সব ক্ষত মেরামত করে, অক্ষতযোনি করে, সব স্মৃতি মুছে আবার ছেড়ে দেওয়া হয় পরের দিনের জন্য। মাঝে মাঝে আবার চরিত্র বদলে দেওয়া হয়, কাল যে উন্মাদিনী মায়ের সামনে তার শিশুকে চিবিয়ে খেয়েছে নরমাংসভোজী রেড ইন্ডিয়ান অটোমাটার দল,  আজ হয়তো সে এক লাস্যময় রূপোজীবি। মনেও নেই কালকের সেই বুক ফাটা আর্ত চিৎকার।
দিব্যি চলছিল ওয়েস্টওয়ার্ল্ড। হঠাৎ সমস্যা বাঁধল এক নতুন আপডেটকে নিয়ে। যার নাম “রেভেরি”। উদ্দশ্য ছিল মানবিক অনুভূতিগুলি আরো ১৫ শতাংশ তীব্র করা, কিন্তু তার ফলে দেখা গেল, মুছে দেওয়া স্মৃতি গুলি আবার ফিরে আসছে। আর অটোমাটাদের স্মৃতি কি হতে পারে সহজেই অনুমেয়। হাড় কাঁপিয়ে  দেওয়া দুঃস্বপ্নকেও এক ডজন গোল দিতে পারে। এটা কি কোন অন্তর্ঘাত?
অ্যাবারনাটি বলে একজন অটোমেটন, হঠাৎ মাটির তলা থেকে  একটা ছবি খুঁজে পায়। ছবিটি আপাত বিশেষত্বহীন। হাসি মুখে একটি মেয়ের ছবি। অ্যাবারনাটির নিজের ও একটি মেয়ে আছে। সদ্য যৌবনা মিষ্টি নিষ্পাপ ডলোরেস। হঠাৎ অ্যাবারনাটির মনে পড়তে থাকে, গেস্ট অর্থাৎ যাদের ওরা নিউ কামার বলে ডাকে, পাতি বাংলায় মালদার পার্টি যারা মোটা টাকার বিনিময়ে ফূর্তি করতে আসে তারা প্রতিরাতে কি অমানবিক অত্যাচার চালায় তার আদরের ডলোরেসের ওপর। অ্যাবারনাটি মৃগী রুগীর মত কাঁপতে থাকে। ডলোরেসকে বলে পালিয়ে যেতে, নরকের দ্বার উন্মুক্ত করে যত পাপী তাপী এসে জুটেছে ওয়েস্টওয়ার্ল্ডে।
চট জলদি অ্যাবারনাটিকে তুলে নেওয়া হয়। আপডেট ডিঅ্যাক্টিভেট করা হয়, সিস্টেম ফর্মাট করে সব পুরানো স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও অ্যাবারনাটি ভুলতে পারে না, তার জীবনের একটাই লক্ষ্য ডলোরেসকে রক্ষা করা।
ডঃ রবার্ট ফোর্ড (অ্যান্টনি হপকিনস্) হচ্ছেন এই অটোমেটনদের জনক। অ্যাবারনাটিকে ডিকমিশন অর্থাৎ বাতিল করে দেবার আগে স্রষ্টা নিজে বসলেন তার সৃষ্টির মুখোমুখি, বললেন, “বলো অ্যাবারনাটি তুমি কি চাও”। হিসহিসিয়ে উঠল অ্যাবারনাটির হিমশীতল স্বর,“বদলা। তোমার আমার প্রাণপুতুলীর সাথে যা করে চলেছো সুদ সমেত ফেরত দিতে চাই তোমাদের। ” অ্যাবারনাটিকে ডিকমিশন করা হল। বাকি ২৫০ অটোমাটা যারা ইতিপূর্বে অ্যাবারনাটির সংস্পর্শে  এসেছে তাদের ফরম্যাট করা হল।
দিব্যি চলছে, ওয়েস্টওয়ার্ল্ড। হঠাৎ এক দেহপসারিনী অটোমেটন ক্লায়েন্টের সাথে ফস্টিনস্টি করতে করতে থমকে গেল। কাঁপতে লাগল মৃগী রোগীর মত। চোখের সামনে ভেসে উঠল সুখী পরিবার ছোট্ট শিশুকন্যার মুখ। যাকে হারিয়েছে গেস্টদের বিকৃত মনোরঞ্জনের জন্য। কি হচ্ছে? আবার ফরম্যাট আবার পুরানো গল্প। কতৃপক্ষের কপালে ভাঁজ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।
সবার অন্তরালে কে যেন ডলোরেসের কানে ফিসফিসিয়ে বলে ,“ওঠো খুকুমণি জাগো। মাটিতে পুতে রাখা পিস্তল তুলে নাও। ” এই পিস্তল সত্যিই কি বিকৃত গেস্টদের আটকাতে পারবে, নাকি এটাও প্লটেরই অংশ মাত্র।
জোনাথন নোলান (আজ্ঞে হ্যাঁ বিখ্যাত চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানের ভাই) নির্মিত নির্দেশিত এই সিরিজ ইতিমধ্যেই অগুন্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। গেম অব থ্রোনস্ কেও টেক্কা দিচ্ছে এই সদ্যজাতো টিভি সিরিজ। ওয়াইল্ড ওয়েস্টের সাথে কল্পবিজ্ঞানের অপূর্ব মেলবন্ধন। সবে দুটি এপিসোড দেখেছি হটস্টারে এবং এককথায় ফিদা। ফিদার বোধহয় কোন বাংলা হয় না। কোন বাংলা প্রতিশব্দে এই ভালোলাগাকে বর্ণণ করা দুঃসাধ্য। যেমন  অ্যান্টনি হপকিনস্।  এই বৃদ্ধ বয়সেও ওণার যাদুকরী কুহক অটুট। আর ডলোরেস ওরফে ইভান রেচেল উডকে দেখলে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। এড হ্যারিস ও আছে। এক ভয়ানক দুষ্ট বিকৃতকাম মানুষ হিসেবে। নির্বিবেক অত্যাচার চালায় অটোমাটাদের ওপর।
দেখার চেষ্টা করতে পারেন, যদি উৎসাহী হন। শুরু করলে কিন্তু শেষ না করে পারবেন না। আমি যেমন অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করছি, তৃতীয় পর্বের জন্য।

