Wednesday 30 September 2015

অনির ডাইরি ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৫

জাতীয়তাবাদের ঢল নেমেছে। তেরঙ্গায় মুড়ে গেছে ফেসবুক। হাবাগোবা মহিলা শ্রমিক আমি, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ফান্ডাটাই বুঝি না। সকালে কাগজ দেখার সুযোগ হয় না, খুব একটা ঔৎসুক্য ও নেই, ফলে সমসাময়িক ঘটনাবলী সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ।এমনকি তথাকথিত পেজ থ্রী সেলেব দেরও খুব একটা চিনি না। সেদিন এক বন্ধু এক অপরূপার ছবি পাঠাল, রক্তবর্ণ বসনে স্বয়ং ঊর্বশী, কেবল হাতে একটি ত্রিশূল । কোথায় যেন দেখেছি, কোন সিনেমা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, সাধারণত সর্বসমক্ষে নিজের অজ্ঞতা যাতে না প্রকাশ পায়, সে ব্যাপারে আমি অত্যন্ত যত্নশীল কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে সেদিন জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম, যে অভিনেত্রীর নামটা যেন কি? পেটে আসছে বটে তবে --- । বন্ধু বেশ কিছু বাছাই অসংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে জানাল, উনি একজন পুণ্যাত্মা সন্যাসিনী।
যাই হোক, সকাল বেলা ফেসবুক খুলেই চমকে উঠলাম, ব্যাপার কি? হঠাৎ করে সবাই তেরঙা ছবি লাগাচ্ছে কেন? দেশের বাবার জন্মদিন আসতে বিলম্ব আছে, আর দেশের বাবাকে উদোম খিস্তিখেউড় করাটাই তো হেপ এণ্ড হ্যাপেনিং। ওনার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না জেনেও যত বিকৃত ভাষায় ওণার সমালোচনা করতে পারবেন, তত বোদ্ধা হিসাবে আপনার নাম ছড়াবে। মাঝে ঝালনুন হিসাবে নেতাজীর সাথে ওণার একটু তুলনা, আঃ জমে ক্ষীর । আজও কতলোক যে ওণাদের বেচে খাচ্ছে। সেদিন দেখলাম জনৈক গবেষক নানা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেই ছেড়েছেন যে গান্ধীজী ঘোরতর বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন।
মোদ্দা কথা হল, বাপুর জন্মদিন নয়, স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবস ও নয়। তবে কি হল রে বাবা? প্রোফাইল পিকচার তো আমিও ঘনঘন পাল্টাই। নার্সিসিস্ট হওয়া মোটেই দোষের নয়। পরের খুঁত দেখার থেকে নিজেকে নিখুঁত দেখা ভাল। কিন্তু নতুন ছবি কেউ লাগায়নি, পুরানোটাই তেরঙা হয়ে গেছে। ওপরে লেখা “ডিজিটাল ভারতের সমর্থনে । ” ব্যাপারটা কি? যত বেলা বাড়তে লাগল, তেরঙা ছবির সংখ্যা বাড়তে লাগল। কিছুকাল আগে আমেরিকায় সমকামী বিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়াতে বহু লোক এরূপ রামধনু রঙের ছবি লাগিয়েছিল। যে দেশে সম্মান রক্ষার্থে খুনজখম আকছার হয়, যেখানে এখনও গাড়ু নিয়ে লোকে মাঠে ছোটে, সমকামী এবং হিজরার প্রভেদ বোঝাতে চুল ছিড়তে হয়, তারাও আমেরিকান সমকামীদের জয়ের উল্লাসে সাত রঙে রাঙিয়ে ফেলল আননবই। মন্দ কি। যতক্ষণ আপনার পুত্র -কন্যা, ভাই- বোন বিষমকামী থাকছে, হেপ হতে সমস্যা কোথায়। হলে পঞ্চম বেদ তো রইল।
কিন্তু ডিজিটাল ভারতটা কি? খায় না মাখে? বেশ কয়েকজনকে প্রশ্ন করলাম, উত্তর এল না বটে তবে তাদের ছবিগুলি চটপট তেরঙা হয়ে গেল। শেষে আমার এক ভগিনীসম সহকর্মী জানাল যে প্রতিটি গ্রাম কম্পুটর দিয়ে ঢেকে ফেলা হবে। অন্তরজালে মুড়ে যাবে ভারতবর্ষ । দীন ,দরিদ্র , অর্ধউলঙ্গ, পূর্ণ উলঙ্গ ভারতবাসীও আননবই পড়তে পারবে। বাঃ বলতে গিয়েও থমকালাম, পড়বে কি করে? অক্ষরজ্ঞান থাকলে তো? বন্ধু বলল, এসব গাড়ল মার্কা প্রশ্ন করলে তোমাকে আই এস আই এর এজেন্ট বলবে। ঠিক । ঠিক। মুখবন্ধ করে কল্পনা করছি, আমার মামার বাড়ির গ্রাম, সুদূর মুর্শিদাবাদের একটা অখ্যাত গ্রাম, আর অখ্যাত থাকবে না। পাষানী গয়লানী , ইসমাইল মাষ্টার, অশোক মুদি, নারান হাড়ির গৃহপরিচারিকা বউ, খোঁড়া অনাথা সরস্বতী মাসি সবাই ল্যাপটপ নিয়ে ঘুরবে। ট্যাবলেট হাতে বুনো পাড়ার ছেলেগুলো বাগালি করতে যাবে। এমনকি বুনোপাড়ার ঘরে ঘরে যখন ধেনো মদ তৈরি হবে তখনও----- “বড়িয়া হ্যায়”।
‪#‎Anirdiary‬ ‪#‎Aninditasblog‬

