Saturday 2 September 2017

এক নম্বর ফরজানা


আশার ফোনটা যখন এল, ইউসুফ তখন অভ্যাগতদের সাথে গল্পে মত্ত ছিল। আজ বকরিদ। সকাল থেকেই দারুণ আবহাওয়া, সমুদ্র নীল রঙের আকাশে ভাসমান পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ, কাঁচা সোনা রোদে ঝকমক করছে কাদখালি গ্রাম। কিন্তু সে রোদ বড় মিঠে, অন্য দিনের মত চামড়া জ্বালানো রোদ নয়, মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। কোরবানি ভালো ভাবেই মিটে যাবার পর, আত্মীয়স্বজন- প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি মাংস বিলি করে সদ্য বাড়ি ফিরেছে ইউসুফ।ওনারাও কয়েকজন দিতে এসেছেন। রামনগর হাইস্কুলের হেড মাস্টার ইউসুফকে নিয়ে কাদখালির গ্রামের একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। শৈশবে যারা পাত্তাও দিত না, আজ তারাই ইউসুফ মাস্টার বলতে অজ্ঞান।

এই রকমই কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিল ইউসুফ, হঠাৎ পাঞ্জাবির পকেটে মৃদু কম্পন অনুভূত হল,আশার ফোন দেখে হাল্কা হাসির রেখা খেলে গেল ইউসুফের ঠোঁটে। রেহানা পাশের বাড়ির খালার সাথে গল্পে মশগুল ছিল, ইউসুফ হাসি চেপে বলল, “রেহানা, আশার ফোন।“ রেহানা, হাসি চেপে বলল, “বলে দাও মাংস খেতে হলে এখানে এসে খেতে হবে।“আশাবরী ইউসুফের সহপাঠী। পাশের রামনগর গ্রামেই বাড়ি, বরাবর একই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে একসাথেই দুজনে  একই সাথে পরীক্ষা দিয়ে প্রধান শিক্ষক হয়। ইউসুফ যেমন পাশের রামনগর হাইস্কুলের হেড স্যার, আশাবরী তেমনি কাটোয়ার একটি মেয়েদের স্কুলের বড়দি।  আশার বয়স পঞ্চাশ হলে কি হবে,বিয়ে থা করেনি এবং সাংসারিক ব্যাপারে এক্কেবারে অপদার্থ। আশার রান্না মুখে তোলা দুষ্কর। তাই প্রতি বকরিদেই রেহানা অর্থাৎ ইউসুফের ঘরণীই মাংস রান্না করে দেয়,আশা আসে, দুপুর বেলায় সবাই একসাথেই খাওয়া দাওয়া করে, রাতেও রেহানা, মাংস-রুটি করে ইউসুফের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় বিশ বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে আসছে, তবু প্রতিবার আশা ফোন করে, চিৎকার করে, “আমার মাংস কোথায়?”

ইউসুফ ফোন ধরে, আশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তরল গলায় বলে উঠল, “ আমি মাংস নিয়েই যাচ্ছিলাম রে, রেহানা যেতে দিল না। তুই চলে আয়-“। ইউসুফ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, আশার গলা শুনে চমকে উঠল, আশাবরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, “ইউসুফ ফরজানা এসেছে।“ মানে? ফরজানা হল ইউসুফ আর রেহানার একমাত্র অষ্টাদশী কন্যা। এ বছরই মেডিক্যালে চান্স পেয়ে কলকাতায় পড়তে গেছে। যথারীতি কলকাতায় এসেই মেয়ের পাখনা গজিয়েছে, বকরিদে একদিনের ছুটিতে তিনি নাকি আসবেন না। সামনেই লম্বা দুর্গা পুজোর ছুটি পড়তে চলেছে, তখন এসে আম্মি-আব্বুকে ধন্য করবেন। তাহলে হঠাৎ কি হল? কাল রাতেও মেয়ের সাথে কথা হয়েছে, সকাল থেকে হয়নি অবশ্য। ফরজানা আশাবরীর মন্ত্রশিষ্য, কিন্তু তাই বলে ঈদের দিন, এভাবে, ব্যাপারটা কিছুতেই ইউসুফের মাথায় ঢুকল না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শুধু বলল, “ফরজানা? কিন্তু বুল্টি যে বলল পুজোর ছুটির আগে আসতে পারবে না?” মেয়ের নাম শুনে রেহানাও অবাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আছে, আশাবরী ক্লান্ত স্বরে বলল, “ঐ ফরজানা নয় ইউসুফ। এক নম্বর ফরজানা।“

