Tuesday 3 October 2017

অনির চিকমাগালুরের ডাইরি

অনির চিকমাংলুরের ডাইরি ২৯শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭
পুজো মানেই হাওড়া। পাড়ায় পাড়ায় ছোট বড় মণ্ডপে সপরিবার সুসজ্জিতা মা দুর্গা, ৬৫ডেসিবেলকে কাঁচকলা প্রদর্শন পূর্বক মাইক্রোফোনের  গগনবিদারী চিৎকার, ঝকঝকে পুজো স্পেশাল আলোয় ধুয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট, কাতারে কাতারে মানুষ, ফুচকা,রোল,বিরিয়ানি, আইসক্রীম,ঝালমুড়ির হরির লুট, বন্ধুদের সাথে দেদার আড্ডা আর সর্বোপরি আমার বৃদ্ধ বাবা-মা আর পিসি। এসব ছেড়ে যাওয়া তাও আবার মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিয়েই,যে কি যন্ত্রণাদায়ক,তুত্তুরী তো কান্নাকাটিই জুড়ে দিল। কি করি?কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। শৌভিক স্বয়ং ফিরিয়ে নিয়ে এল আমাদের, অতঃপর চটজলদি ব্যাগ গুছানো, কারণ পরদিন সকাল ৬টা ৫৫এ আমাদের ফ্লাইট।
আবার দেবুরা আর আমরা একসাথে বেড়াতে যাব, এই নিয়ে তৃতীয় বছর। দেবু লেবার সার্ভিসে আমার ব্যাচমেট, এবং অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মূল আইডিয়া যদিও শৌভিকের তবে তাকে বাস্তবে রূপদান করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব  দেবুর। প্লেনের টিকিট কাটা থেকে হোটেল বুক করা সব দেবুই করে,আমরা শুধু এনইএফটি করেই খালাস।
যাই হোক নবমীর দিন ভোর পৌনে চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে, কাকস্নান করে,শৌভিকের নির্দেশানুসারে মুএসলি আর ঠাণ্ডা দুধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা যখন বার হলাম,সারা রাত জেগে ঠাকুর দেখে ক্লান্ত মহানগর তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। নীচে নেমে খেয়াল করলাম,ঘড়ি পড়তে ভুলে গেছি। শৌভিককে করজোড়ে মিনতি করলাম,“চাবিটা দে,তিন মিনিটে ঘড়ি পড়ে নেমে আসব। ” শৌভিক পাত্তাই দিল না। “ঘড়ি পড়িসনি আর ঘড়ি পড়ে কি হবে?সবসময়ই তো হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুরিস। ”
অগত্যা বিনা ঘড়িতেই রওনা দিলাম আরো একবার দক্ষিণ ভারতের উদ্দেশ্যে।
স্পাইস জেটের ফ্লাইট,ব্যাঙ্গালোর পৌছানোর কথা সাড়ে নটা নাগাদ, এদিকে দিন কয়েক ধরেই ব্যাঙ্গালোর ভেসে যাচ্ছে। ব্যাঙ্গালোরের ওপরও দেখলাম থকথকে গাঢ় মেঘ চাঁদোয়া টাঙিয়েছে। প্লেন বেশ কিছুক্ষণ ধরে চক্কর টক্কর মেরেও যখন আমাদের নামাল ঘড়িতে তখন সকাল ৯টা বেজে ১১মিনিট মাত্র। