Tuesday 22 May 2018

শকুন্তলা

শকুন্তলা ২২/০৫/১৮
ছোট্ট বেলার অমরচিত্রকথা। রঙবেরঙের পুষ্পশোভিত ঘণ সবুজ তপোবনের এক কোণায় মৃগ শিশুকে আলিঙ্গনরতা তরুণী তাপসীর সাথে আচমকা শুভদৃষ্টি হয়ে গেল এক তৃষ্ণার্ত  শ্রান্ত পথভ্রষ্ট যুবকের। প্রাথমিক জড়তা  সঙ্কোচ অবসানে পরিচিত হলেন তাঁরা একে অপরের সাথে, প্রবলপরাক্রান্ত পুরু রাজ দুষ্মণ্ত আর কণ্বের পালিতা কন্যা শকুন্তলা। শকুন্তলার স্নিগ্ধশীতল কমনীয় রূপ বড়ই চিত্রাকর্ষক। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত শিশিরসিক্ত   পুষ্প। মোহিত হয়ে গেলেন রাজন।পালকপিতা তথা তপোবনের অধীশ্বর কণ্বমুনির অনুপস্থিতি জ্ঞাত হয়েও গন্ধর্ব বিবাহের প্রস্তাব দিলেন রাজা দুষ্মণ্ত। প্রাথমিক জড়তা ঝেড়ে ফেলে সম্মত হলেন কন্যা। পঞ্চভূতকে সাক্ষী রেখে শুভবিবাহ সম্পূর্ণ হল।সুখস্মৃতির স্মৃতিচিহ্ন   স্বরূপ স্বর্ণাঙ্গুরীয় দিয়ে বিদায় নিলেন রাজা, প্রতিশ্রুতি অচীরেই লোকলস্কর পাঠাবেন সসম্মানে শকুন্তলাকে রাজগৃহে বরণ করে নেওয়া হবে।
এরপর যথারীতি দুর্বাসা মুনির আগমন এবং পতির বিরহে কাতর অন্যমনস্কা শকুন্তলাকে ভর্ৎসনা  ও অভিশাপ প্রদান। ফলশ্রুতি পলকে শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলেন রাজা। দীর্ঘদিন পিতার আশ্রমে স্বামীর অপেক্ষা করার পর অবশেষে পতিগৃহে যাত্রা করলেন শকুন্তলা।প্রিয়তমা সহচরী অনসূয়া প্রিয়ম্বদা, সাধের তপোবন,স্নেহের মৃগশিশুকে (অথবা তার নাতিপুতি) পিছনে ফেলে সাশ্রুনয়নে সালাঙ্কারা কন্যা চললেন মধুমিলনের উদ্দ্যেশ্যে,গন্তব্য হস্তিনাপুর। পথে হারিয়ে ফেললেন সাধের রাজ অঙ্গুরীয়(অমনি গপ্ করে গিলে ফেলল ইয়া বড় মৎসরাজ/রাণী)। অতঃপর রাজদরবারে সর্বসমক্ষে  চূড়ান্ত অপমানিত হলেন আজন্ম অরণ্যে পালিতা সরলপ্রাণা শকুন্তলা। এমনকি স্বামী পরিত্যক্ত  কন্যাকে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করলেন সঙ্গে আগত আশ্রমবাসীরাও। একাকিনী আসন্ন প্রসবা শকুন্তলা পুনরায় উধাত্ত  হয়ে গেলেন গভীর বনানীর মাঝে।
এরপর নাটক জমজমাট করতে অবতীর্ণ  হলেন স্বয়ং মৎসরাণী। ধরা পড়লেন ধীবরের জালে, পেট থেকে বের হল সেই মূল্যবান মণিরত্নখচিত রাজ অঙ্গুরীয়। অঙ্গুরীয় দরশনে  বিলুপ্ত স্মৃতি ফিরে পেলেন রাজা। পাপবোধে জর্জরিত রাজা দৌড়লেন শকুন্তলার তত্ত্বতল্লাশে, কিন্তু শকুন্তলা কোথায়?
দীর্ঘ অনুতাপের পর্ব মিটলে পুনরায় অরণ্যে মৃগয়া করতে গেলেন রাজা, সেখানে প্রত্যক্ষ করলেন এক অপরূপ রূপবান বালককে। কি তার বিক্রম!স্বয়ং পশুরাজও তার বিশ্বস্ত  সারমেয় তুল্য বশ্য। মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজা। সস্নেহে জানতে চাইলেন,“কে তুমি? কি তব পরিচয়?” আধো আধো সুমিষ্ট আলাপচারিতার মাঝেই মঞ্চে প্রবেশ বালকের তরুণী মাতার। চমকে উঠলেন রাজন, এই তো সে। হারানিধি। তাপসী শকুন্তলা। নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন রাজন,সুখে সপুত্র পতিগৃহে যাত্রা করলেন শকুন্তলা।
এ তো গেলেন মহাকবি কালিদাসের বেতসপত্র সুলভ শকুন্তলা। আসুন এবার মহাভারতের শকুন্তলা তথা দুষ্মণ্তের সাথে  আলাপিত হই।সসৈন্য মৃগয়া করে বহু পশুহত্যার পর শ্রান্ত দুষ্মণ্ত  অনুচরবৃন্দকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে প্রবিষ্ট  হলেন মালিনী নদীর তীরে কণ্ব মুনির অনুপম কাননে। সেখানেই লক্ষ্মী স্বরূপা অতীব রূপবতী তাপসবেশধারীণী কন্যা পিতার অনুপস্থিতিতে তাঁকে যথোচিত সৎকার করলেন। ভোজননান্তে রাজা এই সুনিতম্বিনী চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী কন্যাকে প্রশ্ন করলেন,“কে আপনি আর্যা?” কন্যা নিজেকে পরিচয় দিলেন কণ্ব মুনির কন্যা শকুন্তলা বলে। সে পরিচয় নস্যাৎ করে দিলেন রাজন, কারণ মুনি ঊর্ধ্বরেতা তপস্বী। পীড়াপীড়ি  করাতে কন্যা সলজ্জ ভাবে জানালেন তিনি মহাঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা মেনকার গর্ভজাত তথা জন্মলগ্নেই পরিত্যক্ত  কন্যা শকুন্তলা। কণ্ব মুনির পালিকা দুহিতা।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র আদিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন, সুতরাং শকুন্তলা ক্ষত্রিয়কন্যা, তাই গন্ধর্বমতে বিবাহে কোন সমস্যা ছিল না। শকুন্তলা তবু কিঞ্চিৎ  ইতস্ততঃ করছিলেন, পালক পিতার অনুপস্থিতিতে এই ভাবে লুকিয়ে বিবাহ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু অভিজ্ঞ রাজপুরুষের কূটনৈতিক দক্ষতায় সব সঙ্কোচ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন রাজন। সামান্য তপোবনচারিনী কন্যার সাধ্য কি তাঁর যুক্তি খণ্ডন করে?

