Saturday 13 January 2018

অনাির ডাইরি জানুয়ারি-এপ্রিল ২০১৮

অনির ডাইরি ২৯শে এপ্রিল, ২০১৮
শান্ত নিরিবিলি মফস্বল। গ্রাম বললেও চলে। ছবির মত সুন্দর সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি,শুধু বসবাস করার জন্য মানুষের বড় অভাব।বছর আশির বিপত্নীক লুইস যেমন একাই থাকেন। বহু বছর হল স্ত্রী গত হয়েছেন, একমাত্র কন্যা বহুদূরের কোন বিশাল শহরে নিজের জীবন নিয়ে বড় বেশী ব্যস্ত। কুসন্তান নয় অবশ্যই, সুযোগ পেলেই নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নেয়,এর বেশী সঙ্গ দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। বৃদ্ধ লুইস জানে, বোঝে, তার তেমন কোন অভিযোগও নেই। একাই থাকেন, টুকটুক করে ঘুরে বেড়ান,রান্নাবান্না, সাফসাফাই, দোকানবাজার করেন, স্থানীয় কফিশপে বৃদ্ধদের দৈনিক সমাবেশে অংশ নেন, তারপর নামে রাত।অখণ্ড নিঃসঙ্গতার সাথে সমঝোতা করতে করতে কেটেও যায়, আসে আরেক নতুন দিন একই ছন্দে।
লুইসের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ একদিন প্রবেশ ঘটে জনৈকা প্রতিবেশীনী অ্যাডির। প্রায় অর্ধ শতাব্দী জুড়ে দুই পরিবার পাশাপাশি   থাকলেও মুখচেনার বেশী ঘনিষ্ঠতা কখনই ছিল না তাদের।
অ্যাডিও এককী বিধবা, প্রায় আশি এবং ভয়ানক নিঃসঙ্গ। রাতের নৈঃশব্দ্যে অ্যাডি এক অদ্ভূত প্রস্তাব নিয়ে আসে। একত্রে রাত্রিবাসের প্রস্তাব। এই বৃদ্ধ বয়সে, এমন প্রস্তাব পেয়ে লুইস সম্পূর্ণ হতভম্ব  হয়ে পড়ে। সে মনোভাব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তার মুখে। অ্যাডি দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বলে, এই বয়সে অন্য কোন কুমতলব তার নেই। শুধু একজন সঙ্গীর বড় প্রয়োজন। দিনটা যেনতেন কেটে যায়, বিশাল ফাঁকা বাংলো প্যাটার্নের সাধের বাড়িতে রাত মানেই বিভীষিকা। আ্যাডি বলে,“বিশ্বাস কর, বহু বহু বছর যাবৎ আমি বিনিদ্র রজনী যাপন করি। অনেক ভেবে দেখেছি, আমার একজন সঙ্গীর বড় প্রয়োজন। যার সাথে এক বিছানায় সারারাত প্রয়োজনে গল্প করেও কাটাতে পারি।”
হতভম্ব অবস্থাতেই কোনোমতে লুইস জানায়, সে ভেবে জানাবে। অ্যাডি চলে যায়, যাবার সাথে সাথেই লুইসের জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা ভয়াবহ ভাবে প্রকট হয়ে পড়ে। সত্যিই তো বহু বহু বছর রাতে ঘুমোয় না লুইস। বিছানায় শোয় শুধু অভ্যাসবশতঃ, শুয়ে শুয়ে প্রহর গুণে কাটিয়ে দেয় রাত। সত্যিই তো, শুধু অ্যাডি নয়, লুইসের রাতগুলোও ভয়ানক বিভীষিকাময়।
মৃত স্ত্রীর ফোনের ডাইরি ঘেঁটে, অ্যাডিকে ফোন করে,রাত নটার সময়,নিশুতি পাড়ার রাস্তা টপকে, পিছনের দরজা দিয়ে অ্যাডির গৃহে প্রবেশ করে, লুইস। মন্দ কাটে না রাতটা। অ্যাডি সত্যিই শোওয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ে,লুইস জেগে থাকে বেশ কিছুক্ষণ, তারপর বহুবছর ধরে অপ্রসন্ন নিদ্রাদেবী ধরা দেন লুইসের বাহুবন্ধনে।
পরের রাতে আবার গিয়ে হাজির হয় লুইস। এইভাবেই নিঝুম রাতের বিছানা থেকে শুরু হয় এক নতুন সম্পর্কের। ধীরে ধীরে হৃদয়ের দ্বার অনর্গল করে দুজনেই, এতবছর ধরে জমে থাকা কতশত কথা,বেদনা, অপরাধবোধ, লজ্জা নির্দ্বিধায় ভাগাভাগি করে নেয় দুজনে। অ্যাডির জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে, খর দ্বিপ্রহরে গোটা মহল্লার সামনে দিয়েই অ্যাডির বাড়ি যাতায়াত  শুরু করে লুইস। ছোট্ট মফঃস্বলে ঝড় ওঠে মুচমুচে গুজবের। লুইসের বন্ধুবান্ধব রীতিমত ঘোষিত ভাবে ঈর্ষা করতে শুরু করে তার শারীরিক সক্ষমতার। দুজনের সম্পর্কটা যে সম্পূর্ণ শরীর বিবর্জিত, তা কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। ক্রুদ্ধ লুইস বর্জন করে তার দীর্ঘদিনের বুড়োর দলকে। দুই নিঃসঙ্গ বুড়োবুড়ি আরো কাছাকাছি  সরে আসে। গঠিত হয় লুইস আর অ্যাডির নিজস্ব বদ্বীপ।
জীবন যখন রঙীন, হঠাৎ দুজনের মাঝে এসে উপস্থিত হয় অ্যাডির বছর সাতেকের নাতি। বড় দুর্ভাগা শিশু, ঐ টুকু বাচ্ছা ফেলে তার মা নিরুদ্দেশ। বাবা বাধ্য হয়ে, ঠাকুমার কাছে রেখে যায় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। অ্যাডি লুইসের দৈনন্দিন রুটিন ভেঙে যেতে যেতেও যায় না, বাচ্ছাটাকে নিয়ে দুজনে এক অদ্ভুত স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে।
পরিস্থিতি যখন স্বপ্নের মত, দুই বৃদ্ধবৃদ্ধার জীবন যখন সুখে আনন্দে টইটুম্বুর,হঠাৎ অ্যাডিকে মফঃস্বল ছেড়ে চলে যেতে হয়, মাতৃহীন  নাতির দেখাশোনার জন্য। তসের ঘরের মত ভেঙে যেতে বসে লুইস-অ্যাডির বদ্বীপ। কিন্তু ভাঙে না, মুঠোফোনের বদান্যতায়  দুইজনে নতুন করে তোলে স্বপ্নের হাওয়ামহল। অথবা অটুট রাখে সাবেকী বদ্বীপ,হয়তো অচীরেই দেখা হবে দুজনার, অথবা এভাবেই মুঠোফোনের দুপাশে কেটে যাবে আরো অগুনতি রজনী, অথবা হঠাৎ করে একদিন বন্ধ হয়ে যাবে যে কোন একটা মুঠোফোন, চিরতরে। হতে পারে অনেককিছুই, জবাব জানেন শুধুই মহাকাল। আপাততঃ মুঠোফোনের দুইপারে দুই রাতজাগা প্রেমী মত্ত শুধুই নিভৃত অলাপচারিতায়।
ছবির নাম- আওয়ার সোলস্ এট নাইট। লুইসের চরিত্রচিত্রণে স্বয়ং রবার্ট রেডফোর্ড। আশি উত্তীর্ণ  কোন বৃদ্ধ যে এমন ভয়ানক আকর্ষণীয় হতে পারেন, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। প্রতিটি অনুভূতি এমন অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন,যে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা ছাড়া আপনি ওণার অভিনয়ের মাত্রানির্ধারণ করতে পারবেন না। আর অ্যাডির চরিত্রে জেন ফণ্ডা যেন চাবুক। পরিচালক একজন ভারতীয়, রীতেশ বত্রা। নামটা চেনা লাগল কি? আজ্ঞে হ্যাঁ, যাঁর পরিচালিত প্রথম সিনেমার নাম ছিল লাঞ্চবক্স। দুর্দান্ত গল্প, অসাধারণ অভিনয়, অনবদ্য পরিচালনা আর সব ছাপিয়ে রবার্ট রেডফোর্ডের পাগলকরা উপস্থিতি, পারলে দেখতে ভুলবেন না।

অনির ডাইরি, ১১ই এপ্রিল,২০১৮
এলেখা তাঁদের জন্য নয়,যাঁরা প্রতিনিয়ত আলস্য ভরে পোস্ট দেন, “আমি নারীবাদী নই। আমি সাম্য বাদী। ওসব নারীবাদ হল আসলে ‘নারী বদ’। বদ মেয়েদের স্বেচ্ছাচারিতা। ” এলেখা বাকি আণুবীক্ষণিক পাঠকের জন্য। নিয়ম করে কন্যাভ্রুণ হত্যার খবর যাদের কপালে ভাঁজ ফেলে, পার্কস্ট্রীট থেকে দিল্লী হয়ে, বারাসাত থেকে বদায়ুঁন হয়ে কামদুনী ঘুরে যারা উন্নাও এর অন্ধকারে হারিয়ে যান,গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা করে,অথচ কি বলবেন বুঝতে পারেন না।  এ লেখা শুধুই তাদের জন্য। 
দুহাজারের প্রথম দশকের প্রথমার্ধ, কেবল্ টিভির সদ্য অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের তিনজনের সাতরঙা সংসারে। কেবল্ মানেই সারাদিন খবর, কেবল্ মানে পৃথিবীর সবখেলার লাইভ ফিড, কেবল্ মানেই সোনি, Zee, স্টারপ্লাস, সর্বোপরি কেবল্ মানে এইচবিও। ছুতোনাতা পেলেই, ঘর অন্ধকার করে টিভি খুলে বসে যাওয়া। কত সিনেমা যে মাঝখান থেকে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই।

এইচবিওতেই তাদের সঙ্গে পরিচয়, মিনার্ভা, প্যাট্রিয়া, ডিডি এবং মারিয়া মিরাব্যাল। চার বোন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের এক পুঁচকে দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকের বাসিন্দা। শহরতলী নয় আদতে গ্রাম “ওহো ডি আগুয়া”,সেখানেই মিরাব্যালদের বিশাল খামারবাড়ি। প্রজাপতির মত উড়ে উড়ে কেটেছে তাদের শৈশব। কৈশোরের দরজায় কড়া নাড়তে না নাড়তেই নিস্তরঙ্গ খামারে ঝড় তুলল মিনার্ভা। বড়ই কটু তথা স্পষ্টভাষীনি সে, মেয়ে বলে কি লেখাপড়া শিখব না নাকি? বাবার বড় আদরের মির্নার্ভা বড় জেদী, গোঁ ধরে বসে রইল, অবশেষে রাজি হয়ে গেলেন প্রৌঢ় এনরিক। মিনার্ভা, ডিডি আর মারিয়া পাঁচ বছরের জন্য ভর্তি হল দামী আবাসিক স্কুলে।ভুঁইফোঁড় নাটুকে মিনার্ভা সেখানেও সর্দারনী, সেবার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অথিতি, মাননীয় রাফায়েল ট্রুহিজো। ১৯৩০ এর দশক থেকে ৬০ এর দশক পর্যন্ত ডোমিনিকান রিপাবলিকে একচ্ছত্র একনায়ক। তৎকালীন চার্চ থেকে ইন্টেলিজেন্সিয়া, ভূস্বামী থেকে গণমাধ্যম -সমস্তই ছিল ওণার পোষা সারমেয়তুল্য। ট্রুহিজোর দীর্ঘ শাসনের একটাই মন্ত্র ছিল,বিরোধীশূণ্যতা। প্রতিবাদী কণ্ঠ শুধু চেপে দেওয়া নয়, ঘ্যাচাং ফু।
তো এ হেন ট্রুহিজোর বড়ই মনে ধরল নাটুকে স্পষ্টভাষী ন্যাকামি বিবর্জিত মিনার্ভাকে। মিনার্ভার ডার্ক চকলেট রঙা ত্বক, উস্কোখুস্কো একরাশ চুল, ঋজু মেরুদণ্ড বড়ই চিত্তাকর্ষক। মিনার্ভার মনে তখন অন্য স্বপ্ন। স্কুল থেকে বেরিয়ে মোটেই সু-কন্যার মত বিয়ের পিঁড়িতে বসতে আগ্রহী নয় মিনার্ভা। তার স্বপ্ন ওকালতি। আইন পড়তে চায় মিনার্ভা। কিন্তু দেশের আইনে মেয়েদের আইন পড়া নিষেধ। অনুমতি দিতে পারেন কেবল ট্রুহিজো। মিরাব্যাল পরিবারকে চমকে দিয়ে আচমকা একদিন এক নিমন্ত্রণ পত্র এসে হাজির। নিমন্ত্রণকর্তা ট্রুহিজো স্বয়ং। এনরিক মিরাব্যাল কাঁপতে কাঁপতে স্ত্রী এবং চার কন্যা সহ পৌঁছলেন ট্রুহিজোর প্রাসাদে। বিশাল বল রুম, অসংখ্য নৃত্যরত জুটি,মিনার্ভার সাথে নাচতে নামলেন বৃদ্ধ ট্রুহিজো স্বয়ং। নাচতে নাচতে ফিসফিস করে নিজের মনের ইচ্ছা ট্রুহিজোকে জানিয়ে আইন পড়ার অনুমতি চাইল মিনার্ভা। জবাব এল “না। ” শুধু তাই নয়, সামান্য অসভ্যতাও করে ফেললেন সর্বশক্তিধর ট্রুহিজো। ফলাফল কল্পনারও অতীত, এইটুকু চাষীর মেয়ে মিনার্ভা সাঁটিয়ে কষাল এক চড়। অতঃপর? যাকে বলে “পিনড্রপ সাইলেন্স”। মিরাব্যাল পরিবার দৌড়ে এল মিনার্ভার পাশে। যাইহোক মিটিয়ে নিলেন ট্রুহিজো, কোথাও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নিরাপদে বাঘের ডেরা থেকে বেরিয়ে এল মিরাব্যালেরা।
বাড়ি ফিরে মিনার্ভার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মা। আহাঃ অত বড়া আদমি, নাহয় একটু ইয়ে করেছে, তাই বলে প্রকাশ্যে গায়ে চড়? দেখো এর পরিণাম কি দাঁড়ায়?(চেনা চেনা লাগছে কি?)
পরের দিনই এনরিক মিরাব্যালকে তুলে নিয়ে গেল ট্রুহিজোর পুলিশ। চার বোন আর বৃদ্ধা মা দৌড়ে বেড়ায় এই জেল থেকে সেই থানা, কেউ জানে না বৃদ্ধ কোথায়। খাতায় কলমে তাকে কেউ গ্রেপ্তার করেনি! ট্রুহিজোর প্রাসাদে আবার গিয়ে হাজির মিনার্ভা। বাবাকে ফিরিয়ে দিন। ক্রুর হেসে ট্রুহিজো বলল, দিতেই পারি, বদলে থেকে যাও আমার যৌনদাসী হিসাবে। শিকারকে জালে আটকে নির্মল হেসে ট্রুহিজো বললেন,“এসো পাশা খেলি। আমি জিতলে তো জানোই-আর তুমি জিতলে? তোমায় আমি নিরাপদে যেতে দেব। মুক্তি পাবে তোমার বাবা। চলো তোমাকে আইন পড়ার অনুমতিও দেব। ” হল খেলা। বিজয়ী মিনার্ভা। বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দ তেরাত্রি পোহালো না। অকথ্য অত্যাচারে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এনরিকের শরীর এবং মন। শেষ নিশ্বাসটুকু শুধু আটকে রেখেছিলেন প্রিয়জনেদের সান্নিধ্যের আর্ত প্রতীক্ষায়।
পিতাকে কবর দেবার মাঝেই পুলিশের হাতে আইন পড়ার অনুমতি পাঠালো ট্রুহিজো। অন্য নারী হলে হয়তো এত বড় অপমানে ভেঙে পড়ত। মিনার্ভা অন্য ধাতুতে তৈরি। ট্রুহিজোর প্রতি তীব্র ঘৃণার আগুনে বাতাস দিয়ে  ল স্কুলে ভর্তি হল মিনার্ভা। অচীরেই ট্রুহিজো বিরোধী প্রতিবাদী রাজনীতির মুখ হয়ে দাঁড়াল মিনার্ভা মিরাব্যাল। যাকে স্থানীয় ভাষায় অনুগামী তথা অনুরাগীরা বলত, ম্যারিপোযা। স্প্যানিশ ভাষায় প্রজাপতি।
এই ডোমিনিকান প্রজাপতিকে শেষ পর্যন্ত যদিও ডিগ্রীটা দেয়নি ট্রুহিজো, অন্তিম অধিবেশনে,সর্বসমক্ষে মিনার্ভার ডিগ্রীটা ছিঁড়ে ফেলে দেন তিনি,মেয়েমানুষ বলে কথা, পড়ার অনুমতি দিয়েছি,ডিগ্রী দেবার তো কথা ছিল না।
এরপর শুরু হয়,ট্রুহিজো বনাম প্রজাপতিদের দীর্ঘ অসম লড়াই। একদল সশস্ত্র তথা ধনী অন্যদল নির্ধন তথা নির্বল। এরই মাঝে বিয়ে হয় প্রজাপতিদের, সমমার্গের বিদ্রোহীদেরই বিবাহ করে মিরাব্যাল বোনেরা। সন্তানসন্ততি হয়। সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে পালা করে জেলে যাওয়া। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে জেলে ঢোকানো হয় মিনার্ভা, তার বোন এবং তাদের স্বামীদের। মিনার্ভার চরিত্রে মাতাল করা অভিনয় করেছিলেন সালমা হায়েক।

একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে,জেলে আছে মিনার্ভা, স্বামী তথা সদ্যোজাত সন্তানকে ছেড়ে থাকার বেদনায় দ্রবীভূত। মিনার্ভার সেই মানসিক শক্তি আজ শুধু গল্পকথা। ছোট ছোট করে কাটা চুলে উকুনের বাস,নোংরা আলখাল্লার ওপর দিয়ে থেকে ঘসঘস্ করে গা চুলকাচ্ছে মিনার্ভা, শারীরিক মানসিক অত্যাচারে মানসিক রোগীতে পরিণত হতে আর বেশী দেরী নেই, এমন সময়, সেলের ঘুপচি জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন, দূরে কে যেন কচি হাতে কাগজ জুড়ে বানিয়েছে এক কাঁচা প্রজাপতি, পতপত করে পাখা মেলে উড়ছে নীল আকাশে। ফিরে এস ম্যারিপোযা, ফিরে এস প্রজাপতি।

