Saturday 14 October 2017

চাটুজ্জে বাড়ির ইতিবৃত্ত


চাটুজ্জে বাড়ির ইতিবৃত্ত ২
কথিত আছে সুদূর অতীতে দিল্লীর বাদশাহ, গঙ্গার পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূল বরাবর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাট্টা তুলে দেন বর্ধমানের মহারাজাদের হাতে।যাঁরা কালক্রমে আবার কয়েকটি অঞ্চলের পাট্টা তুলে দেন বেহালা সাবর্ণ রায়চোধুরীর পরিবারের হাতে। এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পরবর্তী কালে তিনটি গ্রাম ইজারা নিয়ে কলকাতা মহানগরীর পত্তন করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতার গুরুত্ব তখন ক্রমবর্ধমান, কলকাতাকে অদুর ভবিষ্যতে ইস্টার্ন বৃটিশ এম্পায়ারের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার তোড়জোর শুরু হল পুরোদমে। সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আরো ৫৫টি গ্রাম নতুন করে ইজারা নিল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছ থেকে। যার মধ্যে ৭টি গ্রাম যথা দক্ষিণ ব্যাঁটরা, উত্তর ব্যাঁটরা, কাসুন্দিয়া, শুলকা (শালকিয়া),বেতড় ইত্যাদি ছিল গঙ্গার পশ্চিম উপকুল বরাবর।এই দক্ষিণ ব্যাঁটরাতেই আমাদের বাড়ি।
ভারতবর্ষে রেল লাইন পাতা শুরু হবার সাথেই শুরু হয়ে গেল এক অঘোষিত শিল্পবিপ্লব।সহযোগী শিল্প হিসাবে গঙ্গা তীরবর্তী দুই ব্যাঁটরাতেই গড়ে উঠতে লাগল একের পর এক লোহার কারখানা।ক্রমশ চড়তে থাকল জমির দাম। কিন্তু দক্ষিণ ব্যাঁটরার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জোড়া পুকুর, চার কামরা বাড়ি সহ সাড়ে সাত বিঘা আবাদী জমির কেবল কোন খরিদ্দার জুটছিল না। এটিকে বলা হত “ভূতের ভিটে”।

প্রপিতামহ কালীপদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেটিয়াবুরুজের ওয়াটগঞ্জ জুটমিলের অফিস মাস্টার। উনবিংশ শতাব্দী শেষের দিক, কিন্তু তখনও নেটিভদের ম্যানজার স্টেটাস দেওয়া হত না। প্রপিতামহ ছিলেন অত্যন্ত ডাকাবুকো নিরীশ্বরবাদী ব্যক্তি। উনি ঐ পরিত্যক্ত “ভূতের ভিটে” কিনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। স্থানীয় জমিদার কেশবচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ঠাকুর দালানে প্রতি শনিবার স্থানীয় মাতব্বরদের(বাবার ভাষায় নিওবুর্জোয়া) আসর বসত। সেখানেই ভূতের ভিটের তৎকালীন মালিক জনৈক চৌধুরী মাত্র ১৬০১তঙ্কায়( ৪কিস্তিতে প্রদেয়) এই সম্পত্তি প্রপিতামহের নামে লিখে দিলেন।
প্রপিতামহ বাস্তুভিটের যথাবিহিত সংস্কারসাধন করে, নিজের সদ্য যৌবনা স্ত্রী, দুই শিশু পুত্র,এক শিশু কন্যা এবং মাতা গোলাপসুন্দরী দেবী সহ নতুন গৃহে স্থিতু হলেন। 
