Sunday 30 December 2018

সব চরিত্র কাল্পনিক


তো যা বলছিলাম আর কি, আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন।অবশ্যই বাংলা মিডিয়াম, আশি-নব্বইয়ের দশকে মধ্য হাওড়ার সেরা গার্লস স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যালয়। আজও আমাদের মত প্রাক্তনীরা নিজেদের তারা বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি।
তো এইরকম জনাকয়েক তারাদের একটা গ্রুপ আছে। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ। সদস্য সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। চট করে সেখানে কোন নতুন সদস্যকে আমরা সংযোজিতও করতে চাই না।কারণ আর কিছুই নয়, আসলে এই গ্রুপে আমরা সকলে বড় বেশী অকপট। গালাগালির কোন রাখঢাক নেই,বরং শালীন ভাষায় সুচারু ভাবে নিজের বক্তব্য পেশ করতে গেলে অনেক সময়ই উদোম খিস্তি খেতে হয়। পাতি কলতলার ঝগড়া মার্কা ঝগড়াও হয় মাঝেসাঝে, কলহরতারা ছাড়া বাকিরা তখন নারদ নারদ জপি। “নারদ নারদ খ্যাংড়া কাঠি,লেগে যা নারদ ঝটাপটি।” অনেকেই তাদের বরকে নিয়ে,ইয়ে মানে বরের শারীরিক সমস্যা,শীতলতা ইত্যাদি নিয়ে খোলাখুলি ঘ্যানঘ্যান করে, সহকর্মী বিশেষ করে ওপরওয়ালাদের গুষ্টি উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে অবশ্য সবথেকে সোচ্চার আমাদের চয়ন। চয়নের পূর্বের বস ছিলেন এক ভয়ানক সুদর্শন হরিয়ানভি জাট, কিন্তু চয়নের কেন যে তাকে অপছন্দ  ছিল কে জানে?দিনের শুরুটাই চয়ন করত, “সাতসকালে শালা আমার হারামি বস্ মেসেজ করল,দিনটাই খারাপ যাবে বা-। ” চয়ন যখন চাকরী ছেড়ে অন্য ফার্মে গেল, আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম,যাক “হারামি বস্” এর হাত থেকে রেহাই পেল গ্রুপটা। ও বাবা,কিছুদিন বাদেই বস্ ফেরৎ এলেন গ্রুপে,ইনি অবশ্য বাঙালী এবং মহিলা, তাতে কি? চয়নের মতে ইনি নাকি  “রক্তচোষা হারামি বস্। ”বস্ নাকি যাকে পায় তার সঙ্গেই সটান শুয়ে পড়ে। দুপুরে টিফিন বক্স খোলার সাথে সাথে হোয়াটস্অ্যাপ খুললেই হুড়মুড় করে ঢোকে চয়নের মেসেজ,“মালটা এই ঢুকল। কার সাথে ইয়ে করতে গিয়েছিল কে জানে?দুটো জুনিয়রকে দুবগলে নিয়ে ঢুকলেন তিনি। পঞ্চাশ বছুরে বুড়ি জামাকাপড় পরেছে দেখো না! কালো স্প্যাগেটি টপের ওপর স্বচ্ছ সাদা শার্ট। সব দেখা যাচ্ছে মাইরি। মালটাকে এই চোদ্দ তলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব?” হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়।

তো যাই হোক এই খোলাখুলি আলোচনা গুলিকে জিইয়ে রাখার স্বার্থে আমরা গ্রুপে নতুন সদস্য সংযোজনে ভয়ানক নারাজ। এর আগে তুলিকা আর হৈমন্তীর পেড়াপিড়িতে দুই তারাকে সংযোজন করা হয়েছিল। তাদের একজন বিশ্বসংসারে বলে বেরিয়েছিল, “চয়ন,সঞ্চিতা,মৌটুসি আর অনির কি মুখ খারাপ। উঃ মাগো কি অশ্লীল কথাবার্তা বলে।” মাইরি বলছি আমাদের আঙুল খারাপ হলেও মুখটাকে আমরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখি। আরেক তারাতো বেছে বেছে শুধু তাদের সাথেই কথা বলত, যাদের বা তাদের বরেদের বাড়ি-গাড়ি এবং ব্যাঙ্কে লক্ষাধিক টাকাপয়সা আছে। সে কি কেলো বাপরে! বাকিদের সাথে মামুলী কুশল বিনিময়েও তার ঘোর আপত্তি।  বারবার ভদ্রভাষায় বলেও তাদের সংশোধন করা গেল না,তখন চয়ন পার্সোনাল মেসেজে আমার গুষ্টি উদ্ধার করে বলল,“হঠা শালা শাঁখচুন্নি দুটোকে। ”

সেই শেষ। বিগত দু বছরে তুলিকা অন্তত বাহান্ন বার সাড়ে পঞ্চাশ জনকে সংযোজন করতে বলেছে, আমরা করিনি। পাছে তুলিকা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে করে বসে,এই আশঙ্কায় আমরা তুলিকাকে অ্যাডমিন পব থেকেই সরিয়ে দিয়েছি।

