Monday 3 August 2015

শ্রমিক আমি (পর্ব-৩)


২০০৯ এর ডিসেম্বর। আমি তখন এ এল সি খড়্গপুর। ডি এল সি ছিলেন শ্রী শৈবাল বিশ্বাস । মেদিনীপুর অফিস তখনও তৈরি হয়নি। ১৫টি ব্লক আর ২টি মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ মাত্র ৪ জন ইন্সপেক্টর। প্রত্যেকেরই আয়ু কয়েক মাস মাত্র। যুবা ইন্সপেক্টর বা কম্প্যুটর জানা ক্লার্ক তখন কল্পনারও অতীত । মাসে মাত্র দশ দিনের গাড়ি। ফলে অনেক হিসাব করে চলতে হত।
খড়্গপুর আই আই টি তখন ঠিকা শ্রমিক অসন্তোষে জর্জরিত । প্রায়ই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকতে হত এস ডি ও সাহেবের চেম্বারে। যদিও এটা আমাদের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিল না, কিন্তু বারংবার অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারী লেবার এনফোর্সমেন্ট অফিসারের দেখা পাওয়া যেত না। তখন এস ডি ও ছিলেন শ্রী অরিন্দম দত্ত মহাশয়। ওনার প্রবল ব্যক্তিত্বের ভয়ে শুধু হাতাহাতি টুকু হত না।
সেদিনের মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ৬টা। শৌভিক তখন বিডিও খড়্গপুর-২। খড়্গপুরের মাত্র দুটো স্টেশন পর মাদপুর নামক গ্রামে আমাদের লালনীল সংসার । আমার ফিরতে দেরী হলে প্রায় দিনই ও ছুঁতোনাতা করে এস ডিও অফিসে এসে হাজির হত। দুর্ভাগ্যবশত সে দিন কি কাজে আটকে গিয়েছিল, ফলে ট্রেন ছাড়া গতি ছিল না। খড়্গপুর এস ডি ও অফিস থেকে রেল স্টেশন হেঁটে আড়াই মিনিট । ৫টা৪৫ এ একটা টাটা লোকাল ছিল, যে কখনই সময়ে আসত না। ফলে আশা ছিল পেয়েই যাব। স্টেশনে পৌছে দেখি থিকথিক করছে লোক। বহু ট্রেন বাতিল। তখন জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কিশনজী। যৌথ বাহিনী তখনও সক্রিয় নয়। ট্রেন বাতিল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমার টাটা প্যাসেঞ্জার ও বাতিল।
শৌভিক বলল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর জন্ম হতে তখনও মাস ছয় সাত বাকি। কিন্তু প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত। এমনি আক্রমণ সামলাতে না পেরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে। তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করলাম। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। ভালোই হল। ও ফিরে গেল। আমাকে জানিয়ে দিল স্টেশনে গাড়ি থাকবে। স্টেশন থেকে আমাদের কোয়ার্টর হেটে গেলে চার মিনিট। তবে ফাঁকা মাঠ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। তাতে আমার আপত্তি না থাকলেও শৌভিকের ড্রাইভার শৈবালদার চূড়ান্ত আপত্তি ছিল।
ট্রেন ছাড়লো। বেশ ভিড়। কোন মতে এক টুকরো সিট্ পেলাম। শীতের ভয়ে জানলা বন্ধ। বাইরেও ঘুট্ঘুটে অন্ধকার । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামল। আন্দাজ করলাম জকপুর। পরের স্টেশনে নামব। আর মিনিট পাঁচ মাত্র। দরজার কাছে এগিয়ে যাব বলে উঠে পড়লাম। আমার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়কে ইঙ্গিত করলাম বসতে, উনি সৌজন্যবশতঃ রাজি হলেন না। বলতে বাধ্য হলাম, যে আমার গন্তব্য মাদপুর । বলা মাত্র কামরায় যেন বাজ পড়ল। “ মাদপুর? এটাতো মাদপুর যায় না। ” বলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন একাধিক ব্যক্তি ।
“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।
ট্রেন তখনও ছাড়েনি। দৌড়ে নামতে গেলাম, পারলাম না। জায়গাটার নাম নিমপুরা। রাতের নিমপুরা কয়লা মাফিয়াদের বিচরণভূমি। একলা মহিলা সহযাত্রীকে সেখানে কেউ নামতে দিতে রাজি না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম, আমারও সাহস হল না। কোন প্লাটফর্মের বালাই নেই। অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মালগাড়ি শবদেহের মত নিশ্চুপ পড়ে আছে। অগত্যা সহযাত্রীদের উপদেশ শিরোধার্য।
হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই তেনাদের দয়া।
শৌভিককে ফোন করব কি, টাওয়ার শূন্য । কোনমতে কান্না সংবরণ করলাম। সৌভাগ্যবশত কলাইকুন্ডা আসার আগেই টাওয়ার পেলাম। রিং হতেই, শৌভিকের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর,“কোথায়? শৈবালদা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছে ট্রেন ক্যানসেল। আমরা তোকে আনতে খড়্গপুর যাচ্ছি। ” ঐ মুহূর্তে ঐ কন্ঠস্বর শুনে আবেগে গলা বুজে আসল। কোনমতে সব বললাম। শুনে বলল,“সর্বনাশ । কলাইকুন্ডায় নেমে, নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেশনমাষ্টারের ঘরে বস। আমি আসছি। ”
কলাইকুন্ডায় পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় এলাম? এটা কি চক্রাকারে ঘুরে আবার নিমপুরায় ফিরে এল? সেই অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মৃতমালগাড়ি । প্লাটফর্ম বা স্টেশনমাষ্টারের ঘর কই? ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাকিরা নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু সেই মহিলা যাননি। অধৈর্য হয়ে বললেন, “নামো। ট্রেন ছেড়ে দেবে যে। ” নামতে গিয়ে দেখি, সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকটা লাফাতে হবে। লাফিয়ে নামলাম। দুটি ট্রেনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেই। ভদ্রমহিলাকে অনুনয় করে বললাম, “যদি দয়া করে একটু স্টেশনমাষ্টারের ঘরটা দেখিয়ে দেন। ” উনি পাত্তা দিলেন না। বললেন ,“ ওখানে যেতে হবে নি। আমার সাথে এস। কে আসছে? বর? বল কলাইকুন্ডা বাজারে আসতে। হাইরোডের ওপর। আসতে সুবিধা হবে। ”
ফোন মৃত। টাওয়ার নেই। নিরুপায় হয়ে ওনাকে অনুসরন করতে থাকলাম। তেলের ট্যাঙ্কারের তলা দিয়ে কোনমতে গলে এপারে এসে দেখি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় চরাচর । অন্ধের মত মহিলাকে অনুসরণ করছি। উনি নানা প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন। আমি কি করি। বাপের বাড়ি কোথায়। বর কি করে। বর কিসে আনতে আসছে ইত্যাদি। মেপে উত্তর দিচ্ছি। বললাম শ্রম দপ্তরে কাজ করি। বর মাদপুর বিডিও অফিসে মালপত্র সরবরাহ করে। বিডিও সাহেব খুব ভাল। ওনার গাড়িটা দিয়েছেন নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরূপায় । প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পঞ্চায়েত্ প্রধানের গলাকাটা মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একজন শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীও থাকত মৃত্যুমিছিলে।
বেশ কিছুটা হেটে হাইরোডে পরলাম। অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাশে । কয়েকটা ফাঁকা চালা দেখে বুঝতে পারলাম বাজারে এসেছি। জনমানবশূন্য বাজারের কঙ্কাল । শুধু একটা মিষ্টির দোকানে একটা জিরো ওয়াট আলো জ্বলছে। দোকান ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। মহিলা একটা বন্ধ দোকানে টোকা মারতে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে এক বছর ২৩/২৪ এর ছেলের মুখ দেখা গেল। মহিলার নির্দেশে সে চেন দিয়ে বাঁধা একটা ল্যান্ডফোন এগিয়ে দিল। শৌভিক ফোনে মৃদু ধমকাল, ওর কথা না শুনে স্টেশন ছেড়ে এসেছি বলে। ফোন রেখে মিষ্টির দোকানের মচমচে বেঞ্চে এসে বসলাম। শৌভিক মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌছে যাবে। আশ্বস্ত হয়ে মহিলাকে অনুরোধ করলাম বাড়ি যাবার জন্য। উনি কর্ণপাত করলেন না। নানা প্রশ্ন করছেন। আমাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মাপছেন। আমি শুধু জানতে পারলাম ওনার নাম পার্বতী মাহাতো। এসি ডিসি এলে চাকরি করেন। নামেই হাইরোড। এতক্ষণ বসে রইলাম, বাস, ট্রেকার ছাড়ুন একটা মোটরবাইক, সাইকেল ও চোখে পড়ল না। মিনিট পনেরো পরে দূরে একজোড়া হেডলাইট দেখা গেল। উন্মত্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম মাঝরাস্তায়। হ্যাঁ । শৌভিকের গাড়িই বটে। মহিলাও দৌড়ে এলেন। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন শৈবাল দা। দরজা খুলে সরে বসল শৌভিক। লাফিয়ে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলাম। জানলা দিয়ে হাত নাড়লাম পার্বতীদির দিকে। ইশারায় শৌভিককে দেখিয়ে বললাম “আমার বর”। উনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। রকেটের বেগে উল্টোদিকে দৌড়ল গাড়ি।
কোয়ার্টারে ফিরে আমার দুই বাবাকেই বললাম আমার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। সব শুনে আমার বাবার দৃঢ় ধারণা হল, ভদ্রমহিলা নির্ঘাত স্থানীয় মাওবাদী কমিটির মহিলা কমান্ডার। নিজের মতবাদের সমর্থনে বাবা জোর গলায় চ্যালেঞ্জ করেছিল, যে ঐ মহিলার দেওয়া সব তথ্য ভূয়ো। আমি ওনাকে কিছুতেই খুঁজে পাব না। আমি কিন্তু সত্যি খুজে পায়নি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, শুনতে ভূল করেছি— অথবা বাবাই ঠিক। কিছু রহস্য না সমাধান হওয়াই ভাল। কি বলেন?

