Thursday 3 May 2018

প্রাণস্বরূপিনী-


সুনিবিড় বনানীর মর্মস্থলে লুক্কায়িত এক পুষ্পদ্যান। প্রাথমিক দর্শনে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নহে, দেব যন্ত্রবিদ্ বিশ্বকর্মা অথবা দানবকূলশ্রেষ্ঠ ময় স্বয়ং স্বহস্তে  নির্মাণ করেছেন এই উদ্যানের। আপাততঃ উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এক সুবিশাল বট বৃক্ষতলে গভীর আলাপচারিতায় মগ্ন দুই সুবেশ যুবক। যুবক ঠিক নয়, যৌবন অস্তাচলে গমন করতে উদ্যত হয়েছে কিন্তু যেতে পারেনি। দুই একটি শ্বেত কেশ বা শ্মশ্রু রাজিই তার একমাত্র প্রমাণ, অন্যথা দুই যুবকই অনুপম সৌন্দর্যের অধীশ্বর। ঋজু দীর্ঘ দেহে বলিষ্ঠ পেশীদের আঁকিবুকি, উন্নত নাসা, গভীর আঁখি, ঘণ আঁখিপল্লব। শুধু একজনের গাত্রবর্ণ দুধে আলতা অপরজনের নবজলধরশ্যাম। শ্যামল যুবকের দুই চোখে মাখামাখি আজব দুষ্টুমি, শ্বেতাঙ্গ যুবকের দুই আঁখি যেন বেদনার কবিতা।
বৃক্ষতলে ভগ্নপ্রায় বেদীর উপর কিছুটা উচ্চ আসনে আসীন শ্যামল যুবক, তার পদতলে নতমুখে আসীন শ্বেতাঙ্গ যুবক। শ্যামল যুবক তাকে কিছু বোঝাবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, অপরজনও বুঝতে চায়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হৃদয় বারবার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। অবশেষে সস্নেহে শ্বেতাঙ্গ যুবককে বুকে আঁকড়ে ধরলেন শ্যামল যুবক। আলিঙ্গনাবদ্ধ  অবস্থায় কেটে গেল বেশ অনেকটা সময়, শ্বেতাঙ্গ যুবক কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে গুমরে অশ্রু বিসর্জন করলেন, তারপর  ধীরে ধীরে মেনে নিলেন শ্যামল যুবার বক্তব্য।
ঘণ বনানীর ভিতর থেকে কয়েকজোড়া বিষাক্ত  চোখ এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিল দুজনারে। এবার ডালপালা সরিয়ে বেরিয়ে এল তারা। সকলের অগ্রভাগে যিনি, তিনিও যথেষ্ট রূপবান,শুধু দুই চোখে ধিকিধিকি জ্বলছে ঈর্ষার সবুজ আগুন। সঙ্গী যুবকও ততোধিক রূপবান, তার দুই চোখে তীব্র ব্যঙ্গ।  আলিঙ্গনাবদ্ধ  দুই যুবক ওণাদের পদস্পর্শে সচকিত হয়ে তাকিয়ে আগত যুবকদের দ্রুত প্রীতি সম্ভাষণ জানালো।
শ্যামল এবং গৌর উভয় যুবাই ঈষৎ  নত হয়ে করজোড়ে বলে উঠলেন,“প্রণাম মহরাজ। ” মহারাজ অর্থাৎ যাঁর দুই চোখে খেলে বিষ, যিনি বিদ্রুপের সুরে তাঁর সঙ্গে আগত সঙ্গী যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন,“অঙ্গরাজ, ঠিক কতদিনের বন্ধুত্ব আমাদের?” অঙ্গরাজ বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললেন,“মনে নেই সখা। সেই যে হস্তিনাপুরে শস্ত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল, সে হল অনেক কাল। তোমরা তখন সদ্য শস্ত্রচালনা শিখেছ। তৃতীয় পার্থর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যজুড়ে। আমারও কানে এল বটে, ভাবলেম, আমিও পরশুরামের শিষ্য বটে, যিনি না জানি কতবার ক্ষত্রিয়শূণ্য করছেন এ ধরা, তাঁর সুশিষ্য হয়ে একবার দেখাই যাক না, কত বড় ধনুর্ধর এই তৃতীয় পার্থ। ” মহারাজ হো হো করে হেসে বলে উঠলেন, “তা কি দেখলে হে? কতবড় বীর কৌন্তেয়?” অঙ্গরাজ জিহ্বা ভর্তি বিষ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,“উফ্ মস্ত বড় বীর বটে। আমার সাথে লড়লেনই না। আমি সূতপুত্র কি না। তবু ভালো আমার অঙ্গুলি গুলি অবিকৃত আছে, শোনা যায় এক নিষাদ পুত্রকে তো-। ”।  