সুদূর মুর্শিদাবাদের দুটি ছোট গ্রাম, রামনগর আর কাদখালি। নাম শুনেই বোঝা যায়, একটি হিন্দু এবং অপরটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। শিয়ালদহ থেকে সকাল আটটা নাগাদ ছেড়ে কুঝিকঝিক করতে করতে লালগোলা প্যাসেঞ্জার যখন পলাশী  পৌছয় সূর্য তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই মধ্য গগন ত্যাগ করে। পলাশী ষ্টেশন থেকে রিক্সা বা বাসে করে আম বাগানের ভিতর দিয়ে রামনগর সুগার মিলের পাশ কাটিয়ে পলাশী হাইস্কুলের সামনে দিয়ে গিয়ে সোজা গঙ্গার ঘাট। আগে নাকি বর্ষা ছাড়া  অন্য সময় গঙ্গায় হাঁটু জল থাকত, তবে ফরাক্কা হবার পর, গঙ্গা সব সময়ই টইটুম্বুর। হাতে টানা নৌকায় চেপে ওপাড়ে রামনগর ঘাট। রাক্ষসী গঙ্গা প্রতিনিয়ত একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে রামনগর গ্রামকে, নৌকা থেকেই দূরে রামনগর সুগারমিলের জিএম বাংলো দেখা যায়। সাহেব দের বানানো সাবেকী কুঠি, লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ দিয়ে ঘেরা।এই সুগারমিলই ছিল রামনগর-কাদখালির লক্ষ্মী। মুর্শিদাবাদের উর্বর মাটিতে আখের ফলন হত দেখবার মত, সেই আখেই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ত সুগারমিল। সে সুদিন বহুদিন গত, আশাবরী-ইউসুফের ছোট বেলা জুড়ে শুধু ভাঙনের গল্প। আজব ব্যাপার মিলটা গঙ্গার এপাড়ে হলেও জিএম এবং এজিএম বাংলো কিন্তু ওপাড়ে, রামনগর গ্রামে। সাহেব সুবোদের ব্যাপার স্যাপারই অন্য রকম ছিল। এখন যদিও কেউ থাকে না ঐ বাংলোয়। চাপড়া খসে খসে পড়ছে, লাল কৃষ্ণচূড়ায় প্রতিফলিত পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মনে হয় রক্তাক্ত কুঠি একা দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করছে।

এই রামনগর গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী মজুমদার বাড়ির ছোট মেয়ে আশাবরী, কাদখালির ছোট্ট মুদির দোকানের মালিক এনায়েৎ মোল্লার মেজ ছেলে ইউসুফ আর ঐ গ্রামেরই তালাকশুদা ফাতিমা বিবির একমাত্র কন্যা ফরজানা একই সাথে রামনগর হাইস্কুলে ভর্তি হয়। সবে সত্তরের দশক পড়েছে, পশ্চিম বাংলা তখনও নকশাল দের রক্ত ধুয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু সেই রক্তের ছিটে আশা-ইউসুফ-ফরজানার জীবনে লাগেনি। আশাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল, ওর ঠাকুমা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মজুমদার গিন্নির ভয়ে তৎকালীন হেড স্যার যাকে আড়ালে সবাই মুচি মাস্টার বলত, প্রায় কাঁপছিল। ইউসুফ গিয়েছিল তার বড় ভাই ওয়াসিমের সঙ্গে, ওয়াসিম ঐ স্কুলেই ক্লাশ ফোরে পড়ত। আর ফরজানাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর মা, ফাতিমা বিবি। সেদিনেই ভর্তি, সেদিন থেকেই ক্লাশ। কোন ইউনিফর্মের বালাই ছিল না। বাড়িতে তিনজনেই ইজের পরে ঘুরত হয়তো, স্কুল বলেই ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা করে জামা ছিল। আশার থেকে ইউসুফের জামা একটু মলিন ছিল, আর ফরজানারটা তাপ্পি মারা ছিল। তাতে কি? রামনগর হাইস্কুলের ছারপোকাওলা বেঞ্চ সেদিন সাক্ষী ছিল, “শিশুর সাম্যবাদ।“ প্রথম দিন থেকেই তিনজন হরিহর আত্মা।