নতুন সদস্য সংযোজনে আমার আর চয়নের এই আপত্তি অবশ্য ধোপে টিকল না, লাবু অর্থাৎ লাবণীর ক্ষেত্রে। তুলিকা কোন কথাই শুনল না। রীতিমত আল্টিমেটাম দিল,“লাবুকে অ্যাড না করলে আমিও থাকব না। মেয়েটা খুব বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এই সময় যদি আমরা বন্ধুরা ওকে একটু সঙ্গ না দি, কে দেবে?” চয়ন তাও মিনমিন করে বলল,“তো যা না,বা-টা গিয়ে সঙ্গ দে। গ্রুপে অ্যাড করার কি আছে?” ঝাঁপিয়ে পড়ল হৈমন্তী আর নীলাঞ্জনা,“তুলির সাথে একমত। মেয়েটার খুব বাজে সময় যাচ্ছে। এই সেদিন বরটা মারা গেল,ঐ শোক না সামলাতে পেরে ওর মাও চলে গেলেন। একাহাতে মেয়ে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে বেচারা। ওকে অ্যাড কর। দুটো প্রাণের কথা বলার কেউ নেইরে ওর। আমরা সবাই এত দূরে দূরে থাকি-। ”
সত্যি বলছি লাবুকে আমি,সঞ্চিতা বা চয়ন তেমন চিনতাম না। ও অন্য সেকশনে পড়ত। যতদূর মনে পড়ে,বেশ শ্যামলা লাজুক একটা মেয়ে,পড়াশোনায়ও অতি সাধারণ ছিল। এগারো ক্লাসে আমাদের স্কুলে আর সুযোগও পায়নি। হাওড়া গার্লস্ এ পড়ত। তারপর আর কোন খবর জানি না। আসলে লাবু,তুলিকা, হৈমন্তী আর নীলাঞ্জনা একই পাড়ার মেয়ে,ফলে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বও একটু বেশী প্রবল। তো এ হেন লাজুক লাবুর জীবনের ওপর দিয়ে যে ইতিমধ্যে এত ঝড় বয়ে গেছে,সত্যি বলছি জানতাম না। বেশ সলজ্জ ভাবেই লাবুকে গ্রুপে অ্যাড করা হল।বেশ সেন্সরড্ ভাবে আলাপ-আলোচনা হল সেদিন গ্রুপে। কেউ তেমন মুখ খুলল না। কিন্তু যার জন্য এত সাবধানতা, সারাদিন সেই বাবুর পাত্তা নেই, অথচ যে যা লিখছে পড়ছে, এতো হেবি জ্বালা। পড়ে, খবর রাখে অথচ কিছু বলে না। তবে কি এও বাইরে খবর পাচার করবে?
গভীর রাতে লাবুর মেসেজ ঢুকল,“ভাই আমার এই বিপদের দিনে তোরা আমার পাশে দাঁড়ালি, অনেক ধন্যবাদ। সারাদিন তোদের সব মেসেজ আমি পড়েছি, বিশ্বাস কর। এত ভালো লাগছিল পড়তে। মনে হচ্ছিল বহুদিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছি। জবাব দেবার সময় পাইনিরে। আজ নাইট ডিউটি, সব পেশেন্ট আপাততঃ ঘুমোচ্ছে, তাই ভাবলাম এই ফাঁকে তোদের সাথে একটু কথা বলি। ভাই  তোরা সবাই বড় বড় চাকরী বাকরি করিস, যারা করিস না তাদের বরেরা করে, আমি ভাই ছাপোষা নার্স। তাও প্রাইভেট নার্সিং হোমে।নার্সিং পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, ভাবিনি কোনদিন চাকরী করতে হবে। বেশ ছিলাম বর-মেয়ে সংসার নিয়ে। হঠাৎ কি যে হল। ব্যবসায় ধাক্কা খেয়ে বরটা- একবার আমার আর মেয়ের কথা ভাবলও না জানিস।”দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। লাবু বোধহয় ব্যস্ত। কেউ কোন জবাব দিচ্ছে না। হয় ঘুমিয়ে কাদা,অথবা কি বা বলবে? এই তীব্র মনখারাপের বাতাস যেন বাতানুকূল যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে পাক খাচ্ছে ঘরের মেঝেতে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ভোরবেলায় উঠে দেখি, লাবু লিখেছে,“সব কথা তোদের জানালাম। আমি খুব সাধারণ রে,বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা,গয়নাগাটি,রূপযৌবন,শিক্ষাদীক্ষা গর্ব করার মত আমার কিছুই নেই ভাই, আমায় তোদের দলে নিবি তো?” জবাবটা নিজস্ব কায়দায় দেখলাম চয়ন দিয়েছে সকলের হয়ে,“নিয়ে তো নিয়েইছিরে বা-টা।”
(চলবে)