এর বেশ কিছু বছর বাদে হঠাৎই একদিন মিনার্ভার বাড়ি উপস্থিত হলেন ট্রুহিজো। কেমন আছো মিনার্ভা? নাকি প্রজাপতি বলে ডাকব তোমায়? সেই মুহূর্তে মিনার্ভার পাগল পাগল দশা। দীর্ঘদিন ধরে বর,একবোন এবং ভগ্নীপতিদের খোঁজ নেই। লড়াই করার শক্তি নিঃশেষিত। মিনার্ভা অনুরোধ করল, ওদের ছেড়ে দিন। ট্রুহিজো একগাল হেসে বলল, অবশ্যই, এবার তোমার সব দুখের রাতি পোহালো।তোমায় মুক্তি দিলাম যাও।
তিন মিরাব্যাল বোনকে অনুমতি দেওয়া হল, জেলে গিয়ে নিজেদের বর এবং বন্দিনী ছোট বোনের সাথে সাক্ষাৎ করার। সাক্ষাৎ করে হৃষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরছিল তিনবোন,আচমকা রাস্তার ওপর ঘিরে ধরল একপাল লোক। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল জঙ্গলে- তারপর? পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল তিন তিনটে প্রজাপতিকে। দিনটি ছিল ২৫শে মে ১৯৬০।
শোনা যায় প্রজাপতিদের মৃত্যুর পর বেশীদিন বাঁচেনি ট্রুহিজোর একনায়কত্ব। দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবের কাছে পরাস্ত হয় ট্রুহিজো। মিনার্ভার মৃত্যুর সাত মাসের মাথায় উন্মত্ত জনতা ঘিরে ধরে কুকুরের মত গুলি করে মারে ট্রুহিজোকে।
২৫শে নভেম্বর যেদিন পিটিয়ে মারা হয়েছিল তিন বিদ্রোহী “নারী বদ”কে,সেই দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘ পালন করে, “ডে ফর এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেন্স্ট উইমেন”। উন্নাও এর সাথে তো ডোমিনিকান রিপাবলিকের তো কোন মিল নেই,তবু কাগজ খুললেই কেন বারবার প্রজাপতিদের কথা মনে পড়ছে বলুন তো? কেন মন চাইছে, আর একটি বার,  ফিরে আসুন ম্যারিপোযা

অনির ডাইরি ৪ঠা এপ্রিল, ২০১৮
কার মুখ দেখে  যে সেদিন বেরিয়েছিলাম, দৌড়তে দৌড়তে বিধাননগর স্টেশনে পৌঁছে দেখি, চোখের সামনে দিয়ে কল্যাণী লোকাল বেরিয়ে গেল। ভারতীয় রেলের কাছে এহেন  নিয়মানুবর্তিতা এক্কেবারেই কাম্য নয়। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট দশ পরে যেখানে ট্রেনের আগমন বার্তা ঘোষিত হওয়াই দস্তুর, সেখানে এভাবে এপ্রিল বোকা বানানোর কোন মানে হয়? 
অথচ দেখুন পরের ট্রেনটির কাছে এই ব্যতিক্রমী নিয়মানুবর্তিতা আশা করে, কি সুন্দর ঠকে গেলাম। তিনি যথারীতি স্বমহিমায় ১৫মিনিট লেটে ঢুকলেন। শুধু কি তাই? গোদের ওপর বিষফোঁড়া মার্কা পিত্তি জ্বালিয়ে, গুটি কয় ষ্টেশন দৌড়েই দাঁড়িয়ে পড়লেন। দাঁড়ালেন তো দাঁড়িয়েই রইলেন, যাকে বলে নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু। ঘটিগরমের মত মুচমুচে হাতেগরম গুজবের মাঝেই গমগমিয়ে উঠল, ঘোষকের কেজো স্বর, “সোদপুর স্টেশনে অবরোধের জন্য আপ এবং ডাউনের সমস্ত গাড়ি চলাচল আপাতত বন্ধ।“
অবরোধে ট্রেনে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। জীবনের প্রথম অবরোধে আটকে থাকার অভিজ্ঞতা আমৃত্যু ভুলব না। হাওড়া খড়গপুর লাইনে, ক্ষীরাই আর হাউর নামক দুই ষ্টেশনের মাঝে আটকে ছিলাম আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। ভরা গ্রীষ্ম। সকাল ৮টা ১৩ এর মেদিনীপুর লোকাল,পাঁশকুড়া স্টেশনে অধিকাংশ যাত্রী নামিয়ে তুলনামূলক ফাঁকা হয়ে, সবে ক্ষীরাই পেরিয়েছে, দুপাশে জনমানব বর্জিত এক্কেবারে মাতাল করা ঘন সবুজ ধান ক্ষেত, বিশাল বিশাল নারকেল আর অশ্বত্থ গাছের সারি, টলটলে নয়ানজুলী, দূরে ধান ক্ষেতে চুমু খাওয়া ঝকঝকে গ্রীষ্মের নীলাকাশ আর “তাহারই মাঝখানে” আমাদের থমকে যাওয়া ট্রেন।
সমস্ত কবি কবি ভাব মুহূর্তে উধাও, চৈত্রের দাবদাহ কি বস্তু হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। জানলা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এল আগুনে পবন, চাঁদিফাটা রোদে পলকে লোহার তৈরি লেডিজ কামরা পরিণত হল তপ্ত তন্দুরে। ঘণ্টা খানেক আটকে থাকার পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল ফ্যানগুলো। এই ভাবে আরো দেড়-দুই ঘণ্টা টিকে থাকা আমাদের মত নিত্যযাত্রীদের পক্ষেই ছিল মোটামুটি ছোটখাটো নরকবাসের সমতুল, তাহলে কল্পনা করুন বাচ্ছা আর বয়স্কাদের অবস্থা সেদিন কি হয়েছিল।ক্রন্দনরত অভুক্ত তৃষ্ণার্ত বাচ্ছা কোলে মায়েদের ডুকরে ডুকরে কান্না অনেকদিন ভুলতে পারিনি।একটা হকার নেই, গোটা কামরায় একফোঁটা খাবার জল নেই- আজও মনে আছে, বিএসএনএলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়তি কাকিমা দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে সামনের কামরার পুরুষ যাত্রীদের কাছে খাবার এবং জল চাইছিলেন অসুস্থ সহযাত্রীদের জন্য আর নির্বিচারে গালি বর্ষণ করছিলেন অবরোধকারীদের উদ্দেশ্যে, “মর, মর, মর হারামজাদারা ওলাউঠো হয়ে মর,অবরোধ করার শখ যেন তোদের জম্মের মত ঘুচে যায়”।
যাই হোক ফিরে আসি ৪ তারিখের নৈহাটি লোকালে, ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। পরিস্থিতি অতোটাও খারাপ নয় এযাত্রায়। এক বয়স্ক মাসীমা যদিও যে ভাষায় অবরোধকারীদের গালমন্দ করছিলেন, খড়গপুরের নিয়তি কাকিমার কথা মনে পড়ে গেল। অজান্তেই বোধহয় ওষ্ঠে হাসির রেখা খেলে গিয়েছিল, উল্টোদিকের সহযাত্রীনীও দেখলাম হেসে উঠলেন। কি ব্যাপার? ঘোষকের মিহি কন্ঠ আবার সরব হয়েছে, “অনুগ্রহ করে শুনবেন, আমরা এখনও সোদপুর ষ্টেশনের সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। ট্রেন কখন ছাড়বে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।“ সিরিয়াসলি? সোয়া ঘণ্টায় অবরোধ ওঠা দূরের কথা, বলে কি সোদপুরের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না? পাশের মাসীমা আরো উচ্চকিত স্বরে খিস্তি মারতে লাগলেন,”কেন রে হতচ্ছাড়ারা? তোদের মোবাইল নেই? যোগাযোগ করতে পারছ না? ইয়ার্কি? আরে আমি এই বেতো পায়ে হেঁটে কুড়ি মিনিটে সোদপুর পৌঁছে যাব, আর  তোরা এখনও যোগাযোগ করতে পারলিনা? মার না। মেরে হঠিয়ে দে...।“ কি ভাবে মারতে হবে, কোথায় কোথায় ডাণ্ডা মারলেই আপদ অবরোধকারীরা পলকে ঠান্ডা হয়ে যাবে, নিপুন ভাবে তার বর্ণনা করছিলেন মাসীমা, হাসি চাপা দায়। উল্টো দিকের সৌম্যদর্শনা সহযাত্রীটি পেশায় অধ্যাপিকা। সেভাবে পরিচয় না থাকলেও মুখ চেনা।বয়সে আমাদের থেকে একটু বড়ই হবেন। একেবারেই পরিচর্যাহীন দোহারা চেহারা। টুকটাক গল্প করছিলাম দুজনে,ঘড়ির কাঁটা পাক্কা মধ্যাহ্ন অতিক্রম করার পর ট্রেন ছাড়ল। উনি হতাশ স্বরে বললেন, “কাল আর আসতে ইচ্ছে করবে বলো?” বললাম, আসবেন না। জবাবে উনি বললেন, প্রিন্সিপালটা এক নম্বরের হারামির হাতবাক্স। তার বউ বছর কয়েক আগে, কার সাথে ভেগে যাওয়ার পর থেকে, হেডু নাকি মহিলাদের সহ্য করতে পারেন না। ছুটি চাইলেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে ওঠেন। আশ্চর্য হলাম না, দীর্ঘ ডেইলি প্যাসেঞ্জারির অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যাবতীয় শিক্ষিকা বা অধ্যাপিকাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীর সবথেকে বড় হারামি কে? জবাব পাবেন, তাঁদের স্কুল বা কলেজের হেডু। বুঝলাম ইনিও তার ব্যতিক্রম নন। তবু আলোচনাকে লঘূ করার জন্যই বললাম, বলবেন ইয়ে মানে পেট ব্যথা করছে, এইটা বললে, মেয়েরা সাধারণত ছুটি পেয়েই যায়, এবং ওপরওয়ালা পুরুষ হলে আর কোন প্রশ্নও করেন না।
উনি একগাল হেসে বললেন, “আমার ওসব বহুদিন অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়েছে। কাজেই ইয়ে বললে, আমার নিস্তার নেই।“ এই জবাব আশা করিনি, তাই চুপ করে রইলাম। উনি আনমনে বললেন, “তাছাড়া ডিভোর্সের ব্যাপার ছিল, তাই এমনি বেশ কিছু ছুটি নিতে হয়েছে। বাড়ি পাল্টালাম, আবার ছুটি নিলাম, কত আর দেবে বলো না?” ডিভোর্স? বাসা বদল? শুনে আর সামলাতে পারলাম না, কেন? জানি অনধিকার প্রবেশ তবু প্রশ্ন করেই ফেললাম, কেন? জরায়ু বাদ যাবার জন্য? উনি হাসলেন। মাপ চাইতে যাব, তার আগেই উনি বললেন, “হ্যাঁ। আবার কি?সমাজের চোখে, একটা মেয়ের জরায়ু বাদ যাওয়া মানে তার নারীত্বের অবসান। বিশেষ করে, সেই নারী যদি বাঁজা হয়।“ খট করে কানে লাগল কথা গুলো। আমার নারীবাদী স্বভাব প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল, উনি আনমনা হয়ে বললেন, “আমি এসব মানি না। দিব্যি ছিলাম, দুজনে। কেউই বাচ্ছা চাইনি। এই নিয়ে আমাদের কোন দুঃখবোধও ছিল না। কিন্তু জরায়ু বাদ যাবার পর কি নাটক, কি নাটক! শাশুড়ি, ননদের কান্নাকাটি। কেন আমার মত একজন অসম্পূর্ণ নারী ওদের ছেলের জীবন বরবাদ করছি। বর বলল, একটা বাচ্ছা দত্তক নি চল। তাতেও শাশুড়ী মায়ের আপত্তি, বংশের রক্ত চাই। অজানা অজাত, কুজাতের বাচ্ছাকে উনি বাড়িতে ঢুকতেও দেবেন না। ভাবো? ননদ বলল, ‘তুই চলে যা। দাদাকে ডিভোর্স দে, তোর লজ্জা করে না, দাদার তো কোন দোষ নেই। ওর তো সন্তানের মুখ দেখার অধিকার আছে। দাদা আবার বিয়ে করুক। ওকে কিসের জন্য ফাঁসিয়ে রেখেছিস? টাকার জন্য?’ আরেঃ তোর দাদার টাকায় আমি ইয়ে করি। আমার বেতনের পয়সাই আমি শেষ করে উঠতে পারি না, তো বরের পয়সা ধুয়ে কি জল খাব? মরুক গে। কলেজে এসে একদিন নাটক করে গেল, কান্নাকাটি, শেষে বিরক্ত হয়ে বরকে বললাম, চলো, ডিভোর্স করি।“ জানলা দিয়ে ছুটে এল এক ঝলক গরম হাওয়া। কি বলি বুঝতে না পেরে, নীরব রইলাম। উনি রুমালে মুখটা মুছলেন, তারপর ক্লান্ত স্বরে শুরু করলেন, “বরটাও ছিল তেমনি, কিছুতেই ছাড়বে না। কান্নাকাটি,কত নাটক, বাপরে বাপ। পুরুষ মানুষ কাঁদলে আমার ভীষণ রাগ হয়। কাঁদবি কেন? পরিস্থিতির মোকাবিলা কর। সরে এলাম। ডিভোর্সের নোটিশ পাঠালাম জেদ করেই। মাস খানেক বাবার বাড়িতে ছিলাম, তারপর এক কামরার ফ্ল্যাট কিনে উঠে এসেছি সদ্য। বছর ঘুরতে চলল, বরটা এখনও একটা বিয়ে করে উঠতে পারল না। অপদার্থ। মেয়েও মনে হয় আমাকেই খুঁজতে হবে, নাহলে ওর ধান্ধা আমি জানি, মা মরলেই, আমার গলায় ঝুলে পড়বে।“
নৈহাটিতে যখন নামলাম ঘড়ির কাঁটা পৌনে একটার ঘরে,ঐ প্রসঙ্গ বাদে অন্য গল্প করছিলাম আমরা, উনি তরল গলায় বললেন, “ভালো মেয়ে থাকলে বোল তো, বরের বিয়ে দেব।“ উদ্গত হাসি চেপে বললাম, “জতুগৃহ পড়েছো? “
(সাপ্তাহিক ডাইরি পর্ব ২)

অনির ডাইরি ২রা এপ্রিল ২০১৮
এবার থেকে ঠিক করেছি অনির সাপ্তাহিক  ডাইরি লিখব। কি করি? সারা সপ্তাহটা কেমন যেন হুস্ করে উড়ে যায় এক পলকে। আগে তবু
ফেরার পথে নৈহাটী লোকালে বসে একটু আধটু লেখালিখি করতাম,এখন সে গুড়ে বালি। একে তো নির্মিয়মান ব্যাণ্ডেল-হালিশহর রেললাইনের দৌলতে মেন লাইনের ট্রেনগুলিতে ভয়ানক গণ্ডোগোল চলছে,তারওপর কথায় কথায় অবরোধ এলাইনের নিত্যঘটনা। সর্বোপরি লেডিজ কম্পার্টমেন্টে গুটিকয় বন্ধুবান্ধব জুটেছে, যাদের কেউ আমারই মত উচ্চ বা মধ্যমানের সরকারী আধিকারিক, কেউ বা অধ্যাপিকা, কেউ এনজিওতে কর্মরতা তো কেউ কোন ছোট বা বড় সাহেবের আর্দালী। কেউ ব্যাঙ্কে কাজ করেন তো কেউ সন্ধ্যাবেলা সল্টলেকের নার্সিংহোমগুলিতে আয়ার ডিউটি করতে যান। সন্ধ্যার নৈহাটী লোকালের লেডিজ কম্পার্টমেন্ট জুড়ে শুধুই “যৌথ খামার”। বন্ধুত্ব  পদমর্যাদা দেখে হয় থোড়াই।
আড্ডা গপ্প তো চুটিয়ে হয়, তার সাথে সাথে চলে চাকুমচুকুম। কেউ গরম মুখ পোড়ানো লালচে অল্প গোল সিঙারা নিয়ে আসে, তো কেউ পঞ্চাননের কালাকাঁদ। হুগলী সমাজকল্যাণ দপ্তরের মূখ্য আধিকারিক কাজলদি তো একদিন একহাঁড়ি পান্তুয়া নিয়ে হাজির। কে যেন দিয়েছিল ম্যাডামকে ভালবেসে, আমরাও অতীব ভালবেসে পরম পরিতৃপ্তি সহকারে তার সদ্ ব্যবহার করলাম। দুঃখ শুধু একটাই আমার লিট্টি মাসি যে কোথায় অজ্ঞাতবাসে গেছে, বহুদিন তাকে দেখিনি। মিস ইউ লিট্টি মাসি।
তারবদলে এক মুড়ি মেসোকে খুঁজে পেয়েছি। নৈহাটী স্টেশনেই মুড়ি মাখেন। সত্যি বলছি মা কালীর দিব্যি, এমন অনবদ্য মুড়ি মাখা আমি বহুযুগ খাইনি।  ফুলো ফুলো বেলফুলের মত মুড়ির গায়ে উদার হস্তে ঢেলে দেন ঘানিভাঙা সর্ষের তেল। চোখের সামনে কচকচ করে কুচিয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দেন টাটকা পেঁয়াজ, কয়েক কুচি আদা আর কাঁচা লঙ্কা। তাতে মেশে গোটা পনেরো মুচমুচে খোসা ছাড়ানো চীনা বাদাম, দু এক চামচ চানাচুর আর অল্প ঝুড়ি। সবশেষে মেশে মেসোর নিজের হাতে তৈরি মশলা। সে মশলার গন্ধেই জিভে জল এসে যায়। অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে স্টীলের চামচ দিয়ে ঘটঘট করে বেশ খানিকক্ষণ মিশিয়ে কাগজের ঠোঙায় ভরে, মেসো যখন হাতে ধরিয়ে দেয়,মুড়িগুলোর গায়ে কালচে মশলা ততোক্ষণে মাখামাখি। ঝাঁঝালো সর্ষের তেলের সুবাসের সাথে মশলার সুঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার। মুখে দিলেই, “উফ্ মার ডালা। আল্লাহ মার ডালা।”
ও হ্যাঁ, মেসোর বাদাম মাখাও কিন্তু অতুলনীয়। একই ভাবে কুচি কুচি পেঁয়াজ,আদা, কাঁচালঙ্কা,কাঁচাতেল আর মেসোর হাতের মশলা দিয়ে ঘটঘট করে মিশিয়ে পুঁচকে পুঁচকে  ঠোঙায় ভরে দেয়। ট্রেন দৌড়য়, সাথে সাথে দৌড়য় সময়, জানলার বাইরে গাঢ় হতে থাকে রাত, জানলা দিয়ে হুহু করে ঢুকে আসে পাগল হাওয়া। ক্লান্ত মহিলা কামরায় উড়ে বেড়ায় হরেকরকম কিস্যা। কখনও কোথাও হাসির হল্লা ওঠে,তো কোথাও চাপা দীর্ঘশ্বাস। এভাবেই শেষ হয়ে যায় একএকটা কর্মব্যস্ত দিন। আজরাতের মত যুদ্ধবিরতি, কাল আবার   সেই গতানুগতিক জীবনসংগ্রাম। প্রতিমুহূর্ত সে শানাচ্ছে নতুন অস্ত্র।  আমাদের পরাস্ত করতে বড়ই ব্যগ্র, কিন্তু আমরাও তো অমৃতের কন্যা। হার মানব থোড়াই।

