Thursday 29 October 2015

আলতামাধবী



 পুজোর কলকাতা কি কুৎসিত,  জনগণ  যেন উন্মাদ হয়ে ওঠে, সেই একই সবৎসা দশভুজা মূর্তি , তবু মত্ত হস্তির মত এ মণ্ডপ থেকে সে মণ্ডপ ঘুরে বেড়ায় । হাঘরের মত গোগ্রাসে  গেলে রোল, চাউমিন থেকে ফুচকা মায় ফুটপাতের  কউয়া বিরিয়ানি। যত্রতত্র এটোকাঁটা আর মূত্র ত্যাগ করে। আবর্জনায় ভরিয়ে দেয় কলকাতাকে। সাথে কর্ণপটহ ফাটানো মাইকের চিৎকার ।  এই সময় চেনা শহরটা যেন আচমকা অচেনা হয়ে ওঠে , আর এই অপরিচিত শহরটাকে বড় ভয় পায় জিনি, জিনিয়া সর্বাধিকারী।  কিছুতেই এই আনন্দ যজ্ঞে সামিল হতে পারে না।  ফলতঃ পুজোর চারদিন বাড়ি পাহারা দেওয়াই ওর কাজ।  বাবা সকাল থেকেই পাড়ার ক্লাবে আড্ডা জমান।  অশীতিপর গুটিকয়েক বন্ধুই মাত্র জীবিত, তবু কি উন্মাদনা পুজোর, মা তাই বলে, “তুুই ঐ লোকটার মেয়ে হতেই পারিস না।  নির্ঘাত পাল্টে গিয়েছিলি। ”
আর মা? মাই বা কিসে কম যায়? বেতো রুগী, দিব্যি মাঞ্জা দিয়ে ঠাকুর দেখতে বের হয়।  শুধু ঠাকুর দেখার জন্য মাসিকে টেনে আনায় বোকারো থেকে । কি করবে? বহু সাধ্যসাধনাতেও জিনি তো বের হয় না।

আজ নবমী, বাধ্য হয়ে জিনিকে বেরোতে হল, বেশি দূর নয়, পাড়ার দোকান।  গরম মশলা শেষ। গরম মশলা ছাড়া আবার কচি পাঁঠার মাংস জমে? তিন বুড়োবুড়ির সম্মিলিত এবং কাতর অনুরোধে ঢেঁকি গিলে, পাঁচন খাওয়া মুখে, মাথা নামিয়ে হনহনিয়ে হাঁটছিল জিনি।  আশেপাশের সুবেশ নারী পুরুষদের মাঝে কি সাংঘাতিক বেমানান । হঠাৎ  এক সুবেশ বলিষ্ট বছর বত্রিশ তেত্রিশের যুবক ওর রাস্তা আটকে দাঁড়াল।  জিনি ক্রুদ্ধ তথা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকাতেই, সে বলে উঠল, “কি দেখছিস বে? শালা জিনি জিনি করে আধ ঘন্টা ধরে চেল্লাচ্ছি, কালা মদন। ” জিনি চিনতেই পারছে না, আমতা আমতা করে কিছু বলতে  যাবে, যুবক আবার বলে উঠল, “কি দেখছিস বে? চিনতে পারছিস না? এরম করিস না শালা, নতুন বউয়ের সামনে ইজ্জত কা ফালুদা হয়ে যাবে মাইরি। ” কাতর হয়ে জিনির হাত চেপে ধরল ছেলেটি, মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল জিনির মুখ, অংশু।  এ অংশু ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।  কত বছর হল, স্কুল ছেড়েছে বারো না কি পনেরো?

অংশু আর তার নবোঢ়া স্ত্রী জমিয়ে দিল নবমীর দুপুর।  সর্বাধিকারীদের বাড়িতে এত হইচই কস্মিনকালেও  কেউ শোনেনি।  দুপুরের  জমাটি পোলাও মাংসের পর সবাই গড়াগড়ি  দিতে লাগল, অংশু আর জিনি ফুঁকতে গেল চিলেকোঠার ঘরে, এই ঘরটাই জিনির নিজস্ব জগৎ।  করো প্রবেশানুমতি  নেই, তবে অংশু ব্যতিক্রম । জানলা দিয়ে গলা সোনার মত রোদ আজব আঁকিবুকি  কাটছে মেঝেতে।  পাশাপাশি শুয়ে বহুযুগ  বাদে দুই বন্ধু সিগারেট ধরালো।  পলকে মনে হল জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে পনেরোটা বছর।  কিছু কথা, কিছু নীরবতায় স্মৃতিচারণ।  হঠাৎ অংশু বলে উঠল,“ বিয়ে করলিনি জিনি?” জিনি জবাব দেবার প্রয়োজন অনুভব করল না। অংশু বলেই চলল, “ আর কতদিন যোগিনী হয়ে থাকবি। এদিকে তুই অনূঢ়া রয়ে গেলি, ওদিকে অঙ্কিত ও একা। ওর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।  ও এখন কলকাতায়।  ”
কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিল জিনির।  ধড়মড় করে উঠে বসল। ‘অঙ্কিত ’ কত সহস্র বছর পর শুনল এই নামটা।  আপাত শান্ত সুজলা সুফলার ধরিত্রীর হৃদয়ে লুকিয়ে  আছে কত লক্ষ কোটি মেগাটন লাভা।  আজ কি আবার অগ্নুৎপাত হবে?
কোন ক্লাসে প্রোপজ্ করেছিল? ক্লাস থ্রি বোধহয়।  জিনি আর অঙ্কিত ছিল অবিচ্ছেদ্য জুটি।  ছকে ফেলেছিল জীবন, ওদের পুরানো পাড়া কসবাতেই ফ্লাট কিনবে, বেডরুমের  রঙ হবে লাইল্যাক।  নাইট ল্যাম্প ব্লু।  রোজ রাতে হাল্কা লয়ে বাজবে ব্রায়ান অ্যাডামস্ না হলে জর্জ মাইকেল।  দক্ষিণের খোলা বারন্দা দিয়ে হুহু করে বাতাস এসে টুংটাং  করে বাজাবে উয়িন্ড চাইম। একটিই সন্তান হবে, ছেলেমেয়ে যাই হোক, নাম হবে “বাপন”।
মেডি পড়তে চলে গেল নাগপুর।  চিঠিপত্র আদানপ্রদান  চলত, কমে এল তাও। সে বার পূজার ছুটিতে দু চার দিনের জন্য বাড়ি এসেছিল অঙ্কিত, ফ্লাইটে।  প্লেনেই ফিরবে, শুধু মায়ের আব্দার তাই। জিনি পাগল হয়েছিল এক ঝলক দেখার জন্য। অঙ্কিতের আর অবকাশ হয় না। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ এল, অঙ্কিত ওর হাত ধরে, গভীর আবেগের সাথে জানাল,“ছেলেবেলার পাগলামি আঁকড়ে বাঁচিস না। গ্রো আপ জিনিয়া।” জিনি অতি কষ্টে বুঝতে পারল, ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। অঙ্কিত সব সম্পর্ক শেষ করে চলে যাচ্ছে। এত সোজা? এভাবে আছড়ে ফেলে দেয়া?