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার পদার্পণ। কলকাতার সাথে একটা ব্যাপারেই বৈপরীত্য চোখে পড়ে, ইন্টারন্যাশানাল টারমিনালে আমার যাবার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু ডোমেস্টিক টারমিনালের টয়লেট অন্তত মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট গুলি অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন।  ভোরের ফ্লাইট হলে প্রতিবারই দেখি একটি টয়লেট বন্ধ এবং অন্যটিতে প্রাণান্ত ভিড়। জলে ভেসে যাওয়া টয়লেট, বদগন্ধযুক্ত। পানীয় জলের জায়গায় ডিসপোসেবল গ্লাস থাকে না এবং চতুর্পাশ এত আবর্জনাময় যে জল খেতে ঘেন্না করবে।
যাই হোক, ব্যাঙ্গালোরে গাড়ি বুক করাই ছিল, দশটার মধ্যে বামালসমেত আমরা যখন গাড়িতে চাপলাম, পেটে ছুঁচোয় পুরোদমে ডনবৈঠক শুরু করেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া শৌভিকের ভোডাফোন দেহ রেখেছে। ড্রাইভারকে বলা হল, আগে প্রাতরাশ , তারপর কোন ভোডাফোন স্টোর দেখে দাঁড় করাতে।
দক্ষিণ ভারতে এলে প্রথম যে সমস্যাটা হয়,তা হল বোধগম্য ভাষায় বার্তালাপ করা। হিন্দি এরা বলে না, আর এদের সাথে ইংরাজিতে বার্তালাপ করতে হলে কাঁদতে হয়। কি যে বোঝে,কি যে বলে ওরাই বোঝে। আমাদের ড্রাইভার দেখলাম নূন্যতম হিন্দি বোঝে। প্রাতরাশের জন্য আমাদের নামাল, আনন্দমহল ভেজ রেস্টুরেন্টে। ভেজ দেখেই সবাই মুখ ভ্যাটকালো,কাল অষ্টমী ছিল, সবাই নিরামিশ খেয়েই কাটিয়েছে, আজ আবার নিরামিষ?পাশেই একটা বিরিয়ানী মহল রয়েছে বটে, তবে শুনশান, টেবিলের ওপর চেয়ারগুলি তুলে লাট লাগানো। আশহত হয়ে নিরামিষ রেস্তরাঁতেই গেলাম। সারাদিন লম্বা ট্যুরের পরিকল্পনা আছে,তাই শৌভিকে হুকুম, ভরপেট প্রাতরাশ সেরে নিতে হবে, পথে কোথাও লাঞ্চ খেতে থামা যাবে না। খামোকা সময় নষ্ট করা যাবে না।
সব বুঝলাম, কিন্তু খাব কি?ইডলি আর ডোসা?কলকাতায় যে ইডলি-ডোসা খেয়ে আমরা তওবা তওবা করি,তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন এখানকার খাবারে পেলাম না। কি ভয়ানক খেতে বাপরে বাপ। আমি আর অন্বেষা অর্থাৎ তুত্তুরীর দেবু মামি যতই ধমকে মেয়েদের খাওয়ানোর চেষ্টা করি না কেন,নিজেদেরই গলা দিয়ে নামছিল নারে বাবা। কুচ্ছিত কদাকার প্রাতরাশ সেরে বমি চেপে,চিকেন প্যাটিস আর চকলেট প্যাস্টি কিনে যখন গাড়িতে উঠলাম ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটার ঘর ছাড়িয়েছে। গন্তব্য শ্রবণবেলগোলা।

অনির চিকমাগালুরের ডাইরি ৩০শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭(পর্ব-২)
