Monday 24 August 2015

অনির ডাইরি 23শে অগস্ট, 2015


দিন কয়েক আগের কথা,অফিস যাচ্ছি, হঠাৎ  মুঠো ফোনের তীব্র আর্তনাদ   খুলে দেখি আমার এক বয়স্ক বন্ধু না উনি আদতে আমার বন্ধু নন, তবে কিছুদিন হল এফ বিতে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন যদিও পরিচয় বহুদিনের যাই হোক প্রাত:কােল ওনার ফোন পেয়ে মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল  ওণার শানিত জিহ্বা আর তীব্র রসবোধের আমি অন্ধ ভক্ত এমন সুচারু ভাষায় ব্যঙ্গ  করতে আমি খুব কম লোককে দেখেছি  তবে আমাকে অত্যন্ত  স্নেহ করেন  ফোন ধরতেই ওনার আর্তনাদ ,“ এই ফেসবুক ডিলিট করে কি করে?” কি আবার হল সকাল বেলায়, গলায় সামান্য উদ্বেগ ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম  ফেসবুক যে ডিলিট হয় না, এ্যাকাউন্ট ডি-এ্যাকটিভেট করা যায় গূঢ় তথ্য দিয়ে এই মুহূর্তে কোন লাভ নেই পরিষ্কার বুঝলাম  উনি সদ্য সদ্য এই অন্তর্জালে জড়িয়েছেন এবং আমি ওনার স্নেহধন্য হবার এটাই মূল কারণ  মাঝে মাঝেই পরশুরামের ভাষায়  আমি ওণার উৎকণ্ঠা পিসিমণি (এ্যাগনি আন্ট)হই প্রসঙ্গত উল্লেখ যোগ্য যে কিছুকাল  পূর্বে একদল বৃদ্ধ  সমকামী ওনাকে সাংঘাতিকভাবে উত্যক্ত  করছিল  অনভিজ্ঞতা  হেতু উনি প্রথম দিকে পরিচিত  অর্ধ- পরিচিত , অপরিচিত সকলের বন্ধুত্ব স্বীকার করেছিলেন  স্বপ্নেও ভাবেননি যে এই বৃদ্ধ  বয়সে শয়ে শয়ে প্রেম প্রস্তাব পাবেন  তাও নানা বয়সের পুঙ্গবদের থেকে  সৌজন্যবশতঃ কিছু লোকজনকে  মোবাইল  নম্বর প্রদান করে অবস্থা আরো সঙ্গিন করে তোলেন  যখন ভয়াবহ হোমোফোবিয়ায় ভুগতে শুরু করেছেন সমস্ত সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে উনি আমার সাহায্য  প্রার্থনা করেন  অতঃপর আমি যাই এবং উকুন বাছার মত একটি একটি করে সব কটাকে ব্লক করে কিছু সেটিং পাল্টে ওনাকে উদ্ধার করি

পুনরায় ওনার এই আর্ত চিৎকার  শুনে প্রথমেই মনে হল, এবার কি বিষমকামীদের উৎপাত ? আড় চোখে পাশের অবাঙালি সহযাত্রীটির দিকে তাকালাম, উনি মনোযোগ সহকারে ম্যানেজমেন্টের বইয়ে দাগ দিচ্ছেনযথাসম্ভব সংযত হয়ে বললাম,“ আবার কি বাঁধিয়েছেন?” উনি আশ্বস্ত করে বললেন না তেমন কিছুই না, তবে এই উঠতি কবিকুলকে উনি আর নিতে পারছেন না আশ্চর্য হলাম, কবিতা তো উনিও মন্দ লেখেন না? আজকাল ১৪ থেকে ৮৪ সবাই কবি সৌজন্যে ফেসবুক  ব্যাপারটা মন্দ নয় কবিতা লেখা বাঙালির জাতীয় হবি  আমার মত দুচারজন অশিক্ষিত অপোগণ্ড ছাড়া দেখুন মশাই আমরা সাংঘাতিক আবেগ প্রবণ জাত  সেই আবেগ প্রকাশ করার সহজতম মাধ্যম কবিতা  আমার অবশ্য আজন্ম  কবিফোবিয়া আছে  আমার প্রাক্তন সহকর্মী শ্রীযুক্ত রক্তিম ইসলাম এবং বর্তমান বন্ধু শ্রী চিরন্তন ভট্টাচার্য ব্যতীত বাকি কবিদের আমার রীতিমত ভয় করে  আমি নিতান্তই ছাপোষা মহিলা শ্রমিক জটিল  কবিতা  একেবারেই বুঝি না উপরিউক্ত দুজনই বারংবার বলেন যে বুঝতে  হবে না কবিতা অনুভবের বস্তু   ঘোরতর সত্যি  রবি ঠাকুর থেকে সুনীল শক্তি এমনকি আধুনিক শ্রীজাত এদের কবিতা অনায়াসে হৃদয়তন্ত্রে আলোড়ন তোলে বিশেষ কোন মুহূর্তে মনে পড়েই যায় অসম্ভব অব্যর্থ শব্দের মূর্ছনা  সাময়িকভাবে  ভূলে যাই আমার ডিমেনশিয়া আছে 
কিন্ত মুশকিল হচ্ছে তাদের নিয়ে যাদের কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে ব্যর্থ প্রেম  কাঁহাতক এই ব্যর্থ প্রেমের গপ্প শোনা যায়? প্রাতঃকৃত করার মত কিছু লোকের কবিতা আসে, যেমন আমার গল্প আসে আর কি এবং তারা শুধু  একটি বিষয়েই গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা লেখেন  ভাই এত বিরহ তোদের? এত বেদনা  শয়ে শয়ে জীবনানন্দ   অথচ কারো জীবনে আনন্দ নাই ভাই রে আজ অবধি একটি  সফল প্রেমও করতে পারলি না? মুস্কিল হল এই নব্য কবিরা অধিকাংশই বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহন করতে পারেন না  এক প্রাক্তন  আমলার কথা শুনলাম কিছুদিন আগে, উনিও উঠতি কবি, শয়ে শয়ে অনুরাগী   আমার দু একজন বন্ধু ওনার কিছু কবিতা শেয়ার করেন মাঝেসাঝে ,একেবারে অপাঠ্য যাইহোক শুনলাম উনি নাকি ওনার কবিতার সমালোচনা সহ্য করেন না  আহা আহা করলে ঠিক আছে অন্যথায় ওনার ফ্রেন্ডলিস্টে জায়গা হয় না  আমি একদা আমার এক পরিচিত কে প্রশ্ন করেছিলাম আপনি ভয়াবহ কবিতাটি কেন লাইক করলেন? অবশ্যই কবিতাটির কোন নিগূঢ় অর্থ আছে যা আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না  যদি অনুগ্রহ করে উনি বুঝিয়ে  দেন  জবাবে উনি অট্টহাস্য করে বলেছিলেন উনি আদপে পড়েননি  তবে ওণার এককালীন বসের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই লাইক করেন

কবিতা লেখা  বা সমালোচনা সহ্য না করা কোনটাই গর্হিত  অপরাধ নয় তবে সমস্যা হয় তখনই যখন কিছু কবি অনবরতপোককরতে থাকেন   উদ্দেশ্য আপনি ওণার কাব্য পড়ুন এবং  লাইক করুন  শুধু লাইক করলে নিষ্কৃতি নেই  কমেন্ট দিন  আপনার সুচিন্তিত মতামত যা অবশ্যই প্রশংসা সূচক হতে হবে আমাদের মত পূরানো পাপীরা ব্যাপারে অভিজ্ঞ   এইরূপ কবিদের তৎক্ষণাৎ আনফ্রেন্ড করাই শ্রেয়

 মুস্কিল হল আমার এই বয়ঃজেষ্ঠ বন্ধুটি বেশ কিছু ব্যক্তিকে আনফ্রেন্ড করেও  উৎপাত বন্ধ করতে পারছেন না , প্রথমে কৈফিয়ৎ দাবী এবং তারপর অনুনয় বিনয় চলছেই  তিতিবিরক্ত হয়ে উনি এ্যাকাউন্টটাই উড়িয়ে  দিতে বদ্ধ পরিকর


বুঝলাম ওনার ডিজিটাল ডিটক্সিফিকেশন দরকার  দিব্যি অবসর জীবন উপভোগ করছিলেন হঠাৎ মুঠোয় আসা মুঠোফোনটি যত নষ্টের গোড়া  সম্পূর্ণ অন্য জগৎ এখানে মুখ এবং মুখোশ দুটোই ভিন্নরকম  অসহায় বৃদ্ধ এই ভিড়ে আরো অসহায় বোধ করছেন  ওনার সমবয়স্ক বন্ধু বান্ধব এই মায়াদুনিয়ায় কেউই নেই  আত্মীয় স্বজন থাকলেও নিজ নিজ পরিমণ্ডলে সীমিত   আসলে দুনিয়ায় তারা আপনার সমব্যথী হলেও মায়াময় জগতে সবাই নিজের প্রতিচ্ছবি উজ্জল করতে সদাব্রত   বড় নিঃসঙ্গ আমার বন্ধুটি  ধীরে ধীরে উনিও হয়তো মেতে উঠবেন, ফেসবুক ওনাকেও রেয়াত করবে না  তবু কিছুদিনের জন্য এই কুহকীর থেকে দূরে থাকাই বোধহয় শ্রেয়  একরাশ বিষাদ নিয়ে আজ মুছে দিলাম ওনার এ্যাকাউন্টটি  তবে হাল ছাড়ছি না  শীঘ্রই ফিরব আমরা

Wednesday 19 August 2015

অনির ডাইরি ১৮ই অগস্ট ২০১৫

ভাগ্যে আজ ধর্মঘট ছিল, আমাদের মত কতিপয় বেতনভূক দাসানুদাস ছাড়া অধিকাংশ ডালহৌসী গামি বাবু ফোকটে ছুটি কাটাচ্ছিল তাই রক্ষা   না হলে আরো কিছু কটুকাটব্য শুনতে হত আর কি  কোনটাই অবশ্য প্রত্যক্ষ ভাবে  আমাকে উদ্দেশ্য করে নয়, তবে আমার জাতের জন্য তো বটেই  না না বাঙালি , ঘটী বা ভারতীয় নয় এছাড়াও আমার একটা জাত আছে   বুঝতে পারলেন না? আমি দাবী করছি যে আপনিও আজ বা গতকাল এই নিয়ে আপনার সুচিন্তিত এবং মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন  হতে পারে জাগতিক ব্যাপার স্যাপারে আপনি উদাসীন কিন্তু  গতকাল খড়দায় যা হয়েছে তা নিয়ে আপনার আদৌ মাথাব্যথা নেই এটা হজম করা বেশ কষ্টকর   একদঙ্গল মহিলা নিত্যযাত্রী এতবড় অবরোধ ঘটিয়ে ফেলল? কি মানা যায়? তাও বরাবরের মার খাওয়া অবলা সুলভ মিনমিনে প্রতিবাদ নয়, অহিংস উপবাস ধর্ণা নয় রীতিমত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই   পুরুষ সহযাত্রী দের বেধড়ক পেটানো  পুলিশ পড়ুন পুং পুলিশের ডান্ডা খেয়েও রণে ভঙ্গ না দিয়ে , শেষমেশ প্রবল পরাক্রান্ত ভারতীয় রেলকে মাথানত করিয়ে ছাড়ল!!! মশাই  এতো আদৌ সহজপাচ্য নয়  এতএব এর শবব্যবচ্ছেদ আসু প্রয়োজন