অনির ডাইরি ২৩শে অগস্ট ২০১৭
এমনিতেই জীবন যথেষ্ট ঝঞ্ঝাট সংকুল, এর ওপর আবার নীতি পুলিশ আর সামাজিক মিডিয়ায় বিপ্লবীদের দৌড়াত্ম যে হারে বাড়ছে, নাঃ মশাই আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। কে যে কোথায় কার কি ছবি বা ভিডিও তুলে কি কারিকুরি করে বাজারে ছাড়ছে,অমনি গড্ডালিকা প্রবাহের মত একদল মিডিয়া বিপ্লবী তা শেয়ার করে চিল্লাতে লাগছে, “ফাঁসি দাও। একে ফাঁসি দাও। জেলে পোরো। এখুনি জেলে পোরো।”  আরেঃ? আপনি বললেই জেলে ভরবে নাকি? পুলিশ বা আদালতের কি আর কোন কাজকম্ম নেই নাকি? কোথায় কে কার সাথে ঝগড়া করছে, কোথায় কে বাচ্ছা ক্যালাচ্ছে, ফোনে ঝগড়া করছে, সিটে পা তুলে বসে আছে, ট্রেনে বসে বিড়ি ফুঁকছে, দেওয়ালে মুত্রত্যাগ করছে-- আর আপনি ষাঁড়ের মত ফাঁসি দাও, জেলে পোরো বলে চিল্লাচ্ছেন?
দেশ জুড়ে বিভিন্ন আদলতে জমে থাকা সিভিল ছাড়ুন ক্রিমিনাল মামলার সংখ্যা কত জানেন?দেশজুড়ে বিচারকের সংখ্যা যে কি সাংঘাতিক অপ্রতুল তা জানেন তো নিশ্চয়ই ? শুধু বিচারকের অভাবে,বিনা বিচারে, কতজন জেলে পচছে জানেন?ফাঁসির অপেক্ষায় কতজন বিভিন্ন জেলে দিন গুণছে জানেন ? কত রাঘব বোয়াল আপনার আমার টাকা উড়িয়ে পুড়িয়ে জেলে বা বিদেশে বিলাসব্যসনে সময় কাটাচ্ছে জানেন?মদ্যপ সোজা ফুটপাতে গাড়ি তুলে দিয়ে ঘুমন্ত ফুটপাত বাসীকে থেতলে দিয়ে/ বা  কুচকাওয়াজরত সৈনিককে পিষে দিয়েও জেলের ঘানি না টেনে কতজন ঘুরছে জানেন? ১৯৮৪র শিখ ঘাতক দাঙ্গায় কতজনের ফাঁসি হয়েছে জানেন?১৯৯২ বা ২০০২এ আসছিই না। ইনসাফ বহুত দূর।
একটা ধনঞ্জয়কে ফাঁসিতে ঝোলানোর ট্রমাই হে মোর দুর্ভাগা দেশ কাটাতে পারছে না, খোদ নির্ভয়ার হত্যাকারীকে নাবালক বলে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হল। অনুরাধা সানবাগকে ভুলে জাননি নিশ্চয়? কোনকালে সফল ডাক্তার ছিলেন,পরবর্তী কালে এক নরাধম কতৃক ধর্ষিতা,নিছক ভেজিটেবল হয়ে বছরের পর বছর ঐ হাসপাতালেরই বেডে কাটিয়ে ন্যায়বিচার না পেয়ে ২০১৫এ পরলোকে পাড়ি দিল। আশি বছরেরে ধর্ষিতা আজন্মকুমারী সন্ন্যাসিনী আর ন্যায় বিচারের আশা রাখেন কি না জানি না।  সোনালী মুখার্জীকে চেনেন? সেই যে অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া সোনালী, তার মুখে যে বা যারা অ্যাসিড ঢেলেছিল তাদের শাস্তি হল না, বরুণ বিশ্বাসের মত আসলি বিপ্লবী হঠাৎ করে খুন হল, একটা লোকও ফাঁসিতে ঝুলল না,আর মায়ের হাতের মৃদু চড় খেয়ে ঠোঁট ফোলানো বাচ্ছা বা ট্রেনে বিড়ি ফোঁকা বা জুতো পা ট্রেনের সিটে তোলার জন্য বা মূত্রত্যাগ  করিবেন না লেখা চুনকাম করা দেওয়ালে মূত্রত্যাগের জন্য আপনি লোকজনকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন? তাও সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট শেয়ার করে? সেরেছে?
আপনি কি আশা করেন? আপনার পোস্ট শেয়ারের লজ্জায় সকল পাপীতাপীর বিবেক জাগ্রত হবে? ঐ মাটি জীবনে আর বাচ্ছার গায়ে হাত তুলবে না নাকি আত্মঘাতী  হবে?ঐ ভদ্রলোক আর জীবনেও তাস খেলতে খেলতে ট্রেনে বিড়ি ফুঁকবে না? ঐ ছোকরা আর কখনও ট্রেনের সিটে জুতো সমেত ঠ্যাং তুলবে না? মূত্রথলিতে চাপ পড়লেও ঐ মেসোমশাই একটা সুলভ টয়লেট খুঁজতে যাবে? আপনার মানসিক বয়স ঠিক কত বলুন তো মশাই?
পুনশ্চ প্রতিবাদ করা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। প্রতিবাদ করুন না কে আটকাচ্ছে?বেধড়ক ঝামেলা করুন। ফেসবুকে পোস্ট ও করুন আপনার, হ্যাঁ আপনার নিজস্ব সমস্যা এবং আপনার প্রতিবাদ। আমি পড়ব। খুব মন দিয়ে পড়ব। এমনকি আপনার পরিবার বা ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধবদের প্রতিবাদের গল্প শুনতেও আমি সাগ্রহে রাজি। কিন্তু বেনামে ছড়ানো ডক্টরড্ ভিডিও এবং তৎসংলগ্ন নীতি জ্ঞান আর সইতে পারছি না।

অনির ডাইরি ১১ই অগস্ট ২০১৭
কি কেলো মাইরি। কি যে একটা অ্যাপ এসেছে, বেনামে মনের কথা বলা যায়, আর গোটা ফেবু জুড়ে লোকে ধিনিক ধিনিক নাচতে লেগেছে। না বিশ্বাস করুন, আমি আদপে আঁতেল জ্ঞান বৃদ্ধা নই। বরং এই সব অ্যাপ ট্যাপ নিয়ে আমার যথেষ্ট ঔৎসুক্য আছে। আরে বাবা এগুলো জানতে হয়, খেলতে হয়, না হলে আপনি যথারীতি পিছিয়ে পড়বেন। যথা- ছোঃ আপনি সারাহা (নাকি সারারা) এ নাম লেখাননি? আপনি তাহলে মনুষ্য পদবাচ্যই নন।
যাই হোক, দিন দুয়েক আগে অফিসে মিটিং, পাওয়ার পয়েন্টে ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হতে হতে এক মুহূর্তের জন্য ফেবু খুলেছিলাম, দেখলাম জনৈক নামজাদা আঁতেল একটি লিঙ্ক দিয়ে বলেছেন, যা খুশি ওণাকে লিখতে পারেন, কে লিখেছেন উনি জানতেও পারবেন না। ব্যাপারটা বেশ মজার না?মজা না সাজা কে মাথা ঘামাবে ভাই, শিরে যেখানে সবসময় সংক্রান্তি নাচছে। ফেবু বন্ধ করে ভূলেও গেলাম সাময়িক ভাবে। বেলা তিনটে নাগাদ টিফিন বাক্স খুলে ভাবলাম ফেবুটাও একটু দেখেনি। ও বাবা, ততোক্ষণে ফেবুতে আগুন লেগে গেছে। সবাই পাইকারি হারে সারারা না সারাহার লিঙ্ক পোস্টাচ্ছে, আর জানতে চাইছে,“বল, বল, বল।” এমনকি শ্রীযুক্ত বিতান দেও পোস্টেছেন। আঃ এ সুযোগ কি ছাড়া যায়?বিতানদার সাথে যত ভাব ততো ঝগড়া। প্রকট না হয়ে এই তো সুবর্ণ সুযোগ।    পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে দুজনেই এত ভালবাসি। আর বিতান দা এই গালমন্দ গুলি ভীষণ কি যেন বলে স্পোর্টিংলি নেয়।  তাই লিঙ্কে গেলাম। কি হল বুঝতে পারলাম না, রেজিস্টার করতে বলল, করে দেখলাম, বিতান দা নয়, অন্য কাউকে মেসেজ পাঠাতে বলছে। মনে মনেই বিতানদাকে গালমন্দ করে সারাহা বন্ধ করলাম। সাধে কি ডেনেস্ দা মেনেস্ বলা হত ওকে। কার ইউজার আইডি শেয়ার করে মুর্গী বানালো কে জানে।
এরপর যতবার ফেবু খুলেছি, আহা কি পুলক যে জেগেছে, এত প্রেম?এত প্রেম লুকানো ছিল এত কাল ধরে পেটরোগা,ডেঙ্গু, আমাশা-কৃমিতে ভোগা বাঙালির হৃদয়ে। কে কাকে কবে কলসির কানা পেটা করেছে বলে আমরা তাকে প্রেম দেব না?দেব, দেব, দেব। অবশ্যই দেব। পরের রগরগে প্রেমবার্তা পড়ে যদি আপনার বায়ু রোগ হয়, তো আপনি উচ্ছন্নে যান মশাই।
প্রেম ছাড়াও দু এক ধরণের বার্তা দেখলাম, নোংরা পাতি খিস্তি মার্কা এবং “বলতো আমি কে” টাইপ।
এরপর শুরু হল আসল যন্ত্রণা যখন যত কেলানে শ্রীকেষ্ট এবং ছিরাধিকা আছে, যারা ঐ সব রগরগে মেসেজ গুলি ফটাফট শেয়ার করতে লাগল এবং পাক্কা গাড়লের মত, “কে?কে তুমি?দেখা দাও। প্রকট হও” মত পোস্ট ছাড়তে শুরু করল। এর সাথে যোগ হল অপর একদলের সারাহা নিপাত যাও, সারাহার ভাঙা হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও মার্কা পোস্ট। হরি হে মাধব, চান করব না গা ধোব?
সবথেকে বড় রগড় হল, মাঝরাতে,যখন আমার এক প্রাণাধিকা স্বাধীনচেতা বন্ধু ফোন করে বলল,“এটা তুই না? এ গোপন গভীর রহস্য তো তুই ছাড়া কেউ জানে না”। বোঝো। যত বলি, না ভাই। আমি নই। বন্ধুর অভিমান ততোই বাড়তে থাকে। শেষে বলল,“তুই তো রেজিস্টার করেছিস দেখলাম---”। বোঝো।  এর নাম গোপনীয়তা? ভাগ্যিস বিতানদাকে গালমন্দ করিনি,নাহলে তো কালই হাই কোর্টের শমন, আর পরশুই তিন বছর জেল আর সাত বার ফাঁসি হত। বাপস্ঃ।