ব্যাঙ্গালোর থেকে শ্রবণবেলগোলার দূরত্ব ১৪৪কিলোমিটার। কর্ণাটকের হাসান জেলায় অবস্থিত। এখানেই নাকি চন্দ্রগুপ্ত শেষ বয়সে জৈনধর্ম গ্রহণ করেন অনশনে দেহত্যাগ করেন। বেলগোলা শব্দের অর্থ হল শ্বেতসরোবর পাতি বাংলায় দুধপুকুর। শ্রবণবেলগোলা হল শ্রবণের দুধপুকুর।শ্রবণবেলগোলা যদিও শৌভিকের পরিকল্পিত ট্যুরে ছিল না। ব্যাঙ্গালোর থেকে চিকমাংলুরের পথেও পড়ে না, মাঝে বেঁকে যেতে হয় অনেকটা। কিন্তু একে তো ড্রাইভার বলল,তারওপর আগের বার ব্যাঙ্গালোর এসেছিলাম,কিন্তু শ্রবণবেলগোলা দেখিনি বলে সুকন্যা হায়হায় করেছিল।

১৪৪কিমি রাস্তা,সারাদিনই গাড়িতে কাটবে, আপাতত তা যদিও অত্যন্ত  স্বস্তিকর। গতকাল রাতে চাপা উত্তেজনায় কারোরই ঘুম হয়নি। অন্বেষা তো সারা রাতই জেগেছিল,এবার ঘুমোনোর তাল করলাম । শৌভিক চটজলদি তুত্তুরীকে অ্যাবুমিন খাইয়ে দিল।বমি বন্ধ করার ওষুধ বটে,তবে তুত্তুরীর জন্য ওটা হল ঘুমের ওষুধ। লোকে মদ-গাঁজা খেয়ে নেশা করে, আমার মেয়ে অ্যাবুমিন খেয়ে নেশা করে। মাঝে মাঝেই বাবার কাছে বায়না ধরে,“একটা অ্যাবুমিন দাও না, খেয়ে ঘুমোব। ”

ঝাঁ চকচকে রাস্তা এবং কয়েক কিলোমিটার ছাড়াছাড়াই টোল প্লাজা। কর্ণাটকে এসে একটা ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলাম,যে রাস্তাগুলিতে টোল প্লাজা আছে, শুধু সেগুলিই ভালো। বাকি রাস্তাগুলিকে আমাদের বাঁকুড়া-পুরুলিয়াও এক ডজন গোল দিতে পারে।  যখন  শ্রবণবেলগোলায় পৌছলাম,ঘড়ির কাঁটা বেলা একটা ছাড়িয়ে দেড়টার দিকে দৌড়চ্ছে। তুত্তুরী তখনও গভীর ঘুমে অচেতন। পুটপুট অর্থাৎ দেবুর মেয়েও অ্যাবুমিন না খেয়েই তুত্তুরীর সাথে পাল্লা দিচ্ছে। আর ঐ রোদে খালি পায়ে এত উঁচুতে চড়তে অন্বেষা মোটেই উৎসুক ছিল না। সুতরাং  তিনজনেই রওনা দিলাম।
ক্ষয়প্রাপ্ত পাহাড়, নাঃ আসলে পাহাড় বললে পাহাড় খেপে যেতে পারে, ঢিপি। একনজর দেখলে আমাদের অতি পরিচিত খণ্ডগিরি বলে বোধ হবে। সামনে বিশাল সাদা কারুকার্য  খচিত গেট,গেট টপকালেই জুতো খুলে রাখতে হয়। একটা প্লাস্টিকের বাজার ব্যাগে ভরে জুতো গুলি রেখে দেয় এরা। একাধিক হকার মোজা বিক্রি করছে,ইতস্ততঃ করে কিনেই ফেললাম তিনজোড়া মোজা।
উঠতে শুরু করার পর,প্রথমে মনে হল, এ আর এমন কি? দেবু কোথায় পড়েছিল হাজারখানা সিঁড়ি,পাশ দিয়ে কারা বলতে বলতে নামল ৬১৩টা। সংখ্যা যাই হোক, বেশ চাপ। একে মাথার ওপর গনগনে সূর্য,পায়ে নাইলনের হড়হড়ে মোজা।
সরু, দুজোড়া খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে, একটা দিয়ে পুণ্যার্থীরা উঠছে, অন্যটা দিয়ে নামছে। ওঠার সিঁড়ির বাঁপাশে আরও একটা নির্মিয়মান সিঁড়ি আপাতত বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দুজোড়া সিঁড়ির মাঝখানে ঢালু এবড়ো খেবড়ো পাহাড়, আদিতে বোধহয় ঐ দিয়েই ওঠানামা করা হত, জনা কয়েক নগ্ন জৈন সন্ন্যাসী এবং সাদা শাড়িতে আপাদমস্তক আবৃত মাতাজী বেতো পায়ে ঐ পথেই নামল। এভাবে চোখের সামনে নগ্ন সন্ন্যাসী জীবনে দেখিনি। সকলেই