অনির ডাইরি ১৩ই মার্চ, ২০১৮
মনটা বেশ খারাপ ছিল, এত অসহায় লাগছিল বলার নয়। বন্ধ কারখানার দুই বৃদ্ধ শ্রমিক চূড়ান্ত হতাশ ভঙ্গীতে যখন বলল,“ছেড়ে দেন ম্যাডাম। এইসব কেস ফেস করে কি হবে? আপনি বলবেন টাকা পয়সা মিটিয়ে দাও, শুনবে কে? মালিক তো দিব্যি গায়ে হাওয়া  লাগিয়ে বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।” ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম,“আমি আপনাদের সর্বত সাহায্য করতে প্রস্তুত, আইন আপনাদের পক্ষে, নিজের ন্যায্য পাওনাটুকুর জন্য সামান্য প্রতিবাদটুকুও করবেন না?” দরজা ঠেলে বেরিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বৃদ্ধ বলে গেল,“ওরা বড়লোক, ওরা ঠিকই বেঁচে যাবে। গরীবের কেউ নেই ম্যাডাম-”।

মন খারাপ করে বাড়ি ফিরছি, রাস্তা পেরোতে যাব,শৌভিকের ফোন,“হয় আমি বাড়িতে থাকব,নয়তো এ”।  এ মানে অবশ্যই তুত্তুরী। পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে তুত্তুরীর আর সময় কাটছে না, অলস মস্তিষ্ক যেন কার বাসা? রোজ বাড়ি ঢুকলেই, নতুন নতুন এবং চমকপ্রদ দুষ্টুমির মোকাবিলা করতে হয়। বুঝলাম তেমনি কিছু। আতঙ্কিত স্বরে জানতে চাইলাম, লম্বা ফিরিস্তি- শৌভিকের শখের খেজুরে গুড়, এই মরশুমের অন্তিম এবং উৎকৃষ্টতম গুড়-দাম ১৮০টাকা কেজি, তুত্তুরী এক কৌটো মহার্ঘ  গুড় কুকুরের বাচ্ছাদের খাইয়েছে।চারতলার বারন্দা থেকে ডেলা ডেলা গুড় ছুঁড়ে দিয়েছে,আর তুত্তুরীর “কুতুয়া” গুলো যাদের নাম পর্যায়ক্রমে লেলো, ভুলো, কেলো,নেলো (গায়ের রঙ অনুসারে) তারা লাফিয়ে লাফিয়ে খেয়েছে। শুধু তাই নয়, ফ্রীজে কেমন করে না না আকৃতির বরফ জমানো যায় তা পরীক্ষা করার জন্য নানা পাত্রে করে তুত্তুরী ফ্রীজে জল রেখেছে,যার একটি আমার ফ্যান্সি স্লিং ব্যাগ। গোটা ফ্ল্যাটের মেঝে জল থইথই--সর্বোপরি যখন বলা হয়েছে,কুকুরকে গুড় খাওয়ালে পেটে ক্রিমি হয় এবং তারা মরে যায়- কেলো, লেলো,নেলো মরে যাবে এই শোকে তুত্তুরী হাঁ হাঁ করে কেঁদে বাড়ি মাথায় করছে।
বুঝলাম অবস্থা বেগতিক, এই মুহূর্তে বাড়ি ঢুকলেই দুপক্ষের সালিশি করতে হবে।এই অবসন্ন মানসিক অবস্থায় তা বড়ই বেদনাদায়ক। ভাবলাম এই মওকায় পার্লার থেকে ঘুরে আসি। ইদানিং ওরা রাত নটা অবধি খুলে রাখছে। সুরজিৎ এর আজকাল প্রচণ্ড ডিমান্ড। গিয়ে দেখি, সুরজিৎ গম্ভীর মুখে,এক বিশাল দেহী , ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তির অবিকল তালের মত মাথায় অত্যন্ত সযত্নে  কোন প্যাক লাগাচ্ছে। লাগিয়ে কি হবে জানি না, কারণ সত্যি বলছি মাইরি, ওণার মাথার চুলের থেকে আমার বরের দাড়ির দৈর্ঘ্য বেশী।

সুরজিৎ  মুখ তুলে বলল, “বাড়ি যাও। এপ্রিলের মাঝামাঝি আসতে বলেছিলাম না। ” দূর ব্যাটা তোর স্পা কে চায়? মাথা ভর্তি গজগজ করছে পাকা চুল। কোন ভাবেই খোঁপা-বিনুনি  বা স্কার্ফ দিয়ে আর ঢাকা যাচ্ছে না।  শৌভিক বার পাঁচেক বিস্মিত (পড়ুন উল্লসিত) স্বরে বলে ফেলেছে,“তুই কি বুড়ি রে!” কাদের অাবার এক্সপার্ট ওপিনিয়নও দিয়ে ফেলেছে,“লোকের পাকা চুল খুঁজতে হয়,অনিন্দিতার বেলায়- হেঁ হেঁ কাঁচা চুল খুঁজতে হবে। ” কেমন গাত্রদাহ হয়। ন-দশ বছরের পুরাতন বর, খুব ভালো করে জানে আমাদের বংশে অল্পবয়সে চুল পাকে। বিয়ের আগে থেকেই বেশ কিছু পাকা চুল ছিল, তখনও বলত,“ তুই কি বুড়ি রে-”।
যাই হোক বললাম সুরজিৎকে। উল্টে ধমকেই দিল, “ফোন করে আসোনি কেন?যদি আমি না থাকতাম?” বলেই ফেললাম আচ্ছা বাপ ঘাট হয়েছে। একগাল হেসে শ্যাম্পু করতে বলল। শ্যাম্পু সাধারণত যে মেয়েটি করে দেয়, তার নাম ধরে নেওয়া যাক মীনা। ও ভালো কিছু পারে না বা সুযোগ দেওয়া হয় না। টুকটাক শ্যাম্পু করে দেওয়া,পেডিকিওর,ম্যানিকিওর এইসবই করে। অবসরে ফ্লোর ঝাঁট দেয়, কাটা চুল ফেলে। আগের বার যখন মীনা শ্যাম্পু করাচ্ছিল, ওর মুখের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে কালশিটের দাগ ছিল। জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, লোডশেডিং এ দেখতে পায়নি বন্ধ দরজায় ধাক্কা খেয়েছে। অবিশ্বাস করিনি। আমার ঐ রকম প্রায়ই হয়। এতবেশী ঠোক্কর খাই, সারা গায়েই প্রায় নীল কালো জেব্রা ক্রশিং। মুখটাই যা বেঁচে যায়। কাল মীনা শ্যাম্পু করাচ্ছিল, আমার মাথার ওপর ওর মুখ, তাকিয়ে দেখি,মুখ শুকনো,চোখ ছলছলে,নাক টানছে আর গালে কালশিটে,কপালে খানিকটা ফুলে ঢোল। এবারের দাগটাকে ধাক্কা খাবার দাগ বলে চালানো অসম্ভব। ধাক্কায় চার-পাঁচটা অঙুলের দাগ বসে না। ঠোঁটও কাটে না। নিজে থেকে না বললে প্রশ্ন করা অসমীচীন। তবু নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা চেপে ধরলাম। এই টুকুরই যা দরকার ছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। বাকিদের নজর এড়িয়ে ফিসফিস করে কান্না ভেজা গলায় বলল,“ অর বরদাস্ত না কর পাই, দিদি। ” সেই এক গল্প- স্কুল পালিয়ে প্রেম- প্রথম চোটে সুখের সংসার। ভালবাসা ছাড়া আর আছে কি? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একে একে দুই একে তিন হওয়া। মেয়ে হওয়াতে শ্বশুরবাড়ির আদর এক ফুঁয়ে উড়ে গেল।বিরক্ত বরের দিনরাত ঘ্যানঘ্যান, বংশে বাতি কে দেবে?মীনা সাধ্যমত বোঝাবার চেষ্টা করে, আজকালকার দিনে ছেলে মেয়ে সব সমান। ফাটল বাড়তে থাকে, ঝগড়াঝাঁটি, সুযোগ পেলেই গায়ে হাত তোলা। ঘর থেকে শিশুকন্যা সহ বার করে দেওয়া। মামুলী গৃহবধু, যাবে কোথায়?মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি উঠবে, খাওয়াবে কে? ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় সন্তানের আগমনের সম্ভাবনা। বরের চেতাবনি, “আবকি বার লেড়কা হি চাইয়ে। ” যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই লেড়কি হয়। ঝগড়া অশান্তি ছাড়ুন,সংসারে টাকাপয়সা দেওয়া বন্ধ করে দিল মীনার বর। বজ্জাত অঔরৎ,জন্ম দিয়েছিস যখন, এবার ঠেলা বোঝ। ফলে গৃহবধুর অবগুণ্ঠন খুলে ফেলে মীনাকেই বেরোতে হল রুজিরুটির ধান্ধায়। পার্লারে কাজ জোটালো। এবার শুনতে হল,বদচলন অঔরৎ। গতর দেখিয়ে টাকা কামাস। আগের বারের কালশিটেটা ছিল, ঐ উপলক্ষেই।
ঐ কালশিটের দাগ মেলাবার আগেই মীনা তার দুই কন্যা সহ বাপের বাড়ি উঠে এল। খুব যে আন্তরিক অভ্যর্থনা পেল তা নয়, তবে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দিনকয়েক হল বাপের বাড়ির পাশের বস্তিতে একটা কুটুরি ভাড়া নিয়েছে। মেয়েদের নিয়ে একাই থাকে। রবিবার দিন মেয়েদুটো পাশের মাঠে খেলছিল,হঠাৎ বাবা এসে দুই মেয়েকে জবরদস্তি নিয়ে চলে যায়। মীনার মা আটকাতে গিয়েছিল,তাকেও রেয়াৎ  করেনি জামাই বাবাজীবন। উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েদুটোকে নিয়ে বিহারে পালাবার। ভাগ্যক্রমে মীনা পার্লার থেকে কিছুক্ষণের ছুটি নিয়ে মেয়েগুলোকে দেখতে গিয়েছিল ঠিক ঐ সময়। পার্লার ফাঁকা থাকলে ওকে  ওরা ওমন একটু আধটু ছেড়ে দেয়। দুটো কচি বাচ্ছার মা।
টেনে মেয়েদুটোকে ট্যাক্সিতে তুলে কাটবে,মীনার সাথে মোলাকাৎ। ট্যাক্সির দরজা ধরে ঝুলে পড়ে মীনা প্রবল চিৎকার করতে থাকে। সাঁঝের মুখ, রাস্তাঘাটে  তেমন লোক ছিল না। মীনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য যতটা নির্মম ভাবে মারা যায়,মারতে কসুর করেনি লোকটা। কপালের এক খামচা চুল ছিঁড়ে নিয়েছে। হাতে দমাদম ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। পেটে লাথি মেরেছে। কিন্তু মা আর সন্তানদের আলাদা করতে পারেনি। মীনা আর তার মেয়েদের কান্নাকাটির আওয়াজে লোক জড় হতে সময় লাগেনি। তারপর মীনা প্রথমে পায়ের চপ্পল খুলে পিটিয়েছে,পরে টানতে টানতে থানায় নিয়ে গেছে।
সুরজিৎ তার টাকলা ক্লায়েন্টকে ফেলে চলে এসে বলল,“বহুৎ বাহাদুর মেয়ে আমাদের মীনা,ম্যাডাম। উদোম কেলিয়েছে বরটাকে। বলেছে আবার যদি থোবড়া দেখিয়েছিস তো আরো কেলাব।  ”মীনা ফোঁস করে বলল,“না তো কি?পড়ে মার খাব?সে তো কম খাইনি ম্যাডাম?খেতে খেতে দেখলাম, নিজের জন্যে নিজে আওয়াজ না উঠালে কেউ বাঁচাবে না। ” সত্যি বলছি দিলখুশ হয়ে গেল। দুপুরের অবসন্নতা,ক্লান্তি এক ফুঁয়ে সাফ। এই না হলে জীবন,কখনও মেঘে ঢাকা, কখনও আলো মাখা- আপনাকে শুধু একটু কষ্ট করে চলতে হবে-

অনির ডাইরি ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮
শহর জুড়ে আজ প্রেমের মরশুম। আলোতে মাখামাখি আমাদের ড্রয়িং রুম। যার দেওয়াল জুড়ে তুত্তুরীর বানানো নানা ছবি,বানান(যার অধিকাংশই ভুলভাল),কমলা ফেব্রিক কালারে হাতের ছাপ, সোনালী গ্লিটারে ময়ূর আঁকা(দেখে উটপাখি মনে হলে আমি দায়ী নই)। হোক না তবু তো ইয়ে ভ্যালেন্টাইন ডে। তারওপর আবার ছুটির দিন- আহাঃ সোনায় সোহাগা। গরম কৃষ্ণ কফির কাপটা বরের সামনে নামিয়ে পরম সোহাগ মাখা আধো আধো স্বরে বললাম,“তুমি আমাকে উইশ করবে না?” উইশ শুনে আমার বরের মুখের হাল কি হল সে আর লিখছি না। সকালের টাইমস্ অব ইণ্ডিয়া থেকে কোন রকমে চোখ তুলে  নাক উঁচু করে বলল,“হ্যাপি শিবরাত্রি। ” দিল পুরো মুডের পিণ্ডি চটকে, তবু যতটা সম্ভব তরল করে বললাম,“না। না। ওটা না।” বর গম্ভীর মুখে মারি চিবুতে চিবুতে বলল,“আমি শিবরাত্রি ছাড়া আর কিছু মানি না। তুই শিবরাত্রি করিসনি। তোকে দূর করে দেব। ”কি অমৃত সম্ভাষণ মাইরি। আজন্ম নাস্তিক, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র  অভাবিত আমার বর নাকি শিবরাত্রি ছাড়া আর কিছু মানে না। আর আজকের দিনে বউকে দূর করে দেবার চিন্তা কোন বাঙালী পুরুষের মনে হচ্ছে না?সদ্য বিবাহিতদের জানি না, তবে আমাদের মত পুরোণো পাপীগুলো ফেবু আর হোয়াটস্ অ্যাপ ভরিয়ে দিয়েছে ঘ্যাণঘ্যাণ করে। “আজকের দিনে বউকে চমকে দিন। গার্লফ্রেণ্ডের সাথে বউয়ের আলাপ করিয়ে দিন”,“বউ মানে বড় উৎপাত” মার্কা পচাগলা রদ্দি জোকস্ পাঠিয়ে পাঠিয়ে। এক ব্যাচমেট তথা অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে তো সক্কালবেলায় উদোম ঝাড়লাম। এতই যখন উৎপাত তোরা বিয়ে করেছিলি কেন?বউকে ছেড়ে একটা বর খোঁজ, বুঝতে পারবি কতধানে কত চাল। মূর্তিমান আপদ এক একখানা।
যাইহোক ফিরে আসি আমাদের আলোকজ্জ্বল ড্রয়িং রুমে। বরকে করজোড়ে নমস্কার করলাম,দরকার নেই বাপু তোমার ভালোবাসায়,দয়া করে বাজার গিয়ে আমায় উদ্ধার করো। বাবার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও জবরদস্তি তু্ত্তুরীও সঙ্গে গেল। ওদের ক্যাথলিক স্কুলেও আজ সারপ্রাইজ, শিবরাত্রির ছুটি। ঘড়ির কাঁটা আধ পাকও ঘোরেনি বাবা-মেয়ে ফিরে এল প্রবল ঝগড়া করতে করতে। শৌভিক যথারীতি,“অসভ্য গোভূতটাকে আমি আর কোথাও নিয়ে যাব না। ওষুধের দোকানে গিয়ে এমন বকেছে, বাপরে বাপ- 'ও ঐ ভায়োলেট ওষুধটা কিনছ। ওটা তো থাইরোনর্ম। থাইরয়েডের ওষুধ। মা খায়”।  হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। শৌভিক চিৎকার করেই চলেছে,“আরো শোন। বলল ‘বাবা,ঐ দেখ ঐ যে শিশির মধ্যে যে লজেন্স গুলো আছে, ওর নাম কফলেট। ওগুলো কিন্তু টফি নয়। কাশি হলে খায়। ’ ওর বকবকানির চোটে শঙ্কর বলল,‘বাপরে এ তো এখুনি ডাক্তার হয়ে গেছে। ওষুধ তো দিতেই পারবে। শুধু ডিগ্রীটা যা নেওয়া বাকি।’ ” হাসতে হাসতে বেদম দশা। তুত্তুরী গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে,শৌভিকবলেই যাচ্ছে,“শুধু তাই নয়, বাপ্পার সঙ্গে যা বকেছে, বাপরে বাপ।”বাপ্পা হল আমাদের চিকেন ওলা।  বাবা যখন কাঁচা আনাজ কিনছিল, তুত্তুরী বাবার হাত ছাড়িয়ে বাপ্পার কাছে গিয়ে বলেছে,“ একটা মুরগি কাটো তো। আমি দেখব। আমার অনেকদিনের শখ। কচকচ করে কেটে ফুলো। কিন্তু আমি মুর্গিটা কিনব না। তুমি তো এমনিই কাটতে, আমার সামনেই না হয় একটা কাটো। ”
তুত্তুরী অভিমানে ফুলছিল। বাবাকে অনেক অনুনয় বিনয় করেছে,একটা ফুল কিনে দাও। মাকে দেবো। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে। বাবা যথারীতি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। উফ্ এই ফুল কেনা নিয়ে কাল কি নাটক। দিব্যি ডেপুটেশন খাচ্ছি, আচমকা তুত্তুরীর মাসির ফোন। ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কি হল রে বাবা? ঝানু তথা বৃদ্ধ ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে বললাম,থামুন। আগে দেখি বাড়িতে কি হল। ফোন ধরতে মাসির কাতর স্বর কানে এলো,“বোনি একটু বোঝাও। কি কাঁদছে। বাপরে বাপ। ফুলে ফুলে কাঁদছে। দম আটকে বমি করে ফেলবে। ”কেন কাঁদছে কেন? না ইস্কুল থেকে ফেরার সময় তুত্তুরী কাতর অনুরোধ করেছে,  মাসি একটা ফুল পেড়ে দাও। কাল ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। আমি মাকে দেব। আমাদের আবাসনে  ফুলের বান ডেকেছে কিন্তু সিকিউরিটার আতঙ্কে মাসি গাছে হাত দেয়নি।
ডেপুটেশন দিতে আসা জঙ্গী তথা বৃদ্ধ নেতা নেত্রীদের বসিয়ে মেয়েকে বোঝালাম।ওণারাও মাথা নেড়ে নানা কথা বলে সাহায্য করলেন।  মাঝখান থেকে গেল বেচারাদের ডেপুটেশনের পিণ্ডি চটকে।
ফেরার পথে নৈহাটী স্টেশনের সামনে দেখি ঢেলে ফুল বিকোচ্ছে। টকটকে চকচকে গোলাপের জওয়ানিতে পিছলে যাচ্ছে চোখ।মেয়ের জন্য বুকটা টনটনিয়ে উঠল। আহাঃ।  অল্পবয়সীদের ভিড়ে মাঝে টুক করে ঢুকে পড়লাম। ফুলওয়ালাকে ফিসফিসিয়ে বললাম,“ভাই মেয়ের জন্য কিনব। সবথেকে বড়টা দাও। আর ঐ সব জঞ্জাল মাঝে মস্ ফার্ণ জরি একদম না।” সাদার ওপর চিকন গোলাপী বর্ডার দেওয়া গোলাপের দাম বলে ৩০টাকা। বললাম ভাগ্। পাতি লাল গোলাপ ৫টাকা দিয়ে কিনে প্লাস্টিকে মুড়ে সযত্নে ব্যাগে ভরলাম। আর একটা গোটা কুড়ি টাকার চকলেট। গরিব শ্রমিক মা, ভালোবাসার দিনে আর কি দেবে- ভালোবাসা ছাড়া?
ট্রেন বেশ ফাঁকা। অন্যমনস্ক ছিলাম হঠাৎ দেখি দুটি গেঁড়ি গেঁড়ি বাচ্ছা চলন্ত ট্রেনের দরজার সামনে টাইটানিক মার্কা পোজ দিচ্ছে। টেনে এনে বসালাম। এই তোদের মা কই?নিরুত্তাপ এবং নিরুত্তর। দুটোর গায়ে রঙ চটা সুতির জামা, পা খালি এবং ধুলি মলিন। কোন ব্যাগ ট্যাগও নেই। সর্বনাশ। পালিয়েছিস নাকি অ্যাঁ?বাড়ি কোথায়? কিছুই বলে না। খালি মিচকে মিচকে হাসি। এদুটোকে ছেড়ে তো আমি নামতেও পারব না। যা দিনকাল। কে ধরে নিয়ে যাবে। কি করবে, মায়ের মন শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। বাবা বাছা করে অনেক বোঝাবার পর বলল, বিধাননগর বস্তিতে থাকে। মা লোকের বাড়ি বাসন মাজে। স্কুলে ভর্তি তো হয়েছে তেমন যায় না। মায়ের সময় কোথায়। বাবা নেই। মানে আছে কিন্তু আরেকটা বিয়ে করেছে। ইদানিং মা সন্ধ্যার দিকে পাশের ফেলাট বাড়িতে নতুন রান্নার কাজ পেয়েছে। মা বেরোতেই ওরাও বেরিয়ে পড়েছে। অনেক বোঝালাম। কত বিপদ হতে পারে। বোঝালাম তোরা ছাড়া মা’কে কে ভালোবাসবে?বোঝালাম মায়ের যন্ত্রণা আর বাড়াস না বাবা। দুহাতে দুটোকে পাকড়ে ঝপাং করে নামলাম উল্টোডাঙা স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে মেলা লেগেছে যেন। কত ফুল। হৃদয়াকৃতির ছবির ফ্রেম,কফি মাগ,টেডি। তুত্তুরীর গল্প বলছিলাম,মেয়েটা বলল,“মাসি মাকে আমরাও কিছু দেব।”কি দিবি বাবা? ছেলেটা বলল,“কিন্ত পুইসা নেই মাসি। ” একটু দূরেই ওদের ঘর। মা অন্ধকার ঘরের দরজার সামনে বসে আছে।  বাচ্ছাদুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম,গোলাপ আর চকোলেটের দরকার কাদের আজ বেশী। একজনকে ফুলটা দিলাম আর একজনকে ক্যাডবেরী।শুধু বললাম ভালো থাকিস বাবা।
বিনা ফুল চকলেটেই বাড়ি ফিরলাম। আমাদের ধনী মহল্লা বাড়ি ঢোকার আগে ফুলের দোকঅনে দাঁড়িয়েছিলাম,৫টাকার গোলাপ ১২-১৫টাকা চাইল। ধুৎ তেরী। ভালোবাসার দিনে বুক ভরা ভালোবাসাই তো যথেষ্ট।
শৌভিকের বর্ণণা আর আমার অট্টহাস্যের ফাঁকে কখন তুত্তুরী গিয়ে নিয়ে এসেছে তার রঙচটা লাল ফোন। যাতে একটা টাকাও আমরা ভরাই না, যাতে তুত্তুরী লোকজনকে ফোন করে বিপাকে না ফেলে। ফোন না যাক, ভয়েস রেকর্ড তো হয়। মেয়ে আমার জন্য মেসেজ রেকর্ড করে রেখেছে,“শোন মা”-কানে দিয়ে শুনি ফিসফিসানি,“আই লাভ ইউ মা। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস্ ডে”। বুকটা ভরে গেল। আবার কি চাই। ভালোবাসা সত্যিই বাতাসে ভাসে, যত দি তার অনেক বেশী ফিরে আসে।
#Happy_Valentines_Day