পুনশ্চঃ অপভাষার জন্য মাপ করবেন। আর যদি পড়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান তো অনুগ্রহ করে আমাকে বার্তাপাঠ আনফ্রেণ্ড করে বাধিত করবেন।

অনির ডাইরি ৭ই অগস্ট ২০১৭
আশির দশকের শেষার্ধ। তখন দ্বিতীয় শ্রেণী। স্কুলের নাম তারা সুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। সাদা জামা, লাল বেল্ট, সাদা মোজা- সাদা কেডস্ জুতো, মাথায় লাল ফিতে দিয়ে দুটি কলা বিনুনী, আর বুকে একটা সোনালী লাল ব্যাজ, যাতে দুটো বক ওড়ার জন্য ডানা মেলতে শিখছে। সকাল বেলা ঘুম ভাঙিয়ে তৈরি করে দিত মা,  তারপর বাবার হাত ধরে, ঘুম চোখে নেশাগ্রস্তের মত টলতে টলতে স্কুল যাওয়া। হেঁটে যেত লাগত দশ থেকে বারো মিনিট। ঠিক ছটা বাজতে দশ মিনিটে বেরোতে পারলে আমিই প্রথম ক্লাসে ঢুকতাম। অন্ধকার ক্লাশ রুমে জানলা খুলে প্রথম আলো ঢোকানোর অনুভূতি ছিল অনির্বচনীয়। তারিখটা আজ আর মনে নেই, সেদিন কোন বিরোধী পার্টি খুব সম্ভবত কংগ্রেসই ধর্মঘট ডেকে ছিল। তখন ধর্মঘট ডাকাটাই ছিল ফ্যাশন-দুরস্ত। সরকারই বলুন বা বিরোধীপক্ষ সবাই নির্দিষ্ট সময়ান্তর বনধ্ ডাকত এবং বাস্তবিকই জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যেত।বনধ্ মানেই ছুটি। মে জুন জুলাই এমনি খরার মাস,  ক্যালেন্ডার খাঁ খাঁ করত লাল কালির অভাবে, ছোট  কাকু হতাশ হয়ে বলত, “এবার কেউ বনধ্ ডাক না বাবা। ” বনধ্ সত্যই ডাকা হত তবে মাইনেপত্র কাটার গপ্প সম্ভবত ছিল না। নাহলে আমাদের মত বহু মধ্যবিত্ত সংসারেই হাঁড়ি চড়ত না হয়তো।
যাই হোক সেদিনও বনধ্ ডেকেছিল। তবে সকাল ছটা বাজতে দশে আবার কিসের বনধ্? দিব্যি মা কান ধরে ঘুম থেকে তুলে তৈরি করে দিল,বাবা ও গল্প বলতে বলতে গলিঘুঁজির ভিতর দিয়ে স্কুলে দিয়ে এল। বেলা গড়াতেই শুরু হল বনধ্। কয়েকটা ছেলে পতাকা আর ডাণ্ডা নিয়ে হাজির হল, দোকানপাটে লাঠি ঠুকে কি ভয়টয় দেখালো, সব ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের তৎকালীন স্কুল সেক্রেটারি স্বয়ং বাসের কাঁচ লক্ষ্য করে ইঁট পাটকেল ছুঁড়তে লাগলেন। ব্যস বনধ্ সফল। এবার আমাদের কি হবে? আমার মত যে গুটি কয় ছাত্রী এবং হাতে গোণা শিক্ষিকা এসেছিলেন, তারা আপাততঃ বন্দী। কারণ বাবা-মা'রা তো গুড়গুড়ি গুলোকে স্কুলে পাঠিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। ছুটির সময় হলে আনতে আসবে, আর যতক্ষণ  না শেষ বাচ্ছাটি স্কুল থেকে বিদায় নিচ্ছে দিদিমণিরাই বা বাড়ি যান কি করে?
বড়দি ছিলেন নীলিমা দি,ভীষণ কড়া। উনি হুকুম দিলেন, সেকশন নির্বিশেষে এক-একটি ক্লাশেয় সব মেয়ে এক একটি ঘরে বসবে, পড়াশোনা করার দরকার নেই, ঘর প্রতি একজন টিচার থাকুন, যিনি গল্প বলে মেয়েদের চুপ করিয়ে রাখবেন। কারণ না হলেই আমরা মাছের বাজার বসাব।
আমাদের ঘরে এলেন তারাদি। মধ্যবয়সী,  শুভ্রকেশ,ছোটখাট, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা শাড়ি,মৃদু অথচ ভয়ানক মিষ্ট গলা। তারা দির গলা শেষ বেঞ্চে অবধি পৌছাত না। তাই উনি পায়চারি করে পড়াতেন। তারাদি গল্প ধরলেন, মুহূর্তে শান্ত সমুদ্রের গর্জন।  গোটা ক্লাশে ছুঁচ পড়লে শব্দ শোনা যাবে। কি সে গল্প?খুব ছোট ছিলাম, ঘটনাটা স্পষ্ট মনে থাকলেও গল্পটা ভুলে গেছি। যতদূর মনে আছে, পাল বংশের অন্তিম পর্বে কোন এক রাজার কথা। যাঁর দুই রাণী ছিল। যথাসময়ে দুই রাণীর দুটি কন্যা সন্তান হয়। যাদের দেখতে ছিল হুবহু  এক,শুধু একজনের চোখের মণি ছিল ভ্রমরকৃষ্ণ আর অপরজনের সমুদ্রনীল। দুই কন্যাই যখন নেহাত শিশু হঠাৎ রাজার অকালপ্রয়াণ ঘটে, রাজবৈদ্য যদিও বলেন রাজা হৃদরোগে মৃত, কিন্তু এক রাণীর সন্দেহ হয়, রাজামশাইকে হত্যা করা হয়েছে। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। কিন্তু সে এমন বিষ অভিজ্ঞ দৃষ্টি ছাড়া তা ধরা অসাধ্য। রাণীর দৃঢ়বদ্ধ ধারণা হয়, তার সতীনই মুখ্য অমাত্যর সাথে যোগসাজসে এই হত্যাসাধন করেছে। এরপর কোপ নামতে চলেছে রাণী এবং তার শিশুকন্যার উপরে। অগত্যা গভীর নিশীথে সদ্যোজাত কন্যাকে বুকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন রাণী মা।
এরপর? কি হয় জানি না। কারণ আমার নাম ডাকা হয়, এবং জানানো হয়, বাবা আনতে এসেছে। বাবাকে দেখার আনন্দের সাথে মেশে চূড়ান্ত হতাশা, গল্পটা আর  শেষ অবধি শোনা হল না। দৃঢ় ধারণা ছিল বাবা নির্ঘাত জানবে, বাবা জানে না এমন গল্পই থাকতে পারে না।  কিন্তু দেখা গেল বাবা শোনেইনি গল্পটা। বড় হতে অনেক আশা ছিল শরদ্বিন্দু বাবুর ওপর। তিনিও নিরাশ করলেন। নারায়ণ সান্যাল ও আশা দিতে পারলেন কই। অনেক খুঁজেছি জানেন। আমার চেনা পরিচিত, যারাই বাংলা সাহিত্য গুলে খেয়েছেন, সকলকে জিজ্ঞাসা করেছি, এমনকি গুগল ও এ গুগলির জবাব দিতে পারেনি। কি হয়েছিল? কে লিখেছিলেন গল্পটা? তবে কি এটা নিছক তারাদির মস্তিষ্কপ্রসূত? এর জবাবের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানি না। মাঝে মাঝেই শত ব্যস্ততা অলসতার ফাঁকে চোখে ভেসে ওঠে সেই ক্লাসরুম, তারা দি আর সেই দুই কন্যার কথা, যাদের একজনের চোখ কৃষ্ণ অপর জনের নীল। কি হয়েছিল তাদের সাথে?পিতার হত্যাকারীকে কি যথোপযুক্ত  শাস্তি দিতে পেরেছিল?নাকি নিজেরাই বিলীন হয়ে যায় কলের গর্ভে?কাল নিরবধি--- যদি কেউ জানেন,অনুগ্রহ করে আমায় একটু জানাবেন?