Monday 13 July 2015

কণা ও তার মেয়েরা

 তানের কথা
একই সাথে কি একাধিক ব্যক্তিকে ভালোবাসা যায় ? বিশ্বস্ত থাকা যায় প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি? সমাজের রক্তচক্ষু বলে না, তবে জীবন কেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পাঠ দেয়?
কোনমতে স্নাতক হয়েই মাকে জানিয়ে দিলাম, আর নয়।  এবার বাবার নির্ধারিত পাত্রকে বিয়ে করে সুখে ঘরকন্যা করতে চাই। মা করুণ স্বরে বলেছিল,“যারা এই বিপদের দিনে একটা ফোন করেও খবর নেয় না, তারা সেই শৈশবের প্রতিশ্রুতি রাখবে বলে তোর বিশ্বাস হয়?”
আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার  করে তবু  গিয়েছিল মা।  মুখ অন্ধকার করে বাড়ি  ফিরেছিল। তবু বিশ্বাস হয়নি, জয়ন্তকে অফিসে ফোন করেছিলাম।  না করলেই ভালো হত।
 মা দমেনি।  অল্প দিনের মধ্যেই সাধ্যাতীত ধুমধাম সহ রাজীবের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।  জয়ন্তদের তুলনায়  এরা নিতান্তই মধ্যবিত্ত।
বিয়ের  পরই বুঝতে  পারলাম,চরম ভুল করেছি। অন্য কারো সাথে দাম্পত্য  সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব। সব কথা খুলে বললাম রাজীবকে। ও ধৈর্য্য  ধরে সব কথা শুনত। কখনও অহেতুক ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেনি। বারবার  বলত ভুলে যেতে, এমন তো কতই হয়।  সময় সব ক্ষত নির্মূল  করে দেয়।
বিয়ের ঠিক তিন মাস পরে ফিরে এলাম মায়ের কাছে। রাজীব এসেছিল ফিরিয়ে নিয়ে যেতে,যায়নি। করজোড়ে অনুরোধ   করেছি ফিরে যেতে।  শুধু  এই ভেবে চূড়ান্ত  কষ্ট পেয়েছি যে আমার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য এই নিটোল ভালো ছেলেটার গায়ে, “নামমাত্র  বিবাহে ডিভোর্সি ” ছাপ পড়ে গেল।

 বুঝতে   পারলাম আবার  ভুল করেছি। আগে একটা ব্যথা  ছিল,সংখ্যা বাড়ল শুধু।
বিচ্ছেদ হবার পরও ফোন করতাম, রাজীব ভদ্র ভাবেই কথা বলত, খবরাখবর  নিত।  একদিন বলল ওর বন্ধুরা একটি মেয়ের সাথে ব্লাইন্ড ডেটের ব্যবস্থা করেছে। ফোনে প্রচুর উচ্ছাস প্রকাশ করলাম। ফোন রেখে গুম হয়ে গেলাম।
সপ্তাহখানেক পরে, একদিন ফোন করেছি, রাজীব আড়ষ্ঠ হয়ে বলল,“ ব্যস্ত আছি। একটু পরে ফোন করি? ” পরে শুনলাম, সেই মেয়েটির সাথে ছিল, শুভেচ্ছা  জানিয়ে  ফোন রেখেদিলাম। আর কখনও কথা হয়নি।

রাজীবের খবরটা শুনে মা অসম্ভব  খুশি হয়েছিল।  বলল,“ যাক বাবা  এত ভালো ছেলেটার যেন ভালই হয়। এবার তুইও কিছু ভাব। ”
 কি ভাবি? আজ বহুদিন বাদে আয়নার   সামনে এসে  দাঁড়ালাম।  ঈশ্!!কি চেহারা হয়েছে আমার।  কান্না চেপে সরে এলাম। দাদু বলতো তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তার ওপর পুরু কালির ছোপ । সেই কোমর ছাপানো চুল প্রায় সবই উঠে গেছে অযত্ন আর অবহেলায়।  চর্বির পাহাড়, অত শখের   কোন জামাই আর গলে না।
বড় অবিচার করেছি নিজের প্রতি। ঠিক করলাম কাল থেকে ডায়েটিং করতেই হবে।  শুধু স্যালাড খেয়ে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই আগের মত হয়ে যাব।
মা শুনে  খুব বকাবকি  করল, কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।  এই সময় আর একটা কুৎসিত নেশা আমায় পেয়ে বসল, গুটকার নেশা। পাশের ফ্লাটের কাকিমা খায়, মাঝে মাঝে ওনার থেেক চেয়ে   খেতাম, শেষে মায়ের অগোচরে রান্নার মাসিকে দিয়ে আনাতাম।  মা জানতে পারলে কান্নাকাটি  করত, কিন্তু নিজেকে সংশোধন করা আমার সাধ্যাতীত।
 আজকাল খুব দুর্বল লাগে।  হাঁফ ধরে।  মাকে বলিনি, মা আজকাল  বড় ব্যস্ত থাকে, ফাংশান আর মিউজিক স্কুল নিয়ে।
গান কলেজে পড়ায়।  মা চায় আমিও কিছু করি।  পরিচিত  কয়েকজনকে বলেও রেখেছে, কিন্তু  আমি চাইনা।
মায়ের সাথে আজ খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেল এই নিয়ে।
 মন খারাপ   করে আয়নার  সামনে এসে দাঁড়ালাম, হঠাৎ  দেখি বাবা।  হ্যাঁ  বাবাই তো।  শেষ  বয়সের পক্ককেশ, ক্লান্ত , পরাজিত, নুব্জ বাবা  নয়। ছোটো  বেলার ঋজু  যুবক বাবা।  এক মাথা কালো চুল , চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা , দুধ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, যে ছবিটায় রোজ মালা দেয় মা, সেই বাবা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।  হাউহাউ  করে কাঁদছি, “ বাবা আর চলে যেও না, আমাদের  ছেড়ে। কেউ কথা রাখেনি বাবা।  তোমার মত কেউ ভালোবাসেনি——”  

কণার কথা
রান্নাঘরে   ছিলাম, হঠাৎ ধড়াম করে বিকট আওয়াজ , দৌড়ে এসে দেখি তান মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে, সম্ভবত জ্ঞান হীন।  এত ভারি চেহারা আমি একা সোজা করতেও পারছি না। জীবনে এত অসহায় কখনও বোধ হয়নি।  ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুয়েেছ— কি করি?কাকে ডাকি?আমাদের মা-মেয়ের তো আর কেউ নেই।  দাদারা ষাটোর্ধ, বেশ দূরে থাকে,আর আশুতোষের দিকে তো সব পাট বহুদিন চুকে গেছে। অঝোরে  কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেলাম ল্যান্ডফোনটার কাছে—

 গানের   কথা
কি আরামে  ঘুমোচ্ছিলাম, বাইরের রোয়াকে  পৌষ মাসের নরম রোদে, কাঁথা মুড়ি দিেয়। পাশ থেকে   মা যে  কখন নিঃসাড়ে চলে গেছে জানতেই পারিনি।  কেউই  দেখেনি মাকে চলে যেতে।  বাবা  গান  শেখাতে বেড়িয়েছিল আর পিসি কলেজে।  ঠাকুমা প্রথমে বড়লোকের কাণ্ডজ্ঞানহীন  মেয়ের খুকিপণা ভেবে বিশেষ পাত্তা  দেয়নি।  বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়ে সন্ধ্যা  নামার সাথে সাথেই চড়ছিল উদ্বেগের পারদ। রাত দশটা নাগাদ  ক্লান্ত শরীরে বাবা বাড়ি ঢুকতেই ঠাকুমা উপুড়  করে দিয়েছিল অভিযোগের  ঝুড়ি ।
 সব শুনে দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য  হয়ে বাবা দৌড়ে ছিল মায়ের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে ।  মামার বাড়ির গলির মুুখে বাবার পথ আটকে ছিল ছোটো মামা ।  দিদিমার নির্দেশে বাবার জন্য সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা  করছিল।  ছোটো মামা করজোড়ে বাবাকে অনুরোধ করে ফিরে যাবার জন্য।  মা নিরাপদেই আছে।  মাথা ঠান্ডা  হলে দিদিমা কথা দিয়েছে মাকে বুঝিয়ে  শুনিয়ে ফেরৎ পাঠাবে।
 আমার মাতামহের আসন্ন অপমানের হাত থেকে ‘জামাই মানুষকে’ বাঁচাতে দিদিমার এই মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে বাবা বুঝতে পারছিল না, হাসবে না কাঁদবে! জামাই? আমাদের এই মফঃস্বল শহরের অন্যতম অভিজাত দত্ত বাড়ির সুন্দরী মেয়ে যখন পালিয়ে তার গানের মাষ্টারকে কালিঘাটে বিয়ে করেছিল, সেদিন থেকেই সবাই  মায়ের সংস্রব  ত্যাগ করেছিল।  এমনকি আমার  জন্মের খবরপেয়েও কেউ দেখতে আসেনি, শুধু দিদিমা ছাড়া।  তাও লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে।
ছোটো  মামার কথা ফেলতে না পেরে বাবা মাথা নীচু করে ফিরে আসে।  বাবার মুখে সব শুনে, ঠাকুমা হিসহিসিয়ে বলেছিল , “ অ! পালিয়েছে।  তা এই পাপটাকে ফেলে গেল ক্যান্? যা দত্ত বাড়ির চৌকাটে ফেলে আয় এটাকে। ” এটা অর্থাৎ  আমার বয়স তখনও পাঁচ মাস হয়নি।
ঠাকুমার মুখে ঐ কুরুচিকর কথা শুনে তীব্র  ঘৃণায় কুঁচকে গিয়েছিল বাবার মুখ, শুধু বলেছিল “ছিঃ”!  আমি জানলাম কি করে? ঠাকুমা এই অসম্মান  কখনও ভোলেনি, নাই আমায় ভুলতে দিয়েছে।  সত্যি কথা বলতে কি, আমার  প্রতি কর্তব্যে ঠাকুমা-পিসি কোন খামতি  রাখেনি, তবে তাতে কখনই কোন স্নেহের স্পর্শ  ছিল না। বাবার অসাক্ষাতে ওরা আমাকে কালনাগিনীর বাচ্ছা  বলে সম্বোধন  করত, যদিও  তার তাৎপর্য  বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি।
আমাকে বলা হয়েছিল মা পড়তে   গেছে শান্তিনিকেতনে।  কথাটা মিথ্যে ছিল না।  দত্তমশাই অর্থাৎ  আমার মাতামহ সত্যিই সঙ্গীত শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে  ছিলেন।
আমি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতাম কবে মা আসবে।
 তখন আমার বছর  পাঁচেক বয়স, পাশের বাড়ি খেলতে গিয়ে ছিলাম, হঠাৎ  ঠাকুমার তীব্র আর্তনাদ শুনে দৌড়ে এসে দেখি, ঠাকুমা অত্যন্ত  অশ্লীল ভাবে মাটিতে বসে বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, আর পিসি  কর্কশ স্বরে কাউকে গালিবর্ষণ করে চলেছে।  বাবা উঠোনের এককোণে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে, আমাকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকতে দেখে যেন হুতাশনে ঘি পড়ল।  পিসি তেড়ে এসে বলে উঠল, “ছেনাল মাগী পাপটাকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে!”
আর কিছু বলার আগেই বাবা আমাকে কোলে তুলে ভোঁ দৌড়। সে দিন বাবা আমাকে গলির মুখে বলাই এর দোকানের মাখন পাউরুটি আর গরম ডিমভাজা খাইয়ে  গড়ের মাঠে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল।  প্রথম ট্রামে চাপা ও সে দিন।  ফাঁকা  ট্রামে সুযোগ বুঝে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে যাব, তার আগে বাবাই খবরটা দিল।  গতকাল  জনৈক বিরাট বড়লোকের সাথে মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ঐ বয়সে তার তাৎপর্য না বুঝলেও, জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা তোমার মনখারাপ? ” বাবা মৃদু হেসে  বলল,“ নাঃ।  বরং হাল্কা  লাগছে।  শুধু  কি অপরাধে ফাঁসির সাজা হল, সেটা যদি  জানতে পারতাম”।