কর্মব্যস্ততার জন্য প্রপিতামহ নিজে থাকতে পারতেন না, প্রায়শঃ শনিবার সন্ধ্যাবেলা কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে গঙ্গা পার হয়ে শিবপুর বোটানিকাল গার্ডেনে নামতেন এবং সেখান থেকে ঝাঁজুর ঘোড়ার গাড়ি চড়ে যখন বাড়ি ঢুকতেন তখন গভীর রাত।এই বিশাল বাস্তু সহ পরিবারেরর দেখাশোনা করার জন্য ৪জন গৃহপরিচারিকা এবং ৬জন অবাঙালি পরিচারক রেখেও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রন্থ থাকতেন প্রপিতামহ।
মিলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হ্যামিলটন সাহেবের অত্যন্ত  স্নেহভাজন ছিলেন প্রপিতামহ। হ্যামিলটন সাহেব ওণার দুশ্চিন্তা দূরীকরণ হেতু একটি উপহার দিলেন। ছয় সপ্তাহের একটি বিলায়েতী কুকুর বাচ্ছা। নাম-জ্যাক।
জ্যাকের দেখাশোনা করার জন্য এক নতুন পরিচারক রাখা হয়, নাম হরিয়া। হরিয়ার উপযুক্ত পরিচর্যায় মাত্র ৬মাসেই জ্যাক হয়ে উঠল একটি হাতির বাচ্ছার সমতুল বিশাল এবং বলশালী। সন্ধ্যের পর হরিয়া জ্যাককে ছেড়ে দিত খোলা জমিতে। সারা রাত যথেচ্ছ বন্যপ্রাণী শিকার তথা ভক্ষণ করে জ্যাক হয়ে উঠেছিল পুরোপুরি মাংসাশী। “ভূতের ভিটের”ভূতেরাও সম্ভবত জ্যাককে ভয় পেত।
এ হেন জ্যাককে হঠাৎ একদিন সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। কারণ অজ্ঞাত। প্রপিতামহীর মতে কোন ঈর্ষাপরায়ণ প্রতিবেশী নির্ঘাত বিষাক্ত মাংসখণ্ড খাইয়ে হত্যা করে জ্যাককে।
পূর্বদিকের জোড়া পুকুরের উল্টো দিকে ছিল ২০০বছরের পুরোণো এক অতিকায় বট গাছ।শোকাতুর প্রপিতামহ যথোচিত সমাদরে ঐ বট গাছের নীচে জ্যাককে সমাহিত করার উদ্যোগ নেন। বট গাছের তলার মাটি খোঁড়া শুরু হয়, অচীরেই খনন কার্য থমকে যায়, আবিষ্কৃত হয় মাটির নীচে একটি পাকা দেওয়াল। প্রপিতামহ ইতস্ততঃ করে হুকুম দেন ঐ দেওয়াল ভেঙে ফেলার। দেওয়াল কিছুটা ভাঙা মাত্রই খননকারীরা খনন বন্ধ করে আতঙ্কে উপরে উঠে আসে। দেওয়ালের ওপাশে রয়েছে একটি  বিশাল গুপ্ত কক্ষ। আর সেই গুপ্তকক্ষ জুড়ে পড়ে আছে এক বিশাল নরকঙ্কাল। যার দুই হাত এবং দুই পা লোহার শিকল দিয়ে দেওয়ালের সাথে বাঁধা। ঐ ভয়ানক দৃশ্য দেখা মাত্র প্রপিতামহ নির্দেশ দেন যত দ্রুত সম্ভব যেন ঐ দেওয়াল পুন: গেঁথে দেওয়া হয়। ঐ দেওয়ালের সামনে আর একটি গর্ত খুঁড়ে জ্যাককে কবর দেওয়া হয়।
প্রপিতামহীর মতে ঐ কবর ভাঙার পর থেকেই আমাদের পরিবারে শুরু হয় নানা বিপর্যয়। হতভাগ্য  ব্যক্তিটি কে ছিল তা আজো এক রহস্য। কানাঘুষো  যে কবর ভাঙার অব্যবহিত পর থেকেই নাকি পূব দিকের পুকুর সংলগ্ন খালি আবাদী জমিতে এক অতিকায়  আলখাল্লা পরিহিত ছায়া পুরুষকে এক বিশাল কুকুর সহ মাঝে মাঝেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। দুজনেই ছিল মূর্তিমান অমঙ্গল। দেখেছেন কি ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আপনার পরিবারের কেউ না কেউ মারা যাবেই। বাবার সবথেকে ছোট পিসিমা পিকোরাণী ছিল তার প্রথম শিকার। শুধু আমাদের নয় আসেপাশের তৎকালীন প্রতিবেশীরাও ভয়ে সন্ধ্যের পর ঐ দিকের জানলা বন্ধ করে রাখত।
