Monday 4 December 2017

অনির ডাইরি

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০১৭

এমনিতে আমি সমসাময়িক রাজনৈতিক বা সামাজিক ঘটনা বা সমস্যাবলী নিয়ে কোন পোস্ট করি না। পারতপক্ষে এই ধরণের পোস্টগুলিতে মন্তব্য করা থেকেও নিরত থাকি, কারণ আর কিছুই না, অজ্ঞতা। দিনান্তে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে বা লিঙ্ক ক্লিক করতে কেন জানি না তীব্র আলস্য বোধ হয়। নিজে তেমন একটা প্রতিবাদ করি না বলে এই নয় যে বা যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাদের প্রতি মানসিক সমর্থন থাকে না, অবশ্যই থাকে এবং এক ধরণের শ্লাঘাবোধও থাকে যে এই প্রতিবাদী ব্যক্তিটি আমার বন্ধুতালিকায় জ্বলজ্বল করছেন। পোস্টে মন্তব্য করে নিজের মতামত জানাতে ভয় লাগে জানেন, তালজ্ঞান আমাদের বড়ই কম। আপাত সাধারণ মন্তব্যকে এমন ভাবে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয় বা হতে পারে যা প্রায়শই সহনসীমা লঙ্ঘন করে যায়।
কিন্তু তবুও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করাটা আবশ্যক হয়ে পড়ে। যেমন কিছুদিন আগে আমাদের জনৈক প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতা দিবস ছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কোন প্রতিবেশী দেশের প্রতিই আমার কোন আলাদা অনুরাগ বা বিরাগ নেই। বংশতালিকা অনুসারে আমার উর্ধ্বস্থ চতুর্দশ পুরুষ এপাড় বাংলারই বাসিন্দা। ফুটবলের “ফ”ও বুঝি না, বুঝতে যে খুব একটা ইচ্ছুক তাও নই, কিন্তু মোহনবাগান জিতলে “যত বার ডার্বি/ততোবার হারবি” মার্কা পোস্টে হৃদয় উজাড় করেদি। মিমকে কিছু বছর আগেও মেমে পড়লেও, ম্যাচ জিতে ফেরা সিংহসম মোহনবাগান সমর্থকদের মিম সগর্বে শেয়ার করি। মোদ্দা কথা, আমি গর্বিত ঘটি, প্রতিবেশীয় সাহিত্যের চূড়ান্ত অনুরাগী বটে, তার বাইরে তেমন কোন অনুরাগ নেই আর কি। সাম্প্রতিক কালে ক্রিকেট খেলা নিয়ে দু দেশের দর্শকবৃন্দের মধ্যে যে অশালীন মিম এবং ভাষাবিনিময় হয়েছে তা যে কোন সুস্থ মানুষকে মানসিক ভাবে পঙ্গু করতে পারঙ্গম। শুধু এক তরফা প্রতিবেশীদের দোষ দেবেন না, আমাদের তরফ থেকেও উস্কানিদাতার সংখ্যা কিছু কম ছিল না।
যাই হোক,আম ভারতীয় হিসেবে এ ক্ষোভ আমারও কিছু কম নেই, যে বাপু তোমাদের চরম দুঃসময়ে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম,আর আজ সুযোগ পেলেই তোমরা কথায় কথায় আমাদের, “রেন্ডিয়ান” বলে সম্বোধন কর? কিন্তু তাই বলে একজন গর্বিত ভারতীয় হিসাবে প্রতিবেশীর স্বাধীনতা দিবসে, “আমরা না থাকলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে তোরা বিলুপ্ত হয়ে যেতিস” বা “আমাদের উচিত হয়নি তোদের পাশে দাঁড়নো” বা “বেইমান চূড়ামণি” এই ধরণের কুরুচিকর পোস্ট ও মেনে নেওয়া যায় না। একথা অনস্বীকার্য যে “যেমন লাস্ট সিনে স্লো মোশনে ডিস্যুম ছোঁড়ে গুরু” মার্কা ক্লাইম্যাক্সে ইন্ডিয়ান আর্মির প্রবেশ ওঁদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে রাতারাতি দাঁড়ি লাগিয়ে দেয়, কিন্তু তাই বলে এক কথায় ন মাস দীর্ঘ স্বাধীনতার লড়াইকে এইভাবে নস্যাৎ করে দেবেন? যাতে শহীদ হন কমপক্ষে ৩ লাখ মানুষ, ধর্ষিত হন দুই থেকে চার লক্ষ নারী তাঁদের আত্মবলিদান এই ভাবে অসম্মান করার অধিকার কারো আছে কি? ফেসবুকে উস্কানিমূলক পোস্ট করছেন যখন, তখন একেবারে হাঁদাগঙ্গারাম বা নাবালক নন আশা করি, একটু তলিয়ে ভাবুন তাহলেই বুঝবেন, যে কেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী (ব্যক্তিগত ভাবে আমি যাঁর চূড়ান্ত অনুরাগী) প্রতিবেশী দেশে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। প্রথমতঃ বিশ্বের দরবারে প্রমাণ করা, যে হ্যাঁ আমরা নিপীড়িত আর্ত জনগণের পাশে আছি । পশ্চিমের প্রতিবেশী কতোটা অপোগণ্ড তা বিশ্বের দরবারে প্রমাণ করা। যাতে একলাফে আমাদের ইজ্জত অনেকটা বেড়ে যায়।আর দ্বিতীয়ত জন্মশত্রু প্রতিবেশী যাতে কখনই পূর্ব-পশ্চিমে সাঁড়াশি আক্রমণ না চালাতে পারে, তাই অত্যন্ত নিপুন ভাবে কাঁকড়ার দাঁড়া ভেঙে দেওয়া। এটা আমার মত গোলা, গাম্বাট, ইতিহাস না জানা পাবলিকের মাথায় যখন ঢুকছে, আপনার মাথায় তখন না ঢোকার কথা নয়। তবুও যদি আপনি মনেপ্রাণে  বিশ্বাস করে থাকেন,যে প্রতিবেশীর দুর্দিনে আমরা তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম,সেটা আমাদের মহানুভবতা তাতেও কোন অসুবিধা তো নেই। কুৎসিত  ভাষায় তা জাহির করার কোন দরকার আছে কি? আর্তের পাশে দাঁড়াতে পারা গর্বের ব্যাপার, কিন্তু তাই নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গর্ববোধ এবং প্রতিবেশীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা কোথাও না কোথাও অত্যন্ত নিম্নরুচি তথা শিক্ষার অভাবকেই পরিস্ফুট করে। যত বিশাল আমাদের দেশ হৃদয়কেও ততোটাই প্রসারিত করুন না। নিজেদের যদি এই উপমহাদেশের বড়দা বলে মনেই করেন, তাহলে বড়দা সুলভ বড় মনের অধিকারী হন না বাপু,ভালো থাকুন এবং ভালো রাখুন।

অনির ডাইরি ৭/১২/১৭
দীনু কাকু, অর্থাৎ শ্রী দীনবন্ধু ভট্টাচার্য উসকে দিল স্মৃতিটা। কি যে এক ইয়ের অ্যাপ এসেছে, আর গোটা ফেবু মেতে উঠেছে প্রশ্নোত্তরের  খেলায়। যতজন এই প্রশ্নোত্তরের  খেলায় অংশ গ্রহণ করেছেন, কারো জবাব দীনু কাকুর ধারে কাছে আসে না। জবজবে ন্যাকামির রস সিক্ত প্রশ্নকেও সপাটে ওভার বাউণ্ডারি মারা বোধহয় কেবল দীনু কাকুই পারেন।
যাই হোক প্রশ্নটা ছিল,“দা মোস্ট ডিলিসিয়াশ মিল আই হ্যাভ এভার হ্যাড”- দীনু কাকু বললেন, “at বঙ্গলক্ষী হোটেল in 1974”। সত্যি বলছি জীবনে নামই শুনিনি। তাই আর উচ্চবাচ্য করলাম না। কিন্তু কেউ বোধহয় জানতে চাইলেন, কোথায় এই বঙ্গলক্ষী হোটেল? জবাব পাওয়া গেল- বহুবাজার আর কলেজ স্ট্রীটের ক্রশিং এ। এবার এল সেই অবধারিত প্রশ্ন, খেয়েছিলেন কি? যার স্বাদ  ৪৩বছর পরও মুখে লেগে আছে? দীনু কাকু বলতে শুরু করলেন,“ভাত, মুসুর ডাল, বেগুনভাজা, পালংশাকের ঘন্ট, ইলিশমাছের ঝাল, রুইমাছের কালিয়া, চাটনি, দই ।” উলস। জিভে জল চলে এল মাইরি।