Saturday 22 December 2018

অনির ডাইরি 22.12.18

২২/১২/১৮

সে সব দিন ছিল সাদাকালো। চোখে ছিল কি সব অসম্ভব স্বপ্ন। আবিষ্কার করেই ছাড়ব টাইম মেশিন। তারপর পাড়ি দেব সুদূর অতীতে অথবা অনাগত ভবিষ্যতে। কে সেই ব্যক্তি, যার সাথে বাঁধা আমার গাঁটছড়া? এদিকে ফুটো ছাতে বছর বছর সোডা-সিমেন্টের প্রলেপ পড়ে চলে, যদি বাধ মানে অবাধ্য বরষা। গরম কালে বিকাল হলেই পশ্চিম আকাশের মুখ ভার, বাবার মুখে বুড়ো নরওয়েস্টারের গল্প-খুনখুনে সেই যে বুড়ো, যার বিশাল দাড়ির আনাচে-কাঁনাচে লুকিয়ে থাকে পশ্চিমী হাওয়া, বুড়ো দাড়ি ছেড়ে দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে “কালবোশেখী”। সাবেকী বার্মাটিকের কাঠের পাল্লা রোদে জলে ভিজে প্রায় পাঁপড় ভাজা-কালবোশেখীর তাণ্ডব যেমন বাড়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ে তার থরহরি কম্প। আর তারপর? উঠোন আর পশ্চিমের বাগান জুড়ে তিন ভাইবোনের হুড়োহুড়ি দিয়ে আম কুড়ানো। বিদ্যুতবাতি ততোক্ষণে ভোঁ কাট্টা। ডিসি কিনা,তাই জোরে হাওয়া দিলেই কেটে পড়ত তার। চিত্রহার-চিত্রমালা-ফরমান-দেখ ভাই দেখ-টুকুস করে লোডশেডিং। পাশের বাড়ির এসি কানেকশন-দিব্যি জ্বলজ্বলে, বিরক্ত চেপে জ্যাঠাইমা বলত,“এসিতো বড়লোকের কারেন্ট, তাই থাকে। আমাদের গরীব লোকের ডিসি কারেন্ট কি না-”। বড়দা পড়াতে বসলেই অবশ্য, মনেপ্রাণে প্রার্থনা জুড়তাম,“ হে ঠাকুর,দাও আলো নিভিয়ে। দাদা তো নয় যেন সাক্ষাৎ  থানার বড়বাবু। ” না মারত না কোনদিন,তবে জিভে যা ধার ছিল, তার থেকে দাদা দুঘা মেরেই দাও বরং। নিভত আলো, ছুটি থোড়াই দিত দাদা। বগলে করে মাদুর আর হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ছাতে পড়তে বসা-।
লোডশেডিং এর রাতে ছাতে শোওয়া-ওঃ সে কি উত্তেজনা। সাথে সাথে জেঠুর ভূতের গল্প। হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লেগে যেত।
অগ্রাণ মাসে নবান্ন। কাঁচা দুধে নলেন গুড় আর নতুন চাল,সাথে হরেক রকম ফলের টুকরো। জ্যাঠাইমার নবান্ন অতুলনীয়। বড়মাসি নবান্নে কাঁচা আদা দিত। কেন এত ভালো নবান্নকে মার্ডার করতে বড়মাসি?
শীত পড়লেই মাসিদের হাতে বোনা সোয়েটার। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে দিদার পাঠানো খেজুরে গুড়ের চাকতি। শীত পড়লেই বড় মাসির পিঠেপুলি বানানোর ধুম লেগে যেত। রাঙালুর পান্তুয়া, লাউয়ের পায়েস নিদেনপক্ষে ইলিশ মাছ বা খাসির মাংস, ভালো কিছু রান্না হলেই আমার তলব পড়ত। বড়দা বা সেজদা নাহলে ছোটদা আসত সাইকেল নিয়ে- বড়জেঠুর সাইকেলের স্পোকে একবার গোড়ালি ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম-বাপরে সেই থেকে খুব ভয় সাইকেলে চড়ায়। তবে বড়মাসির তলব-ভয় পালাত জানলা গলে। আতঙ্ক ছিল সেজমাসি,বাপস্ ধরতে পারলে হয়, ঘষে ঘষে পিতলের ঘটি মাজার মত করে চান করাত আর মাথা ঘষে দিত। শ্যাম্পু নয়,মাথা ঘষা বলতাম আমরা। চুল কাটার ওপর ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। আহাঃ একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, পাশের বাড়ির বৌদি বলত,“সাক্ষাৎ নজরুল”। বিকেল হলেই দড়ি নিয়ে চুল বাঁধতে বসত মেজো পিসি। বড় সযতনে চুল আঁচড়ে দিত, তাও এমন হল্লা জুড়তাম যেন ডাকাত পড়েছে। পশ্চিম আকাশ লাল করে ডুবত সূর্য, কুলায় ফেরা কাকদের চিৎকারে কানে তালা ধরে যেত, আসেপাশের বাড়িতে বেজে উঠত সন্ধ্যার মঙ্গলশঙ্খ।  ঠাকুমা আনমনে বলে উঠত,“বেলা কত ছোট হয়ে গেছে-”। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই-

ছোটো। পুরোনো  দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেবার জন্য।

Thursday 6 December 2018

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ৬ই ডিসেম্বর ২০১৮

সে একটা যুগ ছিল। ভোর হত আকাশবাণীর প্যাঁপো প্যাঁপো শুনে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আসর জমাত বিবিধভারতী। খেলা থাকলে, বিশাল সাবেকী রেডিওতে কলকাতা ক এ বাঙলা ধারাবিবরণী। অনুরোধের আসরে,প্রেম নিবেদন করত পাড়ার ঘন্টারা বেপাড়ার বুঁচিকে। লতাজীর মধুক্ষরা কণ্ঠ গেয়ে উঠত,“শায়েদ মেরে শাদিকা খ্যায়াল দিল মে আয়া হ্যায়”। শ্রাবন্তী মজুমদারকে গোপনে প্রেমপত্র পাঠাত পাড়ার দাদারা,“আয় খুকু আয়। ”
যখন তখন ঝুপ্ করে লোডশেডিং। গরম কালে ছাতে উঠে হাওয়া খাওয়া। মাথার ওপর সুবিশাল মহাকাশ, আর কালো আকাশে শত শত হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা। শীত হেমন্তে দেওয়ালগিরির ঝকঝকে কাঁচে ঠিকরে আসা আলো অন্ধকার কড়িবরগায় রচনা করত আজব নক্সা। গল্প করতে করতে মুছতে গিয়ে,গৃহপরিচারিকা দেবীদির হাতে প্রায়ই মটাং করে ভেঙে যেত হ্যারিকেনের চিমনি। মাসের প্রথমদিকে রবিবার মানেই খাসির মাংস। মাসের শেষে অবশ্য পোনা মাছ। রবিবার মানেই রবিবাসরীয় আর ঝপাং ঝপাং জামাকাপড় কাচার ধুম।শীত পড়তে না পড়তেই গরম জামা-লেপ কম্বল ছাতে রোদ খাওয়ানোর মরশুম।  রোদে তেতে থাকা লেপের ওপর গড়াগড়ি খাবার আনন্দে মাখামাখি দিন কাটছিল বেশ।

দেশজুড়ে যদিও উত্তেজনার পারদ চড়ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, চলছিল চাপানউতোর, ঘনিয়ে উঠছিল পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অমূলক ঘৃণার কালো মেঘ। তখন আমরা বেশ ছোট,স্কুলের গণ্ডী পেরোতে আরো অনেক বছর বাকি, রোজ সকালের আনন্দবাজার জুড়ে থাকত বিশাল বিশাল শিরোনাম। তার তলায় সাদাকালো ছবি। কি হচ্ছে বা হতে চলেছে তা বোঝার মত বুদ্ধি আমাদের ছিল না। আমাদের মহল্লা বা আসেপাশের মহল্লায়ও এই নিয়ে যে তেমন তাপোত্তাপ ছিল তা মনে পড়ে না। ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া তখন কষ্টকল্পনা মাত্র। সংবাদ মাধ্যম বলতে রেডিও যা প্রায় কেউই তখন শুনত না,আর দূরদর্শনে সাড়ে সাতটায় বাংলা আর রাত নটায় হিন্দি/ইংরেজি খবর। পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম।

