Sunday 8 October 2017

অনির ডাইরি October -November 2017

অনির ডাইরি ২৪শে নভেম্বর ২০১৭
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল গাড়িটা, আনমনে  পরা শীতের কলকাতা দেখছিলাম। কেমন যেন মিষ্টি ঝিম্ ধরানো একটা আমেজ আসছিল, ফুরফুরে একটা অবসাদ গভীর নিদ্রার মত গ্রাস করছিল,কিন্তু ব্রেকের ঠেলায় গেল সব আমেজ চটকে। তাকিয়ে দেখি একদল স্কুলের মেয়ে, হইচই করতে করতে পুলকারে উঠছে। কোন নামী স্কুলের ছাত্রী, হয় স্কুল থেকেই সিনেমা দেখাতে এনেছিল অথবা স্কুল পালিয়ে এসেছে সবকটা। সদ্য কৈশোরের চৌকাট পেরোনো প্রাণোচ্ছল মেয়েগুলোকে দেখে হঠাৎ করে নিজের ফেলে আসা মেয়েবেলার জন্য মনটা হুহু করে উঠল। আমরাও তো এমনি ছিলাম, বেশীদিন আগের কথা তো নয়--
আমাদের ছোটবেলার হাওড়া ছিল অনেকটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পে বর্ণিত শহর গুলির মত। অবাঙালি অনুপ্রবেশ এতটা তীব্র ছিল না। গোটা মধ্য হাওড়া জুড়ে তখন আট-আটটা সিনেমা হল গমগম করে চলছে। হাওড়া ময়দানে ছিল বঙ্গবাসী। কদমতলা এলাকায় শ্রীরূপা আর নবরূপম, নেতাজী সুভাষ রোডে যোগমায়া, শ্যামাশ্রী আর পার্বতী, আর বেলিলিয়াস রোডে পুষ্পশ্রী আর শান্তি। জ্যাঠাইমার ছিল সাংঘাতিক সিনেমা দেখার নেশা।৬০এর দশক থেকে ৯০এর দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত হেন বাংলা বা হিন্দি সিনেমা রিলিজ করেনি যা জ্যাঠাইমার দেখা নয়। আমাদের ছোটবেলায় দূরদর্শনে কোন সিনেমা দিলেই জ্যাঠাইমা বলে দিত, এতে কে আছে আর গল্প কি। সংসারের কাজ গুটিয়ে উর্ধবশ্বাসে দৌড়ত সিনেমা দেখতে,একবার তো দুপায়ে দু ধরণের চপ্পল পরেই দৌড়েছিল।
আমার জেঠতুতো দিদি, আমরা ডাকি দিদিভাই বলে,আমরা দুই বোন রুণু আর ঝুনু। আমি যেমন শান্তশিষ্ট ছিলাম দিদিভাই ছিল ঠিক তেমনি দুদ্ধর্ষ বিচ্ছু। ছোট্ট মেয়েকে দুপুরে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে চুপিচুপি জ্যাঠাইমা বেরোত সিনেমা দেখতে, ব্যস্ ওমনি ঘুম ভেঙে,  দিদিভাই দৌড়ত মায়ের পিছন পিছন। ঠাকুমা এবং পিসিরাও পিছন পিছন দৌড়ত ওকে ধরে আনতে। একবার তো চাড্ডি পরেই মোড়ের মাথা অবধি দৌড়েছিল মাকে খুঁজতে। সেবার ঠাকুমা এমন তুলকালাম করেছিল, যে অন্য মহিলা হলে বোধহয় নাকে কানে খৎ দিত আর জীবনে সিনেমা দেখতে যাব না বাপ্ অনেক হয়েছে। যেমন আমার বাবা মা একবারই আমায় ফেলে ইভনিং শো এ সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, অঞ্জন চৌধুরীর শত্রু। আমি এমন কান্নাকাটি  জুড়েছিলাম, ঠাকুমা সাথে যোগ্য সঙ্গত করল, ব্যস সারা জীবনের মত দোহে সিনেমা দেখতে যাওয়াই ছেড়ে দিল বাবা মা। কিন্তু জ্যাঠাইমাকে দমায় কে?সিনেমা দেখার এমন দুর্দম মোহ, দিদিভাইকে নিয়েই সিনেমা দেখতে যাওয়া শুরু করল জ্যাঠাইমা। একবার জ্যাঠাইমা,পিসি আর দিদিভাই কি একটা হিন্দি সিনেমা দেখতে গেছে, যাতে বড়বড় অক্ষরে “এ” সার্টিফিকেট জ্বলজ্বল করছে। তৎকালীন হিন্দি সিনেমার “এ” মানে নির্ঘাত কোন বর্ষার রাতে দুটো ফুল জুড়ে টুড়ে যায়।  যাই হোক দিদিভাইকে নিয়ে ওরা ঢুকতে যাবে, পুলিশ আটকালো, বাচ্ছা নিয়ে ঢোকা যাবে না। জ্যাঠাইমা পিসি অনুনয় বিনয় করবে বলে প্রস্তুত, তার আগেই দিদিভাই লেঙচে খানিকটা  লম্বা হয়ে বলল,“না গো পুলিশ কাকু। আমায় দেখতে ছোট আসলে আমার বয়স অনেক বেশী। ১৭-১৮-১৯ বছর বয়স আমার। ” আসল বয়স কোনমতেই পাঁচের বেশী ছিল না। পুলিশটা হাসি চেপে মাথায় গাঁট্টা মেরে বলেছিল,“চুপ কর। ডেঁপো মেয়ে কোথাকার।”
এতে একটা লাভ হয়েছিল,বেশ কিছুদিন পুলিশে ধরবে বলে সিনেমা দেখতে যায়নি দিদিভাই।
আমাদের ছোট বেলায় সবথেকে বেশী সিনেমা দেখেছি পার্বতীতে। ছোট কাকুর বন্ধু গোপাল কাকু পার্বতীতে কাজ করতেন। সম্ভবত স্পুল চালাতেন। তখন বাচ্ছাদের নানা বিদেশী সিনেমা আসত, বাবা মায়ের হাত ধরে রিক্সা করে নাইট শোয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার স্মৃতি আজো ও টাটকা। সিনেমা দেখার আগে তলার ভিজে ছোলা,সিদ্ধ আলু, শশা,পেঁয়াজ,তেঁতুল জল আর লঙ্কা কুচি দেওয়া ছোলা কাবলীর স্বাদ ছিল স্বর্গীয়। কাঠের চামচে করে খেতে হত, কিছুটা খেতে না খেতেই তেঁতুল জলে ভিজে ঠোঙাটা যেত ছিঁড়ে। তখন হাত লাগানো ছাড়া উপায় থাকত না।
একটু বড় হতে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়নকে জ্যাঠাইমাই নিয়ে যেত সিনেমা দেখাতে। ততোদিনে দিদিভাই সুখে সংসার করছে। দিদিভাই চলে যাবার পর যে শূণ্যতা জন্মেছিল জ্যাঠাইমার জীবনে আমাদের আঁকড়ে তা ভূলে থাকার চেষ্টা করত জ্যাঠাইমা।কখনও নবরূপম কখনও বা যোগমায়াতে দুপুরের শোয়ে মূলতঃ বাংলা বাচ্ছাদের ছবি যেমন মহাপীঠ তারাপীঠ,দাদু নাতি হাতি,রাজা বিক্রমাদিত্য এই ধরণের ছবি দেখতে যাওয়া হত।
বড় মাসির সাথে শ্রীরূপাতে গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখতে যাওয়ার কথা আলাদা ভাবে মনে আছে। জীবনে প্রথম বার ভূতের সিনেমা তথা ভূতের নেত্য দেখেও ভয় পাইনি। সময় বদলাচ্ছিল। ধীরে ধীরে ভিসিপি ভিসিআর ঢুকছিল বাঙালীর সংসারে কিন্তু আমাদের বাড়িতে সিনেমা মানেই হলে গিয়ে দেখা -। এক এক করে কবে থেকে যেন বন্ধ হতে লাগল সিনেমা হল গুলো।আমাদের স্কুলের কাছেই ছিল নভরূপম্।  রোজ আমাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে পিসি একবার জিজ্ঞাসা করত,কি সিনেমা চলছে, একদিন হঠাৎ দেখলাম ফাঁকা গেটে বিশাল তালা ঝুলছে। ক্রমে ক্রমে হানা বাড়ি হয়ে গেল এককালীন গমগম করা সিনেমা হল। তারপর একদিন দেখি আবার গমগমিয়ে উঠেছে নবরূপম্। চলছে ভাঙচুর। সিনেমা হল ভেঙে বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি উঠবে। বন্ধ হয়ে গেল শ্রীরূপাও। যোগমায়া কবে যে তৎকালীন ক্ষমতাশীল দলের পার্টি অফিস হয়ে গেল বঝতেই পারলাম না। বঙ্গবাসী চলত বটে কিন্তু যারা যেত তাদের পাশে ভদ্রবাড়ির পুরুষরা বসতেই ডরাতো,মেয়েরা তো কোন ছার। জ্যাঠাইমার মুখ ক্রমেই শুকিয়ে আসতে লাগল।সামগ্রিক ভাবে বাংলা এবং হিন্দি সিনেমার মানও এই সময় এত অধঃপতিত  হয়েছিল যে কেউই তেমন আর সিনেমা দেখতে যেতে চাইত না বলেই আমার ধারণা ছিল। অবশ্য গুরুদক্ষিণা আর বেদের মেয়ে জোসনা গমগম করে চলেছিল। গুরুদক্ষিণা আমরাও দেখতে গেছিলাম, বেদের মেয়েকে যদিও দেখার সাহস কারো ছিল না।
আশির দশকের শেষে জেঠু রিটায়ার করল। তারপর আর সেভাবে সিনেমা দেখতে যাবার অবকাশ বা ইচ্ছা জেঠিমার ছিল না। এরপর সিনেমা দেখা বলতে জুরাসিক পার্ক। এবার জেঠুর সাথে। মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। হঠাৎ করে আবার হলিউডের সিনেমা এল হাওড়ার হলে। কোন হল মনে নেই। সম্ভবত পার্বতীই হবে। তারপর ইউনিভার্সাল সোলজার এবং ট্রু লাইজ। তিনটেই জেঠুর সাথে। জেঠুর আর আমার টিম যখন জমজমাট হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সিনেমা দেখা। কেন কে জানে? মনে হয় জেমি লি কার্টিজের সিডাকটিভ নাচটাই দায়ী ছিল। জেঠু আর বলত না,চল দেখে আসি। এরপর পড়াশোনার চাপ বাড়তে লাগল। দূরদর্শন জিন্দাবাদ। টিভিতেই ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক, ম্যায়নে প্যার কিয়া দেখা।