Monday 28 September 2015

গোধূলি



ধুলো পুরু আস্তরনে আবৃত আমি,
ছুঁয়েও দেখো না,
গলা জড়াই  কাতর আবদারে, ভালবাসবে একটু?
বিরক্ত তুমি, “কি করে বাসতে হয়”?
সরে আসি নীরব বেদনায়,
জানি প্রেম আছে, শুধু হারিয়ে  গেছে
সেই কবোষ্ণতা ।
আঙুলের  ফাঁক দিয়ে দ্রুত চুঁইয়ে পড়ছে সময়।

Thursday 24 September 2015

মন ভালো নেই

মন ভালো নেই, আমিও না।
কিন্তু কেন? যা চেয়েছি, তাই তো পেয়েছি,
দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তা, অনেক হিসাব-নিকাশ কষে, তবেই তো চেয়েছিলাম।
কেমনে আজ বলি, সব ভুল?
জানতাম, তুমি কেমন, আমারই মনের মত,
শত বিনিদ্র যামিনীর স্বপ্ন- কল্পনা ওপর পরতে পরতে জমা রক্ত, মাংস, চামড়া, রোমরাজি।
বড় প্রিয়, বড় আপন, প্রতিটি রোমকূপ,আমারই তো প্রতিচ্ছবি ।
তবে কেন এ বিষাদ, কার তরে মন উদাস? কার প্রতি অবহেলা?

সবই বুঝি অলস মায়া, নিখাদ দুঃখবিলাস।
image courtesy- Google

সহযাত্রী (পর্ব -৪)