সেদিনটা ছিল রবিবার। বাবা মায়ের হাত ধরে গেছি বড় মাসীর বাড়ি। জমাটি আড্ডার ফাঁকে, রাত নটার খবর চালানো হল। তখন তাই নিয়ম ছিল। বাড়িতে যত বড় অথিতিই আসুক না কেন,খবর বন্ধ হবে না। খবর শুরু হতেই মুহূর্তে নেমে এল শ্মশানের স্তব্ধতা। হাল্কা মনে পড়ে, কাটারী, শাবল,লাঠি হাতে বিশাল জনতার উন্মত্ত চিৎকার,“জয় শ্রীরাম। ” জনৈক সাধুবাবা হিন্দিতে বললেন,“করসেবা রুখ নেহি সাকতি। চাহে কোই সন্ত মহাত্মা রোকে,চাহে কোই নেতা রোখে। আজ ইস ধাঁচে কো গিরানা হ্যায়?কোর্ট অর্ডার কোনদিন মানিনি। মানব না। ” সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন,“আজ পাক্কা গিরালোগে?” জবাব পাওয়া গেল,“গিরনা তো চাইয়ে। পুরি তৈয়ারি কে সাথ আয়ে হ্যায়। ” “আগর নেহি গিরা তো?” “অ্যায়সা তো হো নেহি সাকতা,কিঁউকে-” আর বলতে দিল না পাশের সাধু। জোর করে চুপ করিয়ে দেওয়া হল।

কোন ধাঁচা?সেটাও দেখালো, ১৬শ শতকে তৈরি বিশাল এক মসজিদ। যার বিশাল গম্বুজগুলিও কেমন যেন ফুটন্ত টেনশনের  আঁচে কিঞ্চিৎ  বিবর্ণ। চতুর্দিকে বাঁশ আর দড়ি দিয়ে কর্ডন করা। মধ্য বয়সী জেলাশাসক এবং এসপি ঢুকলেন, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন,“সব ঠিক আছে তো?পিলপিল করে করসেবকরা ঢুকছে। কোন বড় দুর্ঘটনা বাঁধাবার পরিকল্পনা নিয়ে। ”সহাস্য জেলাধীশ এবং এসপি বলে গেলেন,“না। না। শান্তি বজায় থাকবে। কিচ্ছু হবে না। পুলিশ আছে তো।”
মূল হোতাতে কিছুতেই শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে দাবী করেছিল প্রশাসন। কিন্তু পুলিশ এবং প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে,ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরে বাইকে চেপে অকুস্থলে এসে হাজির হলেন সিংঘল। করসেবকদের মধ্যেও প্রবল ধস্তাধস্তি  লেগে গেল। মাথায় হলুদ ব্যাণ্ড পরা একদল তরুণ এতক্ষণ ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা করসেবকদের পিছনে ঠেলে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। পূর্বপরিকল্পিত কি?কে করল এতবড় পরিকল্পনা?দেশ এবং রাজ্যের এতগুলি গোয়েন্দা সংস্থা ঘুনাক্ষরেও কিছু জানতে পারল না?
প্রথম আক্রান্ত  হল মূল শ্রাইনের প্রবেশ দ্বার। মুষ্টিমেয় আক্রমণকারী করসেবকদের ছোঁড়া ইঁট কিছুক্ষণ আটকালো পুলিশ। কিন্তু কতক্ষণ ?লাঠিচার্জ,টিয়ারগ্যাস, শূণ্যে গুলি ছোঁড়া হল কি হল না, কিছুই বোঝা গেল না। হু হু করে ঠুকতে লাগল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করসেবক বাহিনী। নাম মাত্র ধস্তাধস্তি,ফাঁক গলে হুহু করে ঢুকতে লাগল জনস্রোত। পুলিশ শূণ্য শ্রাইনের গেট খুলে দিল কেউ। ততোক্ষণে পাঁচিল টপকে,ফাঁকা ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে আসছে উন্মত্ত জনতা। গম্বুজের মাথায় উড়ল গেরুয়া পতাকা। এটাই ছিল সঙ্কেত। হাতে থাকা অস্ত্র নিয়ে  শতাব্দী প্রাচীন এক স্থাপত্যের ওপর ধর্ষকাম উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধর্মান্ধ একপাল ভারতীয়। মাটিতে মিশে গেল একটা মসজিদ। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২এর সূর্য ডুবল এক চূড়ান্ত অশনি সঙ্কেত নিয়ে।
মন্দির না মসজিদ?বিংশ শতকের শেষ দশকে বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল তথা প্রগতীশীল দেশের মানুষ মত্ত হয়ে উঠল পরষ্পরের রক্ত পিপাসায়। দাঙ্গা শব্দটার সাথে নতুন করে পরিচিত হলাম। সারা ভারতব্যাপী দাঙ্গা। কার্ফু। দিনের পর দিন কার্ফু। সাঁজোয়া গাড়ি টহল দিতে লাগল হাওড়ার রাস্তায় রাস্তায়। দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ সংক্রান্ত সতর্ক বাণী জারি করা হল।
থামে। আবার শুরু হয়। ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে অবিশ্বাস আর ঘৃণার আগুন। প্রতিবাদ করলেই শুনতে হত,“ কাশ্মীরে যখন হিন্দু মন্দির ভাঙা হচ্ছিল, তখন চুপ করে ছিলেন কেন?” ইণ্ডিয়া টুডের মতে এই দাঙ্গার পিছনে প্রত্যক্ষ ভাবে কোন রাজনৈতিক দল সম্ভবত ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় কোন ঘটনা বা রেষারেষিই দায়ী ছিল। গোটা দেশে সংঘর্ষের বলি সরকারী মতে ১০০০। নির্বিচারে চলে লুটপাট। দেশের যে কোন প্রান্তে সম্মিলিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠি তুললেই, শুনতে হয়,“ অত বড় মসজিদ ভাঙার সময় লাঠি তুলতে পারো নি, আর সামান্য প্রতিবাদে লাঠিচার্জ?” দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের আড়ালে হুহু করে ঝরতে লাগল রক্ত।  সুরাট, আহমেদাবাদ,ভোপাল, বম্বে,আসাম, উত্তর প্রদেশ,বিহার,রাজস্থান, কেরালা এমনকি পশ্চিমবঙ্গ। বম্বেতে তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। গাড়ির টায়ারকে দুইদিকে  ল্যাম্পপোস্টের সাথে টানটান করে করে, অ্যাসিড ভর্তি কাঁচের বোতল গুলতির মত ছোঁড়া হত বিপক্ষের ওপর। নিন্দুকে বলে,এই সময় যতলোক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে মারা গেছে তার থেকে অনেক বেশী মানুষ মারা যায় পুলিশের গুলিতে।৫ই ডিসেম্বর ২০১১সালে ইন্ডিয়া টুডে ঐ সময় মৃত বহু মানুষের পরিবার পরিজনদের সাক্ষাৎকার নেয়। তাতে উঠে আসে নানা চমকপ্রদ তথ্য। ১৭-১৮বছরের তরুণ, গণ্ডগোল শুনে দেখতে গিয়েছিল স্টেশনের কাছে কি হচ্ছে,পুলিশ অন্ধের মত গুলি চালায়। গোড়ালীতে গুলি খেয়ে কোন রকমে বুকে হেঁটে বাড়িও ফিরেছিল ছেলেটা,শেষ রক্ষা হয়নি। বাড়ি ঢুকে বুকে গুলি করে মারে দুই কনস্টেবল।তারপর কেটে গেছে ছাব্বিশটা বছর। নাকি কাটেনি। আজকাল প্রায়ই মনে হয়,শুধু যেন আমাদেরই বয়স বাড়ছে,দেশের বয়স বুঝি আটকে আছে সেই যুগেই, অথবা পিছিয়ে গেছে আরো আরো আরো বহুযুগ পিছনে। কে জানে?
#ফিরেদেখা  ©Anindita Bhattacharya