বাবা ছাড়া আমাকে একজনই ভালোবাসত, আমার দিদিমা । ঠাকুমা প্রায়ই অনুযোগ করত, যে দরিদ্র ঠাকুমার থেকে  ধনী দিদিমাই আমার অধিক  প্রিয়, কথাটা আদপেই মিথ্যা  ছিল না।  শুধু  ধনী  অংশটুকু বাদে। দিদিমা কাঙালেরও অধম ছিল।  দিদিমার সবথেকে বড় অপরাধ ছিল, জন্মের  পর আমাকে দেখতে এসে নিজের গলার সোনার হার খুলে আশির্বাদ করে যাওয়া। হারটা ছিল ওণার স্বর্গীয় মা কুসুমকুমারী দেব্যার।  বলাইবাহুল্য, অভাবের তাড়নায় মাস তিনেকের মধ্যেই বাবাকে হারটা বেচতে হয়।  তখন মা নিজ হাতেই হারটা বাবার হাতে তুলে দিলেও , ফিরে গিয়ে কথাপ্রসঙ্গে  দত্তমশাইকে বলে বসে। ফলশ্রুতি?? দিদিমার হাত থেকে সংসার খরচের সব টাকা কেড়ে নেওয়া হয়।
তবে দিদিমাও ছিল অদমনীয়।  গয়লার সঙ্গে সাট করে কম দুধ নিয়ে তাতে জল মেশানো, বাজারের নির্ধারিত পয়সা থেকে  কিছু সরানো, সুযোগ পেলেই দাদুর  পকেটমারা ইত্যাদি যাবতীয় উঞ্ছবৃত্তি করে দিদিমা সারাবছর পয়সা জমাতো। শুধুমাত্র আমার জন্য।  আমার জন্মদিন আসলে কাঁপা হাতে লেখা ভুল বানানে ভরা একটি চিঠি আর আর রুমালে মোড়া পয়সাগুলো বাবাকে পাঠাতো একটা জামা কিনে দেবার জন্য। শুধু কি তাই? পাশের বাড়ির বেলি পিসির হাত দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কত কি যে পাঠাতো, নিজের ভাগের এক টুকরো  ইলিশ  মাছ, দুটো আম, চারটে ভাজা পিঠে, একটু পায়েস, দুটো দানাদার ইত্যাদি ইত্যাদি ।  পুজোয় কিছু  দিতে পারত না বলে নিজেও শাড়ি ভাঙত না আমার  দিদিমা ।
দিদিমার সাথে দেখা করাটা ছিল অভিসারের সামিল।  পূর্বনির্ধারিত দিন ক্ষণ অনুসারে মন্দিরের পিছনে দেখা হত আমাদের।  মায়ের খবর পেতাম।  দিদিমাই বলেছিল , আশুতোষ বাবুরা গুয়াহাটির অভিজাত বড়লোক।  একাধিক চা বাগানের মালিক ওঁরা।  বেতারে মায়ের গান শুনে উনি মুগ্ধ হন।  পরে কোন অনুষ্ঠানে মাকে দেখে উনি সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করলে আমার মাকেই করবেন।  সব খোঁজখবর নিয়েই উনি দত্তমশাই এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। উনি নাকি আমাকে ও দত্তক নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। সব শুনে বাবা বলেছিল, “লোকটা ভালো বলতে হবে। ”
তানের জন্মের  খবরটাও দিদিমাই আমায় দেয়। আমার তখন সাত।
তান হবার পর মা কিছুদিন মামার বাড়িতে ছিল।  আমি প্রায়শই  লুকিয়ে চুরিয়ে মামার বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর   করতাম, মাকে একঝলক দেখব বলে।  মাঝে মাঝে তানকে কোলে নিয়ে বারন্দায় এসে   দাঁড়াতো মা, ঝলমলিয়ে উঠত চারদিক ।  কি অসম্ভব রূপসী ছিল আমার মা। কাঁচা সোনার মত রঙ, কোমর ছাপানো লালচে ঢেউখেলান চুল, নিটোল গঠন, প্রতিমার মত মুখশ্রী — মন খারাপ হয়ে যেত। আমাদের  ঐ বাঙাল কলোনীর ছিটেবেড়ার ঘরে কি অসম্ভব বেমানান। তানও ছিল ততোধিক সুন্দর । খুব আদর করতে ইচ্ছে করত।আমরা তো সহোদরা ।

একদিন স্কুল থেকে  ফিরছি, দত্তমশাই তখন তানকে কাঁধে চড়িয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছে, আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “একে চিনিস? ” আগে  ভয় পেতাম, কেন জানি না সেদিন কোথা থেকে   এত সাহস পেলাম, চোখে চোখ রেখে কেটে  কেটে  বললাম, “কেন চিনব না? আমার  বোন তান। ” তানও কোল থেকে ঝুঁকে পড়ে আমার চুল টেনে, নাক খামচে, মুখ চেটে সমর্থন জানালো।  দত্তমশাই কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়ে, “ছিঃ দিদি।  নোংরা।   নোংরা। ” বলে তানকে টেনে   নিয়ে হনহনিয়ে পালালেন।  সেদিন রাত্রে বাবা আর আমি খুব হেসেছিলাম।

মামার বািড়র সদর দরজা  দিয়ে প্রবেশের অনুমতি  যখন পাই ততোদিনে আমি কলেজে উঠে গেছি।  দত্তমশাই এর মৃত্যুর পর দিদিমার জেদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় দত্তপরিবার।  অবশ্য আমাকে খোলা মনে কেউই মেনে নেয়নি।  দিদিমার অগোচরে প্রকাশ্যে তানের সাথে আমার তুলনা করা হত।  তান তখন ষষ্ট বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, মায়ের রঙ-রূপ আর আশুতোষ বাবুর উচ্চতা মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো রূপসী।  খুব নামি এবং দামি স্কুলে পড়ে, ফড়ফড় করে সাহেবী উচ্চারণে ইংরাজী বলে যার অধিকাংশই আমার মামা মাসীরা বোঝে না।  আশুতোষ বাবুর কোন ধনী বন্ধুপুত্রের সাথে তানের বাগদানও সম্পূর্ণ ।  তার পাশে আমি ? কিছুতেই ওরা বুঝতে   চাইত না, উচ্চমধ্যবিত্তের সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির হাবাগোবা মেয়ের তুলনা করাটা অসঙ্গত । আমার পিসি  যদি না বিয়ের  পরেও তার উপার্জনের সিংহভাগটাই আমাদের সংসারে ঢালত তাহলে আমরা আজও নিম্নবিত্তই থেকে যেতাম।
আমার পোশাক পরিচ্ছদ নিয়েও সমালোচনার অন্ত ছিল না।  কেন আমি শাড়ি পড়ি? তাও মঙ্গলা হাট থেকে কেনা সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি? কেন ম্যাচিং ব্লাউজ  না পড়ে লাল শাড়ির সাথে হলুদ ব্লাউজ  পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি । কি করে বোঝাই  যে দিদিমার অনুরোধে মাঝে মাঝে দত্ত বাড়িতে থেকে যেতে হত, বাড়িতে পরার জামা কাপড়গুলি তো আর ও বাড়িতে পড়া যায় না।  তাই টিউশনির পয়সায় হাট থেকে ঐ শাড়িগুলো কিনেছিলাম। শাড়ির ভিতরে যা পড়তাম তা সবি পুরানো তাপ্পি  মারা, তাই বাসি কাপড় কেচে লুকিয়ে   চিলেকোঠার ছাতে শুকোতে দিয়ে আসতাম। মেজ মামির ছিল সন্দেহ বাতিক, আমাকে অনুসরণ করতে গিয়ে উনিই প্রথম আবিষ্কার  করেন, আমার তালি মারা শায়া আর গিঁট  বাঁধা অন্তর্বাস । আমার জরাজীর্ণ পরিচ্ছদ গুলোই সবার চোখে আমায় খলনায়িকা থেকে  নায়িকা বানিয়ে দিল আর নতুন খলনায়িকা হল তান।

ওদের সময়টাও খুব ভালো যাচ্ছিল না।  দিদিমার মুখে ভাসা ভাসা শুনতে পেতাম সেই বৈভব আর নেই।  সম্পত্তিগত বিবাদের ফলে ওরা নিউআলিপুরের বিরাট বাড়ি ছেড়ে নাকতলায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেছে। টানাটানির  জন্য তানকে দামি স্কুল ছাড়িয়ে  মধ্যবিত্ত মানের নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে। আমি তখন এম এর ফাইনাল ইয়ার, তান মাধ্যমিকে অঙ্কে ফেল করল।  কি করে হল জানি না, ও প্রাক্তন স্কুলে বরাবর একশোয় একশো পেত। মামার বাড়িতে সেদিন অঘোষিত  উৎসব। কতখানি ঈর্ষা করত ওরা ভেবে বাবা আর আমি হতবাক হয়ে  গিয়েছিলাম।

আমার এম এ পাশ করার মাস ছয়েক পরই দিদিমা  মারা যায়। শেষ যে রাতটা আমরা একসাথে কাটিয়েছিলাম দিদিমা  আমায় খুব আদর করছিল।  বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছিল আর মাঝে আমার মাথা শুঁকছিল।  আমিও প্রাণভরে দিদিমার আঘ্রাণ নিচ্ছিলাম।  এককালে এই বিরাট খাটে দত্তমশাই মা আর দিদিমা শুত। আমি চোখ বন্ধ করে দিদিমার মধ্যে মাকে খুঁজছিলাম, জানি দিদিমা ও আমার মধ্যে মাকেই খুঁজছিল। সেই যে কবে মা আমাকে ফেলে চলে এসেছিল, তার পর থেকে ওদের সম্পর্ক কখনও স্বাভাবিক হয়নি।  হঠাৎ  দিদিমা জিজ্ঞাসা করল, “ হ্যাঁ রে তুই নাকি চাকরি করবি?” অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, “ হ্যাঁ ।  তোমাকে  তো অনেকবার  বলেিছ। ” দিদিমা বলল, “পাবি? সত্যি?” হাসলাম।  কিছুক্ষণ নীরব থেকে  দিদিমা বলল,“পেলে আমায় কিছু টাকা দিবি? ” দিতে আর পারলাম কই? সেটাও পৌষ মাস, নিউমোনিয়া কেড়ে নিল আমার দিদিমাকে। সাথে সাথেই মায়ের খবরাখবর  পাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল।

 চাকরি পেলাম।  বিয়ে ঠিক হল।  ভেবেছিলাম মা আসবে।  কিন্তু নিমন্ত্রিতদের তালিকায় মামার বাড়ি থাকলেও মা বাদ। বাবা বলেছিল, পিসি-ঠাকুমা তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেয়।  বিয়ের সব দায়িেত্ব পিসি একা।  বাবার তীব্র আপত্তি ছিল।  পিসি ফুৎকারে উড়িয়ে  বলেছিল ,“  বেশি বাপগিরি করতে আসিস না। ওর জন্মের পর থেকে আমি ওর বিেয়র জন্য পয়সা জমাচ্ছি। ” বিয়ের পর দিন যখন চলে আসব, সেই আমার পাঁচ বছর বয়সের দৃশ্য গুলির পুনরাভিনয় দেখলাম।  ঠাকুমা সেই একই ভাবে মাটিতে বসে ’দ্যাশের’ ভাষায় বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, পিসি শুষ্ক চোখে কর্কশ কন্ঠে বাবা আর ঠাকুমাকে ধমকাচ্ছে আর বাবা খালি খালি  ধুতির খুঁটে চোখ মুচছে। পিসি লাল চোখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখ আমার আদিখেত্যা আসে না।  তুই আমার প্রথম সন্তান । ” হেসে ফেললাম।  পিসির হাতটা ধরে বললাম, “বাবাকে—— ” সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরোনো পিসি ফিরে এল।  মুখ ঝামটা মেরে বলল, “এতদিন তোর বাপকে কে দেখল রে হারামজাদী। ”
মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমিই বাড়ি ছেড়ে এলাম।

সেদিন যখন ফোনটা এল, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুচ্ছে, নৈশভোজ সমাপ্ত করে তখনও আমরা এঁটো হাতে গল্প করছি।  আমিই ধরেছিলাম ফোনটা। হ্যালো বলাতে কোন প্রত্যুত্তর আসেনি, শুধু  মৃদু ফোঁপানোর শব্দ ছাড়া।  মুহূর্তমধ্যে ঐ ফোঁপানি সংক্রামিত  হল আমার মধ্যে।  বন্য হস্তীর মত আর্তনাদ করে হাউহাউ করে কাঁদছি।  সবাই ছুটে এসেছে।  সম্মিলিত প্রশ্নের মুখে আমি  শুধু  একটা কথাই বলতে পারলাম ,“মা কাঁদছে।  ”