হঠাৎ করে শান্তিনিকেতন হোটেলের কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় বলুন তো? না না হাওড়া কলকাতা ছাড়ুন,বীরভূমেরও ত্রিসীমানায় খুঁজে পাবেন না। শান্তিনিকেতন হোটেল ছিল খড়্গপুরে, ইন্দা মোড়ের কাছে। ২০০৭সাল। লেবার সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই পাঠিয়ে দেওয়া হল খড়্গপুর। ইন্দা মোড়েই আমাদের অফিস। হাওড়া থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করতাম। সকাল আটটায় চায়ের সাথে মার হাতের চাট্টি গরম ভাত খেয়ে, বিশাল ব্যাগ(সত্যি মাইরি বাবা একটা চটের ফ্যান্সি বাজার ব্যাগই কিনে দিয়েছিল, আদরের মেয়ের খাবার আর জল বয়ে নিয়ে যাবার জন্য) ভর্তি টিফিন, জলের বোতল,ছাতা, ট্রেনে পড়ার ইয়া মোটা গল্পের বই নিয়ে বেরোতাম।
যাই খাবার নিয়ে যাই না কেন, ট্রেনে উঠলেই খিদে পেত এবং সারাদিন খিদে পেতেই থাকত। টাকা যেমন টাকা টানে,মোটিরাও বোধহয় মোটিদেরই আকর্ষণ করে। অচীরেও গলায় গলায় দোস্তি হয়ে গেল নবনীতার সাথে। দুজনের কেউই চেহারা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিলাম না। ট্রেনে ওঠা থেকে খাওয়া শুরু হত। ঝালমুড়ি, দশটাকায় দশটা পাতি লেবুর সাইজের মুসাম্বি, কুচো গজা, ঘুঘনি, বাদাম, চিট বাদাম যাকে বাদাম পাটালি বলে আর কি ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনদিন কিছু না খেলে হকাররা এসে জ্বালাত,“আজ খেলেনি কেন?” আবার ফেরার পথে ট্রেনে একই কাণ্ড ঘটত।
কে যেন সেই সময় আমাদের জ্ঞান দিল, “তোমরা ভাতের সময় ভাত খাউনি, তাই তোমাদের এত খিদে পাউছু”। সত্যি। সত্যি। সত্যি।
শুরু হল ভাতের হোটেল খোঁজা। নবুর অফিস এবং আমাদের অফিস তোলপাড় করে একটাই ভাতের হোটেলের নাম পাওয়া গেল। ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন খড়্গপুর, দা ওয়ান এণ্ড ওনলি শান্তিনিকেতন হোটেল। প্রথম দিন আমরা টিফিন টাইমে গেছি, দুটো বাজছে সবে। ও বাবা, থিকথিকে ভিড়। কতলোক যে বসে খাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। দূর পাল্লার বাসের যাত্রীরাও বউ বাচ্ছা সহযোগে খেতে বসেছে। ভাত লে আও। ডালটা এট্টু দেখি, মাছ দে রে চিৎকারে আবহাওয়া সরগরম।  আমাদের বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, একজন ডেকে বসিয়ে দিল।স্কুলের বেঞ্চের মত বেঞ্চ পাতা। নীচুতে বসলাম, ওপরে খাবার এল। শালপাতার থালার ওপর কলাপাতা পাতা। গরম ভাত, অ্যালুমিনিয়ামের বালতি থেকে কাঁচের ডিশে করে খপাৎ করে তুলে যেটা নবনীতার পাতে ঢালল, তাতে আমরা দুজন খেয়েও আর একজন খেতে পারে। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম, ভাগ করে নেব বাপ। আর দিস না। এবার এল নুন,লঙ্কা আর পাতি লেবু।