দেখুন আমার কথা শেষ হবার আগেই আপনি  আমায়  ভুল বুঝছেন  আমি হতভাগ্য স্বঘোষিত নারীবাদী হতে পারি, কিন্তু  যে কোন সংরক্ষণের আমি ঘোর বিরোধী আর পথঅরোধ ব্যাপারটাই আমার মতে বেআইনী হওয়া উচিৎ জানেন যখনই ফেসবুকে কোন মহিলা সংক্রান্ত খবর দেখি, শতকরা  নিরানব্বই ভাগ নারী নির্যাতন  ঘটিত হয় যদিও, আমি খবরের নীচের মন্তব্য গুলি পড়ি  কখনও পড়ে দেখেছেন? ব্যাপক রসের খোরাক মশাই   কোথাও  কোন অবলার ওপর কোন নরাধম অত্যাচার করেছে, দুই বাংলার কিছু পুরুষ ঝাঁপিয়ে  পড়ে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে  কি অদ্ভূত মানসিক মিল মশাই কে বলবে দুটি  আলাদা দেশের বাসিন্দা   কিছু লোক বলে, হায় কপাল তুই দিব্যি  ফূর্তি করে নিলি, আমার নম্বর যে কবে আসবে? এগুলো একেবারেই অর্বাচীন   লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্ত  সম্প্রদায় আবার এর জন্য মেয়েদের  উদ্দামতা তথা শর্ট স্কার্ট ইত্যাদি পরাকে দায়ী করে যেন ধর্ষিতা মাত্রই স্বল্প পোশাকী হয় যাই হোক খড়দার ব্যাপারটা নিয়ে মন্তব্য গুলি পড়ছিলাম  বিশুদ্ধ দেশীয় মতামত একদল বলছে মুখে সমানাধিকারবাদ এর কথা বলে অথচ? হাসি পাচ্ছিল যে দেশটা আদ্যন্ত সংরক্ষণ নির্ভর  ক্রীমি লেয়ারে থাকা জনগন সামান্য সুযোগ হারাতে চায় না, প্রতিনিয়ত যেখানে সংরক্ষিত হবার জন্য আন্দোলন চলে, সেখানে গুটিকত মহিলার জন্য সংরক্ষিত একটা ট্রেন মেনে নিতে কি কষ্টই না হচ্ছে


দেখুন মশাই আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তান , জীবনেও কোন সংরক্ষণের সুবিধা পাইনি শুধু বাসের কিছু সিট আর লেডিজ কম্পার্টমেন্টের সুবিধা বাদে  তবে এই সংরক্ষণ যে কেন  তা নিয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন   শুধু দুটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করব মনে আছে কিছু  বছর আগে মেট্রো রেলের কিয়দাংশ মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা  হয়  তার বিরুদ্ধে পুং যাত্রীরা অবরোধ করেননি  শুধু কুৎসিত  মন্তব্যই যথেষ্ট ছিল  অবলারা দিক মাড়ানো ছেড়ে দিয়েছিল  দ্বিতীয়টি হল লোকাল ট্রেনের একটি কামরা দিনের কয়েকঘন্টার জন্য মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করার একটা চেষ্টা করা হয়  আমি তখন খড়্গপুর লোকালের নিত্যযাত্রী   সে তিক্ত  অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে আমি অপারগ  বার বার কি মার খাওয়া যায় বলুন?

Monday 17 August 2015

অনির ডাইরি ১৪ই অগস্ট, ২০১৫



কতদিন পরে এলামপ্রায় তিন মাস  সেই দূষিত  বিষাক্ত  বাতাস  আর  পুতিগন্ধময় পথঘাট, নিয়ন্ত্রনহীন যানবাহনের বেয়াক্কেলে শোরগোল যদিও সম্পর্কে  মহানগরের বৈমাত্রেয় ভাই এঁদো গলি , কানাগলি, গাড়ি ঢোকে না, বিরক্তিকর কুকুরের বিষ্টা আচ্ছা আপনাদের মহল্লার সারমেয়কূল কি এতটাই পেটরোগা? প্যাচপ্যাচে কাদা,খানাখন্দ, জমা জল, বিপদসীমার ঠিক নীচে বয়ে চলা নর্দমা-- হোক না তাও তো আমার শহরব্রিজ টপকালেই যেন বাতাসে বাবার সিগারেটের  গন্ধ, নাগরিক  শোরগোলে কেমন যেন মিশে আছে মায়ের বকুনি  (কম খেয়েছি?)! ভেজা ভেজা পথঘাট না ঠাকুমার সদ্য ধোওয়া উঠোন! মাপ করবেন কুকুরেরগু’  টাকে মহিমান্বিত করার মত কিছু মাথায় আসছে না  তবে একথা স্বীকার  করতেই হবে আমাদের মহল্লার ছেলে মেয়র হবার পর কিন্তু অবস্থা অনেকটাই ভাল  কুকুরগুলো বেয়াড়া বেআদপ বদতমিজ হলে বেচারা সাফাই কর্মীদের কি দোষ? প্রাত:কালে প্রাতকৃত্য তাও বুঝি, সারাদিনে কত বার যাবিরে বাপ? রোজই কি তোদের পেট ছাড়ে? খাস তো ভাই  ডাল, ভাত, বাসি রুটি আর উচ্ছিষ্ট শাক চচ্চড়ি  বড়জোর মাছের কাঁটা আর রবিবার হলে মাংসের হাড়  তাতেই অ্যাসিডিটি  যখনই বেরোবেন দেখতে পাবেন একাধিক  কুত্তা ঘাস চিবোচ্ছে ওরা বাংলী মশাই   শুধু ভোরবেলা অর্ধ- চেনা লোক দেখলে মনে পড়ে যায় কোন এককালে ওরাও শ্বাপদ ছিল


কুকুর পুরাণ থাকুক  ফিরে আসি আমার শহরেবিরাট যৌথ পরিবার শরিকী বিবাদে ছিন্নভিন্ন, নিত্য অশান্তি, মনকষাকষি, বাবা মায়ের কর্ম ক্ষেত্রের লাগাতার টেনশন, ঝড়ের মত কেটে যাওয়া স্কুল জীবন, কত শত নষ্ট বসন্ত সাদা জামা লাল বেল্ট ছেড়ে শাড়ি স্কুল ছেড়ে কলেজ  প্রিয় বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ   ঠাকুমা দিদিমার হঠাৎ  করে হারিয়ে যাওয়া বেকারত্বের স্বাদ চাখা   মেরুদণ্ড ভেঙে পড়তে পড়তেও থমকান   বাবা বলত, “ যে সহে, সে রহে  মূল কথাটা যিনি বলেছিলেন তিনিও কিন্তু চাটুজ্জে ছিলেন চিরকাল অলস সংগ্রাম বিমুখ চুড়ান্ত  অমিশুক ঘরকুনো অনি কেমন যেন বদলে গেল  লড় নয়তো মর  জীবনের সোজা হিসাব   হঠাৎ  করে পাওয়া শ্রমিকত্ব জীবনের ভোলটাই পালটে দিল  আচমকা পরিচিত  অরকূট আর স্থানীয় দোকান থেকে রিটায়ার্ড বাবার কষ্ট সঞ্চিত অর্থে  কিনে দেওয়া রিলায়েন্স সিডিএমএ মোবাইল সুদ সমেত ফিরিয়ে দিতে লাগল একটা একটা করে হারানো  বন্ধু ছিন্ন বিছিন্ন যৌথ পরিবার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেও কি করে জানি না মান অভিমান ভূলে একদিন মিলেমিশে  গেল  এই শহরেই প্রথম দেখা তার সাথে  প্রথম আলাপে যে নাক উচু করে বলেছিল,“ আপনাদের তো ডিপার্টমেন্টে পোস্টিং নেই?”  সে আদতে এই শহরেরই জাতক  এই শহরই তো শিখিয়েছে কিছুই হারায় না

Tuesday 11 August 2015

পরকীয়া


 ঈশাণ সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে । ওকে নিয়ে দীপক আর মিলির সুখের সংসার। মিলি স্কুলে পড়ায়, রায়চৌধুরী বাড়ির প্রথম চাকুরিরতা বধূ ।  ছিপছিপে, লম্বা, প্রকৃত গৌরবর্ণা। দিব্যি শ্বশুর শাশুড়ী  নিয়ে সংসার করছে।  আত্মীয় স্বজনের চোখে আদর্শ পুত্রবধূ । 
 কিন্তু  এই গণ্ডী ছাড়ালেই, না না গুজব শোনা যায়।  বন্ধু বান্ধবই বলুন বা সহকর্মী সবাই  দুদলে বিভক্ত । একদল মিলির কৃপাপ্রার্থী।  বা সোজা কথায় প্রণয়প্রার্থী। অপর পক্ষ  অবশ্যম্ভাবী তারা যাদের প্রতি মিলি আর সদয় নয়, বা কখনও সদয় ছিল না। এ পক্ষে মহিলাদের সংখ্যা একটু বেশিই। মিলি অবশ্য তার কোন প্রণয়প্রার্থীকে চট করে অবহেলা করে না। মেলামেশা, ফেসবুক, হোয়াট্স্ অ্যাপ, কফিশপ্, উপহার গ্রহন করে কৃতার্থ করে দেয়।  তবে ঐ টুকুই।  শরীরগন্ধী প্রেমালাপ চলতেই পারে,তবে বন্ধ দরজার ওপারে যাবার মত সৌভাগ্য কারোরই হয়নি। শুধু স্কুলের সুতপার দাদার বন্ধুর,  বন্ধুর বন্ধু নাকি এই বিরল সুযোগ পেয়েছিল।  শোনা যায় সেই ভদ্রলোক  মিলি তে এতই মোহিত হয়েছিলেন,  যে নিজের স্ত্রীকে ছাড়তেও রাজি ছিলেন।  মিলি নাকি তার কাছে দীপককের নামে যাতা বলেছিল।  দীপক নাকি যৌনশীতল। দাঁড়ান মশাই, এ সব সুতপার অপপ্রচার হলেও হতে পারে।  সুতপাও ডাকসাইটে রূপসী। প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্যম্ভাবী। দীপক যৌনশীতল হলে ঈশাণ জন্মাল কি করে? এত লম্বা চওড়া সুদর্শন  পুরুষ। মানছি একটু ভুঁড়িদাস । কিন্তু ওটা আভিজাত্যের চিহ্ন। রাণাঘাটের বিখ্যাত রায়চৌধুরী বাড়ির রক্ত আছে মশাই।  সত্যি কথাটা হল মিলির হিংসুটে  মহিলা সহকর্মীনীরা দীপককে নপুংসক, লোচ্চা ইত্যাদি ভেবে এবং আলোচনা করে ধর্ষকাম আনন্দ পায়। দীপকটা কি? বউ এর বহুগামিতা কি আন্দাজ করতেও পারে না।  কিন্তু মুস্কিল হল, দীপক ঠিক কি তা জানা ঐ মফঃস্বলের শিক্ষিকাদের পক্ষে সহজ না।  দীপক সেক্টর ফাইভের নামকরা আধা বিদেশী কোম্পানির  দামী ইঞ্ছিনিয়ার।

