Thursday 5 October 2017

চোরা পূর্ণিমা


আজ কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো। শোভাবাজারের চট্টরাজ পরিবারে বিশাল ধুমধাম করে পুজো হয়। চট্টরাজদের বিশাল পরিবার। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীতে গমগম করে বাড়ি। এই প্রজন্মের বড় বউ অদিতি ডাকসাইটে রূপসী। লাল পাড় গরদ, মানানসই সোনার গয়নায় ঝলমলাচ্ছে, তার মধ্যে অদিতির গলার বিশাল সীতাহারে সকলের চোখ আটকে যাচ্ছে। কি অসাধারণ ডিজাইন। সাবেকী গয়না বোঝাই যায়। অনেক মহিলাই লোলুপ দৃষ্টিতে নেড়ে দেখছে,এ ব্যাপারে অদিতি অত্যন্ত উদার। জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে “ঠাকুমার হার গো। ওণাকে ওণার শাশুড়ী দিয়েছিলেন। এখন ভাইবউয়ের সম্পত্তি।  এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঐ আব্দার করল, পড়তেই হবে। আমার তো বেশ ভয় লাগছে,পরের জিনিস বাবা। ” অদিতির বাপের বাড়ি নিউ আলিপুর, ওরা বিশাল ধনী এবং অভিজাত পরিবার।
শ্যামলা, এ বাড়ির মেজ বউ পিছন ফিরে পুজোর জোগাড় করতে করতে মুখ ভ্যাঙালো। অদিতি মোটেই এত উদার নয়। বিয়ে হওয়া ইস্তক শ্যামলার পিছনে লেগে আছে। শ্যামলার নামের মতই গাত্রবর্ণ। বাবা জুটমিলের বড় বাবু ছিল। জুট মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর মায়ের সব গয়না বিক্রি করে দুবেলা পেট আর দুই বোনের পড়াশোনা চলেছে। সময়মত শ্যামলা প্রাইমারি টিচারের চাকরীটা না পেলে আর বেচার মতও কিছু থাকত না। আন্দুলের মেয়ে শ্যামলার সাথে এবাড়ির মেজ ছেলে শুভাশিসের প্রেমের বিয়ে। শ্যামলারা জাতেও বামুন না। সোজা কথায় অদিতির যা যা আছে শ্যামলার তার কিছুই নেই। এমনকি অদিতির বর নামি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর হোমরাচোমরা অফিসার আর শ্যামলার বর ছাপোসা পুলিশের সাবইন্সপেক্টর।
এত কিছু থাকা সত্ত্বেও অদিতির যদি একটু মানসিক উদারতাও থাকত।
শ্যামলার সব কিছুতে শুধু খুঁত ধরেই ক্ষান্ত  হয় না অদিতি সেই নিয়ে শাশুড়ি খুড়শাশুড়ি ননদদের সাথে হাসাহাসি করে। প্রতিটা অনুষ্ঠানে শ্যামলার সাজপোশাক নিয়ে তাচ্ছল্যপূর্ণ মন্তব্য করে। যেমন আজই সবার সামনে বলল,“একটা ভালো শাড়িও কি পড়তে নেই আজকের দিনে?” অথচ এই লালপাড় হলুদ তাঁতের শাড়িটা শ্যামলার কছে যে পরম মূল্যবান সেটা অদিতি ভালোই জানে। শ্যামলার গরীব বাপ ওকে পুজোয় দিয়েছে এটা। শ্যামলারই বেতনের পয়সায় ওদের সংসার চলে, তবু তার মধ্যে থেকেই কিছু টাকা বাঁচিয়ে আন্দুল বাজারের আনন্দমহল বস্ত্রালয় থেকে এই শাড়িটা কিনে বাবা ওকে দিয়েছিল শ্যামলার চোখ উপছে পড়েছিল অশ্রুজল। পুজোয় অদিতির বাপের বাড়ির মত তত্ত্ব আসেনি বলেও শ্যামলাকে উপহাস শুনতে হয়েছিল।
এসব তো ছাড়ুন,অদিতি শ্যামলাকে চোর বদনাম দিতেও ছাড়েনি। ভাইবউয়ের একটা ডিজাইনার শাড়ি অদিতি বাপের বাড়ি থেকে এনেছিল বরের অফিসের পার্টিতে পরবে বলে। সেটা সাবেকী আলনায় রেখে স্নান করতে ঢুকেছিল, বেরিয়ে দেখে নেই। শ্যামলা সবে স্কুল থেকে ফিরে মুখহাত ধুয়ে খাবার নিয়ে বসেছিল, অদিতি হাউসকোট জড়িয়ে ডাইনিং রুমে এসে সে কি চিৎকার। কে নিয়েছে ওর দামী শাড়ি, সে যেন এখুনি স্বীকার করে, না হলে অদিতি সবার ঘর সার্চ করবে। আর ধরতে পারলে---