Tuesday 4 December 2018

অনির ডাইরি ৪/১২/১৯৮৪-২০১৮


স্পষ্ট অস্পষ্টের মায়াজালাক্রান্ত স্মৃতি।এটুকু মনে আছে, বড় মামার বিয়ে ছিল সেই সময়। মায়ের খুড়তুতো ভাই, বংশের বড় ছেলে, তার বিয়েতে না গেলে হয়?তখন নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরু। মহানগরে ততোটা না হলেও সুদূর মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম রামনগরে জাঁকিয়ে বসেছে শীত। বিয়ে বাড়ির হুল্লোড়ের পাশাপাশি মাচা থেকে লেপ কম্বল পাড়া,রোদে দেওয়ার কাজ চলছে পূর্ণোদ্যমে। ভোর বেলা হুহু করতে করতে কাঁচা ঘুমে উষ্ণ মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়াতো দিদা। বড় মামা আর্মিতে ছিলেন। শুধু বড়মামা কেন, রামনগর-কাদখালি-বাছড়া গ্রামের সব সমর্থ পুরুষই বেলডাঙা ক্যাম্প দিয়ে মিলিটারিতে ঢুকত। গ্রামে ঘুরতো আড়কাঠি, এক্স আর্মি ম্যান। ট্যাকা দাও চাকরী নাও। জমি বেচে চাকরীতে ঢোকো, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার টাকা জমিয়ে জমি কেনো,গরু কেনো, মাটির বাড়ি সারাও,পাকা বাড়ি তোলো। বিয়ের সম্বন্ধ এল বলে, বর্তমান ধ্যানধারণা অনুসারে রূপসী না হলেও ঐ সময় চলনশীল মোটামুটি ডাগরডোগর মেয়েদের বাবারা রেডিও,সাইকেল, হাতঘড়ি এবং সে যুগে চমকে ওঠার মত নগদ নিয়ে পাত্রের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ত।
বড় মামার সাথে তার দুই আর্মি ম্যান বন্ধুও এসেছিলেন বিয়েতে। অজ গ্রাম। ইলেকট্রিসিটি দূর অস্ত। শৌচাগার স্নানাগারের কথা বলে আর সফিস্টিকেটেড ফেবু জনতাকে লজ্জা দিতে চাই না। কিন্তু ঐ দুই মিলিটারি মামার তাতে কোন সমস্যা ছিল বলে মনে পড়ে না। দিব্যি বাড়ির ছেলে হয়ে মিশে গিয়েছিলেন।
বিয়ের দিন, বর যাবে পাল্কি করে। ছোটদা নীতবড়, বরের সাথে তার পাল্কি চাপার কথা। আমি এমন কান্না জুড়লাম, ছোটদা আমাকে পাল্কি চাপার সুযোগ করে দিয়ে সরে গেল। পলাশী থেকে দুটো স্টেশন পর সেই নবগ্রামের ভিতর দিকে মেয়ের বাড়ি। বিশাল জোড়া নৌকায় বরযাত্রীরা গঙ্গা পেরিয়ে এপাশ থেকে বাসে উঠল। লাক্সারী বাস না। বড় বাস, যেগুলি দূর পাল্লায় চলত তখন নদীয়া মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাসের নামটা কি ভাবে যেন আজও মনে আছে। বাস থেকে নেমে বর যাত্রীরা হেঁটে যাবে, আর আমি আর বর পাল্কিতে। আমরা আগে পৌঁছলাম। বড় মামিমার মা,বরকে বরণ করে নীতবরকে বরণ করতে গিয়ে থতমত খেয়ে একসা কাণ্ড। ছোটদা আজোও মাঝেমাঝেই মাথায় গাঁট্টা মারে, ওর ভাগের লাইমলাইট খেয়ে নেওয়ার জন্য।
যাইহোক, বিয়ে হল, আলো জ্বালিয়ে, কিসের আলো মনে নেই হ্যাজাক সম্ভবত। বাবা বা দাদারা ভালো বলতে পারবে। আমি এতই ছোট ছিলাম যে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম ছোট মাসির কোলে। সেই ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে। বর আসবে- নতুন বউ আসবে এই উন্মাদনায়।
রামনগরে খবরের কাগজ গিয়ে পৌঁছত প্রায় সূর্য ডোবার সময়। ইলেকট্রিসিটি নেই ফলে টিভির কোন গল্পই নেই। জনগণমাধ্যম বলতে রেডিও। যাতে খুব সহজে রেডিও বাংলাদেশ এবং রেডিও সিলোন আসত,কিন্তু বিবিধ ভারতী কখনই ধরা যেত না। কলকাতা ক এবং খ মাঝে মাঝে ঝাঁকি দর্শন দিত বটে তবে তার জন্য রেডিওটিকে নিয়ে রীতিমত কসরত করতে হত। কি নিস্তরঙ্গ জীবন ছিল ভাবুন।দেশ যদি রাতারাতি শত্রুপক্ষের করায়ত হয়ে যেত তাহলেও বোধহয় দিন দুয়েকের আগে রামনগরবাসীরা কিছুই জানতে পারত না। কারো খুব একটা জানার উৎসাহও ছিল বলে মনে হয় না। দেশ বা জাতীয় সংবাদের তুলনায় স্থানীয় গ্রাম্য পরনিন্দা পরচর্চাতেই অধিবাসীরা অধিক বরং বলা চলে অত্যধিক উৎসাহী ছিল।