 দীপককে কি মিলিও বোঝে? পনেরো বছরের বিবাহিত জীবন এক কথায় “পিকচার পারফেক্ট”। দীপকের বাবা মা অনেক দেখে শুনে মিলিকে পুত্রবধু করে এনেছিলেন।  ওঁনারা কখনই চাননি বাড়ির বউ উপার্জন করতে বেরোক।  প্রয়োজনটাই বা কি?  কিন্তু দীপক চেয়েছিল।  শুধু মৌখিকভাবে চাওয়া  নয়, নিরন্তর  অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।  চাকরির পরীক্ষাই হোক বা ইন্টারভিউ, মিলির সঙ্গ দিয়েছে।  হ্যাঁ  কাব্যিক প্রেম ওদের মধ্যে কখনই ছিল না।  বন্ধুত্বের বন্ধন এত দ্রুত এত প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল যে বেচারা প্রেম অনুপ্রবেশ করার সুযোগই পায়নি।
 দীপক মিলির সব গূঢ় রহস্য জানে। মিলি নিজেই বলে। দীপক মনোযোগী শ্রোতা।  দীর্ঘদিন কোন প্রেমিকের নাম না শুনতে পেলে, দীপক খোঁচায়, “ কি হল মিলি? ঐ বেচারা  কবে কৃপাধন্য হবে?”
একবারই এক প্রেমিকের  সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা বাদ দিলে, শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মিলি বেশ রক্ষণশীল । যদিও দীপক বারবার বলে ,“দেহ বিবর্জিত পরকীয়া প্রেম হল কাঁঠালের আমসত্ত্ব।  কোন গাধা বিনা প্রলোভনে তোমার নকরা সইবে?”

          শুরুতে  মিলি বিশ্বাস করত না।  এই গদগদ প্রেম , সীমাহীন মুগ্ধতা , স্তাবকতা  এসব কি শুধুই এই দেহের জন্য। কিন্তু জীবন বড় নির্দয় । ঠেকে শিখেছে মিলি, মুখে যতই স্বপ্নিল প্রেমের বুলি থাকুক না কেন, পরকীয়াচ্ছুক পুরুষদের প্রকৃত উৎসাহ কেবল মাত্র শরীরকে ঘিরে। মিলির আপাত রক্ষণশীল মনোভাব, তাদের পর্যায়ক্রমে হতাশ, ক্ষুব্ধ  এবং বিরক্ত করে তোলে। আবেদন নিবেদন বিফল হলে পালিয়ে বাঁচে। নামমাত্র কারণ দেখিয়ে সম্পর্কচ্ছেদ  করে।  প্রথম পরকীয়ার বেলায় মিলি মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত  হয়ে পড়েছিল যে নাকখৎ দিয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছিল।  তার মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য সব ইনহিবিশন ত্যাগ ওরা বন্ধ দরজার ওপারে মিলিতও হয়, ব্যাপারটা আদপে অনুপভোগ্য ছিল না, কিন্তু চরম ব্যাপারটিতে মিলি রাজী হতে পারেনি।  ওর উপরোধে লোকটি যে ওকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল, সে কৃতজ্ঞতা মিলি আজও ভোলেনি। অতঃপর মামুলী চুম্বন আর সেক্সটিং অবধি মিলির দৌড়।
সেই ঘটনার পর চূড়ান্ত অপরাধ বোধে মিলি দীপককে সব খুলে বলতে গিয়েছিল, দীপক কর্ণপাত করেনি। উল্টে আলিঙ্গন করে বলেছিল, “ বয়স হয়ে যাচ্ছে মিলি।  এ সুযোগ বেশিদিন আর পাবে না। আগেই বলেছি আমার কিচ্ছু যায় আসে না। বাট্ প্লিজ্ ইউজ আ কনড্ম ।  কার কি অসুখ আছে ---” ।
এহেন দীপক আর মিলির শান্ত, সুখী গৃহকোণে যে তুফান উঠেছে তার জন্য দায়ী শুধু একজন, তাঁর নাম মার্ক জুকারবার্গ। না উনি এই “আনন বই” রচনা করতেন, না কাতারে কাতারে বুভুক্ষু নরনারীর  দল এতে ভিড় জমাতো।  ওসব আলো না আঁধার কার্ড ছাড়ুন মশাই , আপাতত ফেসবুকই আমাদের সামাজিক পরিচয় পত্র ।  আপনি এফ বি তে অনুপস্থিত? সেকি মশাই ? “ ভূতের ভবিষ্যৎ ” এ ভূতেরাও অবধি তাদের সোশাল নেটওয়ার্ক “স্পুকবুক ” এ অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছিল, আর আপনি কি তালেবর মশাই ? যান, বরং ভীমবেটকার গুহায় গিয়ে থাকুন ।

দীপক কিছুতেই এই তথাকথিত লেজকাটা শেয়ালদের দলে নাম লেখাবে না, মিলিও নাছোরবান্দা। আরেঃ এটা হল, যাকে  বলে “ম্যাটার অব সোশাল স্টেটাস্। ” মিলির বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন, সহকর্মী , সহযাত্রী ছাড়ুন পুঁচকে  ঈশান এবং তার বন্ধুরা পর্যন্ত আছে এফ বি তে, নেই শুধু দীপক। সবাই মিলিকেই তো প্রশ্ন করে। কেউ কেউ ঠারেঠোরে একথাও বলেছে যে, মিলির এই ফেসবুক প্রেম সহ্য করতে পারে না বলেই দীপক এই ভেড়ার  পালে নাম লেখাতে অনিচ্ছুক । কথাটা কানে আসা ইস্তক মিলি অগ্নিশর্মা । যত রকম প্রলোভন সম্ভব- ফ্রী গেমস্, উঠতি কবিদের টাটকা কবিতা থেকে সরিতা ভাবীদের ঠসক্ সব ব্যর্থ ।  মিলি এও বলেছে যে ফেসবুকে ঢুকলেই দীপক তার হারিয়ে যাওয়া রাণাঘাট হাইস্কুল আর শিবপুর বিই কলেজের বন্ধুদের খুঁজে পাবে, তাতে আরো আতঙ্কিত দীপক । দীপক ভয়ানক অসামাজিক ।  শুনলে চমকিত হবেন কেবলমাত্র অমিয়া ছাড়া দীপকের আর একটিও বন্ধু নেই।
অমিয়া দীপকের সহকর্মী ।  প্রায় বিশ বছর আগে যাদবপুর থেকে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ এ বাছাই হয়ে অমিয়া ওদের অফিসে যোগ দেয়। ওর প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে দীপক ছিল অমিয়ার টিমলিডার। বন্ধুত্ব জমতে সময় লাগেনি।  সেই সম্পর্ক আজো টিকে আছে।  স্বভাবের দিক দিয়ে অমিয়া একেবারে দীপকের বিপরীত। দিলখোলা , সাহসী ঋজু ,স্পষ্টবাদী  অমিয়া যাকে বলে টমবয়। 
মিলি ছাড়া শুধু অমিয়ার কাছেই দীপক অকপট । বরং মাঝেমাঝেই মিলির মনে হয় দীপকের অন্তঃপুরে অমিয়ার প্রবেশ অবাধ হলেও মিলির নয়। কোথাও একটা অদৃশ্য ঘর আছে, যেখানে মিলি কখনই প্রবেশের অনুমতি পায় না। মিলি ঘরটাকে খোঁজার আপ্রাণ  চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এনিয়ে কিছু বলতে গেলে দীপক হেসেই উড়িয়ে  দেয়। মিলি অনুভব করে ঘরটা আছে।  মিলি এও জানে যে ঘরটার অস্তিত্ব সম্পর্কে অমিয়া অবহিত।  অমিয়া মিলিকে অসম্ভব স্নেহ করে।  মিলি জিজ্ঞাসা করলে মিথ্যা বলতে পারবে না। কিন্তু তাহলে দীপকের বিশ্বাসভঙ্গ  হবে, যা মিলি কখনই চায় না।  দীপকের একমাত্র  বন্ধু তথা বান্ধবী যদি দূরে সরে যায় বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে ওর দীপক।  তাই মিলি আর আজকাল এসব নিয়ে ভাবে না। আর তাছাড়া মিলিরও কিছু গোপন কথা আছে যা দীপক জানে না।  বিয়ের পূর্বে শান্তিপুরের মেয়ে মিলি সেনকে তার প্রথম প্রেমিক ত্যাগ করেছিল, গাঁইয়া বলে। আর লেডি ব্রেবোর্ণে পাঠরতা মিলিকে তার দ্বিতীয়  প্রেমিক ডাম্প করেছিল কারণ ও নাকি যথেষ্ট রূপসী ছিল না।  আমাদের মিলি রায়চৌধুরী, এই চল্লিশ বছর বয়সেও যার অগুনতি স্তাবক আর প্রণয়ী মাছির মত ভনভন করছে, সে নাকি যথেষ্ট রূপসী ছিল না! লক্ষ লক্ষ রূপের প্রশংসা শুনেছে মিলি, রোজই শোনে, একান দিয়ে শুনে, ঐ কান দিয়ে বার করে দেয়। কিন্তু  ঐ অপমাননা আজো কুড়ে খায় ওকে।  ভুলতে পারে না মিলি।