মূল সম্পত্তি কবেই তিরিশটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বিক্রি হয়ে গেছে। জনসমাকীর্ণ পাড়া,বৈদ্যুতিন আলোতে উজ্জ্বল পথঘাট। বহু বছর সেই অশরীরীর দর্শন পায়নি কেউ। কিন্তু গভীর রাতে জ্যাক মাঝে মধ্যে ডাকে। রক্তজল করা সে ডাক।পাড়ার কুকুরদের শোরগোল মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। গোটা পাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গুমরে ওঠে এক রক্তজল করা কুকুরের ডাক। কয়েক বার মাত্র, তারপরই সব চুপ। বেশ কিছুক্ষণ কাটলে আকুল কান্না জোড়ে পাড়ার সারমেয়কূল। তীব্র অসহায় ভয়ার্ত সে কান্না।যে বাড়ির সামনে জমায়েৎ হয়ে কান্না জোড়ে কুকুরগুলি ঠিক সেই বাড়ির কেউ না কেউ ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ---
আর একটা কথা বলে শেষ করব, মানবেন কি না মানবেন আপনার ব্যাপার,আমার কাজ গল্প বলা, ঐ বিশাল দেহী পুরুষের রহস্য সম্ভবত মৃত্যুর পূর্বে প্রপিতামহ আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। উনি বলে যান প্রপিতামহীকে, যিনি আমৃত্যু এই রহস্য বুকে চেপে রাখেন পরিবারের মঙ্গলার্থে। মৃত্যুশয্যায় প্রবল বিকারের সময় উনি বলে যান আমার ঠাকুমাকে। ঠাকুমাও তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বলে গিয়েছিল ছোট কাকুকে। ছোট কাকু ঠিক করেছিল গল্পের আকারে ঘটনাটি লিখবে। সেই মত বাবা এবং জেঠুর কাছে নানা খবরাখবরও যাচাই করে নেয়। সবিস্তারে কিছু বলে না, শুধু বলে লিখলে জানতে পারবি। যেরাতে ওণার লেখা শুরু করার কথা ছিল, আচমকা সেই রাতেই স্বাস্থ্যের ভয়াবহ অবনতি ঘটে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ও অবকাশ পাওয়া যায়নি।
শুভ ভূত চতুর্দশী।
চাটুজ্জে বাড়ির ইতিবৃত্ত ৯ই অক্টোবর ২০১৭
(১)
আমাদের হাওড়ার বাস্তুভিটা সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত বিঘা। সবই প্রপিতামহের মেহনত তথা দূরদৃষ্টির ফল। ঐ দূরদৃষ্টির কণামাত্র আমার দাদুর ছিল না। দাদু ছিলেন অনেকটাই আমার মত আবেগসর্বস্ব, বাস্তব বুদ্ধিহীন। প্রপিতামহ নরমপন্থী  কংগ্রেসের মোটামুটি ছোটখাটো নেতা গোছের ছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, সে যুগের ক্ষমতাবান রাজনৈতিক  দলের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে অত বড় সম্পত্তি রাখা যেত না। সম্পত্তি মানে শুধু বাস্তুভিটা নয়, আরো বহু জমি জায়গা,সুন্দরবনে বিশাল আবাদযোগ্য জমি, অতিকায় বজরা ইত্যাদি। যখন প্রপিতামহ সম্পত্তির পরিমাণ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করতে ব্যস্ত ছিলেন,আমার দাদু তখন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজ বিতারনের পরিকল্পনায় মত্ত। প্রপিতামহ জানতেন, কিন্তু আমাদের পরিবারে কখনই কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হত না।