ভুলতে পারে নি জিনি। বারবার চিঠি লিখেছে, জানতে চেয়েছে কেন? কেন? কেন? জবাব আসেনি।  অঙ্কিত শুধু দুলাইন লিখেছিল,“আই অ্যাম নট ইয়োর কাপ অব টি।  নিজের স্টান্ডার্ডের কাউকে খুঁজে নে।”
মা শুনে বলেছিল ওর জীবনে অন্য কেউ আছে।  জিনির বিশ্বাস হয়নি। এই সময় বাবার মৃত্যুপথযাত্রী নিঃসন্তান পিসি তাঁর শোভাবাজারের বাড়িটা ওর বাবার নামে লিখে দেয়। জিনিরা কসবা ছেড়ে চলে আসে। সচেতনভাবে কোন পুরোনো বন্ধুর সাথে জিনি যোগাযোগ  রাখেনি। এমনকি ফেসবুকেও ও নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলেনি। সহকর্মী তথা ছাত্রছাত্রীদের চাপে ও ফেসবুক করে বটে, এখানে ওর নাম,“ আলতা- মাধবী”।

 আননবই এ অঙ্কিতকে অবশ্য খুঁজে  বার করেছে জিনি।  রোজ সকাল সন্ধ্যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অঙ্কিতে প্রোফাইল দেখা ওর প্রাত্যহিক রুটিনের অঙ্গ।  মা জানে, কাছাকাছি থাকলেই ওর ছবি দেখে শাপশাপান্ত করে।  জিনি বিরক্ত  হয়, কিন্তু মায়ের ঐটুকুই বিনোদন। অঙ্কিত চলে যাবার পর জিনি কোন সম্পর্কে জড়ায়নি।  সম্পর্ক বলতে যেখানে  দৈহিক এবং মানসিক উভয় ইনভল্ভমেন্ট জড়িত, নাহলে খুচরো  দৈহিক  সম্পর্ক অগুন্তি হয়েছে। এ ব্যাপারে জিনি নিজেকে আদৌ বঞ্চিত করেনি।
অঙ্কিতের বিয়ের সংবাদ অবশ্য ও আননবই মারফৎ পায়নি, তখন ও রাকেশকে ডেট করত।  কোন একটা হলিউড ছবি দেখতে গিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে দেখেছিল ওদের।  মেয়েটি জিন্স টপ পড়লেও সদ্যবিবাহিত বোঝাই যাচ্ছিল।  হেসে হেসে কথা বলছিল ওরা। জিনি রাকেশের বিশাল বপুর আড়ালে দমবন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। মাথা ঘুরছিল, সাথে প্রচন্ড  বমিবমি ভাব।  ওরা একটা রোমান্টিক  হিন্দি ছবি দেখতে ঢুকে গেল।  জিনি আর দাঁড়ায়নি।  ধুম জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।  মা সব শুনে শাপশাপান্ত করেছিল, “ আমি যদি বামুনের মেয়ে হই, এ বিয়ে টিকবে না। হারামজাদার ডিভোর্স হবেই হবে। জেল ও হবে। ” বাবা অবশ্য পাশ থেকে ফোড়ন কেটেছিল,“ ব্রাম্ভণের সে তেজ নেই, সিং নেই আর লেজ নেই। ”

 সত্যই বিচ্ছেদ হল তাহলে?  তাই কিয়ৎকাল ধরে অঙ্কিতের রিলেশনশিপ স্টেস্টাস,“ ইটস্ কমপ্লিকেটেড” ? অংশু বকেই যাচ্ছে, “ বোঝ জিনি।  ওকে একটা সুযোগ দে। ও প্রায়ই তোর কথা বলে। ” জিনি শীতল স্বরে বলল, “ আমি কাউকে ফোন করতে পারব না। ”
“ বুঝেছি।  ও করবে?” জিনি নিরুত্তর।

আজ বিজয়াদশমী।  মা আর মাসি গরদ পড়ে হেব্বি মাঞ্জা দিয়ে বরণ করতে গেছে, বাবাও ময়ুরপুচ্ছ ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি সাথে কোলাপুরি চপ্পল পড়ে লটরপটর করতে করতে গেল। জিনি ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে, হঠাৎ মুঠো ফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠল, অচেনা নম্বর, হৃদপিণ্ডটা কি ফেটে যাবে?  “ হেলো!”
বহুযোজন দূর থেকে ইথারনেটে ভেসে এল এ কার স্বর? “ শুভ বিজয়া। ”
“শুভবিজয়া।  কে বলছেন?”
“গলাটা কি এতটাই পাল্টে গেছে জিনিয়া?” জিনি জবাব দিতে পারল না। কলকাতার বাতাসে অক্সিজেনের  কি হঠাৎ অভাব হল? শ্বাস নিতে এত কষ্ট ! অঙ্কিত বলেই চলেছে, “ আমার জন্য বিয়ে করলে না জিনি? আমি খুব গর্বিত, আমাকে একজন এত ভালবাসে। আমি তোমাকে  বিগত এক বছর ধরে খুঁজে  চলেছি। যা ঘটে গেছে সব ভুলে এস আজকের এই পবিত্র দিনে আমরা নতুন করে শুরু করি।  ” হঠাৎ হাসি পেল জিনির, “ অঙ্কিত আমি বিয়ে না করলেও অন্ততঃ পাঁচ ছয় জনের অঙ্কশায়িনী হয়েছি। ” থতমত খেয়ে গেল অঙ্কিত, “ পাঁচ ছয় জন? যাক কি আর করা যাবে। নতুন করে শুরু করি এস। ”
“দাঁড়াও।  নতুন করে শুরু করার আগে পুরোনোটা তো শেষ করতে হবে। কি বলেছিলে তুমি? আমি তোমার যোগ্য নই”
“ তোমার সব মনে আছে জিনি? কিছু ভোলোনি দেখছি” গর্বিত স্বরে বলে উঠল অঙ্কিত ,“ এত ভালবাস আমায় আজো?” অঙ্কিতের গদগদ স্বরে গা গুলিয়ে উঠল, জিনিয়ার, “ আমি নিজেকে ভালোবাসি।  অপমান আমি ভুলতে পারি না। যাই হোক সম্পর্ক শেষ হওয়া নিয়ে কোন অভিযোগ নেই, শিট হ্যাপেন্স।  কিন্তু কেন? সেটা জানার অধিকার আমার সেদিনও ছিল, আজ ও আছে। ” ইস্পাত কঠিন স্বরে বলল জিনিয়া।  মা দুর্গা এগিয়ে আসছেন, ঢাকের আওয়াজ তীব্র হচ্ছে।  অঙ্কিত আমতা আমতা করে বলল,  “ আসলে মা”।  “ মা? মা তো আজোও আছেন। নয় বছরের সম্পর্ক একটানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে মায়ের জন্য? ওয়াও। যদি বলতে অন্য কেউ এসেছিল, বলতে আজ আর মনে নেই, মেনে নিতাম।  মা বড্ড দুর্বল লজিক সোনা। ”  
অঙ্কিত চুপ করে রইল।  জিনি বলল, “রাখছি।  আমরা দীর্ঘ তের বছর একসাথে পড়াশোনা করেছি, সে অধিকারে তুই একশ বার আমায় ফোন করতে পারিস।  কিন্তু বাবার ভাষায় থুথু ফেলে থুতু চাটিস না।  প্লিজ। ” মা দুর্গা ঠিক ওদের বাড়ির নীচে, পাড়ার কচিকাচা গুলো উদ্দাম নাচ জুড়েছে, সবাই ডাকছে ওকে। ইশারায় জিনি জানাল আসছে।  ফোন কেটে দুদ্দাড় করে নিচে নামছে জিনিয়া, নামতে নামতে আলতা- মাধবী মুছে ফেসবুকে নিজের নাম লিখছে জিনিয়া সর্বাধিকারী।
#Amiani #AninditasBlog

Saturday 10 October 2015

সহযাত্রী –অন্তিম পর্ব