যাই হোক দীপকের কথায় ফিরে আসা যাক। মিলির অবাক লাগে দীপকের কেন আর একটাও বন্ধু নেই।  স্কুল কলেজের কারো সাথে নূন্যতম যোগাযোগটুকুও নেই ওর। অবশ্য রাণাঘাট হাইস্কুল  থেকে পাশ করে শিবপুর বিই কলেজ, মাঝে কিছুদিন বিদেশে কাটিয়ে গল্ফগ্রীনের ডুপ্লেক্স। ফলে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ না থাকার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। আশির দশকের অন্তে বা নব্বই এর শুরুতে যোগাযোগব্যবস্থার এই উন্নতি কষ্টকল্পনা ছিল মাত্র । যাই হোক অনর্গল দাম্পত্য  কলহে উত্যক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত দীপক অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। “ খুলে দাও।  তবে অপারেট করার মত বাজে সময় আমার  নেই।  তুমিই কোরো। ” এই ভাবেই শ্রী দীপক রায়চৌধুরীর ফেসবুকে পদার্পণ  । পরম যতনে এ্যাকাউন্ট খুলতে বসে মিলি, দীপকের স্কুল , কলেজ, ইয়ার অব্ পাশআউট সব সঠিক তথ্য দিয়ে।  কিন্তু প্রবল আপত্তি করে দীপক।  অবশেষে  কেবল নাম, ছবি আর জন্মদিন দিয়েই এ্যাকাউন্ট খোলা হয়।  প্রথম বন্ধু  যথারীতি মিলি এবং অমিয়া। ধীরে ধীরে বন্ধু সংখ্যা বাড়তে থাকে।  অধিকাংশই দীপকের সহকর্মী , মিলি বা দীপকের আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ।  রাতে দীপক বাড়ি ফিরে গা- হাত- পা ধুয়ে, ঈশাণের সঙ্গে সময় কাটিয়ে, বাবামার কুশল সংবাদ নিয়ে যখন এসি চালিয়ে বই নিয়ে বসে, তখন মিলি ওর ল্যাপটপে দীপকের অ্যাকাউন্টটা খোলে।  নতুন যারা বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, তাদের মধ্যে মিলির পরিচিত লোক গুলিকে ও বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নেয়, অচেনা হলে দীপককে জিজ্ঞাসা করে।  দীপক চিনলে ভাল, নইলে তৎক্ষণাৎ নাকচ ।  সেদিনও মিলি তাই করেছিল।  কিন্তু দীপক কোন উত্তর না দিয়ে কেমন বোবা ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।  বিরক্ত হয়ে মিলি গলার আওয়াজ তুলল,“ দীপক ? দীপ? কি করব?”
মহাশূন্য থেকে যেন ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল,“ কি করবে?”
 “ধুৎ এ্যাকসেপ্ট করব কি না? তোমাদেরই স্কুলের প্রাক্তণী? ইমন কি যেন? অ চৌধুরী।  চিনতে একে? ”
বিমর্ষ ভাবে মাথা নাড়ে দীপক ।  “তবে? ডিক্লাইন করি?”
“ নাঃ।  থাক।  পরে দেখছি।  হয়তো চিনতাম বা না। ” ক্লান্ত ভাবে সাড়া দেয় দীপক ।
“দীপক শেষে তুমি! ” মিলির আওয়াজ শুনে কেমন যেন আঁতকে উঠল দীপক। ধড়াম করে ল্যাপটপ বন্ধ করে পিছন ফিরে দেখে মিটিমিটি হাসছে মিলি, হাতে চায়ের ট্রে।  বিছানায় ট্রেটা নামিয়েই মিলি বলে উঠল,“তা কি দেখছিলে শুনি তন্ময় হয়ে?  সরো সরো দেখি। ” দীপককে ঠেলে সরিয়ে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে ডালা খোলে মিলি,“ হুঁ।  ইক্ শেষে ইমন চৌধুরী? আমি ভাবলাম সানি-” বলে চোখ টেপে মিলি।  দীপকের মুখ মৃতের মত অভিব্যক্তি শূন্য । খেয়াল না করে বকেই চলে মিলি। “ কি দারুণ দেখতে গো। এই বল না, এ তোমার সাথে পড়ত? ইয়ার অব পাশ আউট তো দেখছি একই। ” দীপক নিরুত্তর।  “ এই।  এ্যাকসেপ্ট করে নিতে দাও না প্লিজ্।  নাহলে আমি রিকোয়েস্ট পাঠাই কি করে?” আদুরে গলায় মিলির কথা  মাঝপথেই থেমে যায়।  দীপক অকস্মাৎ  ল্যাপটপের ডালা ঝপাৎ  করে বন্ধ করে বজ্র কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করে,“ও আমায় খুঁজে পেল কি করে? ”
 “কে?”
 “রোজ ৫/৬টা করে রাণাঘাটবাসী আমায় রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছে। সাথে সাথে গাদা গাদা মেসেজ। ”
ঘাবড়ে গিয়েও ওষ্ঠে হাসি  লেগে থাকে মিলির,“ এফ বি তে একটা রাণাঘাটবাসীদের কমিউনিটি আছে।  মাস খানেক আগে তোমাকে তার মেম্বার করে দি- ” কথা শেষ করতে না দিয়ে গর্জে ওঠে দীপক, “হাউ ডেয়ার ইউ! আমাকে না জিজ্ঞাসা করেই?” দীপক রায়চৌধুরীর আদুরে বউ এর চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। কোনমতে কান্না চেপে কিছু বলতে যায়, দীপক কর্ণপাত করে না।  মুখ লাল করে চিৎকার  করে ওঠে,“ ডিলিট ইট।  নাউ। ” মিলি হতবাক হয়ে যায়।  বিগত এক মাস ধরে বহু লোক দীপকের দিকে বন্ধুত্বের  হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তার মধ্যে রাণাঘাটের লোক কম নেই, তাহলে? কে এই ইমন, যার জন্য দীপক এত অশান্ত হয়ে পড়েছে।  কোনমতে মিলি বলে,“দীপ।  অনেক যত্নে তোমার এ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। ” “করবে?  না অমিয়াকে বলব?”
“ করছি” চোখের জল মুছে বলল মিলি।

মিলির ঔৎসুক্য বাড়তেই থাকে।  কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়? অমিয়া নিশ্চিত জানে না। ব্যারাকপুরের মেয়ে আর দীপকের সাথে কলকাতায় আলাপ। শ্বশুর শাশুড়ি অবশ্যই জানবেন।  তবে উগ্রচণ্ডা  শ্বশুরকে মিলি এড়িয়ে  যায়। ভীষণ কটুভাষী ভদ্রলোক। মিলিরা যখন বিদেশ থেকে ফিরে সবে এই ডুপ্লেতে থাকতে শুরু করে, উনি একবার সিকিউরিটিকে নির্দেশ দেন, কোন রাণাঘাটের লোক যদি ওণাদের খুঁজতে আসে, তাকে যেন তৎক্ষণাৎ অর্ধচন্দ্র  দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।  তখন খুব হাসি পেয়েছিল , আজ যেন ভাবতে বসলে কেমন অন্যরকম  লাগে মিলির।

 সময় মত শাশুড়ীকে পাকড়াও করল মিলি।  দীপকের মা সহজ সরল মাটির মানুষ, সদাহাস্যময়ী।  মিলি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, “মা রাণাঘাটের ওপর এদের এত রাগ কেন গো?” ভদ্রমহিলার  মুখ দেখে মিলি বুঝতে পারল উনি কিছুই জানেন না।  একটু দম নিয়ে মিলি আবার জিজ্ঞাসা করে, “মা, তুমি ইমনকে চেনো?”  অল্প চমকে উঠে তড়িঘড়ি মুখোশ পরতে সচেষ্ট হন ভদ্রমহিলা, “হ্যাঁ ।  ঐ আরকি ভাল চিনি না। বুবালের সাথে পড়ত। ” বুবাল অর্থাৎ দীপক।  অতিরিক্ত সরলতার জন্য এই মুখোশ পরার অপচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ  হয়।  যে ভদ্রমহিলা রোজ একটু করে অ্যালজাইমারের শিকার হয়ে চলেছেন,  মিলির নামটাও অর্ধেক সময় উনি ভুলে যান, তার ইমনের কথা মনে থাকার পিছনে নিশ্চিত কোন গূঢ় কারণ আছে।

রহস্য আছে এতো জানা গেল।  সমাধান হবে কি করে।  দীপক সেদিনের পর থেকে গুম মেরে আছে।  চরম উদাসীন সব ব্যাপারে ।  মিলি অনেক ভেবে ঠিক করল একবার অমিয়াকে জিজ্ঞাসা করে দেখা যেতে পারে।  কিন্তু দীপককে টপকে অমিয়ার নাগাল পাওয়া দুষ্কর । অচিরে সুযোগ পাওয়া গেল।  উপলক্ষ্য দীপকের জন্মদিন ।  বলাই বাহুল্য নিমন্ত্রিত শুধুই অমিয়া।  অমিয়া ক্যান্সার বিজয়িনী ফলে ঝালমশলা কিছুই খেতে পারে না।  তবে সেটা বীয়ারে পুষিয়ে  নেয়।  প্রতিবার এই বীয়ার খাওয়া নিয়ে দুজনের ঝগড়া হয়।  দীপক মাত্রা ছাড়াতে নিষেধ করে অমিয়ার স্বাস্থ্যের জন্য।  অমিয়া পাত্তা  তো দেয়ই না উল্টে খিস্তিখেউড় করে।  রেগে দীপক ঘর থেকে বেড়িয়ে  যায়।  অমিয়াও কিন্তু আর খায় না।  প্রতিবার এই নাটক দেখে মিলির পক্ষে হাসি চাপা কষ্টকর হয়।  এবার মিলি না হেসে সুযোগের সদ্ ব্যবহার করল।

“ইমনকে চেনো?” অমিয়াকে প্রস্তুত হবার সুযোগ না দিয়েই প্রশ্ন করে মিলি।

“কে? ” দৃশ্যত চমকে ওঠে অমিয়া।  পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে “হ্যাঁ ।  আমার এক পুরানো বন্ধু । ” আর থাকতে পারে না মিলি।  অমিয়ার হাঁটু জড়িয়ে ভেঙে পড়ে মিলি।  “ প্লিজ্  সত্যি কথাটা বল অমিয়াদি। প্লিজ্। প্লিজ্। প্লিজ্”
“ আমি মিথ্যা বলি না, মিলি।  তুই জানিস। ” ওকে  সামলাতে সামলাতে বলে অমিয়া। 
“ দীপকের সাথে তার কি সম্পর্ক ।  ”
 “ সেটা দীপককে জিজ্ঞাসা কর। ”
 “ ইমন যেদিন থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, ও যেন কেমন বদলে গেছে।  কথাবার্তা ছাড়, তাকিয়ে দেখে না পর্যন্ত । ” কাঁদতে কাঁদতে বলে মিলি। “   স্ত্রী হিসাবে এটুকু জানার অধিকার ও কি আমার নেই?”
“   কিছু জিনিস না জানাই ভাল মিলি।  পুরানো কাসুন্দি । ” দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে  বলে অমিয়া। “ তবে হ্যাঁ , তোর জানা উচিৎ। ”
দীপক ঘরে ঢুকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অমিয়া শান্ত স্বরে বলে! “ দীপক । ও জানতে চায়। ” একটু দম নিয়ে বলে’“ ইমনের কথা। ”
দীপক ফিসফিস  করে শুধু বলে ,“অমিয়া। ”
         