মহারাজ আবার অট্টহাস্য করে বললেন,“আসলে ভয় পায় । ভয়। সখা। আমি তৎক্ষণাৎ তোমায় অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর রূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তাও-”। দুই সখার অট্টহাস্যে উড়ে গেল বটে আশ্রয় নেওয়া পাখির দল। শ্বেতাঙ্গ যুবক অর্থাৎ তৃতীয় পার্থ নীরব এবং অবনতমস্তক রইলেন, কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে মহারাজ দুর্যোধন আবার শুরু করলেন,“তা সখা এত বৎসরে কতবার তোমায় এভাবে আলিঙ্গন করেছি আমি?” ছলছল চোখে পার্থ তাকালেন উপহাসরত দুই প্রতিপক্ষের দিকে। হ্যাঁ প্রতিপক্ষই তো। আগামী কাল প্রভাতে শুরু হতে চলেছে এক চিলতে রাজসিংহাসনের অধিকার দিয়ে কুরু পাণ্ডব যুদ্ধ। উভয় পক্ষের সব আয়োজন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। পড়ন্ত বিকালে নিজ শিবিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যুযুধান প্রতিপক্ষের নেতৃবর্গকে দেখে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তৃতীয় পার্থ। এরা কারা?এদের বিরুদ্ধে ধারণ করতে হবে শস্ত্র? পিতামহ ভীষ্ম যাঁর কোলে চেপে কেটেছে শৈশব?গুরু দ্রোণ? যাঁকে পিতৃ অধিক শ্রদ্ধা করেন পার্থ,ভালোবাসেন।ভ্রাতা দুর্যোধন? বিকর্ণ? যাদের সাথে পিঠোপিঠি খুনসুটি করে কেটেছে শৈশব? জয়দ্রথ? একমাত্র ভগিনী দুঃশলার স্বামী? মাতুল শল্য? না অসম্ভব। একমাত্র অঙ্গরাজ কর্ণ ব্যতিরেকে এঁদের কারো বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ অসম্ভব। কর্ণকে মারতে অবশ্য হাত কাঁপবে না পার্থর।
যাই হোক পার্থর এই চিত্তবৈকল্য প্রত্যক্ষ করেই সখা কৃষ্ণ তাকে টেনে এনেছে কুরুক্ষেত্র প্রান্তর থেকে বহুদূর এই বনানীর অভ্যন্তরে। পাপাচারী দুর্যোধন নির্ঘাত চর মারফৎ খবর পেয়ে পশ্চাৎধাবন করেছে। একাকী এসেছে না সৈন্যদল সমেত? যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভেই যদি ঘায়েল করা যায় কৃষ্ণ আর অর্জুনকে, বাকি পাণ্ডবদের পরাস্ত করা এক পলকের ব্যাপার। হতাশায়, বেদনায় চিন্তাশক্তিহীন হয়ে পড়ল।

অর্জুনকে খুব একটা পাত্তাও দিলেন না মহারাজ দুর্যোধন। সজোরে করতালি  বাজাতেই, অরণ্যের গাছপালা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল শয়ে শয়ে সুসজ্জিত  যোদ্ধা। পলকে ঘিরে ফেলল কৃষ্ণার্জুনকে। অক্ষম ক্রোধে গুমরে উঠল অর্জুন, গাণ্ডীব!সাধের গাণ্ডীবকে হেলায় ফেলে এসেছেন শিবিরে। আচমকা ঘিরে ধরা সৈন্যরা দুভাগ হয়ে গেল, জঙ্গলের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন, এক সুদেহী পুরুষ,  তামাটে গাত্রবর্ণ, পেশীবহুল শরীর।  