 পয়লা জানুয়ারি। বৎসরের প্রথম দিন নিত্যযাত্রীদের ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। তবে ট্রেন ফাঁকা নেই। ভ্রমণ পিয়াসী জনগণের চাপে লেডিস কামরায় পা রাখাই দায়। তার ওপর বেলুন, বাঁশি আর খেলনা ওয়ালাদের দাপট। কোন মতে ওরা চারজন একটি কোণায় গুটি সুটি হয়ে বসেছিল। পাশকুড়া স্টেশনে আরযু যেন ওদেরই প্রতীক্ষা করছিল। ভিড়ের মধ্যে ত্রস্তা হরিণীর মত দুটি চোখ ঠিক খুঁজে বার করল ওদের, ঊষা ও হাত নেড়ে ডেকে নিলেন। কোনমতে একটু জায়গা হল আরযুর বসার মত। মুখ চোখ শুকনো। চোখের চার দিকে পুরু কালির পোঁচ। চোখ দুটি যেন রসাল ফলের মত টুসটুস করছে, টুসকি মারলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়বে সব গ্লানি। ঊষা ভালো করে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, “হ্যাঁ রে, আজ্জু, কাল রাতে ঘুমোসনি?” আরযু কোন মতে চোখের জল চেপে মাথা নাড়ল। তারপর ঊষার বুকে মাথা ডুবিয়ে দিল। ঊষা দুই বাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরল সদ্য পরিচিত মেয়েটিকে। মৃদু স্বরে আওড়াতে লাগল গত কালের প্রতিশ্রুতি। “ ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আমি বলেছি না।” নবনী এত ক্ষণ শ্যেন দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল। হটাত প্রশ্ন করল, “আরযু তুমি আবার ওকে ফোন করেছিলে?” আরযু মুখ না তুলে কাঁপতে কাঁপতে জানাল, করেছিল এবং যথারীতি অপমানিত হয়েছে। নবনী ঈষৎ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, “ ঊষাদি তোমার প্রিয়তমকে ফিরিয়ে দেবার জন্য কতদূর কি করতে পারবে আমি জানি না, তবে আমার একটা উপদেশ যদি শোন তাহলে, সে ফিরে আসলেও আসতে পারে।” দ্রুত মুখ তুলল আরযু, নবনী না থেমে বলেই চলল, “ তুমি আগামী তিন মাস ওর সাথে কোন যোগাযোগ রেখ না। ফোন কর না। করলেও ধর না। দেখা হলেও মুখ ঘুড়িয়ে চলে যাবে। যদি ওর মনে তোমার প্রতি কোন অনুভুতি অবশিষ্ট থেকে থাকে ও অবশ্যই ফিরে আসবে।” দপ করে নিভে গেল চোখের আলো। আরযু আবার কাঁদতে লাগল। “আমি পারব না দিদি। মরেই যাব। দিক গালি, তবু দিনান্তে একবার ঐ কন্ঠ না শুনলে যে মরেই যাব।” লিপি কঠোর স্বরে বলল, “কিচ্ছু মরবে না। নবনী দির কথা যদি না শুনতে পার তাহলে অন্তত যতদিন কাকিমা তোমার জন্য চেষ্টা করছে, ততদিন কথা দাও ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না।” আরযু নিমরাজি হল। ট্রেনটাও ফাঁকা হয়ে এসেছে। শিলা এবার ঊষা কে জিজ্ঞাসা করল, “ তুমি কি করবে কিছু ভেবেছ? কথা বলবে কি?” ঊষা একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ শোন খড়গপুরে একটা কালি মন্দির আছে। ঐ মন্দিরের যিনি পাণ্ডা উনি ভালো হাত দেখতে পারেন। ওষুধ টষুধ ও দেন। আমি নানা ভাবে বিপদে পড়ে ওনার কাছে গেছি, উনি আমায় রক্ষা করেছেন। এক বার তো এমন বিপদ যে ভাবলাম বাড়িই বিক্রি করে দেব,” লিপি মাঝ পথেই ওনাকে থামিয়ে দিল, “আরযু তোমার ঐ ছেলেটির নাম কি?” আরযু কিছুক্ষণ নীরব থেকে জানাল, “ ওসমান আলি।” লিপি হাত নেড়ে বলল, “হয়ে গেল কাকিমা। ওসমান আলির জন্য মা কালি? চলবে না।” ঊষা তাও নাছোড়বান্দা। “মায়ের কাছে আবার সন্তানের জাত কি রে?” তাও একটু ভেবে বললেন, “ আজ্জু তাও আমি একবার ঠাকুর মশাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি কেমন?” আরযু হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।
ঊষার পুরোহিত মশাই আপত্তি করেননি। দ্বিপ্রহরে ওরা চারজন গিয়ে উপস্থিত হল মায়ের দরবারে। নবনী আসতে পারেনি। জায়গাটা গ্রাম গ্রাম।বেশ ফাঁকা। সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে, ওপরে মা করাল বদনী রক্তাত জিহ্বা বার করে দাঁড়িয়ে আছেন, সিঁড়ির নিচে একটি ঘরে এক ভদ্রলোক বসে বসে কথা বলছিলেন। শিলা এবং লিপি জল্পনা করেছিল, নির্ঘাত রক্ত বর্ণ পোশাক মস্তকে রক্ত তিলক কাটা, রক্ত চক্ষু, এক মুখ গোঁফ দাড়ি, গালপাট্টা ওলা কাপালিক হবে, কিন্তু দেখা গেল,চোখে চশমা, পরনে ধুতি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি এক অতি সাধারণ দেখতে ভদ্রলোক। ঊষা এক গাল হেসে কুশল বিনিময় করল। অতঃপর আরযুর সাথে পরিচয় করিয়ে  দিয়ে বলল, “দাদা এই যে আমার মেয়ে আজ্জু। বড় ভালো মেয়ে দাদা। বড় ব্যথা পেয়েছে। একটু দেখুন না, মায়ের দয়ায় যদি ছেলেটি ফিরে আসে।” আরযু ঢপ করে প্রণাম করে বসল। ভদ্রলোক সংকুচিত হয়ে বললেন, “থাক মা থাক। মায়ের মন্দিরে আর কারো পদস্পর্শ করা উচিৎ নয়। তোমার বাঁ হাতটি একটু দেখাও।” একটি বিশাল আতশ কাঁচ দিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন, আরযুর দুটি হাত। অতঃপর বললেন, “নাম কি?” আরযু নাম জানাল। ঠাকুর মশাই আঁখি বন্ধ করে কিয়ৎ ক্ষণ বসে রইলেন, অবশেষে জানালেন, “ ওসমান আলি নামের লোক কখনই কোন সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে না।” লিপি ফট করে বলে উঠল, “ কেন ঠাকুর মশাই বিধর্মী বলে?” উনি মৃদু হেসে বললেন, “নারে মা। মায়ের কাছে আবার সন্তানের ধর্ম কি? ও সব ভেদাভেদ তো আমরা করি। সংখ্যা তত্ত্বের নিরিখে বিশ্লেষণ করে বললাম।” আরযুর দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, “মন শক্ত কর মা। আমি তবু দেখব মাকে বলে। আসছে শনিবার যজ্ঞ আছে মায়ের, রাত আটটার পর দিদি আপনি আমায় ফোন করবেন, আমি বলে দেব মায়ের কি নির্দেশ।” ঊষা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ফেরার পথে লিপি শুধু বলল, “দেখ শিলু এরা কি অসম্ভব মাস সাইকোলজি বোঝে। আরযুর দৈহিক ভাষা থেকেই উনি সাফ বুঝতে পেরেছেন, এ সম্পর্ক জোড়া লাগানো অসম্ভব। ভাঙলেন তবু মচকালেন না।” আরযুকে দেখে অবশ্য বেশ খুশি খুশি লাগছিল। শিলালিপি অস্ফুটে বলল, “বিশ্বাসে যদি মিলায় বস্তু।” লিপি রেগে বলল, “ বাল মিলবে শালা।”