অভিভাবকহীন হয়ে প্রথম সিনেমা দেখা দীপা মেহতার ফায়ার। নীপা আর আমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম দেখবই। অফিসে ফোন করে জানালাম বাবাকে, মায়ের অফিসে ফোন করার সাহস পাইনি যদিও। দুপুরের শো ছিল। সম্ভবতঃ পুষ্পশ্রীতে দেখা। সন্ধ্যা বেলায় মায়ের সে কি মন খারাপ। এত অল্পবয়সে আমাদের বাড়ির কোন মেয়ে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে যায়নি। সেই তো শুরু। হাওড়ার হল গুলো একের পর এক বন্ধ হতে লাগল,ফলে আমাদেরও গঙ্গা পেরোনো শুরু। আবার নতুন করে গাঁটছড়া বাঁধা হলিউডের সাথে।  মেট্রো,গ্লোব,নিউ এম্পায়ার টপকে নন্দন নলবন ঝিলমিল বারবার কিন্তু সে অন্য গল্প।
অনির ডাইরি ১২ই নভেম্বর ২০১৭
সেদিন তার সাথে আলাপ হল জানেন। সেই যে “তারে আমি চোখে দেখিনি,তার অনেক গল্প শুনেছি”, কিন্তু এত গল্প শুনেও তেমন ভালবাসতে পেরেছিলাম কই?আসলে কি জানেন আমার না বোহেমিয়ান ছেলেদের একদম পছন্দ নয়, কারনটা বোধহয় নিছক ঈর্ষা।  আপনি কখনও কোন মহিলা চরিত্রের কথা শুনেছেন যার কোন কাজ নেই কম্ম নেই,  দিন নেই রাত নেই টো টো করে ঘুরে বেড়ায়? রাস্তার পাগলী হলে অবশ্য আলাদা।
ইনি তো আবার খালি পায়ে হাঁটেন, ভাবা যায়? এমন একখান পাঞ্জাবি পরেন যাতে কোন পকেট থাকে না, কারণ? উনি টাকা পয়সা সঙ্গে রাখেন না!মাঝে মাঝেই ভবিষ্যৎ বাণী করে সকলকে চমকে দেন, অসম্ভব সব সমস্যা টুসকি মেরে সমাধান করে দেন। পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি পরে কপর্দকশূন্য হয়ে উনি ঢাকার পথে পথে ঘুরে বেড়ান। নাম? হিমু। যদিও হুমায়ুন আহমেদ সাহেবের সৃষ্ট জনপ্রিয়তম চরিত্র। 
সেদিন হঠাৎ আলাপ মিসির আলির মাধ্যমে। মন্দ লাগল না, গল্পের নাম “হিমুর দ্বিতীয় প্রহর”, আমি যদিও মিসির আলির জন্যই ব্যগ্র ছিলাম, আর এত স্বল্প আলাপে কতটুকুই বা জানা যায়, দীর্ঘ আলাপ যে অবশ্যম্ভাবী তা বেশ বুঝতে পারছি।
সেদিন আরো একজনের গল্প শুনলাম, নাম মেরী হার্ট। সময়কাল উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগ, স্থান নিউ হেভেন, কানেক্টিকাট, আমেরিকা। শৈশবে পিতৃমাতৃহীন মেরী তার পিসির কাছেই মানুষ। হঠাৎ একদিন কি যে হল, সেলাই করতে করতে আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেরী,বুড়ি পিসি দৌড়ে এল, ডাক্তার বদ্যিও করা হল কিন্তু মেরীর হৃদপিণ্ড আর কিছুতেই সচল হল না। পরের দিন প্রভাতে, গ্রামের চার্চে সমাধিস্থ করা হল মেরীকে। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলল বুড়ি পিসি, সারা রাত ঘুমাতে পারল না, ভোরের দিকে যখন অজান্তে জুড়ে গেল চোখের পাতা পিসি এক ভয়াবহ স্বপ্ন দেখল,মাটির ছফুট নীচে গাঢ় অন্ধকারে কফিনের মধ্যে ছটফট করছে মেরী, বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, নখ দিয়ে কফিনের ডালা আঁচড়ে আঁচড়ে হাতগুলো রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত  করে ফেলছে মেরী কিন্তু বেরোতে পারছে না। ভোরের আলো ফুটতেই গাঁয়ের লোকের দরজায় দরজায় মাথা কুটতে লাগল পিসি, “ওগো একটি বার কবর খুঁড়ে দেখো, আমার মেরী বেঁচে আছে বোধহয়। ” প্রসঙ্গত তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা আজকের তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ পিছিয়ে, বড় বড় শহরে কেউ মার গেছে কিনা দেখার জন্য তাকে অন্যান্য মৃতদেহের সঙ্গে ভাগাড়ে ফেলে রাখা হত, যদি পচন ধরে তবে কবরে দেওয়া হবে। সবাই যে জীবিত থাকত তা তো না, মৃতদেহের দেহের ভয়ানক পচা গন্ধ ঢাকার জন্য লাগানো হত সুগন্ধী ফুলের গাছ। ভাবুন ফুলের সাথে পচা শবের গন্ধের মিশ্রণ কি ভয়ানক হতে পারে। আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হত, যেমন পায়ের নখের ভিতরের নরম মাংসে সুঁই ফোটানো, ধারালো ক্ষুর দিয়ে ফালি ফালি করে পায়ের পাতা কাটা, সাঁড়াশির মত যন্ত্র দিয়ে জিভটা টেনে বার করে আনা ইত্যাদি। গ্রামের দিকে তো আর সে সব ছিল না। স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তার যেই বলত মৃত ওমনি কফিনে ঢুকিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হত। কতশত জীয়ন্ত মানুষ যে এই ভাবে মারা যেত তার ইয়ত্তা নেই। সেই জন্য কফিনের সাথে কখনও জুড়ে দেওয়া হত পতাকা কখনও ঘন্টা যার সুতো বাঁধা থাকত মৃতের হাত পায়ের সাথে। যেই নড়ে উঠবে ওমনি বেজে উঠবে ঘন্টা বা নেচে উঠবে পতাকা। কিন্তু মেরীর গরিব পিসির সে সামর্থ্য কই? যাই হোক লোক জড় করে যখন কবর পুনঃখনন হল, ঢালা খুলে দেখা গেল মেরী মৃত,আতঙ্কে চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, দুহাতের নখ গুলো রক্তাক্ত আর কফিনের ডালায় অসংখ্য আঁচড়ের দাগ।
আর একটা গল্পের কথা বলে শেষ করব, এটাও উনবিংশ শতকেরই ঘটনা,তবে অন্তিম ভাগ। স্থান রোড আইল্যাণ্ড, আমেরিকা। যক্ষ্মা তখন রাজরোগ। যদিও যক্ষার জীবাণু মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কিছুকাল পূর্বেই কিন্তু এর প্রতিষেধক তখনও অজানা। গ্রামের পর  গ্রাম শেষ হয়ে যাচ্ছে, কে কাকে কবর দেয়? জর্জ ব্রাউন নামক এক কৃষক ইতিপূর্বেই হারিয়েছে তার স্ত্রী এবং জেষ্ঠ্যা কন্যাকে। অতি কষ্টে একা হাতে পুত্র এডউইন এবং কন্যা মার্সিকে বড় করেছে জর্জ। ছেলের বিয়ে ও দিয়েছে, সুখী পরিবারে হঠাৎ হানা যক্ষার। পুত্র এডউইনকে বাঁচাতে পোষা গবাদী পশুদের বিক্রি করে সেই টাকায় এডউইনকে বউ সমেত কলোরাডো পাঠিয়ে দিল জর্জ। কলোরাডোর শুকনো আবহাওয়ায় যদি সেরে ওঠে ছেলে। কন্যা মার্সি রয়ে গেল বাবাকে চাষবাসে সাহায্য করার জন্য।  ঈশ্বরের আশিসে সেরেও উঠল এডউইন, কিন্তু কন্যা মার্সিকে বাঁচানো গেল না।
সুস্থ হয়ে এডউইন ফিরে এল। শোক ভুলে আবার কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ল বাপ ছেলে। কিন্তু যক্ষ্মা আবার হানা দিল। এডউইনকে আবার ধরল রাজরোগে, এবার অবস্থা আরো খারাপ। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিল।
এডউইনকে বাঁচাবার সব রাস্তাই যখন বন্ধ, হতাশ জর্জের সাথে দেখা করতে এল জনৈক মিঃ রোজ। রোজের পরিবারকেও খেয়েছে রাক্ষসী যক্ষা। কিন্তু নিজের কনিষ্ঠা কন্যাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পেরেছে রোজ। জর্জ যদি চায় রোজ এডউইনকেও বাঁচাতে পারে। এর জন্য কি করতে হবে?