সুমি আর কলির দৌলতে দাশনগর থেকে কোলাঘাট যেতে মন্দ লাগত না, কোলাঘাটে ওরা নেমে যাবার পর আবার দুঃসহ একাকীত্ব। মোবাইলে টাওয়ার থাকত না। এফ এমও ধরা যেত না। টাইমস অব ইন্ডিয়া মুখস্ত করতে করতে কোন মতে খড়গপুর পৌঁছত শিলালিপি। ফিরতি ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবার অদম্য ইচ্ছেটাকে কবর দিয়ে, চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম প্লাটফর্ম পার হয়ে, সম্ভবত খাড়াইতম ওভার ব্রিজ টপকে, হাফ মাইল হেঁটে অটো স্ট্যান্ড। স্টেশনের সামনেই রিক্সাস্টান্ড, তবে রিক্সাওয়ালা গুলিকে স্বচ্ছন্দে ডাকাত বলা যায়,  প্রত্যহ ওদের সাথে দরাদরি অথবা বচসা করা শিলালিপির দুঃস্বপ্ন মনে হত। সুতরাং অটো ছাড়া গতি ছিল না। অটোতে অবশ্য মিনিট সাতেকের বেশি লাগত না অফিস পৌছতে।
পোঁছেই বা কি লাভ হত? কোন অজ্ঞাত কারণে, সমস্ত কর্মযজ্ঞ থেকে শিলালিপি ছিল বঞ্চিত। কাজ বলতে এক আধো অন্ধকার ড্যাম্প ধরা, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে সারাদিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা। মাসে একবার একটা রিপোর্ট সই করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া ছাড়া এক কথায় শিলালিপি সম্পূর্ণ বেকার। ঘরটিতে তিনটি জানালা, যার মধ্যে দুটি বাইরে থেকে ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করা। তৃতীয় জানলাটি খোলে বটে, প্রচণ্ড বর্ষা আর তীব্র শীতেও তাকে খুলেই রাখতে হয়, উপায়ন্তর নেই, পাল্লা ভাঙা। চেম্বারে একটা ফোন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, মাঝে মাঝে শিলালিপির মনে হত জগত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে ওকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।
বিকাল পৌনে পাঁচটা বাজলে, বন্দী দশা ঘুচত। সারা দিন বসে থাকার ক্লান্তি আর চূড়ান্ত হীনমন্যতা নিয়ে গুটি গুটি বেড়িয়ে পড়ত শিলালিপি। ফেরার মেদিনীপুর লোকালে সহযাত্রী বলতে যারা ছিল, প্রায় সকলেই ডাই ইন হারনেস কেসে চাকরী পাওয়া বিভিন্ন বয়সী রেলের চতুর্থ শ্রেণীর মহিলা কর্মচারী। অতি সাধারণ বেশভূষা, কাঁধে বা হাতে সস্তার ব্যাগ অথবা বাজারের চটের থলে। ট্রেন ছাড়লেই প্রত্যেকের ঝোলা থেকে বের হত, মস্ত এক প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ভর্তি মুড়ি। একটু পড়েই ঝালমুড়ি, চপ আর চা ওয়ালারা উঠত। কেউ চপ কিনে, চটকে মেখে নিত মুড়ির সাথে, কেউ বা মুড়ি ওয়ালাকে পয়সা দিয়ে মাখিয়ে নিত, সাথে গরম চা। প্রাতকালে শিলালিপি যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন ওরা ট্রেন ধরে। দুপুরে রেলের ক্যান্টিনের ভাত আর সকাল বিকাল মুড়ি, বাঁধাধরা রুটিন। পরে একজন শিলালিপিকে জানিয়েছিল, শুধু দুই বেলা মুড়ি আনবার জন্য ওরা নিয়মিত প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট কেনে। যাইহোক, আপাত সাদাসিধে মানুষ গুলির সাথে শিলালিপির খুব কমই ভাব বিনিময় হত। ফেরার পথে মন খারাপ করে বসে  থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি, সবে ট্রেন খড়গপুর প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়েছে, মহিলারা যে যার মুড়ির প্যাকেট বার করবে করবে করছে, হটাৎ তীব্র গোলযোগ। হইচই, চিৎকার, সপাটে চড় মারার শব্দ এবং অবশেষে ভেউভেউ কান্না। কৌতূহলী হলেও সিট ছেড়ে উঠল না শিলালিপি, পার্শ্ববর্তীনী নিত্যযাত্রীরা দৌড়ল। মহিলা কামরায় ঝগড়াঝাঁটি কালেভদ্রে হয় না। নারদের নিত্য বসবাস। তবে মারামারি আজ অবধি দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি শিলালিপির। একটু পরেই  মহিলারা যে যার সিটে ফিরল, সাথে এক ক্রন্দনশীলা তরুণী। দেখলেই বোঝা যায়, নির্ঘাত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, নতুবা হবু ছাত্রী। সেদিন ট্রেনে বেশ ভিড় ছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিন জনের জায়গায় চার জন কষ্টেসৃষ্টে বসেছিল। এই নিয়েই ঝগড়া এবং হাতাহাতি। জনৈক ডেইলি পাষণ্ড মহিলা ঐ তরুণীকে সাঁটিয়ে এক চড় কশিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে বেচারি মেয়েটি রণে ভঙ্গ দিয়ে করুণ সুরে কাঁদছিল। “আমাকে আমার মা বাবাই কোনদিন মারেনি। সামান্য একটু সিটের জন্য এভাবে কেউ মারে?” শিলালিপির আশে পাশের সহযাত্রীরা নানা ভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। একজন চা কিনে দিল, মেয়েটি তবু ফুঁপিয়েই চলেছে, শিলালিপি, খানিক পরে অবিশ্বাসের সুরে পার্শ্ববর্তিনীকে জিজ্ঞাসা করল, “সত্যই মেরেছে?কে মারল দিদি?”