ফলতঃ ঠাকুরদাকে হিংস্র ছাত্র আন্দোলন করার অপরাধে কলকাতার সাধের কলেজ থেকে বিতাড়ন করা হল।
কুছ পরোয়া নেহি। প্রপিতামহ তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলেন, মেদিনীপুর কলেজে। ও বাবা!ধন্যি ছেলে। পড়াশোনা চুলোয় গেল, অস্ত্র আমদানী করার জন্য জাহাজের খোলে লুকিয়ে পালাল সোজা  ব্রহ্মদেশ। মান্দালয় জেলে ঘানি ঘুরিয়েই জীবন কাটত হয়তো, যদি না প্রপিতামহের কাছে খবরটা পৌছাত। বংশের জেষ্ঠ্য পুত্র, কতই বা বয়স?১৭-১৯বড় জোর, কিন্তু ছেলেকে মুচলেকা  ফিরিয়ে আনতে হলে যে কালাপানি পেরোতে হবে? ধোপা- নাপিত বন্ধ, মেয়েদের কেউ বিয়ে করবে না, একঘরে হয়ে পচে মরতে হবে।
প্রপিতামহ ছিলেন আদ্যন্ত নাস্তিক।  নিজেকে চার্বাক পন্হী বলে দাবী করতেন। সেই যে ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। সমাজের কঠোর অনুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে  ড্যাং ড্যাং করে কালাপানি পেরোলেন। বন্ধ হল ধোপা নাপিত। টিকিওয়ালারা বিধান দিলেন গোময় ভক্ষণ আর দানের মাধ্যমে আবার সমাজে প্রবেশের অনুমতি পেতে পারেন।
ছোঃ। গোবর খাবে কালিপদ চাটুজ্জে?দেখা যাক। স্বয়ং জেষ্ঠ্য পুত্রের জন্য বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে হাজির হলেন  হাওড়ার প্রবল প্রতিপত্তিশালী প্রগতীশীল নেতা গঙ্গাধর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। ওণার একমাত্র কন্যা নাম স্বর্ণলতা। দেশবন্ধু থেকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ অবধি গঙ্গাধর বাবুর বাড়ি কে আসেন না?
গঙ্গাধর বাবু ছিলেন সে যুগে রিপন কলেজ অর্থাৎ বর্তমান সুরেন্দ্র নাথ কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তারওপর নামী হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ওণাকে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী বলত দীনদরিদ্র মানুষজন। ওণার মৃত্যুর পর বাঁশতলা শ্মশানের সামনের রাস্তাটির নামই রাখা হয়েছিল গঙ্গাধর মুখার্জী রোড, এই অন্ধবিশ্বাসে, যে  চাইলে মৃত মানুষকেও জীবিত করতে পারেন। ওণার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন স্বর্গীয় রাধানাথ শিকদারের  কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীনাথ শিকদারের কন্যা। আহিড়িটোলার বিখ্যাত শিকদার বাড়ির মেয়ে। কাদম্বরী দেবী সেনেট হলে বসে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং লর্ড কার্জনের হাত থেকে সার্টিফিকেট পান। সেই সার্টিফিকেট বাঁধিয়ে রাখা ছিল মুখোপাধ্যায় বাড়িতে।
গঙ্গাধর বাবুর ছিল সনাতনী টিকিওয়ালা ধর্মের ধ্বজাধারীদের ওপর অখণ্ড ক্রোধ। কারণ হল ওণার পিতা ঈশ্বর বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়।