শ্যামলার গলায় খাবার আটকে গিয়েছিল।কি শাড়ি, কত দাম কিছুই জানে না শ্যামলা। একটু বেশী কথা বলে, এক কাপড়ে বিয়ে হয়ে এসেছে, কোনদিন নিজের বাপের বাড়ির অবস্থা লুকোয়নি। তাই বলে চোর?বাড়িতে সেই সময় কোন কাজের লোকও ছিল না। অদিতি নিশ্চয় শ্বশুর শাশুড়ী খুড়শ্বশুর,খুড়শাশুড়ী বা দেওর ননদদের বলেনি। এবাড়িতে নতুন লোক তো একটাই। টপটপ করে ঝরে পড়ছিল চোখের নোনতা জল। কেউ প্রতিবাদও করল না। শুধু অদিতির বর বলল,“কি ছেলেমানুষি হচ্ছে অদিতি। ভালো করে খুঁজে দেখেছো?তুমি বাড়ির লোকের ঘর সার্চ করতে পারো না।”
শাড়িটা কোথায় পাওয়া গিয়েছিল জানেন?আলনার পিছনে। হড়হড়ে শাড়ি নির্ঘাত হড়কে পিছনে পড়ে গিয়েছিল। অদিতি কিন্তু কোনদিন সরি বলেনি শ্যামলাকে।
শ্যামলা একমনে পুজোর যোগাড় করে চলেছে, ঠাকুরমশাই এলেন বলে। শাশুড়ি মা অদিতিকে চাপা স্বরে বললেন,“অদিতি হারটা হয় খুলে এসো,নয়তো গায়ে চাপা দাও। এত লোকের ভিড়, কে কাকে খবর দেবে। তোমার জন্য সবার বিপদ হবে।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও দোতলায় উঠে গেল অদিতি।
পুজো শুরু হয়েছে, ঠাকুরঘর ভিড়ে ভিড়াক্কার। অদিতি যথারীতি শ্যামলাকে সরিয়ে ঠাকুরমশাই এর পাশে জায়গা করে নিয়েছে। মৃন্ময়ী লক্ষ্মীর সামনে চিন্ময়ী লক্ষ্মী। বড় বউদির সাথে সেলফির জোয়ার বইছে দেওর ননদদের মধ্যে। পিসতুতো ননদ তো বলেই দিল, “প্রাচী দেশাইয়ের মত লাগছে বউদি তোমায়। ”শ্যামলার ওপর নির্দেশ হয়েছে আরেক ঠাকুরমশাইয়ের তদারক করার,অর্থাৎ হেঁসেলে গিয়ে দেখতে হবে, খাবার কতদূর রেডি হয়েছে। মোটামুটি সাড়ে আটটা নটা থেকেই ব্যাচ বসবে।
রাঁধুনী ঠাকুরের কাছে যাবার পথ,  দোতলার সিঁড়ির সামনে দিয়েই যেতে হয়। টুক করে দোতলায় উঠে গেল শ্যামলা। অদিতির ঘরে তালা দেওয়া। যবে থেকে শুভাশিস আর শ্যামলা পাশের ঘরে থাকতে শুরু করেছে অদিতি কোথাও গেলেই ঘরে চাবি মারে। শুধু শ্যামলা ছাড়া এতবড় চট্টরাজ পরিবারের কারো কখনও মনে হয়না তা আদৌ অশোভন। টুক করে বুক থেকে বার করল ডুপ্লিকেট চাবি। তক্কে তক্কেই ছিল শ্যামলা,বিনা দোষে চোর বদনাম দেবার মাস দুই তিন পর একদিন সুযোগ বুঝে চাবির ছাপ তুলে নিয়েছিল।
বুকের ভিতর ড্রাম পিটছে কেউ। যদি কেউ উঠে আসে এই মুহূর্তে চিরদিনের মত চট্টরাজ পরিবার থেকে বিতাড়িত হবে শ্যামলা।ভিতরে ঢুকে টুক করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। জানলা দিয়ে আসা অাবছা আলোকে হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে হাজির হল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আলতো হাতে টানল ড্রয়ার। এই তো জ্বলজ্বল করছে ভারী সীতাহার।
ছাতের ওভারহেড ট্যাঙ্কে টুপ করে ডুবে গেল হারটা। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্র। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ট্যাঙ্কের জলে চাঁদ আর শ্যামলার প্রতিচ্ছবি মিলেমিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।  আশৈশব শুনে এসেছে কোজাগরী পূর্ণিমা হল চোরা পূর্ণিমা। এদিন কিছু চুরি করতে হয়। জীবনে কোনদিন কিছু চুরি করেনি শ্যামলা, আজও করল কি? মুখ বুজে অপবাদ সহন করাও তো পাপ?
রাধুনী বামুন ঠাকুরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাঁপাতে হাঁপাতে শ্যামলার মুখে হাল্কা হাসি খেলে গেল,মনে মনে বলল“দিদিভাই আজ প্লিজ আমার ঘরটা সার্চ করো কিন্তু। ”
©Anindita's Blog

No comments:

Post a Comment