মহিলা ঠোঁট মুচড়ে বলল, “ঐ দেখছু না, ঐ মেয়েছেলেটা। কেউ মারে বল? আহা কেমন ফোঁপাচ্ছে দেখছনি। ওকে কাঁদতে দেখে, আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ছে গো।” বৃদ্ধার অঙ্গুলি অনুসরণ করে শিলালিপি দেখল, দূরে এক ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ মহিলা, আহত জন্তুর মত, ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে কপালে লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে, দেখেই মনে হবে, স্বয়ং মা শিতলা, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গা ছমছমিয়ে উঠল শিলালিপির।
দিন কয়েক পরের কথা, সকালের ট্রেনটা সবে মেচেদা ছারিয়েছে,মহিলা কামরা মোটামুটি খালি, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে, কিছু নিত্যযাত্রী বসে আছে, শিলালিপি যথারীতি টাইমস মুখস্ত করার বৃথা চেষ্টা করছিল, অকস্মাৎ সেদিনের সেই রণচণ্ডী মহিলা এসে ধপ করে ওর পাশে বসল। এই সিটে সাধারণত আট জন বসে, বর্তমানে মাত্র শিলালিপিকে নিয়ে মাত্র জনা তিনেক মহিলা বসে আছেন। ঠেসাঠেসি বা মারামারি হবার সম্ভবনা ক্ষীণ তবু শিলালিপি একটু জানলার দিকে চেপে বসল। মহিলা অবশ্য দিব্যি খোশ মেজাজে উল্টো দিকে বসা নিত্যযাত্রীনীর সাথে গল্প জুড়লেন। না না বিষয়ে কথা হচ্ছে, হাসির ফোয়ারা ছুটছে মাঝে মাঝেই, হঠাৎ মহিলা ওকে কনুই এর খোঁচা মেরে বলল, “ কি বল, ভাই তাই না?”
“অ্যাঁ? তাই কি? শুনিনি সরি।” মারের ভয়ে সরি বলল বটে, মনে মনে বলল, তোমাদের ভ্যাজোর ভ্যাজোর খামোখা শুনতে যাব কেন বাপু।  মহিলা হাসতে হাসতে  বলল, “এই সব রঙ, তোমাদের মানায়, আমাদের বয়সে কি চলে? কি করব ভাই, ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে পুজোয় দিয়েছে, তাই পরা।” শিলালিপি জবাবে দেঁতো হাসি হাসল। কিছু পরে ট্রেন আরও ফাঁকা হয়ে গেল। উল্টো দিকের নিত্যযাত্রীনীও নেমে গেলেন। খড়গপুর আসতে তখনও এক ঘণ্টা, মা শীতলা বকেই চলেছে, শিলালিপিরও মন্দ লাগছিল না, বেশ গ্রাম্য সরল মনে হল মহিলাকে। এক চপওয়ালা উঠল, প্রায় খালি ঝুড়ি নিয়ে, মা শীতলা তার সাথে দরাদরি করে, ঠাণ্ডা ডিমের চপ কিনল, আলুর চপের দরে। মুড়িও কেনা হল এক ঠোঙা, অতঃপর ওনার উপরোধে শিলালিপিকে খানিক খেতেও হল, মন্দ লাগছিল না, সময়টা বেশ দ্রুত কাটছিল। ট্রেন যখন খড়গপুর ধুকছে, শিলালিপি অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “ দিদি আপনার নাম কি?’’
মহিলা লাজুক হেসে বলল, “ঊষাঙ্গিনি। সবাই ঊষাদি বলেই ডাকে। তুই এত দূর থিকে আসিস, আমার নম্বরটা রেখে দে, দরকারে বলিস।” এভাবেই ঊষাঙ্গিনির সাথে, শিলালিপির আলাপ, তবে বন্ধুত্ব দ্রুত জমেনি, জমতে সময় লেগেছে। লিপিলেখার সাথে দেখা হয়েছিল, এরও বেশ কিছুদিন পর, সৌজন্য ঊষাঙ্গিনি। লিপিলেখা ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করার দিন দুয়েকের মধ্যেই কি ভাবে যেন, ঊষাঙ্গিনির সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলে, শিলালিপি তখন ছুটিতে। ঊষাঙ্গিনি লিপিলেখাকেও নিজের নম্বর দিয়ে একই ভাবে বলেছিলেন, বিপদে আপদে ওনাকে ফোন করতে। ওনার এই আপেক্ষিক উদারতায়, শিলালিপি না গললেও লিপিলেখা গলে যায়। ঊষাঙ্গিনি অচিরেই হয়ে ওঠে লিপিলেখার ঊষা কাকিমা।পরে যদিও শিলালিপি এবং লিপিলেখা আবিষ্কার করে, যে ঊষাঙ্গিনি ওদের নম্বর তো দিয়েছিল, কিন্তু ফোনটা সঙ্গে না এনে প্রায়দিনই বাড়িতেই রেখে আসেন, এই নিয়ে শিলালিপি এবং লিপিলেখার যুগ্ম আক্রমণের সামনে, উনি অসহায় ভাবে শুধু বলেছিলেন, “কি করব বল? নাতির আব্দার কি ফেলা যায়। তাতে কি? তোরা আমার অফিসে ফোন করবি, বড় সাহেবের ঘরে বটে ফোনটা, ও উনি ডেকে দিবেন। ”