ব্যতিক্রম ছিলেন বড় মেসোমশাই এবং অবশ্যই কিছুটা আমায় ছোট মেসোও। ছোটোর উৎসাহে বড় সকাল থেকেই রেডিও নিয়ে কসরত করছিলেন,হঠাৎ কি যে হল,বড় মেসোমশাই চিৎকার করে উঠলেন চুপ চুপ চুপ। শর্ট ওয়েভে ইংলিশ খবরে এমন কিছু বলছে, যে ক্ষণিকের মধ্যেই চূড়ান্ত নীরবতা নেমে এল উৎসবমুখর বিয়ে বাড়িতে। যারা ইংরাজি বুঝল না,তাদের বাংলায় বুঝিয়ে দিল পাশের জন। কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে বুঝতে পারলাম। বহু লোক রাতারাতি মারা গেছে। বড় মামা বিয়েতে আসা এক ভদ্রলোকের পরিবার থাকেন ঐ শহরে। তিনি উদ্ভ্রান্তের মত খানিক দৌড়দৌড়ি করলেন। তারপর হাঁচোড়পাঁচোড় করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কিচ্ছুটি দাঁতে না কেটে। তখন মোবাইল ছাড়ুন ল্যাণ্ডফোনই দুর্লভ। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একটাও ল্যাণ্ডফোন থাকত না। যারা ফেবুতে আঁতেল মার্কা পোস্ট দেয় যে মুছে যাক সোশাল নেটওয়ার্ক, হারিয়ে যাক মোবাইল, পাড়ার মোড়ে শুধু একটা ডায়ালটোন ওলা ফোন থাকুক। লুপ্ত হোক ইমেল। ফিরে আসুক চিঠি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের আমার সিরিয়াসলি মাইরি,“ক্যালাতে” ইচ্ছা করে।বাপ তোরা জঙ্গলে গিয়ে থাক। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব যে আমাদের কতদূর এগিয়ে দিয়েছে,তা সেদিনের কথা ভাবলেই বুঝতে পারি। কি সাংঘাতিক মানসিক অবস্থা হয়েছিল ওণার তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবে একজন ইস্পাত শীতল মিলিটারি ম্যান ও নিজের পরিবারের বিপদ সম্ভবনা দেখলে আলুভাতে মার্কা হয়ে যায় তা আমার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা।
শোকের আবহে বিয়ে বাড়ি শেষ হল। রেডিও ছেড়ে নড়লেনই না দুই মেসোমশাই। দাদা মামারা সেই খবরের তর্জমা করে জনে জনে পরিবেশন করতে লাগল।
দেখতে দেখতে রামনগর আর আমাদের আশু বিরহে মুষড়ে পড়া দিদাকে ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম আমরা। বাড়ি ফিরেও সেই একই আলোচনা। ইণ্ডিয়া টুডের প্রচ্ছদে হাড় হিম করা সেই ছবি, একটা শিশু, আমাদেরই বয়সী হবে,যার খোলা দুই ঘোলাটে চোখে মৃত্যুর শীতলতা। বোধহয় কবর দেওয়া হবে,কারণ মাথা এবং গলার অনেকটাই মাটিতে ঢাকা। কি মিষ্টি,কি নিষ্পাপ একটা শিশু। ঘুমের মাঝে বেঘোরে মৃত। যার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলার কেউ নেই। কে ফেলবে?সবাই তো মারা গেছে। পাহাড়ের ওপর থেকে গভীর রাতে চুপি চুপি নেমে এসেছিল মৃত্যুদূত।যার পোশাকী নাম মিথাইল আইসোসায়ানেট। পথে যাকেই পেয়েছে গিলে নিয়েছে।বিশ্বের জঘণ্যতম ইণ্ডাসট্রিয়াল ট্রাজেডি। সরকারী মতে মৃতের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিনহাজারের একটু বেশী (৩৭৮৭) আর বেসরকারী মতে? ১৬,০০০। সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়ে যায় রাতারাতি। প্রায় আট হাজার মানুষ সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যেই মারা যান। অতঃপর চলতে থাকে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা। বিচারের বাণী কেঁদে ককিয়ে গলা শুকিয়ে মরে । মূল কালপ্রিটকে সযতনে কারা যেন পগার পার করে দেয়। জ্যাঠাইমা যেমন আমাদের দেখলেই প্রচ্ছদটা উল্টে রাখত। তেমনি ছেলে ভুলানো ল্যাবেঞ্চুস ধরিয়ে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা চলে কিছুদিন। তারপর?জনতার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক দুর্বল। রোজ নতুন নতুন উত্তেজক খবর চায়। ওসব পচাপাতকো খবরে আর কার মাথা ব্যথা।
৩৪বছর কেটে গেছে ভোপাল গ্যাস লিক কাণ্ডের। কেউ মনে রাখেনি। কেউ কথা রাখেনি।
#Bhopaltragedy #ফিরেদেখা