বয়স্ক,এক হাতে কমণ্ডুলের মত একটা পাত্র,অপর হাতে ময়ূরের পেখম গোল করে বেঁধে ইয়া মোটকা একটা ঝাড়ুর মত বস্তু। গোটা সিঁড়ি দেবুতে আর আমাতে হাঁপাতে হাঁপাতে রিসার্চ করতে করতে উঠলাম ঐটি কি কাজে লাগে। দেবুর মতে ঠাণ্ডা লাগলে প্রাইভেট পার্ট চাপা দেয়,অথবা মহিলা দেখলেও চাপা দিতে পারে। যদিও চতুর্দিকে প্রচুর মহিলা ছিল সেই মুহূর্তে। একটা জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম এরা পুরুষ পুণ্যার্থীদের প্রণাম দিব্যি নেয়,মহিলা হলে লাফিয়ে সরে যায়,সে যত দূর থেকেই প্রণাম করা হোক না কেন।
উঠতে উঠতে দূরে নীচে দুধপুকুরটিকেও প্রত্যক্ষ করলাম। দক্ষিণ ভারতের মন্দির গুলিতে যে ধরণের বড় চৌকোণা বাঁধানো চৌবাচ্চা থাকে, ওমনি। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে চারদিক দিয়ে। চার কোণে চারটি দুয়ার। জলের রঙ শ্যাওলা সবুজ। বেশ অপরিচ্ছন্ন।
হাঁফাতে হাঁফাতে ওপরে উঠলাম,প্রায় ১০০০ফুট তো হবেই। উপরে একটি বড় মন্দির আছে,তাতে মহাবীর পূ্র্ববর্তী তিনজন তীর্থঙ্করের মূর্তি আছে। বেশ অন্ধকার ভিতরটা,ততোধিক ফাঁকা। আধো অন্ধকারে তিনটি মূর্তি একই রকম লাগল। মন্দিরের বাইরে ঢালু পাহাড়, ব্যাঙ্গালোর আসেপাশে সবকটা পাহাড়ই এই রকম। ঢালু এবং মসৃণ। ঢালু পাহাড়ের গায়ে কিছু শিলাশিপিআছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু এক কলম। প্রতিটি লিপি কাঁচের শিট দিয়ে ঢাকা,যাতে কেউ ভুল করে পদার্পন না করে বসে।
তিন তীর্থঙ্করের পাশ দিয়ে লম্বা সিঁড়ি উঠে গেছে, তার ওপর ৫৮ফুট উঁচু গোমতেশ্বরের মূর্তি। পৃথিবীর দীর্ঘতম মনোলিথিক স্ট্যাচু। প্রতি ১২ বছর অন্তর দেশ বিদেশ থেকে জৈন পুণ্যার্থীরা এখানে এসে জমায়েত হয় এবং গোমতেশ্বরের মূর্তিকে দুধ,হলুদ বাটা, শ্বেত চন্দন,মধু, চালগুঁড়ো,আখের রস ইত্যাদি দিয়ে ধোয়া হয় এবং সোনা রূপার ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। এই উৎসবের নাম “মহামস্তকাভিষেক”। পরবর্তী মহামস্তকাভিষেক আছে ২০১৮এ। যাবেন নাকি? ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি,জৈনরা কিন্তু গোমতেশ্বরকে বলে “বাহুবলি। ”
শ্রবণবেলগোলা থেকে যখন  নামলাম,ঘড়ির কাঁটা আড়াইটে ছাড়িয়েছে। পরবর্তী গন্তব্য হ্যালেবিড বা হ্যালেবিডু তারপর বেলুরের চিন্নাকেশভা মন্দির ঘুরে তারপর চিকমাংলুর বা চিকম্যাঙ্গালুর। ফিসফিসিয়ে শৌভিককে জিজ্ঞাসা করলাম,“সব হবে তো আজকে?” শৌভিক আশ্বস্ত করল, ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে আছি,এখানে সূর্য অনেক দেরীতে অস্ত যায়।
হ্যালেবিড যখন পৌছলাম,পাঁচটা বেজে গেছে,সূর্যদেব পাটে না বসলেও আলো কিন্তু বেশ কম।