(চলবে)

Sunday 20 September 2015

সহযাত্রী পর্ব-৩


অবশেষে ট্রেন এল, লোকাল ট্রেন বেশি ক্ষণ দাঁড়াবে না, ঐ অতি স্বল্প সময়ে মেয়ে ঠিকঠাক ট্রেনে উঠতে পারবে কি না, এই নিয়ে উর্বশী দেবীর বেজায় দুশ্চিন্তা ছিল, মাকে সাময়িক ভাবে ভুল প্রমাণিত করে তড়িঘড়ি মহিলা কামরায় উঠেও পড়ল শিলালিপি। হাওড়া থেকেই মোটামুটি ভর্তি হয়ে এসেছে ট্রেনটা। তবুও কিছু বসার সিট খালি ছিল, দৌড়ে গিয়ে বসতে গিয়ে এক চোট ধাক্কা খেল শিলালিপি, ভাবলেশহীন মুখে এক সুসজ্জিতা রমণী, তৎক্ষণাৎ ঐ সিটের ওপর তাঁর ব্যাগটি রেখে জানানলেন, “জায়গা আছে।” কার জায়গা, কিছু বুঝতে পারল না শিলালিপি, সবাই বসেই আছেন, মহিলাকে প্রশ্ন করার অবকাশ পেল না, কারণ ততক্ষণে তিনি পার্শ্ববর্তী মহিলার সাথে, পুনরায় গল্পে মসগুল হয়ে পড়েছেন। মন খারাপ করে অন্য সিটে বসতে গেলেও পুনরায় একই অভিজ্ঞতা হল। ইতিমধ্যে পরবর্তী স্টেশন এসে গেল, বেশ কিছু সুদর্শনা রমণী, ওর পাশ কাটিয়ে গিয়ে সংরক্ষিত সিটে বসেও পড়লেন, বোকার মত কাঁধে ব্যাগ আর হাতে টিফিনের ঝোলা নিয়ে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে দাঁড়িয়েই রইল শিলালিপি। কান্না পাচ্ছিল, কোনমতে ঠোঁট কামড়ে উদ্গত কান্না সংবরণ করল, কারণ অজান্তেও অনুভব করছিল, বেশ কয়েক জোড়া চোখ তীব্র দৃষ্টিতে ওকে পর্যবেক্ষণ করছে। কি করা যায়? তবে কি আবার বাড়িতেই ফোন করে জিজ্ঞেস করবে? নাকি জলপাইগুড়িতে সৌরকে ফোন করবে? সে তো মাঝে মাঝে নাকি লোকালে সওয়ারি করত। নাকি অপেক্ষা করবে? এমন সময় হঠাৎ কলাবতী অর্থাৎ রম্ভার ফোন, “কি রে? ট্রেনে উঠতে পেরেছিস?” কোন মতে গলা ঝেড়ে জবাব দিল, শিলালিপি, “হ্যাঁ মাসিমণি।”
“হুঁ। বসতে পেয়েছিস?” চোখ ছলছলিয়ে উঠল শিলালিপির, কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ফেলবে, তাই চুপ করে রইল। রম্ভা আবার বললেন, “পাসনি তো? জানতাম। কি বলছে? আসন সংরক্ষিত?” “হ্যাঁ।”
“বুঝেছি। এই জন্যই এদের ডেইলি পাষণ্ড বলে। তাও তো সাউথ ইস্টার্ন অনেক ভাল। শোন এমনি জায়গা পাবি না। দেখ কোথায় তিন জন বসে আছে, সেখানে গিয়ে বল, একটু চেপে বসুন তো। বললেই অভ্যাস বশতঃ ওরা একটু সরে বসবে। একটু কষ্ট করে বসে যা, বাগনানে সব নেমে যাবে। বুঝেছিস?” মাসির প্রতি কৃতজ্ঞতায় শিলালিপির মনটা ভরে উঠল, আপাত কঠিন রম্ভার মনে যে ন্যাদোশ আলু ভাতে মার্কা বোনঝির জন্য কতখানি দরদ আছে, তার পরিচয় অবশ্য এর আগেও ও বহুবার পেয়েছে। রম্ভার উপদেশ অব্যর্থ। কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে বসতে পেল শিলালিপি।
গভীর মনোযোগের সাথে সহযাত্রী দের পর্যবেক্ষণ করতে লাগল শিলালিপি, প্রায় সকলেরই পরনে পরিপাটি করে পড়া সুতির শাড়ি,  হাল্কা প্রসাধন, গম্ভীর মুখ, পরিমিত হাসি, এক কথায় ভয়াবহ রকম মার্জিত। মাঝে মাঝে দু একজন অবশ্য সিল্ক বা সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি পড়েছেন। ওনাদের বাক্যালাপ অল্পক্ষণ শুনলেই বোঝা যায়, এঁরা সকলেই শিক্ষিকা। বাপরে সবাই শিক্ষিকা আর মাঝে একজন ছাত্রী। মনে মনে প্রমাদ গুনল শিলালিপি।