এক নম্বর ফরজানা (পর্ব -২)
রামনগর হাইস্কুলের দিনগুলি বোধহয় আশাবরী, ইউসুফ আর ফরজানার জীবনের সবথেকে বর্ণময় দিন ছিল। তিনজনের মধ্যে ফরজানা ছিল পড়াশোনায় সবথেকে ভালো। ফরজানা যেখানে ৭০/৭৫ এর নীচে নামত না, আশা আর ইউসুফ সেখানে কোনমতে পাশ টুকু করত, তাও একে অপরের ভরসায়। আশা ৪৫ পেলে ইউসুফ পেত ৪৪ বা ৪৬। শেষ বেঞ্চে বসে নরক গুলজার করাই ছিল দুজনের মোক্ষ।

কি যে সুন্দর দিল ছিল সে সব, রামনগর গ্রামের সীমানা বরাবর ছিল বিশাল আমবাগান। কথিত আছে এই সেই পলাশীর বিখ্যাত আম বাগান, সেই রক্তাক্ত রণাঙ্গন, যেখানে সুবা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব পরাস্ত হন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে। সেই আমবাগানের আয়তন ছিল নাকি কমবেশি প্রায় এক লক্ষ বিঘা। সিরাজের স্মৃতি বিজড়িত আমবাগানকে কেন্দ্র করে যাতে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সেন্টিমেন্ট না গড়ে ওঠে, তাই যুদ্ধে জয়ী হবার পর, নির্মম ভাবে, ঐ আমবাগান কেটে সাফ করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তী কালে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় ঐ এক লক্ষ বিঘা জমি কিনে নেন, জনৈক রামলোচন ঠাকুর। তাঁর নামেই রামনগর। পরবর্তী কালে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেই পূর্বেকার গঙ্গার খাতটা এখনও আছে, রামনগর আর কাদখালির মাঝে, অশ্বক্ষুরাকৃতি সেই হ্রদের স্থানীয় নাম বাদুরি। গঙ্গার ধার বরাবর আবার গড়ে ওঠে বিশাল আম বাগান। নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর বিশাল বিশাল মহীরুহ, নামে আম বাগান হলেও আসলে সুমিষ্ট আম আর রসালো লিচু গাছের পরিকল্পিত জঙ্গল। গরম কালে সেই আম বাগান ইজারা নিত ব্যবসায়ীরা, তাদের পেটোয়া লোকজন তাঁবু ফেলে বাগান পাহারা দিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই তিন মূর্তিকে আটকায় কার সাধ্যি।ঠাঠা রোদ হোক বা পড়ন্ত বিকেল বাঁদরের মত গাছে গাছে ঝুলে আম পাড়া ছিল দৈনন্দিন রুটিন। মিষ্ট আম লিচুর লোভে গাছ ভরে থাকত ঝাঁক ঝাঁক লাল পিঁপড়েয়, তাই সারা গায়, কেরোসিন তেল মেখে আম চুরি করে বেড়াত তিন মূর্তি।