অনির চিকমাগালুরের ডাইরি ১লা অক্টোবর ২০১৭ (পর্ব-৩)
হ্যালেবিডের হয়সলেশ্বরা মন্দিরে যখন পৌছলাম, ঘড়িতে তখন পাঁচটা। আকাশে সূর্য থাকলেও তার সেই তেজ নেই। নাই থাক, কি অপরূপ সুন্দর মন্দির,চোখ জুড়িয়ে গেল।এটি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিবমন্দির।  বিশাল পরিচর্চিত ঘণ সবুজ বাগানের মধ্যে উঁচু বেদীর ওপর মন্দির, কথিত আছে বেলুরের চেন্নাকেশভা মন্দিরের সাথে তীব্র রেষারেষি করে এই মন্দির গড়ে তোলা হয়।যদিও মন্দির গড়ে ওঠে স্থানীয় সম্পত্তিশালী  শৈব জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ এবং অর্থে কিন্তু নামকরণ হয়  তৎকালীন হয়সল বংশীয় রাজা বিষ্ণুবর্ধণ হয়সলেশ্বরের নামানুসারে।  
কালচে সবুজ সিস্ট নামক পাথর দিয়ে তৈরি মন্দিরটি আসলে গড়ে উঠেছে দুটি বিশাল শিব মন্দিরকে নিয়ে, একটি শিবের নাম হয়সলেশ্বর বলাইবাহুল্য রাজার নামানুযায়ী এবং অপরটির নাম শান্তালেশ্বর, রাণী শান্তালা দেবীর নামানুসারে। দুটি মন্দিরের সামনে বিশাল কারুকার্য খচিত মণ্ডপ। এই ধরণের স্থাপত্যরীতিকে নাকি দ্বিকূট বিমান বলা হয়। 

একে নবমী তায় শনিবার বলে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। জুতো খুলে বেদীর ওপর উঠতে হয়। অবাক হয়ে দেখলাম দর্শনার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি হিজাব পড়া সুন্দরী মেয়েও আছে। চমকে গেলাম বিশ্বাস করুন। একজন আস্তিক হিন্দু হিসাবে আমার মাঝে মাঝে খুব লজ্জা করে, আমরা স্বচ্ছন্দে ইমামবাড়ায় ঢুকতে পারি, ব্যাণ্ডেল চার্চে ঢুকতে পারি। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু মন্দিরেই অহিন্দু দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। এখানে শুধু ঐ কয়েকটি মেয়েই নয়, আরো কয়েকজন বোরখা পরা মহিলাকেও দেখলাম দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, বেদীর ওপরও উঠছে, ঈশ্বরের পবিত্রতা তাতে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হচ্ছে না। 
দুটি মন্দিরের সামনের মণ্ডপে দুটি বিশাল কৃষ্ণকায় নন্দীর মূর্তি। মন্দিরের মূখ্য প্রবেশধারের দুই পাশে সুন্দরী লাস্যময়ী যক্ষ্মিণী মূর্তি আপনাকে স্বাগত জানাবে। ভিতরে বিশাল শিবলিঙ্গ।তবে ভিতরটা বড় বেশী অন্ধকার, পাথুরে মেঝে এত মসৃণ যেন তেল ফেলেছে কেউ। মাত্র একঘন্টায় কতটুকুই বা দেখতে পেলাম। মনই ভরল না। 