কণার কথা—
মধ্য রাতের নিয়নজ্বলা কলকাতার রাস্তায় উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স।  একটা হাতে গানের হাত ধরে আছি, অন্য হাতে তানের।  আমার কাঁধে মাথা রেখে সমানে ফুঁপিয়ে  চলেছে গান।  তান নিথর।  হাসি হাসি মুখে যেন কোন সুখস্বপ্নে বিভোর।  আধো আলোছায়াতে চেনা দুষ্কর কোনটা কে।  যেন একজোড়া গান বা একজোড়া তান, নাকি দুটুকরো আমি ? একটা লড়াকু, বারংবার হেরেও হার না মানা  আর একটা অলস সংগ্রাম বিমুখ হেরে যাওয়া আমি।
গানকে যখন ছেড়ে এসেছিলাম তখন আমার কতই বা বয়েস।  বড় আশা নিয়ে বাসবকে বিয়ে করেছিলাম।  সঙ্গীতের মূর্ছনায় উচ্ছল হয়ে উঠবে জীবন।  বাবার নয়নমণি ছিলাম, সেই বাবা আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক  ত্যাগ করল।  কি অসম্ভব কষ্ট হত বাবার জন্য, লুকিয়ে কাঁদতাম।  বাবা বলেছিল “ ভুল করছ। এর মাসুল তোমাকেই গুনতে হবে। ” ভুল মানে? উফ্ সে কোন পৃথিবী।  বাসবের মা- বোন আমাকে সহ্য করতেই পারত না।  বিবিহযোগ্যা বোন থাকতেও বাসব কি করে আগে বিয়ে করল? নির্ঘাত আমরা তুক্ করেছি, এইরুপ নিম্নরুচির আলোচনা হত, আমাকে শুনিয়ে।  একটা মাত্র ঘর, তাতে একটা তক্তোপোশ। ওপরে শুতাম আমরা, মাটিতে জটিলা কুটিলা।  বাসবের সাথে দেখা হত দিনান্তে। দুটো কথা বলারও অবকাশ ছিল না। প্রেমালাপ দূরে থাক,  রাতে দুটো ফিস্  ফিস চরে কথা বললেও ধমক খেতে হত।
আজ ও মনে আছে, সেদিন ভীষণ মনখারাপ ছিল বাবার জন্য, ভাবলাম একবার দেখেই চলে আসব। গানকে ঘুম পাড়িয়ে নিঃসাড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বাবা বাইরের ঘরে একা উদাস  হয়ে বসেছিল কি জানি হয়তো আমারি প্রতীক্ষায়।  ডুকরে কেঁদে উঠলাম।  বাবাও কাঁদছিলো।  তারপর যে কি হল, আজ আর মনে পড়ে না।একটাই আফ্শোস ছিল, বিদায় জানিয়ে আসার সুযোগ পাইনি।

গানের  কথা -
তান চলে গেল।  দুদিন ভেন্টিলেটরে রেখেও বাঁচানো গেল না।  মাল্টিপল অর্গ্যান ফেলিয়র।  বাবাকে খবরটা দিলাম, বাবা বলল,“মাকে একা ছাড়িস না।  বড় অসহায় ও । ” মাকে ছাড়িনি আমি।  জড়িয়ে আছি সবসময়।  নিমতলা মহাশশ্মান, তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছি আমরা,মা বারবার ওর হিমশীতল ঠোঁটে চুমু  খাচ্ছে, খুব আদর করছে ওকে, হঠাৎ   ধড়মড় করে উঠে পড়ল মা।  আলুথালু  অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ালো এক সুবেশ যুবকের সামনে।  বহুক্ষণ ধরেই ছেলেটিকে দেখছি। উত্তেজিত হয়ে মা কিছু বলছে।  ছেলেটি মাথা নীচু করে চলে গেল।  মা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসে বলল, “ হারামজাদা।  দেখতে এসেছে আমার মেয়ে সত্যি মরেছে কি না। ” ভাবলাম তানের প্রাক্তন স্বামী  হবে। একটু পরেই ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল অপর এক যুবা।  তাকে দেখে মা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।  মাই পরিচয় করিয়ে দিল রাজীবের সাথে।  হতবাক্  হয়ে গেলাম।  এ যদি তানের বর হয় তবে ওকে ছিল? পরে রাজীবই বুঝিয়ে  দিল, ওটা ছিল জয়ন্ত।  ওর সাথেই আশুতোষ বাবু তানের বিয়ে ঠিক করেছিলেন শৈশবে। রাজীব ও মায়ের সাথে একমত, জয়ন্তর দেওয়া হৃদয়ভঙ্গের বেদনা সহ্য করতে না পেরেই---।  জয়ন্ত কিন্তু  চলে যায়নি।  দাহ করে ফেরার সময়ও আমি ওকে দেখেছি।  ভীড়ে লুকিয়ে ছিল।

ছমাস পর—
 মা নাকতলার ফ্ল্যাটে একাই থাকে।  আমি নিয়মিত খবরাখবর  নিই।  আরো একজন খোঁজ নেয়।  আমার বাবা ।  মা ও সসঙ্কোচে এদিকের খবর জানতে চায়।  আমি দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছি ——— স্বপ্ন কি কখনত্ত সত্যি হয়???

Image courtesy- Google

Monday 25 May 2015

যদি তারে নাই চিনি (Part-1)

জুলাই মাস, দুপুর আড়াইটা, আকাশের মুখ ভার, তাই রোদের সেই তাপ নেই। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে, অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ রিক্সাওয়ালার ডাকে চমকে উঠলাম, “দেখেন দিদি, এই হোটেলটা ঠিক আপনার পছন্দ হবে।” রিক্সায় চড়ার  সময় বলেছিলাম, জনপদ থেকে দূরে, কোন ফাঁকা হোটেল দেখে দিতে। যেখানে নিরিবিলিতে কটা দিন কাটানো যায়। সত্যি কথা বলতে কি জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। একটু শান্তি চাই। মানুষ জন আর সহ্য হচ্ছে না। পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের সাথে কিছু সময় কাটাতে চাই। কিছু বোঝাপড়া করা বাকি।
          অনেক ভেবেচিন্তে এই স্থান নির্বাচন করেছি। এই অঞ্চলটি খুবই স্বল্প পরিচিত এক পর্যটন কেন্দ্র। কয়েক বছর আগেও কেউ এই জায়গাটার নাম জানত না। রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভ্রমণ পিপাসুদের চোখে পশ্চিমবঙ্গকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এইরকম বেশ কয়েকটি স্থানকে সরকারি ভাবে গড়ে তোলা হয়। সেই প্রচেষ্টা খুব যে সফল হয়েছে বলা চলে না, তবে সপ্তাহান্তে কিছু বঙ্গসন্তান অবশ্যই আসে।
          পাছে কোন পরিচিত মুখ চোখে পড়ে যায়, তাই ইচ্ছে করেই সপ্তাহের শুরুতে এসেছি। আজ সোমবার। এক নজরে হোটেলটা মন্দ লাগল না। বরং বেশ ঝকঝকে। ভাড়া কত হবে?  সাধ্যাতীত হয়ে যাবে না তো? ইতস্ততঃ করছি দেখে রিক্সাওয়ালা  অভয় দিল, “ যান না দিদি, এই সময় লোক হয় না বলে, ওরা হাফ-প্রাইসে ঘর দেয়।”
ভাড়া চুকিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। সামনে কেয়ারী করা বাগান, গাড়ি রাখার জায়গা, নুড়ি বসানো পথ ধরে তিনটি সিঁড়ি টপকে রিসেপশন রুম। সামনেই ম্যানেজারের  ডেস্ক, কিন্তু ফাঁকা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, অ্যাকোরিয়ামের লাল-নীল মাছ গুলি ছাড়া অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই। মিনিট তিন চার পরে হাঁফাতে হাঁফাতে এক ভদ্রলোক এলেন, বুশ শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে। প্রৌঢ় মানুষ, মনে হল আমাকে দেখে বেশ হতাশ হয়েছেন। একে তো একলা মেয়ে, তায় পরনে ম্লান সুতির সালয়ার-কামিজ, কাঁধে একটা লাল-কালো কাপড়ের ব্যাগ, তাতে ‘রেমন্ড’ লেখা। সব মিলিয়ে মোটেই আকর্ষণীয় নয়।
জিজ্ঞাসা করলেন, “ক’দিন থাকবেন?” “তিন-চার দিন”। “হুঁ। ভাড়া ১২০০ টাকা, তবে অফসিজিনে ৬০০ টাকা লাগবে, প্রতিদিন। আর হাঁ দিনের বেলা আর রাতে আটটার পর জেনারেটার চলবেনি।” মাথা নাড়লাম। সকাল আটটায় চা, সাড়ে নটায় ব্রেকফাস্ট, রাত আটটায় ডিনার।“ আবার বাধ্য ছাত্রীর মত মাথা নাড়লাম। “নাম ঠিকানা লিখুন।“ ছদ্মনাম ভেবেই রেখেছিলাম, ঠিকানাও। ফোন নম্বরটা ফাঁকা রাখলাম। ওঠা ভুল লেখার রিস্ক নিতে পারলাম না।
          জনৈক আব্দুলকে ডেকে ম্যানেজার বাবু আমায় ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। ঘরে ঢুকে অভিভূত হয়ে গেলাম, আমার জানলা দিয়ে সমুদ্র ডাকছে। হোটেলটিই প্রায় বেলাভুমি ঘেঁষেই উঠেছে। ঠিক নীল দামাল সমুদ্র নয়, কেমন যেন কালচে বুড়ো সমুদ্র। ঢেউ গুলো যেন অসীম ক্লান্তি নিয়ে পাড়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ছে। হোক বুড়োটে, তাও সমুদ্র তো।
          সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ভাল লাগছে কি? কি জানি? সব অনুভূতি কেমন ভোঁতা হয়ে আসছে। আজকাল কিছুই ভাল লাগে না। মাত্র তিরিশেই নিজেকে ফুরিয়ে যাওয়া ক্ষয়াটে বৃদ্ধা মনে হয়। হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল। ঠিক কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ঘোর কাটতে দেখি সূর্য কখন পাটে  বসেছে, সন্ধ্যা নামছে। ফাঁকা ধূধূ বালুকাবেলায় শুধু আমি একা। না ভুল বললাম, দূরে একটা আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে, তা কোন মানব না ছায়ামানব জানি না। কি বা যায় আসে।
          হোটেলে ঢুকতেই আব্দুল বলল, “মেমসাহেব, চা খাবেননি?” ‘মেমসাহেব’?? হাসি চেপে ডাইনিং রুমে বসলাম। ডাইনিং রুমে আরও এক জন বসে আছেন। সম্ভবত বোর্ডার , বেশ সুদর্শন, গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, চোখে রিমলেস চশমা। আমাকে দেখে মৃদু হেঁসে বললেন, “ম্যাডাম কে আজ এসেছেন?” প্রমাদ গুনলাম। এই রে ,এই শুরু। এবার নাম- ধাম, পরিচয় সেখান থেকে কত যে শাখা প্রশাখা বেরোবে? একা মেয়ে দেখে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা না করাটাই অস্বাভাবিক। যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে, সৌজন্যমূলক ভাবে ঘাড় নাড়লাম শুধু। ঊনিও আর কিছু বললেন না। আমিও কথা বাড়ালাম না। তবে অনার আওয়াজ বহুক্ষণ আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, একেই বোধহয় ব্যারিটোন ভয়েস বলে।
          এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নামকাওয়াস্তে থাকে। থাকলেও ভোল্টেজ খুবই অল্প। রাত্রে প্রায় কোনদিনই থাকে না। সপ্তাহান্তে হোটেল ভর্তি থাকলে সাড়া রাত জেনারেটর চলে, না হলে রাত আটটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে, সাড়ে আটটার মধ্যে জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় যে হতভাগ্যরা থাকে, তাদের  হোটেলের তরফ থেকে হ্যারিকেন আর প্রয়োজন হলে টর্চ দেওয়া হয়। নৈশ ভোজ চলাকালীন আমাদেরকেও হাতে হ্যারিকেন ধরানো হল। ওনার টর্চ আছে, তাই আমাকে একটা টর্চ ও দেওয়া হল। খেতে খেতে দেখলাম, ম্যানেজার বাবু আর আব্দুল ওনাকে খুব খাতির করে।
          খেয়ে ঘরে ফিরছি, উনি বললেন, ‘ ম্যাডাম, এখনি ঘরে গিয়ে কি করবেন? চলুন পিছনের আঙিনায় গিয়ে বসি। জোয়ারের সময়, সমুদ্র প্রায় আঙিনা অবধি চলে আসে। কপাল ভাল থাকলে, আপনার পদস্পর্শও করে যেতে পারে। ’ লোভ সামলাতে পারলাম না। পিছনের আঙিনায় বেশ কিছু গার্ডেন চেয়ার পাতা আছে, তার একটায় গিয়ে বসলাম। উনিও বসলেন, তবে আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ঝুপ করে আলো নিভে গেল। নিভু নিভু হ্যারিকেনের  আলোয়, সে এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ। ঝিঁঝিঁর ডাক, আর জলের ছলাৎ ছলাৎ, সাথে শিহরণ জাগানো নোনতা সোঁদা বাতাস। কত ব্যেস হবে ওনার, মধ্য চল্লিশ তো বটেই, পঞ্চাশের কাছাকাছিই হবে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, অন্ধকার চরাচরের সুযোগ নেবেন কি না? কিন্তু উনি কিছুই বললেন না। আমি ঘড়ি পরিনি। উনি টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখে বললেন, “চলুন, এগারোটা বাজে।”
ওনার পিছন পিছন হোটেলে ঢুকলাম। আমাকে শুধু আমার ঘর অবধি এগিয়ে দিলেন তাই না, আমার ঘরের সামনে আমার টর্চ আর হ্যারিকেনটাও ধরলেন, যাতে আমি তালা খুলতে পারি। তালা খুলে, ঘরে ঢুকে ওনার দিকে তাকালাম, উনি একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে, বললেন, “ওককে ম্যাডাম। শুভরাত্রি।“
          দরজা বন্ধ করে পুরো বেকুব লাগছিলো, নিজেকে চড় কসাতে ইচ্ছে করছিল; কি চাইছিলাম আমি? আমাকে পাত্তা দেবেন উনি? আমার সাথে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করবেন? কোন মূর্খের স্বর্গে বাস করি আমি? এককালে আমি মনে করতাম, আমার থেকে কুরূপা কোন মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই, সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে আসছিলো। জীবনে কোন কিছুকেই সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারি না। প্রেম প্রস্তাব কম পাইনি, কিন্তু একটাও বিশ্বাস হয়নি। আমার দৃঢ় ধারণা আমি পুরুষদের অভিসন্ধি খুব ভাল বুঝতে পারি। এই প্রথম হিসেব মিলল না।