তবে মহাভারতের শকুন্তলা আদৌ অমরচিত্রকথা বা কালিদাসের শকুন্তলার ন্যায় আবেগের বশীভূত গর্দভ ছিলেন না, রাজার প্রস্তাবে সম্মত তো হলেন কিন্তু, মিলনের পূর্বে কন্যা রাজাকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন তাঁর গর্ভজাত পুত্রই হবেন যুবরাজ এবং দুষ্মণ্তের অবর্তমানে তাঁর সমগ্র রাজ্যের অধীশ। প্রসঙ্গত রাজার অপর এক স্ত্রী ছিল, যাঁর নাম লক্ষণা এবং তাঁর গর্ভজাত পুত্রের নাম জনমেজয়।

মিলন শেষে হৃষ্টচিত্ত রাজা দ্রুত ফিরে গেলেন তাঁর রাজ্যে(কণ্ব মুনি জানতে পারলে কি বলবেন চিন্তা করতে করতে)। যাবার পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন অচীরেই পাঠাবেন চতুরঙ্গিনী সৈন্যসামন্ত, তখনই যথাবিধি পতিগৃহে গমন করবেন শকুন্তলা, তৎপূর্বে নয়। কোন অঙ্গুরীয়/কণ্ঠহার/কোমরবন্ধনী কিছুই বোধহয় দিয়ে গেলেন না। বা গিয়ে থাকলেও পরশুরামের অনুদিত মহাভারতে তার উল্লেখ নেই।
কণ্বমুনি ফিরে এসে দৈব বলে সব জানতে পেরে মার্জনা করলেন তাঁর আদরের দুহিতাকে। কেটে গেল তিন তিনটি বৎসর। দুর্বাসা কিন্তু এলেন না, ফলে ভুলে যাবার অভিশাপও কেউ দিল না। তবু রাজা যেন ভুলেই যেন ক্ষণিকের সেই মিলন। অমন তো কতই হয়। তিন বৎসর পর (মহাপুরুষরা নাকি দীর্ঘদিন মাতৃগর্ভে বসবাস করে) কণ্বমুনির আশ্রমেই ভরতের জন্ম দিলেন শকুন্তলা।

