Saturday 21 April 2018

অনির সাপ্তাহিক ডাইরি, এপ্রিল, ২০১৮

অনির সাপ্তাহিক ডাইরি ১৬-২১শে এপ্রিল, ২০১৮
এবারের সাপ্তাহিক ডাইরি আমাদের মাসিকে নিয়ে।মাসি মানে মায়ের বোন নয় কিন্তু, তেনারা সকলেই সুশিক্ষিত সুচাকুরে, স্বাধীনচেতা, অত্যন্ত প্রগতিশীল মেহনতি নারী। চুপি চুপি বলে রাখি, এই অধমের নারীবাদী হবার মূল অনুপ্রেরণা, কোথাও না কোথাও আমার মা এবং তাঁর তিন বোন।যাই হোক, এই মাসি হল, আমাদের কাজের মাসি।সেই যে, সীতা ভ্রমে যাকে অপহরণ করতে বসেছিল ভিক্ষুক রূপী রাবণ (আশা করি এই বহুল প্রচারিত জোকটি, আপনাদেরও পরিচিত), সেই মাসি। ধরে নেওয়া যাক মাসির নাম- নমিতা।
সমস্ত কাজের মাসিদের যেসব গুণাবলী থেকে থাকে, আমাদের নমিতা মাসিও তার ব্যতিক্রম নয়। যেমন ধরুন ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যরাত্রের ঘণ্টাধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই, মাসির দাবী সনদ এসে পৌঁছায়,”বওদি, মাইনেটুকুন বাড়াতে হবে কিন্তু”। যেমন ধরুন প্রতিটি মেজে যাওয়া বাসনে মাসি হস্তাক্ষর রেখে যায়,আতশকাঁচ ছাড়াও দেখতে পাবেন, হয় এঁটো লেগে আছে, নয়তো সাবান।বলতে গেলেই অস্বীকার, আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, গা মুচড়ে বলবে, “ বওদি, তুমিই খালি বল।“ শুধু কি তাই, মাসির কাজের সময় যদি শ্যেন দৃষ্টিতে নজর না রাখা হয়, তাহলে হয়তো মাসি, একটা ঘর ঝাঁটই দেয় না, বা জল না পাল্টে এক পুঁচকে বালতির জলে গোটা বাড়ি কাদা তকতকে করে মুছে দিয়ে পালায়। কাঁহাতক খিটিরখিটির করা যায়, আর তাছাড়া, নিরপেক্ষ ভাবে বলুন তো, কোন ওপরওয়ালা তার অধস্তন কর্মচারীকে নিয়ে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকে? সুতরাং আমরা বহুদিন হাল ছেড়ে দিয়েছি, মাসিও মনের আনন্দে উত্তরোত্তর ফাঁকি মেরে যায়। তবে হ্যাঁ, মাসির নামে অসৎ হবার বদনাম, শত্রুও দিতে পারবে না, আর একটা বড় গুণ হল, মাসি ছুটি নেবার আগে জানিয়ে দেয়, এবং ঠিক যেদিন ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, পৃথিবী উল্টে না গেলে, সেইদিনই মাসির প্রত্যাবর্তন ঘটে।
মাসির বাড়ি বনগাঁ, আপাতত এখানেই কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকে, এক পশলা বৃষ্টিতেই মাসির ঘরে একহাঁটু জল জমে যায়। মাসে চারটে আবশ্যিক ছুটি ছাড়াও মাসি জলজমার ছুটি পায়। দিতেই হয়। মাসি বিধবা,একাই থাকে।আগে রান্নার কাজ করত, রোজগারও ভালোই হত, কিন্তু বর্তমানে শ্বেতীর প্রাবল্য বড়ই বেড়ে যাওয়ায়, আমাদের এই প্রগতিশীল ন্যুভেরিশ মহল্লায় মাসি আর রান্নার কাজ পায় না। অগত্যা ঘরমোছা-বাসনমাজা। তিনটি কন্যা, সকলেই মাসির মতে সুপাত্রস্থ।তাদের দায়ে-অদায়ে মাসি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়য়, অথচ বিগত চার বছরে, মাসির বিপদে কখনও কারোর টিকিও দেখিনি।একবার ভয়াবহ ফুড পয়জনিং-এ বেশ কিছুদিন ভোগার পর, দুর্বল শরীরে কাজে যোগ দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে মাসি বলেছিল, “কি করব বওদি, কাজ না কইরলে খাব কি? মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছি বওদি চারদিন। আমার বড় মেয়ে পাশেই থাকে।এই কয়দিনে এক থালা ভাতও দিতি পারেনি জানো। রেঁধে আনতি গেছিল, ওর বর এক নাথি মেরে নর্দমায় ফেলে দিইছে।“প্রসঙ্গত মাসির বড় মেয়ে পাঁচ বাড়ি রান্না করে সংসার প্রতিপালন করে। বছর ত্রিশ পয়ত্রিশ বয়স, মাসির মতই সুরূপা, বেশ সুন্দরীই বলা চলে। আর জামাই রিক্সা টানে, তারপর চুল্লু খায়। মেয়েটির তুলনায় বেশ বয়স্ক দেখতে। বউ তার স্বীয় উপার্জন থেকে বাপের বাড়িতে কিছু দিতে গেলেই, নেশাগ্রস্ত পুরুষ সিংহ জেগে ওঠে। প্রায়ই মার খায় মেয়েটি, তবু পড়ে থাকে, “মেয়েজাত” পুরুষ অভিভাবক ছাড়া চলে নাকি?