কাঁধ পর্যন্ত কেশরাজি, পুষ্প মালিকা সহযোগে চুড়া করে বাঁধা। মস্তকে সুবর্ণ মুকুটে শোভা পাচ্ছে শিখি পুচ্ছ। চন্দন চর্চিত দেহ সুবাসে পরিপূর্ণ। কোমরবন্ধনীতে আটকে আছে একটি ধাতব চক্র। একহস্তে ভারী গদা, অপর হস্তে একটি সদ্য উৎপাটিত রক্তকমল এবং শঙ্খ। সহসা শ্রী বিষ্ণু বলে ভ্রম হওয়া দুষ্কর নয়। তিনি বাসুদেবের উদ্দেশ্য কটু মন্তব্য করে বললেন,“ঐ ধূর্ত বাসুদেব, শুনি তুই নাকি নিজেকে স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার বলে দাবী করিস?” শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে হাসি চেপে রাখা ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছিল, তাও দাঁতে দাঁত চেপে তিনি কইলেন,“এমন দুর্মতি আমার কেন হবে আর্য?” আর্য শুনেই সেই ব্যক্তি পুনরায় দন্ত কিড়মিড়িয়ে বললেন,“আর্য? আমি কোন সাধারণ আর্য নহি, আমি হলাম বঙ্গ-কিরাত-পৌণ্ড্রের অধিপতি পৌণ্ড্রক। আমি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। দুর্যোধনের পরম সুহৃদ।” অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন পার্থ এবং পার্থসারথী উভয়ই। ছদ্ম ভক্তিতে ডগমগ হয়ে উভয়ে প্রণাম করলেন, “প্রণাম শ্রীবিষ্ণু!“ দুর্যোধন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন,“ আরেঃ বাসুদেব,তোর সাহস হয় কি করে,আমার পরম সুহৃদের অবমাননা করিস?তুই কে? মথুরারাজ কংসের মামুলী ভৃত্য। কৌশলে প্রভুকে হত্যা করে তার রাজপাট দখল করতে গিয়েছিলি। এত ধূর্ত তুই যে সিংহাসনে স্বয়ং বা অধিস্থান করে, পুতুলরাজা বসালি? জরাসন্ধের ভয়ে যুদ্ধ ছেড়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এলি দ্বারকা,।  ধিক্। ধিক্। শত ধিক্ তোরে। ক্ষত্রিয় কূলের কলঙ্ক। রমণীমোহন, প্রেমলীলায় পারদর্শী, নারীদের ও অধম তুই। নিজেকে শ্রীবিষ্ণুর অবতার বলে দাবী করিস তুই? থুঃ। ”
শ্রীকৃষ্ণের ওষ্ঠে এবং অধরে তখনও খেলা করছে পড়ন্ত কমলা রোদের মত এক চিলতে নির্মল হাসি। সখা মানহানির  প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন পার্থ। কি কুৎসিত  ভাষায়ই না তাকে অসম্মান করল দুর্যোধন এবং কর্ণ। দেবী কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্রকে পিতৃপরিচয় তথা বাকি ভাইদের সাথে দ্রৌপদীকে ভাগ করে নেওয়া, বৃহণ্ণলা সেজে উত্তরের সঙ্গলিপ্সার মত হীন কটুক্তি শুনতে হল। তখনও নীরব কেশব। ক্রোধে ফুঁসছে পার্থ।
পৌণ্ড্রক নাটুকে ভঙ্গীতে বলতে লাগলেন,“শুধু কি তাই? আপনি কি জানেন মহারাজ, কেশবের একটি রক্ষিতা আছে।” পলকে কঠিন হয়ে গেল কেশবের দৃষ্টি। দুর্যোধন এবং কর্ণ উল্লসিত  হয়ে জানতে চাইল, “কে? নির্ঘাত কোন বহুভোগ্যা নারী?”  উত্তরে মিচকে হেঁসে পৌণ্ড্রক বলল,“ না জানি নে বাপু। গোকুলে বসবাসের দিনগুলিতে দুইজনের প্রেম তথা রমনের গল্প পোষা গবাদি  পশুগুলির মুখে মুখে ফিরত। সে নারী কিন্তু বিবাহিতা ছিলেন। ”