ছোট স্টীলের বাটিতে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ডাল। সদ্য সাঁতলানো হয়েছে, পাঁচ ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কার গন্ধে ম ম করছে। এরপর ইয়া বড় বড় চাকা চাকা বেগুন ভাজা। আহা গরম ডাল বেগুন ভাজা লেবুর রস আর কাঁচা লঙ্কা চটকে গরম ভাত--- স্বর্গীয় অনুভূতি। এরওপর পড়ল দুটি ইয়া বড় বড় পোস্তর বড়া। উলস। সত্যি বলছি দাদা, মা কালীর দিব্যি। পেঁয়াজ কুচো কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পোস্তর বড়া। তারপর ছোট স্টীলের বাটিতে সর্ষে বাটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে গরম জিভ পুড়ানো বাটা মাছের ঝোল। বাটা মাছটা এত বড় যে,মুণ্ডুটা বাটিতে ডোবানো আর লেজটা শূণ্যে উঠে আছে,অনেকটা বাংলার ৯এর মত দেখতে। শেষ পাতে চাটনীর নামে যেটা এল,  সেটা অবশ্য কলকাতার স্বাদে হাল্কা মিষ্টিওলা পাতি টমেটোর ঝোল। তা হোক। দিলখুশ খানার পর মুখ হাত ধুয়ে ইন্দা বাজার থেকে পান কিনে যে যার অফিসের দিকে রওনা দিলাম, তবে অফিসে ঢোকার আগে আমাদের অফিসের নীচের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি দই খেতে ভুলিনি। ঐ দোকানের বৃদ্ধ মালিক এককালে আইপিটিএর হয়ে গ্রামে গ্রামে পালাগান করে বেড়াতেন। পরবর্তী কালে সে সব আদর্শ  কাঁসাই এর জলে ভাসিয়ে মিষ্টির দোকান খোলেন। বড় স্নেহ করতেন আমাদের। মাঝে মাঝেই আমাকে ডেকে মিষ্টি খাওয়াতেন, দাম দিতে গেলেই ওণার অভিমান হত। দামের বদলে বসে ওণার গান শুনতে হত। চোখ বন্ধ করে মাটির সুরে সমাজের নানা সমস্যা, অনাচার,দিনবদল  আর শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে গান বাঁধতেন জেঠু। ভাবলেই মন ভালো হয়ে যায়।এই দম বন্ধ করা ইঁট কাঠ পাথর সোশাল মিডিয়া ভাইরাল ভিডিও লাভ জিহাদ খুন ধর্ষণ নির্যাতন থেকে বহুদূরে আমার আর নবুর লালনীল খড়্গপুর। আজীবন অমলিন।

অনির ডাইরি ৪/১২/১৭

স্পষ্ট অস্পষ্টের মায়াজালাক্রান্ত স্মৃতি।এটুকু মনে আছে, বড় মামার বিয়ে ছিল সেই সময়। মায়ের খুড়তুতো ভাই, বংশের বড় ছেলে, তার বিয়েতে না গেলে হয়?তখন নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরু। মহানগরে ততোটা না হলেও সুদূর মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম রামনগরে জাঁকিয়ে বসেছে শীত। বিয়ে বাড়ির হুল্লোড়ের পাশাপাশি মাচা থেকে লেপ কম্বল  পাড়া,রোদে দেওয়ার কাজ চলছে পূর্ণোদ্যমে। ভোর বেলা হুহু করতে করতে কাঁচা ঘুমে উষ্ণ মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়াতো দিদা। বড় মামা আর্মিতে ছিলেন। শুধু বড়মামা কেন, রামনগর-কাদখালি-বাছড়া গ্রামের সব সমর্থ পুরুষই বেলডাঙা ক্যাম্প দিয়ে মিলিটারিতে ঢুকত। গ্রামে ঘুরতো আড়কাঠি, এক্স আর্মি ম্যান। ট্যাকা দাও চাকরী নাও। জমি বেচে চাকরীতে ঢোকো, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার টাকা জমিয়ে জমি কেনো,গরু কেনো, মাটির বাড়ি সারাও,পাকা বাড়ি তোলো। বিয়ের সম্বন্ধ এল বলে, বর্তমান ধ্যানধারণা অনুসারে রূপসী না হলেও ঐ সময় চলনশীল মোটামুটি ডাগরডোগর মেয়েদের বাবারা রেডিও,সাইকেল, হাতঘড়ি এবং সে যুগে চমকে ওঠার মত নগদ নিয়ে পাত্রের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ত।
