Friday 8 September 2017

স্বপ্ন #৪


স্বপ্ন দেখলাম, আমি আর দেবশ্রীদি একটা পাথরের এবড়োখেবড়ো বেঞ্চে বসে গল্প করছি। আমার ডান আর দেবশ্রী দির বাঁ পাশেই গভীর অতলান্ত খাদ। খাদের ওপাশে ধাপে ধাপে ঘন সবুজ পাহাড়, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। গোল গোল পাকদণ্ডী  নেমে গেছে সেইসব পাহাড়ের গা বেয়ে। দূরের ঐ পাহাড়ের মাথায় মুকুটের মত ভাসছে পেঁজা তুলোর মত মেঘ। মেঘ গুলি ক্রমশ আমাদেরও ঘিরে ধরছে। দুজনের মাঝখান দিয়ে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে গলে যাচ্ছে ধোঁয়ার মত মেঘ। ঠাণ্ডা ভিজে হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের চুল। আমার পিছনে খাড়াই সবুজ পাহাড় বরাবর পাইন গাছের বন, ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ জড়িয়ে ধরছে তাদেরও। দুষ্টু ভিজে হাওয়ায় ঘনঘন মাথা নাড়াচ্ছে পাইন গাছের বন, অদ্ভূত ফিসফিসানির শব্দ ভেসে আসছে পাইনের বন থেকে। ডি দির (ছোট করে এটাই বলি) পিছনে ঢালু পাকদণ্ডী নেমে গেছে।
কি রোমান্টিক আবহাত্তয়া, আমাদের গল্প আর শেষই হচ্ছে না। সূর্যের আলোর রঙ সোনালী থেকে কমলা হবার পথে। আমাদের হুঁশ নেই।আমাদের উচ্চকিত হাসির আওয়াজ বড় বেমানান এই নিশব্দ পরিবেশে, কিন্তু কি করি? শৌভিক আর ত্রিদিবেশদার সবজান্তা হাবভাব, তুত্তুরী আর উজানের নিত্যনতুন দুষ্টুমি এবং সর্বোপরি, আমাদের নতুন প্রেমিকদ্বয়- ডিদির বিল পুলম্যান আর আমার রিচার্ড ম্যাডেন, উফ্ আমি তো ম্যাড ফর ম্যাডেন।
     হঠাৎ একজন বলে উঠল,“উফ্ তোমাদের এই হাসি আর সহ্য হচ্ছে না। ”চমকে তাকিয়ে দেখি, যিনি বলছেন, তাঁর পরণে বিবর্ণ লুঙ্গি,গায়ে আঁটো তাপ্পি দেওয়া ব্লাউজ। বেশ বয়স্ক, মাথার চুল সব পেকে গেছে। মঙ্গোলিয় মুখশ্রী, দাঁত নেই একটাও। সবথেকে আশ্চর্য হলাম, একটা চোখ নেই। শূণ্য  কোটরের ওপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে একটা কাটা দাগ। একটা ধুসর ঘোলাটে চোখে উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি একা নন, আমাদের আসে পাশে আরো অনেক লোক। জনা বিশ পঁচিশ তো হবেই।  সবাই বয়স্ক, সবাই জোড়াজোড়া। আর আশ্চর্যভাবে কেউ অক্ষত নয়। কারো দুহাত কাটা, কারো পা নেই,চাকা লাগানো চেয়ারে বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছে তার সঙ্গী।  দিকে তাকানো যায়, বাকিদের ক্ষত এত ভয়ানক, দেখলে গায়ে কাঁটা দেবে।
একচক্ষু বৃদ্ধা আবার বললেন,“এখানে কেউ জোরে কথাও বলে না, হাসি কাকে বলে আমরা কবেই ভুলে বসেছি।” ডিদি ক্ষমা চেয়ে বলল,“মাপ করবেন।চল অনিন্দিতা। ” আমিও বেমালুম উঠে দাঁড়ালাম। বেঞ্চের পাশে দুজনের কালো রুকশ্যাক কাঁধে নিয়ে এগোে যাব, মহিলা বললেন,“কোথায় যাবে?” তাই তো। কোথায় যাব? কোথায় যেন থাকার কথা আমাদের কিচ্ছু মনে পড়ছে না। ডিদিরও একই হাল। ভ্যাবলার মত বলল,“জানি না তো। ” সর্বনাশ।রাত নামছে,নির্জন পাহাড়িয়া এলাকা,কোথায় থাকব। আমাদের গাড়ি কোথায়? এলাম কি করে?সবজান্তা বরগুলো গেল কোথায়?