অনির ডাইরি ৫ই অগস্ট ২০১৭
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন
আপনি,তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী”  আসন্ন দুর্গা পুজোর আনন্দ বোধহয় এর থেকে ভালো ভাবে বয়ান করা দুঃসাধ্য । ঘণ কালো মেঘে ডাকা আকাশ, ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অফিস-ইস্কুল,জমা জল, ডেঙ্গু-জ্বর সব কিছুর মাঝে হঠাৎ যখন এক ঝলক স্বচ্ছ নীল আকাশ আর একফালি সোনা রোদ এসে স্পর্শ করে, ক্লান্ত, চূড়ান্ত  ল্যাদখোর মনও ক্ষণিকের জন্য খুশিতে টলটলিয়ে ওঠে। পুজোর আসার আনন্দ বরাবর শুরুই হয় পুজোর কেনাকাটা দিয়ে। একমাত্র আমার জ্যাঠাইমাকেই দেখতাম জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সব কিনে কেটে ভাগ বাটোয়ারা করে দিত। পুজোর প্রথম জামাটা আমার বরাবরই জ্যাঠাইমার থেকে পাওয়া।
বড় পরিবারে মানুষ হবার প্রথম সুফল হল, পুজোয় পাওয়া অসংখ্য জামা। তা বেশ অনেক গুলি তো হতোই। তখন এতো মল কোথায়? পুজোর বাজার মানেই নিউ মার্কেট। রবিবার ছাড়া বাবা-মার সময় হত না।  ১৫ই অগস্টের পর রবিবারেও খোলা থাকত নিউ মার্কেট। মোটামুটি বাবাদের বোনাস ও ঐ সময়েরই আগে পরে হত। রবিবার দিন তড়িঘড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে, বাসে করে সপরিবারে যাওয়া হত নিউ মার্কেট।