অমিয়া চলে গেছে।  গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। মিলি আলুথালু হয়ে  মাটিতেই বসে আছে।  দীপক খাটে বসে।  আলো জ্বলছে।  ,“ মিলি” আস্তে ডেকে ওঠে দীপক।   মিলি তাকায় না।  “তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই শিরোধার্য। শুধু মাঝেসাঝে ঈশাণকে দেখার অনুমতি যদি দাও। ” গলা ধরে এল দীপকের।
মিলি জ্বলে উঠল।  “ শুধু ঈশাণ? আর আমি? ”
“ এই ডুপ্লেটা তোমার নামেই কেনা। আর যা তুমি বলবে। ”
“ এত বছরের ভালবাসা?” মিলি চোখের জল আটকাতে পারল না।
“ ভালো কি আমি বাসিনি?” এবার দীপকের গলা ধরে আসে। “ইমন আমার প্রথম প্রেম।  একমাত্র প্রেম। কিন্তু তুমি  আমার অভ্যাস । ”
“অভ্যাস ? সকাল বেলায় প্রাতকৃত্য করার মত?” মিলি রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে। 
দীপক হাসে না,“ হ্যাঁ ।  বা দাঁত ব্রাশ করা। ”
“ হরিবল্।  রোমান্টিক কথা বলার চেষ্টা ও কর না।  ইমনকে ছাড়লে কেন?”
“ বাবার জন্য।  সমকামী ছেলের বাবা হবার থেকে আত্মহত্যা করা শ্রেয় । প্রথম দিকে ফাঁকা বুলি মনে হয়েছিল। দৈনন্দিন অশান্তি এড়াতে ইমনকে নিয়ে জোহান্সবার্গ চলে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম।  সেই মত ট্রান্সফার করালাম নিজেকে।  ”
“কিন্তু জোহান্সবার্গ তো আমায় নিয়ে গিয়েছিলে বিয়ের পর। ” আর্তনাদ করে উঠল মিলি। 
বিষণ্ণ ভাবে মাথা নাড়ে। “বিয়ের আর  মাত্র দিন পনেরো বাকি। ইমন আমার কথায় পার্টটাইম পড়ানোর চাকরিতে ইস্তফা দেবে সব ঠিকঠাক্ । মাকে  জানালাম।  আশিস্ দিল মা।  কিন্তু কথাটা কি ভাবে হিটলারের  গোচরে এল জানি না।  হয়তো ভয় দেখিয়ে মার মুখ থেকেই--। তিরিশটা ঘুমের ট্যাবলেট আমার সামনে ফেলে হুমকি   দিল গান্ডু ছেলের বাবা মার বেঁচে  থেকে লাভ কি? তাই আমি বেড়িয়ে পড়লেই মায়ের গলার নলি কেটে ঐ ওষুধ খেয়ে বাবাও”। 
“ সস্তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং। ” তীব্র ঘৃণায় চিৎকার করে ওঠে মিলি। “ চলে গিয়ে দেখতে পারতে, আত্মহত্যা করার সাহস ঐ বুড়োর নেই। ”
“ রিস্ক নিতে পারিনি।  মায়ের---”
“হুঁ।  মায়ের দুলাল। তারপর?”
“ ইমনকে কোন খবর দিতে পারিনি।  এই অপরাধবোধ আমায় কুরে খেয়েছে এত বছর।  আই ডাম্পড্ হিম।  আমার ছোট্টবেলার বন্ধু- প্রথম প্রেম । আর তোমার সাথেও কি প্রতারণা নয়?”।

আঁতকে উঠল দীপক।  মিলি গরম চায়ের কাপে ঘুমন্ত  দীপকের আঙুল ডুবিয়ে দিয়েছে।
 “স্যরি।  এত ডাকছি উঠছ না” হাসতে হাসতে  বলল মিলি।  বেশ বেলা হয়েছে।  শরতের সোনালি রোদ ঘরময় আঁকিবুকি  কাটছে। হতভম্ব  দীপক হঠাৎ করুণ স্বরে বলে ওঠে,“ মিলি তুমি কি থেকে যেতে পার না?”
 “ সি এল নেই বেশি। ”
“ না মানে” দীপকের চোখ ছলছল  করে ওঠে।  মিলি সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। “ স্কুল যাচ্ছি।  ফিরে এসে সব শুনব। ”চলে যেতে গিয়ে ও থমকে দাঁড়ায় মিলি,“ প্রতিটা অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তুমি কি ইমনের কথা ভাবতে? নাকি আলাদা আলাদা লোকের কথা?”

দীপক সলজ্জ ভাবে মাথা নামায়। যেতে যেতে মিলি শুধু বলে,“ শালা পরকীয়া সবাই করে।  দোষ হয় কেবল মিলির। ”
image courtesy- google

Monday 3 August 2015

শ্রমিক আমি (পর্ব-৩)


২০০৯ এর ডিসেম্বর। আমি তখন এ এল সি খড়্গপুর। ডি এল সি ছিলেন শ্রী শৈবাল বিশ্বাস । মেদিনীপুর অফিস তখনও তৈরি হয়নি। ১৫টি ব্লক আর ২টি মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ মাত্র ৪ জন ইন্সপেক্টর। প্রত্যেকেরই আয়ু কয়েক মাস মাত্র। যুবা ইন্সপেক্টর বা কম্প্যুটর জানা ক্লার্ক তখন কল্পনারও অতীত । মাসে মাত্র দশ দিনের গাড়ি। ফলে অনেক হিসাব করে চলতে হত।
খড়্গপুর আই আই টি তখন ঠিকা শ্রমিক অসন্তোষে জর্জরিত । প্রায়ই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকতে হত এস ডি ও সাহেবের চেম্বারে। যদিও এটা আমাদের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিল না, কিন্তু বারংবার অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারী লেবার এনফোর্সমেন্ট অফিসারের দেখা পাওয়া যেত না। তখন এস ডি ও ছিলেন শ্রী অরিন্দম দত্ত মহাশয়। ওনার প্রবল ব্যক্তিত্বের ভয়ে শুধু হাতাহাতি টুকু হত না।
সেদিনের মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ৬টা। শৌভিক তখন বিডিও খড়্গপুর-২। খড়্গপুরের মাত্র দুটো স্টেশন পর মাদপুর নামক গ্রামে আমাদের লালনীল সংসার । আমার ফিরতে দেরী হলে প্রায় দিনই ও ছুঁতোনাতা করে এস ডিও অফিসে এসে হাজির হত। দুর্ভাগ্যবশত সে দিন কি কাজে আটকে গিয়েছিল, ফলে ট্রেন ছাড়া গতি ছিল না। খড়্গপুর এস ডি ও অফিস থেকে রেল স্টেশন হেঁটে আড়াই মিনিট । ৫টা৪৫ এ একটা টাটা লোকাল ছিল, যে কখনই সময়ে আসত না। ফলে আশা ছিল পেয়েই যাব। স্টেশনে পৌছে দেখি থিকথিক করছে লোক। বহু ট্রেন বাতিল। তখন জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কিশনজী। যৌথ বাহিনী তখনও সক্রিয় নয়। ট্রেন বাতিল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমার টাটা প্যাসেঞ্জার ও বাতিল।
শৌভিক বলল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর জন্ম হতে তখনও মাস ছয় সাত বাকি। কিন্তু প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত। এমনি আক্রমণ সামলাতে না পেরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে। তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করলাম। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। ভালোই হল। ও ফিরে গেল। আমাকে জানিয়ে দিল স্টেশনে গাড়ি থাকবে। স্টেশন থেকে আমাদের কোয়ার্টর হেটে গেলে চার মিনিট। তবে ফাঁকা মাঠ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। তাতে আমার আপত্তি না থাকলেও শৌভিকের ড্রাইভার শৈবালদার চূড়ান্ত আপত্তি ছিল।
ট্রেন ছাড়লো। বেশ ভিড়। কোন মতে এক টুকরো সিট্ পেলাম। শীতের ভয়ে জানলা বন্ধ। বাইরেও ঘুট্ঘুটে অন্ধকার । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামল। আন্দাজ করলাম জকপুর। পরের স্টেশনে নামব। আর মিনিট পাঁচ মাত্র। দরজার কাছে এগিয়ে যাব বলে উঠে পড়লাম। আমার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়কে ইঙ্গিত করলাম বসতে, উনি সৌজন্যবশতঃ রাজি হলেন না। বলতে বাধ্য হলাম, যে আমার গন্তব্য মাদপুর । বলা মাত্র কামরায় যেন বাজ পড়ল। “ মাদপুর? এটাতো মাদপুর যায় না। ” বলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন একাধিক ব্যক্তি ।
“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।
ট্রেন তখনও ছাড়েনি। দৌড়ে নামতে গেলাম, পারলাম না। জায়গাটার নাম নিমপুরা। রাতের নিমপুরা কয়লা মাফিয়াদের বিচরণভূমি। একলা মহিলা সহযাত্রীকে সেখানে কেউ নামতে দিতে রাজি না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম, আমারও সাহস হল না। কোন প্লাটফর্মের বালাই নেই। অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মালগাড়ি শবদেহের মত নিশ্চুপ পড়ে আছে। অগত্যা সহযাত্রীদের উপদেশ শিরোধার্য।
হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই তেনাদের দয়া।
শৌভিককে ফোন করব কি, টাওয়ার শূন্য । কোনমতে কান্না সংবরণ করলাম। সৌভাগ্যবশত কলাইকুন্ডা আসার আগেই টাওয়ার পেলাম। রিং হতেই, শৌভিকের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর,“কোথায়? শৈবালদা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছে ট্রেন ক্যানসেল। আমরা তোকে আনতে খড়্গপুর যাচ্ছি। ” ঐ মুহূর্তে ঐ কন্ঠস্বর শুনে আবেগে গলা বুজে আসল। কোনমতে সব বললাম। শুনে বলল,“সর্বনাশ । কলাইকুন্ডায় নেমে, নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেশনমাষ্টারের ঘরে বস। আমি আসছি। ”
কলাইকুন্ডায় পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় এলাম? এটা কি চক্রাকারে ঘুরে আবার নিমপুরায় ফিরে এল? সেই অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মৃতমালগাড়ি । প্লাটফর্ম বা স্টেশনমাষ্টারের ঘর কই? ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাকিরা নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু সেই মহিলা যাননি। অধৈর্য হয়ে বললেন, “নামো। ট্রেন ছেড়ে দেবে যে। ” নামতে গিয়ে দেখি, সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকটা লাফাতে হবে। লাফিয়ে নামলাম। দুটি ট্রেনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেই। ভদ্রমহিলাকে অনুনয় করে বললাম, “যদি দয়া করে একটু স্টেশনমাষ্টারের ঘরটা দেখিয়ে দেন। ” উনি পাত্তা দিলেন না। বললেন ,“ ওখানে যেতে হবে নি। আমার সাথে এস। কে আসছে? বর? বল কলাইকুন্ডা বাজারে আসতে। হাইরোডের ওপর। আসতে সুবিধা হবে। ”
ফোন মৃত। টাওয়ার নেই। নিরুপায় হয়ে ওনাকে অনুসরন করতে থাকলাম। তেলের ট্যাঙ্কারের তলা দিয়ে কোনমতে গলে এপারে এসে দেখি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় চরাচর । অন্ধের মত মহিলাকে অনুসরণ করছি। উনি নানা প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন। আমি কি করি। বাপের বাড়ি কোথায়। বর কি করে। বর কিসে আনতে আসছে ইত্যাদি। মেপে উত্তর দিচ্ছি। বললাম শ্রম দপ্তরে কাজ করি। বর মাদপুর বিডিও অফিসে মালপত্র সরবরাহ করে। বিডিও সাহেব খুব ভাল। ওনার গাড়িটা দিয়েছেন নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরূপায় । প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পঞ্চায়েত্ প্রধানের গলাকাটা মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একজন শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীও থাকত মৃত্যুমিছিলে।
বেশ কিছুটা হেটে হাইরোডে পরলাম। অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাশে । কয়েকটা ফাঁকা চালা দেখে বুঝতে পারলাম বাজারে এসেছি। জনমানবশূন্য বাজারের কঙ্কাল । শুধু একটা মিষ্টির দোকানে একটা জিরো ওয়াট আলো জ্বলছে। দোকান ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। মহিলা একটা বন্ধ দোকানে টোকা মারতে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে এক বছর ২৩/২৪ এর ছেলের মুখ দেখা গেল। মহিলার নির্দেশে সে চেন দিয়ে বাঁধা একটা ল্যান্ডফোন এগিয়ে দিল। শৌভিক ফোনে মৃদু ধমকাল, ওর কথা না শুনে স্টেশন ছেড়ে এসেছি বলে। ফোন রেখে মিষ্টির দোকানের মচমচে বেঞ্চে এসে বসলাম। শৌভিক মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌছে যাবে। আশ্বস্ত হয়ে মহিলাকে অনুরোধ করলাম বাড়ি যাবার জন্য। উনি কর্ণপাত করলেন না। নানা প্রশ্ন করছেন। আমাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মাপছেন। আমি শুধু জানতে পারলাম ওনার নাম পার্বতী মাহাতো। এসি ডিসি এলে চাকরি করেন। নামেই হাইরোড। এতক্ষণ বসে রইলাম, বাস, ট্রেকার ছাড়ুন একটা মোটরবাইক, সাইকেল ও চোখে পড়ল না। মিনিট পনেরো পরে দূরে একজোড়া হেডলাইট দেখা গেল। উন্মত্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম মাঝরাস্তায়। হ্যাঁ । শৌভিকের গাড়িই বটে। মহিলাও দৌড়ে এলেন। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন শৈবাল দা। দরজা খুলে সরে বসল শৌভিক। লাফিয়ে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলাম। জানলা দিয়ে হাত নাড়লাম পার্বতীদির দিকে। ইশারায় শৌভিককে দেখিয়ে বললাম “আমার বর”। উনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। রকেটের বেগে উল্টোদিকে দৌড়ল গাড়ি।
কোয়ার্টারে ফিরে আমার দুই বাবাকেই বললাম আমার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। সব শুনে আমার বাবার দৃঢ় ধারণা হল, ভদ্রমহিলা নির্ঘাত স্থানীয় মাওবাদী কমিটির মহিলা কমান্ডার। নিজের মতবাদের সমর্থনে বাবা জোর গলায় চ্যালেঞ্জ করেছিল, যে ঐ মহিলার দেওয়া সব তথ্য ভূয়ো। আমি ওনাকে কিছুতেই খুঁজে পাব না। আমি কিন্তু সত্যি খুজে পায়নি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, শুনতে ভূল করেছি— অথবা বাবাই ঠিক। কিছু রহস্য না সমাধান হওয়াই ভাল। কি বলেন?