বেলুরের চিন্নাকেশভা মন্দির দেখা আপাতত স্থগিত। পৌছতে পৌছতেই অন্ধকার নেমে আসবে। চিকমাগালুর কফি গ্রুভ রিসর্ট থেকেও দেবুকে ফোন করে জানাল আজ না যেতে কারণ ছটার পর মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। গাঢ় অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ১২০কিমি বেগে দৌড়তে লাগল গাড়ি। জিপিএস এতক্ষণ রাস্তা প্রদর্শন করলেও চিকমাগালুর শহর ছাড়াতেই ঝুপ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।  গতকাল রাত থেকে এই উত্তেজনা আর পরিশ্রম আর নিতে পারছিল না শরীর। অন্বেষা এবং আমি পর্যায়ক্রমে দেবুর মুণ্ডপাত করতে লাগলাম। চিকমাগালুর শহর ছাড়িয়ে বহুদূর চলে এলাম,  ফাঁকা অন্ধকার কফি আর গোল মরিচ গাছের জঙ্গল আর উপুর্যান্তে বৃষ্টি কফি গ্রুভ রিসর্টের নাম ও নেই আর গন্ধও নেই। রাস্তায় কোন বোর্ডও নেই আর একটা লোকও নেই। অতিকষ্টে ঘসটে ঘসটে যখন আমরা পৌছলাম, তখনও বৃষ্টি ধরেনি।বিশাল এলাকা জুড়ে ফাঁকা ফাঁকা নয়নাভিরাম কটেজ। কেয়ারী করা ফুলের বাগান, নকল ঝর্ণা আর সুদৃশ্য সুইমিং পুল, ব্যাডমিন্টন  কোর্ট, বাচ্ছাদের পার্ক। ঝকঝকে রিসেপশন আর রেস্তরাঁ, এমন প্রত্যন্ত  জায়গা যেখানে কারো মোবাইলে কোন টাওয়ার নেই,নেট তো দূরের কথা সেখানে এমন ঝাঁ চকচকে রিসর্ট কল্পনার অতীত। কটেজে ঢুকে মন ভরে গেল। বিশাল বিলাসবহুল ঘর, কাঠের চৌকোনো ছাদ, দুপাশে নিজস্ব বারন্দা, যার একটা উল্টো দিকের জঙ্গলের দিকে খোলে। বারন্দায় সোফা, ইজি চেয়ার কি নেই। আর বাথরুম?বাথটাব আর হেয়ার ড্রায়ার বাদে যেকোন পাঁচতারা হোটেলের মতই। তবে রিশেপসন রেস্তোরাঁ যত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হোক, ঘর গুলি ততোটাই আলো আঁধারির রূপকথা। শুনলাম ইচ্ছা করেই নাকি জোরালো আলো লাগানো হয়নি,যাতে রাত্রিবেলা জঙ্গলের অসীম প্রশান্তি শহুরে আলোর চকচকানিতে বিঘ্নিত না হয়। 

গরমাগরম কফি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে, একটু রেস্ট নিয়েই রাত নটা নাগাদ ডিনার। এখানে বোধহয় রাত দশটা সাড়ে দশটার পর কেউ জেগে থাকে না। আমরাও বেশি ক্ষণ জাগতে পারব বলে মনে হয় না, কাল সকালে ওঠার কোন তাড়া নেই, বারোটা নাগাদ বেরোব, হিরেকোলা লেক আর মুথুডি ফরেস্ট সাফারিতে। আপাতত শুভরাত্রি। আজ নবমী, আনন্দময়ীর শেষ রাত কলকাতায়, এখানে বিন্দুমাত্র তাপোত্তাপ নেই কারোর। লোকজনই বা কোথায়? শুধু আসার পথে দেখলাম কিছু বাস আর গাড়ির সামনে কলা গাছ আর পার্পল রঙের গুঁড়িগুঁড়ি ফুলের মালা ঝুলছে। একই দেশ অথচ কত বৈচিত্র তাই না?
(চলবে)


অনির চিকমাগালুরের ডাইরি ২রা অক্টোবর  ২০১৭(পর্ব-৪)

আজ ঘুম থেকে ওঠার কোন তাড়া নেই, তবু কেন জানি না ঘুমটা ভেঙে গেল। সারারাত অঝোরে ঝরার পর বৃষ্টি একটু থেমেছে। যে কোন ভাল হোটেলের মত ঘরেই ইলেকট্রিক কেটলি, কাপ,টিব্যাগ,কফি-দুধ আর চিনির পাউচ দেওয়া ছিল, চাইলেই বানিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু চিকমাগালুরে এসে কে আর ফিল্টার্ড কফি খায়?