যাই হোক, বছর খানেক আগের ঘটনা, কি কারণে সেদিন অফিস যাইনি।মাসি, এসেছে বাসন মাজতে, আচমকা মাসির ফোন বেজে উঠল, ফোন ধরে, মাসির সে কি চিৎকার, আর কান্না।আমরা দৌড়ে গেলাম, কি ব্যাপার? জুতো রাখার জায়গায় মাসি ধপ করে বসে পড়ে বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, “কি সব্বোনাশ হল বওদি আমার,”। যা শুনলাম, সাময়িক ভাবে আমারও গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল, মাসির মেজোজামাই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। উন্মত্ত হয়ে, জামাকাপড় খুলে গোটা বাড়িতে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে। নতুন কেনা কালার টিভি, ফ্রীজ, কাঁচের আলমারি, বাসনকোসন সব ভেঙে চুরমার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বউকে বেদম পিটিয়ে, বউয়ের কোল থেকে বছর ছয়েকের আতঙ্কিত শিশুকন্যাকে কেড়ে নিয়ে তুলে আছাড় মেরেছে।ঐ ভাঙচুরের মধ্যেই বাচ্ছাটা বমি এবং হিসি করে গোঙাচ্ছে, আর তার মা, পালিয়ে একটা ঘরের দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে ফিসফিস করে তার মাকে ফোন করছে।
শুনে প্রথমেই বললাম, আগে পাড়া প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন কারো নম্বর থাকলে তাকে ফোন করে বলো ওদের উদ্ধার করতে, আর তুমি এখুনি যাও, মেয়ে আর নাতনীকে নিয়ে এস। আসার আগে, পুলিশে ডাইরি করিয়ে এসো। বড় জামাইয়ের নামেও এর আগে বহুবার থানায় জানাতে বলেছি, প্রতিবার মাসি বলে, “জামাইমানুস বওদি। অত দোষ ধইরতে নেই।তাইড়ে দিলে, বাচ্ছাকাচ্ছা নিই মেয়ে আমার যাবে কুথা? এই দেকো না, আমার বর ও তো, দা দিয়ে মারি আমার সামনের দাঁত গুলা ভেইনে দিইছিল, তাও তো তার শেষ নিশ্বাস অবধি তাইর সেবা আমিই করলাম বওদি।“ এবারে তেমন কোন জ্ঞান দেবার চেষ্টা করল না। দ্রুত হাতে মাসির ফোন ঘেঁটে, অনুরোধ মোতাবেক জনৈক প্রভাতের নাম্বার বার করে ফোনে ধরে দিলাম। শুনলাম, প্রভাত হল মেয়েটির ভাশুর। সে আশ্বাস দিল, সে দেখছে। মাসি চোখ মুছে, ফিরে গেল, এত রাতে মেয়ের বাড়ি যাওয়া অসম্ভব নাকি, সেই বনগাঁর ভিতর দিকে কোন আধা গ্রাম, তাই কাল সকালেই মাসি যাবে।
ছুটি এবং কিছু নগদ দিয়ে যাকে আগের রাতে বিদায় করলাম, পরদিন দেখি সে কাজে হাজির। যাওনি? মাসি বাসন মাজতে মাজতে বিষাদ মাখা কেজো সুরে বলল, “কি কওরবো বলো বওদি, আমার কি কম জ্বালা? পভাত জেতি নিষেধ কইরল যে।“ কে প্রভাত? ও মেয়ের ভাশুর? তা তার এত সাহস হয় কি করে? আর তুমিই বা তার কথা শুনে গেলে না কেন? মেয়ে আর বাচ্ছাটাকে যদি পাগলটা খুন করে?” কি কওরবো বল বওদি, পভাতের কাছে আমার অনেক টাকার দেনা আছি, বুঝেছো। সেবার বন্যায় আমাদের দ্যাশের বাড়ি ধবসি গেল, তারপর বরের চিকিচ্ছা, মেইয়েদের বিয়ে, খেপে খেপে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার মত ধার এখনও শোধা বাকি। পভাত টাকা দিছিল এই শর্তে, যে ওর পাগল ভাইয়ের সাথে আমার বড় মেয়ের বিইয়ে দিতি হইবে।