          ভোরের নরম আলো মুখে এসে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল। দৌড়ে গেলাম সমুদ্রকে দেখতে। কিন্তু কোথায় সে? ভাটার টানে বেশ পিছিয়ে গেছে। ওনাকে দেখতে পেলাম, প্রাতভ্রমণে বেড়িয়েছেন। ব্যালকনিতে আমাকে দেখে, হেঁসে হাত নাড়লেন। ঈশারায় ডাকলেন, নেমে আসতে। হঠাৎ মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল। দৌড়ে গেলাম সৈকতে ওনার কাছে। ঈশ! কি দামি ট্রাক প্যান্ট আর রাউন্ড নেক টিশার্ট পরেছেন। হাতের ঘড়িটাও দুর্মূল্য, সুইস তো বটেই। ওনার পাশে কি অস্মভব বেমানান আমি। দু একটা ভালো জামা কাপড় ও আনিনি। মনটা আবার তেতো হয়ে গেল।
 

Thursday 30 April 2015

একটি ঘেঁটে যাওয়া গল্প




মার্চ মাস। প্রচণ্ড কাজের চাপ। হঠাৎ মুঠো ফোনটির প্রবল চিৎকার। তাকিয়ে দেখি রাতুল। এই কর্পোরেট দুনিয়ার লোকজন আমাদের কি ভাবে কে জানে? সরকারি কর্মচারী মানেই যেন অফিসে সংবাদ প্ত্র পড়ে বা গসিপ করে। রাতে ফোন করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত কে জানে?
        বেজার গলায় বললাম, “খুব চাপ। যা বলার খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেল।” বিদ্রুপ এবং শ্লেষ এর প্রত্যাশা ছিল। আমাকে নিরাশ করে, অদ্ভুত হেরে যাওয়া গলায় রাতুল বলল, “ জানি তুই ব্যস্ত। অসময়ে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু থাকতে পারলাম না রে। এই মাত্র আমার জীবনের চরম সর্বনাশটা ঘটে গেল।
        “মানে?” ধড়াস করে উঠলো বুক। তবে কি কাকু – কাকিমার কিছু হয়ে গেল? রাতুল ওদের একমাত্র আদরের নাড়ুগোপাল। দিদি বিয়ে করে দুবাই চলে যাবার পর থেকে ওদের জগত রাতুলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। নাকি অরো? রাতুলের এক মাত্র পুত্র। পুরো দেব শিশু। হে ঈশ্বর অরোর যেন কিছু না হয়। “রাতুল!  হতচ্ছাড়া  চুপ করে আছিস কেন? বল? কি হল?”
        রাতুল হতাশ গলায় বলল, “আই আম গেটিং ডিভোর্সড্।” “মানে? কি প্রলাপ বকছিস? অফিস টাইমে গাঁজা খেয়েছিস নাকি?” আড় চোখে ক্যালেন্ডারটা দেখে নিলাম, না এপ্রিল এখনো পড়েনি। এটা আমার বা রাতুলের জন্ম বা বিয়ের দিন ও নয় যে সারপ্রাইজ দেবে, তবে কি????” উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলাম, “বল না শালা। দর বাড়াচ্ছিস কেন?” রাতুল কি কান্না চাপছে? নাহ আমারই মনের ভুল, নাকি???রাতুল, থেমে থেমে বলল, “আমি কলেজ স্কোয়ারে। প্রিয়াঙ্কা ডেকেছিল। বলল এই প্রেসিডেন্সী থেকেই শুরু হয়েছিল, তাই এখানেই শেষ হয়ে যাক সবকিছু।”
        “প্রিয়াঙ্কা ডেকেছিল মানে?” প্রিয়াঙ্কা রাতুলের স্ত্রী। বহরমপুরের মেয়ে। ওরা অবাঙালি। প্রেসিডেন্সীতে রাতুলের সহপাঠিনী ছিল। সেখান থেকেই প্রেম। পরের বছর রাতুল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ব্যাঙ্গালোর চলে গেলেও ওদের সম্পর্কটা টিকেই যায়ঠিক যেমন আমাদের বন্ধুত্ব। রাতুল, সাদিক, রাফিয়া, দ্বৈপায়ন, শ্রেয়সী আর আমি অনি। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে আমরা একে অপরের ঘনিষ্টতম বন্ধু। সময় ও আমাদের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায়নি।
        প্রিয়াঙ্কা কলেজে পড়ায়। ওর কলেজ বহরমপুর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাই ও অরোকে নিয়ে নিজের বাবা-মার কাছে থাকে। লম্বা ছুটি পড়লে ওরা কলকাতায় আসে। না হলে রাতুল যায়। কর্পোরেট চাকরি মানেই চাকরগিরি তাই প্রতি সপ্তাহান্তে না পারলেও সুযোগ পেলেই কেটে পড়ে। প্রিয়াঙ্কার ওকে ডেকে পাঠানো ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হল না। প্রিয়াঙ্কা কলকাতায় এলে তো রাতুলদের সল্টলেকের বাড়িতেই উঠবে, তা হলে? রাতুল বলল, “ও সকালের ট্রেনে এসেছে, রাতের ট্রেনে ফিরে যাবে।” বুঝলাম জল অনেক দূর গড়িয়েছে। রাতুল কি রকম ভেবলে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সাদিককে ফোনে পাচ্ছি না। আমি এখন কি করব?”
        সাদিক কোথায়? সেই ভূ-মধ্যসাগরে। জাহাজে চাকরি করে সাদিক। বছরে ন মাসই বাইরে। ফেসবুক আর হোয়াটস্ এ্যাপের কল্যাণে অবশ্য সাদিক সর্বদাই আমাদের সাথী। চিরকাল রাতুলের রক্ষাকর্তা সাদিক। আমাদের মধ্যে সবথেকে রগচটা, সবথেকে ডাকাবুকো। রাফিয়ার মত শান্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে যে কি করে সাদিকের প্রেমে পড়েছিল কে জানে? যাই হোক বিয়ে করে সুখেই আছে দুটোতে।
        মাথা কাজ করছিল না। বললাম, “রাতুল ওখানেই থাক। আমি আসছি।” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সাদিক বাদে একে একে সবাইকে ফোন করলাম। কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। দ্বৈপ্য অর্থাৎ দ্বৈপায়ন আর রাফিয়া বলল এক্ষুনি আসছে। শ্রেয়ার মিটিং চলছে, ৪টের আগে পৌছতে পারবে না। রাতুলকে নিয়ে আমরা সবাই কফি হাউসে গিয়ে বসেছিসেই কফি হাউস রাতুল-প্রিয়াঙ্কা, সাদিক-রাফিয়া, সৌর-আমি না জানি কত সফল প্রেমের সাক্ষী। রাতুলকে দেখে মায়া লাগছিল, উদ্ভ্রান্তের মত তাকাচ্ছে, অপ্রকৃ্তিস্থের মত কথা বলছে। যা বুঝলাম, প্রিয়াঙ্কা আজ সকালে ওকে ডেকে বলেছে, “সব শেষ। তোমার সাথে আমার পোষাচ্ছে না।” “পোষাচ্ছে না মানে?” রাফিয়া আর আমি সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। শ্রেয়া কঠোর স্বরে বলল, “রাতুল! সত্যি কথা বল। কি বাঁধিয়েছিস?” রাতুলের সুন্দরী নারী দেখলেই ছোঁকছোঁক করার অভ্যেস সুবিদিত।প্রিয়াঙ্কারও তা অজানা নয়। তবে এ নিয়ে কখন ও কোন বিরোধ বা দাম্পত্য কলহের কথা শুনিনি। রাতুল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “বিশ্বাস কর, আমি কিছু জানি না।”
        সাদিক অনলাইন হয়েই হোয়াটস্ এ্যাপ কাঁপাতে লাগল। রাতুলকে বলল, এখুনি বহরমপুর গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে। প্রয়োজন হলে প্রিয়াঙ্কার পায়ে ধরে মানাতে। প্রিয়াঙ্কার বাবার সাথে বহরমপুরের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যাক্তির দহরমমহরম আছে। প্রণয় পর্বে উনি এক বার রাতুলকে হুমকি দিয়েছিলেন, যে বহরমপুরে পা দিলেই গায়েব করে দেবেন। সেই ভয়ে কি না জানি না, রাতুল না না অজুহাত দেখাতে লাগল। বিরক্ত হয়ে শেষে দ্বৈপ্য বলল, “ আমি যাব। তোকে একা যেতে হবে নাকাল সকালেই চল।
পরের দিন, বিকাল বেলায়, দ্বৈপ্যর ফোন। কনফারেন্সে রাফিয়া, শ্রেয়া আর আমি তিন জনেই কানেক্ট হলাম। রাতুল, হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে। দ্বৈপ্যর মত শান্ত ছেলে, যার মুখে কোনদিন অসংস্কৃত শব্দ শুনিনি,অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে ষাঁড়ের মত চিৎকার করছে আর অনর্গল খিস্তি খেউর করে চলেছে। প্রিয়াঙ্কার বাবা নাকি দরজা খুলে রাতুলকে দেখেই গালমন্দ শুরু করেন। ছোট্ট অরো পাপা- পাপা বলে ছুটে আসছিল, প্রিয়াঙ্কার মা তাকে নড়া ধরে হিড়হিড় করে টেনে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে যান। অরোর প্রবল কান্না, রাতুল- দ্বৈপ্যর অনুনয়- বিনয় কিছুতেই ওদের মন গলেনি। প্রিয়াঙ্কা ঘর থেকেই বের হয়নি। এমনকি রাতুল স্ত্রী পুত্রের জন্য যে উপহার নিয়ে গিয়েছিল, তাও ওনারা গ্রহণ করেননি। দ্বৈপ্য করজোড়ে অনুরোধ করে যাতে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য রাতুলকে প্রিয়াঙ্কা আর অরোর সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়, জবাবে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন ভদ্রলোক।
        রাতুল হাউহাউ করে কাঁদছিল। পরিণত বয়স্ক কোন পুরুষকে কোনদিন কাঁদতে শুনিনি। হৃদয়বিদারক সে অনুভূতি ভাষায় অপ্রকাশ্য। “কি নরম ও। গায়ে কি সুন্দর গন্ধ জানিস? কি ছোট্ট লাল জিভ, ঠোঁট দুটো কি নালঝোল মাখা ভেজা ভেজা, জানিস? চুমু খেতে গেলেই চেটে দেয়। দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে তোতা পাখির মত ডাকত, ‘পাআআপাআআ’। একবার ছুঁতে দিল না জানিস?” রাফিয়া আর আমিও কাঁদতে লাগলাম।