রোজের মতে একই পরিবারে যদি পর্যায়াক্রমে একাধিক ব্যক্তি যক্ষ্মারোগে মারা যায়, তাহলে এই মৃত্যু মিছিলের জন্য দায়ী কোন ব্যাকটেরিয়া নয়, বরং এক ডিমন(অপদেবতা)। সেই  ডিমন কোথায় থাকে, রোজের মতে পরিবারের মৃত কোন সদস্যের দেহে থাকে সেই ডিমন। দিনে ঘুমোয়, রাতে উঠে এসে আক্রান্তের তপ্ত শোণিত পান করে। মৃতদের কবর খুড়লেই পাওয়া যাবে এমন একটি মৃতদেহ যা আজো অবিকৃত। ঐ মৃতের হৃদপিণ্ডটিতে টলটল করবে তাজা রক্ত।
রোজের কথায় প্রথমে বিশ্বাস করেনি জর্জ। পরে মনে পড়ল রোজ রাতে এডউইন মার্সিকে দেখতে পায়। মৃত বোন দাদার বিছানার আসেপাশে ঘুরে বেড়ায়। জর্জ নিজেও একবার দেখেছে অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সামনের জমিতে অদৃশ্য হয়ে গেল মার্সি। এ মার্সি বরফ শীতল, চোখে পৈশাচিক দৃষ্টি।
একমাত্র পুত্রকে বাঁচাতে স্ত্রী এবং দুই মৃত কন্যার কবর খোঁড়া হল। বাকি দুজন কঙ্কাল হয়ে গেছে, কিন্তু মার্সি এখনও আগের মতই আছে। জর্জের ডাক্তার বন্ধু বলল, এত ঠাণ্ডায় শব অবিকৃত আছে আর তাছাড়া ওরা অনেক বছর আগে মারা গেছে আর মার্সি মারা গেছে সদ্য মাস তিনেক আগে। মার্সির হৃদপিণ্ড আর লিভার উপরে নেওয়া হল, আগুনে পুড়িয়ে সেই ছাই টনিকের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হল এডউইনকে। এবার শুধু প্রতীক্ষা।
সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুই মাসেরমাথায় চলে গেল এডউইন। পড়ে রইল বৃদ্ধ বাপ আর সদ্য বিধবা স্ত্রী। পুত্রকে বাঁচাতে বৃদ্ধ পিতার এই প্রয়াসকে মোটেই ভালো চোখে দেখল না তৎকালীন আমেরিকান সমাজ। ছিঃ! ছিঃ রবে ভরে উঠল ট্যাবলয়েডগুলি। সেই সব পেপার কাটিংস জড় করে রাখতেন জনৈক ব্যক্তি, পরে তিনি মার্সিকে নিয়ে একটি গল্প লেখেন। এক রক্তচোষা অতিপ্রাকৃত জীবের গল্প, যাকে হত্যা করার একমাত্র উপায় পবিত্র ক্রশ দিয়ে তার হৃদপিণ্ড ফুটো করে দেওয়া। সৃষ্ট চরিত্রের  নাম  কাউন্ট ড্রাকুলা। আর লেখকের নাম ব্রাম স্টোকার। শুভররাত্রি।
(সোর্স - দা লোর পডকাস্ট)

অনির ডাইরি ২০শে অক্টোবর ২০১৭
একটা গল্প বলি শুনুন, একটা ছোট্ট মেয়ের গল্প। আসুন মেয়েটার নিজের জবানীতেই শোনা যাক,“আমি মেরী।বয়স কত, জানি না। মা খুব মারে।রোজ মারে। চাবুক পেটা করে। আমাকে কেউ কখনও চুমু খায়নি,আদরও করেনি।অন্য বাচ্ছাদের সাথে কখনও খেলতে পাইনি।খেলা দূরের কথা,অন্য কারো সাথে বাক্যালাপেরও অনুমতি ছিল না।কথা বলার চেষ্টা করলেই কপালে জোটে বেধড়ক মার।মা যখন বাইরে যায়,আমাকে ঘরে তালাচাবি বন্ধ করে রেখে যায়। আমি সেভাবে কোনদিন বাড়ির বাইরে বেরোইনি---”।পড়তে পড়তে আঁতকে উঠেছিলাম বিশ্বাস করুন।ঘুমন্ত মেয়েকে আরো দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরলাম। ওর গায়ের গন্ধে নাক ডুবিয়ে ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, কাল রাতেই তো কি বকলাম মেয়েকে, বৃষ্টির মধ্যেও দাদা মানে আমার ভাইপোর সাথে ছাতে উঠে বাজি পোড়াতে চেয়েছিল বলে।চোখ দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছিল গোল মুক্তোর দানার মত অশ্রুবিন্দু--- মা’রা তো বকেই, মাঝে মাঝে ঠ্যাঙায় ও,আবার হৃদয় নিকড়ে আদরে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু তাই বলে এমন অকথ্য অত্যাচার?
কে এই মেরী?মেরীর কথা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দেড়শো বছর। সময়কাল ১৮৭৪,স্থান নিউইয়োর্ক স্টেট সুপ্রীম কোর্টের ভরা চত্বর। সর্বসমক্ষে এই কথাগুলি বলছিল একটি বাচ্ছা মেয়ে, যার শরীরের সর্বাংশে দগদগে চাবুকের কালশিটে দাগ,কিছু পুরাণো, কিছু তরতাজা,যে নিজেই জানে না তার বয়স কত।
নথি ঘেঁটে জানা যায় যে মেরীর জন্ম ১৮৬৪ সালে। পুরো নাম মেরি এলেন উইলসন। জন্মের অব্যবহিত পরেই মেরীর পিতৃবিয়োগ হয়।মায়ের একার উপার্জনে মা মেয়ের পেট আর চলছিল না, তারওপর সদ্যোজাত শিশুকে ফেলে কাজ জোগাড় করাও ছিল চাপের। মেরীর জন্মদাত্রী মা সাময়িক ভাবে অর্থের বিনিময়ে একজনের জিম্মায় মেরীকে রাখতে বাধ্য হন। কিন্তু দেয় অর্থটুকুও তিনি নিয়মিত জোগাড় করতে পারতেন না। ফলে দুবছর বয়স হলে মেরীর স্থান হয়,নিউইয়োর্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব চ্যারিটিজে। মেরীর জন্মদাত্রী মা সম্ভবত এই পর্যায়ে বা এর আগেই মারা যান।
আবেদনের ভিত্তিতে জনৈক ম্যাককর্ম্যাক দম্পতিকে দত্তক দেওয়া হয় মেরীকে। মেরীর নতুন পালক পিতামাতার নাম ছিল টমাস এবং মেরী ম্যাককর্ম্যাক। দত্তক নেবার অল্পদিন পরেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়,মারা যায় মেরীর পালক পিতা টমাস। পালিকা মা,যার নামও ছিল মেরী,পুনর্বিবাহ করে,দত্তককন্যা সহ শ্বশুরালয়ে গমন করেন।
এরপর নতুন অ্যাপার্টমেন্টে কেটে যায় বেশ কয়েক বছর। নতুন মহল্লার স্থানীয় অধিবাসীরা যে কোন কারণেই হোক গোড়া থেকেই মেরীর পালিকা মাতার আচার আচরণে সন্দিহান হয়ে ওঠে। অবশেষে জনৈক প্রতিবেশিনী মিসেস কনোলি সাহায্য প্রার্থনা করেন, অ্যাটা এঞ্জেল হুইলার নামক এক সমাজসেবী। এক অসুস্থ গৃহবন্দী বৃদ্ধাকে সহায়তার মিথ্যা বাহানা বানিয়ে দ্বাররক্ষকের থেকে ডুপ্লিকেট চাবি জোগাড় করে কনোলী এবং অ্যাটা যখন মেরী এলেনের মায়ের অনুপস্থিতিতে ওদের ফ্ল্যাটে ঢোকে, মেরীর অসহায় অবস্থা দেখে ওণারা হতবাক হয়ে যান। কি দেখেছিলেন কনোলী এবং অ্যাটা? আসুন কোর্টে ওদের জবানবন্দি শুনি,“আমরা দেখলাম একটা পুঁচকে মেয়ে, যাকে দেখে কোনমতেই বছর পাঁচেকের বেশী মনে হয় না(যদিও মেরীর বয়স তখন ৯), একটা নীচু স্টোভের ওপর একটা প্যান রেখে তার ওপর দাঁড়িয়ে বাসন মাজছে। যে ফ্রাইং প্যানটা মাজতে ও নাস্তানাবুদ হচ্ছিল, তার ওজন প্রায় ওর সমান। টেবিলের অপর প্রান্তে একটা চামড়ার চাবুক রাখা আছে। বহুল ব্যবহারে যার চামড়া গুলি খুলে এসেছে,ছোট্ট বাচ্ছা মেয়েটির ততোধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাত এবং পা  অজস্র চাবুকের দগদগে ক্ষত।ডিসেম্বরের নিউইয়োর্কেও মেয়েটির পায়ে কোন জুতো নেই। সেই নির্মম দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সবথেকে করুণ ছিল শিশুটির মুখ। দুটি টলটলে চোখ সোচ্চারে জানাচ্ছিল, ভালবাসার কোন স্পর্শ কোনদিন পায়নি তারা। এর পৃথিবী জুড়ে শুধুই দমন,পীড়ন, ভয় আর আতঙ্কের রাজত্ব।”
অ্যাটা দৌড়ে যান থানায়। কিন্তু থানা তাঁকে নিরাশ করে। তৎকালীন আইন অনুযায়ী অত্যাচারের কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকলে পুলিশ কারো পারিবারিক  ব্যাপারে নাক গলাতে অক্ষম। অ্যাটা চিৎকার করে ওঠে, এক অপুষ্টি-আক্রান্ত শিশুর গায়ে এতগুলি পুঁজরক্ত ওলা ক্ষতই কি যথেষ্ট নয়? কনোলি আর অ্যাটা তো স্বচক্ষে দেখেছে, মেরীর বাসন মাজা। আর কি প্রমাণ চাই আইনের?পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়,অ্যাটা কি নিজের চোখে দেখেছেন যে ঐ ক্ষতগুলি মেরীর মায়ের চাবুক মারার জন্যই হয়েছে? যদি দেখে থাকেন,পুলিশ এখুনি মেরীর মাকে গ্রেপ্তার করবে, না দেখে থাকেন তাহলে---
অ্যাটা এবার সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হলেন, মেরীকে ডাকা হল তার বক্তব্য শোনার জন্য, ছোট্ট মেরী, আজীবন নির্যাতিত মেরী জীবনে প্রথম সাহস সঞ্চয় করে মুখ খুলল,কি বলল মেরী,“My father and mother are both dead. I don’t know how old I am, have no memories of the time when I didn’t live with the McCormacs.The whip always left a black and blue mark on my body. I have now the black and blue marks on my head which were made by mamma and also a cut on the left side of my forehead which was made by a pair of scissors. She struck me with the scissors and cut me. I have no recollection of ever having been kissed by anyone. I have never been taken on my mamma’s lap and caressed or petted. I have never dared to speak to anybody because if I did I would get whipped. I don’t know for what I was whipped, mamma never said anything to me when she whipped me. I don’t want to go back to live with mamma because she beats me so.”