মহিলা দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে বলল,“এস। তবে আমাদের খাবারদাবার খুবই সীমিত। ভালো বিছানাপত্র কিছুই নেই। শুধু আজ রাতটুকু থাকতে দেবো। সন্ধ্যা নামছে, চতুর্দিকে জঙ্গল, তায় বষ্টি নামছে। এদিকে খুব হায়না আর নেকড়ের উৎপাত। ” আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বৃদ্ধাকে নীরবে অনুসরণ করলাম। দেখলাম, বাকি লোকজনও আমাদের সঙ্গেসঙ্গেই আসছে। কি কষ্ট করে একজন আর একজনকে বয়ে আনছে। আমরা একজনকে সাহায্য করতে গেলাম, কিন্তু যাকে হেল্প করতে গেলাম, সে আঁ আঁ আঁ করে  চিৎকার করে উঠল। বেচারা মুখগহ্বর দেখে আঁতকে উঠলাম।  জিভটাই নেই।
যেখানে পৌছলাম, সেটা একটা বড় ভাঙা বাড়ি। এতই ভাঙা, এখানে কি সত্যই কেউ থাকে।
বিরাট হলঘর। দেওয়ালে মান্ধাতার  আমলের ফায়ার প্লেসে গণগণে আগুন ছাড়া কোন আলো নেই। হলঘরে গোল করে অজস্র বিছানা। শতছিন্ন, কাপড়ের পুঁটুলি বললে ভালো হয়। তেলচিটে ভ্যাপসা গন্ধ। একটা ওমনি বিছানা আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। প্রতি বিছানায় একজোড়া বৃদ্ধ দম্পতি। খুব সামান্য নৈশাহারের পর ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুতে যাব, একচক্ষু বৃদ্ধা হাঁ হাঁ করে উঠল। “শোবে না। একদম শোবে না। শুলে আমরা কেউ বাঁচব না। তোমরাও না।  ” সে কি। কিছুই বুঝলাম না।
কি অস্বস্তিকর রাত। তীব্র ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। চোখের পাতা বন্ধ করার উপায় নেই।  বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। কাঠের ছাতে পড়ন্ত জলের ফোঁটার আওয়াজে রীতিমত ভয় লাগছে। যেদিকে চোখ ফেরাই, একদল ঘায়েল বুড়োবুড়ি জেগে বসে আছে, যাদের চোখ অবশিষ্ট  আছে, তাদের চোখের পাতায় ধিকিধিকি জ্বলছে ফায়ার প্লেসের আগুন। ডিদি আর পারছিল না। বললাম, “আমার কাঁধে মাথা রেখে বসেই ঘুমোও। দূরের গুলো বুঝতে পারবে না, আর পাশের বৃদ্ধাকে আমি গল্পে মশগুল রাখছি। ”

বৃদ্ধার দিকে ফিরলাম,“মাসি!” একটা মার্বেলের গুলির মত চোখ আমার দিকে ফিরল।  পাশে ওণার স্বামী, কুঁজো হয়ে কেশে উঠল। “এখানে কেন ঘুমানো নিষেধ মাসি?তোমরা না ঘুমিয়ে কি করে থাকো?”  ©Aninditasblog©Aninditasblog
বৃদ্ধা নিস্প্রিয় স্বরে বলল,“দিনে ঘুমোই। রাতে ঘুমোলে ও আমাদের খুঁজে বার করে ফেলবে। ” কিছুই বুঝলাম না। যত গাঁজাখুরি। ডি দি ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই কথা চালাবার জন্য বললাম,“কে?” কিছুক্ষণ কোন কথা নেই, তারপর বৃদ্ধার স্বামী জবাব দিল,“আমাদের মেয়ে। আমি নিজের হাতে আগুন লাগিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মরলে অন্তত শান্তি পাব। সব কেড়ে নিয়েছে রাক্ষুসী। চোখের সামনে গোটা গাঁকে শেষ করে দিল।  