এ নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে একটা শিশুর মাকে যতটা প্রয়োজন, বাবাকে ঠিক ততটা নয়, কিন্তু বাবা তো বাবাই, বাবার স্থান পূরণ করা অস্মভব। সৌর আর তুলতুলির টান কি আমি অনুভব করতে পারি না।
পরিস্থিতি আরও জটিল হল, যখন আদরের খোকার আসন্ন বিবাহ-বিচ্ছেদ রোধ করার জন্য, রাতুলের বৃদ্ধ বাবা-মা কাউকে কিচ্ছু  না জানিয়ে গিয়ে হাজির হলেন প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি। কি হয়েছিল, সঠিক জানি না তবে প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি থেকে বুড়ো-বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসেন এবং বৃদ্ধ উপবীত তুলে শাপ-শাপান্ত করতে থাকেন। বৃদ্ধা জ্ঞান হারান। হয়তো ধকল আর মানসিক টানাপড়েন এর জের, তবে প্রিয়াঙ্কা রাতুলকে ফোন করে যাতা বলে। ওদের প্রতিবেশীদের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই নাকি এই নাটক রচনা করা হয়েছে।  অবাঙালী পুত্রবধূকে যে ওনারা মুক্ত মনে গ্রহণ করেননি এটাও সত্যি।
        যাইহোক সাদিকের চিৎকার আরও বেড়ে গেল। লাশ ফেলে দেবে। ওর সাথে নাকি কোন গুণ্ডার জিগরী দোস্তি। রাতুল ও নাচছে, তবে লাশ ফেলতে হবে না। শুধু হারামি শ্বশুরটাকে আচ্ছা করে কেলাতে হবে। প্রমাদ গুনলাম। এই পরিকল্পনার অংশীদার জানতে পারলে আমার বিবাহ-বিচ্ছেদ আসন্ন। রাফিয়া ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল, “ধুর! ধুর! সাদিকের দৌড় কতদূর জানিস না? ঐ পচা খাল অবধি। কম লোককে জবাই করে খালের জলে ভাসিয়েছে ভুলে গেলি?” সত্যি সাদিক পায়ে পা দিয়ে লোকের সাথে ঝগড়া করত এবং ঐ হুমকিই দিত বটে।
সাদিক একাই দাপাদাপি করতে লাগল। রাতুল বেপাত্তা। ফোন পরিসীমার বাইরে, অফিস যায় না। বাড়িতে ফোন করাতে কাকিমা এমন কান্নাকাটি জুড়ে ছিলেন, যে ভয়ে আমরা আর সাহস পাই না।  শ্রেয়া একদিন সাহস করে, প্রিয়াঙ্কাকে ফোন করেছিলতিন বার প্রিয়াঙ্কা ধরেনি, চতুর্থ বারে ফোন তোলে এবং অভিযোগের ঝুড়ি উপুর করে দেয়- রাতুল একটা অপদার্থ (এ ব্যাপারে অবশ্য আমরা একমত), মাতৃ- স্তন্যপানকারী বালক (ঠিক), প্রিয়াঙ্কা আর অরোকে সময় দেয় না ( হতে পারে, কাজের চাপ, তায় রাতুলটা বিশ্বকুঁড়ে) প্রিয়াঙ্কা আর অরোর কোন দায়িত্ব নেয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সব স্বামী- স্ত্রীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ডিভোর্স কি এই সব কারণে হয়?  যাইহোক শ্রেয়ার ওর সাথে কথা বলে দৃঢ় ধারনা হয়েছে, যে রাতুলটা বিছানায় একেবারেই ঢ্যাঁড়শ। যৌন অতৃপ্তিজনিত ক্ষোভ জমতে জমতেই আজ এই বিস্ফোরন। শ্রেয়া অবশ্য পৃথিবীর সব সমস্যার মূলেই এই এক্তি জাগতিক কারণ দেখতে পায়। হতেই পারে, তবে সহমত হতে পারলাম না। রাফিয়া বলল, “কি বোকা মেয়ে রে? স্বচ্ছন্দে রাতুলের অগোচরে চুটিয়ে প্রেম করতে পারত। রাতুল যা গামবাট, জানতেও পারত না। আর পারলেই বা কি? কিছু বলত না। এরকম হামেশাই হয়। বিবাহ বহির্ভূত প্রেম। এই কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ?” সত্যি কথা বলতে কি, প্রিয়াঙ্কার ওপর আমাদের কোন অসূয়া নেই। শুধু রাতুলটাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ দিল না, এই যা আফসোস। বেচারা জানেই না কোন অপরাধে ফাঁসি হচ্ছে।
        রাতুল ফিরে এল। কামাক্ষ্যা গিয়েছিল। রাতুল আর পুজো? কবে পুষ্পাঞ্জলি দিতে শিখল?  বিদ্রুপ গায়ে না মেখে রাতুল ঘোষণা করল, ও খুব শীঘ্রি তিরুপতি যাচ্ছে। সাদিকের রক্তচাপ বেড়ে গেল, আর ওর গালি-গালাজের ঠেলায় আমাদের। রাতুল নির্বিকার। ওর কোন সহকর্মী নাকি তারাপীঠের এক মহাতান্ত্রিককে চেনে, তাঁর বশীকরণ মোক্ষম। এক মন্ত্রে প্রিয়াঙ্কা অরোকে নিয়ে সুড়সুড় করে ফিরে আসবে রাতুলের কাছে, পূর্বস্মৃতিও লোপ পাবে। অমাবস্যার দিন রাতুল চলল তারাপীঠ মহাশ্মশান। আমাদের অনুনয়-বিনয়, সাদিকের খিস্তি, দ্বৈপ্য- শ্রেয়ার যুক্তি কিছু কাজে এল না। বাবাজী নাকি কথা বলেন না। ওনার চ্যালা মহারাজ গুরুর নির্দেশ ব্যাখ্যা করে যা বললেন, তা হল,  মেয়েটা ভাল। কিন্তু বাপটা রাম ঢ্যামনা। কানে ফুস মন্তর দিয়েছে। পরিস্থিতি খুব জটিল। যজ্ঞ করা আশু প্রয়োজন, না হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ তো হবেই এমনকি রাজদ্বার দর্শন ও হতে পারে। খরচ মাত্র দেড় লক্ষ টাকা। রাতুল পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
        মাস দুয়েক নির্বিঘ্নে কাটে। আমাদের সবার অনুরোধে রাতুল সাহস সঞ্চয় করে আর এক বার প্রিয়াঙ্কার সাথে দেখা করতে যায় বহরমপুর, সাথে প্রচুর উপহার, স্ত্রী, পুত্র এমন কি শ্বশুর- শাশুড়ি, শালীর জন্যও। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে থাকি আমরা। রাতে রাতুলের কোন ফোন আসল না। ভাবলাম নির্ঘাত সব ঠিক হয়ে গেছে। মান-অভিমানে ব্যস্ত তাই খবর দেবার হুঁশ নেই বাবুর।
        পরদিন সকাল নটা নাগাদ রাতুলের ফোন, জয়গুরু বলে ফোন ধরলাম। ফোন ধরতেই রাতুলের অসহায় কণ্ঠস্বর, “চলে গেল যে? কে করি?” “অ্যাঁ? মানে? কে চলে গেল? কোথায় তুই?” রাতুল ঢোঁক গিলে বলল, “প্রিয়াঙ্কা রে। আমার সামনে দিয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেল। তার বাইকে চেপে।” রাতুল অসংলগ্ন ভাবে যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে, রাতে রাতুল আর যায়নি। একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে সকাল বেলায় প্রিয়াঙ্কাদের গলির মোড়ে থলে ভর্তি উপহার নিয়ে হাজির হয়, প্রিয়াঙ্কাকে রাস্তায় ধরবে বলে, যাতে  শ্বশুর মশাই ঝামেলা বাঁধাতে না পারে, কিন্তু সব থেকে বড় উপহারটা প্রিয়াঙ্কাই ওকে দিয়ে যায় আজ।
        বিশ্বাস হয়নি। বন্ধু হতে পারে, সহকর্মী হতে পারে, আত্মীয় বা প্রতিবেশী হলেও আশ্চর্য হব না। হয়ত ঐ দিকেই যাচ্ছিল। হতেও তো পারে। রাতুল ফিরে আসে। সাদিক খোঁজ নিয়ে জানায়, আমার সন্দেহ অমূলক। ওরা পরস্পর প্রেমাষ্পদ এবং সম্ভবত বাগদত্ত। প্রিয়াঙ্কার এই বিয়েটা ভাঙলেই ওরা বিয়ে করতে চলেছে।
        অনেক গুলো মাস কেটে গেল। মা দুর্গা এসে চলেও গেলেন। রাতুলের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আর কথা বলি না। সবাই ভয়াবহ ব্যস্ত যে যার জীবনে। আমাদের বন্ধনও অটুট। সাদিক দেশে ফিরে ভালো আইনজ্ঞের সন্ধানে ব্যাপ্ত। রাতুল রাফিয়াকে আর আমাকে মাঝেমাঝেই ফোন করে জিজ্ঞেস করে, আমাদের ছানাগুলো কি করছে। অরোর বয়সে ওরা কি কি করত। খারাপ লাগে। কিন্তু বাস্তব বড়ই নির্মম।
        আজ বহুদিন বাদে রাতুল আমার অফিসে এল।আমাদের শ্রম কমিশনারেটের ভাঙা বাড়ি, খারাপ লিফট, অপরিচ্ছন্ন করিডোর, পচা চেম্বার, ঠাণ্ডা না করতে পারা বাতানুকূল সব নিয়ে আগের মত তামাশা করতে লাগল। আরও জ্বালাত, যদি না সাদিক ফোন করে ডেকে নিত। প্রিয়াঙ্কা নোটিশ দিয়েছে, তাই নিয়েই আইনজ্ঞের সাথে পরামর্শ করবে। দুজনের সম্মতিতেই ডিভোর্স হচ্ছে। রাতুল প্রিয়াঙ্কার আনা কোন অভিযোগ খন্ডন করার চেষ্টাও করেনি। উকিল বাবুর ইচ্ছে ছিল লম্বা টানার, রাতুল শান্তি চায়। শুধু অরোকে নিয়ে হাল্কা বাগবিতণ্ডা হতে পারে।
        খুব স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছিল রাতুল, হাসছিল হা হা করে। কতদিন বাদে। আমার তো খুশি হবার কথা। তাও এত বিষণ্ণ লাগছে কেন? এত দিনের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব হয়তো বা ভালবাসা ও ভেঙে যাচ্ছে তাই কি? “চলি রে” বলে ও উঠে পড়ল। রাতুলকে সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে এলাম। রাতুল নেমে যাচ্ছে, আমার কানে বেজেই চলেছে, ““কি নরম ও জানিস......। গায়ে কি সুন্দর গন্ধ জানিস......? কি ছোট্ট লাল জিভ, ভেজা ঠোঁট, চুমু খেতে গেলেই চেটে দেয় জানিস......। দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে তোতা পাখির মত ডাকে………”