মেরীর এই বক্তব্য ছিল যুগান্তকারী যা পরবর্তীকালে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নতুন আইন প্রণয়ন করার পথ প্রশস্ত করে। মেরীর মায়ের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। অ্যাটা স্বয়ং দত্তক নেন মেরীকে। জীবনে প্রথমবার ভালবাসা এসে ছুঁয়ে যায় মেরীকে।
মেরীরা আজো আছে। হয়তো আমার বা আপনার পাশের বাড়িতে। নিজের শিশু সন্তান বা নাতিপুতির দেখাশোনা করার জন্য বা গৃহপরিচারক হিসেবেও অনেকে মেরীদের জায়গা দেয় নিজের বাড়িতে। একটা শিশুর কাছ থেকে অজান্তে কেড়ে নেয় তার খোলা আকাশ, একচিলতে রোদ, কেড়ে নেয় তার খেলার মাঠ, মায়ের আদর। কেড়ে নেয় তার শৈশব। বিনিময়ে দুবেলা পেট ভরে খেতে তো পায়,লজ্জা নিবারণের বস্ত্র তো আছেই।  অনেক সময় বাবামা স্বেচ্ছায় পাঠিয়ে দেয়, কাজ করে দুটো পয়সা আনার জন্য। পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে প্রতিনিয়ত কত মেরী যে এভাবে হারিয়ে যায়-কোথায় যায় মেরীরা? কে জানে। কারো স্থান হয় লালবাতি এলাকায়, কারো বা সরকারি হোমে, কারো বা রাস্তায়- তারপর?  কি হয় এই মেরীদের? জানি না। শুধু জানি সব মেরীরই যদি একজন অ্যাটা থাকত,জগৎটাই বোধহয় পাল্টে যেত তাই না?
অনির ডাইরি ১৯শে অক্টোবর  ২০১৭
“বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল ১৮ মাত্র।খুব গোঁড়া, রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা, যেখানে “ভালো মেয়েরা” কখনই তাদের বাবা মায়ের অবাধ্য হয় না। তাই বাবা যখন বিয়ের কথা তুলল,শুধু বলেছিলাম,‘তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য রাজি আমি,জীবনটাকে বাজি রাখতে। ’ বিয়েটা যে খুব সুখের হয়নি, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ থেকে প্রায় বছর নয়েক আগের কথা, বিয়ের ঠিক দু বছরের মাথায়,এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তছনছ হয়ে যায় আমার জীবন।কি ভাবে যেন আমার বর ঘুমিয়ে পড়েছিল, গাড়ি চালাতে চালাতে-। গাড়ি গড়িয়ে যায় খাদে। শেষ মুহূর্তে আমার বর পড়ন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হয়। ঈশ্বর পরম করুণাময়।
কিন্তু আমি পারিনি জানেন। প্রাণে বেঁচে যাই বটে, কিন্তু গাড়ির ভিতর আটকে পড়ার ফলে মারাত্মক ভাবে আহত হই।ঠিক কোথায় কোথায় চোট পেয়েছিলাম, বলতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। আমার ডান হাতের রেডিয়াস ও আলনা, আমার মণিবন্ধ,আমার শোল্ডার বোন,কলার বোন,একাধিক পঞ্জরাস্থি সমেত বুকের খাঁচা সব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমার মেরুদণ্ড।আমার স্বপ্ন, আমার ভবিষ্যতের মতই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আমার শিরদাঁড়া।
গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে যখন বার করছিল আমার ক্ষতবিক্ষত শরীর, সজ্ঞানে প্রথম বার উপলব্ধি করলাম, জীবন কখনও আর আগের মত হবে না।
এরপর আড়াই মাস হাসপাতাল বাস।হতাশার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলাম । সর্বক্ষণ মৃত্যুচিন্তা করতাম। কেন করব না বলুন,তো? একদিন ডাক্তার বাবু এলেন, আমাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস  চেপে বললেন,‘ তুমি ছবি আঁকতে ভীষণ ভালবাসতে তাই না? আর্টিস্ট হতে চেয়েছিলে, কিন্তু কোনদিন আর ছবি আঁকতে পারবি না মা। ” দ্বিতীয়দিন  ডাক্তারবাবু বললেন,“তোমার শিরদাঁড়ার  অবস্থা এত খারাপ, তুই আর কোনদিন হাঁটতে পাবরি না মা।” নিজেকে বোঝালাম, ঠিক আছে। চলবে। তবু তো বেঁচে আছি।  তৃতীয়দিন ডাক্তারবাবু  এলেন, ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল, আর আছে টাই বা কি এই হতভাগ্য নারীর যা কেড়ে নেওয়া সম্ভব? ডাক্তারবাবু আবার বললেন,“তোমার শিরদাঁড়ার  অবস্থা এত খারাপ,তুই কোনদিন আর সন্তানের জন্ম দিতে পারবি নারে মা। ”
সেই দিন ভেঙে পড়লাম। সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন, মনে হল আমার ফুসফুস দুটো সজোরে নিকড়ে সব হাওয়া বার করে দিয়েছে কেউ। এভাবে বেঁচে থেকে কি লাভ?কেন আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে এরা?কি মূল্য আছে আমার মত একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া,পঙ্গু, পরোমুখাপেক্ষী,পচাগলা শরীরের। 

তা সত্ত্বেও  বেঁচে আছি দেখুন। কি ভাবে?কেন?সেই গল্পই তো বলতে এসেছি,শুনবেন কি আমার কথা? পাগল হয়ে গিয়েছিলাম জানেন?দমবন্ধ হয়ে আসত হাসপাতালের ঐ মৃত্যুর মত হিমশীতল সাদা দেওয়াল,সাদা ছাত, সাদা বালিশ,বিছানা, চাদর, ইউনিফর্ম  দেখতে দেখতে। একদিন থাকতে না পেরে,  আমার ভাইকে বললাম,আমাকে একটা ক্যানভাস আর কিছু রঙ এনে দিতে পারিস?জানি আমার একটা কবজি চিরতরে বরবাদ হয়ে গেছে, তবু  কিছু আঁকতে চাই। একটু রঙ ভরতে চাই জীবনের এই সাদা ক্যানভাসে।

এইভাবেই তথাকথিত মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়েই আমার প্রথম ছবি আঁকা। কি অসাধারণ সে অনুভূতি, একটা শব্দও না ব্যয় করে  আমার মনের কথা ফুটিয়ে তুললাম আমার ক্যানভাসে। ওষুধ,পথ্য,ডাক্তার,বদ্যি যা পারেনি, আমার আঁকা ছবিগুলি তাই করে দেখালো জানেন?ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলাম ।
হাসপাতালে আমার ঘরে লোকজন ভিড় জমাত জানেন, আমার আঁকা ছবি গুলো দেখতে। কত প্রশংসা করত। অসম্ভব বর্ণময় লাগত ওদের আমার আঁকা ছবি। আমার পাঁজর গলানো, হৃদয় পোড়ান ব্যথা সহস্র রঙের ফুলঝুরি হয়ে ঝরে পড়ত দর্শকের চোখে।
সেইদিন  ঠিক করলাম, আমি বাঁচতে চাই। আর কখনই কারো মনের মত হওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে, কিন্তু আমি, আমার মনের মত তো হতেই পারি।  বাঁচব। শুধু নিজের জন্যই বাঁচব আমি।
মনে হল বাঁচতে হলে আগে নিজের ভয় গুলিকে জয় করা দরকার। কাগজ কলম নিয়ে বসলাম, তালিকা তৈরি হল আমার ভয়ের। ঠিক করলাম এই সবকটাকে একে একে জয় করব। আমার সবথেকে বড় ভয় কি ছিল বলুন তো?সবথেকে বড় আতঙ্ক ছিল বিবাহ বিচ্ছেদ। এক লহমায় কাটিয়ে উঠলাম আমার এই ভয়,আর তাকে দিলাম মুক্তি, চিরতরে। মন বলল, ভাল থেকো,খুব খুব ভালো থেকো তুমি।
ভয়কে জয় করার এই প্রচেষ্টা,এক ধাক্কায় আমার মনোবল এত বাড়িয়ে দিল,যে দিন জানতে পারলাম, সে  বিয়ে করেছে,সোজা ফোন তুলে তাকে মেসেজ পাঠালাম,“তোমার আনন্দের শরিক আমিও। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি খুব, খুব ভালো থাকো দোহে। ” সে জানে  আজও আমার দৈনন্দিন প্রার্থনায় জড়িয়ে থাকে তার নাম।
আমার দু নম্বর ভয় কি ছিল বলুন তো?মা না হতে পারার হাহাকার। কিছুতেই একে কাবু করতে পারছিলাম না জানেন। ধীরে ধীরে নিজেকে বোঝালাম, আমার জরায়ু শুষ্ক নিষ্ফলা বটে,আমার হৃদয় তো নয়। প্রসব করতে না পারলেও তো মা হওয়া যায়। ঘরের কোণে কতদিন আর এভাবে গুমরে মরব? দত্তক নেবার অনুরোধ জানালাম দেশের বিভিন্ন অনাথ আশ্রমে। দুবছর কেটে গেল, কেউ কিছু জানালো না। তারপর একদিন তাকে পেলাম, দেশের এক ছোট্ট শহরের এক অখ্যাত অনাথ আশ্রম তাকে আমার কোলে তুলে দিল। তার বয়স সবে দুদিন। আমার ছেলে। হ্যাঁ আমারই তো ছেলে, আজ তার বয়স ছয়। কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছে আমার জীবন সে-