“ মানে? তুমি আগে থেকে জানতে পাগল? “ হ্যাঁ গো। এমনই ভালো ছেলে, বিএ- এমএ পাশ। অঙ্কের ছাত্রর পড়ায়। তবে মাথা বেগড়ি গেলেই এমন করে। পভাত তো নিজেও বড় অপিসার। বেরামপুরে থাকে।“ মানে? বহরমপুর থেকে সে বলল, সে দেখছে, বনগাঁয় কিভাবে সব ম্যানেজ করবে, আর তুমি গেলে না? “ হ্যাঁ বওদি, কাল সারা রাত শুধু কেইন্দেছি। আমার বড় মেয়েটা ঠিকই করছিল, যে পালিয়ে গিয়ে রিক্সাওলাকে বিয়ে করল। তখন পভাত বলল, তাহলে মেজোটার সাথে দিয়ে দাও। মেয়ে আমার বিয়ে করতে চায়নি বওদি। জামাইকে তো দেখতেও কুচ্ছিত।বুড়ো হাবড়া, সব চুল পেকি গেছে। এট্টাও দাঁত নেই। মেয়েটার আমার সবে ২৪ পুরোবে।“
তবে আবার কি? ফিরিয়ে নিয়ে এস। দেনার দায়ে, যে পাপ করেছ, প্রায়শ্চিত্ত কর। মাসির সেই এক কথা, আনলে খাবে কি? ভালো করে বোঝালাম,গতরে খেটে খাবে, তোমার মত। তোমার মাটির এক কামরার ঘরে ভাগাভাগি করে থাকবে, নিরাপদ তো থাকবে অন্তত। মাসি নিমরাজি হয়ে গেল, দিন চারেক বাদে একগাল হেসে ফিরে এল।“পভাত সব ঠিক করে দিয়েছে বওদি। নতুন টিভি, আলমারি কিনি দিইয়েছে,ওদের সংসার তো পভাতই টানে।“ আর পাগলাটা? “ও এখন ঠিক আছে।“ মেয়েকে আনলে না? “মেয়ে আসতে চাইল না বওদি। বলল, এরা আমার জীবন বরবাদ কইরছে, এত সহজে ছেড়ে দেব নাকি? পভাতকে বলেছে আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমাকে।“ বাঃ। মধুরেন সমাপয়েতঃ। তা তোমার পভাত কি বলেছে? জবাব পেলাম, প্রভাত বলেছে, ভেবে পরে জানাবে। আপাতত, ভাইকে সামলে, লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘরকন্যা করতে। কিন্তু প্রভাত তো ঐ বুড়োটার দাদা, অনেক বড় না, তোমার মেয়ের থেকে? মাসি, দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “পুরুষমানসের আবার বয়স আর চরিত্তির।“
কিছুদিন পর শুনলাম প্রভাত নাকি ভেবে চিন্তে জানিয়েছে, এই মুহূর্তে বিয়ে করতে অপারগ।আরো ভাই আছে, তাদের সংসারও প্রভাতকেই টানতে হয়, কাজেই- তবে সামনেই অবসর নেবার দিন আসছে, তখন ভেবে দেখবে। আপাতত কন্যা পাগলের সাথেই ঘরকন্যা করুক।
মাস ছয়েক আগে শুনলাম, মেয়েটি আসন্নপ্রসবা, মাসির লম্বা ছুটি চাই। শালীনতার সীমা অতিক্রম না করেই জানতে চাইলাম, এটা বৈবাহিক ধর্ষণের পরিণাম নয়তো? মাসি এমন হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, যে বেশ বুঝলাম বৈবাহিক ধর্ষণ শব্দবন্ধটি মাসির একেবারেই অপরিচিত। চারটি রসকদম্ব নিয়ে ফিরে এল মাসি, নাতি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মাসি আবার ছুটির দরখাস্ত পেশ করল, নাতির মুখে ভাত। প্রভাত, বিশাল ধূমধাম করে অন্নপ্রাশন করছে ভাইপোর, সারা গ্রাম নিমন্ত্রিত। সোনার চেন দিয়ে মুখ দেখেছে, মাসি কি দেবে তাই নিয়ে মাসি ভয়ানক উদ্বিগ্ন ছিল, আংটি, জামা ইত্যাদি কেনার টাকাও প্রভাতই দিয়েছে।সম্ভবত ধার, মাসি নিজেও জানে না এখনও, সময়মত বলবে প্রভাত। দিলাম ছুটি, সবাই দিয়েছে। কাজ সেরে মাসি চলে যাচ্ছে, দরজা বন্ধ করতে গিয়ে শুনলাম মাসির ফোন বাজছে, মাসি ফোন ধরে উল্লসিত স্বরে বলছে, “কি গো পভাত? তোমার ছেলি কি কইরছে অ্যাঁ?খেলছে? হে হে হে......” ।

No comments:

Post a Comment