শনিবার রাত্রে ঊষা দুরাভাষ মারফৎ বাকি তিন সখিকে জানাল, ওনার ‘দাদা’ জানিয়েছেন, এ সম্পর্ক জোড়া লাগার কোন সম্ভবনাই নেই। তবে গ্রহ শান্তির যজ্ঞ করে দেখা যেতে পারে। সোমবার ঊষা রাগে গরগর করতে করতে বলল, “ ফেরেব্বাজে দেশ ছেয়ে গেল। দৃশ্যত হতাশ এবং ক্লান্ত আরযু আজ আর বসে থাকতে পারেনি। ঊষাঙ্গিনির কোলে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ট্রেনের ফাঁকা সিটে। জমিয়ে শীত পড়েছে, সব জানলা বন্ধ, তবু দরজা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। নবনী উত্তপ্ত স্বরে বলল, “তোমাকে বলেছিলাম ঊষাদি, মা কালীর দ্বারা হবে না। ফকির খোঁজো।” ঊষাঙ্গিনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ চুপ করছু। শোন না আজ্জু, আমি খোঁজ নিয়েছি, ঘোড়াঘাটায় এক পির বাবা বসেন। খুব ভাল। ওনার ওষুধ অব্যর্থ। আমাদেরই অফিসে একটি মেয়ের প্রায় ডিভোর্স হয় আর কি। পির বাবা এমন ওষুধ দিলেন, এখন দিব্যি আছে দুজনে।” নবনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ আরে আমাদের সরস্বতীদির মেয়েকেই তো মেরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা বোবা মেরে গিয়েছিল জানিস। সরস্বতীদি বলল, পির বাবার ওষুধ খেয়ে অনেক ভাল আছে।” নবনী অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কাঁধ নাচাল। ঊষা রেগে বললেন, “নেকাপড়া জানা মেয়ে গুলোর সবেতেই অবিশ্বাস।”
মঙ্গলবার দিনই পির বাবার কাছে আরযুকে নিয়ে গেল ঊষা। বাকিরা কেউ আর অফিস ছেড়ে যেতে পারল না যদিও। বুধবার আরযু এল না। ঊষা জানাল, আরযু দেশের বাড়ি গেছে, পির বাবা যে ওষুধ দিয়েছেন, বাড়ির পশ্চিম কোণে যে গাছ আছে, তাতে বাঁধতে হবে। পীর বাবা বলেছেন, হাওয়ায় যেমন যেমন ঐটি দুলবে, ওসমান আলির হৃদয় ও উদ্বেল হয়ে উঠবে আরযুর জন্য। রুদ্ধশ্বাসে ওরা অপেক্ষা করতে লাগল সুখবরের জন্য। কার যেন বিয়ে ভাঙতে ভাঙতে আটকে দিয়েছেন পীর বাবা। ঊষা পইপই করে আরযুকে বলে দিয়েছেন, ওসমান আলি ফিরে এলেই ওদের ফোন করতে। রবিবার অবধি কোন ফোন এল না।
 সোমবার আরযুকে দেখেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরযুকে আগের থেকে একটু ভাল লাগছিল দেখতে, ন্যুব্জ শিরদাঁড়া যেন একটু ঋজু হয়েছে। আরযু হেসে হেসেই ওদের জানাল, তাবিজটা কদিন ধরে হাওয়ায় খালি দুলছে আর দুলছে। ওসমান আলির টিকিও দেখা যায়নি। আরযুও যোগাযোগের চেষ্টা করেনি।
এবার কিংকর্তব্য? ঠাকুর তাবিজ সবই হল। শেষ উপায় একটিই অবশিষ্ট আছে, ওসমান আলির সাথে কোন তৃতীয় ব্যক্তির কথোপকথন। কি কারণে এই ভুল বোঝাবুঝি সেটা জানা গেলে, পরে প্রয়োজনে দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে ত্রিপাক্ষিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যদি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যায়। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, কাল ঊষাঙ্গিনি কথা বলবে ওসমান আলির সাথে। মাঝে শুধু আজকের রাত। নেমে যাবার আগে আরযুকে বারংবার নিষেধ করা হল, কোন ভাবেই যেন ওসমানের সাথে যোগাযোগ না করে। আরযু ঘাড় নেড়ে জানাল, “পাগল নাকি? তোমরা আমার জন্য এত করছ, তোমাদের আদেশ শিরোধার্য।”    
 পরদিন সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে চাপল, কিন্তু সমস্ত উত্তেজনায় জল ঢেলে দিল আরযু। পইপই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও বিগত রাতে সে ওসমান আলিকে ফোন করেছিল। শুধু তাই নয়, ওসমান যাতে দ্রুত  ফোন কেটে না দেয়, বাক্যালাপকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিগত কদিন ধরে ঊষাঙ্গিনি, নবনী, লিপিলেখা এবং শিলালিপি ওর জন্য বা বলা যায় ওদের জন্য কি করেছে, সবিস্তারে বর্ণনা করেছে ওসমান আলিকে। মূর্খ বালিকা ভেবেছিল ওসমান প্রেমে গদগদ হয়ে ওর বান্ধবীদের কৃতজ্ঞ চিত্তে ধন্যবাদ জানাবে। বাস্তবে হল, ঠিক উল্টো। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে চারটে ধুমসি মিলে এত কাটাছেড়া করেছে, শুনে ওসমান তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তার ওপর ওকে বশীকরণ করার চেষ্টা সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, খিস্তি খেউরের বন্যা বয়ে যায়। আরযু এদিন নীরব শ্রোতা ছিল না, ওসমান আলির কিছু বাছাই করা গালি স্ট্রেট ব্যাটে ফিরিয়ে দেয় আরযু। শেষ পর্যন্ত ওসমানকে বরাহনন্দন এবং ওসমানের মাকে বারবনিতা বলে ফোন কেটে দেয় আরযু।
বাকি চার মহিলা উৎফুল্ল হয়ে পিঠ থাবড়ায়, “ ঠিক করেছিস আরযু। আরও আগে করা উচিৎ ছিল। মামুলী ক্লাস এইট পাস জমির দালাল, কোন সাহসে তোর মত মেয়েকে ওসব বলে।” আরযু মাথা নিচু করেই বসে থাকে, মুক্ত বিন্দু ঝরতেই থাকে অঝোরে। অবশেষে হাল্কা নাকি সুরে বলে ওঠে, “আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না, কাকিমা। প্লিজ কিছু কর।” তীব্র আকুতি ভরা দুটি চোখ ঘুরতে থাকে চার জনের ওপর।
এরপর বেশ কিছুদিন আরযু এল না। ওরা প্রথমে আমল দেয়নি, ভেবেছে বাড়ি গেছে হয়ত। ফোন ও বন্ধ। তীব্র দুশ্চিন্তায় পাগলপারা হয়ে উঠল বাকি চার বান্ধবী। আরযুর অফিস শিলা আর লিপির অফিসের নিকটেই। সপ্তাহখানেক বাদেও যখন আরযু ফিরল না, বাঁ কোন রকম যোগাযোগ করা গেল না, লিপি আর শিলা উদ্বেগ চাপতে না পেরে আরযুর দপ্তরে গিয়ে হাজির হল। অফিস না জাহান্নম। লোকে আড়ালে বলে, ঐ অফিসে সারা মাস মাইনে হয়, আর একদিন বোনাস। হাওয়ায় টাকা ওড়ে, সন্ধ্যের মুখে নাকি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে লাল শালুতে মুড়ে বখরা চলে যায় সবথেকে বড় সাহেবের কাছে। দুটি মেয়েকে দেখে প্রথম চোটেই বাবুটি বুঝে গিয়েছিলেন, এরা মাল দিতে আসেনি। তবু প্রশ্নের উত্তরে চিরতার জল খাবার মত মুখ করে জানালেন, “ কি হয়েছে জানিনি। আসছেননি। ফোন ও ধরছেননি।” লিপি তবু নাছোড়বান্দা। “বাড়ির ঠিকানাটা যদি পাওয়া যায়। আমরা ওর বন্ধু।” বাবুটি মাছি তাড়াবার ভঙ্গীতে জানালেন, “ অনাত্মীয় ব্যক্তিকে ঠিকানা দিতে পারবনি। নিয়ম নেই।”
হতাশ হয়ে ওরা ফিরে আসছে, একটি দালাল টাইপ লোক ইশারায় ডাকল। “আজ্জু দিদিকে খুজছেন? বড় ভালো মেয়ে ছিল গো। পাপের আখড়ায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। নির্ঘাত চাকরী ছেড়ে দিয়েছে।” “ওনার বাড়ি কোথায় জান?” ওরা আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল। লোকটি হেঁসে বলল, “ওনাদের গাঁয়ের নাম জানি। তবে আপনারা যেতে পারবেননি।”
“কেন?”