মিনি বাস হলে মেট্রো সিনেমার সামনে নামাত, আর বড় বাস হলে প্রেস ক্লাবের সামনে। প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে বাবার হাত ধরে মনোহর দাস তড়াগের ওপর দিয়ে হেঁটে ওপারে জহর লাল নেহেরু রোডে পড়া। কি লোভী অথচ ভীতু ভীতু চোখে তাকাতে তাকাতে যেতাম, পাক্কা ভিজে বেড়াল হয়ে- ভাবতেই হাসি পায়। মনোহর দাস তরাগের গয়েই বসে যেত হকাররা ছোটখাট পসরা নিয়ে।চৌরঙ্গী ততোক্ষণে জনসমুদ্র। পিলপিল করত লোকে। কত চেনা লোকের সাথে যে দেখা হত। মাঝে মাঝে  স্কুলেরই কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলে মনে হত আয়না দেখছি, তারাও বাবাদের হাত ধরে জুলজুল করে তাকাতে তাকাতে যেত, যথারীতি মায়েরা পিছন পিছন আসত। দেখা হলে হাসি চাপা দায় হত।
লিন্ডসে দিয়ে শুরু হত। আগে জুতো। সেই যে কথিত আছে না পুজোয় চাই নতুন জুতো। শ্রীলেদার্সে ঢোকে কার সাধ্যি। কি লম্বা যে লাইন পড়ত বাপরে বাপ। অগত্যা খাদিমই ভরসা। জুতোর পর জামা। পুরোনো নতুন নিউ মার্কেট পায়ে হেঁটে ঘোরার আনন্দ লিখতে বসে এই মুহূর্তেও অনুভব করছি। প্রতিটি দোকানের বাইরে ভিতরে হ্যাঙারে ঝোলানো কতশত জামা। সবাই আসছে, দেখছে, ঘাঁটছে, চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ আবার কিনছেও। তবে যত ভিড় করিডরে, তার কণা মাত্র ভিড় ও দোকান গুলিতে থাকত না।
পাঁচটার কমে বাবা কোনদিন জামা কিনে দিত না। জামা,জুতোর ব্যাগে কাহিল হয়ে নিউ মার্কেট ত্যাগ করার পর কেনা হত, চুলের ক্লিপ, হেয়ার ব্যাণ্ড, ঝুটো দুল, ব্যাগ, কখনও কখনও কাপড় আঁটা ক্লিপও। যেন পাড়ার দোকানে ওসব পাওয়া যায় না। টুকিটাকি  কেনাকাটা চলতেই থাকত যতক্ষণ  না বাবা হুঙ্কার ছাড়ত। এরপর?রালিজের ধোসা আর কুলফি ছাড়া থোড়াই পুজোর মার্কেটিং শেষ হত মশাই।
তারপর অনেক অনেক বছর কেটে গেল। গঙ্গা দিয়ে অনেক অনেক জল গড়িয়ে সাগরে মিশে সামুদ্রিক জলস্তর অনেক অনেক উঁচু কে দিল, পৃথিবী বেশ কয়েক ডিগ্রী গরম হয়ে গেল, বাবামায়েরা বুড়ো হয়ে গেল আর আমাদের শৈশবও কোথায় যেন হারিয়ে গেল। নিউ মার্কেট হারালো তার জৌলুস। নিউ মার্কেটের জামা শুনলে লোকজন নাক সিঁটকাতে লাগল।  আমাদের মত নিখাদ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও শপিং মলে প্রবেশাধিকার পেল। দামী কিন্তু কেনা যায়। দেখতেও বেশ অনন্য। মুছে যেতে লাগল নিউ মার্কেট আর পুজোর অবিচ্ছেদ্য সংযোগ। হারিয়ে গেল সপরিবারে পুজোর বাজার। বিয়ের পর দেখলাম, পৃথিবীর অলসতম নাস্তিক ব্যক্তিটির সাথেই ঈশ্বর আমার গাঁটছড়া বেঁধেছেন। যার মধ্যে পুজো নিয়ে বিন্দুমাত্র উন্মাদনা নেই। শপিং শুনলে আঁতকে ওঠে। “ঐ ভিড় ঠেলে মারামারি করে কেনাকাটা করার কি দরকার? এত আছে তো আর জামাকাপড় কেনারই বা কি দরকার? এবার পুজোয় কেনাকাটা করার আগে বরং একটা বাড়ির ব্যবস্থা কর। রাখবি কোথায়?” ধুস্। অগত্যা বন্ধুবান্ধবই ভরসা। সঞ্চিতা সবসময় রাজি সঙ্গ দিতে, কিন্তু কিছুতেই সময় মেলে না। আর সুকন্যার সাথে সময় তো মেলেই সাথে সাথে মেলে কুঁড়েমিও। দুজনেই সদ্য পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় ফিরেছি। জামাকাপড়ের  কি সাংঘাতিক বেহাল দশা তা আমরা ছাড়া শুধু ঈশ্বরই জানেন। তবু রোজ আমাদের বার্তালাপ বাঁধা থাকত একই ছন্দে,“ যাবে তো? হ্যাঁ যাব।  তাহলে চল? আজ থাক। ” দেখতে দেখতে বিশ্বকর্মা এসে চলে গেলেন, মায়েদের গালমন্দের দাপটে গুরু এবং লঘুজনদের জিনিস গুলি যাও বা কেনা হল, সু বা আমার আর কিছুই কেনা হয়ে উঠল না। দেবু তখন মালদায়। কি কাজে কলকাতা এসেছে, একে ব্যাচমেট তায় পুরোনো পশ্চিম মেদিনীপুর কানেকশন, একসাথে তিনজনে লাঞ্চে গেছি, খাবো কি, দেবু বউকে পুজোয় কি এবং কি কিনে দিয়েছে সেই গপ্পই শেষ হয় না। মাঝপথে দম নিতে থেমে দেবু বলল,“ তোদের বরেরা কি দিল?”  সু গম্ভীর মুখে বলল,“কচু” এবং আমিও ততোধিক গম্ভীর ভাবেই বললাম,“পোড়া। ”দেবু হাঁ হয়ে বলল,“চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাচ্ছিস দুজনে? চল। চল। আজই কিনবি চল। ” কি কিনব, সেই নিয়ে লম্বা চওড়া থিসিস লিখলাম দুজনে, সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলাম না। ট্যাক্সিতে উঠেও যখন ঐক্যমত হতে পারলাম না, দেবু বিরক্ত হয়ে বলল,“ওরে বাপ, তোরা শাড়িই কিনবি চল। আমি না থাকলে শালা তোদের যে কি হবে?” সত্যই তাই। দেবু কান ধরে না নিয়ে গেলে হয়তো মায়েদের থেকে ধার করা শাড়িতেই পুজো কাটাতাম আমরা।
আরো জল গড়িয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে। সু আবার ফিরে গেল মেদিনীপুর।দেবু নেমে গেল দুর্গাপুর। পুজো বয়ে আনতে লাগল একরাশ বিষণ্ণতা।একে তো মাইনে পত্র, পেকমিশন,জিএসটি নিয়ে  মনখারাপ, সর্বোপরি এই দুঃসহ একাতীত্ব। একাই কি তবে? ধুৎ আজ মনস্থির  করেই নিলাম, একা তো একাই। সারা বছর তো অনলাইন শপিং চলে, জগজ্জননীর আগমনে আমি কিছুতেই অনলাইনে ডিসকাউন্টে কেনা বাসি পচা জামাকাপড় পড়ব না। পুজোয় যদি মারামারি গুঁতোগুঁতি, দামাদামি করে কেনাকাটাই না করতে পারলাম তাহলে আর করলাম কি।
অনির ডাইরি ২৩শে জুলাই ২০১৭
বর্ষা নামলেই আমাদের ক্যাথারসিস হয়। সব্বার দেওয়াল দেখুন,আজ শুধু বর্ষা নিয়েই সরগরম। এমনকি আমার বর ও সাতসকালে কবির সুমনের কয়েক লাইন পোস্টিয়েছে। যদিও অন্য সকলের পোস্টসূচক অনুভূতির থেকে শৌভিকের পোস্টের অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। 
বর্ষা আমার বরাবরই প্রিয়। বাঙালী, মধ্যবিত্ত অথচ বর্ষা আপনার মনে রোমান্টিক অনুভূতির স্পর্শ আনবে না, এ আবার হয় নাকি? তবে আজকাল কেমন যেন মনে হয় এই অনুভূতিগুলো বয়স ভেদে ভিন্ন ধরনের হয়। যেমন শৈশবে, বর্ষা মানেই ছিল নিষিদ্ধ আনন্দ। বর্ষা মানেই উঠোনে জমা জল, আর সেই জলে ভাসানো কাগজের নৌকা। মা আর কাকিমার শুধু অফিস বেরোনোর অপেক্ষা, অতঃপর ঠাকুমাএবং পিসিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট প্রদর্শন করে শুরু হয়ে যেত তিন ভাইবোনের উল্লাস এবং হুল্লোড়বাজি। তখন আশির দশক। ডিসি কারেন্ট। সামান্য ঝড় হলেই তার ছিঁড়ে যেত। সন্ধ্যা থেকে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসানোর বৃথা চেষ্টা মা’রা অচীরেই ত্যাগ করত। টিপটিপ বা ঝমঝমে বৃষ্টিতে নীচের দালানে কমিয়ে রাখা হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোয় জমিয়ে হাড়হিম করা ভূতের গল্প। কোথায় লাগে হেমেন্দ্র কুমার রায়। ছাত দিয়ে জল পড়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার। দোতলার ঘর গুলো প্রায় ভেসে যেত। বাবা তখন হ্যারিকেন, ছাতা, লোহার কাঠি আর আমাদের নিয়ে যেত ছাতের নর্দমার মুখ খোঁচাতে। মারামারি লেগে যেত, কে ছত্রধারক হবে আর কে হ্যারিকেন বাহক।
শুরু হল নব্বইয়ের দশক।বর্ষা মানেই রেইনি ডে বা ফাঁকা ফাঁকা ক্লাস রুম। দিদিমণি না আসতে পারায় ফাঁকা পিরিয়ডে চুটিয়ে গপ্প, মাঝে মাঝে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে প্রিয়বন্ধুর হাত ধরে দেখা ঘণ কালো বাদরের কান্না। বর্ষা তখনও হৃদয়ে রোমান্সের ছোঁয়া লাগাতে পারেনি। ছোঁয়া লাগল নবম শ্রেণীতে। সেই যে “আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি--। ”
দোতলার উত্তর পশ্চিম দিকের ঘরটায় ছিল চারটে মানুষ প্রমাণ জানলা,পুরাণো দিনের বাড়ি, কোন জানলাতেই সান শেড ছিল না। ঝড় না উঠলে বাইরের দিকের কাঠের  খড়খড়ি বন্ধ করা হত না। ভিতরের তিন ভাঁজ কাঁচপাল্লা বন্ধ করেই কাজ চালানো হত। এরকম বৃষ্টির দিনে, নিঝুম দুপুরে,  টিপটিপ আওয়াজ শুনতে শুনতে ঠাকুমার বিয়ের বিশাল খাটে শুয়ে, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে কাঁচ পাল্লার ভিতর দিয়ে আকাশ দেখা ছিল কি যে অসম্ভব রোমান্টিক ব্যাপার। কতদূর পর্যন্ত যে আকাশ দেখা যেত, ভাবলেই বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা করে।  মাথার ওপর বিশাল ডিসি পাখার ঘরঘর, জানলার কাঁচে ছিটপিট ছিটপিট জলের আল্পনা, মাঝে মাঝে একটা ভিজে চুপচুপে কাক বা পায়রা এসে বসত, কাঠপাল্লার ওপর, গম্ভীর ভাবে ভিতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, ছটপটিয়ে জল ঝেড়ে  আবার উড়ে যেত। সত্যি বলছি সময় থমকে আছে আজোও  ঐ মুহূর্তে----