অনির ডাইরি ২২শে জানুয়ারী ২০১৮


প্রায় দুশো বছরের বার্মাটিকের ভারি সদর দরজা ঠেলে ঢুকলে, প্রথমেই ডান হাতে  পড়বে অতিকায় কাঁঠাল গাছ, আর একটু এগোলেই বিশাল ইঁট বার করা উঠোন। উঠোনের পূব দিকে টালির চালের ঠাকুরঘর। এটা মেকশিফ্ট ঠাকুরঘর,আসলটা ছিল তিনতলার ছাতে। সেখানেই হলুদ জলচৌকির ওপর, বসানো হত সরস্বতী প্রতিমা। কখনই খুব বড় প্রতিমা আসত না,ছোট্ট থেকে মাঝারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত আমাদের সরস্বতী। আগের দিন রাতে আমাদের তিন ভাইবোনের উন্মাদনা দেখে কে?বাবার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে বানানো হত শিকলি। লাল সবুজ মার্বেল পেপারকে ফলকাটা ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে কেটে গোল গোল করে শিকলের মত জোড়া। জ্যাঠাইমা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে আটা আর জল মিশিয়ে ফুটিয়ে বানিয়ে দিত আঠা। সিগারেটের প্যাকেট জমিয়ে রাখত বাবা বছর ভর, ভিতরের সোনালী রূপালী রাঙতা গোঁফ ছাঁটা কাঁচি দিয়ে নিটোল করে কেটে বানানো হত ফুল। মায়ের অব্যবহৃত সবুজ দক্ষিণী সিল্কের শাড়ি দিয়ে ঢাকা হত ঠাকুরঘরের পলেস্তারা খসা দেওয়াল। পুজোর আগেরদিন থেকেই পড়াশোনার পাট চুকানো। সব বই খাতা মায়ের শ্রীচরণে অর্পণ করে বাঁধনছেঁড়া ঘুড়ির মত উড়তাম আমরা তিন ভাইবোন। এদিন সিরিয়াল দেখতে বসলে মা কাকিমার রক্তচক্ষু থাকত না। সুযোগ পেলেই আটটা নাগাদ ছোট্ট ভাই অনিন্দ্যকে বাবার সাথে বসিয়ে আমি আর অয়ন বসে পড়তাম টিভির সামনে। আধ ঘন্টার তো ব্যাপার। সেবার চৌধুরী ফার্মাস্যুটিকাল বলে একটা সিরিয়াল চলছিল, জনৈক অভিনেত্রী এবং এক রাজনৈতিক নেতা অভিনয় করতেন। টিভিটা ছিল ঠাকুমার ঘরে, সাবেকী টেলেরামা, ঠাকুমার ঘর এবং দরজার বাইরের দালান জমজমাট সেদিন। কে নেই? জেঠু, জেঠিমা,ছোট কাকু, পিসি,ঠাকুমা, আমরা দুই ভাইবোন,ছোট কাকিমা, দুই গৃহপরিচারিকা,মায়াদি আর দেবী দি যাদের আমরা পরিবারের সদস্য বলেই জানতাম তখন। যাইহোক নেতা এবং অভিনেত্রী সেদিন ঘণ সবুজ লনে (সাদা কালো টিভি  বাকিটা আমার কল্পনা), আচমকা দুজনেই পোশাক খুলে সুইমিং পুলে নেমে গেলেন। না না উদ্বিগ্ন হবেন না, উভয়ই সুইম স্যুট পরে ছিলেন। কাকার মুখ পাষাণের মত কঠোর হয়ে উঠল, আমরা মাথা নীচু করে ফিকফিক করে হাসছি, নেতা আর অভিনেত্রী জলমগ্ন অবস্থায় গভীর আলিঙ্গনাবদ্ধ  হলেন, ছোট কাকুর চিৎকার দেখে কে?“কি অশ্লীল। অশালীন জিনিসপত্র দেখায় আজকাল। ছিঃ। বেরো। বেরো দুটোতে। ” আমরা একছুটে উঠোনে, হাসির দমকে ততোক্ষণে কাঁপছে ধরা। 

পরদিন পুজো হত। সকাল থেকে ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে মা- কাকিমারা ফল, মিষ্টি, চিঁড়ে,মুড়কি, খই, কদমার নৈবেদ্য সাজিয়ে দিত। জ্যাঠাইমা বানাতো শ্রী। পুজোয় বসতেন জেঠু। পরণে লাল পট্ট বস্ত্র, ঘাড় অবধি চুল,টকটকে ফর্সা রঙ, কাটা কাটা নাক মুখ চোখ, থুতনি।বজ্র গম্ভীর কণ্ঠস্বর। পঞ্চপ্রদীপের পোড়া সলতে আর ধুনোর গন্ধ,তার সাথে জেঠুর হাতে টং টং করে বেজে উঠত পিতলের ঘন্টা, যার মাথায় বসে বসে থাকত পিতলের গরুড়। ঘন্টা ধ্বনির সাথেই আমরা প্রাণপনে কাঁসর ঘন্টা পেটাতাম, কাঁই না না, কাঁই না না। 

কি সব দিনছিল সোনালী দিন। তুত্তুরীকে কিছুটা হলেও সেই অনুভূতির স্পর্শ দেবার জন্যই বাড়িতে সরস্বতী পুজো করা।  এবার আমাদের বাড়িতে কোন পুজো হয়নি। কি করেই বা হবে, আমাদের মেজো জেঠু যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এক নিখাদ আমুদে,চূড়ান্ত আড্ডাবাজ,রসিক,হাসিখুশি মানুষ। আমার শ্বশুরমশাই এবং বর যদিও অ্যাগনস্টিক, অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব দিয়ে আদৌ ভাবিত নয়,লোকাচারের পরোয়াটরোয়া করেন  না,পুজোটাও তো লোকাচার, কাজেই পুজো হল কি না হল তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র  চিন্তিত নয়। কিন্তু তুত্তুরীকে বোঝায় কে? পাশের বাড়িতে শিকলি খাটায়,টুনি বাল্ব লাগায় এ বাড়িতে আমার কন্যা  ডুকরে ডুকরে কাঁদে। অগত্যা শ্বশুরমশাই বললেন,“এক কাজ কর,ওকে একটা পুঁচকে ঠাকুর কিনে দাও। ও নিজে পুজো করুক। ” কি আব্দার রে বাবা। ও করবে পুজো?তাহলেই হয়েছে। সেই আমাকে আর কাকিমা মানে উমাকেই সব গুছিয়ে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, পাঁচালির বই খুলে মন্ত্র গুলিও প্রমট্ করতে হবে- 

বাবাকে বুঝিয়ে বললাম ও সব চলবে না। তাহলে?এককাজ করা যাক,এমনিতেই তো নিরামিষ, মোটামুটি পুজোর ভোগের খাবারটাই রাঁধা যাক।ওকে শাড়ি পরানো হোক।  উমা আর আমিও শাড়ি পড়ি। সকলে একসাথেই খাওয়া দাওয়া করি? সবাই তাতে রাজি। তুত্তুরী আর ওর বাবা সাগ্রহে দৌড়ল বাজার। ফিরে এল তুমুল ঝগড়া করতে করতে, শৌভিক রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,“এই অসভ্য গোভূতটাকে আমি আর কোনদিন নিয়ে বেরোব না। আলু যা কিনেছি কিনেছি, বাকি প্রতিটা আলু ও হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেছে।নিষেধ করলেও শোনেনি এবং সেই  ধুলো হাত তারপর নিজের এবং আমার জামায় মুচেছে। শুধু তাই নয়, তারপর কি বায়না মুর্গি কাটা দেখবে। দেখতে না দিয়ে টেনে নিয়ে এসেছি বলে রাস্তায় বসে পড়ছিল।” তুত্তুরীও গলার শিরা ফুলিয়ে হাত পা নেড়ে বলল,“আর তুমি যে বাবাকে রাঙালু আনতে বলেছিলে?দেখো না দেখো কি এনেছে? শাঁকালু কিনে এনেছে। তাও দুটো। ”ঝটিতি ব্যাগ খুলে দেখি জ্বলজ্বল করছে একজোড়া শাঁকালু। ভেবেছিলাম গোটা সিদ্ধ করব, বুঝিয়েও দিয়েছিলাম। তারপরও যদি কেউ এভাবে সাবোটাজ করে কি বলি?” বাপমেয়ের দ্বৈরথ তখনও থামেনি,শৌভিক চিৎকার করেই যাচ্ছে,“ ওর কথা শুনিস না। দেখছিস না ড্রয়িং রুমের দেওয়াল জুড়ে কি সব এঁকে রেখেছে। তুই দেখছিস তো”?  তুত্তুরী নির্বিকার চিত্তে বলল,“তো?ঘরটার নামই তো ড্রয়িং রুম। ড্রয়িং করারই তো ঘর, তাই ড্রয়িং করেছি। ”বুঝলাম এদের পাল্লায় পড়লে আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে। এখনও কত রান্না বাকি,দাদু-বাপ-মেয়ের ফরমাইশ ডুমো ডুমো আলু ফুলকপি আর মটরশুঁটি দিয়ে আতপ চালের ঘি গন্ধী খিচুড়ি, মুচমুচে গরম বেগুনী,মাখোমাখো তেলতেলে মিষ্টি মিষ্টি ফুলকপি আলুর তরকারী,টমেটো-খেজুর আমসত্ত্ব কিসমিসের চাটনী আর পায়েস। ভেবেছিলাম উমার জন্য গুড়ের পায়েস রাঁধব, এঁনাদের আব্দার না চিনির পায়েস চাই। তাই সই। লিখতে একটু দেরী হয়ে গেল আপাদের সকলকে ভট্টাচার্য বাড়ির তরফ থেকে শ্রীপঞ্চমীর অনেক শুভেচ্ছা। যাঁরা মেসেজ করেছেন তাদের কাউকেই আলাদা ভাবে জবাব দেবার পরিস্থিতিতে যে ছিলাম না আশাকরি বুঝতে পেরে নিজগুণে মার্জনা করবেন।