Monday 13 July 2015

কণা ও তার মেয়েরা

 তানের কথা
একই সাথে কি একাধিক ব্যক্তিকে ভালোবাসা যায় ? বিশ্বস্ত থাকা যায় প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি? সমাজের রক্তচক্ষু বলে না, তবে জীবন কেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পাঠ দেয়?
কোনমতে স্নাতক হয়েই মাকে জানিয়ে দিলাম, আর নয়।  এবার বাবার নির্ধারিত পাত্রকে বিয়ে করে সুখে ঘরকন্যা করতে চাই। মা করুণ স্বরে বলেছিল,“যারা এই বিপদের দিনে একটা ফোন করেও খবর নেয় না, তারা সেই শৈশবের প্রতিশ্রুতি রাখবে বলে তোর বিশ্বাস হয়?”
আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার  করে তবু  গিয়েছিল মা।  মুখ অন্ধকার করে বাড়ি  ফিরেছিল। তবু বিশ্বাস হয়নি, জয়ন্তকে অফিসে ফোন করেছিলাম।  না করলেই ভালো হত।
 মা দমেনি।  অল্প দিনের মধ্যেই সাধ্যাতীত ধুমধাম সহ রাজীবের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।  জয়ন্তদের তুলনায়  এরা নিতান্তই মধ্যবিত্ত।
বিয়ের  পরই বুঝতে  পারলাম,চরম ভুল করেছি। অন্য কারো সাথে দাম্পত্য  সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব। সব কথা খুলে বললাম রাজীবকে। ও ধৈর্য্য  ধরে সব কথা শুনত। কখনও অহেতুক ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেনি। বারবার  বলত ভুলে যেতে, এমন তো কতই হয়।  সময় সব ক্ষত নির্মূল  করে দেয়।
বিয়ের ঠিক তিন মাস পরে ফিরে এলাম মায়ের কাছে। রাজীব এসেছিল ফিরিয়ে নিয়ে যেতে,যায়নি। করজোড়ে অনুরোধ   করেছি ফিরে যেতে।  শুধু  এই ভেবে চূড়ান্ত  কষ্ট পেয়েছি যে আমার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য এই নিটোল ভালো ছেলেটার গায়ে, “নামমাত্র  বিবাহে ডিভোর্সি ” ছাপ পড়ে গেল।

 বুঝতে   পারলাম আবার  ভুল করেছি। আগে একটা ব্যথা  ছিল,সংখ্যা বাড়ল শুধু।
বিচ্ছেদ হবার পরও ফোন করতাম, রাজীব ভদ্র ভাবেই কথা বলত, খবরাখবর  নিত।  একদিন বলল ওর বন্ধুরা একটি মেয়ের সাথে ব্লাইন্ড ডেটের ব্যবস্থা করেছে। ফোনে প্রচুর উচ্ছাস প্রকাশ করলাম। ফোন রেখে গুম হয়ে গেলাম।
সপ্তাহখানেক পরে, একদিন ফোন করেছি, রাজীব আড়ষ্ঠ হয়ে বলল,“ ব্যস্ত আছি। একটু পরে ফোন করি? ” পরে শুনলাম, সেই মেয়েটির সাথে ছিল, শুভেচ্ছা  জানিয়ে  ফোন রেখেদিলাম। আর কখনও কথা হয়নি।

রাজীবের খবরটা শুনে মা অসম্ভব  খুশি হয়েছিল।  বলল,“ যাক বাবা  এত ভালো ছেলেটার যেন ভালই হয়। এবার তুইও কিছু ভাব। ”
 কি ভাবি? আজ বহুদিন বাদে আয়নার   সামনে এসে  দাঁড়ালাম।  ঈশ্!!কি চেহারা হয়েছে আমার।  কান্না চেপে সরে এলাম। দাদু বলতো তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তার ওপর পুরু কালির ছোপ । সেই কোমর ছাপানো চুল প্রায় সবই উঠে গেছে অযত্ন আর অবহেলায়।  চর্বির পাহাড়, অত শখের   কোন জামাই আর গলে না।
বড় অবিচার করেছি নিজের প্রতি। ঠিক করলাম কাল থেকে ডায়েটিং করতেই হবে।  শুধু স্যালাড খেয়ে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই আগের মত হয়ে যাব।
মা শুনে  খুব বকাবকি  করল, কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।  এই সময় আর একটা কুৎসিত নেশা আমায় পেয়ে বসল, গুটকার নেশা। পাশের ফ্লাটের কাকিমা খায়, মাঝে মাঝে ওনার থেেক চেয়ে   খেতাম, শেষে মায়ের অগোচরে রান্নার মাসিকে দিয়ে আনাতাম।  মা জানতে পারলে কান্নাকাটি  করত, কিন্তু নিজেকে সংশোধন করা আমার সাধ্যাতীত।
 আজকাল খুব দুর্বল লাগে।  হাঁফ ধরে।  মাকে বলিনি, মা আজকাল  বড় ব্যস্ত থাকে, ফাংশান আর মিউজিক স্কুল নিয়ে।
গান কলেজে পড়ায়।  মা চায় আমিও কিছু করি।  পরিচিত  কয়েকজনকে বলেও রেখেছে, কিন্তু  আমি চাইনা।
মায়ের সাথে আজ খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেল এই নিয়ে।
 মন খারাপ   করে আয়নার  সামনে এসে দাঁড়ালাম, হঠাৎ  দেখি বাবা।  হ্যাঁ  বাবাই তো।  শেষ  বয়সের পক্ককেশ, ক্লান্ত , পরাজিত, নুব্জ বাবা  নয়। ছোটো  বেলার ঋজু  যুবক বাবা।  এক মাথা কালো চুল , চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা , দুধ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, যে ছবিটায় রোজ মালা দেয় মা, সেই বাবা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।  হাউহাউ  করে কাঁদছি, “ বাবা আর চলে যেও না, আমাদের  ছেড়ে। কেউ কথা রাখেনি বাবা।  তোমার মত কেউ ভালোবাসেনি——”  

কণার কথা
রান্নাঘরে   ছিলাম, হঠাৎ ধড়াম করে বিকট আওয়াজ , দৌড়ে এসে দেখি তান মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে, সম্ভবত জ্ঞান হীন।  এত ভারি চেহারা আমি একা সোজা করতেও পারছি না। জীবনে এত অসহায় কখনও বোধ হয়নি।  ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুয়েেছ— কি করি?কাকে ডাকি?আমাদের মা-মেয়ের তো আর কেউ নেই।  দাদারা ষাটোর্ধ, বেশ দূরে থাকে,আর আশুতোষের দিকে তো সব পাট বহুদিন চুকে গেছে। অঝোরে  কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেলাম ল্যান্ডফোনটার কাছে—