“কাগজে পড়ছেননি কি সব হচ্ছে? নির্বিচারে খুন জখম, মেয়েদের ওপর অত্যাচার চলছে।” “সে কি? কেন?” “ আরেঃ এই তো কদিন আগেই সতেরো জন লোক কে মেরে কেটে পুড়িয়ে দিল। কেউ ঢুকতে পারছে না, ঐ মহল্লায়। জমি নিয়ে বিবাদ, সেখান থেকে   ” লোকটি আর কথা শেষ করল না।
দিন কাটতে লাগল আপন ছন্দে, শুধু ওদের চারজনের যেন কেমন তাল কেটে গেল। মাত্র কদিনের আলাপ, তাও ওদের দৈনিক আলাপচারিতা জুড়ে শুধুই আরযু। সত্যি আরযু দের মহল্লায় ব্যাপক গোলমাল। সাংবাদিক রাও ঢুকতে পারছে না। রোজই কাগজে বের হচ্ছে। বিদগ্ধ জনেরা মোমবাতি মিছিল করছে, বোকা বাক্স ফাটিয়ে দিচ্ছে লোকজন। রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে ওদের অঞ্চলের নাম। সবাই আলোচনা করছে, করছে না কেবল চার রমণী। প্রত্যহ ওরা তন্নতন্ন করে খোঁজে, মৃতের তালিকায় কোন আরযু চৌধুরী বা ওসমান আলির নাম আছে কি না। থাকে না।  কটা লোকেরই বা থাকে। বন্ধ থাকা ফোনে রোজই ফোন করে শিলা বা লিপি। আরযুর অফিসেও যোগাযোগ রাখা হয়, কিন্তু আরযু নিপাত্তা।
মাস খানেক পর লিপিলেখা একদিন শিলালিপিকে জানাল, “ আমি মাস খানেকের মধ্যেই বিয়ে করছি।” “মানে? এত তাড়াতাড়ি? দু বছর পরে করবি বলেছিলি?” জানাল হতভম্ব শিলা। লিপি চোখ সরিয়ে জানাল, “ আর পারছি না রে। আরযুকে দেখার পর থেকেই কেমন যেন তরাশে  আছি। কেবলই ভয় করে, যদি ওসমানের মত রণজয় ও? কি করে বাঁচব রে?” শিলা বিমর্ষ ভাবে জানায়, “ সত্যি আরযুকে কত বলতাম, ছেড়ে দে, মেরে আয়, লাথ মার, গুলি মার। অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে?”
বিয়ে করে চলে গেল লিপিলেখা। চাকরী ছেড়ে সুদূর দক্ষিণ ভারত। নবনীর হঠাৎ করে সন্তান সম্ভবনা দেখা দিল। রয়ে গেল শুধু ঊষাঙ্গিনি আর শিলালিপি। আর একরাশ সুখ স্মৃতি। আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসছিল বাঁধন। ডেইলি পাষণ্ডদের বন্ধুত্বের এটাই ভবিতব্য, পথেই শুরু, পথেই শেষ। কেউ কেউ লিপির মত বিদায় জানাবার সুযোগ পায়, কেউবা আরযুর মত আচমকা হারিয়ে যায়।
সব সয়ে যায়। যাবার আগে লিপিলেখা গালে চুমু খেয়ে বলেছিল, “ আমিই যোগাযোগ রাখব। কিচ্ছু ভাবিস না। ছেড়ে যাচ্ছি না।” পৌঁছে সত্যি ফোন করেছিল। ব্যস তারপর আর কোন খবর নেই। শিলালিপির বস ইতিমধ্যে বদলে গেছেন। নতুন বস এসে পুরো অফিসটাই শিলার হস্তে সমর্পণ করেছেন। তাতে শিলা যৎপরনাস্তি উল্লসিত। পুরানো সাদাকালো অফিস যেন হঠাৎ রামধনু রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। অরকুটের নেশাও জমিয়ে ধরেছে। অবসর পেলেই অরকুট। কটা স্ক্রাপ এল? কে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল? শিলালিপির পরিচিত খুব বেশিজন অবশ্য অরকুটে নেই। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ব্যাপারটাই দুর্বোধ্য ওর পরিমণ্ডলে। কিন্তু এ এমন এক কাঁঠাল যার আঠা আদৌ ছাড়ে না। খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে অর্কুট। হঠাৎ একদিন লিপিকে পেয়ে যায়, না আসলে, লিপিলেখাই ওকে খুঁজে বার করে। অফিসে ঢুকে, ক্যম্পুটার চালাতেই দেখে, লিপির স্ক্রাপ, “ ওরে কত কষ্ট করে তোকে খুঁজে বার করলাম। বরকে গ্যালন গ্যালন তেল দিয়ে এসব শিখলাম, তোর জন্য, আর তুই কি সেটিংস লাগিয়েছিস মাইরি, কিছুতেই ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারছি না।” আনন্দে চোখে জল এসে যায় শিলালিপির। কে বলে সহযাত্রীদের সম্পর্ক পথেই হারিয়ে যায়? কিচ্ছু হারায় না মশাই।  হয়তো কোনদিন আরযুকেও এভাবেই ওরা খুঁজে পেয়ে যাবে, কে বলতে পারে? জীবন সমুদ্র সম কিছুই হারায় না।
#Aninditasblog #AmiAni

Saturday 3 October 2015

সহযাত্রী পর্ব- ৫-৭


ঊষাঙ্গিনি যেদিন লিপিলেখার সাথে শিলালিপির পরিচয় করিয়ে দিলেন, সাময়িক ভাবে শিলালিপির মনে হল, নিজেরি প্রতিচ্ছবির সাথে পুনঃ পরিচিত হল। দুজনেরই মাঝারি উচ্চতা, হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, গৌর বর্ণ, গোল মুখ, তফাৎ বলতে লিপিলেখা মাথায় একটু লম্বা আর শিলালিপির কেশদাম একটু বেশি লম্বা। ভাব জমতে দেরি লাগল না। উপরন্তু দুজনের অফিসও একই পাড়ায়, ফলে ট্রেন থেকে নেমে বাকি রাস্তাটাও  দুজনে একসাথেই যায়। লিপিলেখা দীর্ঘ দুই বৎসর পশ্চিম বঙ্গের বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছে, স্বভাবতই একটু বেশি স্মার্ট। আজকাল আর ওরা স্টেশন থেকে বেড়িয়ে অটো ধরতে দৌড়য় না, বরং ভাগাভাগি করে রিক্সায় চাপে। দরাদরি বা ঝগড়া করার ব্যাপারে লিপিলেখা রীতিমত দক্ষ। শিলালিপি প্রথম দিন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, আপাত শান্ত, মিষ্টি লিপিলেখার ঝগড়া দেখে, লিপিলেখা পরে বুঝিয়েছিল, “ওরে মদন, গ্রুপে ঝগড়া করা আর ঝাড়ি মারার মজাই আলাদা। এখানে আর কাকে ঝাড়ি মারব? তাই একটু ঝগড়াই করে নিলাম।”