আর এখন বর্ষা, এক অন্য অনুভূতি জাগায়, ইচ্ছে করে, প্রবল ইচ্ছে করে ঠাকুমার বিয়ের ঐ বিশাল খাটের মত কোন খাটে আমার আপাততঃ সবথেকে প্রিয় চার সখীর সাথে অগোছালো গড়াগড়ি বা সোজা কথায় ল্যাদ খাবার। একটু গল্প,  আবার একটু মোবাইল ঘাঁটা, একটু ট্যাবে বই  পড়া, একচোট হাসাহাসি, মাঝে মাঝে বিড়িখোর( আসলে মূল্যবান সিগারেট) গুলোর বিড়ি ফুঁকে আসা, অথবা খাটে বসেই বিড়ি ফোঁকা একটা ভাঙা কাপে ছাই ফেলা,অন্যমনস্কভাবে জানলায় জলের আল্পনা দেখতে দেখতে বাইরের ঝুটো সফিস্টিকেশনকে খুলে ফেলে আসল আমি’র বেরিয়ে আসা----

অনির ডাইরি ২২শে জুলাই ২০১৭
পুরুলিয়ার শিশুটির জন্য সবার হৃদয় ভারাক্রান্ত, হবে নাই বা কেন?এরকম কিছু হলে প্রথমেই নিজের প্রিয়জনদের জন্যই দুঃশ্চিন্তা হয়, তাই না? সবাই আতঙ্কিত, সবাই ক্ষুব্ধ তা তাঁদের পোস্ট দেখেই বোঝা যায়।তড়িঘড়ি সবাই পোস্ট করেছেন, একজনের দেখা মাত্রই অন্যজন আরো করুণ অথবা আরো বিস্ফোরক পোস্ট দিচ্ছেন। কখনও কখনও কারো পোস্ট দেখে অবশ্য মনে হয়েছে, এটাই ঐ যে বলে না ইন থিং। এনিয়ে একটা পোস্ট না দিলে, ছোঃ আপনি মশাই সামাজিক ভাবে অসংবেদনশীল।

একজন স্বঘোষিত নারীবাদী হিসেবে ব্যাপারটা আমার বেশ কৌতুকের মনে হয়। এর আগেও আমরা এই নিয়ে বহু চর্চা করেছি, বহু অগ্নিগর্ভ পোস্ট লেখা হয়েছে এবং দিনান্তে আমরা পুনরায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, যে, এই ধরনের পাশবিক প্রবৃত্তি তো পুরুষদের থাকবেই। মেয়েদেরই উচিত সাবধান হওয়া। সেই যে পিঙ্ক সিনেমায় স্কিৎজফ্রেনিক উকিলবাবু নোট করছিলেন, মেয়েদের কি কি করা উচিত নয়, মনে আছে? না থাকলে একবার কষ্ট করে দেখেই ফেলুন সিনেমাটা।

রেগে যাচ্ছেন তো?নারীবাদী মানেই সেই পুরুষদের দোষারোপ  করার মানসিক  ব্যারাম যুক্ত মানসিক  রুগী। যারা সবাইকেই ধর্ষক বলে মনে করে নির্ঘাত এইসব বলে জ্ঞান দিচ্ছেন। কি করব বলুন। আপনি যেভাবে ব্যাপারটা দেখেন, যে ভাবে সোশাল মিডিয়ায় বিপ্লব আনেন, তারপর সব ভুলে আবার অন্য ঘটনা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন আমি তা পারি না।

এতজন শিশুটিকে নিয়ে এত লেখালিখি যারা করেন,  তাদের মধ্যে কতজন ভিড় বাসে যখন কোন মহিলা সোচ্চারে কারো অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করেন, তাকে সমর্থন জানান? কেউ জানান কি? না মশাই আমার এতবছর বাসট্রামে ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কেবল একবার এক বৃদ্ধ কেবল এক মহিলার সমর্থনে আওয়াজ তুলে ছিলেন। তারপর তাকে যে ভাষায় বীর পুঙ্গবেরা সম্ভাষণ জানিয়ে ছিল, তা আর লিখছি না। পরিণত বয়স্ক মহিলারা যেখানে চিৎকার  করে সেখানে শিশুগুলির কি অবস্থা হয় অনুমান করুন। ভাবলে হাড় হিম হয়ে যাবে। মেয়েগুলো যেই আট দশ বছরের হবে শুরু হয় এই আক্রমণ। এরকম একজন মহিলা খুঁজে বার করুন তো যার এই অভিজ্ঞতা নেই। বিশ্বাস করুন মেয়েরা প্রথম প্রেম ভুলে যায় কয়েক মাস বা বছরে কিন্তু  শৈশবের প্রথম আক্রমণ জীবনেও ভোলে না। মনে হয়, নোংরা এক খাপলা পাঁক গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হল, যা শত সহস্রবার ধুলেও যাবে না। কোন এককালে এক পরিচিত নব্য উকিল বলেছিল,“মেয়েদের একা একা বেশী বাড়ি থেকে বেরোন উচিত নয়। রাস্তাঘাটে তোমাদের সাথে যা হয়, চাকরী করার কথা তোমরা ভাবো কি করে?” উনিও দেখলাম এই ঘটনা নিয়ে এক জ্বালাময়ী পোস্ট দিয়েছেন।