“স্তব্ধ হও মূর্খ। ” গর্জে উঠলেন কেশব। কেঁপে উঠল ধরিত্রী। “ তাঁর সম্পর্কে একটি কুবাক্য উচ্চারণ করলে জিহ্বা উৎপাটিত করব। ” পৌণ্ড্রক কর্ণপাত না করে বলে চলল,“আমি সম্প্রতি তাকে খুঁজে বার করেছি। এই মহাশয়, গোকুল ত্যাগ করার পর একটি বারও তার তত্ত্বতল্লাশ পর্যন্ত করেনি জানেন? সেদিন হতে নাকি সেই নারী মূক এবং বধির হয়ে কোন মতে স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে। কি অপরূপ রূপসী সে নারী কি কইব মহারাজ। কেশব বধের অন্তে আমিই হব তার নতুন কেশব। ঐ নারী দেবভোগ্যা।  নাম -”। কথা শেষ করতে পারল না,  পৌণ্ড্রকের কাটা মুণ্ড গড়িয়ে এল কেশবের রক্তিম চরণতলে। ঘুরন্ত সুদর্শন চক্র থেকে ছুটছে আগুনের ফুলকি।আগুন ঝরানো  স্বরে কেশব বলে উঠলেন,“মূঢ় মতি । তোদের এত দুঃসাহস, আমার প্রাণস্বরূপিনীকে নিয়ে কুৎসা রটাস? কোন অষ্টাদশ দিন ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, আমি এই মুহূর্তে ধ্বংস করব কুরু বংশ এবং তাদের অনুগামী সকলকে। ” কেশবের রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল দুর্যোধনের সৈন্যদল। সহসা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ঢেকে দিল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক আগের দিনের সূর্য। লকলকে জিহ্বা বার করে ছুটে এলেন পবন এবং অগ্নিদেব। জঙ্গলে লেগে গেল দাবানল, সমুদ্রে বাড়্বানল। প্রবল ভূকম্পে কেঁপে উঠল মেদিনী। সমগ্র বিশ্ববাসী ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়ল। কেশবের ঐ ভয়ানক রূপ দর্শন করে কাপুরুষের মত দৌড়ে পালাতে লাগলেন কুরুরাজ এবং অঙ্গরাজ। সুদর্শনকে পুনরায় অঙ্গুলিতে ধারণ করলেন কেশব, এমন সময় তাঁর চরণতলে আছড়ে পড়লেন তৃতীয় পার্থ,“তিষ্ঠ প্রভু। তিষ্ঠ। ” একাগ্র চিত্তে সমস্ত উপাসনা করতে লাগলেন তাঁর চিরসখার, সুগভীর সখ্যতার আবডালে যাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন পার্থ। দরদর করে দুই চোখ দিয়ে ঝরে পড়তে লাগল অশ্রুকণা।
কতক্ষণ সময় এইভাবে কেটেছে পার্থ জানেন না, আচমকা একজোড়া উষ্ণ হাতের স্নেহস্পর্শে চোখ খুললেন তিনি। সম্মুখে কেশব। সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যপরায়ণ  কেশব। “চল সখা। ”  বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে পড়লেন পার্থ। কিছুই মনে পড়ছে না। এতক্ষণ তাঁরা জঙ্গলে কি করছিলেন?কেশবও নীরব। রথে উঠলেন পার্থ, আসন গ্রহণ করলেন পার্থসারথী। রথ ছাড়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন,“কোন সংশয় নেই তো সখা?” পার্থ অবাক হয়ে বললেন,“নাঃ। কিসের সংশয় সখা?” নিরুত্তর রইলেন কেশব। ছুটল চতুঃঅশ্বের রথ, পার্থ শুধু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন তাঁর বাল্যসখার দুই আঁখি টলটলায়মান, মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে মুক্তার মত দু একটি অশ্রুকণা।

No comments:

Post a Comment