Thursday 9 April 2015

ভাল থেকো চয়ন



মন ভাল নেই। কিচ্ছু ভাল লাগছে না চয়নের। অফিসের সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে এক টা সিগারেট ধরালো। বুক ভরে পড়ন্ত বিকালের ঠাণ্ডা হাওয়া টানলো, তাও যেন চাপটা কাটছে না।
সিঁড়ির দেওয়ালের না না দেব-দেবীর ছবি, যাতে এই ঝকঝকে দেওয়াল কেউ থুথু ফেলে নোংরা না করে। ঐ হাসি মুখের অভয় দেওয়া ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে রাগ আরও বেড়ে গেল। কেন? এত লোক থাকতে কেন চয়নের সাথেই এত অন্যায় করলেন ভগবান। দম বন্ধ হয়ে আসছে, মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
চয়নিকা মধ্য তিরিশ, অবিবাহিত, মাঝারি উচ্চতা, ছোটো করে কাটা চুল, পরনে ডেনিম আর কুর্তা, সেক্টর ফাইভের এক নামি বেসরকারি সংস্থায় মোটামুটি ভাল পদে কর্মরতা। মাইনে পত্র খারাপ পায় না। আপন বলতে দুই বোন আর এক কাকা। দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কাকা এক চূড়ান্ত বাউন্ডুলে লোক। তবু এই কাকাই চয়নের একমাত্র অবলম্বন।
দুই বোনেরই শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যুৎসাহী চয়নের বিয়ের ব্যাপারে, কৌতুহল পাড়াপড়শির ও কিছু কম না। সবার ওপর অফিস কলিগেরা তো আছেই। সবার প্রশ্ন একটাই চয়ন কেন বিয়ে করছে না? আর কবে করবে? চয়ন সব সময় কাকাকেই শিখণ্ডী খাড়া করে, দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলে, “ আমি তো বিয়ে করে চলে যাব, কাকাকে দেখবে কে?”।
খুড়ো মশাই অতি ধুরন্ধর। অন্য লোক হলে, নির্ঘাত বলত, “আমার জন্য কেন নিজের জীবন বরবাদ করছিস? আমার ঠিক চলে যাবে।” কিন্তু কাকা কিছুই বলে না। শুধু মিটিমিটি হাসে। চয়ন প্রচুর খোঁটা দেয়, মাঝে মাঝে মুখঝামটাও মারে। কিন্তু কাকা যেন সর্বংসহ। কাকার উপস্থিতি আর ভালবাসাই চয়নের বেঁচে থাকার রসদ।
কষ্ট হয় চয়নের, ভীষণ কষ্ট হয়। ভয় করে। ভুলে থাকার চেষ্টা করে। ভুলেও যায়। মেতে ওঠে জীবনের রঙে। সাধ্যাতীত পরিশ্রম করে। দশ জনের কাজ একা করার চেষ্টা করে, ক্লান্তির শেষ সীমানায় টেনে নিয়ে যেতে চায় নিজেকে। যাতে করে, রাত্রে বিছানায় গা দিলেই অতল ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে। রাতকে চয়নের বড় ভয়। কিন্তু চয়নের দেহ এক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
দেহ-মনের এই দ্বৈরথে আজ বড় ক্লান্ত, নিঃস্ব, রিক্ত চয়ন। যখন শিশু ছিল, অবোধ ছিল তখনই ভাল ছিল। জীবনের এক মাত্র সুখের সময়। নারীত্বের লক্ষন যেমন যেমন প্রকাশ পেতে লাগলো, আতঙ্কে ভুগতে লাগলো চয়ন।স্কুলে ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল তিস্তা। কতদিন ওরা হাত ধরাধরি করে ঘুরেছে। মেয়েদের স্কুলে বাচ্ছারা তাই করে। আদপে দৃষ্টিকটু না। কিন্তু আঙ্গুলে আঙ্গুলে যে এত কথা হতে পারে, প্রতিটা স্পর্শ যে এত বাঙময় হয় আগে তো বুঝত না চয়ন। তিস্তার আলিঙ্গন এত মোহময় আগে কখনও লাগেনি। কথায় কথায় তিস্তার ওকে জড়িয়ে ধরা, সে শিহরণ আজো চাইলেই অনুভব করতে পারে চয়ন। তিস্তার সাথে ওর শারীরিক নৈকট্য বোধহয় শালীনতার সীমা স্পর্শ করব করব করছিল, মৃদু গুঞ্জন কানে আসতেই চয়ন নিজেকে সরিয়ে নেয়। সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তিস্তার আচরণ,ও কোনদিনই কিছু বোঝেনি। চয়ন শুধুমাত্র ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল। আজো যেমন আছে।
তিস্তার পর দোলা। দোলনচাঁপা। কথায় কথায় বলত, “চয়ন, তোকে আমি বড্ড ভালবাসি রে।” চয়ন, ঘরপোড়া গরু, বলতো, “ভাগ শালা।” কিন্তু দোলার সেই স্ফুরিত অধর, ব্যথা-বিদুর চোখ, তাড়িত করতো বিশ্বাস করতে। আজকাল তো লোকে ধন্যবাদ না বলেও “আই লাভ ইউ” বলে। কি করে বিশ্বাস করতো চয়ন? চয়নও  অবশ্য কোনদিন বলে উঠতে পারেনি। ক্ষুব্ধ দোলা বলতো, “দেখিস, যে দিন আমি থাকব না, সেদিন তুই বুঝবি।”
আজ দোলা কোথায়? দিব্যি মায়ের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে উঠেছে। কি যেন বলছিল বিয়ের আগে, “ মন থেকে সাড়া পাচ্ছি না। বিয়ে না করলে দাদার বিয়ে হচ্ছে না।” ইত্যাদি ইত্যাদি। ও রকম সবাই বলে। দোলার বিয়েতে কি খাটাই না খেটেছে চয়ন, দোলা এক বার তাকায়নি পর্যন্ত। ঘাড় শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। অন্য বন্ধুদের সাথে দিব্যি মিষ্টি হেঁসে কথা বলেছে, চয়ন ওর হাত ধরে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল, ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। কিসের এত ক্ষোভ ওর? বিয়ের পর দোলার একটা ফোন ধরেছে? আছে অথচ নেই। ফেসবুক থেকে জানতে পারে ওরা কোথায় বেড়াতে গেছে, চয়ন অনাহুতের মত কমেন্ট, ইনবক্স মেসেজ করে, দোলা নিরুত্তর। প্রতি পদে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বুঝিয়ে দেয় দোলা ওর পরোয়া করে না। ঞ্জানতঃ চয়ন কারো মনে কোনদিন কষ্ট দেয়নি, অথচ দোলা যেন ওর হৃদপিণ্ডটাই ফুটো করে দিয়েছে। কাঁদতে পারে না, এটাই ওর সবথেকে বড় দুর্বলতা।
ফেসবুকে লোকে সমকামীদের নিয়ে কত কিছু লেখে, প্রচণ্ড রাগ হয় চয়নের, “ শালারা আয়, আমার জুতোয় পা গলিয়ে দেখ। যত ভণ্ডের দল। কটা গল্প, উপন্যাস লেখা হয় চয়নদের নিয়ে? একটা সিনেমা ওঠে? আর যা তোলা হয়, টা দেখে ওর হাসি পায়। ওর এক সুন্দরী সহকর্মী তার পুরুষ বন্ধুর দেওয়ালে একবার লিখেছিল, “উফ! ভাল ছেলে পাওয়া এত কষ্টকর জানলে আমি লেসবিয়ান হতাম।” সাঁটিয়ে একটা চড় কসাতে ইচ্ছে করছিল চয়নের। আজ যেমন অফিসে দীপক আর রণিত, দুই মেয়েবাজ গল্প করছিল, “ও সব সমকাম-টাম কিস্যু না। ছেলে গুলোকে চাবকানো উচিত, আর মেয়েদের জন্য তো আমরা আছিই।” আজ আর সহ্য করতে পারলো না চয়ন, বাথরুমের নিভৃতে উগরে দিল নিজের সমস্ত ক্ষোভ। বহুদিন বাদে কাঁদল চয়ন, ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো সব ব্যথা – বেদনা, নিস্ফল আক্রোশ, অক্ষম রাগ। তীব্র ধিৎকারে ভরে ওঠে ওর মন, প্রতিবাদ না করতে পারার অক্ষমতার গ্লানিতে নিজেকে কৃমিকীটের অধম বলে মনে হয়।  
ইএম বাইপাসের এক নামি বেসরকারি হাসপাতালের ওপিডিতে মাথা নীচু করে বসে আছে চয়নিকা। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আজ এখানে এসেছে ও। শেষ চেষ্টা, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার। ওর ডাক আসতে দরজা ঠেলে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকল চয়ন, ডাঃ ইশারায় ওকে বসতে বললেন। ডাঃ সুতপা সেন, মনোবীদ, প্রায় পঞ্চাশ, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, দোহারা চেহারা, হেনা করা লালচে চুল, রিমলেস চশমার আড়ালে এক জোড়া সহমর্মী চোখ, কালো দামি সুতির শাড়িতে সোনার ব্রোচ আটকানো দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল চয়নের। ডাক্তার উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ ওর মনে হল, এখানে আসাটা খুব ভুল হয়ে গেছে। কি চায় ও? কেন এল? কি বলবে ডাক্তারকে? অস্ফুটে নিজেকে অশ্রাব্য গালি দিতে লাগল চয়ন। মাথা নীচু করে ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল, এক, দুই, তিন মিনিট কাটছে না ঘণ্টা? ডাঃ ও কিছু বলছে না কেন? নাঃ আর বসা যায় না। “দুঃখিত, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য। চলি” উঠে দাঁড়িয়ে বলল চয়ন। ডাঃ এর ভ্রূ দ্বয় সামান্য কোঁচকাল, খর হল চোখের দৃষ্টি। পরিষ্কার বাংলা এবং ইংরাজি উচ্চারনে কেটে কেটে বললেন, “ মাঝে মাঝে দু এক জন অপোগণ্ড আসে তাদের কিশোর পুত্রকন্যা কে নিয়ে, আমি তাদের ঘাড় ধরে বার করে দি। আমি ডাক্তার চয়নিকা, ভগবান নই।”
অনেক কথা হল, তর্ক- বিতর্ক, খেলা, বিনোদন, রাজনীতি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা, হল না শুধু চয়নকে নিয়ে কোনো কথা। বহুদিন বাদে হাল্কা লাগছিল, আরও বসতে ইচ্ছে করছিল, ডাঃ সেন ও উঠতে বলছিলেন না। তবু উঠল ও। আরও পেশেন্ট অপেক্ষা করছে।  আসার সময় সুতপাদি বললেন, “ভালো থেকো চয়ন।” মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল, ও।
হাল্কা লাগছিল। লিফটের লাইনে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ধরল। পুরো দেওয়ালটাই স্বচ্ছ কাঁচের, বাইরে ঝকঝকে সোনা রোদ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের নকশা সোচ্চারে ঘোষণা করছে মা আসছেন। মনটা আরও খুশিতে ভরে উঠল চয়নের। খুব ইচ্ছা করছিল একটা সিগারেট ধরাতে, নিদেন পক্ষে একটা বিড়ি হলেও চলবে, জোর করে নিজের অবুঝ মনকে শান্ত করে নীচে নেমে এল। দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসে বলা আছে যদিও। একতলার ঝাঁ চকচকে ক্যাফেটেরিয়াটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলো না, চয়ন। “ধুত্তোর, নিকুচি করেছে” বলে এক কাপ কফি আর বানানা ওয়ালনাট ব্রেড নিয়ে আরাম করে জানলার ধারে বসল।
সত্যি শরৎ কালের যাদু আছে, আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল চয়নিকা, হঠাৎ বুক পকেটে মুঠো ফোনটা সজোরে কাঁপতে লাগল। এক পলকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল ওকে, নির্ঘাত অফিস। মুখটা মুহূর্তের জন্য তেতো হয়ে গেল। ধরবেই না আজ ও, যত পারে কাঁপুক। কিন্তু কম্পনের কি রকমফের আছে? তা না হলে এ কম্পন কেন এভাবে চয়নের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে? স্থির থাকতে দিচ্ছে না ওকে, হঠাৎ এক জুয়া খেললতে ইচ্ছে করল চয়নের, চোখ বুজে আন্দাজে ফোনটা বার করে, কানে দিয়ে, বিপক্ষকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও বলে উঠল, “ দোলা, আমি ভাল আছি রে।”
image courtesy Google