দিন কয়েক কাটল। মোটামুটি মুখ চেনা হয়ে গেছে, রম্ভা বলেই ছিলেন, যে অচিরেই শিলালিপিকেও ওরা ওদের একজন হিসাবে গণ্য করবে। ততটা না হলেও, আজকাল বসতে গেলে কেউ বলে না যে, সিট রাখা আছে। দীর্ঘ পথ তো আর মুখ বুঝে যাওয়া যায় না, অগত্যা সহযাত্রীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করল শিলালিপি, শিক্ষিকাদের মধ্যে দুটি সুস্পষ্ট দল আছে, একদল প্রাক এস এস সি যুগের, অপর দল এস এস এস সি দিয়ে ঢোকা শিক্ষিকাকুল। প্রাক্তনিদের বক্তব্য হল, তাঁরাই প্রকৃত শিক্ষিকা। তাঁরা ভালবেসে পড়ান, নিছক চাকরী করেন না। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে তাঁরা সর্বদাই হেডুর সাথে সহযোগিতা করেন, বিশেষ কাজে ছুটির দিনেও আসতে ওনাদের আপত্তি নেই। বা থাকলেও তা মৃদু। উগ্র সাজগোজ করেননি,শাড়ি পরব না, সালোয়ার দাও বলে বায়নাক্কা করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। অপর দিকে নবীনাদের বক্তব্য হল, তাঁরা রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরী পেয়েছেন, কোন দাদা দিদি মাসি মেসো ধরে নয়। সুতরাং অকারনে কাউকে খাতির করে চলার প্রশ্নই ওঠে না। প্রাক্তনিরা সকলেই বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে পড়ান, তাই তাদের পক্ষে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা কোন সমস্যা নয়, কিন্তু সল্টলেক থেকে কোলাঘাট বা গড়িয়া থেকে পাশকুড়া যাকে দৌড়তে হয়, তাঁর পক্ষে ছুটির দিন স্কুল করা মোটেই আহ্লাদের কথা নয়। শুধু দীর্ঘ পথযাত্রাই নয়, অনেক শিক্ষিকাকেই বাস, ট্রেন, ট্রেকার এমনকি সাইকেলে চড়ে স্কুল যেতে হয়, শাড়ি পড়ে যা প্রায় অসম্ভব। সালোয়ার ও তো জাতীয় পোশাক, যথেষ্ট ভদ্র মার্জিত, শরীর ঢাকা পোশাক। পরলে অসুবিধা কোথায়? তবে ভিতরে ভিতরে সুস্পষ্ট বৈরিতা থাকলেও উপরে কিন্তু সহজ সৌজন্যমূলক সম্পর্ক বজায় ছিল। নবীনারাই অবশ্য ছিল সংখ্যা গরিষ্ট। তবে শিলালিপি কে একা পেলেই দু দলই একে অপরের নামে পরচর্চা শুরু করত। যেমন কলি। সুমি আর কলি সুদূর দক্ষিণ কলকাতার শহরতলী থেকে সুদূর কোলাঘাটে পড়াতে যেত। শিলালিপিরই সমবয়সী। সুমি বেশ স্থুলাকৃতি, নাদুস নুদুস, মিষ্টি মিষ্টি দেখতে, দেখলেই বোঝা যায়, শিলালিপির মতই বাবা মায়ের আবদেরে আলু ভাতে। প্রায় রোজই অপরূপ সুন্দর তথা অত্যন্ত মূল্যবান শাড়ি পড়ে রোজ স্কুলে যেত। ঐ বিশাল বপু বার হাত শাড়িতেও ঢাকা পড়ত না, তাই সুমির মা সর্বত্র যত্ন সহকারে সেফটি পিন লাগাতেন, সেই সেফটি পিন মাঝে মাঝেই খুলে গিয়ে সুমিকে তো ঘায়েল করতই, একবার শিলালিপির হাতেও ফুটে গিয়েছিল। তখনও ওদের সাথে ভাব জমেনি। শুধু মুখ চেনা, তবু সমবয়সী বলে, দেখা হলেই এক গাল হাসি বিনিময় হত। যেদিন সুমি প্রথম ওকে ডেকে নিজেদের পাশে বসালো, শিলালিপি বেশ পুলকিত বোধ করল, যাক এত দিনে হংস মধ্যে হংস যথা হতে পারল। কি কপাল, সেদিনই সুমির মায়ের সযত্নে আঁটা পিন, পট করে খুলে গিয়ে দুজনকেই ঘায়েল করল। সুমি বেচারা লজ্জায় লাল কালো হয়ে অনেক ক্ষমা চাইল। শিলালিপ ক্ষততে হাত বোলাতে বোলাতে শুধু বলল বলল, “ এত সেফটি পিন লাগাও কেন?” লজ্জায় সুমি করুণ মুখে বলল, “কি করি? পেট দেখা যায় যে? মোটা হবার কি কম জ্বালা? তুই তো বুঝিস।”
(চলবে)