 গানের   কথা
কি আরামে  ঘুমোচ্ছিলাম, বাইরের রোয়াকে  পৌষ মাসের নরম রোদে, কাঁথা মুড়ি দিেয়। পাশ থেকে   মা যে  কখন নিঃসাড়ে চলে গেছে জানতেই পারিনি।  কেউই  দেখেনি মাকে চলে যেতে।  বাবা  গান  শেখাতে বেড়িয়েছিল আর পিসি কলেজে।  ঠাকুমা প্রথমে বড়লোকের কাণ্ডজ্ঞানহীন  মেয়ের খুকিপণা ভেবে বিশেষ পাত্তা  দেয়নি।  বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়ে সন্ধ্যা  নামার সাথে সাথেই চড়ছিল উদ্বেগের পারদ। রাত দশটা নাগাদ  ক্লান্ত শরীরে বাবা বাড়ি ঢুকতেই ঠাকুমা উপুড়  করে দিয়েছিল অভিযোগের  ঝুড়ি ।
 সব শুনে দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য  হয়ে বাবা দৌড়ে ছিল মায়ের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে ।  মামার বাড়ির গলির মুুখে বাবার পথ আটকে ছিল ছোটো মামা ।  দিদিমার নির্দেশে বাবার জন্য সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা  করছিল।  ছোটো মামা করজোড়ে বাবাকে অনুরোধ করে ফিরে যাবার জন্য।  মা নিরাপদেই আছে।  মাথা ঠান্ডা  হলে দিদিমা কথা দিয়েছে মাকে বুঝিয়ে  শুনিয়ে ফেরৎ পাঠাবে।
 আমার মাতামহের আসন্ন অপমানের হাত থেকে ‘জামাই মানুষকে’ বাঁচাতে দিদিমার এই মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে বাবা বুঝতে পারছিল না, হাসবে না কাঁদবে! জামাই? আমাদের এই মফঃস্বল শহরের অন্যতম অভিজাত দত্ত বাড়ির সুন্দরী মেয়ে যখন পালিয়ে তার গানের মাষ্টারকে কালিঘাটে বিয়ে করেছিল, সেদিন থেকেই সবাই  মায়ের সংস্রব  ত্যাগ করেছিল।  এমনকি আমার  জন্মের খবরপেয়েও কেউ দেখতে আসেনি, শুধু দিদিমা ছাড়া।  তাও লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে।
ছোটো  মামার কথা ফেলতে না পেরে বাবা মাথা নীচু করে ফিরে আসে।  বাবার মুখে সব শুনে, ঠাকুমা হিসহিসিয়ে বলেছিল , “ অ! পালিয়েছে।  তা এই পাপটাকে ফেলে গেল ক্যান্? যা দত্ত বাড়ির চৌকাটে ফেলে আয় এটাকে। ” এটা অর্থাৎ  আমার বয়স তখনও পাঁচ মাস হয়নি।
ঠাকুমার মুখে ঐ কুরুচিকর কথা শুনে তীব্র  ঘৃণায় কুঁচকে গিয়েছিল বাবার মুখ, শুধু বলেছিল “ছিঃ”!  আমি জানলাম কি করে? ঠাকুমা এই অসম্মান  কখনও ভোলেনি, নাই আমায় ভুলতে দিয়েছে।  সত্যি কথা বলতে কি, আমার  প্রতি কর্তব্যে ঠাকুমা-পিসি কোন খামতি  রাখেনি, তবে তাতে কখনই কোন স্নেহের স্পর্শ  ছিল না। বাবার অসাক্ষাতে ওরা আমাকে কালনাগিনীর বাচ্ছা  বলে সম্বোধন  করত, যদিও  তার তাৎপর্য  বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি।
আমাকে বলা হয়েছিল মা পড়তে   গেছে শান্তিনিকেতনে।  কথাটা মিথ্যে ছিল না।  দত্তমশাই অর্থাৎ  আমার মাতামহ সত্যিই সঙ্গীত শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে  ছিলেন।
আমি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতাম কবে মা আসবে।
 তখন আমার বছর  পাঁচেক বয়স, পাশের বাড়ি খেলতে গিয়ে ছিলাম, হঠাৎ  ঠাকুমার তীব্র আর্তনাদ শুনে দৌড়ে এসে দেখি, ঠাকুমা অত্যন্ত  অশ্লীল ভাবে মাটিতে বসে বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, আর পিসি  কর্কশ স্বরে কাউকে গালিবর্ষণ করে চলেছে।  বাবা উঠোনের এককোণে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে, আমাকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকতে দেখে যেন হুতাশনে ঘি পড়ল।  পিসি তেড়ে এসে বলে উঠল, “ছেনাল মাগী পাপটাকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে!”
আর কিছু বলার আগেই বাবা আমাকে কোলে তুলে ভোঁ দৌড়। সে দিন বাবা আমাকে গলির মুখে বলাই এর দোকানের মাখন পাউরুটি আর গরম ডিমভাজা খাইয়ে  গড়ের মাঠে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল।  প্রথম ট্রামে চাপা ও সে দিন।  ফাঁকা  ট্রামে সুযোগ বুঝে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে যাব, তার আগে বাবাই খবরটা দিল।  গতকাল  জনৈক বিরাট বড়লোকের সাথে মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ঐ বয়সে তার তাৎপর্য না বুঝলেও, জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা তোমার মনখারাপ? ” বাবা মৃদু হেসে  বলল,“ নাঃ।  বরং হাল্কা  লাগছে।  শুধু  কি অপরাধে ফাঁসির সাজা হল, সেটা যদি  জানতে পারতাম”।

বাবা ছাড়া আমাকে একজনই ভালোবাসত, আমার দিদিমা । ঠাকুমা প্রায়ই অনুযোগ করত, যে দরিদ্র ঠাকুমার থেকে  ধনী দিদিমাই আমার অধিক  প্রিয়, কথাটা আদপেই মিথ্যা  ছিল না।  শুধু  ধনী  অংশটুকু বাদে। দিদিমা কাঙালেরও অধম ছিল।  দিদিমার সবথেকে বড় অপরাধ ছিল, জন্মের  পর আমাকে দেখতে এসে নিজের গলার সোনার হার খুলে আশির্বাদ করে যাওয়া। হারটা ছিল ওণার স্বর্গীয় মা কুসুমকুমারী দেব্যার।  বলাইবাহুল্য, অভাবের তাড়নায় মাস তিনেকের মধ্যেই বাবাকে হারটা বেচতে হয়।  তখন মা নিজ হাতেই হারটা বাবার হাতে তুলে দিলেও , ফিরে গিয়ে কথাপ্রসঙ্গে  দত্তমশাইকে বলে বসে। ফলশ্রুতি?? দিদিমার হাত থেকে সংসার খরচের সব টাকা কেড়ে নেওয়া হয়।
তবে দিদিমাও ছিল অদমনীয়।  গয়লার সঙ্গে সাট করে কম দুধ নিয়ে তাতে জল মেশানো, বাজারের নির্ধারিত পয়সা থেকে  কিছু সরানো, সুযোগ পেলেই দাদুর  পকেটমারা ইত্যাদি যাবতীয় উঞ্ছবৃত্তি করে দিদিমা সারাবছর পয়সা জমাতো। শুধুমাত্র আমার জন্য।  আমার জন্মদিন আসলে কাঁপা হাতে লেখা ভুল বানানে ভরা একটি চিঠি আর আর রুমালে মোড়া পয়সাগুলো বাবাকে পাঠাতো একটা জামা কিনে দেবার জন্য। শুধু কি তাই? পাশের বাড়ির বেলি পিসির হাত দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কত কি যে পাঠাতো, নিজের ভাগের এক টুকরো  ইলিশ  মাছ, দুটো আম, চারটে ভাজা পিঠে, একটু পায়েস, দুটো দানাদার ইত্যাদি ইত্যাদি ।  পুজোয় কিছু  দিতে পারত না বলে নিজেও শাড়ি ভাঙত না আমার  দিদিমা ।
দিদিমার সাথে দেখা করাটা ছিল অভিসারের সামিল।  পূর্বনির্ধারিত দিন ক্ষণ অনুসারে মন্দিরের পিছনে দেখা হত আমাদের।  মায়ের খবর পেতাম।  দিদিমাই বলেছিল , আশুতোষ বাবুরা গুয়াহাটির অভিজাত বড়লোক।  একাধিক চা বাগানের মালিক ওঁরা।  বেতারে মায়ের গান শুনে উনি মুগ্ধ হন।  পরে কোন অনুষ্ঠানে মাকে দেখে উনি সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করলে আমার মাকেই করবেন।  সব খোঁজখবর নিয়েই উনি দত্তমশাই এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। উনি নাকি আমাকে ও দত্তক নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। সব শুনে বাবা বলেছিল, “লোকটা ভালো বলতে হবে। ”
তানের জন্মের  খবরটাও দিদিমাই আমায় দেয়। আমার তখন সাত।
তান হবার পর মা কিছুদিন মামার বাড়িতে ছিল।  আমি প্রায়শই  লুকিয়ে চুরিয়ে মামার বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর   করতাম, মাকে একঝলক দেখব বলে।  মাঝে মাঝে তানকে কোলে নিয়ে বারন্দায় এসে   দাঁড়াতো মা, ঝলমলিয়ে উঠত চারদিক ।  কি অসম্ভব রূপসী ছিল আমার মা। কাঁচা সোনার মত রঙ, কোমর ছাপানো লালচে ঢেউখেলান চুল, নিটোল গঠন, প্রতিমার মত মুখশ্রী — মন খারাপ হয়ে যেত। আমাদের  ঐ বাঙাল কলোনীর ছিটেবেড়ার ঘরে কি অসম্ভব বেমানান। তানও ছিল ততোধিক সুন্দর । খুব আদর করতে ইচ্ছে করত।আমরা তো সহোদরা ।

একদিন স্কুল থেকে  ফিরছি, দত্তমশাই তখন তানকে কাঁধে চড়িয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছে, আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “একে চিনিস? ” আগে  ভয় পেতাম, কেন জানি না সেদিন কোথা থেকে   এত সাহস পেলাম, চোখে চোখ রেখে কেটে  কেটে  বললাম, “কেন চিনব না? আমার  বোন তান। ” তানও কোল থেকে ঝুঁকে পড়ে আমার চুল টেনে, নাক খামচে, মুখ চেটে সমর্থন জানালো।  দত্তমশাই কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়ে, “ছিঃ দিদি।  নোংরা।   নোংরা। ” বলে তানকে টেনে   নিয়ে হনহনিয়ে পালালেন।  সেদিন রাত্রে বাবা আর আমি খুব হেসেছিলাম।

মামার বািড়র সদর দরজা  দিয়ে প্রবেশের অনুমতি  যখন পাই ততোদিনে আমি কলেজে উঠে গেছি।  দত্তমশাই এর মৃত্যুর পর দিদিমার জেদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় দত্তপরিবার।  অবশ্য আমাকে খোলা মনে কেউই মেনে নেয়নি।  দিদিমার অগোচরে প্রকাশ্যে তানের সাথে আমার তুলনা করা হত।  তান তখন ষষ্ট বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, মায়ের রঙ-রূপ আর আশুতোষ বাবুর উচ্চতা মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো রূপসী।  খুব নামি এবং দামি স্কুলে পড়ে, ফড়ফড় করে সাহেবী উচ্চারণে ইংরাজী বলে যার অধিকাংশই আমার মামা মাসীরা বোঝে না।  আশুতোষ বাবুর কোন ধনী বন্ধুপুত্রের সাথে তানের বাগদানও সম্পূর্ণ ।  তার পাশে আমি ? কিছুতেই ওরা বুঝতে   চাইত না, উচ্চমধ্যবিত্তের সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির হাবাগোবা মেয়ের তুলনা করাটা অসঙ্গত । আমার পিসি  যদি না বিয়ের  পরেও তার উপার্জনের সিংহভাগটাই আমাদের সংসারে ঢালত তাহলে আমরা আজও নিম্নবিত্তই থেকে যেতাম।
আমার পোশাক পরিচ্ছদ নিয়েও সমালোচনার অন্ত ছিল না।  কেন আমি শাড়ি পড়ি? তাও মঙ্গলা হাট থেকে কেনা সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি? কেন ম্যাচিং ব্লাউজ  না পড়ে লাল শাড়ির সাথে হলুদ ব্লাউজ  পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি । কি করে বোঝাই  যে দিদিমার অনুরোধে মাঝে মাঝে দত্ত বাড়িতে থেকে যেতে হত, বাড়িতে পরার জামা কাপড়গুলি তো আর ও বাড়িতে পড়া যায় না।  তাই টিউশনির পয়সায় হাট থেকে ঐ শাড়িগুলো কিনেছিলাম। শাড়ির ভিতরে যা পড়তাম তা সবি পুরানো তাপ্পি  মারা, তাই বাসি কাপড় কেচে লুকিয়ে   চিলেকোঠার ছাতে শুকোতে দিয়ে আসতাম। মেজ মামির ছিল সন্দেহ বাতিক, আমাকে অনুসরণ করতে গিয়ে উনিই প্রথম আবিষ্কার  করেন, আমার তালি মারা শায়া আর গিঁট  বাঁধা অন্তর্বাস । আমার জরাজীর্ণ পরিচ্ছদ গুলোই সবার চোখে আমায় খলনায়িকা থেকে  নায়িকা বানিয়ে দিল আর নতুন খলনায়িকা হল তান।