আমার তৃতীয় ভয় ছিল, আমার মত একজন খুঁতো, পঙ্গু, হুইলচেয়ারাসীন মহিলাকে কি এই নিঁখুত সমাজ গ্রহণ করতে পারবে?মুখোমুখি হলাম নিজের এই ভয়টারও জানেন-বেশী বেশী করে জনসমক্ষে  আসতে লাগলাম। বেশী বেশী করে ছবি আঁকতে লাগলাম।লোকে জানতে পারল আমার কাহিনী।মডেলিং এর সুযোগ এল, লুফে নিলাম। জাতীয় টিভিতে সংযোজক হবার ডাক এল, দৌড়ে গেলাম। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের গুড উইল অ্যাম্বাসাডর ফর উইমেন হলাম। আজ নারী এবং শিশুদের অধিকার নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলায় ব্রতী। এরপর শুধুই সাফল্যের কাহিনী - ২০১৫এ বিবিসির সেরা ১০০নারীর তালিকায় স্থান পেলাম। ২০১৬এ ফোর্বসের “৩০ আন্ডার ৩০”তে আমার জায়গা খুঁজে পেলাম-----

জীবন ভয়ানক সুন্দর। না না স্বপ্ন কল্পনার জাল বুনি আমরা নিজেদের জীবনকে কেন্দ্র করে।  রূঢ় বাস্তবের অভিঘাতে যেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সেই জাল, ওমনি আমরা হাল ছেড়ে দি।  দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি কোনদিন আমাকে,হ্যাঁ আমাকে হুইলচেয়ারে বসতে হবে। জীবন বড় নির্মম। প্রতি মুহূর্তে  আমাদের পরীক্ষা নিয়ে চলে।তাই বলে হাল ছেড়ে দেব? না, কখনই না। বরং লড়ুন। দরকার হলে লড়ে হারুন। ভয় পান, প্রয়োজনে গলা ফাটিয়ে কাঁদুন, কিন্তু দোহাই লড়াই ছাড়বেন না।উঠুন,ধুলো ঝাড়ুন,নতুন করে শুরু করুন আপনার লড়াই। লড়ুন,লড়তে থাকুন- ” মুনিবা মাযারীর জবানী। পাকিস্তানের চিঠি। আজ এই গভীর তমসাচ্ছন্ন উপমহাদেশে মুনিবাদের বড় দরকার।এরাই তো আমাদের দীপক। কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ুক প্রাণের রোশনাই । শুভ দীপাবলী।

অনির ডাইরি ১৬ই অক্টোবর ,২০১৭
ছোটবেলায় খুব ঘণ ঘণ জ্বর আসত আমার। আর জ্বর শুরুই হত ১০২ডিগ্রী থেকে।হাতের নাগালেই ছিলেন ডঃ দলুই। আসলে যদিও উনি হাড়ের ডাক্তার,কিন্তু আমাদের মহল্লায় যার যাই রোগব্যধি হত সকলে ছুটত ডঃ দলুইয়ের কাছে। ঐ শ্রেণীর ডাক্তার এখন সত্যিই দুর্লভ। বাইরে কম্পাউন্ডার বসে থাকত, পর্দা সরিয়ে ওণার চেম্বারে ঢুকতে হত। আসলে একটিই ঘর। বড় ফ্রী স্যাম্পলের ওষুধের আলমারি দিয়ে পৃথক করা। চেম্বারে ঢুকলেই, ডঃ দলুই বলতেন শুয়ে পড়। একটা ক্যাম্পখাটের মত গদি মোড়া শোবার জায়গা ছিল। সিঁড়ি ভেঙে উঠে শুয়ে পড়লেই, আগে ডাক্তার প্যাঁক প্যাঁক করে পেট টিপতেন, তারপর চোখের পাতা টেনে দেখতেন,অতঃপর উঠে বসতে হত। বুকে পিঠে স্টেথো ঠেকিয়ে, গলায় চামচ ঢুকিয়ে টর্চ দিয়ে গলা দেখে, সটান একটা থার্মোমিটার মুখে ঢুকিয়ে দিতেন।
ব্যাস আর কি। এবার ঘসঘস করে প্রেসক্রিপশন লিখে ছেড়ে দিতেন। ওণার ডায়গনেসিস একদম নিঁখুত হত। দু চার দিনের মধ্যেই জ্বর হাওয়া। ওমা সাত দিনের মাথায় আবার পুনর্বিক্রমে ফিরে আসত জ্বর।
জেঠু বরাবরই চূড়ান্ত ঈশ্বর বিশ্বাসী। খুব অল্প বয়সে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ওণার গুরুদেবের নাম ছিল শিবানন্দ হংসপুরীজী। বাড়ি শুদ্ধ সবাই ওণাকে দাদু বলে ঢাকত। উনি ছিলেন বেশ মজার মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উনি ইংরেজদের হয়ে লড়াই করেন। মামুলী সেপাই নয়, মাঝারি গোছের অফিসার ছিলেন। সম্ভবত উত্তর আফ্রিকার কোন উপকূল বরাবর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা ওণার হৃদয়ে গভীর বৈরাগ্যের জন্ম দেয়। উনি শুধু নন,ওণার পাঁচ বা ছয় ভাই প্রত্যেকেই সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। দাদু নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্ন নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন এবং আমার নাস্তিক জেলখাটা নকশাল বাবাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। ঐ সত্তরের সেই টালমাটাল সময়ে উনি দীর্ঘদিন বাবা এবং ছোটকাকুকে ওণার তৎকলীন বিহারের আশ্রমে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
যাই হোক দাদু কলকাতা এসেছিলেন, মাঝে মাঝেই আসতেন শিষ্যদের ডাকে, এবং তথাকথিত ধনী শিষ্যগৃহে থাকার থেকে আমাদের ভাঙা বাড়িতে থাকতে বেশী ভালোবাসতেন। বাবার সাথে ব্যাপক তর্কাতর্কি হত, কেউ কারো অবস্থান থেকে সরতেন না। সেবারে এসে উনি যখন দেখলেন যে আমায় নিয়ে বাবার মন খারাপ, উনি হেসে বলেছিলেন,“আমি যা দিচ্ছি এটা ওর হাতে বেঁধে দে। একটা সময় এটা নিজে থেকেই হারিয়ে যাবে, কিন্তু জ্বর আর কখনও ফিরে আসবে না। ”শ্বেত অপরাজিতা গাছের শিকড় স্বহস্তে বেঁধে দিলেন আমার হাতে। তাজ্জব ব্যাপার দিন দশেক পরে সেটা যে কোথায় খুলে পড়ে গেল, শত খুঁজেও পাওয়া গেল না। কিন্তু জ্বরও আর কখনও আসেনি।
কিন্তু সত্যি বলছি, জ্বর আসাটাকে আমি খুব মিস করতাম। কি রকম ঝিমঝিমিয়ে উঠত মাথা, এক লাফে উঠে পড়তাম মায়ের কোলে। মায়ের গায়ের সেই তেল হলুদ মশলা মেশানো মিষ্টি গন্ধ। আর মিষ্টি মিষ্টি ডঃ দলুইয়ের ওষুধ, আহাঃ।
মা নিজে ছিলেন পোস্টাফিসের কর্মচারী। ঐ সময় কাউন্টার ডিউটির প্রবল চাপ থাকত। ফলে জ্বর ১০৪-৫উঠলেও মাকে অফিস যেতেই হত। ছুটি মঞ্জুর হয়ে আসতে আসতে আমি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতাম। আমার সমস্ত অসুখ বিসুখে অফিস কামাই করত বাবা। সারাদিন গল্প শোনাত আর মাথায় জলপট্টি দিত। শুধু অসুখ বিসুখ নয়, যখনই বায়না করতাম,“ বাবা আজ অফিস যেও না। ” বাবা ডুব মারত। নিজের কাজটাকে অসম্ভব ভালোবাসত লোকটা, তবে সবথেকে বেশী বোধহয় আমাকেই ভালোবাসত। আজ যদিও আমার স্থান তুত্তুরীর দখলে।
ফেলে আসা দিন, ফেলে আসা ছোটবেলা বড়ই সুন্দর। কিন্তু বর্তমানই বা খারাপ কি। হ্যাঁ ভালোবাসার ঐ প্রকাশ এই বয়সে কেউ করবে না জানি, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনুভূতি গুলোও যে তীব্র হয়ে ওঠে। সব লুকানো ভালবাসাই যে ধরা পড়ে যায় রাডারে--- মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, একটু আধটু জ্বরভাব মন্দ কি।
অনির ডাইরি ১২ই অক্টোবর ২০১৭
“চাউ খেলাম, তারপর দেখি বাবা একটা এত্ত বড় আনারস নিয়ে এসেছে। কি মরতে বলেছিলাম আনারস খেতে খুব ভালোবাসি, আমার জন্য এক বড় বাটি ভর্তি রেখে দিয়েছিল। খেয়ে তো নিলাম, অ্যান্টাসিড তো খেলাম না। তারপর, সে কি গ্যাস” শুনতে না চাইলেও কানে আসছিল সব কিছু। মনে মনে আপ্রাণ  প্রার্থনা শুরু করলাম, হে ভগবান এই মহিলার গ্যাসের বিবরণী শোনার আগে হয় আমাকে তুলে নাও,নয়তো একে। একেই নাও। সাতসকালে অফিসযাত্রী এক বাস ভর্তি লোকের সামনে, কানে মোবাইল চেপে খোশ গল্প জুড়েছে, তাও কিনা গ্যাস নিয়ে? 