দুবছর বয়সের মধ্যেই তার মধ্যে দেখা গেল প্রবল পরাক্রম। অরণ্য থেকে হিংস্র জীবজন্ত ধরে এনে বেঁধে রাখতেন পোষ্য অনুগত সারমেয়র মত। তাই তার অপর নাম নাকি সর্বদমন। যাই হোক ভরত যখন তিন বছরের,বিষণ্ণ হৃদয়ে শকুন্তলাকে পতিগৃহে রওণা করে দিলেন মহর্ষি কণ্ব।
বিশাল জমজমাট রাজদরবারে, শিশু পুত্রের হাত ধরে সর্বসমক্ষে এসে দাঁড়ালেন শকুন্তলা। বললেন,“রাজন,তুমি অঙ্গীকার করেছিলে,আমাদের পুত্রই হবে যুবরাজ। এই নাও আমাদের পুত্র, অভিষিক্ত  কর যৌবরাজ্যে। ”দুষ্মন্ত দিব্যি চিনলেন শকুন্তলাকে, কিন্তু তাও সর্বসমক্ষে স্বীকার করলেন না। উল্টে বললেন,“দুষ্ট তাপসী,তুই কে? তোর সাথে আমার ধর্ম, অর্থ বা কামের কোন সম্পর্ক হয়নি। ” লজ্জায় অসম্মানে তথা তীব্র অপমানে সাময়িক ভাবে শকুন্তলার মনে হল তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছেন। পরক্ষণে তীব্র ক্রোধ গ্রাস করল তাঁকে,দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরলেন প্রাণাধিক পুত্রের হাত। হিসহিস করে বললেন,“দুষ্ট রাজন। তোমার সব মনে আছে। অহেতুক মিথ্যা বললে আমার অভিশাপে তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ  হবে। আমায় পরিত্যাগ কর, আমি ফিরে যাব আমার অরণ্য মায়ের কোলে, পালক পিতার নিরাপদ আশ্রয়ে কিন্তু এই শিশু?এ তোমার আত্মজ। একে ত্যাগ কোর না।”
রীতিমত প্রেম চোপড়া বা শক্তি কাপুর সুলভ ভঙ্গীতে রাজা বললেন,“আমার ঔরসে?তোমার গর্ভজাত পুত্র? কই? আমার তো মনে পড়ে না।নারীরা এমনি বেশী মিথ্যা বলে। আর যার জননী বারঙ্গণা মেনকা আর জনক ব্রাহ্মণত্ব লোলুপ নির্দয় কামুক বিশ্বামিত্র তার থেকে আর কি বা আশা করা যায়। দুষ্ট তাপসী দূর হও।”
তীব্র স্বরে শকুন্তলা বলল,“মেনকা দেবতাদের পরম কাম্য, দেবী রূপে গণ্য হন।আমি তাঁর কন্যা। মূর্খ রাজা তুমি ভূমিতে চলো, আমি অন্তরীক্ষে। আমি ইন্দ্র কুবেরাদির গৃহে যেতে পারি। যে দুর্জন, সে পরম সজ্জনকেও দুর্জনই দেখে। তুই মূর্খ রাজা।ঘোর পাপাচারী। তোর সাথে মিলনের কথা ভাবলেও বমনেচ্ছা জাগে। শোন রে দুরাত্মা, তোর সাহায্য ব্যতিরেকেও আমার পুত্র সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর হবে। ” এই বলে শকুন্তলা সপুত্র নিষ্ক্রমণে উদ্যত হলেন, এমন সময় দৈববাণী হল,শকুন্তলাই সঠিক।
রাজা দেঁতো হেসে মন্ত্রী অমাত্যদের কইলেন, “শুনলেন তো। আমি স্বয়ং এই বালককে পুত্র বলে মানি,তবে কি না শুধু শকুন্তলার কথায় যদি ওকে আপন করে নিতাম- তবে হেঁ হেঁ লোকে দোষ দিত কিনা। ” আর শকুন্তলাকে বললেন,“দেবী!তোমার সতীত্ব প্রতিপাদনের জন্যই তো আমি এইরূপ ব্যবহার করেছিলাম, নয়তো লোকে মনে করত, তোমার সাথে আমার ইয়ে ইন্টুপিন্টু হয়েছিল। তোমার ছেলেই তো রাজা হবে, কথা দিয়েছি না। চলো এবার ঘরে চলো আর হ্যাঁ তুমি কিন্তু আমায় আজ পচুর বাজে কথা বলেছো,হ্যাঁ। আমি খুব দুক্কু পেয়েছি কিন্তু তাও দেখো আমি কতো মহৎপ্রাণ আমি, যাও তোমায় ক্ষমা করলাম। ”
(আসল দুষ্মণ্তকে চেনা চেনা লাগল কি? সত্যিই মহাভারতের জবাব নেই। সাধে কি বলে? “যা নেই (মহা)ভারতে, তা নেই ভারতে”। )

No comments:

Post a Comment