তবে ঊষাঙ্গিনি, শিলালিপি আর লিপিলেখার বন্ধুত্ব জমে ক্ষীর হয় যখন নবনী এসে ওদের সাথে মিলিত হয়। নবনী হল এই চতুষ্কোণের সবথেকে বর্ণময় অঙ্গ। নবনী এক গুঢ় রহস্য। ঊষাঙ্গিনির মত ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা নবনীকেও প্রকাশ্যে এড়িয়ে চলে। অথচ নবনীর গুণের শেষ নেই। নবনী হস্তরেখা বিশারদ, গ্রহ শান্তি বিশারদ, কোন দিনে কোন রঙ পরলে সব গ্রহ খুশি থাকে, তা নবনীর নখ দর্পণে। নবনী শুধু জানেই না, অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলে। প্রতি সোমবার নবনী সাদা শাড়ি পরে আসে, মঙ্গল বার লাল, বুধ বার সবুজ ইত্যাদি ইত্যাদি। রামদেব বাবার একনিষ্ট ভক্ত। রোজ প্রাণায়াম করে, এবং দাবি করে প্রতিনিয়ত নাকি ২৫গ্রাম করে ওজন কমছে। প্রসঙ্গত নবনী একটি ছোট্ট খাট্টো ননীর পাহাড়। তবে লিপিলেখা আর শিলালিপির কাছে নবনীর সবথেকে আকর্ষণীয় গুন হল তার অফুরন্ত আদি রসের ভাণ্ডার। ঐ রকম লক্ষ্মীশ্রী মার্কা এক বছর ত্রিশের বঙ্গনারী এবং এক সন্তানের জননী যে ঐ রূপ আদি রসে টইটুম্বুর হতে পারে, তা নবনীর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ না থাকলে লিপিলেখা আর শিলালিপি জানতেও পারত না। পরিচয় জমার দিন দুয়েকের মধ্যেই নবনী ঊষাঙ্গিনি, লিপিলেখা আর শিলালিপির সামনে আক্ষরিক অর্থে নিজের স্বামীকে বিবস্ত্র করে দিল। নবনীর মতে তার স্বামী বাঙালি নয়, শক্তি তথা সামর্থে পাঞ্জাবি সমতুল। পুঙ্খনাপুঙ্খ ভাবে শুধু নিজের বরের দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনাই নয়, ফুলশয্যার রাত্রের প্রতিটি মুহূর্ত সবিস্তারে বর্ণনা করতে শুরু করল। লিপিলেখা আর শিলালিপি লজ্জায় লাল বেগুনী হয়ে গেলেও নীল ছবি দেখার মত মুখ করে শুনছিল। এত উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে নবনীও পূর্ণ উদ্যমে সবিস্তারে বলে যাচ্ছিল, কিন্তু রণে ভঙ্গ দিলেন, ঊষাঙ্গিনি, এত ক্ষণ উনিও লোলুপ ভাবে শুনছিলেন, কিন্তু শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে নবনী যখন নীল ছবি শুরু করেছে, উনি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, “ কি হচ্ছে, লবনী? তোর তো সাত আট বছর আগে বিয়ে থা হয়েছে, ওদের তো এখনও বাকি। সব কি তুই বলে দিবি?” উত্তরে বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে নবনী বলল, “তাও বটে। তবে সব জেনে রাখাই ভালো। এই তোমরা বিয়ে করবে কবে? বয় ফ্রেন্ড আছে?” লিপিলেখা আর শিলালিপি দুজনেই জানাল আছে। অতঃপর নবনী জিজ্ঞাসা করল, “ কে কি করেছো?” লিপিলেখা আর শিলালিপি সমস্বরে বলে উঠল, “মানে?” নবনী চোখ মেরে বলল, “ নেকু। বয় ফ্রেন্ডের সাথে কে কি করেছো? আমি তো সব বললাম। এবার তোমাদের পালা।” বহু জোর জবরদস্তির পর দুজনেই জানাল, চুম্বনের বেশি কিছু না। শুনে আকাশ থেকে পড়ল নবনী। “অ্যাঁ?? কত দিনের সম্পর্ক?” লিপিলেখার পাঁচ আর শিলালিপির মাত্র এক বছর। কর্মসূত্রে লিপিলেখার বয় ফ্রেন্ড রণজয় থাকে সুদূর ব্যাঙ্গালোর আর শিলালিপির সৌর জলপাইগুড়ি। মাত্র এক বছর বলে সৌরকে আপাতত ছাড় দিয়ে রণজয়কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নবনী। “পাঁচ বছরের সম্পর্ক অথচ চুমু ছাড়া কিছু হয়নি??? শালা নির্ঘাত নপুংসক।” “নবনীদিইইইইইই” বলে চিৎকার করে উঠল লিপিলেখা। “ভাল হবে না বলছি।” নবনী অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে বলল, “ আরে তোমরা আমার ছোট বোনের মত। এটা সিরিয়াস ব্যাপার। না পরীক্ষা করে একদম বিয়ে করতে যেও না।” শিলালিপি দাঁত বের করে হাসছিল, নবনী তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমিও। ছেলেখেলা নয়।” হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে লিপিলেখা বলল, “ কি করে পরীক্ষা করব নবনীদি? সেটাও তো বলে দাও? পরীক্ষা করতে গেলেই তো ” বলে চোখ টিপল লিপিলেখা। হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খেল শিলালিপি, ঊষাঙ্গিনি ঠোঁট মুচড়ে, বলে উঠল, “মরণ।” কিন্তু নবনী অদম্য। “আরে এত দিনের সম্পর্ক, মানুষটার শরীরে একটা অঙ্গ আছে কিনা, সেটাও তোমরা দেখতে পারবে না?” নবনী চোখ গোল করে বলল।
 “তুমি দেখেছিলে বোধহয়?” বলল শিলালিপি।
“অবশ্যি। উফ আমার বরটা না পুরো পাঞ্জাবি মাইরি। জান ফুলশয্যার পরদিন আমাকে টিটেনাস দিয়েছিল।” গরবিনী পায়রার মত ঘাড় ঘুড়িয়ে জানাল নবনী।
“সে কি??? কেন???” সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল লিপিলেখা আর শিলালিপি।
 “দিতে হয়।” জবাবটা অবশ্য আর বেশি দিল না নবনী। তবে শারীরিক বিভঙ্গে বুঝিয়ে দিল অনেক কিছুই। সেদিন রাতে সৌর এবং রণজয় যখন যে যার প্রিয় বান্ধবীকে ফোন করল, শিলালিপি আর লিপিলেখা প্রথমেই নবনীদির গল্প শুরু করল। নপুংসক কিনা পরীক্ষা করার যে পদ্ধতি নবনী শিখিয়েছে, সেটা শুনে, সৌর বলল, “ হুম। আমার ঐ পরীক্ষায় বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তবে কাল তোমার নবনিদিকে জিজ্ঞেস কোর, অঙ্গটা আছে, তা নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু সেটা আদৌ কর্মক্ষম কিনা, সেটা কি ভাবে জানা যাবে? ” আর রণজয়কে লিপিলেখা যখন জানাল, যে ফুলশয্যার পরদিন বউকে টিটেনাস দিতে হয়, তা শুনে রণজয় আকাশ থেকে পরে বলল, “ কি সব আজগুবি কথাবার্তা। বাপের জন্মে শুনিনি। তোমার নবনীদির বরটা একটা গান্ডু।”
        যে কোন কারনেই হোক ঊষাঙ্গিনি, নবনী কে একদম পছন্দ করে না। সামনা সামনি অবশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই, গলা জড়িয়ে প্রায়ই গান গায় দুজনে, লিপিলেখা আর শিলালিপির জন্যই ওদের বন্ধুত্ব নাকি প্রগাঢ় হয়েছে, তাই দুতিন দিন ছাড়া ছাড়াই ওরা একবার করে বেসুরো গলায়, বেখাপ্পা স্বরচিত গান গায়, যদিও গানটা শুরু হয়, “এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।” কিন্তু আড়ালে ঊষাঙ্গিনি নবনীকে “মটকী” বলে ডাকেন। নবনী প্রায় দিনই ভাল ভাল শাড়ি পরে আসে আর সগর্বে ঘোষণা করে, “এই শাড়িটা আমার বর দিয়েছে।” উষাঙ্গিনির এতেই আপত্তি, নবনী না থাকলেই বলে, “ আমার বর দিয়েছে না হাতি দিয়েছে। তোরা জানিসনি, ও মটকীর কত গুণ। সাধে কি লেডিস কমপার্টমেন্টের কোন মেয়েছেলে ওকে দেখতে পারে নি? ওর অফিসে সুজন বলে একটা ছেলের সাথে মটকীর লটঘট ছিল। একদিন প্লাটফর্মে কি হাতাহাতি দুজনে।  আজকাল মটকী একটা বুড়ার সাথে ঘোরে, এই নিয়ে সুজনের সাথে মন কশাকশি। সুজন ওকে ভালবেসে সোনার বালা দিয়েছিল, এবার যখন বলছে ফেরত দে, মটকী আর দেয়নি। জানিস সুজন নিজে আমায় কেঁদে কেঁদে বলেছে, ‘ দিদি ও কুহকিনী। ডাইনি। ওর জন্য আমি আমার বউটাকে কত কষ্ট দিয়েছি। শাড়ি, সোনার বালা যা চেয়েছে দিয়েছি, সে আমার সাথে এমন করল।’”