এই রকম সংলাপ যে প্রতিদিন কত শুনতে হয়, রাস্তাঘাটে লোকে জোরে জোরে ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে বলতে যায়, খেয়ালও করে না,যে পার্শ্ববর্তী  লোকজনকে শুনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাবার্তা আবার বেশ মজারও হয়। এই প্রসঙ্গে আমার দুটি অভিজ্ঞতা না শেয়ার করে পারছি না- প্রথমটি বছর কয়েক আগেকার কথা। চাঁদিফাটা গরমে গলে যাচ্ছে কলকাতা। অফিস সেরে বাড়ি ফিরছি, ঘড়ির কাঁটা ছয়ের ঘর ছাড়িয়েছে বেশ কিছু আগে, বাসে থিকথিকে ভিড়। মিনিবাস। জানলার ধারে এক প্রৌঢ়া বসেছেন,তারপাশে আমি। মহিলার সাথে প্রায় দিনই দেখা হত। রাজ্য সরকারের কোন দপ্তরের বড়দি। এমনিতে খুবই ভালো, স্নেহশীলা শুধু কেউ আমায় ফোন করলেই উনি একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করতেন,“বর?” একই ভাবে মিনিট তিনেকের বেশী হোয়াটস্ অ্যাপে থাকলেও উনি একই প্রশ্ন করতেন। কি করে বোঝাই, যে শৌভিক তখন মগরাহাটে বিডিওগিরি করছে,খামোকা বউকে ফোন বা মেসেজ করে খোশগল্প করার ইচ্ছা বা সুযোগ কোনটাই তার নেই। যাই হোক, আমার পাশে এক ঘণ কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিলেন, একনজরে দক্ষিণী বলেই সন্দেহ হয়, উনিএমন প্রবল বেগে ঘামছিলেন যে আমি আতঙ্কিত ছিল এই বুঝি ওণার ঘামবৃষ্টি হল আর কি। ভদ্রলোক একটি সপসপে রুমাল দিয়ে সমানে হাত কনুই মুচছেন, তবু টপ করে এক ফোঁটা ঘাম আমার মণিবন্ধে পড়ল। ইয়াক্। আমি কিছু বলা বা করার আগেই উনি আঁতকে উঠে,ঘাবড়ে গিয়ে ওণার ঐ ঘর্মাক্ত  রুমালটি দিয়ে ঘামটি মুছতে এলেন,  তড়িঘড়ি আমার রুমালটি দেখিয়ে ওণাকে ক্ষান্ত করলাম বটে, উনি  লজ্জায় আরো ভিতর দিকে গুঁতোগুঁতি করে সেঁদিয়ে গেলেন। একটি নব্য যুবা ঐ শূন্যস্থানটি পূরণ করল। বছর ত্রিশ বয়স, নেহাত সাদামাটা চেহারা। কোনমতে দাঁড়িয়েই, কানে মুঠো ফোন ঠেকিয়ে বলল,“হ্যালো মন। ” ও হরি। মন? এই দমবন্ধ-করা ভিড় বাসে কোথায় মন খুঁজছ বাপু? “ মন?সাড়া দিচ্ছ না কেন?রাগ করেছো?” পাশের মহিলা ফিসফিস করে বলল,“মন বৃন্দাবনে। ” হাসি চেপে নিজের ফোন ঘাঁটতে লাগলাম। ছেলেটি কাতর স্বরে বলেই চলেছে,“মন?প্লিজ রাগ করো না। তিথি শুধু আমার বন্ধু। তুমি জানো তো?” পাশের মহিলা বলে উঠলেন,“ত্রিকোন প্রেম। মিলনতিথি কেস্। ” ছেলেটি করুণ ভাবে বলেই চলেছে,“এমন বলে না মন। আমি তো শুধু তোমাকেই-”। পাশের মহিলা অস্ফুটে বললেন,“ভালোবাসি। ” ছেলেটি বুঝিয়েই চলেছে,“মোটেই না। তিথির থেকে তোমায় অনেক মিষ্টি দেখতে।” পাশের মহিলা বিচক্ষণ স্বরে বললেন,“উহুঃ। মনে হচ্ছে তিথিই বেশী সুন্দরী। মন নির্ঘাত একটা পুঁচকে মেয়ে। ” ছেলেটি ততোক্ষণে  নাকখৎ দিতে বাকি রেখেছে, ধীরে ধীরে তিথি আর মনের তুলনাও শুনে ফেললাম। কে লম্বা,কে কচি, কে ফর্সা-সবেতেই মন ফার্স্ট ক্লাশ পেয়ে বেরিয়ে গেল। মুস্কিল হল যখন ছেলেটি মুখ ফস্কে বলে ফেলল তিথির চুল একটু বেশী ঘণ আর লম্বা। এরপর মন আর মানে? ঘ্যাঁচ করে দিল ফোনটা কেটে। ছেলেটি বার চারেক ফোন করল দেখলাম,“হ্যালো মন। শোন না। ” ঘ্যাঁচ। “হ্যাঁ মন। শুনছ।” ঘ্যাঁচ। কতবার ঘ্যাঁচাঘেঁচি হল জানি না। ছেলেটি হঠাৎ ব্যস্তভাবে দুপায়ের ফাঁকে দাঁড় করানো ব্যাগটি তুলে নিয়ে দৌড়ে বাস থেকে নেমে গেল। উফ্ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।এই “মন মানে না”র ত্রিকোণমিতি আর পার্শ্ববর্তীনীর ধারাবিবরণী আর নিতে পারছিলাম না।

দ্বিতীয় ঘটনাটি সাম্প্রতিক। কয়েক সপ্তাহ আগে ভয়াবহ নিম্নচাপে কাবু পশ্চিমবঙ্গ। সন্ধ্যাবেলার বর্ষণক্লান্ত শুনশান নৈহাটী স্টেশনে হঠাৎ দেখা চয়নের সাথে। চয়ন আমার বাল্যবন্ধু এবং উঠতি স্থপতি বাস্তুকার। আসল নামটি লিখছি না, এহেন চয়নের বস নিয়ে আজন্ম সমস্যা।বস পছন্দ না হলে কেউ চাকরী পাল্টাতে পারে তা চয়নের সংস্পর্শে না এলে জানতেই পারতাম না। আগের বস্ ছিলেন এক অসম্ভব সুদর্শন আপেলের মত টুকটুকে মধ্যবয়সী জাঠ ভদ্রলোক। তাকে চয়নের না পসন্দ ছিল কারণ তিনি নাকি প্লেবয়। অফিস শুদ্ধ মেয়ে কর্মচারীগণ ওণার প্রেমে হাবুডুবু খেত আমার নিকষ বেরসিক বান্ধবীটি ছাড়া।ওণার নামই দিয়েছিল,“আমার হারামি বস্”।
যাই হোক, চাকরী পাল্টে নতুন বস পেল।ইনিও মধ্যবয়সী,সুন্দরী।  কদিনবাদেই চয়ন চাকরী পাল্টাবার গল্প শুরু করল, কারণ?  মহিলার নাকি একটু ইয়ে আছে। অফিস শুদ্ধ সব পুরুষ কর্মচারীই ওনার অনুরাগী এবং স্তাবক। তাতে অফিসের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কাজের পরিবেশ নেই বলে সেদিনও চয়ন বসের মুণ্ডপাত করছিল। বস্ পুরাণ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম, আচমকা কে যেন কানের কাছে বলে উঠল,“ধুর শা-। উঠেছি লোকাল ট্রেনে একটা বাথরুমও নেই।” ওপাশের লোকটি  কিছু বলল, আমাদের পিছন সিটে বসা লোকটি তারোস্বরে চিল্লাতে লাগল,“তো কি করব? বউকে বললাম আর জল খাব না। তা নয়,‘খাও। জল খাও।’ বেরোবার আগে এত জল খাওয়ালো-- উঃ হুঃ হুঃ। ”চয়ন আর আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। একটা আধদামড়া ধুমসো লোক, বউ জল খাইয়েছে, ট্রেনে বাথরুম নেই বলে ঘ্যানঘ্যান করছে। যতঃ আপদ।
ওবাবা লোকটি একটি গালি দিয়ে বলল, “তোদের জন্যই আমার এই দুর্গতি।”ওপাশের লোকটি বোধহয় জানতে চাইল কেন? আমাদের সহযাত্রী স্বভাব সিদ্ধ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,“তোরাই তো বললি বিয়ের রাতে বেড়াল কাটতে-” এবার প্রমাদ গুণলাম। এই গল্প শুরু হলে একে এখান থেকে বিতাড়ন না করে উপায় নেই। লোকটি দেখলাম নিজেই উঠে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালো। উঃ হু হুহু। মোটামুটি ফাঁকা কামরায় দিব্যি শোনা যাচ্ছে যদিও, লোকটি বলছে,“মানে আবার কি?তোরা বললি বলেই আমি ঘরে ঢুকেই একটা ইয়ে দিলাম।” ইয়েটা একদমই শুনতে পেলাম না কিয়ে। চয়ন গম্ভীর ভাবে বলল,“ বহুত না ইন্সাফি হ্যায়। এতক্ষণ কানের পোকা বার করে দিয়ে এখন ইয়েটাই শুনতে দিল না। ” হাসব না বিরক্ত হব কিছুই বুঝলাম না। লোকটি উঃহুহু করে দেড় পায় একটু নেচে নিল। “হাসিস না। তোরা বললি বলেই করলাম। বউ চোখ গোলগোল করে বলল,‘তাই। তোমার খুব গ্যাসের প্রবলেম বুঝি? জলটল খাওনা নির্ঘাত”। সেই থেকে খালি জলই গিলিয়ে যাচ্ছে। সাদা জল,  মিছরির জল,  ত্রিফলার জল।  আর পারছি না বাবা, আমাকে পরের স্টেশনেই নামতে হবে। ” আমি আর চয়ন প্রবল বেগে একে অপরকে চিমটি কাটছি তাও হাসি কুলকুল করে বেরিয়ে আসছে। ফোনের ওপাশের লোকটি বোধহয় বিড়াল কাটা নিয়ে কিছু জ্ঞান দিল, আমাদের সহযাত্রী ভেবলে গিয়ে বলল,“তা সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিবি তো? আমি ভাবলাম বিয়ের রাতেই নিজের সবথেকে খারাপ ব্যাপারটাই বউকে জানিয়ে দিতে হয়। ”। লোকটি নেমে যাবার পর আমাদের হাসির দমক সেদিন নিম্নচাপকেও লজ্জা দিয়েছিল বটে, তবে একটা ব্যাপার সেদিন পুনরায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল বাঙালি সত্যিই নমস্য এবং তার গ্যাস ও। আর বাঙালির বিড়াল কাটা, সেটা আপনারাই বিচার করুন-
অনির ডায়েরি ১১ই অক্টোবর ২০১৭
একটি সুদর্শন নব্য যুবক এবং একটি মিষ্টি মেয়ে। ধরে নিন কলেজে আলাপ। প্রথম দর্শনেই ঝগড়া, ঝগড়া গড়ায় খুনসুটিতে, ধীরে ধীরে মাথা গলায় প্রেম। গাঢ় প্রেম শুধুমাত্র  প্লেটোনিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বুঝলেন কি না?কোন এক ঝর ঝর বাদল দিনে - D