আটটা থেকেই প্রাতরাশ শুরু হয়ে যায়। সাড়ে আটটার মধ্যে না গেলে ওরা ফোন করে বিনীত ভাবে জানায়, গরম গরম প্রাতরাশ তৈরি, শুধু আপনারই প্রতীক্ষা। প্রাতরাশ কমপ্লিমেন্টারি। এই কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট গুলি সাধারণত এলাহী হয়। এখানেও আয়োজন কিছু কম ছিল না। থরে থরে সাজানো ছিল, হোয়াইট ব্রেড, তার পাশেই গরম টোস্টার, আপনারই প্রতীক্ষারত। তার পাশে মাঝারি বাটিতে ডুমো ডুমো করে কেটে রাখা মাখন, তার পাশের বাটিতে লাল রঙের জ্যাম, তার পাশে বড় জুসের কন্টেনার উল্টে রাখা আছে। একদিন ফুটির জুস থাকত তো পরের দিন তরমুজের জুস। পাশেই ছোট কাঁচের গ্লাস সাজানো থাকত, গ্লাস তুলুন, উল্টানো কন্টেনারের কল খুলুন আর গ্লাসে ভরে নিন, হাল্কা কমলা বা লাল রঙের জুস। এছাড়া ফল থাকত, একদিন তরমুজ  তো আর একদিন ডুমো ডুমো করে কাটা সাংঘাতিক মিষ্টি পাকা পেঁপে। 
এবার বাঁদিকে ঘুরে যান,লম্বা সাদা কাপড় ঢাকা টেবিলে স্টীলের বড় ক্যাসারোলে রাখা আছে গরমাগরম দোসা, যা দেখতে অনেকটা সরুচাকলি বা রুটির মত। পাশে বিশাল পোর্সেলিনের বাটিতে সাদা নারকেলের চাটনী। তার পাশে বিশাল ট্রেতে সাম্বার, তার পাশে আটার ফুলকো লুচি বা পুরী, তার পাশে ডাল বা ভাজি,তারপাশে কলাইয়ের ডালের মুচমুচে বড়া। আবার বাঁদিকে ঘুরে যান এবার পাবেন ভেজ নুডলস্ আর কারি রাইস না হলে উপমা। তারপর সিদ্ধ ডিম, অবশেষে চা বা কফি আপনি যা চান, ঢেলে নিন। 
এত খাবার দেখলে আমি ঘাবড়ে যাই। বেশীর ভাগ দিনই ফল,জুস,ডিম সিদ্ধ আর উপমা বা ভেজ নুডলস্ খেতাম তুত্তুরী আর আমি। এরা ভেজ নুডলসেও কারি পাতা আর সর্ষে ফোড়ন দেয়। যাই হোক ব্রেকফাস্ট করে বাচ্ছা গুলো গেল ট্রাম্পুলিনে চড়ে নাচতে। সুইমিং পুল দেখলে আমার আর তুত্তুরীর আর সবুর সয় না। আর এত সুন্দর ঘণ নীল পুল দেখলে তো আর কথাই নেই।  সাধারণ আমরা যেখানেই যাই, আর কিছু নি বা না নি, সাঁতারের পোশাকগুলি প্যাক করতে ভুলি না। এবারও তুত্তুরীর পোশাক নেওয়া হয়েছে কিন্তু তাড়াহুড়ো  করে আমারটা আনতে ভুলে গেছি। অনেক হোটেল যেমন মেফেয়ার গোপালপুরে ওরা কস্টিউম ভাড়া দেয়। কিন্তু এদের সে ব্যবস্থা নেই। কাছে পিঠে কোন মল বা মার্কেটও নেই,কি হবে?দেবু বলল,“ভাবিস না। এদের ওসব নিয়ম নেই যে সুইমিং কস্টিউম না পড়লে জলে নামা যাবে না। এমনি জামাকাপড় পরেই নামা যাবে। ”সে তো যাবে, কিন্তু যা ঠাণ্ডা জল। পা ডুবিয়েই সাঁতার কাটার আশা ত্যাগ করলাম, আমি যাও বা সামলে নেব,তুত্তুরী নামলে নিউমোনিয়া অবধারিত। 