আচ্ছা এটা ছাড়ুন, অফিস কাছারিতে যখন কোন মহিলা সহকর্মী পুরুষ কর্মচারীর বিরুদ্ধে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ আনেন কতজন তাকে সমর্থন করেন? আমি রীতিমতো গর্বিত সেই সব মেয়েদের জন্য যারা সামাজিক লজ্জা সংকোচের ভেক ছুঁড়ে ফেলে প্রতিবাদ টুকু করার সাহস দেখায়। তাদের সমর্থন করা ছাড়ুন তাদের নিয়ে হাসাহাসি, অশ্লীল ঠাট্টা ইয়ারকিতে ছয়লাপ হয় প্রথম চোটে। এরকম বহু ইন্ডাসট্রিয়াল ডিসপিউট আসে আমাদের কাছে, যেখানে মেয়েটি প্রতিবাদ করা মাত্র তাকে চাকুরী থেকে বিতাড়ন করা হয়।
আর একটা কথা, ধর্ষণের ঠিক কি রকম বিচার আপনি আশা করেন? দিল্লীর নির্ভয়া বা পুরুলিয়ার বাচ্ছাটির ক্ষেত্রে ফাঁসি আর অন্যান্য  ক্ষেত্রে?? ফাঁসি বা জেল? নাকি নিছক সালেশী? যেদিন পুরুলিয়ার শিশুটি মারা গেল ঠিক সেদিনই আনন্দবাজারের ৩নং পৃষ্ঠায় একটা খবর ছিল। কাঁথির ধাউরিয়াবাড় গ্রামের খবর। দুই বোনকে, যাদের একজন নাবালিকা দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণ করে আসছিল এক বৃদ্ধ। জানাজানি হলে বৃদ্ধ ঐ ভিটেয় আত্মাহুতি দেবে এই ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য করা হয় মেয়েদুটিকে। সম্প্রতি নাবালিকাটি গর্ভবতী  হয়ে পড়ায় ব্যাপারটি সবার গোচরে আসে। অতঃপর? পুলিশ, থানা, কোর্ট, সোশাল মিডিয়া, জ্বালাময়ী পোস্টে ফাঁসির দাবী, কি তাই তো? না মশাই। কিছুই হয়নি। হয়েছে সালিশি সভা। বললাম না কাঁথি, হরিয়ানা নয়, আপনি বলছেন খাপ পঞ্চায়েত?  বিচারে বৃদ্ধকে ২লক্ষ ২০হাজার টাকা জরিমানা  করা হয়েছে। দুই বোনের ক্ষতিপূরণ ১লক্ষ টাকা করে, ১৫হাজার টাকা গর্ভপাতের জন্য আর পাঁচ হাজার টাকার মোচ্চব হবে। ও হ্যাঁ মেয়ের বাবাকেও জরিমানা করা হয়েছে,  মেয়েদের সামলে রাখতে না পারার জন্য। আর আপনার জ্বালময়ী ন্যাকা পোস্টে ৯২টা লাইক আর৫৩টা কমেন্ট।  ঘেন্না ধরে গেল মশাই।
অনির ডাইরি ২১শে জুলাই ২০১৭
সেটাও ছিল ২১শে জুলাই। কলকাতা অচল করার দাবী জানালো এক অল্পবয়সী নেত্রী। লক্ষ্য রাইটার্স। কেন? কি বৃত্তান্ত? আজ থোড়াই মনে আছে। সব তথ্য যদিও নিছক আঙুল নাড়লেই পেয়ে যাব, কিন্তু থাক। ইচ্ছা করছে না। ইতিহাস থাকুক বইয়ের পাতায়, আর উইকিপিডিয়ার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে। আমি শুধু অনির ডাইরি লিখতে পারি।
বাবা এবং ছোটকাকু দুজনেই নকশাল ছিল। সুপরিকল্পিত  ভাবে বাড়ি ঘিরে ফেলে ভাঙচুর চালিয়ে ছিল বিপক্ষ পরবর্তী কালে যারা চৌত্রিশ বছর সিংহাসন দখল করে রাখতে সক্ষম হয়। সেদিনের ঘটনাবলী যতটুুকু শুনেছি  তা মনে করে হৃদয়কে অকারণ ভারাক্রান্ত করতে চাই না। শুধু এটুকু বলি যে আসল পরিকল্পনা ছিল পিটিয়ে মারার, ঘটনাটা যতদূর আমি বুঝেছি এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল যেন, পুলিশ এবং সিআরপি যৌথভাবে  বাবা এবং ছোটকাকুর খোঁজে আমাদের বাড়িতে তত্ত্বতালাশ চালাতে আসবে, সাথে সাথে জমা হবে শ দুই আড়াই চ্যাংড়া যাদের কিছুবছর আগেও আমরা হার্মাদ বলে উল্লেখ করতাম। তারাই তাক বুঝে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারবে দুই ভাইকে। প্রায় সপ্তাহ কয়েক ধরে পাড়ার বিভিন্ন  লাল রঙ করা বাড়িতে জমা হচ্ছিল এই হার্মাদের দল। খবর ছিল বাবাদের কাছেও তাও ধরা পড়ে যায়, খুব কাছের কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায়। বাবাকে পিটিয়ে আধমরা করেই দিয়েছিল,  পুরো পারেনি শুধু এক পাঞ্জাবি সিআরপি অফিসারের জন্য। যে এত চক্রান্তের কিছুই জানত না। আসামীকে জনগণ পেটাচ্ছে, বাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে অথচ রাজ্য পুলিশের লোক গুলো ঠুঁটো জগন্নাথদেব, ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। অর্ধমৃত বাবাকে কাঁধে ফেলে, মাথাটা বুকে চেপে, যাতে কেউ মাথায় না মারতে পারে,চাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল  পাড়ার বাইরে দাঁড় করানো জিপে।
যাই হোক। এই সব ন্যায্য কারণেই ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আমাদের বাড়ির প্রতিটা লোকের ছিল অসীম ঘৃণা। কিন্তু ঐ দুর্ভেদ্য দুর্গে ফাটল ধরাবে কে? বাবার মুখে শুনেছি দাদু মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন,“ শত্রুকে কোনদিন ক্ষমা কোর না। আর কিছু যদি নাও পারো, প্রতিরাতে শোবার আগে একবার অন্তত ওদের অমঙ্গল কামনা করতে থাকো। ”

গড ফাদারে সেই যে ডন কর্লিয়নি বলে গেছেন, “প্রতিশোধ বাসি হলে মিষ্টি হয়!“যথা সময় মঞ্চে প্রবেশ এই অল্প বয়সী জঙ্গী নেত্রীর। গোটা চাটুজ্জে বাড়ি মুগ্ধ হয়ে গেল ওনাকে দেখে। বলছি আশির শেষ আর নব্বই দশকের গোড়ার কথা। আমি রাজনীতির “র” ও বুঝি না, অনুগ্রহ করে আমার গায়ে কোন দলের রঙ লাগাবার চেষ্টা করবেন না। আমি শুধু লিখে চলেছি অনির কথা, তার নানা প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অভিজ্ঞতার কথা।

সেদিন নেত্রী বললেন “চলো রাইটার্স”। বিভিন্ন দিক থেকে ওণার গুণমুগ্ধরা এসে জড় হতে লাগল কলকাতায়। টি বোর্ডের উল্টোদিকে রাধাবাজার পোস্টাফিসের উপরে ছিল বাবার অফিস। তিনতলার জানলা থেকে বাবারা দেখছিল কাতারে কাতারে লোক আসছে হাওড়া ব্রীজ অচল করে। আটকালো পুলিশ। না মশাই শুধু উর্দি পড়া সুটেড বুটেড পুলিশ না, হাওয়াই চটি বা খালি পায়ে উর্দি পড়া ঝুটো পুলিশও ছিল সেদলে।