Monday 30 March 2015

Say No to Body Shaming

Do you know what "Body Shaming" is? Nothing but being extra judgemental about yourself. We spend all our life try to make every one happy but take ourselves for granted. Please don't. You are too fat? So? Lady you are gorgeous. No assets? Lady you are gorgeous too. You love to wear make up? Do it, if that makes you happy. You hate make up? Please don't. You don't have much hair left? Lady you are as feminine as any other girl. You want to hide your greys? Want to put on red lippie? Do it. Do not pay attention to negative people or gossip.
you are one of a kind. All you need is bit selflove. Love thyself. Pamper yourself. Trust me you have the time. Indulge yourself, you badly need it. Tomorrow is the new beginning.
 http://cdn2.blisstree.com/wp-content/uploads/2013/07/original.jpgImage Courtesy -Google

Tuesday 24 March 2015

মেয়েটা ভাল



‘ছেড়ে দিন। ডিভোর্স দিয়ে দিন। ও আর ফিরে আসবে না । আর এলেও এ সম্পর্ক কোনদিন ঠিক হবে বলে আপনার মনে হয়? ক্ষত থেকেই যাবে।’ আমার উগ্র ফেমিনিস্ট কান বিশ্বাস করতে পারছিল না, আমি? যে কিনা কথায় কথায় ‘ইউনিভার্সাল সিস্টারহুডে’র দোহাই দি, আমি এ মন্তব্য করছি, তাও এক জন মহিলার সম্বন্ধে?
          শ্রোতা হলেন সুব্রত বাবু। স্থান ভাষা ভবন, জাতীয় গ্রন্থাগার। ফেব্রুয়ারীর কলকাতা। ঝকঝকে নীল আকাশ, মিঠে রোদ, ফুরফুরে হাওয়া। সামাজিক সুরক্ষা মাস অর্থাৎ জানুয়ারী সবে শেষ হয়েছে। আমরা কে কেমন কাজ করেছি তারই পর্যালোচনা করার জন্য মাননীয় শ্রম মন্ত্রী দক্ষিণবঙ্গের সমস্ত শ্রম কমিশনার এবং ইন্সপেক্টরদের মিটিং এ ডেকেছেন।
          সেখানেই বহুদিন বাদে সুব্রত বাবুর সঙ্গে দেখা। উনি এক কালে আমার ইন্সপেক্টর ছিলেন। বেশ কিছু বছর আগের কথা। তখনও পরিবর্তনের হাওয়া ওঠেনি। সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম তখনও নেহাতই শান্ত জনপদ। পশ্চিম বঙ্গের রঙ্গমঞ্চে তখনও কিষানজীর আবির্ভাব হয়নি। লেবার সার্ভিসে যোগ দেবার সাথে সাথেই পাঠিয়ে দিল পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তে এক ছোট্ট মহকুমার এ.এল.সি করে।
          রাঢ় বাংলা। লাল মাটির রুক্ষ দেশসহজ সরল মানুষ জন। অফিসে যোগ দেওয়া মাত্রই পরপর দুজন ইন্সপেক্টর অবসর নিলেন, যেন আমারই প্রতীক্ষায় ছিলেন। রয়ে গেলাম আমি, এক মহা ধুরন্ধর চোর আর্দালি আর এক আধপাগল নৈশ প্রহরী। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিছু দিন চলল। বেদম হবার আগেই  এক জন অবসর প্রাপ্ত করণিককে পেয়ে গেলাম। নামমাত্র মজুরীর বিনিময়ে সমর বাবু এসে হাল ধরলেন আমার অফিসের। এই স্থূলকায় বিরল কেশ ভদ্রলোকটিকে আমি আদর করে ডাকতাম বড়বাবু বলে।
          এমতবস্থায় একদিন কলকাতা থেকে বড় সাহেব ফোন করে সুখবর দিলেন, শক্ত-পোক্ত এক যুবক ইন্সপেক্টর  পাঠানো হচ্ছে, যাকে দেখলেই মনে হয় প্রচুর খাটতে পারে। পক্ষ কালের মধ্যেই সুব্রত বাবু এসে যোগ দিলেন। ভুমি পুত্র, জেলা সদরে বাড়ি। বেশ কালো, লম্বা, বৃষস্কন্দ, পেটানো চেহারা। ফুল হাতা শার্ট গুটিয়ে হাফ করে পরেন। দীর্ঘ দিন কোন দপ্তরে করণিক ছিলেন। যুবক নন, বয়স ৩৭ এবং অবিবাহিত।অ্যাডিশনাল কমিশনার সাহেব খুব ভুল কিছু বলেননি। প্রবল কর্মক্ষম বলেই আপাত দৃষ্টিতে মনে হল।
সুব্রত বাবুকে নিয়ে প্রথম দিকে খুব সমস্যা হয়। তরুণী মহিলা অফিসারকে উনি আদপে পাত্তা দিতে চাইতেন না। সমর বাবু এবং আধপাগল নৈশপ্রহরীর সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতেন। অতি দুর্মুখ, ঘোরতর কর্মবিমুখ এবং অসৎ ওনার সখা ছিল আমার চোর আর্দালি। প্রায় দিনই দুজনকে অফিসে পাওয়া যেত না। শক্ত হাতে হাল ধরলাম। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠল। বেশ কিছুদিন গরম হাওয়া বইবার পর, আস্তে আস্তে উত্তাপ কমে এল। কিছু দিন বাদে সব ধামাচাপা পড়ে গেল। যদিও তিক্ততার রেশ টুকু এবং মনের কোনে অবিশ্বাস রয়েই গেল।
আবহাওয়া স্থিতিশীল হতেই বুড়ো সমর বাবু ঘটকগিরিতে নামলেন। আমি হাত জোড় করে অব্যাহতি চাইলাম। সৌর তখন প্রোবেশনে উত্তরবঙ্গে আছে। শীঘ্রই বিয়ে করতে হবে না হলে এক জেলায় দুজনের পোস্টিং অসম্ভব। অতএব আমি বাদ। বাকি রইলেন সুব্রত বাবু। উনি লজ্জায় বেগুনী হয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। দুজনে কোমর বেঁধে পাত্রী দেখতে লাগলেন। আমার অফিস প্রায় লাটে  ওঠে।
আরো তিনটে ঋতু কেটে গেল। আমার বিয়ে হয়ে গেল। কয়েক মাসের মধ্যেই সৌর বি.ডি.ও হয়ে এল আমার মহকুমায়। নতুন সংসার, পুরানো অফিস। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলতে লাগলো আমাদের জীবন। কত শত নতুন অভিগতা, নতুন অনুভব। পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো পাত্রী খোঁজা। মাঝে মাঝে আওয়াজ দিতাম, কুমারটুলি তে বায়না দিতে যেতে হবে। মাতৃত্ব কালীন ছুটিতে যাবার মাস খানেক আগে সুব্রত বাবু এসে কার্ডটা দিলেন। স্থানীয় মেয়ে। বয়স ত্রিশ। বাবা সদরের নাম করা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। মেয়েও পাশ দিয়েছে তবে প্রাকটিস করে না।
দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলাম। অফিসের অবস্থা যতটা ভয়াবহ হবে ভেবেছিলাম, দেখলাম তা নয়। সুব্রত বাবু বেশ খোশ মেজাজে আছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি সব ঠিক আছে তো?” উনি লাজুক হেসে বললেন, “ হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনার আশীর্বাদে। তবে বাবা মা এর একমাত্র মেয়ে, কোনো কাজ শেখেনি। আমার বাবা আবার বাইরের লোকের হাতে খান না। মা ও খুব শুচিবায়ুগ্রস্ত , খিটখিটে প্রকৃ্তির, কাজের লোক টেকে না। ফলে মায়ের ওপর খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে। ওকে কোনো কাজ করতে বললে ও করে বটে, তবে পুঙ্খনাপুঙ্খ লাগায় নিজের বাবা-মাকে। আর ওনারা এসে অশান্তি করেন। তবে বিশ্বাস করুন ম্যাডাম মেয়েটা খুব ভাল ”
সময়ের সাথে সাথে সুব্রত বাবুর বাড়ির অশান্তি বেড়েই চলল এবং তা আর বাড়ির চার দেওয়াল এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। রেগে গিয়ে একবার উনি নিজের স্ত্রীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন, যাতে শ্বাশুড়ি কুমন্ত্রণা দিতে না পারেন। ফলশ্রুতি ওনার শ্বশুরমশাই থানায় যেতে উদ্যত হন এবং আমাকে ফোন করে ওনাকে শায়েস্তা করার অনুরোধ করেন। সে যাত্রা কোনোমতে ওনাকে নিরস্ত করে সুব্রত বাবু কে হাফ ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠাই ফোন ফেরৎ দিতে। সমস্যা চরমে ওঠে যখন ডাক্তার জানান যে টেস্ট টিউব বেবি ছাড়া ওনাদের বংশ বৃদ্ধি সম্ভব নয় এবং খরচা সাকুল্যে চার লাখ। পি এফ থেকে দুলাখ লোনের জন্য আবেদন করে, বাকিটা সুব্রত বাবু ওনার স্ত্রীর গয়না বিক্রি এবং শ্বশুরের কাছে কর্জ করবেন বলে মনস্থ করেন।
আজো মনে আছে, সে দিনটা ছিল সুক্রবার।সুব্রত বাবুর স্ত্রী সকাল বেলা শ্বশুর- শ্বাশুড়িকে প্রণাম করে বরের সাথে বাপের বাড়ি গেলেন, বলে গেলেন,“রবিবার রাতে নিতে আসতে ভুলো না।”তারপর থেকে ওনাদের বার কয়েক দেখা হয়েছে মাত্র, শুধু আদালতে। শ্বশুর বাড়ি গেলে ওনাকে কুৎসিত ভাষায় অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বউ ফোন ধরে না। পরবর্তী কালে নম্বরও বদলে গেছে। কোন মধ্যস্ততাকারীকে ওনারা বাড়িতে ঢুকতে দেননি। সমর বাবু আর আমার দৃঢ় ধারণা ছিল কোন তৃতীয় ব্যক্তি আছে। কোন তৃতীয় কোণ। কিন্তু সুব্রত বাবু তা নস্যাৎ করে বারবার বলতে থাকেন, “না ম্যাডাম, মেয়েটা ভাল।”
ওনাকে মাঝপথে ছেড়ে আমি বদলী হয়ে আসি মহানগরে। তারপর তিন বছর কেটে গেছে। সমর বাবু ও রণে ভঙ্গ দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কেস আজো চলছে, এবং সুব্রত বাবু আমাকে আজো বললেন, “ ডিভোর্স দিয়ে দিলে আমি কি নিয়ে থাকব? আমার তো আর কিছু হবার বয়স নেই ম্যাডাম। আর বিশ্বাস করুন মেয়েটা খুব ভাল”।
 
image courtesy-Google