এবারেই শুরু আসল গপ্প। মেয়েটি বুঝতে পারে,সে আর একা নয়। ক্যাঙ্গারু জননীর মতই বহন করছে আরো একটি ছোট্ট অভূমিষ্ঠ প্রাণ। আতঙ্কিত মেয়েটি দৌড়ে যায় তার প্রিয়র কাছে, যে আসছে সে তো দুজনেরই। কিন্তু ছেলেটি মুখ ফিরিয়ে নেয়। অত্যন্ত কটু ভাষায় বলে, কার পাপ, আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছ?যদি ওটিকে নিকেশ করে আসতে পারো,আমরা আবার বন্ধু হতে পারি,বেশী কিছু আশা কোর না।
সব জানতে পেরে মেয়েটির নিজের পরিবার ও মেয়েটির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।  আত্মহত্যা উন্মুখ মেয়েটির সাথে হঠাৎ  দেখা হয়ে যায় এক অগ্নিস্বরূপিনী মহিলা আইনজীবীর। উকিল দিদি বলেন, মরবে কেন?লড়। প্রয়োজনে লড়ে মর। তোমার অনাগত সন্তানকে তার পিতৃপরিচয় দেওয়া তোমার কর্তব্য এবং অধিকার।
শুরু হয় মামলা। ছেলেটির হয়ে দাঁড়ায় খোদ তার বাবা। শহরের নামী এবং দামীতম উকিলবাবু। মেয়েটির বাবাও ঐ আদালতের ছোটখাটো কর্মচারী ছিলেন, এই উকিলবাবু সর্বসমক্ষে  ওণাকে বেশ্যার দালাল বলে গাল পাড়েন। তীব্র ক্ষোভে তথা লোকলজ্জায় বৃদ্ধ তার পরিবার সহ শহর ত্যাগ করে।আশ্রয়হীনা  নায়িকা জায়গা পায় তার উকিল ম্যাডামের গৃহে। R
কেস গড়াতে থাকে, সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে মেয়েটির গর্ভস্থ ভ্রূণটিও। যৎপরনাস্তি অভব্যতা করা হয় জেরার নামে, না মেয়েটি টলে না তার উকিল । গল্প যে সময়কার ডিএনএ টেস্ট তখন কল্প বিজ্ঞান মাত্র। অন্তে মেয়েটিই জয়ী হয়, ছেলেটির সাথে অন্তিম মোলাকাৎ এর অডিও টেপ বাজিয়ে সর্ব সমক্ষে প্রমাণ করে দেয়, নায়ক বা এক্ষেত্রে প্রতিনায়কের সাথেই তার দৈহিক মিলন ঘটেছিল। আদালত ও মেয়েটির সপক্ষেই রায় দেয়।
এবার কি হল? মধুরেণ সমাপয়েৎ?একদম। মেয়েটি সর্বসমক্ষে জানায় ঐ জানোয়ারটাকে কে বিয়ে করবে? আমার শুধু সন্তানের পিতৃপরিচয় দরকার ছিল। সেটুকু পেলেই হবে। বাকি ওর মুখ দেখাও পাপ।
দারুণ না?সম্ভবত ৭০ বা ৮০র দশকের সিনেমা । কোন ছোটবেলায় সাদাকালো টিভিতে দেখা,আজো স্মৃতিপটে ভাস্বর। নায়িকা ছিলেন রতি অগ্নিহোত্রী আর নায়ক আমাদের প্রিয় মিঠুন দা। উকিল ম্যাডামের চরিত্রচিত্রণ কে করেছিলেন বলুন তো?রেখা।
এই সিনেমাটি বোধহয় কিছু মানুষকে দেখানো খুব দরকার। জাতে নারীবাদী বলেই হয়তো ঘোরতর সাম্যবাদী। পুরুষ ও নারীর সমাধিকারে বিশ্বাসী।  কারো প্রেমে পড়লেন, তারপর জেনেশুনে তার সাথে দৈহিক সম্পর্কে যুক্ত হলেন, খুব ভালো কথা। দুজনেই যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন কার কি বলার আছে। এবার গেল আপনার প্রেমটি চটকে,ওমনি  কাঁদতে লাগলেন,“বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করা হয়েছে” বলে? বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস ব্যাপারটা ঠিক কি? বলপূর্বক  সহবাস? তাহলে তখুনি থানায় গেলেন না কেন? আপনাকে ভয় দেখিয়ে সহবাসে বাধ্য করা হয়েছিল বা চুপ করিয়ে রাখা হয়েছিল কি?তাহলে অবশ্যই আইনের দ্বারস্থ হন। K
সিরিয়ালসি, প্রাণের হুমকি দিয়ে সহবাস, ফাঁসিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে সহবাস, দেনার দায়ে অথবা দেনা মুক্তির প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস,অভুক্ত দীনকে চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস সর্বক্ষেত্রে  আপনার হয়ে গলা ফাটাব। কারণ সেসব ক্ষেত্রে বাস্তবিকই আপননিই হলেন নির্যাতিতা। কিন্তু এই একবিংশ শতকে এসেও বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস?D
ভাবের ঘরে অনুগ্রহ করে চুরি করবেন না। কেউ যদি আপনাকে বিয়ে করব বলে আপনি  কি ওমনি বালিশ চাদর নিয়ে দৌড়ন? একটি অশিক্ষিত সহায়সম্বলহীন গ্রাম্য মেয়ের ক্ষেত্রে  মেনে নিতে পারি কিন্তু শিক্ষিতা উপার্জনশীল স্বাধীন মেয়েদের মুখে এই জাতীয় কাঁদুনী শুনলে আমার বিবমিষার উদ্রেক হয় বিশ্বাস করুন।
প্রেম করেছিলেন,ঘনিষ্ট হয়েছিলেন, সেটাকেই মায়ের মেয়ের মত স্বীকার করে নিন। নতুবা মনের কোন গহীন সিন্দুকে ঢুকিয়ে তালাচাবি মারুন। যদি ঐ মিলনের ফলে কোন সমস্যায়   হয়ে পড়েন তাহলে আপনার লড়াই উপরিউক্ত গল্পে বর্ণিতা নায়িকার মতই কুর্ণিশের যোগ্য, নতুবা নিজেকে করুণার পাত্রী বানাবেন না। R

আর একটা কথা সম্পর্কের নটে গাছটি মুড়োলেই ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও বা আবেগঘণ চিঠিচাপাটি, ছবি, ইমেল সর্বসমক্ষে   প্রকাশ করে দেওয়াটা একজন পুরুষ করলে  যতটা নক্ক্যারজনক ঠিক ততোটাই ঘৃণ্য যদি একজন মহিলা করে থাকেন। আইন আপনার পক্ষে বলে দয়া করে তার অপব্যবহার করবেন না।
প্রতিনিয়ত কত মেয়ে বাধ্য হয়ে সহবাসে লিপ্ত হয়, অনুগ্রহ করে তাদের অসম্মান তথা বেদনাকে আপনার ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের কষ্টি পাথরে ফেলে খাটো করবেন না। K
আমার পরিচিত এক গৃহপরিচারিকা অসুস্থ  সন্তানের ওষুধ কেনার টাকা জোটাতে পাড়ার ইস্ত্রিওয়ালার অঙ্কশায়ীনী হয়েছিল। জানাজানি  হবার কথা নয়, তবু মদের ঠেকে ইস্ত্রিওয়ালা দিল ব্যাপারটা ফাঁস করে। মহিলার সোয়ামী জানতে পেরে ইস্ত্রিওয়ালাকে কিচ্ছু বলল না,এক গেলাসের ইয়ার বলে কথা। বাড়ি ফিরে  মদের ঝোঁকে বউকে সর্বসমক্ষে উদোম পেটাল এবং পরদিন নেশার ঝোঁক কেটে যেতে, নষ্ট মেয়ে(ছেলে)র কষ্টার্জিত পয়সাগুলি কেড়েকুড়ে বউকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় বউয়ের সাথে থাকতে লাগল। নষ্ট মেয়েটি পাঁচ বাড়ি বাসন মেজে ছেলেকে বড় করল। সেইk ছেলেও একদিন মনের মত জীবনসঙ্গী জুটিয়ে নষ্ট মা(গী)কে ছেড়ে বস্তি ত্যাগ করে ভদ্র পাড়ায় উঠে গেল।  একটি অনিচ্ছাকৃত সহবাস পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল মেয়েটির জীবন। শেষ দেখেছিলামr হাওড়ার কুখ্যাত লালবাতি এলাকার সীমানা বরাবর তেলভাজা বিক্রি করত মেয়েটি। বহুবছর দেখিনি। জানি না কি অবস্থায় আছে।যখনই এই ধরণের সুখী সুখী ব্যর্থ প্রেম মার্কা সহবাসের কান্না শুনি আমার খুব মনে পড়ে শিবাণীদির কথা। কেমন আছো শিবাণীদি? D
অনির ডাইরি ৮ই অক্টোবর ২০১৭
সদ্য চাকরীতে ঢুকেছি, প্রথম পোস্টিং খড়্গপুর। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের জয়েন্ট বিডিওর সাথে সদ্য আলাপিত হয়েছি , বিয়ে থা আরো বছর দুই পরের গল্প। পশ্চিমবঙ্গ তখন শাসন করছে কারা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আসছে,বিভিন্ন দপ্তরের কর্ম তৎপরতাও বাড়ছে। এইসব জটিল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সমীকরণ কিছুই বুঝি না। ক্যাম্প হত ভুরি ভুরি। কারা যে ডাকত, কি যে হত, কিছুই বুঝতাম না। বস্ যেখানে পাঠাত যেতাম, ফেমিনা খুলে বসে থাকতাম,বস্ বলত ফিরে এস, মুক্তির আনন্দে পাখনা মেলে বাড়ি ফিরতাম।
পাশের দুই মহকুমায় দুই ঘনিষ্ট বন্ধু এএলসি গিরি করত। দুজনেরই স্বাধীন অফিস, আমার মত বসের অধীন নয়। দুজনেই সুপার এফিশিয়েন্ট, এ বলে আমাকে দেখ, তো ও বলে আমাকে। স্বঘোষিত ঢ্যাঁড়শ ছিলাম বলেই বোধহয় আমার প্রতি দুজনেরই এক ধরণের অপত্য বোধ ছিল। প্রায় প্রতিদিনই দুজনে ফোন করে খবরাখবর নিত। সুখ দুঃখের গল্প হত। এক বন্ধুর স্বামী বনবিভাগে কর্মরত ছিলেন,দৈর্ঘ্যে ছিলেন ছোটখাট্ট পাহাড়। নিজেরই যা আকৃতি, প্রস্থ নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার আমার নেই।