বড় মামার সাথে তার দুই আর্মি ম্যান বন্ধুও এসেছিলেন বিয়েতে। অজ গ্রাম। ইলেকট্রিসিটি দূর অস্ত। শৌচাগার স্নানাগারের কথা বলে আর সফিস্টিকেটেড ফেবু জনতাকে লজ্জা দিতে চাই না। কিন্তু ঐ দুই মিলিটারি  মামার তাতে কোন সমস্যা ছিল বলে মনে পড়ে না। দিব্যি বাড়ির ছেলে হয়ে মিশে গিয়েছিলেন।
বিয়ের দিন, বর যাবে পাল্কি করে। ছোটদা নীতবড়, বরের সাথে তার পাল্কি চাপার কথা। আমি এমন কান্না জুড়লাম, ছোটদা আমাকে পাল্কি চাপার সুযোগ করে দিয়ে সরে গেল। পলাশী থেকে দুটো স্টেশন পর সেই নবগ্রামের ভিতর দিকে মেয়ের বাড়ি। বিশাল জোড়া নৌকায় বরযাত্রীরা গঙ্গা পেরিয়ে এপাশ থেকে বাসে উঠল। লাক্সারী বাস না। বড় বাস, যেগুলি দূর পাল্লায় চলত তখন নদীয়া মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাসের নামটা কি ভাবে যেন আজও মনে আছে। বাস থেকে নেমে বর যাত্রীরা হেঁটে যাবে, আর আমি আর বর পাল্কিতে। আমরা আগে পৌঁছলাম। বড় মামিমার মা,বরকে বরণ করে নীতবরকে বরণ করতে গিয়ে থতমত খেয়ে একসা কাণ্ড। ছোটদা আজোও মাঝেমাঝেই মাথায় গাঁট্টা মারে, ওর ভাগের লাইমলাইট খেয়ে নেওয়ার জন্য।
যাইহোক, বিয়ে হল, আলো জ্বালিয়ে, কিসের আলো মনে নেই হ্যাজাক সম্ভবত।  বাবা বা দাদারা ভালো বলতে পারবে। আমি এতই ছোট ছিলাম যে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম ছোট মাসির কোলে। সেই ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। বর আসবে- নতুন বউ আসবে এই উন্মাদনায়।
রামনগরে খবরের কাগজ গিয়ে পৌঁছত প্রায় সূর্য ডোবার সময়। ইলেকট্রিসিটি নেই ফলে টিভির কোন গল্পই নেই। জনগণমাধ্যম বলতে রেডিও। যাতে খুব সহজে রেডিও বাংলাদেশ এবং রেডিও সিলোন আসত,কিন্তু বিবিধ ভারতী কখনই ধরা যেত না। কলকাতা ক এবং খ মাঝে মাঝে ঝাঁকি দর্শন দিত বটে তবে তার জন্য রেডিওটিকে নিয়ে রীতিমত কসরত করতে হত। কি নিস্তরঙ্গ জীবন ছিল ভাবুন।দেশ যদি রাতারাতি শত্রুপক্ষের করায়ত হয়ে যেত তাহলেও বোধহয় দিন দুয়েকের আগে রামনগরবাসীরা কিছুই জানতে পারত না। কারো খুব একটা জানার উৎসাহও ছিল বলে মনে হয় না। দেশ বা জাতীয় সংবাদের তুলনায় স্থানীয় গ্রাম্য পরনিন্দা পরচর্চাতেই অধিবাসীরা অধিক বরং বলা চলে অত্যধিক উৎসাহী ছিল।
ব্যতিক্রম ছিলেন বড় মেসোমশাই এবং অবশ্যই কিছুটা আমায় ছোট মেসোও। ছোটোর উৎসাহে বড় সকাল থেকেই রেডিও নিয়ে কসরত করছিলেন,হঠাৎ কি যে হল,বড় মেসোমশাই চিৎকার করে উঠলেন চুপ চুপ চুপ। শর্ট ওয়েভে ইংলিশ খবরে এমন কিছু বলছে, যে ক্ষণিকের মধ্যেই চূড়ান্ত নীরবতা নেমে এল উৎসবমুখর বিয়ে বাড়িতে। যারা ইংরাজি বুঝল না,তাদের বাংলায় বুঝিয়ে দিল পাশের জন। কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে বুঝতে পারলাম। বহু লোক রাতারাতি মারা গেছে। বড় মামা বিয়েতে আসা এক ভদ্রলোকের পরিবার থাকেন ঐ শহরে। তিনি উদ্ভ্রান্তের মত খানিক দৌড়দৌড়ি করলেন। তারপর