“আহা রে। গলায় দেবার দড়িও জোটে না হারামজাদার। নবনীর কাছে লাথি খেয়ে বউ এর জন্য শোক উথলে উঠল। গান্ডু শালা। হারামি” লিপিলেখা রেগে অশ্লীল শব্দ বর্ষণ করতেই থাকে, আর শিলালিপি হাসতে হাসতে ট্রেনেই শুয়ে পরে।
মন্দ কাটছিল না ডেইলি পাষণ্ডগিরি। নবনীর আদিরস আর পরকীয়া, ঊষাঙ্গিনির গালমন্দ, নাচন কোঁদন আর এদের দুজনকে নিয়ে আবডালে শিলালিপি আর লিপিলেখার পরচর্চা। খড়গপুর স্টেশনের পাঁচ এবং ছয় নম্বর প্লাটফর্মের মাঝে একটি জুস কাউন্টার আছে। নিত্যযাত্রীরা সকলেই জানে ঐটি হল পরকীয়ায় নিমজ্জিত রাধা শ্যামদের অবাধ মিলনক্ষেত্র। একত্রে জুস খাওয়ার অর্থ হল, পরকীয়ার ওপর শিলমোহর পরা। ঐযে বলে না “ইটস্ অফিশিয়াল”। এই জুস কাউন্টারেই একদিন ওরা নবনীকে দেখেছিল সেই “বুড়া”র সাথে। ঘটনাচক্রে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দামামা বাজতেই  শিলালিপিদের কাজও আকস্মিক বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এই কর্মযজ্ঞে শিলালিপির প্রত্যক্ষ ভুমিকা না থাকলেও, মাঝে মাঝেই বসের নির্দেশে নানা ক্যাম্পে যেতে হত। শিলালিপি হতাশ হয়ে বলত, “গ্লামার কোশেন্ট বাড়াতে নিয়ে যায়। কি হচ্ছে কিছুই বুঝি না। করনীয় কিছু নেই, শুধু হুকুম তামিল করা।” ফলে পাঁচটার ট্রেন ধরা সর্বদা সম্ভব হত না। তবে ওদের বন্ধুত্ব এতই সুদৃঢ় ছিল যে, লিপি ঊষা এবং নবনী শিলালিপির জন্য অপেক্ষা করত। পরের ট্রেন পৌনে ছটায়। আসতে আসতে ছটা তো বটেই। এই সময় প্লাটফর্ম বেশ ফাঁকা হয়ে যেত। বেশ কিছু বাজারউলি, জনা কয়েক উর্দিধারী আর স্টলওয়ালা ছাড়া  বিশেষ কেউ থাকত না। এইটাই ছিল ঊষাঙ্গিনির সুবর্ণ সুযোগ। কাঁধে আর হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে গোটা প্লাটফর্ম চক্কর কাটত, কোথায় কোন উর্দিধারী কি তোলা তুলছে দেখার জন্য। দেখতে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত ঝগড়া করার জন্য। সাথে লিপিলেখা যথাযথ সঙ্গত দিত। কদাচিৎ নবনীও অংশ গ্রহণ করত। প্রায় দিনই শিলালিপি এসে দেখত ওর তিন বান্ধবী স্টেশনে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে বসে আছে। সেদিনও এসে দেখে তুমুল ঝগড়া চলছে, জনৈক উর্দিধারী ব্যক্তি আর কিছু না পেয়ে, এক ফুলওয়ালীর থেকে খানিক ফুলই তুলে নিয়েছে। ঐ উপরি ফুলে মায়ের পূজা করবে, এত বড় অনাচার? ঊষাঙ্গিনি যখন বলতে গেছে, লোকটি নির্বিকার ভাবে জবাব দিয়েছে, “ তা আপনিও নিন না। ” ফলত ঊষা আর লিপি ঝাঁপিয়ে ঝগড়া করছে, ভাগ্যিস তখন ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল বা অর্ন্তজালের এই দৌরাত্ম্য ছিল না, নাহলে নির্ঘাত সেদিন ওটাই ব্রেকিং নিউজ হত। শিলালিপিকে দেখে ওরা রণে ভঙ্গ দিল। সেদিন নবনী বলেই রেখেছিল, ও তাড়াতাড়ি ফিরবে। বাকি তিন কন্যা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে বসে গল্প করছে, ঊষাঙ্গিনি বীরদর্পে বর্ণনা করছে কেমন করে ওরা ঝগড়া করেছে, হঠাৎ লিপি বলে উঠল, “ নবনী দি না? হ্যাঁ নবনী মোটিই তো।” ঊষা আর শিলা ঘুরে দেখে, বাস্তবিকই নবনী। অত্যন্ত রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে কারো দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, এবং জুসে চুমুক দিচ্ছে। লাস্য চুইয়ে পড়ছে, প্রতিটি বিভঙ্গে। শিলালিপি বলে উঠল, “ কি বেহায়া মাইরি। জানে আমরা এই ট্রেনে ফিরব। তাও?” ঊষাঙ্গিনি প্যাঁচার মত মুখ করে বলল, “ দেখ। কবে থিনি বলছি। ও নির্ঘাত সেই বুড়ার সাথে যাবে। মাঝে মাঝেই যায়। আর আমাদের বলে অফিসে চাপ আছে, পরে যাব।” ইতিমধ্যে ট্রেনের ঘোষণা হয়ে গেছে, ট্রেন আসছে, নবনী লেডিজ কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকাচ্ছেও না। বুড়ার সাথে দিব্যি ঘনিষ্ট ভাবে দাড়িয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে সাধারণ কামরায় সোয়ার হবে। লিপি আর থাকতে পারল না, “দাঁড়া। মোটির প্রেম করা ঘোচাচ্ছি।” স্বভাব বিরুদ্ধ প্রগলভা হয়ে চিৎকার করে উঠল, লিপিলেখা, “নবনীদিইই । তাড়াতাড়ি এস। ট্রেন এসে গেল যে।” নবনীর মুখের হাল ভাষায় অপ্রকাশ্য। দেখন হাসি হেসে, মত্ত হস্তিনীর মত এগিয়ে এসে বলল, “ শিলু, কেমন চমকে দিলাম। তোমাদের সাথে যাব বলেই তো তাড়াতাড়ি ফিরলাম না। কোথায় ছিলে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।”