অনাির ডাইরি১২ই জানুয়ারী,২০১৮
গণ্ডগোলের সূত্রপাত বেশ কয়েকদিন আগে, তাহলে বিশদেই বলি, বড়দিনের প্রায় এক মাস দীর্ঘ ছুটিতে তুত্তুরীর হোমওয়ার্ক ছিল একটি গহনার বাক্স। অর্থাৎ জুয়েলারি বক্স। এই টুকুনি গেঁড়ি গুলো থোড়াই ওসব বানায়? সব কাজ সামলে সেই মায়েদেরই কোমর বাঁধতে হয়। তা না হয় বাঁধলাম, দীপাবলীতে উপহার পাওয়া ড্রাইফ্রুটের বাক্স দিয়ে দিব্য গহনার বাক্স বানানো যায়, কিন্তু মুশকিল হল বাক্সর গায়ে অলংকরণ করব কি করে? আগের প্রজেক্ট অর্থাৎ ফুলদানি বানাবার সময় কি কুক্ষণে ফেব্রিক কালার আর আঠা কিনেছিলাম! সব রঙ শোভা পাচ্ছে আমাদের সাধের ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে, ড্রয়িং রুম ছাড়ুন, গোটা বাড়ি ময় কত কি যে পর্যায়ক্রমে লেখা এবং আঁকা আছে, যেমন দরজাদিয়ে ঢুকে জুতো খুলতে যাবেন, দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে,“মাসি খুব খারাপ। ” মাসি খারাপ তো বটেই, টিভি বন্ধ  করে হোমওয়ার্ক করতে যে বলে তাকে কি করে ভালো বলবেন বলুন তো মশাই?
শোবার ঘরের দেওয়ালে লেখা,“মা আই লাভ ইউ”।  নিজের সৌভাগ্যে চোখে জল এসে যায়, পরদিন কোন গর্হিত অপরাধের জন্য এক ধমক মারি, ফিরে গিয়ে দেখি “মা”এর ওপর ইয়া বড় একটা কাটা চিহ্ন। তারপর দিন আবার হয়তো ফেরার পথে আঙুর কিনে আনলাম, তো সেই কাটা মায়ের ওপর আবার লেখা হল “মা আই লাভ ইউ। ” 
লাভ ইউ/লাভ ইউ নট ছাড়ুন,কত কি যে আঁকা এবং লেখা আমাদের দেওয়াল জুড়ে। যত্র তত্র দশ হাত ওলা মা দুর্গা আঁকা, আম, পদ্মফুল, সূর্য এছাড়াও অজস্র দাগ, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে গোলগোল দাগ কাটে তুত্তুরী, আহা কতটা লম্বা হল দেখতে হবে না বুঝি? এমন কিছু ছবি আঁকে যা দেখে শৌভিকের এবং আমার হৃদ্কম্প হয়। মিষ্টি মিষ্টি কথায় জিজ্ঞেস করি, “এটা কি এঁকেছিস বাবু?” “ আঙুল মা। বুঝতে পারছ না?” পাপী তাপী মন আমাদের আঙুল দেখে যে কি ভেবেছিলাম সে নাহয় উহ্যই থাক। আর একবার একটা ছবি দেখে অফিস থেকে ফিরে দুজনেরই পিলে চমকে গিয়েছিল, এটা কি? পরে জানলাম ওটা হনুমানের ছবি। বাকিটা তার ল্যাজ। পুঁচকে হনুমানের বিশাল ল্যাজের গল্প বোধহয় লঙ্কাকাণ্ডে পড়েছি এবং গল্প শুনিয়েছি। তুত্তুরী সেটাই চিত্রাঙ্কন  করেছে আর কি। আমাদেরই মনে পাপ আছে---
তো যা বলছিলাম আর কি,দেওয়ালে চিত্রাঙ্কন  নিয়ে কিছুদিন ধরেই বাপ এবং মেয়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে। আজকাল আবার তুত্তুরী এঁকে মোছা ধরেছে, ফলে দেওয়ালের অবস্থা চিন্তা করতে পারছেন--। তারওপর রোজই তুত্তুরী কিছু না কিছু হারিয়ে আসে। পেন্সিল বক্স খুললে দেখবেন, গোটা দুয়েক এক ইঞ্চি পেন্সিলের টুকরো আর আধখানা নোংরা রাবার, গোটা দুই প্লাস্টিকের স্কেল ছাড়া আর কিস্যু নেই। প্রবল বায়নাক্কার পর, অথবা অযাচিত ভাবেই হয়তো নতুন পেন্সিল বা ইরেজার বা শার্পনার দেওয়া হল, প্রাণের বন্ধুকে দেখাবে বলে, ঠিক বেলা দুটো নাগাদ আমার মায়ের ফোন আসবে অফিসে,“শোন না,ও শার্পনারটা হারিয়ে ফেলেছে বুঝলি। ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বকিস না যেন।” মেলার মিটিং এর তীব্র ব্যস্ততা, যত বলি আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। মা আর ফোন ছাড়েই না, “শোন না, কাল থেকে এত হোমওয়ার্ক দিস না। এই টুকু বাচ্ছা অত পড়ার চাপ দিস না। ”হতভম্ব হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ, এই মহিলাই না পড়া পড়া নিয়ে আমার জীবন অতিষ্ঠ  করে তুলেছিল শৈশবে? একটা আধটা পেন্সিল রাবার হারালেই না বাড়িটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হয়ে যেত?
দাঁড়ান দাঁড়ান গল্প আরো আছে, যে মেয়ে বই থেকে কমপ্রিহেনশন পড়তে গিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হয় যায়, সে কি না এয়ারটেলের এসএমএস পড়ে,যথোচিত পাঠোদ্ধার করে, নির্দেশাবলী অনুসরণ করে ফোনে দশ টাকার লোন টকটাইম ভরিয়ে ফেলে? সমস্ত ইন্সপেক্টরদের নিয়ে মিটিং করছি, মেয়ের ফোন, কি করে ফোন করলি রে বাপ? তোর ফোনে তো কোন পয়সা নেই। এতবার দাদু, মামমাম(দিদা) আর কাকিমাকে ফোন করে জ্বালাত যে আমরা ঐ ফোনটায় পয়সা ভরানোই ছেড়ে দিয়েছি। শুধু ফোন ঢুকবে, বেরোবে না। ওমা মেয়ে তো দিব্যি ফোন করছে, কি বলতে, না এত হোমওয়ার্ক দিও না তো। ভালো লাগে না। নিজের মত একটু থাকতে দেবে তো নাকি?
আরো আছে, দাঁড়ান। মেলা সংক্রান্ত শত ব্যস্ততার মাঝেও, অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রায় জোর করে শাটার খুলিয়ে নানা টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে এনে, একরাতের মধ্যে জুয়েলারি বক্স রেডি করে দিলাম, মিস্ বললে তবে না নিয়ে যাবে স্কুলে। মেয়ের আব্দার মিস্ আজই বলেছে নিয়ে যেতে। আমি বিশ্বাস করলাম,শৌভিক নয়। শৌভিক বারবার বলে গেল ও মিথ্যা বলছে, মিস নয়, ও বন্ধুদের দেখাতে নিয়ে যাবে। কার কথা শুনি?তুত্তুরী কেঁদে কেটে দাদু মামমামকে জানিয়ে এমন কাণ্ড বাঁধাল,বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। বড় ক্যারিব্যাগে করে পাঠিয়ে দিলাম স্কুলে। রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরতেই মাসি বলল, মিস এমন কিছু বলেননি, বরং বলেছেন নোটিশ দিলে তবে নিয়ে যেতে। তুত্তুরী আসলে ওর প্রাণের বন্ধু ঈশাণীকে দেখাবে বলে নিয়ে গেছে,ব্যাস শুরু হয়ে গেল শৌভিকের বাক্যবাণ,“বলেছিলাম না,ও ভয়ানক মিথ্যুক!ও মোটেই তোর মত নয়। তোকে একের হাটে কিনে দশের হাটে বেচবে। ওরে সাইকোলজি আমার পাস সাবজেক্ট হলেও আমি খুব ভালো করে পড়েছিলাম। মানবচরিত্র আমি খুব ভালো বিশ্লেষণ করতে পারি। ও অতি ধুরন্ধর। তোর মত গোবরগণেশ নয়। ” আমি যে গোবরগণেশ, সবার সব কথায় বিশ্বাস করি, খুব সহজেই মানুষকে ভালোবেসে ফেলি,এবং সেই ভালোবাসার প্রকাশ না করে থাকতে পারি না তা আমি জানি। তাই বলে কেউ তার সুযোগ নেবে এটা বড়ই হৃদয়বিদারক। শুরু হল অহিংসা অসহযোগ।
বুক ফেটে যাচ্ছিল মেয়ের সাথে কথা না বলতে পেরে, সেই ভোর সাড়ে ছটায় স্কুলে পাঠাবার আগে মেয়েকে চুমু খাই, তারপর সেই রাত আটটা। মাঝে শুধু মেয়ের গায়ের দুধ-দুধ গন্ধটা নাকে লেগে থাকে। আর ঠোঁটে? মেয়ের ফাটা ঠোঁটের ঊষ্ণ চুম্বনের গলিয়ে দেওয়া অনুভূতি । এটা কি কোন বাবার পক্ষে বোঝা সম্ভব ?
তবু চেষ্টা করলাম, মিথ্যে সেই বলে যার কল্পনাশক্তি প্রবল। আমিও বলতাম। পাথর গলেই না। শৌভিকের মতে আমি নির্বোধ চূড়ামণি আর তুত্তুরী অত্যন্ত সুচতুর ভাবে বাবার বিরুদ্ধে আমায় ব্যবহার করছে, দলভারি করার জন্য। কি করি?কি ভাবে সামলাই এই গৃহযুদ্ধ? দুজনেরই ফরিদপুরিয়া গোঁ। আমি হাওড়া-মুর্শিদাবাদ কম্বো, ভালোবাসা আর আবেগ ছাড়া কিছু বুঝিনা। ইশোশানাল ফুল। বাবা মাও যোগ্য সঙ্গত করল, সত্যি বলছি ঘরে দপ্তরে এত চাপ সামলানো অসম্ভব। প্রতি পদক্ষেপে মনে হয় কি অসম্ভব ব্যর্থ আমি। একজন মা এবং একজন মহিলা শ্রমিক হিসাবে-
ঠিক এই সময় আমার প্রাণাধিকা বান্ধবীর মেসেজ, সেও নারী শ্রমিক। তারও একটি মাত্র সন্তান। এবং সেও আগাগোড়া মিথ্যুক। পায়ে কুকুরে আঁচড়ে দিয়েছে, কি অসীম পারদর্শিতার সঙ্গে লুকিয়ে গেছে এই খবর, বাবা মাকে কি অসাধারণ পট্টি পড়িয়েছে ,চেয়ার টানতে গিয়ে পয়ে আঁচড় লেগেছে। ঈশ্বর মঙ্গল করুন “উটো“র সেই বন্ধু ছেলেটির, যার সত্যি কথা শুনে মেলা শেষে প্রায় রাত দশটার সময় আমার বান্ধবী ওষুধের দোকানের ঝাঁপ খুলিয়ে ছেলেকে অ্যান্টি রাবিজ এবং টেটভ্যাক দিতে পেরেছে।
সুকন্যার মেসেজ বুকে বল এনে দিল,নাঃ তুত্তুরী একটু বেশী কল্পনাপ্রবণ বটে তবে খারাপ নয়। পড়াশোনা করুক বা না করুক ক্লাস টুতে উঠেই যাবে। এবার যেটা প্রয়োজন তা হল বাপ†মেয়ের ভাব করিয়ে দেওয়া,আর কে না জানে, পুরুষদের হৃদয়ের রাস্তা কোথা থেকে শুরু হয়, বিশ্বাস করুন শিশুদেরও- নীচের ছবি দুটির একটি হল আমার বানানো গহনার বাক্স আর অপরটি আমার বানানো চকলেট কেক।  প্রেসার কুকারে বানানো। ভিতরে ঠাসা চকোলেট চিপস্।  আসলে হয়েছে কি হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলাম,সংসারে শান্তি চাই। বর আর মেয়ের ভুল বোঝাবুঝি মেটাবো, এদিকে বাড়িতে কোকো পাউডার নেই। ঘড়ি বলছে রাত নটা। হাউসিং এর মার্কেটে তালা, অগত্যা বোর্ণভিটাই ভরসা। ভুলবেন না এটা হল ক্যাডবেরী বোর্ণভিটা, ফাইনেস্ট চকোলেট। সাথে এক চামচ নেসক্যাফেও দিয়েছি কিন্তু, নাহলে ঐ মাদক গন্ধ্টা ছাড়বে না। বোর্নভিটার ডেলা ডেলা পাওয়ার বুস্টার গুলোই বেক করার পর গলগলো চকো চিপস্ হয়ে গেছে। খেয়ে দেখবেন না কি?
পুনশ্চ ঃ- আমার কিন্তু মাইক্রো নেই, প্রেশারকুকার আর নুনই ভরসা।

অনির ডাইরি ১১ই জানুয়ারী ২০১৮
রাত বাড়ার সাথে সাথেই চেনা শহর কেমন যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে। শুনশান কালেক্টরেটে পেশী আস্ফালন করে ঘুরে বেড়ায় একপাল অনাথ সারমেয়।এমনিতেই আমাদের কালেক্টরেটটি বিশাল,লোকমুখে শুনি এটা নাকি হাজি মহম্মদ মহসিন সাহেবের নিবাস ছিল এককালে। এখানকার ঝুল বারন্দা নাকি পৃথিবীর দীর্ঘতম। একদিকে জেলা আদালত, জেলার মূখ্য বিচারকের নিবাস,ডিভিশনাল কমিশনারের দপ্তর অন্যদিকে ডিএম সাহেবের করণ। দিনেমানে বোধহয় হাজার খানেক লোক সমাগম হয়, অথচ রাত নামলেই হানাবাড়ি। বিশাল জনশূণ্য আবছা আলোকিত বারন্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই গা ছমছম করে।যতটা না আধিভৌতিক পরিবেশের জন্য তারথেকে অনেক বেশী দায়ী হাড় কাঁপানো গঙ্গার হিমেল হাওয়া।
ফাঁকা লঞ্চে গুটি কয় সওয়ারি,লঞ্চ ঘাট থেকে স্টেশনে যাবার গমগমে নৈহাটি বাজারে যেন শনি লেগেছে। সারি সারি ঝাঁপ বন্ধ দোকানের সামনের আধো অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে নৈহাটি স্টেশন। আপাততঃ বেশ কিছুক্ষণ  কোন ট্রেন নেই। ফাঁকা বেঞ্চে, ব্যাগ পত্তর আঁকড়ে বসলাম। নৈহাটিতে খুব ছিঁচকে চোরের উৎপাত। অসতর্ক হলেই হাত থেকে ব্যাগপত্র মোবাইল ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়। কাজেই--
মাথায় ঘুরছে মেলার চিন্তা। নিমন্ত্রণ ঠিকঠাক হল তো? আসবেন না জানি, তবুও আমরা এমন ভাবে নিমন্ত্রণ করি যেন ব্যক্তিগত শুভানুষ্ঠান। হোয়াটস্ অ্যাপে জেলা প্রসাশন তথা অন্যান্য দপ্তর এবং লেবার তথা সাবঅর্ডিনেট লেবার সার্ভিসের সকল পরিচিতকে আগেই কার্ডের প্রতিলিপি পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করেছি। এমনকি অবসর প্রাপ্ত শ্রমিকদেরও বাদ দিই নি। হোক না অবসর প্রাপ্ত তাও তো শ্রমিক। কি যে খুশি হন এনারা। এই খুশি টুকুর রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন ওণাদের শুভকামনা হিসাবে।
অনেকেই জবাব দিয়েছেন,ধন্যবাদ জানিয়েছেন। জনৈক রিটায়ার্ড দাদা দেখলাম লিখেছেন, “ধন্যবাদ। তোমাদের অনুষ্ঠান সর্বতোভাবে সাফল‍্যমণ্ডিত হোক , এই কামনা করি। বিশ্বাস করি , হবেও।শুভেচ্ছা নিও।নতুন (ইং) বছর মঙ্গলময় হোক।” মনটা ভরে গেল, এই না হলে বয়ঃজেষ্ঠ্য। সারাদিনের ক্লেদ,গ্লানি, হতাশা,ক্লান্তির ওপর যেন ওষধি মলমের প্রলেপ। দিলখুশ মেসেজ। বলতে গেলাম,“পারলে আসবেন কিন্তু। ”তার আগেই দেখি ওণার মেসেজ ঢুকল,“যেতে হয়তো পারবো না .....
স্ত্রী তো অসুস্থ দীর্ঘদিন ধরে।”সে কি?জানি না তো। অবশ্য জানবই বা কি করে?মেসেজ পাঠাই বটে,নিয়ম করেই পাঠাই, যে কোন উৎসবে-পরবে,বাঁধা গৎ-“আপনাকে এবং আপনার পরিবারের সকলকে অমুখ দিবসের শুভেচ্ছা। ” জবাবেও ফরোয়ার্ডেড মেসেজ বা ছবিই পাঠান সকলে, না ও পাঠাতে পারেন কোন জবাব। কদাচিৎ কেউ কেউ ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠান। “ভালো থেকো” মার্কা। মন ভরে ওঠে ভালো থাকার সুবাসে। তারপর? আবার সেই থোড় বড়ি এবং খাড়া।

যাই হোক, সেটাই বললাম। কি হয়েছে। সুললিত বাঙলা হরফে জবাব এল,“প্রায় বছরখানেক ধরে ভুগছে , নিউরো হসপিটালে চিকিৎসা চলছে। বার দুই মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে । নানারকম সমস্যা।দিনে, প্রথমদিকে , ১৪/১৫ বার জ্ঞান হারাচ্ছিল।কমে ৮/১০ বার...... ৪/৫ বার...... এখন ২/৩ দিনে ১/২ বার ।কোনও রকম উত্তেজনা ( আনন্দ বা দু:খ ) হলেই বেহুঁশ। মাথায় সামনের দিকে একজায়গায় আর পিছনদিকে এক জায়গায় ড‍্যামেজ হয়েছে। পড়ে যায় খালি,গেছে ও বেশ কয়েকবার। ধরে ফেলি আমরা। ফলে , সবসময় আমি আগলে বসে থাকি , বেরোতে পারি না। ডাক্তার strictly বলে দিয়েছে মাথায় আর চোট কোনও রকমে লাগলে fatal হয়ে যাবে , life risk হতে পারে।বুঝতেই পারছ, আর কেউ নেই , ছেলে তো বেরিয়ে যায় অফিস।”
ইশ্ ইশ্ ইশ্ ছাড়া আঙুল সরল না। বৌদিকে দেখিনি কোনদিন,গল্প শুনেছি,বিশাল হাউসিং এর দুর্গাপুজার সব দায়িত্ব উনি একা হাতে সামলাতেন। আর দাদা চণ্ডীপাঠ করতেন। একবার আমার কাতর অনুরোধে সাড়া দিয়ে উনি চার্চ লেনে আমার চেম্বারে কিছুটা চণ্ডীপাঠ করেছিলেন। কি উদাত্ত জলদগম্ভীর  কন্ঠস্বর। টকটকে ফর্সা রঙ,ঋজু চাবুকের মত মাঝারি চেহারা, আর্যসুলভ খাড়া নাক,চোখবন্ধ করে যখন সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন,রীতিমত গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। সেই সৎ ভালোমানুষ দুটিরএকি অবস্থা?উনি ঠিক কারো সমবেদনা বা করুণাগ্রহণের পাত্র নন,তবুও আমার সমবেদনা কি ভাবে যেন খুব ভালো মনেই গ্রহণ করলেন। বললেন, “ জানো, রান্নার লোক নেই দীর্ঘদিন , পাচ্ছি না। ওর বারণ আগুনের সামনে যাওয়া।আমাকেই করতে হয়।ইদানীং ও একটু আধটু জোর করে করছে। আগে তো কোনওদিন করিনি , ভাই।  পারতাম না।ঠেলায় পড়ে শিখে গেছি।” আবার লিখলাম “ইস্ কি অবস্থা। ” আমার শব্দকোষ সাময়িক ভাবে খালি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আদি অনন্তকাল ধরে এই জনহীন নৈহাটি স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে প্রবল ঠান্ডায় আমিও জমে গেছি। উনি লিখে চলেছেন,“ চাইলেও যোগাযোগ রাখতে পারিনা।
২০/২২  টা ওষুধ খাওয়াতে হয়,সারা দিনে। ” 
ঘোষিকা ঘোষণা করে দিল, ট্রেন আসছে। গুটি কয়েক সহযাত্রীও দেখলাম কোথা থেকে এসে হাজির। ফোন বন্ধ করার আগে লিখলাম,“আপনাদের ঈশ্বর কেন এত যাতনা দিচ্ছেন বঝতে পারছি না। প্রার্থনা করি বৌদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। ” উনি লিখলেন,“ সেটাই প্রার্থনা করো। এমনি তে আমি মোটামুটি ঠিকঠাকই আছি, অন্তত শারীরিক ভাবে। তোমাদের শুভেচ্ছা ভালোবাসা আর ঈশ্বরের আশীর্বাদই এই বৃদ্ধের একমাত্র সম্বল।  যোগাযোগ রেখো,একতরফা ভাবে হলেও। রাগ অভিমান না করে।ভালো থেকো। শুভেচ্ছা আশীর্বাদ নিও।” মনটা কেমন ভরে গেল জানেন। কে বলে পৃথিবী শুধুই আবেগহীন, হিসেবী ব্যক্তিবর্গের চারণভূমি ?মোটেই নয়। মোটেই নয়। আমরাও আছি। এবং বিশ্বাস করুন আমরাই কিন্তু সংখ্যাগুরু, আর যতদিন আমাদের মত আবেগসর্বস্ব মানুষজন রয়েছে,পৃথিবী কিন্তু সবুজই থাকবে।