হাঁচোড়পাঁচোড় করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কিচ্ছুটি দাঁতে না কেটে। তখন মোবাইল ছাড়ুন ল্যাণ্ডফোনই দুর্লভ। বিস্তীর্ণ  অঞ্চল জুড়ে একটাও ল্যাণ্ডফোন থাকত না। যারা ফেবুতে আঁতেল মার্কা পোস্ট দেয় যে মুছে যাক সোশাল নেটওয়ার্ক, হারিয়ে যাক মোবাইল, পাড়ার মোড়ে শুধু একটা ডায়ালটোন ওলা ফোন থাকুক। লুপ্ত হোক ইমেল। ফিরে আসুক চিঠি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের আমার সিরিয়াসলি মাইরি,“ক্যালাতে” ইচ্ছা করে।বাপ তোরা জঙ্গলে গিয়ে থাক। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব যে আমাদের কতদূর এগিয়ে দিয়েছে,তা সেদিনের কথা ভাবলেই বুঝতে পারি। কি সাংঘাতিক মানসিক অবস্থা হয়েছিল ওণার তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবে একজন ইস্পাত শীতল মিলিটারি ম্যান ও নিজের পরিবারের বিপদ সম্ভবনা দেখলে আলুভাতে মার্কা হয়ে যায় তা আমার স্বচক্ষে  প্রত্যক্ষ করা।
শোকের আবহে বিয়ে বাড়ি শেষ হল। রেডিও ছেড়ে নড়লেনই না দুই মেসোমশাই। দাদা মামারা সেই খবরের তর্জমা করে জনে জনে পরিবেশন করতে লাগল।
দেখতে দেখতে রামনগর আর আমাদের আশু বিরহে মুষড়ে পড়া দিদাকে ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম আমরা। বাড়ি ফিরেও সেই একই আলোচনা। ইণ্ডিয়া টুডের প্রচ্ছদে হাড় হিম করা সেই ছবি, একটা শিশু, আমাদেরই বয়সী হবে,যার খোলা দুই ঘোলাটে চোখে মৃত্যুর শীতলতা। বোধহয় কবর দেওয়া হবে,কারণ মাথা এবং গলার অনেকটাই মাটিতে ঢাকা। কি মিষ্টি,কি নিষ্পাপ একটা শিশু। ঘুমের মাঝে বেঘোরে মৃত।  যার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলার কেউ নেই। কে ফেলবে?সবাই তো মারা গেছে।  পাহাড়ের ওপর থেকে গভীর রাতে চুপি চুপি নেমে এসেছিল মৃত্যুদূত।যার পোশাকী নাম মিথাইল আইসোসায়ানেট।  পথে যাকেই পেয়েছে গিলে নিয়েছে।বিশ্বের জঘণ্যতম ইণ্ডাসট্রিয়াল ট্রাজেডি।  সরকারী মতে মৃতের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিনহাজারের একটু বেশী (৩৭৮৭) আর বেসরকারী মতে? ১৬,০০০। সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়ে যায় রাতারাতি। প্রায় আট হাজার মানুষ সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যেই মারা যান। অতঃপর চলতে থাকে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা। বিচারের বাণী কেঁদে ককিয়ে গলা শুকিয়ে মরে  । মূল কালপ্রিটকে সযতনে কারা যেন পগার পার করে দেয়। জ্যাঠাইমা যেমন আমাদের দেখলেই প্রচ্ছদা উল্টে রাখত। তেমনি ছেলে ভুলানো ল্যাবেঞ্চুস ধরিয়ে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা চলে কিছুদিন। তারপর?জনতার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক দুর্বল। রোজ নতুন নতুন উত্তেজক খবর চায়। ওসব পচাপাতকো খবরে আর কার মাথা ব্যথা।
৩৩বছর কেটে গেছে ভোপাল গ্যাস লিক কাণ্ডের। কেউ মনে রাখেনি। কেউ কথা রাখেনি।
#Bhopaltragedy

No comments:

Post a Comment