সহযাত্রী


অনেক দিন আগের কথা, তখন পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল, মুষ্টিমেয় জনগণের দিবাস্বপ্ন মাত্র। রেড জোন আছে বটে, তবে জঙ্গলমহল তখনও লাল হয়নি। মাঝে মাঝেই বিরাপ্পনের নাম শোনা গেলেও, কিষান জীর সাথে বঙ্গবাসী তখনও অপরিচিত। শিলালিপি, লিপিলেখা, ঊষাঙ্গিনি আর নবনী চার ঘনিষ্ট বন্ধু। চার জনেই ডেইলি পাষণ্ড। ১১৩ নং মেদিনীপুর লোকাল এবং ১১৫ নং খড়গপুর লোকালের মহিলা কামরার সব নিত্যযাত্রী এবং সব হকার ওদের চেনে। ওরা একসাথে যায় আবার এক সাথে ফেরে। নবনী এবং উষাঙ্গিনিী এ লাইনে পুরানো পাপী, বহুদিন ধরে যাতায়াত করছে, উষাঙ্গিনির বয়স দেখে যদিও মনে হয় পঞ্চাশ, বাহান্ন এমনকি পঞ্চান্নও হতে পারে, তবে তিনি দাবী করেন তাঁর বয়স নাকি সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। কয়েক বৎসর পূর্বেও দোহারা চেহারা ছিল, আজকাল একটু ভারির দিকে। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ। সস্তার কলপ করা চুলে গদগদে করে সিঁদুর পরেন। হাতে শাঁখা, পলা। অধিকাংশ দিনই সিনথেটিক শাড়ি পরেন, কদাচিৎ তাঁত বা সিল্ক। চান করে ভেজা চুল বেঁধে ট্রেনে ওঠেন, উঠেই আগে চুলটা খুলে দেন। চটি খুলে সিটের ওপর বাবু হয়ে বসা ওনার প্রিয়তম অভ্যাস। জোরে জোরে কথা বলেন, কথায় কথায় অট্টহাস্য করেন, মাঝে মাঝে সুর করে গানও গান, অবশ্য চলতি বাংলা সিনেমার গান, না হলে বড় জোর স্বর্গীয় মান্না দে বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। গান গাইতে গাইতে সিটে বসে এক পাক নেচেও নেন। অবশ্য কামরা খালি থাকলে তবেই। কোন এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে চতুর্থ  শ্রেণীর কর্মচারী। উষাঙ্গিনির পুত্র কন্যা উভয়েই বিবাহিত। বড় নাতিটিরই সপ্তম শ্রেণী হল। স্বামীও ঐ একই অফিসে চাকরী করেন। তবে কলকাতায় পোস্টেড। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন, স্বামীর কাজে খুশি হয়ে কোন এক বড় সাহেব ঊষাঙ্গিনিকে অনুগ্রহ পূর্বক এই চাকরীটী যোগাড় করে দেন। যাই হোক মহিলা কামরার নিত্যযাত্রীদের কাছে উনি খুব একটা জনপ্রিয় নন। কারণ উনি নাকি অনেকের কাছেই টাকা ধার করে রেখেছেন। হকাররাও ওনাকে দেখলে সরে সরে যায়। তবে টাকার পরিমান ৫০০-১০০০ এর মধ্যেই থাকে। উনি সময় সুযোগমত ৫০-১০০ করে শোধও দেন, তবু শিলালিপি আর লিপিলেখাকে নিরালায় পেলেই অন্যান্য মহিলা যাত্রীরা সাবধান করে দেয়। সব মিলিয়ে মানুষটা মন্দ নন। শহুরে পালিশ বিহীন গ্রাম্য মহিলা।
শিলালিপি আর লিপিলেখা সদ্য সদ্য ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করেছে। দুজনেরই দপ্তর খড়্গপুর। ওদের বয়সও কাছাকাছি, সমবয়সীই বলা যায়। দুজনেই গৌরী, বেশ হৃষ্টপুষ্ট। শিলালিপি আসে হাওড়া থেকে আর লিপিলেখা ট্রেনে ওঠে বাগনান থেকে। ট্রেনেই ওদের আলাপ, আলাপ থেকে ঘনিষ্টতা হয়ে বর্তমানে ওরা একে অপরের প্রিয়তম বান্ধবী। শিলালিপির বদলির চাকরী, খড়গপুর ওর প্রথম পোস্টিং। বাবা মায়ের দুলালী, প্রথম দিন বৃদ্ধ বাবা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সমুদ্র নীল জিন্স, সাদা শার্ট আর উঁচু গোড়ালির ফ্যাশন দুরস্ত জুতো পড়ে প্রথম দিন অফিস গিয়েছিল শিলালিপি। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অফিস পৌছতে লেগেছিল পাক্কা চার ঘণ্টা। জুন মাসের তীব্র গরমে তথা পথশ্রমে ক্লান্ত মোমের পুতুলকে দেখে মেদিনিপুরিয়া বড় সাহেবের মনেও দয়া হয়েছিল, তাই সেদিন তড়িঘড়ি ছেড়ে দেন। সাড়ে তিনটের ট্রেন, লোকাল অবশ্যই, ঐ সময় কোন এক্সপ্রেস ট্রেন থাকে না, ধরার জন্য তিনটের সময় অফিস থেকে বেড়িয়ে যথারীতি চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাতটার সময় বাড়ি ঢুকে শিলালিপি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে। সাথে সাথে মাও খানিক কেঁদে নিলেন। সে কি নাটক বাপ রে বাপ। অবশেষে শিলালিপির বাবা প্রবল চিৎকার চেঁচামিচি করে পাড়ার লোকের ঘুম চটকিয়ে নাটকে যবনিকাপাত করেন সেদিনের মত নাটক বন্ধ হলেও পরদিন থেকে নতুন নাটক শুরু করে শিলালিপি। মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে বেজে থেমে যায়, মা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বাবার চিৎকারে পাড়ার তন্দ্রাচ্ছন্ন সারমেয় কূলের আমেজ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু শিলালিপির ঘুম আর ভাঙে না। অবশেষে যখন নিদ্রাভঙ্গ হয়, তখন বেলা নটা। অতএব ঐ দিন আর অফিস যাওয়া হয় না। তাতেও শিলালিপির কোন অপরাধ বোধ ছিল না, দিব্যি চান করে ভাত খেয়ে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে একটা সুখী সুখী দিবানিদ্রার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সব আমেজ নষ্ট করে দিল একটা ফোন। আগের দিনের স্নেহশীল বড় সাহেবের ফোন, আজ অবশ্য গলায় স্নেহ ছাড়ুন, বিন্দুমাত্র মিষ্টতাও ছিল না। হিমশীতল গলায় ধমকালেন, পুনরায় বিনা সংবাদে বা কোন অগুরুতর কারণে অফিস না গেলে, উনি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। শিলালিপি অনুভব করল বাস্তবিকই গরিবের কথা বাসী হলে কতটা মিষ্টি হয়, বিগত রাত থেকে নানা ভাবে বাবা এই কথাটাই বোঝাবার নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। জনমানসে রাজ কর্মচারীদের সম্পর্কে যাই ধারণা থাকুক না কেন, সরকারি চাকরীতে আদৌ যেমন খুশি চলা যায় না। ঢুকেছ কি মরেছ। বাবা যথার্থই বলেন, “সরকারি চাকরী হল আদতে চাকরগিরি। আর তোরা হলি জনগণের চাকর বাকর, public servant?”