বেলা বারোটা নাগাদ বেরোলাম সবাই মিলে, পথে কোথাও লাঞ্চ পাওয়া যায় না, তাই গ্রীলড্ চিকেন স্যাণ্ডউয়িচ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই প্যাক করে দিতে বলা হয়েছিল। এরা চিকেন স্যাণ্ডউয়িচ পারেনি, তাই ভেজ স্যাণ্ডউয়িচই প্যাক করে দিল। 
প্রথম গন্তব্য হিরেকোলালে লেক। এটা আদিতে শৌভিকের পরিকল্পিত ট্যুরে ছিল না। কিন্তু ড্রাইভার বলল, চিকমাগালুর শহর থেকে মাত্র ১০কিমি দূরে অপার্থিব সুন্দর এই মিষ্টি জলের হ্রদ। গোটা চিকমাগালুর শহরে নাকি জল সরবরাহ করা হয় এই হ্রদটি থেকে। 
ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে পাণ্ডববর্জিত টলটলে জলের লেক,সেদিন যদিও বেশ ভালোই জনসমাগম ছিল, কিন্তু তাতেও পরিবেশের গভীর প্রশান্তি বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হয়নি। লেকের জলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শনশনে হাওয়া। যদিও ঠাণ্ডা সেভাবে আর লাগছে না। বেশ ভাল,কিন্তু সত্যি বলছি স্বপ্নময় উমিয়াম লেক বা স্বচ্ছ সবুজ আয়নার মত লেক ডাওকি ছাড়ুন আমাদের পুরুলিয়ার বড়ন্তী ও একে স্বচ্ছন্দে দশ গোল দিতে পারে।

আবার গড়ালো গাড়ির চাকা, এবার মুথুডি ফরেস্ট সাফারি। দুবার নাকি সাফারি হয়, একবার সকাল ৭টায় আর একবার বিকাল ৩টায়। আমরা সোয়া দুটোর মধ্যেই পৌছে গেলাম,পথে লেখা আছে আস্তে চালান, আওয়াজ করবেন না। বাঘকে রাস্তা ছেড়ে দিন। যাঃ বাবা!খামোকা বাঘ রাস্তায় নেমে হাঁটতে যাবেই বা কেন?এলিফ্যান্ট করিডর দেখেছি অনেক জায়গায়, বাঘেরও করিডর লাগে নাকি? একটা জ্বলজ্যান্ত বাঘ রাস্তা দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গীতে হেলে দুলে গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভূতুড়ে না?তুত্তুরী এবং পুটপুট প্রবল ক্যাঁওম্যাও জুড়েদিল, বাঘে যদি ধরে? সাথে তাল মেলালো অন্বেষাও। আশ্বস্ত করার জন্য বললাম,যদি বাঘমামার সাথে দেখাও হয়,নির্ঘাত আমাকেই আগে উদরস্থ  করার তাল করবে। শৌভিককে জিজ্ঞাসা করলাম,“হ্যাঁ গো আমাকে বাঘ ধরলে তুমি বাঘের সঙ্গে হাতাহাতি করবে তো?” শৌভিক অত্যন্ত উদাসী ভাবে বলল,“নাঃ। আমি বরং একটা দুরন্ত ছবি তুলে দেব। তারপর ফেসবুকে আপলোড করে লিখব- লাস্ট মোমেন্টস্ অব অনিন্দিতা।তারপর দেখবি কত যে স্যাড ইমোজির বন্যা বয়ে যাবে। ” দেবু পাশ থেকে ফিচকের মত বলল,“হ্যাঁ সবাই লিখবে-রিপ। আর আই পি অনিন্দিতা। ” শৌভিক আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বিজ্ঞের মত বলল, “তরপর চারদিন বাদে লিখব, মরেনি। হাসপাতালে আছে। ওজন একটু কমেছে। ” প্রবল হাসির জলতরঙ্গে চমকে উঠল নিস্তব্ধ জঙ্গল। 
(চলবে)

1 comment:

  1. সুন্দর লিখেছেন। সহজ সরল‌। ঠিক যেন মুখের কথা শুনছি।

    ReplyDelete