Saturday 6 January 2018

অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি

অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি ২৩.১২.২০১৭
 ( পর্ব- ১)
পশ্চিম মেদিনীপুরের সাথে আমাদের সম্পর্ক বেশ প্রাচীন আমি নিজে প্রায় সাড়ে চার বছর (২০০৭-১১) এবং শৌভিক দু বছর (২০০৯-২০১১) কর্মসূত্রে পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটালেও কখনই ঝাড়গ্রাম যাবার সৌভাগ্য হয়নি আমার প্রাণাধিকা বান্ধবী সুকন্যা ভট্টাচার্য তখন ছিল ঝাড়গ্রামের এএলসি বিয়ের আগে সু বারংবার আমাকে ডাকাডাকি করত, “একবার এস ঘুরে যাও  যাচ্ছি- যাব করতে করতে কখন যে সময় গড়িয়ে গেল বুঝলাম না তলায় তলায় বোধহয় জমছিল অসন্তোষ, চোরাগোপ্তা আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চললেও তা আমার কানে আসত না আচমকা একরাতে, গোয়ালতোড়ে যাত্রা ফেরত একদল আপাত নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরাপত্তা বাহিনী বেদম মারের হাত থেকে বাঁচল না স্কুলের ১২-১৩ বছরের ছাত্রও মেরে নাক মুখ থেঁতো করে দেওয়া হল, ব্যস তারপরই রাতারাতি উত্তাল হয়ে উঠল জঙ্গলমহল আর শৌভিক যখন মেদিনীপুরে গেল, ততদিনে জঙ্গল মহলের রঙ্গমঞ্চ দাপাচ্ছেন কিষেন জী
আপাতত এরিখ মারিয়া রিমার্কের ভাষায় অল কোয়ায়েট ইন দা জঙ্গল মহল”। ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রাম আলাদা জেলা হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে, সুতরাং এবার গন্তব্য ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম যাবার সবথেকে ভালো ট্রেন হচ্ছে,সম্বলপুর-হাওড়া ইস্পাত এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে সকাল ৬.৫৫ এ ছেড়ে ঝাড়গ্রাম ঢোকে মোটামুটি সোয়া ৯টা নাগাদ। আমাদের ট্রেন যদিও ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে নটা বাজিয়ে দিয়েছিল। স্টেশনেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রবিন বাবু। শ্রী রবিন চক্রবর্তী বর্তমানে ঝাড়গ্রামের এএলসি। প্রায় অভিভাবকের মত আমাদের নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিলেন,শুধু তাই নয় যে কটি দিন আমরা ওখানে ছিলাম, রোজ নিয়ম করে রবিন বাবু ফোন করে খোঁজ খবর নিতেন।
ঝাড়গ্রাম শহরটি বেশ মনোরম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বনফুলের গল্পে বর্ণিত রাঢ় বাংলা বা তৎকালীন বিহারের ছোট্ট শহর গুলির মত। বেশ ফাঁকা ফাঁকা, পিচ রাস্তার দুপাশে লাল কাঁকুড়ে মাটি সদর্পে জানান দিচ্ছে আপনি রাঢ় বঙ্গে পদার্পণ করেছেন। প্রচুর প্রচুর গাছগাছালিতে প্রায় সবুজ শহর ঝাড়গ্রামআমরা থাকব বাঁদরভুলা প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রে। ঝাড়গ্রাম ষ্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বে অপেক্ষাকৃত নির্জন শালের জঙ্গলের মাঝে ফরেস্টের গেস্ট হাউস। অনলাইন বুকিং করাই ছিল। পৌঁছে মন ভরে গেল। চতুর্দিকে যতদূর চোখ যায় লাল মাটি আর সারি সারি শাল গাছ। তিনটি মাত্র কটেজ আছে, নামগুলিও কি মিষ্টি- সুবর্ণরেখা, ডুলুং এবং কংসাবতী। চেক ইন টাইম বেলা বারোটা। তবে ফাঁকা থাকলে অনেক সময় আগেই চেক ইন করতে দেয়। যদিও সেদিন আমাদের কটেজটি ফাঁকা ছিল না। কুচ পরোয়া নেই। এক কাপ কফি খেয়ে আমরা রওনা দিলাম চিল্কিগড়ের জঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দির খুব বিখ্যাত। কথিত আছে যে মধ্যপ্রদেশ থেকে জনৈক সূর্যবংশী রাজা  জগতদেও জঙ্গলমহল আক্রমণ করে স্থানীয় ধল্ভুমের আদিবাসী রাজা ধবলদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁর রাজত্ব এবং রানীকে অধিগ্রহণ করেন।এই নতুন রাজাও এরপর নাকি রানীমার অনুরোধে “ধবলদেব” উপাধি গ্রহণ করেন। হয়তো স্থানীয় আদিবাসী প্রজাদের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই নব্য ধবলদেব অথবা এনারই কোন উত্তরপুরুষ স্বপ্নে দেবী মহামায়ার দর্শন পান। দেবী নির্দেশ দেন, অবিলম্বে যেন তাঁর একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। সেই তিন চারশ বছরের পুরানো মন্দিরের নাম ছিল “ব্রাহ্মণমহল”। আজ শুধু তার ধ্বংস মাত্রই অবস্থিত আছে। পাশেই গড়ে উঠেছে নতুন কনকদুর্গার মন্দির। কথিত আছে পাথরের মূর্তির ওপর সোনার আস্তরণ চড়ানোর জন্যই এই নাম।
জঙ্গলের মুখে গাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। পার্কিং ফি ৫০টাকা। আর দর্শনার্থীদের প্রবেশ মুল্য ১০টাকা। জঙ্গলের বুক চিরে পিচের রাস্তা ঢুকে গেছে। দুপাশে প্রায় সাত ফুট সাদা-নীল তারজালের বেড়া। যাতে কেউ জঙ্গলে না ঢুকে পড়ে। এই জঙ্গলে হরেক রকম দুষ্প্রাপ্য গাছ আছে, শাল্লকী, রক্তপিতা, মুচকুন্দ, কেলিকদম, কামিনী, কেন্দু ইত্যাদি।পিচের রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে অদূরে মন্দিরের সামনে। বিশাল লালচে মাঠকে গোল করে ঘিরে একদিকে বেশ কয়েকটি দোকান ফুল-মালা-পুজার ডালি বিক্রি হচ্ছে। দোকান এর সারির ডানদিকে একটি বাচ্ছাদের পার্ক,আর বাঁ দিকে বোটিং এর সাইনবোর্ড দেওয়া। সামনেই প্রাচীন এবং নবীন দুটি মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের উল্টোদিকে একটা সাদা পাথর অথবা সিমেন্টের মূর্তি, যার কোলে কাঁকে ভর্তি হনুমানের দল। এখানকার হনুকূল এবং তাদের গুণ্ডামি অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। ড্রাইভার আমাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। হামেশাই পুণ্যার্থীদের হাত থেকে পুজার ডালি কেড়ে নিয়ে পালায়। বিশেষ করে বাচ্ছাদের ওপর এদের বেশী আক্রোশবাচ্ছাদের হাতে কিছু থাকলে আগে কেড়ে নেয়।
ব্রাহ্মণমহলটির ভগ্নপ্রায় দশা। ভাঙা মন্দিরের আলগা ফটকে ঝুলছে বিশাল তালা। মন্দিরের ছাত ফাটিয়ে নেমেছে গাছের শিকড়। ব্রাহ্মণমহলের ঠিক সামনেই শাখাপ্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটি কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছ। বটগাছের ডালে বাঁধা অজস্র লাল-হ্লুদ সুতা, যার কিছুতে আবার ঢিল বাঁধা। পুণ্যলোভী ভক্তবৃন্দ সম্ভবত সুতা বেঁধে মানত করে। বটগাছের ডান পাশে কমলা সাদা রঙের নতুন মন্দিরটি বেশ বিশাল। সামনে বিশাল মঞ্চ সম্ভবত বলি হয়, এখানে নাকি বলির রক্তের ফোঁটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী ডুলুং নদী অবধি। তবেই নাকি ধরিত্রী উর্বরা হয়ে ওঠে।
জুতা খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে  মন্দিরে ঢুকতে হয়। সামনে এক টুকরো বারন্দা, তারপর গ্রিলের গেট। সেই গেট হনুমানের ভয়ে সব সময় ভেজানো থাকে। গেটের ওপাশে লাল মেজের ওপর পূজারী এবং ভক্তিমতীরা বসে আছেন। সামনে সিংহাসনে আসীন দেবী কনকদুর্গা। এক নজরে পিতলের মূর্তি বলে বোধহয়, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, গাধা অথবা ঘোড়ায় আসীন, চার হাতের মধ্যে তিনটি দৃশ্যমান। এক হাতে খড়গ, এক হাতে প্রদীপ, অপর হাত মুষ্টিবদ্ধ, দেখে মনে হয় ঘোড়ার রাশ ধরার জন্য।
আগেই বলেছি, মন্দিরের অদূরেই ডুলুং নদী। যার নামই এত সুন্দর, তাহলে ভেবে দেখুন সে স্বয়ং কতটা রূপসী হতে পারে।চিল্কিগড় অরণ্যের সীমানা বরাবর ছোট্ট মেয়ের মত নূপুর বাজিয়ে চলেছে ডুলুং। তিরতিরে স্বচ্ছ জলের রঙ সবজে নীল। নদীখাত মুলত বালি, নুড়ি আর কাঁকড়ে পরিপূর্ণ। দেখলেই পা ডোবাতে ইচ্ছা করে।মিষ্টি সোনা রোদে কয়েকজন আদিবাসী নারী পুরুষ স্নান করছে,গোটা দুয়েক উলঙ্গ বাচ্ছা একবার জলে গা ভিজিয়েই পরক্ষণেই পাড়ের বালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেনাগরিক জীবন তথা জটিলতা থেকে বহু দূরে সময় যেন এখানে থমকে গিয়েছে।
অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি ২৪.১২.২০১৭
 ( পর্ব- ২ )
ব্রাহ্মণমহল অর্থাৎ পুরাতন কনকদুর্গা মন্দিরের পিছনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেলে দুটি লাল মাটির পায়ে চলা পথ চোখে পড়ে। একটি নিয়ে যায় ডুলুং এর কাছে, অপরটি মিশে গেছে জঙ্গলে। ডানদিকের পথে অর্থাৎ ডুলুং এর দিকে আমরা ছাড়াও আরো কয়েকজন ভ্রমণপিপাসুর পায়ের ছাপ পড়লেও জঙ্গলের রাস্তা সুনসান। দুষ্টু- মিষ্টি ডুলুং এর সঙ্গ কিছুক্ষণ উপভোগ করে আমরা হাঁটা লাগালাম জঙ্গলের পথে। জঙ্গল বেশ ঘনমূল জঙ্গলকে প্রায় সাত ফুট উঁচু নীল-সাদা তারের জাল দিয়ে আবদ্ধ করার বৃথা চেষ্টা বাঞ্চাল করে, জঙ্গল লাফিয়ে নেমে এসেছে পায়ে চলা পথের ওপর। রাস্তা জনমানবশূন্য, একটু ভয়ই লাগবে।যদিও পথ হারাবার ভয় প্রায় নেই বললেই চলে, কারণ পথ ঐ একটি।  প্রায় মিনিট চল্লিশ হেঁটে জঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করে আমরা পাকা রাস্তার কাছে বেরলাম।
তুত্তুরীর আব্দারে আমাদের আবার জঙ্গলে ঢুকতে হল, বোটিং না করে আমার মেয়ে ফিরবে না। কনকদুর্গা মন্দিরের  পাশেই বোটিং এর সাইন আমার কন্যা দেখতে ভোলেনি। শাখামৃগ কুলের পাশ কাটিয়ে বোটিং এর রাস্তা ধরে দেখলাম, একটা ঘোলা শ্যাওলা ধরা খাল, তাতে গুটি কয়েক প্যাডল বোট বাঁধা আছে। সামনে একটি অল্পবয়সী ছেলে বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছে। বেশ কয়েকটি কমলা লাইফ জ্যাকেট ঝুলছে। জানা গেল, প্যাডল বোট ছাড়া কিছু নেই। তাও মাত্র দুই জন বসার মত। বোটিং এর পরিকল্পনা ত্যাগ করে, ভগ্নহৃদয় কন্যাকে পাশের চিলড্রেন পার্কে নিয়ে গেলাম। পার্কটি বেশ ভালো এবং ঝাঁ চকচকে। দোলনা, শ্লিপ, সি-স সবই বেশ নতুন এবং রঙচঙে। তবে কতদিন থাকবে জানি না, কারণ  বড় বড় করে "১২ বছরের ঊর্ধ্বে চড়া নিষেধ"”লেখা থাকা সত্ত্বেও বাচ্ছাদের মা-মাসি এমনকি বাবারাও দিব্যি চড়ে দোল খাচ্ছেফেরার পথে এক জায়গায় লেখা শিবমন্দির, এখানে নাকি মাটির তলা থেকে শিবলিঙ্গ আপনে আপ উঠে আসে। কিন্তু দেখতে হলে আবার জঙ্গলে ঢুকতে হবে, ইতিমধ্যেই বেলা বাড়ছে, তাই আমরা আর গেলাম না। যদিও পরবর্তী কালে ঝাড়গ্রামের এডিএম সাহেব বলছিলেন, ওটা দেখে আসা উচিৎ ছিল।লাঞ্চের আগে একবার চিল্কিগড় রাজবাড়ি ঘুরে যাওয়া হল চিল্কিগড় রাজবাড়ির কোন ইতিহাস কোথাও পেলাম না চৌকো পাল্লাহীন খোলা ফটক দিয়ে ঢুকলে চোখে পড়ে এক  অপেক্ষাকৃত ছোট অনাড়ম্বর দোতলা বাড়ি সামনে বিশাল খোলা প্রাঙ্গণ, গরু চড়ছে রাজবাড়ির একতলায় সর্বশিক্ষা মিশনের খিচুড়ি স্কুল এবং অফিস। দোতলায় কি জানি না। বাড়িটির পিছনে আর একটি সুদৃশ্য দোতলা পুরানো বাড়ি দৃশ্যমান, কিন্তু কোথা দিয়ে যেতে হয় বুঝলাম না। শৌভিকের ধমক অগ্রাহ্য করেও খোলা মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটি ভাঙা তোরণ তথা দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রতিবারই আবদ্ধ উঠান বা কানা গলিতে ধাক্কা খেলাম। যে কোন কারণেই হোক না কেন সব মিলিয়ে চিল্কিগড় রাজবাড়ি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।   
বাঁদরভুলায় লাঞ্চ বলাই ছিল। কি যত্ন করে যে এরা খেতে দেয় কি বলব।তেমনি সুস্বাদু রান্না। ঝকঝকে কাঁচের প্লেটে গরম ভাত, ডাল,মুচমুচে আলু ভাজা, মাখা মাখা আলু পোস্ত, স্যালাড,ডিমের ঝোল, চাটনী আর পাঁপড়। দ্বি-প্রাহরিক ভুরিভোজের পর, একটু গড়িয়ে নিয়ে আবার বেরলাম আমরা। এবার গন্তব্য কংসাবতী ক্যানেল। গভীর জঙ্গলের মাঝে লাল মাটির রাস্তা দিয়ে গড়াতে গড়াতে চলল গাড়ি, ড্রাইভার দেখালো দূরে একটু উঁচুতে পাকা রাস্তা। ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে দূরত্ব অনেক কম হয়, রাস্তাও ভালো, কিন্তু ভয়ানক হাতির উৎপাত। হাতি বেরিয়ে এলে আর পিছাবার বা গাড়ি ঘোরাবার জো নেই। পাকা রাস্তার এপাশে ঢালু বরাবর ইলেকট্রিক তার টানা আছে। ঐ তারে নাকি রাতের বেলা বিদ্যুৎ দেওয়া থাকে। যাতে হাতি তারের বাঁধন ছিঁড়ে এ পাশে না আসে। কিছুদিন আগে নাকি একটা হাতি শক খেয়ে মারা গিয়েছিল। দিনের বেলা তারে কারেন্ট থাকে না। আমরা নেমে লাফিয়ে তার টপকে ওদিকটা দেখে এলাম। শৌভিক কিছু ছবিও তুলল। সামনে যে রাস্তা চলে গেছে তার দুপাশে পাহাড়প্রমাণ মন্দিরঝাউ এর সারি। কি যে অনির্বচনীয় এই সৌন্দর্য তা ভাষায় প্রকাশে আমি অক্ষম। সর্বোপরি জনশূন্য।
এরপর গন্তব্য আমলাচটি ভেষজ উদ্যান। কত যে অদ্ভুত অদ্ভুত গাছ, আর তাদের নানা গুণাবলী – কয়েকটির নাম বলছি- গন্ধনাকুলী (রক্তচাপ কমাতে এবং চর্মরোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়), ধ/ধব (মুখের ক্যান্সার, কলেরা, সর্দিকাশি), মন্দিরঝাউ (ব্যথা- বেদনা), ফরাস (মুখের ঘা),কাঁঠালিচাঁপা (কলেরা), শঙ্করজটা (অজীর্ণ) ইত্যাদি। এছাড়াও চেনা বাসক, হরীতকী,অশোক, নাগেশ্বর, বকুল এবং নানা ধরণের তুলসী গাছ যেমন- মিষ্টি তুলসী, বাবুই তুলসী এবং দুলাল তুলসী গাছও ছিল। এরপর গোলাপবাগান। ঝাড়গ্রামের মত রুখাশুখা অঞ্চলেও যে কত ধরণের রঙবেরঙের গোলাপ হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হত না। এটা সরকারী সম্পত্তি নয়, প্রবেশ মুল্য ১০টাকা। এরপর ঝাড়গ্রাম মিনি জু। এখানে দেখার মত প্রায় কিছুই নেই- কিছু নীলগাই, হরিণ, একটা বাচ্ছা হাতি, গোসাপ আর কিছু পাখি ছাড়া। তুত্তুরীর জন্যই দেখতে যাওয়া। না গেলেও কোন ক্ষতি ছিল না। অবশেষে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি।
অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি ২৫.১২.২০১৭
 ( পর্ব- ৩)
শেষ বিকালে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। চিল্কিগড় রাজবাড়ির তুলনায় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি অনেক জমকালো।আয়তনেও বিশাল।বিগত কয়েক বছরে আমরা দক্ষিণ বা বলা যায় রাঢ় বঙ্গে যে কটি রাজবাড়ি দেখেছি, সবকটির ইতিহাসই মোটামুটি একই খাতে বয়। এই রাজবংশ গুলির প্রতিষ্ঠাতারা সকলেই বিভিন্ন সময়ে দিল্লীর বাদশাহের পাঠানো সেনাবাহিনীর কোন না কোন সেনানায়ক ছিলেন। সকলেই মোটামুটি রাজপুতানা বা মধ্যপ্রদেশ থেকে বঙ্গদেশে সামরিক অভিযানে আসেন এবং কালক্রমে বাদশাহের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে নিজেকে বিজিত অঞ্চলের রাজা বলে ঘোষণা করেন। ঝাড়গ্রাম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী সর্বেশ্বর সিংহ ও আদতে ছিলেন রাজপুত এবং বাংলার তৎকালীন দেওয়ান মান সিংহের এক সেনা নায়ক। স্থানীয় মাল রাজাদের পরাস্ত করে ১৫৯২ সালে এই রাজ বংশের পত্তন করেন। সাবেকী রাজপ্রাসাদটির বর্তমানে ভগ্নপ্রায় দশা, নতুন রাজবাড়িটির বয়স বেশী নয়। বিংশ শতকে নির্মিত এই রাজবাড়ির একতলাটি বর্তমানে হোটেল এবং দোতলায় রাজ পরিবার এখনও বসবাস করেন।
রাজবাড়ির উল্টো দিকে ট্যুরিজমের গেস্ট হাউসটিও বেশ ভালো। এখানেও বেশ কিছু কটেজ আছে। আরো কিছু নির্মীয়মাণ। জেলা প্রশাসনের নাকি না না পরিকল্পনা আছে এটিকে ভবিষ্যতে বিলাস ভুল রিসর্ট হিসাবে গড়ে তোলার। তবে আপাতত বাঁদরভুলায় ফরেস্টেরটি  নিঃসন্দেহে সেরা।
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি পরিদর্শনের পর, আবার বাঁদরভুলায় ফিরে যাওয়া। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ঝাড়গ্রামের এডিএম ডেভেলাপমেন্ট শ্রী কৌশিক পাল সাহেব আমাদের দুজনেরই পূর্ব পরিচিত। উনি হুগলী জেলার পিডি ডিআরডিসি ছিলেন। বিগত শ্রমিক মেলায় এবং শ্রম দপ্তরের সিকেসিও নিয়োগের সময় আমরা ওনার যৎপরনাস্তি সহায়তা এবং সাহচর্য পেয়েছিলাম। অফিস আসা যাওয়ার পথে লঞ্চ পেরোতে মাঝে মাঝেই স্যারের সাথে দেখা হত। আমরা ঝাড়গ্রাম এসেছি শুনে উনি কিছুতেই ছাড়লেন না, গাড়ি পাঠিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন ওনার কোয়ার্টারে। সন্ধ্যাটা দিব্যি আড্ডা আর ভুরিভোজে  কাটিয়ে প্রায় রাত নটা নাগাদ ফিরে গেলাম বাঁদরভুলায়।
দ্বিতীয়দিন সকাল নটার মধ্যে প্রাতরাশ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঘাটশিলার পথে। বাঁদরভুলায় ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। আগের দিন বলে রাখতে হয়, আপনি কি খাবেন। এমনিতে লুচি, কর্ণফ্লেক্স এবং ব্রেড তিনটিরই অপশন আছে। কেন জানি না ওখানকার ব্রেড বা কর্নফ্লেক্সকে তেমন ভরসা করতে পারিনি আমরা। ফলতঃ লুচি। এত যত্ন করে খাওয়ায় এরা কি বলব,তেমনি সুস্বাদু খাবার। ঝকঝকে কাঁচের প্লেটে গরম গরম চারটি ফুলকো আটা-ময়দার লুচি, দুটি ছোট বাটিতে ছোলার ডাল বা গরম ঘুঘনি এবং হ্লুদ ছাড়া আলুর তরকারী, দুটি করে সিদ্ধ ডিম, দুটি করে কলা এবং দুটি করে রাজভোগ। ঘর প্রতি দু প্লেট করে ব্রেকফাস্ট বরাদ্দ। আমরা তিনজনে মিলে দুপ্লেট শেষ করতে পারতাম না। ফলে রোজই একটি করে ডিম নষ্ট হত এবং কলাগুলি বেঁধে দিতে বলতে হত।রাজভোগগুলির কথা বিশেষ ভাবে না বললেই নয়, এত ভালো মিষ্টি কলকাতা ছাড়ুন আমাদের হুগলীতেও পাওয়া যায় না। পুরো সলিড ছানার ডেলা, মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। আহাঃ।
ঝাড়গ্রাম থেকে ঘাটশিলা যেতে দেড় ঘণ্টা মত লাগে। রাস্তা এমনিতে ঝকঝক করছে, শুধু ঝাড়খণ্ডে কিছুটা অংশে চার লেনের কাজ চলছে বলে রাস্তা রীতিমত এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে এবং প্রচুর ধুলোয় আচ্ছন্ন চতুর্দিক। ঘাটশিলায় প্রথম দ্রষ্টব্য ফুল্ডুংরি পাহাড়। পাহাড় বললে অবশ্য পাহাড় গাল দেবে। ছোট্ট লাল টিলা। গোটা টিলা জুড়ে লম্বা লম্বা শাল গাছের  জঙ্গল। আমরা ছাড়া দর্শনার্থী প্রায় নেই বললেই চলে। ফুলডুংরিতে পায়ে চলা সমতল পথ প্রায় নেই বললেই চলে। যে টুকু আছে পুরো ঢালু এবং গোল গোল নুড়িতে ভর্তি। পা দিলেই ওঠা ছাড়ুন হড়কে নেমে আসবেন। শৌভিক তরতরিয়ে উঠে গেল যদিও, আমি আর তুত্তুরী খানিক নীচে দাঁড়িয়ে থাকলাম। চতুর্দিকের নির্জনতায় কেমন গা ছমছম করে, সাহস করে আমরাও উঠেই পড়লাম। টিলার মাথাটি পাঁচিল দিয়ে গোল করে ঘেরা, কেন জানি না। ওপর থেকে দৃশ্যপট বেশ সুন্দর, তবে আহামরি কিছু নয়। নামাটা ছিল বেশ কঠিন, একবার পা হড়কালে ধরার মত কিছু নেই আসে পাশে, সোজা গড়িয়ে নীচে গাড়ির কাছে পৌঁছে যেতে হবে।
ফুলডুংরির পর বুরুডি ড্যাম। বুরুডি ঘাটশিলার অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ট্যুরিস্ট স্পট। বেশ ভিড় ছিল। চতুর্দিকে ঢেউ খেলানো সবুজ টিলার সারি, মাঝখানে বিশাল বুরুডি লেক। লেকের জল নীলচে। ড্যাম থেকে সিড়ি বেয়ে নীচে নামা যায়। লেকের বুকে একটি ভাসমান জেটি, জেটি অবধি পৌঁছাবার রাস্তাটি বাঁশ এবং কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। যার এক ধারে রেলিং এর মত একটি বাঁশ বাঁধা থাকলেও ওপর দিকটি ন্যাড়া। রীতিমত পা টিপে টিপে যেতে হয় ভাসমান জেটিতে। এখানেও গুটি চারেক প্যাডেল বোট রাখা আছে। যার মধ্যে দুটিতে চার জন বসতে পারে আর দুটি দুজন বসার মত। চার জনের বোট দুটিতে এক দল লোক ইতিমধ্যেই চড়ে লেকের ওপাশে পৌঁছে গেছে। তাদের উচ্চকিত আনন্দ সঙ্গীত (পড়ুন হল্লা) এপাড় থেকেও শোনা যাচ্ছে। লেকের ধার বরাবর উঁচু উঁচু খাড়াই পাথর জেগে আছে, দেখতে বেশ সুন্দর। জনা দুয়েক ব্যক্তি ওগুলির ওপর বসে কেতা মেরে সেলফি তুলতে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে পশ্চাৎদেশে হাত বোলাতে বোলাতে ফিরে এল। ঘড়ির কাঁটা প্রায় মধ্যাহ্নের দিকে দৌড়লেও বেশ কুয়াশা ছিল। রোদের তেজ প্রায় নেই বললেই চলে, শৌভিক কিঞ্চিৎ হতাশ হল বইকি। ভালো ছবি এই অবস্থায় তোলা গেল না বলে। আমরা বাঁধের ওপর দিয়ে মিষ্টি রোদে ভিজতে ভিজতে এপাড়-ওপাড় করলাম। এক নজরে ম্যাসাঞ্জোর বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। যদিও ম্যাসাঞ্জোরের তুলনায় অনেক পরিষ্কার। ড্যামের ওপর জায়গায় জায়গায় প্লাস্টিকের চেয়ারও পাতা, বসে বসে নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য। যদিও চেয়ার গুলিতে যা ধুলো, বসলে জামার রঙ বদলে যাবে। আমাদের মুগ্ধতার সুযোগে তুত্তুরী অবশ্য মহানন্দে বেশ কয়েকটি চেয়ারে বসেও নিল এবং হাত বুলিয়ে ধুলোও ঝেড়ে দিল। জনসমক্ষে তো আর ঠ্যাঙানো যায় না। কি আর করা যাবে। স্যানিটাইজারের বোতল আর টিস্যুই ভরসা।  এবার গন্তব্য গৌরিকুঞ্জ।
অনির ঝাড়গ্রাম-ঘা্টশিলার ডাইরি ২৬/১২/২০১৭
(পর্ব-)
ইতিপূর্বে  কখনও ঘাটশিলায় পদার্পণ করিনি, তবুও ঘাটশিলার নাম শুনলেই মন কেন জানি না অকারণ স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে। বাঙালী হিসাবে ঘাটশিলায় এসে প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভৃষণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি না দেখা অমার্জনীয় অপরাধ স্ত্রী পুত্র নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ উনি ঘাটশিলায় বসবাস করেন। ১৯৫০সালে এই শহরেই উনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।অশনি সঙ্কেত,দেবযানের মত বইয়ের সাথে রচনাস্থল হিসাবে ওতপ্রোত ভাবে মত জড়িয়ে আছে এই মেঠো শহরের নাম।  ঘাটশিলার দহিগোরা অঞ্চলে অবস্থিত বাড়িটির নাম গৌরিকুঞ্জ।
বাড়ির বাইরের প্রাকারে প্রস্তরফলকে লেখা আছে যে দীর্ঘদিনের অনাদরে বাড়িটি ভেঙে পড়ছিল, স্থানীয় বিধায়ক শ্রী প্রদীপ কুমার বালমাচুর উদ্যোগে এবং বিধায়কের তহবিল থেকে প্রদত্ত অর্থে ২০০৯ সালে বাড়িটির আমূল সংস্কার সাধন করে মিউজিয়ামের মত গড়ে তোলা হয়। প্রসঙ্গত যদি এ বাড়ির ভাব না ধরতে পারেন, তাহলে দ্রষ্টব্য কিন্তু কিছুই নেই। সে যুগের এক দরিদ্র, ছাপোষা, সরল স্কুল মাস্টারের বাড়ি যেমন হবার কথা, গৌরিকুঞ্জ ঠিক এমনই।   নিছক সাদামাটা দোতলা বাড়ি। চওড়া নীচু গেট ঠেলে প্রাঙ্গনে ঢুকে বাঁ দিকে দু ধাপ সিঁড়ি ভেঙে দুকামরার বাড়ি। সামনে একফালি বারন্দা। জুতো খুলে উঠতে হয়। এক বৃদ্ধ প্রহরী বারন্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। ঘর গুলির মাথায় বাংলায় লেখা শোবার ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি। লেখকের ব্যবহৃত জামাকাপড় এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি যত্ন করে কাঁচের বাক্সে রাখা। ওণার লেখা কিছু চিঠিপত্রের কপিও সুন্দর করে সাজানো। আমরা ছাড়া আর একটি বাঙালী দম্পতি কেবল মাত্র এসেছিলেন দেখতে। বৃদ্ধ প্রহরীকে নানা প্রশ্ন করছিলেন,কিন্তু জবাব দেয় কে?ঝাড়খণ্ডের ঝিম্ ধরা শীতের রোদে বিমোহিত বৃদ্ধ বুঝি বাকহারা। বাড়িটির বাঁদিকে একই আঙিনায় একটি বিশাল কনক্রিটের মঞ্চ। হয়তো দুর্গা মণ্ডপ। কাকেই বা প্রশ্ন করি। রাজবাড়ি দেখে অভ্যস্ত তুত্তুরী কিছুতেই বুঝতে পারছিল না বাবা মা এক অতি সাধারণ দুকামরার বাড়ি দেখে কেন এত পুলকিতপূর্বোক্ত দম্পতি চলে যাবার পর আমরা যখন নেমে জুতো পড়ছি, বৃদ্ধের ঘুম ভাঙল। মন্ত্রোচ্চারণের সুরে বললেন, “বড়বাবু এখেনেই থাকতেন। ওনার ছেলে তারাদাস। তিনিও এখেনে থাকতেন। তিনি মারা গেছেন। কিছু দিন”। বলে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করলেন। দশ টাকার নোটটি দিয়ে দেখলাম, ওনার পছন্দ হল না, ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আপনার নাম কি?” বৃদ্ধ সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাড়ি চুলকে বললেন, “অপূর্ব।“ শৌভিক ফিসফিসিয়ে বলল, “অপূর্ব? রায় নয়তো? রায় হলেই সোনায় সোহাগা।“ জিজ্ঞাসা করলাম না। কিছু কিছু রহস্যকে ভেদ না করাই ভালো। হোক না জীবন একটু রহস্যময়।