ক্যানিং স্ট্রীট থেকে টি বোর্ড অবরুদ্ধ করে শুরু হল বেপোট মার। প্রথম চোটেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল জনতা। ছুটল যে যেদিকে পারে অলিগলি দিয়ে। পিছনে লাঠি উচিয়ে আসল এবং নকল পুলিশ । জনতাও সুবোধ নয়। ঐ ভয়ানক মার জনতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটালো।  পাল্টা লাঠি ,ইঁট , সোডার বোতল ছুটে আসতে লাগল গলি গলি থেকে।আমার জামাইবাবু ছিলেন হাওড়া থেকে আসা দলটিতে। দু চার ঘা উনিও খেলেন।

নেত্রী সম্ভবতঃ ছিলেন এসপ্ল্যানেড সংলগ্ন কোথাও। খবর পেয়ে ছুটে এলেন অকুস্থলে। টিবোর্ডের পাশের বাড়িটার সামনে অস্থায়ী একটা স্টেজ বাঁধা হয়েছিল। তিনি উঠে মাইক কেড়ে নিয়ে স্বভাব বশতঃ চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “আপনারা শান্ত হন। অকারণ হিংসা ত্যাগ করুন। ” হয়তো বুঝেছিলেন আসল এবং নকল পুলিশ কি করতে বা বাঁধাতে চাইছে। 

এরপরের ঘটনা বলতে বসে বাবা আজো আক্ষেপ করে। কেন যে তখন মোবাইল ছিল না। থাকলে অসংখ্য ছবি তুলে রাখতে পারত।মঞ্চে লাফিয়ে উঠল একদল হাওয়াই চটি পড়া পুলিশের দল-- তারপর শুধু মার আর মার। নেত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে বেধড়ক মার খেলেন অপর এক নেতা এবং নেত্রীর দেহরক্ষী। পুলিশ হয়ে পুলিশের রাতে রক্তাক্ত হল। আর নেত্রী? অত মার খেয়ে, সাদা শাড়ি রক্তাক্ত হওয়া সত্ত্বেও নড়ানো গেল না ওনাকে। পালালেন না মঞ্চ ছেড়ে। হার্মাদদের নজর পড়ল ওপরের খোলা জানালায়। আধলা ইঁট দমাদ্দম উড়ে আসতে আগল জানলা গলে সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কয়েকজন দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল ওপরে----

পরদিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় ছিল সেই বিভৎস দৃশ্য। ছবির পর ছবি শুধু ওনার মার খাওয়া। মার খেতে খেতে পড়ে যাওয়া এবং পড়ে গিয়েও মার খাবার। লাল হয়ে যাওয়া সেই কাগজটা বহুদিন রাখা ছিল আমাদের বাড়িতে। লাল লম্বা রোয়াকে দাঁড়িয়ে জেঠু, বাবা এবং ছোট কাকু সহমত হয়েছিল, কবে, কখন কি ভাবে কেউ জানে না কিন্তু মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। আমরা তিন গুড়গুড়ে খুড়তুতো  জেঠতুতো ভাইবোন হাঁ করে শুনছিলাম।

সত্যি সত্যি সেই মৃত্যুঘন্টার দর্শন পেয়েছিলাম জানেন, সময়টা ২০০৯। ২১শে জুলাই মানেই সেই সময় ব্রিগেডে সমাবেশ। জ্বালাময়ী ভাষণ।  ভয়াবহ যানযট। নিত্যযাত্রীদের ভোগান্তি। আমি এএলসি খড়্গপুর। শৌভিক প্রবেশনার আলিপুর। সদ্য বিয়ে হয়েছে কিন্তু আলাদা আলাদা থাকতে বাধ্য হই পেশাগত কারণে। কি যেন বলতো শৌভিক উইক ডেজ্ ব্যাচেলর উইকএন্ড ম্যারেড তাই।
সেদিন ও দাশনগর থেকে মেদিনীপুর লোকালে উঠে, নবপরিণীত  বরকে ফোন করলাম। রোজকার রুটিন ছিল সেটাই। শৌভিক ধরল না। ভাবলাম চান করতে গেছে হয়তো, পরে করবে। প্রায় উলুবেড়িয়ার কাছে, হঠাৎ ফোন। “কাল রাত থেকে খুব জ্বর। তুই কি আসতে পারবি?”এটা কি ধরনের প্রশ্ন হল? আজ ২১শে জুলাই ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর ছুঁইছুই। যদি নামিও উল্টো দিকের ট্রেনে চাপতে পারব? সে যে কি থিকথিকে ভিড় বলে বোঝাতে অপারগ। কিন্তু এত বড় মুখ করে ডাকছে। না গিয়ে কি পারি?শৌভিক যদিও ততোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে পইপই নিষেধ করেই চলেছে। একদম গাড়লের মত কাজ যেন না করি। লক্ষী মেয়ের মত যেন অফিস যাই। তখনও পরিবর্তন দূরের স্বপ্ন মাত্র। ক্ষমতাসীন দল যদি জানতে পারে ২১শে জুলাই এএলসি অফিস করেনি,ঝামেলা হতে ও পারে। ভালবাসা আবার কবে এত সদুপদেশ শোনে?মুখে বললাম আচ্ছা। নেমে পড়লাম উলুবেড়িয়ায়। গোঁতাগুতি করে ট্রেনে উঠে নামলাম হাওড়া স্টেশনে। ঘড়িতে বেলা দশটা। অতঃকিম?এয়ারপোর্ট পৌছব কি করে?যেকটি বাস আছে, সারি সারি মৃত শহরের হর্ম্যরাজির  মত ঘুমন্ত। কয়েকজন উঠে বসে তো আছে, কিন্তু নড়েও না চড়েও না। আমিও উঠলাম। একঘন্টায় কয়েকগজ এগোল বটে বাস। তারপর জানিয়ে দিল আর যাবে না।
তখনও হাওড়া ব্রীজ অনেকটা। ইতিমধ্যে শুরু হল বৃষ্টি। সেকি বৃষ্টি তাকে আটকায় কেসিপালের সাধ্য কি? ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছাড়িয়ে উর্ধবশ্বাসে দৌড়চ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শৌভিকের অমৃতবাণী। কেন নামলি?কেন হাওড়া স্টেশন থেকে উল্টোদিকের বাস ধরে বাড়ি ফিরে গেলি না? কেন একঘন্টা ভোন্দুর মত বাসে বসে রইলি? কতদূর পৌছলি? বাপরে বাপ। এত হিসেবি হলে না তো প্রেম হয়, নাই অ্যাডভেঞ্চার। 
দুই কাঁধে দুটো ঝোলা আর হাতে ছাতা নিয়ে আধভেজা হয়ে হাঁটতে লাগলাম অগুনতি মানুষের ভিড়ে। দিব্যি এগোচ্ছিল ভিড়টা, আচমকা হাওড়া ব্রীজে উঠে থমকে গেল সব। যেন আচমকা নদীর বুকে ঘুর্ণি । একে ওকে গোঁত্তা মেরে এগিয়ে দেখি, হাওড়া ব্রীজের মাঝ বরাবর এক বিশাল ঘন্টা। ধাতব কিনা বুঝলাম না। ধাতব হলে তো বিশাল ভারি হবে। একটা চাকা লাগানো গাড়ির ওপর বসানো সামনে লেখা “মৃত্যু ঘন্টা। ” গাটা শিরশির করে উঠল--- কি যেন বলে? ফর হুম দা বেল টোলস্? তার জবাব ছিল শুধু মহাকালের গর্ভে।

No comments:

Post a Comment