বেণীমাধব বাবুর সম্পর্কে শোনা একটা গল্প আজ না বলে পারছি না। বেণী বাবু গিয়েছিলেন গঙ্গায় স্নান করতে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন ডাচ এবং একজন দিনেমার সাহেবের মধ্যে চুলোচুলি  বেঁধে যায়। ব্যাপারটা আদালত অবধি গড়ায়, ঝগড়ার অন্যতম সাক্ষী হিসেবে বেণীমাধব বাবুকে কাঠগড়ায় উঠতে হয়।বৃটিশ জজ জানতে চান,“বাবু তুমি জানো এদের কি নিয়ে মারামারি হয়েছে?” বেণীমাধব বাবু তখন বলতে থাকেন, “ ধর্মাবতার ডাচটি এই বলেছে এবং তার জবাবে দিনেমার সাহেব এই বলেন----_”। উনি সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন ভাষার খিস্তিখেউড় ন্যাজামুড়ো সমেত আদালতে উগড়ে দেন। না ডাচটি প্রতিবাদ করে না দিনেমার। জজ সাহেব চমৎকৃত হয়ে জানতে চান,“ বাবু তুমি এদের ভাষা জানো?” বেণীবাবু ঘাড় নেড়ে জানান, না উনি ঐ ট্যাঁশ ভাষা জানেন, না বলতে পারেন। ওণার সামনে যে বার্তালাপ হয়েছে উনি শুধু সেটুকুই বিবৃত করেছেন মাত্র।

এহেন শ্রুতিধর বেণী বাবু শেষ বয়সে ধর্মের মোহে পড়েন। পুজো আচ্ছা সাধনার উৎপাত বাড়তে থাকে। স্ত্রীকেও বলেন, সংসার অসাড়। আমার সাথে সাধনায় ব্রতী হও। সাধাসিধে গ্রাম্য অশিক্ষিত স্ত্রী নিজ সন্তান সংসার ফেলে স্বামীর ধর্মানুরাগী হতে অস্বীকৃত হন। তখন ক্রোধে বেণীমাধব বাবু সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাহির বাটিকেই নিজের সাধন ক্ষেত্র বানিয়ে তোলেন এবং দুজন ভৈরবীও রাখেন।

মায়ের এই অসম্মান তথা মনোকষ্টই গঙ্গাধর বাবুর বড় হবার মূলধন ছিল। ফলতঃ সনাতন ধর্মের প্রতি ওণার বিরাগ সর্বজনজ্ঞাত ছিল।
এমতবস্থায় প্রপিতামহের পাঠানো বিবাহের প্রস্তাব উনি লুফে নেন। আরো একটি গল্প ছিল। ঠাকুমা অর্থাৎ স্বর্ণলতা দেবীর গায়ের রঙ ছিল ঘণশ্যাম। বর্ণবিদ্বেষ ব্যাপারটি বাঙালীর জীবনে নতুন না। সে যুগেও তের বছর বয়সেও সুযোগ্য মনোমত পাত্র পাননি গঙ্গাধর বাবু। বলতে ভুলে গেছি দাদুর গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতা।
বিয়ে হল। তেরো বছরের ধেড়ে মেয়ে মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এল। আর একঘরে করে রাখে কে? দাদুর বড় বোনের বিয়ে হল এক বিশাল ধনী বাঙালি বিচারকের কনিষ্ঠ পুত্রের সাথে। অভিজাত্যের যাবতীয় কুফল অচীরেই দৃশ্যমান হল। মদ আর রেসের মাঠেই খেয়ে নিল বড় জামাইকে। আদরের বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন রাণী। রাণী যেদিন বিধবা হয়ে তিন মেয়ের হাত ধরে ফিরে এল, বাপের দেওয়া একটা গয়নাও আর আস্ত নেই। সব গিলেছে রেসের ঘোড়া।
রাণুর দুঃখ নাকি অন্য কিছু জানি না মাত্র ৩৯বছর বয়সে দেহত্যাগ করলেন  কালীপদ চট্টোপাধ্যায়। ফেলে রেখে গেলেন বিশাল বাড়ি, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, ধন সম্পত্তি। ঠাকুরদার বয়স তখন ২১ মাত্র। 