শিলালিপির স্বর্গীয় মাতামহ রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় প্রথমা কন্যার নাম রেখেছিলেন উর্বশী। এই নিয়ে মাতামহের সাথে ওনার মাতা ঠাকুরানীর তীব্র বিবাদ হয়, অপ্সরার নামে ভদ্র পরিবারের মেয়ের নাম রাখা সেই প্রাচীনপন্থী মহিলার মতে ছিল নিতান্তই “অলপ্পেয়ে” ব্যাপার স্যাপার। জাই হোক কয়েক বৎসর পর যখন শিলালিপির মাসিমণির জন্ম হল, তখন সেই মহিলা জেদ ধরলেন নাতনির নাম রাখতে হবে রম্ভা। মাতামহ হয়তো অন্য কোন শ্রুতিমধুর নাম কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু বৃদ্ধার জেদের সামনে অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যাইহোক রম্ভার জন্মের পর ঠাকুমা খুব অল্পকালই জীবিত ছিলেন, ওনার মৃত্যুর পর যতবার রম্ভার নাম পরিবর্তনের প্রচেষ্টা হয়েছে, প্রতিবার রম্ভা তা ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছে। বৃদ্ধ পিতামহী মৃত্যুর পূর্বে যেন তাঁর সমস্ত জেদ এবং ব্যক্তিত্ব ঐ ক্ষুদ্রিকাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কেউ রম্ভার নাম নিয়ে ফাজলামি করার সাহস পায়নি। উর্বশী এবং রম্ভা সহোদরা হলেও চরিত্রগত ভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত । শিলালিপির মা স্বভাবত বেশ মিষ্ট এবং কোমল, সর্বংসহ প্রকৃতির রমণী। কেন্দ্র সরকারের মাঝারি শ্রেণীর কর্মচারী। রম্ভা ততোধিক দৃঢ়, রূঢ় বলাই বাহুল্য তীব্র ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। কেন্দ্র সরকারের অডিট সংক্রান্ত দপ্তরের বেশ দরের অফিসার। জামাই বাবু অর্থাৎ শিলালিপির বাবার সাথে ওনার ব্যক্তিত্বের সংঘাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। উভয়েরই ব্যক্তিত্ব প্রবল। তবে দিদি বা শিলালিপির প্রতি ওনার ভালবাসায় কোন খাদ নেই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও দিনান্তে একবার উনি দুরাভাষ মারফৎ খবরাখবর নিয়েই থাকেন। যদিও ওনার সর্বদাই মনে হয়, উর্বশী তাঁর মেয়েকে অতিরিক্ত আদরে একটি “আব্দেরে আলু ভাতে” তৈরি করেছে। সেদিন যখন উনি শুনলেন, শিলালিপি অফিস যায়নি, তীব্র বিরক্তির সাথে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “অফিস যায়নি কেন?”
উর্বশী ভয়ে ভয়ে বললেন, “না, আসলে কাল এত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছিল, তাই আজ আর ঘুম থেকে উঠতেই পারেনি।”
“ঘুম থেকে উঠতে পারেনি বলে অফিস যায়নি???”
“ভালো হয়েছে দূরে পোস্টিং হয়েছে, এবার তোর ঐ ন্যাদোশ মেয়েটা মানুষ হবে। ট্রেনে করে যাতায়াত করতে হলে চটপটে হতেই হবে। এ তোমার কলকাতা হাওড়ার বাস নয়, যে পাঁচ মিনিট পর পরই পাওয়া যাবে। কাল ও যদি না যায়, তো বলিস পরশু ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব আমার।”
শিলালিপির বাবা এত ক্ষণ ভালো মানুষ সেজে কাগজ পড়ার ভান করে স্ত্রী এবং শ্যালিকার কথোপকথন শুনছিলেন, বলাই বাহুল্য শ্যালিকাকে উনি খুব একটা পছন্দ করেন না, তবে স্ত্রীর ভয়ে সহ্য করতে বাধ্য হন। আড়ালে আবডালে রম্ভাকে উনি কলাবতী বা কলা বলে সম্বোধন করেন। কাল শিলালিপি অফিস না গেলে পরশু রম্ভা আসবেন, এত বড় গসিপ হজম করা ওনার পক্ষে অস্মভব। উর্বশী দেবী বলার আগেই, উনি কাগজ বগলে দৌড়লেন, শিলালিপির ঘরে, বিছানার ওপর কাগজটা আছড়ে বলে উঠলেন, “হল তো!” কৌতূহলী শিলালিপি বোকা বাক্স থেকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, “ আমি অত ডাকলাম, উঠলি না। এবার কলা এসে তোর ঘুম ভাঙাবে। আসছেন তিনি। ”
কলা অর্থাৎ রম্ভাকে বড় ভয় শিলালিপির। শিক্ষা দেবার জন্য রম্ভা করতে পারেন না, এমন কিছুই নেই। নিজের একমাত্র পুত্রকে একবার তিনি নিজের হিশি নুন দিয়ে চাটিয়েছিলেন। বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও টুবাই রাতে বিছানা ভেজাত।
অগত্যা বস এবং কলাবতী অর্থাৎ মাসিমণির যুগ্ম আতঙ্কে পরদিন থেকে শুরু হল শিলালিপির ডেইলি পাষণ্ডগিরি। প্রাতঃকালে মায়ের হাতের ডাল ভাত খেয়ে, যত্ন করে গুছিয়ে দেওয়া দুই সেট টিফিন ব্যাগে পুরে, দুর্গা নাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল শিলালিপি। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বাসে তুলে দিলেন। দাশনগর স্টেশন থেকে ১১৩ নং মেদিনীপুর লোকাল। ট্রেন আসার কথা ৮টা ১১এ। পরের ট্রেনের সময় হয়ে এলেও তেনার দেখা নেই। প্লাটফর্মে কারো যেন কোন তাড়া নেই। যে যার মত, মুঠো ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কোন টিকিট পরীক্ষক বা রেল পুলিশের পাত্তা নেই। কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? অগত্যা বাবাকেই ফোন লাগাল শিলালিপি, “ট্রেন তো এল না বাবা। কি করি?”
“আসবে আসবে, অপেক্ষা কর। সাউথ ইস্টার্ন রেলের নাম আগে ছিল, বি এন আর। বেঙ্গল নাগপুর রেলয়ে।আর স্থানীয় লোকজন কি বলত জানিস, ‘ বি নেভার রেগুলার’। মাত্র আধ ঘণ্টায় হতাশ হয়ে পড়লে হবে?” কৌতুকের সুরে জবাব দিলেন বাবা।
(চলবে)image courtesy- Google

Thursday 10 September 2015

অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের



মঙ্গল পাণ্ডে কোথায় তুমি?
সত্যিই কি তুমি তবে এনফিল্ড বুলেটের সুতো দাঁতে কাটতে স্বীকৃত হলে?
মাত্র ১৫৮ টা বছর, এত দুর্বল নুব্জ হয়ে পড়ল তোমার মেরুদণ্ড ?
জানি কামানের গোলায় শতছিন্ন হওনি ,
জানি তুমি আসবে, আসবেই,আসতেই হবে,
অপেক্ষা শুধু সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের, ততোদিন না হয় আরো একটু শূলপক্ক হই আমরা।