ওদের সময়টাও খুব ভালো যাচ্ছিল না।  দিদিমার মুখে ভাসা ভাসা শুনতে পেতাম সেই বৈভব আর নেই।  সম্পত্তিগত বিবাদের ফলে ওরা নিউআলিপুরের বিরাট বাড়ি ছেড়ে নাকতলায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেছে। টানাটানির  জন্য তানকে দামি স্কুল ছাড়িয়ে  মধ্যবিত্ত মানের নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে। আমি তখন এম এর ফাইনাল ইয়ার, তান মাধ্যমিকে অঙ্কে ফেল করল।  কি করে হল জানি না, ও প্রাক্তন স্কুলে বরাবর একশোয় একশো পেত। মামার বাড়িতে সেদিন অঘোষিত  উৎসব। কতখানি ঈর্ষা করত ওরা ভেবে বাবা আর আমি হতবাক হয়ে  গিয়েছিলাম।

আমার এম এ পাশ করার মাস ছয়েক পরই দিদিমা  মারা যায়। শেষ যে রাতটা আমরা একসাথে কাটিয়েছিলাম দিদিমা  আমায় খুব আদর করছিল।  বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছিল আর মাঝে আমার মাথা শুঁকছিল।  আমিও প্রাণভরে দিদিমার আঘ্রাণ নিচ্ছিলাম।  এককালে এই বিরাট খাটে দত্তমশাই মা আর দিদিমা শুত। আমি চোখ বন্ধ করে দিদিমার মধ্যে মাকে খুঁজছিলাম, জানি দিদিমা ও আমার মধ্যে মাকেই খুঁজছিল। সেই যে কবে মা আমাকে ফেলে চলে এসেছিল, তার পর থেকে ওদের সম্পর্ক কখনও স্বাভাবিক হয়নি।  হঠাৎ  দিদিমা জিজ্ঞাসা করল, “ হ্যাঁ রে তুই নাকি চাকরি করবি?” অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, “ হ্যাঁ ।  তোমাকে  তো অনেকবার  বলেিছ। ” দিদিমা বলল, “পাবি? সত্যি?” হাসলাম।  কিছুক্ষণ নীরব থেকে  দিদিমা বলল,“পেলে আমায় কিছু টাকা দিবি? ” দিতে আর পারলাম কই? সেটাও পৌষ মাস, নিউমোনিয়া কেড়ে নিল আমার দিদিমাকে। সাথে সাথেই মায়ের খবরাখবর  পাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল।

 চাকরি পেলাম।  বিয়ে ঠিক হল।  ভেবেছিলাম মা আসবে।  কিন্তু নিমন্ত্রিতদের তালিকায় মামার বাড়ি থাকলেও মা বাদ। বাবা বলেছিল, পিসি-ঠাকুমা তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেয়।  বিয়ের সব দায়িেত্ব পিসি একা।  বাবার তীব্র আপত্তি ছিল।  পিসি ফুৎকারে উড়িয়ে  বলেছিল ,“  বেশি বাপগিরি করতে আসিস না। ওর জন্মের পর থেকে আমি ওর বিেয়র জন্য পয়সা জমাচ্ছি। ” বিয়ের পর দিন যখন চলে আসব, সেই আমার পাঁচ বছর বয়সের দৃশ্য গুলির পুনরাভিনয় দেখলাম।  ঠাকুমা সেই একই ভাবে মাটিতে বসে ’দ্যাশের’ ভাষায় বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, পিসি শুষ্ক চোখে কর্কশ কন্ঠে বাবা আর ঠাকুমাকে ধমকাচ্ছে আর বাবা খালি খালি  ধুতির খুঁটে চোখ মুচছে। পিসি লাল চোখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখ আমার আদিখেত্যা আসে না।  তুই আমার প্রথম সন্তান । ” হেসে ফেললাম।  পিসির হাতটা ধরে বললাম, “বাবাকে—— ” সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরোনো পিসি ফিরে এল।  মুখ ঝামটা মেরে বলল, “এতদিন তোর বাপকে কে দেখল রে হারামজাদী। ”
মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমিই বাড়ি ছেড়ে এলাম।

সেদিন যখন ফোনটা এল, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুচ্ছে, নৈশভোজ সমাপ্ত করে তখনও আমরা এঁটো হাতে গল্প করছি।  আমিই ধরেছিলাম ফোনটা। হ্যালো বলাতে কোন প্রত্যুত্তর আসেনি, শুধু  মৃদু ফোঁপানোর শব্দ ছাড়া।  মুহূর্তমধ্যে ঐ ফোঁপানি সংক্রামিত  হল আমার মধ্যে।  বন্য হস্তীর মত আর্তনাদ করে হাউহাউ করে কাঁদছি।  সবাই ছুটে এসেছে।  সম্মিলিত প্রশ্নের মুখে আমি  শুধু  একটা কথাই বলতে পারলাম ,“মা কাঁদছে।  ”

কণার কথা—
মধ্য রাতের নিয়নজ্বলা কলকাতার রাস্তায় উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স।  একটা হাতে গানের হাত ধরে আছি, অন্য হাতে তানের।  আমার কাঁধে মাথা রেখে সমানে ফুঁপিয়ে  চলেছে গান।  তান নিথর।  হাসি হাসি মুখে যেন কোন সুখস্বপ্নে বিভোর।  আধো আলোছায়াতে চেনা দুষ্কর কোনটা কে।  যেন একজোড়া গান বা একজোড়া তান, নাকি দুটুকরো আমি ? একটা লড়াকু, বারংবার হেরেও হার না মানা  আর একটা অলস সংগ্রাম বিমুখ হেরে যাওয়া আমি।
গানকে যখন ছেড়ে এসেছিলাম তখন আমার কতই বা বয়েস।  বড় আশা নিয়ে বাসবকে বিয়ে করেছিলাম।  সঙ্গীতের মূর্ছনায় উচ্ছল হয়ে উঠবে জীবন।  বাবার নয়নমণি ছিলাম, সেই বাবা আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক  ত্যাগ করল।  কি অসম্ভব কষ্ট হত বাবার জন্য, লুকিয়ে কাঁদতাম।  বাবা বলেছিল “ ভুল করছ। এর মাসুল তোমাকেই গুনতে হবে। ” ভুল মানে? উফ্ সে কোন পৃথিবী।  বাসবের মা- বোন আমাকে সহ্য করতেই পারত না।  বিবিহযোগ্যা বোন থাকতেও বাসব কি করে আগে বিয়ে করল? নির্ঘাত আমরা তুক্ করেছি, এইরুপ নিম্নরুচির আলোচনা হত, আমাকে শুনিয়ে।  একটা মাত্র ঘর, তাতে একটা তক্তোপোশ। ওপরে শুতাম আমরা, মাটিতে জটিলা কুটিলা।  বাসবের সাথে দেখা হত দিনান্তে। দুটো কথা বলারও অবকাশ ছিল না। প্রেমালাপ দূরে থাক,  রাতে দুটো ফিস্  ফিস চরে কথা বললেও ধমক খেতে হত।
আজ ও মনে আছে, সেদিন ভীষণ মনখারাপ ছিল বাবার জন্য, ভাবলাম একবার দেখেই চলে আসব। গানকে ঘুম পাড়িয়ে নিঃসাড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বাবা বাইরের ঘরে একা উদাস  হয়ে বসেছিল কি জানি হয়তো আমারি প্রতীক্ষায়।  ডুকরে কেঁদে উঠলাম।  বাবাও কাঁদছিলো।  তারপর যে কি হল, আজ আর মনে পড়ে না।একটাই আফ্শোস ছিল, বিদায় জানিয়ে আসার সুযোগ পাইনি।

গানের  কথা -
তান চলে গেল।  দুদিন ভেন্টিলেটরে রেখেও বাঁচানো গেল না।  মাল্টিপল অর্গ্যান ফেলিয়র।  বাবাকে খবরটা দিলাম, বাবা বলল,“মাকে একা ছাড়িস না।  বড় অসহায় ও । ” মাকে ছাড়িনি আমি।  জড়িয়ে আছি সবসময়।  নিমতলা মহাশশ্মান, তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছি আমরা,মা বারবার ওর হিমশীতল ঠোঁটে চুমু  খাচ্ছে, খুব আদর করছে ওকে, হঠাৎ   ধড়মড় করে উঠে পড়ল মা।  আলুথালু  অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ালো এক সুবেশ যুবকের সামনে।  বহুক্ষণ ধরেই ছেলেটিকে দেখছি। উত্তেজিত হয়ে মা কিছু বলছে।  ছেলেটি মাথা নীচু করে চলে গেল।  মা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসে বলল, “ হারামজাদা।  দেখতে এসেছে আমার মেয়ে সত্যি মরেছে কি না। ” ভাবলাম তানের প্রাক্তন স্বামী  হবে। একটু পরেই ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল অপর এক যুবা।  তাকে দেখে মা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।  মাই পরিচয় করিয়ে দিল রাজীবের সাথে।  হতবাক্  হয়ে গেলাম।  এ যদি তানের বর হয় তবে ওকে ছিল? পরে রাজীবই বুঝিয়ে  দিল, ওটা ছিল জয়ন্ত।  ওর সাথেই আশুতোষ বাবু তানের বিয়ে ঠিক করেছিলেন শৈশবে। রাজীব ও মায়ের সাথে একমত, জয়ন্তর দেওয়া হৃদয়ভঙ্গের বেদনা সহ্য করতে না পেরেই---।  জয়ন্ত কিন্তু  চলে যায়নি।  দাহ করে ফেরার সময়ও আমি ওকে দেখেছি।  ভীড়ে লুকিয়ে ছিল।

ছমাস পর—
 মা নাকতলার ফ্ল্যাটে একাই থাকে।  আমি নিয়মিত খবরাখবর  নিই।  আরো একজন খোঁজ নেয়।  আমার বাবা ।  মা ও সসঙ্কোচে এদিকের খবর জানতে চায়।  আমি দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছি ——— স্বপ্ন কি কখনত্ত সত্যি হয়???

Image courtesy- Google