এই জন্যই কি ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছিলাম? কত স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে। যে মেয়ে গোটা গ্রামের গর্ব ছিল, সেই এই হাল করল আমাদের। কেন? কেন? কেন?” কাশির দমকের সাথে বৃদ্ধ দুলতে লাগল,দমদম করে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
বৃদ্ধা আটকাল না। ক্লান্ত রিক্ত স্বরে বলল,“একদিন এল রাক্ষসী। সঙ্গে একদল লোক। অস্ত্রশস্ত্রের  বাহারে চমকে গেলাম আমরা। দৌড়ে গেলাম, আলিঙ্গন করতে, মেয়ে  দূরে সরিয়ে দিল। সে ধর্মান্তরিত হয়েছে। মিশে গেছে সংখ্যাগুরুর সাথে। এবার বদলে ফেলতে চায় আমাদেরও। আমাদের চোখের সামনে আছড়ে ভাঙল আমাদের দেবতার মূর্তি। প্রসাব করে দিল একটা লোক ভাঙা দেবতার গায়ে।ছিঁড়ে টুকরো  টুকরো করে দিল সব পুরাণো বই পত্র। বুড়োবুড়িরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, চিৎকার করলেই মুখে তরবারির ঘা। আমি গালি দিলাম, হারামজাদি তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম? আমার চোখে একটা ছুরি গেঁথে দিল একটা লোক। ওর বাবাকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে সে কি মার। রাক্ষসী বলল, হয় নতুন ধর্ম গ্রহণ করো, নাহলে তোমাদের চোখের সামনে তোমাদের বাচ্ছাদের জবাই করব। ওর বাবা মাটি থেকে চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দে মা। বাচ্ছা গুলোকে ছেড়ে দে। ছেড়ে দে।” বুড়ি এবার হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল।
বুড়ো ধরল,“ ছাড়ল না।  একটা একটা করে পরিবার ধরে ধরে শেষ করল। রয়ে গেলাম শুধু কয়েকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা।  মেয়ে উঁচু সিংহাসন থেকে বলল, ও ইচ্ছা করেই নিজের গাঁয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এসেছে। যাতে আরো ক্ষমতা পেতে পারে, দেশের রাণী হতে চায় আমার মেয়ে।  এই  আধমরা বুড়োবুড়ি গুলোকে গিনিপিগের মত দেখাবে গোটা দেশে।
চোখের সামনে মৃত সন্তানের রক্তাক্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন  দেহ দেখে কার আর বাঁচার ইচ্ছা থাকে? ওদের কারো ছিল না, ওরা মরতে প্রস্তুত ছিল। আমি তাও করজোড়ে রাক্ষসীকে বললাম, আজ রাতটা দে মা।  কাল আমরা সবাই তোর ধর্ম নেব। বিশ্বাস করল মেয়ে। রাতে সে কি মোচ্ছব। আমরা কয়েকজন বিধ্বস্ত পরাজিত বুড়োবুড়ি শোনিত সিক্ত মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি, বুক চাপড়ে কাঁদছি, আর আমাদেরই গৃহ লুন্ঠিত  ভোজ্যদ্রব্য মদ্যে সে কি উল্লাস রাক্ষসী আর তার সহচরদের। ভোরের ঠিক আগে সব থেমে গেল, মদের বোতলের মতই গড়াগড়ি যাচ্ছে সব। আমরা উঠলাম, বিলাস গৃহের দরজা বন্ধ করে দিলাম, বাইরে থেকে।  তারপর আগুনননন----