সুবর্ণরেখা অর্থাৎ সোনালি নদী। বিয়ের পর পর শ্বশুরমশাই গল্প শোনাতেন, সুবর্ণরেখার বালি অন্য নদীর বালির মত ফ্যাকাশে না। সোনা রঙ তার। সুবর্ণরেখা মানেই চূড়ান্ত নস্টালজিয়া। সুবর্ণরেখা মানেই ঈশ্বর চক্রবর্তীর নিঃসঙ্গতা- সুবর্ণরেখা মানে সীতা আর অভিরামের বাঁধন ছাড়া মেঠো প্রেমের বানভাসি- সুবর্ণরেখা মানেই-ঋত্বিক ঘটক- অভি ভট্টাচার্য-বিজন ভট্টাচার্য-মাধবী। সুবর্ণরেখা মানে খোয়া আর পাওয়ার গোলকধাঁধা। সুবর্ণরেখা মানে প্রলয়ের মাঝেও  নতুন করে বাঁচার দিশা। ঘাটশিলার রুক্ষ ধুলিমলিন দেহকে স্পর্শ করে বয়ে চলেছে সেই সুবর্ণরেখা।
ড্রাইভার এক বিশাল সুউচ্চ প্রাকার পরিবৃত বাড়ির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ বলে বলল,স্যার উটা ঘাটশিলার রাজবাড়ি ছিল। এখন কিছু নাই। সাপখোপের বাসা। সেই সাপখোপের বাসাকে গোল করে ঘুরে এক নির্মিয়মান ফ্লাইওভারের নীচে থামল গাড়ি। ইঁট পাথর সিমেন্টের জঞ্জালের ওপাড়ে ঢালু মাঠের প্রান্তে বইছে সুবর্ণরেখা। কিন্তু কে? মোটেই প্রলয়ঙ্করী চঞ্চলা তন্বী তো না, বরং শ্লথ পৃথুলা বৃদ্ধা। জলই নেই। নদী খাত বরাবর জেগে আছে অসংখ্য পাথর। পাথরে পা দিয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে নদীর মাঝে চলে যাওয়া যায়। চোখ সয়ে গেলে কিন্তু মন্দ লাগল না। মুস্কিল হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা আড়াইটের ঘর ছাড়ালেও অনেক স্থানীয় লোক,সকলেই বাঙালী চান করতে নেমেছে। যত বড় রূপসীই হোক না কেন এতগুলি গামছা পড়া হুমদো যেখানে প্রবল হল্লা পাকিয়ে চান করছে, তাকে ভালো লাগা বেশ কঠিন দূরে নদীখাতের দিকে আঙুল দেখিয়ে শৌভিক বলল,ওখানে যাবি?নদীর বুকে দুটি মাঝারি সাইজের কংক্রিটের গোল পাইপ দিয়ে কাজ চালানো সাঁকো সেই সাঁকো টপকে নদীর বুকে জেগে ওঠা একটা চর চর জুড়ে শুধুই নানা উচ্চতার উল্লম্ব পাথর। পাইপ টপকাতে গিয়ে টলটল করতে করতে তুত্তুরী থপাস করে জলেই পা ডুবিয়ে দিল। তাকে কোনমতে সামলে ওপাড়ে পৌঁছেই নাক কুঁচকে গেল। এই কারণেই এই অংশটি জনবিরল। স্বচ্ছ ভারতের কোন প্রভাব এদিকে পড়েছে বলে মনে হয় না। ঘাটশিলা আদপেই নির্মল নয় বাপু।নরোবরে ভর্তি। কারা এই ভাবে প্রকাশ্যে পাইপ টপকে খোলা চত্বরে প্রাতঃকৃত করতে আসে ভগবান জানে। এত সুন্দর অথচ উল্লম্ব ভাবে এবড়োখেবড়ো অংশে কাজ করতে বসা মোটেই সহজ নয়। রাগে মুখ লাল করে গাড়িতে ফিরল আমার বর। ড্রাইভার সব শুনে দাঁত বার করে বলল, জন্যই তো স্যার। ওপাশে একটা ঘূর্ণি আছে। পড়লে কেউ বেঁচে ফেরে না। পাথরে চড়লে পাছে আপনারা পড়ে যান- তাই আর কি- তাই ইয়ে করে রেখেছে? ইল্লি আর কি?

সূর্য ঢলার সাথে সাথে আমরাও ছুটতে লাগলাম বাঁদরভুলার পথে। সারাদিন কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। এদিকে তেমন ভাতের হোটেল নাকি নেই। খিদেও পায়নি। সকালের ঐ লুচি-ডাল-তরকারী-ক্লা-ডিম- রাজভোগ খেয়ে। ড্রাইভার শুধু বলল,কাল বেলপাহাড়ি যাবেন তো? তাহলে যাবার পথে শিলদায় কোন হোটেলে বলে যাব খন। বলে রাখলে উরা ভাত রেখে দেয়। তবে কাল কিন্তু অনেক কিছু দেখার আছে স্যার। এট্টু জলদি বের হলে ভালো হয়।
(চলবে)

অনির ঝাড়গ্রাম-ঘা্টশিলার ডাইরি ৩০/১২/২০১৭
(পর্ব-)
জানেন কি, ঝাড়গ্রাম জেলার সবথেকে সুন্দর অংশটির নাম বেলপাহাড়ি। আগের দিন এডিএম কৌশিক পাল সাহেব বলছিলেন যে বেলপাহাড়ি কে নিয়ে জেলা প্রশাসনের না না পরিকল্পনা আছে। উনি বলেইছিলেন,“পারলে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়। সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে। না হলে সব দেখে উঠতে পারবে না।” আমরা যদিও নটার আগে বেরোতে পারলাম না। লুচি-ছোলার ডাল-হলুদ ছাড়া আলুর তরকারি-সিদ্ধ ডিম আর জিভে জল আনা রাজভোগ দিয়ে জম্পেশ করে প্রাতরাশ সেরে বেরোতে বেরোতে বেলাই হয়ে গেল। তাতে সুবিধা যেটা হল, ভোরের কুয়াশা গেল কেটে। টাটকা সূর্যের গলানো সোনা রঙের আলোয় ঝকঝকিয়ে উঠল চারপাশ।
বেলপাহাড়ি ভয়ানক সুন্দর। প্রতিটি স্কোয়ার ফুটই ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হতে পারে- যে দিকে তাকাবেন বটলগ্রীন রঙের শালের জঙ্গল,টেরাকোটা রঙের মাটি, মাটির ওপর গাছের শুকনো ঝরা পাতার আল্পনা।অলস গ্রাম বাংলার জীবন গাড়ির কাঁচ ভেদ করে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসে। মসৃণ রাস্তাঘাট, হুহু করে দৌড়য় গাড়ি।
পাকা রাস্তা থেকে নেমে টলতে টলতে লালচে মেঠো পথে বেশ খানিকটা গিয়ে গাড়ি যেখানে নামাল- তার নাম লালজল। লালজল একটি গুহার নাম। একটি ক্ষয়প্রাপ্ত টিলার মাথায় লালজল নামক গুহায় কোন এককালে জনৈক সাধুবাবা থাকতেন। কি ভাবে থাকতেন জানি না, বেশ ছোট, অন্ধকার এবং চড়াই উতরাই বেশ চাপের। বেতো হাঁটু থাকলে লালজলে না চড়াই ভালো। রাস্তা বলতে ক্ষয়ে যাওয়া বড় বড় পাথর। চার হাত পা প্রয়োগ করারও প্রয়োজন পড়তে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। লালজলের ওপর থেকে দৃশ্য এমন কিছু আহামরি নয়। ছোট্ট পুঁচকে টিলার ওপর থেকে আর কিই বা আশা করা যায়?পাহাড়ের নীচে একটি মন্দিরও  আছে। আসলে এলতলা মাটির বাড়ি, টিনের চালা। একজন প্রৌঢ়া থাকেন, প্রথমে ভেবেছিলাম বুড়ো সাধুর ভৈরবী হবেন হয়তো, নেমে দেখলাম বৈষ্ণব মন্দির।শ্রী চৈতন্য এবং নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর ছবি রাখা। তুত্তুরী জুতো খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে প্রণামী দিয়ে এল। নকুলদানা প্রসাদ পেয়ে মেয়ের আনন্দ দেখে কে? 