যাই হোক,জেলা পরিষদে কোন এক ডেভেলাপমেন্ট মিটিং চলছিল ঐ দাদাও এসেছেন তাতে,মিটিং শুরুর ঠিক মুখেই  জেলা পরিষদের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্মাধ্যক্ষ(যত দূর মনে পড়ছে) দাদার হাতে একতাড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এগুলি আপনার স্টাফ এবং অন্যান্য দের মধ্যে বিতরণ করে দেবেন। ”মিটিং এর তাড়াতুড়োয় দাদা ভালো করে দেখেননি বা শোনেনওনি। ভেবেছেন হয়তো নতুন কোন স্কিম টিম হবে। পরে ভুলেও গেলেন যথারীতি। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার পর খেয়াল হতে বার করে দেখেন, পার্টির মুখপত্র তথা প্রচার পুস্তিকা। গোটাটাই ওণার স্ত্রীর মুখে শোনা, ওণার হাতে ঐ কাগজ ধরিয়েছে দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে উনি তৎক্ষণাৎ সেই কর্মাধ্যক্ষকে ফোন করেন এবং প্রবল চিৎকার করে জানান,“আপনার সাহস হয় কি করে? আপনি একজন সরকারী আধিকারিকের হাতে দলের কাগজ ধরান?আপনি জানেন না, আমরা সরকারী কর্মচারী, আমাদের কোন রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না বা দলের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকতে পারে না। ”
তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওণার বলা ঐ কথাগুলো বলার মত মেরুদণ্ডের জোর অনেক তাবড় সরকারী আধিকারিকেরও ছিল না। দাদার বলা কথা গুলো শুনে সেদিন গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। শুধু আমি নয়, এই গল্প শুনে মোটামুটি আমার গোটা পরিবারই ওণার ভক্ত হয়ে পড়ে।
যাই হোক এত কথা এই কারণেই বলা যে সচেতন ভাবে কখনই কোন রাজনৈতিক ব্যাপার বা কোন বরেণ্য নেতা বা নেত্রীকে নিয়ে কখনই কিছু লিখি না, অন্তত সচেতন ভাবে তো নয়ই।  একে তো রাজনীতি বুঝিই না হয়তো সেটাই আসল কারণ, কিন্তু বন্ধুর মুখে শোনা  ঐ দাদার বলা বুলিও কানে বাজে।
কিন্তু আজ সকালে যখন ঘুমই ভাঙল ভারতবর্ষের কোন একটি রাজ্যের কোন এক নিগৃহীতা নারীর কথা পড়ে তখন বুঝতে পারলাম না কি বলব। পুজোর সময় আমার এক ঘনিষ্ট বান্ধবী বলছিল,“ তোর ঐ সম্পর্কিত লেখা গুলো আমি পড়ি নারে অনি। নিতে পারি না। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। ” এই ঘটনাটি কিন্তু দম বন্ধকরা ভয়েরই। দু বছরের শিশু সন্তানকে ডাক্তার দেখিয়ে বাইকে বাড়ি ফিরছিল বাবা মা।বাইক থামিয়ে প্রখর দিবালোকে আখের খেতে টেনে নিয়ে যায় মাকে জনা চারেক দুষ্কৃতি। বাচ্ছার গলায় ছুরি ঢেকিয়ে---
আখরি রাস্তা বলে একটা সিনেমা এসেছিল, দূরদর্শনেই দেখা, যাতে অমিতাভর ডাবল্ রোল ছিল, পিতা এবং পুত্র। জয়াপ্রদা এবং শ্রীদেবীও ছিলেন। তাতে এমন একটি সিন ছিল, জয়া প্রদার শিশুকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে, তাকে নিগ্রহ(ভোগ পড়লেই ভাল)পরেশ রাওয়াল। কোন ছোট বেলায় দেখা, আজও ভুলিনি দৃশ্যগুলি। ফেসবুকেও দেখলাম অনেকে বলছে অশ্লীল সিনেমা, অর্ধ উলঙ্গ নায়িকাদের নাচ তথা ইন্টারনেটই ঐ রাজ্যের ছেলেদের চরিত্র খারাপ করে দিচ্ছে। আমার বন্ধু মহলে কেউ কেউ বলবেন ফাঁকা আখের খেতে যাবার দরকার কি ছিল?বরের সাথেই পাঠিয়ে দিতে পারত? যার যা অভিরুচি। মেয়েদের বাড়ি থেকে না বেরোতে দিলেই যে দেশ শুদ্ধ হয়ে যাবে, এই নিয়ে কোন প্রশ্নই ওঠে না।
যাক গে এত তিক্ততাতেও যেটা ভেবে মজা  লাগল, সেটা হল ঐ রাজ্যের মাননীয় মূখ্যমন্ত্রী দিন কয়েক আগে ভারতবর্ষের সবথেকে শিক্ষিত শালীন রাজ্যের সাথে নিজেদের তুলনা করে দক্ষিণভারতের ঐ রাজ্যটিকে তুলোধোনা করেছেন, যেখানে লাভ জিহাদ হয়, সেটা আবার বসবাসের উপযুক্ত রাজ্য নাকি?যেখানে চিকনগুনিয়ায় মানুষ মারা যায়, সেখানে আবার চেউ বসবাস করে নাকি। ছোঃ। ছোঃ।
স্যার জী দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির স্বজাত-অজাত-কুজাতে বিয়ে নিয়ে ব্রেন স্টর্মিং এর অঢেল সময় পাওয়া যাবে,কারা যেন আপনার রাজ্যে ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা দেখছে,থানায় টেনে এনে প্রেমিক যুগলকে ঠাসিয়ে চড় মারছে,  লাভ টাভ ছাড়াও যদি মেয়েদের নূন্যতম  নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়, সেটা যদি একটু দেখেন। আর একটা অনুরোধ পারলে ওয়াক্ত সিনেমাটা যদি আর একবার দেখেন, আহাঃ সেই যে রাজকুমার♥♥ সাহবের অমর উক্তি,“জিনকে ঘর শিশে কে হোতে হ্যায়, উহ্ দুসরে কে ঘরফে পাত্থর নেহি ফেঁকা করতে”। এই সব উঠতি (নামতিও বটে) ছোঁড়াদের ঠিক বিশ্বাস করা যায় না জানেন তো, আজ পরের বহু-বেটিকে ধরে টানাটানি করছে, কাল যে কার কি ধরে টানবে, উলঙ্গ রাজা কবিতাটিও যদি, নাঃ থাক --- আর না বলাই ভাল। সরকারি নৌকর কি না।

অনির ডাইরি ৭ই অক্টোবর  ২০১৭
দিন তিনেক ধরে এক নতুন আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছি। কি সাংঘাতিক সে আকর্ষণ বাপস্। একটা খেলা, অবশ্যই মোবাইলে, যার নাম চয়েজ। একটা গল্প গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলবে, মাঝে মাঝেই, আপনি যার এক বা একাধিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  চরিত্র এবং নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, ঐ চরিত্রগুলির হয়ে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যার কিছু কিছু আবার তৎক্ষণাৎ। সিদ্ধান্ত  ভুল হলেই,“তু শালা কামসে গ্যায়া। ” আমি যেমন ইতিমধ্যেই বার চারেক সদ্গতি প্রাপ্ত হয়েছি। আবার নাক কান মুলে ফিরে আসতে হয়েছে।  সঠিক হলে তেমনি  আবার একটু  এগিয়ে যাবেন। 
আমি এমনিতেই সিদ্ধান্ত নিতে তেমন দড় নই। বিয়ের আগে, সব সিদ্ধান্তই বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে মনের সুখে কাপ্তেনি করে বেরিয়েছি। বিয়ের পর অবশ্য বাবা আর পাত্তা দেয় না। বর তো কোনকালেই দেয়ই না। যাই হোক গেমে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক সহজ, যদি ক্রমাগত কোন গুড়গুড়ে ভয়ার্ত স্বরে আপনার কানের কাছে বিড়বিড় করতে থাকে,“কি করছ মা?ফোনে গেম খেলছ?” আমাদের বাড়িতে মোবাইলে গেম খেলা এক্কেবারে বর্জিত। শুধু ভৎসনাই নয় ব্যাপারটা বিবাহবিচ্ছেদ অবধিও গড়াতে পারে। ফলে এমনিতেই লুকিয়ে চুরিয়ে খেলতে হয়,তার ওপর সুগ্রীব দোসর। তুত্তুরীকে যত বলি ওরে এটা গেম নয়, এটা একটা বই।তবু,“মা তুমি ব্লু হোয়েল খেলছ কিন্তু। বাবাকে বলে দেব। ” একবার ভাবলাম স্নানঘরে দরজা বন্ধ করে খেলি।  অতঃপর পরিকল্পনা পাল্টাতে বাধ্য হলাম, হাত ফসকে জলে পড়লে আর রক্ষা নেই। মিথ্যা মিথ্যা বললাম, গেম অব থ্রোনস্ পড়ছি। তুত্তুরী কি অত বোকা? “সে তো ট্যাবে পড়তে। এমনি বই, এত লোকজন, আগুন,রাজপ্রাসাদ এসব তো দেখা যেত না। তুমি ব্লু হোয়েল খেলছ। আমি জানি। পুলিশকে বলে দেব। ”
পুলিশের প্রতি কোন রকম অসম্মানকর শব্দাবলী প্রয়োগ করতে অপারগ, কারণ বহুক্ষেত্রে পুলিশের ভয় দেখিয়েই তুত্তুরীকে ঘুম পাড়ানো হয় বা মোবাইল থেকে দূরে রাখা হয়।
এতো গেল পারিপার্শ্বিক,  কিন্তু মুস্কিল করছে গেমটাও। খেলার শুরুতেই জানতে চেয়েছিল কি ধরণের খেলা খেলতে চাই রোমান্স না রোমাঞ্চ। যথেচ্ছ রোমান্স হয়েছে ইহ জীবনে বাপ, আর সাহেবী রোমান্স চাই না। খেলায়ও রোমান্স থাকলে নির্ঘাত বদহজম হবে। অগত্যা রোমাঞ্চ । কিন্তু সেখানেও ওরা ঠিক করেই রেখেছে দুটি চরিত্রের মধ্যে গভীর প্রেম বাঁধিয়েই ছাড়বে। আর আমি কিছুতেই তা হতে দিচ্ছি না। যতবার অপশন দিচ্ছে-১ হাগ হার ২স্টেপ ব্যাকোয়ার্ড। পিছিয়ে আসছি। বার তিনেক একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছে, কেন বাঁচালে আমায়-অপশন ছিল- ১হামি তুমাকে ভালোবাসি ২গাধা নাকি তুই?এতদিনেও লড়তে শিখিলি না? আমি ২ই দিলাম। সুন্দরী পুতুলের ওষ্ঠাধর ফুলে উঠলেও কিচ্ছু করার নেই।
একদিকে তুত্তুরী আর একদিকে উটকো ভালোবাসার অত্যাচার কতক্ষণ টানতে পারব কে জানে?

No comments:

Post a Comment