জ্বলন্ত যতুগৃহ পিছনে ফেলে আমরা পালালাম, বাঁচব বলে। এত কিছুর পর বেঁচে থাকাই হবে আমাদের প্রতিবাদ।  কিন্তু রাক্ষসী মরেও পিছু ছাড়েনি।  যখনই রাতে কেউ ঘুমোয়, রাক্ষসী তার স্বপনে এসে হানা দেয়। এমন ভয়ানক অত্যাচার চালায়, যাতে সে বলতে বাধ্য হয় আমরা কোথায় লুকিয়ে আছি। আর জানতে পারলেই এসে হানা দেয়। পালাতে হয় আবার। কিন্তু সবাই পালাতে পারি না।  কতজনকে যে খেল শয়তানি তার ইয়ত্তা নেই”।
আমার কাঁধে ডিদির মাথা, হঠাৎ ভয়ানক কাঁপতে লাগল। “না- না-না” ডিদির চিৎকারে সবাই আঁতকে উঠল। “ওকি ঘুমিয়ে পড়েছে?” আঁতকে উঠল বৃদ্ধ বৃদ্ধা। হামা দিয়ে এগিয়ে এসে প্রচণ্ড ঝাঁকাতে লাগল, ডিদিকে। “ছেড়ে দে।  ছেড়ে দে ওকে শয়তানি। ওকে ছাড়।” ডিদির মুখে বরফ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল একজন, যার ছিটেয় কেঁপে উঠলাম আমি। ডি দি তাও চোখ খুলছে না। ওরা বলল, “পালাও। ওকে নিয়ে পালাও। যেভাবে পারো পালাও।  আমরা ওর শত্রু।  তোমরা নও। পালালে হয়তো ও তোমাদের ছেড়ে দেবে। ” পালাই? কি করে পালাই। বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার, বৃষ্টি, হায়না, সর্বোপরি কনকনে ঠান্ডা। ডিদিকে চাগিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ওঠো। ওঠো ডিদি।  ওঠো। হঠাৎ ডিদি চোখ খুলল, দুচোখে সাংঘাতিক আতঙ্ক। আঙুল দরজার দিকে দেখিয়ে বলল,“ও এসে গেছে। ” দড়াম করে একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া নিয়ে যে ঢুকল, তার গোটা শরীর পুড়ে ঝলসে কালো। মুখের চামড়া গলে জুড়ে গেছে গলার সঙ্গে। মাথাটা একদিকে বেঁকানো। মাথার চুল আধপোড়া। দুটি গলে যাওয়া চোখ সাক্ষাৎ আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। 
প্রবল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে দেখি, নিজের ঘরেই আছি। ঘর অন্ধকার, এসি চলছে, মৃদু সবুজ রাত আলোয় অদ্ভুত ঘরোয়া উষ্ণতা। শৌভিক ক্লান্ত ঘ্যানঘেনে স্বরে বলছে,“ আবার? তোর এই স্বপ্নের ঠেলায় আমি এবার গৃহত্যাগ  করব মাইরি”। একটু ভালো করে জড়িয়ে ধরলাম বর আর মেয়েকে, স্বপ্নই তো।  সত্যই কি কারো আসার ক্ষমতা আছে।
পরদিন সকালে ডিদির মেসেজ পেয়ে চমকে গেলাম,ডি দি লিখেছে,“ অফিসে এসে ঢুলছি। কালরাতে একদম ঘুম হয়নি। কি সাংঘাতিক ভূতের স্বপ্ন দেখলাম, ভাবলেই ভয় লাগছে। মেয়ে ভূত। চোখ গলা মেয়ে ভূত বাপরে। তুমিও ছিলে স্বপ্নে অনিন্দিতা। ”
©Aninditasblog

No comments:

Post a Comment