Saturday 1 December 2018

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজ নামচা -১লা ডিসেম্বর,২০১৮


সুপ্রভাত। শীতের মধুর আমেজে জারিত মহানগর। বাতাসে সদ্য নির্মিত কফির ভুরভুরে সৌরভ। তুষার ধবল পোর্সিলিনের কাপে প্রগাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ধুমায়িত কফি,আর পাশে মুড়ে রাখা পাট না ভাঙা খবরের কাগজ। এই তো জীবন কালি দা।
চলুন এগোনো যাক, পুত্রবধূর হাতে প্রহৃত হয়ে পুলিশের শরণাপন্ন জনৈক বৃদ্ধা। বাপস্। ডাইরেক্ট ঠ্যাঙানি? ব্যাপারখানা কি? বউ বলেছে,শাশুড়ী আমার শাড়ি ধরে টানাটানি করছিল,তাই মেরেছি এক ধাক্কা। তাতেও ছাড়ল না গো। তাই সাটিয়ে এক চড়। দুগ্গা দুগ্গা। যত অনাসৃষ্টির খবর গো। পিছনের পাতায় এই ধরণের রগরগে খবরই থাকে। আসল খবরের অভাব হলে,এগুলো দিয়ে ভরে দেয় আর কি। আমিও যেমন পিছন থেকে কাগজ পড়া শুরু করেছি।
চলুন এগোনো যাক। উরিঃ শালা।বোতল প্রতি ৪৮পয়সা তোলা তুলছে যেন কারা। মদ খাও, পকেট ভরো কর্মসূচী। চলুন এগোই।
রাতবিরেতে ফাঁকা হাইওয়েতে বউয়ের মুখে বিষের বোতল চেপে ধরল বর। সে কি? কেন?ওঃ সেই দেনাপাওনার গপ্প।  বাড়ির লোক বিয়ে হওয়া ইস্তক জামাইকে শান্ত রাখতে কতকিছু দিয়েছে তার লম্বা ফিরিস্তিও দিয়েছে দেখি। তালাক দিলে বোধহয় ফেরৎ দেবার প্রশ্ন উঠত। তাই যত্ন করে ডেকে এনে বিষের বোতল ঠুসে দেওয়া। বেচারা লোকটারে, এই মেয়েটা এখনও প্রাণ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। পাশের কলমের মেয়েটার শ্বশুরবাড়ি অবশ্য অত ঝামেলায় যায়নি। দেনাপাওনা মেটেনি,সোজা ধরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার বয়স কত দেখেছেন?মাত্র ১৯। বাঃ। পাশের কলমে দেখছি একটা বছর ১৬র  বিয়ে নাবালিকার ভেঙে দিয়েছে পুলিশ।  বাবা আর হবু বরের কোমরে দড়ি,হাতে হাতকড়া।তাও খাস কলকেতায়।  সত্যি মাইরি এদের অার শিক্ষা হবে না।
চলুন এগোই। উফ্ আবার সেই একই খবর। মেয়েজামাইয়ের অত্যাচারে পুলিশের দ্বারস্থ সম্বলহীনা বৃদ্ধা।কারা নাকি জানতে চেয়েছেন, কত নিয়ে মিটমাট করবেন মাসিমা?শুনেই সংজ্ঞালুপ্ত হয়েছে মাসিমার। চিত্রগ্রাহক বোধহয় প্রতীক্ষায় ছিল, সংজ্ঞাহীন মাসিমার ছবি তোলার জন্য।
বিরক্ত লাগছে মাইরি কাগজ পড়তে। ইনি দেখুন না,হনুমানের জাতবিচারে বসেছেন। তিনি দলিত ছিলেন না ব্রাহ্মণ,তা নিয়ে এই একবিংশ শতকে কি গ্যাসের বা তেলে দাম কমবে?গ্যাসের দাম অবশ্য কমেছে,দেখেছেন?কমবেই তো। বিশ্বের বাজারে তেল জল গ্যাস, সব সস্তা হয়ে গেছে। তবে আপনার বাড়ি পৌছে দিয়ে এখনও সাড়ে আটশো চাইবে হয়তো। তবু চার অঙ্কের থেকে তিনঅঙ্ক একটু প্রাণের আরাম। কি বলেন?
প্রায় শেষ করেই ফেলেছি কাগজ। কলেজ যাব না। ক্লাস করব না। কিন্তু পরীক্ষা দেবার অধিকার দিতে হবে। বাপ এর পরের দাবিটা কি করবি তোরা?পড়াশোনা করব না,বই আর মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দিন?পড়বে গুগল আর পাশ করব আমারা?তৈরি হবে জাতির ভিত। হরি হরি।

সকালের প্রশান্ত উৎফুল্ল  মেজাজের সাড়ে বারোটা বেজে গেছে মাইরি। বিশ্রী তেতো হাকুচ মার্কা খবর সব। ইনি কে?পতাকা হাতে কাগজ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন?পরণে পুরাণো, বিবর্ণ, কিঞ্চিৎ আলুলায়িত শাড়ি। ঋজু মেরুদণ্ড। দুচোখে ধকধক করছে নিজ অধিকার বুঝে নেবার দাবী। মুখের বলিরেখা, পায়ের ধুলো আর গায়ের পোড়া রঙে সসম্ভ্রমে পিছলে যাচ্ছে দিল্লীর সুখী সুখী রোদ। এই তো আমার দেশ। যে দেশ বলছে, মন্দির মসজিদ নিয়ে কি হবে?আমার ডালরুটি কই?