তারপর আসত ভরা বর্ষা, প্যাচপ্যাচে কাদা মেখে হুড়োহুড়ি খেলা। ফি বছর বন্যা হত, জলে ভেসে যেত মাঠ-ঘাট। স্কুলও বন্ধ থাকত তখন। উপায়ন্তর না থাকলে কিছুদিন অদর্শনেই কাটত ওদের দিন। তারপর পুজোর দামামা বাজাতে বাজাতে আসত শরৎ। শরতে আশাবরীদের বাড়িতে দুর্গা পুজো হত, এখনও হয় যদিও,ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের সাথে সাথে ইউসুফ আর ফরজানারও চারদিন ধরেই নিমন্ত্রণ থাকত। দুর্গা মণ্ডপের সামনে বিশাল খোলা চত্বরে ঠেক বসত, কোথাও আশার বাবা-কাকা এবং তাদের বন্ধুরা বসত, কোথাও বা দাদা-দিদি-বউদি-জামাই বাবুদের ঠেক বসত, আশাদেরও নির্দিষ্ট ঠেকের জায়গা ছিল। পুজোর গান, শারদীয়ার গল্প আর মাস্টার মশাইদের নকলনবিশীতে কোথা দিয়ে যে কেটে যেত চারদিন হদিস থাকত না কারো। দশমীতে ভাসান দেখার আনন্দই ছিল আলাদা, এখানে বলে বাইচ বা বাচ। দুটি নৌকায় করে একচালা প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝ গঙ্গায়, তারপর নৌকা দুটি ক্রমশ আলাদা হতে থাকে, এক সময় ঝুপ করে মায়ের মূর্তি জলে পড়ে যায়। বিভিন্ন প্রতিমার মধ্যে বাচ প্রতিযোগিতা হত, গঙ্গার ঘাটে যেন মেলা বসে যেত ঐ দিনে। কাতারে কাতারে মানুষ, জাতিধর্ম নির্বিশেষে নতুন বা অপেক্ষাকৃত চকচকে পোশাকে ভিড় জমাত বাচ দেখবে বলে। পুজোর পরপরই বেশ ঠান্ডা পড়ে যেত। ডিসেম্বরে থাকত বার্ষিক পরীক্ষা, পরীক্ষা মিটলেই পুরো দমে দুষ্টুমি শুরু হয়ে যেত। ভোর বেলা খেজুরের রস চুরি করা, খেতের টাটকা মুসুর কড়াই, ওরা বলত মুসুরি চিবোতে চিবোতে বাদুরির ধারে আড্ডা, এক সাথে সাইকেল চালাতে শেখা, লুকিয়ে বিড়ি ফোঁকা, তারপর লেবু পাতা চিবিয়ে বাড়ি ফেরা, কি সব স্বর্গীয় দিন ছিল সে সব।

অষ্টম শ্রেণী অবধি রামনগর হাইস্কুলে পড়ার পর, ওরা ভর্তি হল পলাশী হাইস্কুলে। গঙ্গা পেরিয়ে এপাশে এসে, সাইকেলে মিনিট দশ লাগত, আর হেঁটে পনেরো মিনিট। আশা আর ইউসুফের সাইকেল ছিল, লেডিস সাইকেলের বালাই ছিল না, আশা ওর বাবার সাইকেলই নিয়ে যেত। কোনদিন আশা চালাতো ফরজানা সামনে বসত, আবার কোনদিন উল্টে বসত ওরা। তখন ওরা ক্লাশ নাইন, সেদিনের কথা ইউসুফ বা আশা আজো ভোলেনি, বাদুরির ধারে বিশাল পাম্প হাউসের সামনের চাতালে বসে গপ্প করছিল তিনজনে, ইউসুফ মাঝে মাঝে সাইকেলে চড়ে নানা কারিকুরি দেখাচ্ছিল, হঠাৎ কাদখালি থেকে একজন লোক দৌড়তে দৌড়তে এল, “ফজ্জানা!ফজ্জানা জলদি চল, ফাতিমা গায়ে আগুন দিছে।“
(চলবে)

No comments:

Post a Comment