লালজলের পর খ্যাদারাণী  ড্যাম। বুরুডি বা মাসাঞ্জোরের সাথে তুলনা করলে কিন্তু বেশ সাদামাটা।একদিকে  দিগন্ত ছোঁয়া বিশাল জলরাশি, অন্যদিকে লালচে মেঠো পথ হারিয়ে গেছে দূরে, হয়তো বা মিশেছে দিগন্তেই। বাঁধের কাছাকাছি অসংখ্য শালুক গাছ। ফুল যদিও চোখে পড়ল না। হয়তো কেউ তুলে নিয়ে গেছে। পাশে স্থানীয় বিনপুর-২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড লাগানো, যাতে স্পষ্ট ভাষায় জলে নামতে নিষেধ করা হয়েছে। লেখা আছে, দেখে যতই অগভীর ম্নেন হোক না কেন, আসলে এই জলাধার যথেষ্ট গভীর, কাজেই মদ্যপ অবস্থায় ছাড়ুন সুস্থ অবস্থায়ও জলে নামা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। হোক সাধারণ, তাও খ্যাদারানীর একটা নিজস্ব সৌন্দর্য তথা মাধুর্য আছে।মহুয়ার মত, যা ধীরে ধীরে আমাদের স্নায়ুর ওপর প্রভাব বিস্তার করছিল, কিন্তু আচমকা বিকট হিন্দি গানের কান ফাটানো আওয়াজে সব চটকা ভেঙে দিল। স্থানীয় পিকনিক পার্টি। বিশাল বক্সে তারস্বরে বাজছে হানি সিং এর ভয়ানক বেসুরো গান। পিকনিক পার্টির দেখা নেই। স্থানীয় ছেলেপিলেদের পিকনিক বেশ বোঝা যায়।
এরপর আজকের মুখ্য আকর্ষণ গাড়রাসিনিকাল থেকেই ড্রাইভার বারবার বলছিল, “স্যার গাড়রাসিনিতে কি আর উঠতে পারবেন? বেশ খাড়াই।“ উঠতে পারবেন মানে? আরে ভাই আমরা গড়পঞ্চকোট পাহাড়ে চড়েছি তিনজনে, এই চেহারা এবং ফিটনেস নিয়ে। পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ভগ্নপ্রায় মন্দির আবিষ্কার করেছি,আমাদের ডিএম সাহেবের ভাষায় ”ইয়ে গাড়রাসিনি কেয়া চিজ হ্যাঁয়?”  বেলপাহাড়ি গেলে গাড়রাসিনি অবশ্যই চড়বেন। এটাই বেলপাহাড়ির সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। প্রথম অর্ধেক পথ জঙ্গল তথা অস্বাভাবিক খাড়া রাস্তা। পুরোটাই নুড়ি পাথরে ভর্তি, যাকে ইংরাজিতে গ্রেভেলস বলে, ওঠা সহজ, নামার সময় পা টিপে টিপে নামতে হয়, নাহলেই সোজা গড়াতে গড়াতে সোজা নীচে। আর বাকি অর্ধেক পথ? সেটাও খাড়াই, কিন্তু সেখানে ওঠার মত কোণ পথ নেই। উঁচুনিচু  পাথরের ওপর পা দিয়ে উঠতে হয়, যার মধে কয়েকটি আবার রীতিমত নড়ে। তবু বলব, গাড়রাসিনির সৌন্দর্য অপরিসীম, জেলা প্রশাসনের কাছে একটাই অনুরোধ, অনুগ্রহ করে গাড়রাসিনিকে গাড়রাসিনির মতই থাকতে দিন। দয়া করে পুরুলিয়ার জয়চন্ডী পাহাড়ের মত কংক্রিটের সিঁড়ি করবেন না, বা কোন মাড়োয়াড়ি সংস্থাকেও করতে দেবেন না। এত কষ্ট করে গাড়রাসিনির মাথায় চড়ার পর আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। নীচে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি থেকে সুদূর খ্যাদারানী ড্যাম সব স্পষ্ট দেখা যায়। মন ভরে যায়। গাররাসিনির মাথায় একটি বন্ধ মন্দির এবং একটি গুহা আছে।
নামার পর ড্রাইভার বিশ্বাসি করছিল না, বার তিনেক প্রশ্ন করল, “স্যার ম্যাডামও চড়ে ছিলেন?” এবার পেটপুজার পালা। ঘড়িতে আড়াইটে বাজছে, আসার সময় শিলদাতে আর বলে আসা হয়নি, অবশ্য বাঁদরভুলার ব্রেকফাস্টের সৌজন্যে আমাদের কারো তেমন খিদে বোধ হচ্ছিল না, ড্রাইভার বিনপুর—২  বিডিও অফিসের সামনে ঘ্যাঁচ করে গাড়ি দাঁড় করালো, বিডিও অফিসের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে ছোট্ট দোকান, অ্যাসবেস্টস বা টিনের চাল, গোটা তিনেক প্লাস্টিকের টেবিলের ওপর টেবিল ক্লথ পাতা, টেবিল পিছু ওলটানও বালতির মত চারটে করে স্টুল পাতা।ভাতের হোটেল। এত বেলায় ঠান্ডা ভাত, পাতলা ডাল, খোলা শুদ্ধ গুটি কয় পাতলা আলুভাজা, পোস্তর বড়া, মাছের মাথা দিয়ে এক হাতা করে বাঁধা কপির তরকারী, আর পোস্ত দিয়ে ট্মেটোর চাটনি( যাতে একদানাও চিনি পাবেন না ) ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই খেলাম চারজনে। কি অসম্ভব ভালো রান্না। পোস্তর বড়া খেয়ে তো আমরা ফিদা। আর আছে কিনা জানতে চাওয়াতে মালিক থেকে রাঁধুনি অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে গেল, কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “ইয়ে স্যার যাবার সময় যদি বলে যেতেন-“।  বলেছিলাম না, এখানকার মানুষজন অসম্ভব অথিতিবৎসল। যদি বেলপাহাড়ি যান, তবে অবশ্যই ঐ দোকানে খাবেন, ওদের পোস্তর বড়া অতুলনীয়, তবে সবথেকে ভালো ঐ ঝালঝাল ট্মেটো পোস্ত, যাকে ওনারা টমেটোর চাটনি বলেন।
এবার গন্তব্য ঘাগরা ফলস আর তারাফেনী ড্যাম
(চলবে)

অনির ঝাড়গ্রাম-ঘা্টশিলার ডাইরি ৩০/১২/২০১৭
(পর্ব-)
বিনপুর ২নং বিডিও অফিসের সীমানা বরাবর টালির চাল আর দরমার তিন দেওয়ালের হোটেলে শালপাতার টাটকা ধোয়া থালায় ঠাণ্ডা গরম মোটা চালের ভাত, পাতলা প্রায় লবণহীন ডাল, গুটি কয় সরুসরু খোলা সমেত ভাজা নতুন আলুর টুকরো,প্রায় তেল ছাড়া বাঁধাকপির তরকারি যার মধ্যে শোভিত একটি মাছের কাঁটা সাক্ষ্য দিচ্ছ যে ইহা আসলে মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি, জিভে জল আনা ইয়া বড় পেঁয়াজ দিয়ে পোস্তর বড়া আর মিষ্টি ছাড়া পোস্ত দিয়ে টমেটোর চাটনী দিয়ে বেলা তিন ঘটিকায় গুরুপাক দ্বৈপ্রাহরিক আহার শেষ করে আমরা তিনমূর্তি রওণা দিলাম ঘাঘরা জলপ্রপাতের উদ্দেশ্য।আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দিনকয়েক আগে বলেছিল, গাড়রাসিনীকে পাহাড় বললে পাহাড় গালাগাল দেবে। ঝাড়গ্রাম থেকে প্রায় ৫০কিমি তথা বেলপাহাড়ি থেকে ৮কিমি দূরে অপেক্ষাকৃত নির্জন বনভূমির মধ্যে অবস্থিত ঘাঘরার ক্ষেত্রেও কথাটি অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত ঘাঘরাকে জলপ্রপাত বলা হয়তো বাতুলতা।ক্ষয়প্রাপ্ত পাথরের বুকে নূপুর পড়া বাচ্ছা নদীর সুললিত নৃত্য বললে বোধহয় ভালো হত। সেই নাচের ধাক্কায় কোথাও কোথাও পাথর ক্ষয়ে নানা বিচিত্র তথা মনোহারী রূপ নিয়েছে। বর্ষায় নাকি ঘাঘরার গায়ে যৌবনের ছোঁয়া লাগে। নদী সম্ভবত যার নাম তারাফেনী, তখন হয়ে ওঠে উদ্দাম। বর্ষা বিদায় নেবার সাথে সাথেই কমতে থাকে তারাফেনীর বয়স। আর এই মাঝ ডিসেম্বরে নদী নেহাতই চপলা শিশুকন্যা মাত্র। ডুলুং এর নিপাট সরলতা বা সুবর্ণরেখার গাম্ভীর্য তথা প্রাজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই,ফাজিল দুষ্টু নদী নিজের মনে কুলকুলিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন পৌছলাম,সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, পিকনিক পার্টিও ডেরাডাণ্ডা গুটিয়ে কেটে পড়েছে। অন্যান্য পর্যটকরাও গাড়ি ঘুরিয়ে কেটে পড়ল এক এক করে। ঝুপ করে নেমে এল অপার নিস্তব্ধতা। ঘাঘরা চতুর্দিকে নির্জন শাল পিয়ালের জঙ্গল, কেমন যেন একটা গা ছমছমে অনুভূতি হতে থাকল। কিছুদিন আগেও এইসব অঞ্চল ছিল দুর্ভেদ্য। আসার পথে ড্রাইভার গল্প বলছিল, সেই সময় একবার সন্ধ্যা বেলা নিকষ অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বরের গাড়ি নিয়ে যেতে গিয়ে তেনাদের নিষেধ সত্ত্বেও আলো জ্বেলে ফেলেছিল- পরিণতি?গাড়ি ঘিরে ফেলে বন্দুকবাজের দল। কলার ধরে টেনে নামায় সকলকে তারপর শুরু হয় গণপ্রহার। হাত এবং বন্দুকের কুঁদো দিয়ে। বলতে ভুলে গেছি ঘাটশিলা থেকে ফেরার পথে তো সেই গাছটাকেও দেখেছি, জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট ঝোরার ওপর কালভার্ট, তারওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার দেখালো,“স্যার উখানেই উয়াকে মেরেছিল”।উয়ার”ভয়েই এককালে সন্ধ্যাবেলা ইস্পাত চলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লালগড় বেলপাহাড়ি হয়ে উঠেছিল লাল মুক্তাঞ্চল। আজ তিনি নেই, তবু এই জনহীন অঞ্চলে অধিক সময় নষ্ট করা নিছক বোকামি। দুষ্টুমিষ্টি তারাফেনীর সাথে নিভৃতে কিছুটা সময় কাটিয়ে রওণা দিলাম তারাফেনী ড্যামের দিকে।
বুরুডি,খ্যাঁদারাণী দেখার পর তারাফেনী ড্যাম আর চোখে লাগে না। ছোট্ট নদীর ওপর আপাত সাধারণ একটা বাঁধ। কোন অনির্বচনীয়তা নেই যার মধ্যে। আমরা আর নামলাম না। সন্ধ্যা নামছে খুব তাড়াতাড়ি, গাড়ি দৌড়োল বাঁদরভুলা প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রের পথে। আজ রাতে দেশী মোরগের মাংস খাওয়াবে বলেই রেখেছে,সাথে হাতে গড়া গরম রুটি। আহাঃ
পরদিনই বিদায় জানাতে হবে ঝাড়গ্রামকে। ফেরার ট্রেন ইস্পাত প্রায় চারটেয় ঢোকে ঝাড়গ্রাম। তার আগে সারাদিন শুধু ঘুরে বেড়ানো। মন মাতানো আটা ময়দার গরম ফুলকো লুচি,ঝাল ঘুঘনি,হলুদ বিহীন আলুর তরকারি, সিদ্ধ ডিম আর রাজভোগ দিয়ে যথাবিহিত উদরপূর্তি করে, বাঁদরভুলার অথিতিপরায়ন স্টাফদের বিদায় জানিয়ে মালপত্র গাড়িতে তুলে আমরা রওনা দিলাম নয়াগ্রাম রামেশ্বরের মন্দিরের পথে। জঙ্গলের মধ্যে সুবর্ণরেখা নদীর ধারে পুরীর মন্দিরের ধাঁচে সাদা চুনকাম করা নাতিদীর্ঘ মন্দির। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মন্দিরে পৌঁছানোর পথের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশে আমি অপারগ। ঝাড়গ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের বনভূমির সাথে এই জঙ্গলের প্রভেদ বিস্তর। এই জঙ্গলের কোণ রহস্যময়তা নেই, কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি জঙ্গল, পথের দুপাশে নাতিদীর্ঘ গাছের সারি, তাতে থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটেছে, জানলার কাঁচ নামালেই ছুটে আসে জংলী ফুলের গন্ধ বাহী হাওয়া, আমরা ছাড়াও আরও অনেকে চলেছে মন্দিরের উদ্দেশ্যে। বেশীর ভাগই স্থানীয় বাসিন্দা, কলেজে পড়া ছেলেমেয়ের দল। সব মন্দিরের মত রামেশ্বরের মন্দিরেরও একটা গল্প আছে, কথিত আছে, চৌদ্দ বছরের বনবাস কালে কখনও রাম, সীতা এবং লক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে এই স্থানে এসে উপনীত হন। গভীর জঙ্গল এবং নিঃসঙ্গ সুবর্ণরেখা পলকে রাম-সীতার মন কেড়ে নেয়। সেই দিনটি ছিল, শির চতুর্দশীর পুণ্যতিথি। সীতা দেবী, সুবর্ণরেখার তটেই সোনালী বালি দিয়ে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ গড়ে ভূতনাথের উপাসনা করেন। উপাসনান্তে যখন শিবলিঙ্গগুলিকে নদী বক্ষে বিসর্জন দিতে যাবেন, আচমকা দৈববাণী হয়, সেই  দৈববাণীর নির্দেশ মত, সীতার আব্দারে রামচন্দ্র বিশ্বকর্মাকে দিয়ে নির্মাণ করান দ্বাদশ শিবলিঙ্গের মন্দির। বর্তমান মন্দিরটির গায়ে কোন অলঙ্করণ দেখতে পেলাম না, বেশ ভিড়। পুণ্যার্থী রমণীগণ পূজার ডালি নিয়ে ভিড় জমিয়েছে মন্দিরের ভিতরে। মন্দিরের সীমানা বরাবর বেশ খানিকটা নীচে কুল্কুলিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুবর্ণরেখা নদী। নদীর তীরে নিভৃত নির্জনতায় অল্পবয়সী কপোতকপোতীদের ভিড়, আমরা আর নামলাম না। বিকাল চারটেয় ট্রেন, এখনও হাতিবাড়ি আর ঝিল্লিবাঁধ দেখা বাকি-
আমাদের ঝাড়গ্রাম ঘাটশিলা ট্যুরের সবথেকে সুন্দর অভিজ্ঞতার নাম হাতিবাড়ি। গহিন শাল-পিয়ালের জঙ্গলের মাঝে নিভৃত ফরেস্ট বাংলো। যার দরজায় ঝুলছে ইয়া বড় তালা। এই ফরেস্ট বাংলোটি অনলাইন বুক করা যায় না। শুনলাম, এটি নাকি সরাসরি ঝাড়গ্রামের ডিএফও সাহেবের তত্ত্বাবধানে থাকে। পাশেই আর একটি ফরেস্ট বাংলো আছে, সেটিও জনবিরল, অথচ দরজা হাট করে খোলা। ভিতরে ডাইনিং রুমে জামাকাপড় শুকোচ্ছে, অথচ ডেকে ডেকেও কাউকে পাওয়া যায় না। পাশেই বয়ে যাচ্ছে কল্লোলিনী সুবর্ণরেখা, ডেকেই চলেছে আমাদের অথচ যাবার পথই মেলে না। নতুন বাংলো থেকে যাবার কোন পথ নেই, আর পুরানোটায় তালা দেওয়া। ড্রাইভার অসহিষ্ণু হয়ে ঘটাং ঘটাং করে বন্ধ দরজা পিটতে লাগল, তাতে শালের মগডাল থেকে উড়ে এল এক ঝাঁক বন্য কোন পাখি, কিন্তু আমরা ছাড়া কোন জনমনিষ্যির সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। অগত্যা পায়ে হেঁটেই ঘুরতে লাগলাম জঙ্গলের বুক চিরে। কি দম বন্ধ করা নৈঃশব্দ্য। নৈশব্দের অত্যাচারেও যে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হয়, তা প্রথম উপলব্ধি করি, বাঁকুড়ার সুতানে, এখানে নৈশব্দের ঐ দৌরাত্ম নেই, কারণ? এখানে জঙ্গল নিজেই যে নিঃসঙ্গ নয়, এখানে জঙ্গলের একটা নদী আছে। বেশ খানিকক্ষণ দিগভ্রান্তের মত ঘোরার পর শুকনো পাতায় ঢাকা একটা সরু পায়ে চলা পথ চোখে পড়ল, সেদিকে পা বাড়াতেই প্রবল উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে উঠল নদী, বেশ খানিকটা নামতেই চোখ ধাধিয়ে গেল পূর্ণ যৌবনা সুবর্ণরেখার উত্তাল সৌন্দর্যে। আহা কি মায়াময় পরিবেশ, ঝকঝকে সোনালী রোদে টলটলে জলের নীচের প্রতিটি নুড়ি পাথরও দৃশ্যমান। আমরা ছাড়া দূরে কয়েকজন স্থানীয় কাঠকুড়ানি,কালোকোলো পাথরে কোঁদা চেহারা। নিভৃতির সুযোগে সদ্য স্নান সেরে উঠেছে কয়েকজন, নদীর বালিতে টানটান করে মেলা তাদের লাল নীল শাড়ি।কেউ বা সস্তা এনামেলের হাড়ি মাজতে ব্যস্ত। কি সামান্য আয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। কি অসীম যত্নে মাজছিল হাড়িগুলো। কুড়িয়ে পাওয়া শুকনো ডালপালা আর পাতার বস্তাকে ধীর লয়ে একটা শালতিতে চাপিয়ে রওনা দিল একজন একাকী রমণী।কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল,কি  অবাঞ্ছিত আমরা এখানে।আমাদের উপস্থিতি শুধু এদের বিব্রতই করবে, থাক জঙ্গলবালিকারা তাদের নিজস্ব বনভূমি আর একলা নদীকে নিয়ে। আমাদেরও একটা জঙ্গল আছে, ইট কাঠ পাথর আর দূষণের জঙ্গল, হোক না তবুও তো আমাদেরই জঙ্গল, আমাদের অপেক্ষাতেই অধীর। এবার ঘরে ফেরার পালা। অবশ্য তার আগে ঝিল্লী বাঁধটা ঘুরে নিতে ভুলিনি। ঝিল্লী বাঁধে এক অপরূপা আদিবাসী রমণীকে দেখেছি জানেন, এমনই শান্ত স্নিগ্ধ তার রূপ, আমার বর ছাড়ুন, আমিই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। নাতি দীর্ঘ, প্রথম আষাঢ়ের মেঘের মত গায়ের রঙ, পরনে লাল পাড় কোরা শাড়ি, যার আঁচল আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়ানো, মাথায় একঢাল লালচে কালো চুল একটা হাত খোঁপায় আঁটছিল না। লজ্জাবনত চোখ দুটি যেন ঝিল্লী বাঁধে ফুটে থাকা গোছা গোছা গোলাপি শালুকের পাপড়ি, ছোট্ট তিরতিরে নাক,পানপাতার মত সুডৌল মুখ। কোন পুজা শেষে, পূজার ফুল ফেলতে এসেছিল, হয়তো তারপর স্নান করবে, কারণ গোড়ালি ভর জলে নেমে সাঁওতালি ভাষায় নিজের বরকে সলজ্জ ভাবে কিছু বলল, বরটিকে দেখেও মন ভরে গেল, পাথরে খোদা নাতিদীর্ঘ শিব ঠাকুর যেন। মেঘলা দুপুরে, দিগন্ত বিস্তৃত ঝিল্লী বাঁধের ধারে শুধু আমরা ছিলাম আর ছিল তারা- আমাদের উপস্থিতিতে কি অসীম লজ্জা পাচ্ছিল দোঁহে, দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা লাগালাম গাড়ির দিকে,মনে মনে বললাম, “ভালো থেকো তোমরা।“
(শেষ)