Sunday 18 November 2018

পায়ের তলায় সর্ষে, গন্তব্য চন্দননগর

রাস্তা মরে কেটে দুই লেন। তার অর্ধেক জুড়ে লরি আর আলো, তৈরি হচ্ছে আসন্ন বিজয়ার শোভাযাত্রার জন্য। একলেন দিয়ে দুই দিকের গাড়ি, বাইক, সাইকেল এবং টোটো। ফলশ্রুতি ভয়ঙ্কর যানজট। রাস্তায় একজনও উর্দিধারীর দর্শন পেলাম না। কেন কে জানে? হয়তো কয়েকদিন ধরে পূর্ণরাত্রি কর্তব্যপালন করে ভোর সকালে ক্লান্ত। 
এদিকে গাড়ি নড়েই না। কোন জায়গায় স্থানীয় যুবক,প্রৌঢ় (এমনকি তরুণরাও) ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে, তো কোন জায়গায় অমুক সিকিওরিটির জনাদুই নীলসাদা ব্যাণ্ডপার্টির মত ড্রেস পরা নভিস সদ্য যুবক। ফলশ্রুতি এক লহমা আগে যে রাস্তা দিব্যি গলে যাওয়া যেত, এখন সেখানে চিটচিটে জ্যাম। জনগণও তেমন সুবিধার নয়।যত্রতত্র বাইক ঢুকিয়ে দেয়। কিছু বলতে গেলেই চোখ রাঙায়। বাইক আরোহীরা এমনিতেই কারো তোয়াক্কা করে না, এখানে আবার গুচ্ছ গুচ্ছ সুন্দরী বাইকচালকের ভিড়। তবে এত কষ্ট করে যখন এণাদের শ্রীমুখ চোখে পড়ে প্রাণ ভরে যায়।

বড়ই রূপসী ইনি। নীলনয়না সুন্দরী। তবে ইয়ে মাপ করবেন মাননীয় কতৃপক্ষগণ, দেবীর গরিমা মনে হয় কিঞ্চিৎ কম। সোনার গহনা তেমন নেই। মুকুটের পাশে একটি সোনার ফুল টিমটিম করছে। রূপা অবশ্য প্রচুর। চাঁদমালা,মুকুট, কণ্ঠহার, কানপাশা,কেশদামের মাঝে লুকানো নাগরাজা। সিংহীর মুকুট। জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের সাজসজ্জা মোটামুটি একই। থিমের ঠাকুরের প্রাদুর্ভাব ঘটলেও উৎকট বিৎকট দেবীমূর্তি এখনও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোকে কলুষিত করতে পারেনি। দেবী এখনও সনাতনী। দৈর্ঘ্যে অতিকায়। রীতিমত সম্ভ্রম আদায়কারী। পরণে ডাকের সাজ। গোল মুখ। আকর্ণ আঁখি। বেশ ভারী,নাদুসনুদুস চেহারা। “ঢাই কিলোকা হাত” না হলেও যথেষ্ট ভারী নধর হাত। সোনা রূপার মুকুটকে ছাপিয়ে শোলার মুকুট চুম্বন করে চাঁদোয়াকে। সেই শোলার মুকুটে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। যেমন মনসাতলা, ভদ্রেশ্বরের এই দেবীর মুকুটে শোভা পাচ্ছেন মহেশ স্বয়ং। চলে আসার সময় সিংহের কানের পাশে একটা সোনার ঝাপটা বেশ কৌতুক উদ্রেক করল। সিংহীমশাইকে গয়না কেন বাপু,তিনি দেবীর ড্রাইভার বলে?



কলকাতার মত চওড়া রাস্তা বা বিশাল প্রাঙ্গণ কিছুই তেমন নেই চন্দননগর,ভদ্রেশ্বর বা মানকুণ্ডুর। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে সামান্য পরিসরে গড়ে ওঠে চোখ ধাঁধানো মণ্ডপ। যার প্রকৃত শোভা খোলে রাতের বেলা। ওয়েলকাম টু বাগবাজার,চন্দননগর। তেমাথার মুখে বিশালাকায় দেবী দণ্ডায়মান। গোটা মণ্ডপ জুড়ে অজস্র ছাতা, আজ্ঞে হ্যাঁ ছাতার কারুকাজ। ইনি যথেষ্ট জাগ্রত দেবী। গহনার আধিক্য দেখুন না। মাথায় রূপার ফিলিগ্রী করা অতিকায় মুকুট। কপালে ঝাপটা। সোনার ত্রিনয়ন। নথ। গলায় সোনার চিক এবং সীতাহার।এছাড়াও বেশ কয়েকটি সোনার হার। কানে রূপার কানফুল। হাতে রূপার বাজুবন্ধ। সোনার চুড়ি। রূপার দু দুটি চাঁদমালা। এমনকি সিংহীর মাথায়ও রূপার মুকুট।তবে ঠাকুর দেখবেন খুব সাবধানে, ডাইনে বাঁয়ে টোটো আর বাইকের অবাধ গতি যে কোন সময় আপনাকে দেবীর দরজায় পৌঁছে দিতে পারে। অবশ্য যদি যথেষ্ট পূণ্যকর্ম করে থাকেন। নাহলে কপালে হাসপাতাল দর্শন অবধারিত।



মণ্ডপসজ্জা চন্দননগর। ইনি কে জানি না ভাই। গোটা মণ্ডপ জুড়ে ভয়াল ভয়ংকর আদিম দেবদ্বিজের মূর্তি। ইনি তাঁদের অন্যতম। গোটা শরীর জুড়ে শুধু মুখ। চিনতে পারলে জানাবেন তো।