চোখের নিমেষে হু হু করে নিঃশেষ হয়ে গেল সব সম্পত্তি।মামলা আর দেনার দায়ে বিক্রি করতে হল বিঘার পর বিঘা জমি জলের দরে। বাস্তুসংলগ্ন জমিও বেচে দেওয়া হল। রয়ে গেল সাড়ে সাত কাটা জমি সমেত বিশাল দোতলা বাড়ি। আগের তুলনায় যদিও তা অতি ক্ষুদ্র। কিন্তু আমাদের চোখে বিশাল।
দোতলা বাড়ির উত্তর পশ্চিম কোণের ঘরটি কোন এককালে ছিল প্রপিতামহ এবং প্রপিতামহীর। পরবর্তী  কালে ঠাকুরদা ঠাকুমা থাকতেন। বাবামার বিয়ের পর ঐ ঘরটিই বরাদ্দ হয় ওদের জন্য। আমার ছোট বেলাতেও আসে পাশে তেমন কোন দোতলা বাড়ি ছিল না। ফলে উত্তরের তিনটে আর পশ্চিমের একটা বিশাল খড়খড়িওলা জানলা  অবারিত ছিল রোদ, ঝড় আর বৃষ্টির জন্য। বর্ষা বরাবরই আমার প্রিয় ঋতু।
সে বর্ষা, বর্ষাই নয়, যা আপনাকে স্মৃতিচারণে বাধ্য না করে। আজ যেমন খালি মনে হচ্ছে সেই ছোট্ট বেলার বর্ষার কথা। বাবার গায়ে লেপ্টে গল্প শোনা, মাথার ওপর বিশাল ডিসি পাখা ঘুরতে ঘুরতে আচমকা ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। বাবা ওমনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত,“যাঃ।  আজ রাতের জন্য নিশ্চিন্ত। ” বাইরে তখন ঝরঝর বাদল ধারা, আকাশের রঙ ময়ূরকন্ঠী  কালো, ঝিলিক দিয়ে উঠল বিজলি, শনশন করে মাথা নাড়াল বৃদ্ধ পেয়ারা গাছ।ওপাশ থেকে যোগ্য সঙ্গত করল যমজ বেল আর যজ্ঞি ডুমুর গাছ। একতলার দালানে ঝটপটিয়ে উঠল জেঠিমার পোষা তথা নিজের হাতে ধরা একগুচ্ছ টিয়া পাখি। বন্ধ কাঁচপাল্লার বাইরে  খোলা জানলার খড়খড়িতে এসে বলল একটা আখাম্বা ভিজে কাক। কুচকুচে গোল চোখে দেখার চেষ্টা করল আমাদের, দক্ষিণে বিশাল লম্বা দালান, দালানের দিকের জানলা দিয়ে টুক্ করে উঁকি মেরে গেল মেজ পিসি। আহা বড় ভালবাসে ঝুনুকে গো। সেই কোন দুধের শিশুকে ফেলে যখন ঝুনুর মা অফিস চলে যেত, কে বুকে পিঠে করে বড় করেছে? আর ঝুনু যে মিটমিটে শয়তান, কোথায় খাটের নীচে বসে দেশলাই জ্বালছে, নয়তো বাবার গোঁফ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে মায়ের ছাপা শাড়ি কেটে পুতুলের শাড়ি বানাচ্ছে। উফ্ কি ঠ্যাঙান ঠেঙিয়েছিল ঝুনুর মা সেবারে। যদিও আজ বাবা আছে,  তবুও মানুষ করার টান বড় টান বাপু, তোমরা বুঝবে না। আমরা কিন্তু কিছুই খেয়াল করছি না,তখন বড় ব্যস্ত, ঘর ভর্তি পিতৃপুরুষগণ, আর তাদের হাজারো রসালো গল্প। যার কতটা বাস্তব আর ই কতটা পরাবাস্তব সে নিয়ে কে মাথা ঘামায় মশাই। আমার বাবা যদি একবার গল্প বলতে শুরু করে, বিশ্বাস করুন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়, বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা।ঠিক যেমন এই মুহূর্তে পথের জ্যামে আটকে হারিয়ে যাচ্ছি ক্রমেই নিজের ছোটবেলায়। সাধে কি বলি বর্ষা যদি  নস্টালজিকই না করে তুলতে পারে, সে বর্ষা বর্ষাই নয়।

No comments:

Post a Comment