নবনীর পরকীয়া নিয়ে প্রায় একটা মহাভারত লেখা যায়। শুধু সেই বুড়া নয়, ধীরে ধীরে নবনীর আরও একাধিক সম্পর্কের খোঁজ তথা চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগল। মাওবাদীরা তখন জঙ্গল মহলে সক্রিয় হতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝেই তেনাদের কারণে ট্রেন বাতিল হতে লাগল। সেদিনও ৪.৪৫ এর মেদিনীপুর লোকাল কোন কারণে বাতিল হয়েছিল। অগত্যা ঊষাঙ্গিনি, নবনী, লিপিলেখা এবং শিলালিপিও আরও অগণিত নিত্যযাত্রীদের মত আরণ্যক এক্সপ্রেসে সওয়ার হল। পাশকুড়ায় নেমে অন্য লোকাল ধরা হবে। আরন্যকে সেদিন থিকথিকে ভিড়। ঊষাঙ্গিনির বয়স দেখে একজন দয়াপরবশ হয়ে সিটটা ছেড়ে দিল বটে, নবনী, শিলা আর লিপি দাঁড়িয়েই চলল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আরণ্যকের নিত্যযাত্রীদের একটি দলের সাথে নবনী জমিয়ে আড্ডা মারতে লাগল। খানিক পরে চা ওয়ালা উঠল, তীব্র শীত পড়েছে বলে, সেদিন কফি নিয়ে উঠেছে। শিলালিপিদের আর কিনতে হল না, নবনীর সাথে ফষ্টিনষ্টি করা সাহেবদের একজন সবাইকে কফি খাওয়াল। কফি তে দু এক চুমুক দিয়েই গলায় এক রাশ লাস্য নিয়ে নবনী দূরে বসা একজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “এই সুজন, কফি খাবে?” এক ঘোর কৃষ্ণকায় হোঁৎকা মত অল্পবয়সী ছেলে এতক্ষণ জানলার ধারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে অন্ধকার মাঠঘাট দেখার চেষ্টা চালাচ্ছিল এবং মাঝে মাঝেই আড় চোখে নবনীর দিকে তাকাচ্ছিল। সে হটাত এই সহৃদয়তায় বিগলিত হয়ে, এক রাশ মুলোর মত দাঁত বার করে জানাল, খুব খাবে। এদিকে মুস্কিল হল, যে কফিওয়ালা ততোক্ষণে অন্য কামরায় চলে গেছে, আর ফেরার সম্ভবনা নেই। বিন্দুমাত্র না ঘাবড়িয়ে নবনী নিজের এঁটো আধখাওয়া কফিটা বাড়িয়ে দিল, এবং সেই সুজন নির্লজ্জের মত উঠে এসে, সেই কফিটি শেষ করল। লিপি শুধু হিসহিস করে বলে উঠল, “হ্যাঁ গো, উষা কাকিমা, এই তোমার সুজন? এই কান্নাকাটি করছিল, মোটি নবনী ওর থেকে সোনার বালা হাতিয়ে বুড়ার সাথে ভেগেছে? হারামি শালা, ওর হয়েছে কি? নবনীর পোষা কুত্তা কাহিকা।”
        শুধু পরকীয়া কেন, মদ্য পান এবং উদ্দাম ফুর্তি করাতেও নবনীর উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। এ ব্যাপারে প্রায়ই না না বিদ্ঘুটে পরিকল্পনা বার করত। যেমন একদিন বায়না ধরল, খড়গপুরের কোন ভালো হোটেলে একটা রুম নিয়ে চার জনে মিলে সারা রাত উদোম হয়ে উদ্দাম নাচাগানা করা হোক। সাথে মদ্য এবং মাংস থাকবে। উষা সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল। শিলালিপি তো রেগে বাক্যহারা, কি অসভ্য মার্কা আব্দার। হিডেন ক্যামেরা ব্যাপারটা বহুল প্রচলিত না হলেও অজানা ছিল না। তাছাড়া চারটি মাতাল মহিলা সারারাত উদ্দাম নাচানাচি করলে, হোটেলওয়ালারা ছেড়ে দেবে। লিপি তো হেসেই খুন। শেষে অতি কষ্টে সে যাত্রা নিরস্ত করা গেলেও মদ খাবার আব্দার চলতেই লাগল। নবনী এবং উষার যুগ্ম আব্দারের কাছে শিলা আর লিপি অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে নিল। তবে শর্ত এই, শিলালিপিকে মদ খাবার জন্য জোরাজুরি করা চলবে না। লিপির ও সব ট্যাবু নেই। বাইরের হস্টেলে থাকাকালীন সিনিয়র দিদিরা ওদের দিয়ে মদ এবং কনডম কেনাত।
নির্দিষ্ট দিনে যে যার অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে চার জনে হাজির হল, খড়গপুরের বিখ্যাত “পার্ক হোটেলে”। ভর দুপুর বেলা হোটেল খালি। ওদের দেখে সিকিউরিটি ফ্যামিলি সেকশনে নিয়ে যেতে উদ্যত হল, কিন্তু নবনী জানাল, বার কাম রেস্তরাঁই ওদের গম্য। আজ থেকে আট বছর পূর্বে খড়গপুরের মত মফস্বল শহরে ঘোর দ্বিপ্রহরে চার জন চাকুরিরতা মহিলা মাল টানতে আসবে বোধহয় সিকিউরিটি ভদ্রলোকটির কাছে অকল্পনীয় ছিল। উনি ঘাবড়ে, মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে দিদি, ওখানে মদ টদ বিক্রি হয়...।।” লিপি গম্ভীর ভাবে বলল, “হু”। ফাঁকা বারে মদ্য পান সাথে ভয়াবহ পোড়া ফিসফ্রাই, ফ্রায়েড রাইস আর চিকেনের একটা আইটেম, যা খেতে অবিকল চিলি চিকেনের মত সাথে দুর্বার আড্ডা, সময় পাখনা মেলে উড়ে গেল। হোটেল থেকে বেড়িয়ে ফুরফুরে মেজাজে চারজন হাটা দিল আই আই টির দিকে, কারণ মাঝে কোথাও অটো পাওয়া যায় না। ঊষাঙ্গিনি ফুর্তিতে বেজায় বেসুরো গলায় গান ধরল, “এই সুন্দর সরনালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্দু” একবার শিলার থুতনি ধরে চুমু খাচ্ছে, এক বার লিপির। নবনী বিরক্ত হয়ে বলল, “চলবে না উষাদি। এই খটখটে রোদে এ গান জমছে না।” ঊষা অন্য গান ধরল, “ওরে তোরা হাত ধর, পিতিজ্ঞে কর, চিরদিন তোরা বন্ধু হয়ে থাকবি।” গেয়েই লিপির হাত শিলার হাতে ধরিয়ে দিলেন, যেন কন্যা সম্প্রদান করছেন। সম্মিলিত হাসির রোল উঠল। ঠিক সেই সময়, জলপাইগুড়ি থেকে সৌর ফোন করে বসল শিলালিপিকে। কাল রাতেই শিলালিপি জানিয়েছিল আজ ওরা সদলবলে মদ্যপান করতে যাবে। শিলালিপি যদিও খাবে না। বাবা মা জানতে পারলে কেটেই ফেলবে, তবু। সৌরও নিষেধ করেছিল, পান করতে। কারণ এতটা রাস্তা একা ফেরা, কোথায় বমি টমি করে এক কাণ্ড বাঁধাবে, ভুল ষ্টেশনে নেমে যাবে ইত্যাদি। তবু কেমন যেন সন্দেহের বশবর্তী হয়েই ফোনটা করেছিল সৌর, ফোন ধরতেই হেঁড়ে গলার ঐ গান সাথে উদ্দাম হাসির কলতান। সৌরর আর সন্দেহ রইল না, শিলা মাতাল হয়ে, একদল মাতাল মেয়েছেলের সাথে সার্বজনীন মাতলামি করছে। শিলা হাসতে হাসতে যতই বলে, “আমি খাইনি। আর এরাও মাতাল নয়। কাকিমা ইচ্ছা করে মাতাল হবার নাটক করছে,” সৌর অবুঝ। বাধ্য হয়ে ফোনটাই কেটে দিল, শিলালিপি। ফাঁকা রাস্তায় ঊষা শ্রীচৈতন্যের মত উদ্বাহু হয়ে গান ধরল, “ওরে আমি মাতাল সেজেছি।” ওরা হাসতে হাসতে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছিল, হঠাত, ঊষা চিৎকার করে উঠল, “এই হারামজাদিইইইইইই। মরবে দেখ। কানে ফোন দিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে।” সত্যই একটি মেয়ে কানে মুঠোফোন দিয়ে আনমনা হয়ে হেঁটে যাচ্ছে, উষাঙ্গিনির কথা শেষ হতে না হতেই দূরে দেখা গেল, সাক্ষাৎ যমদূত। সহস্র দাঁত বার করে ছুটে আসছে। মেয়েটির হেলদোল নেই। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ওরা দাঁড়িয়ে দেখল, ঊষাঙ্গিনি দুটো ব্যাগ মাটিতে ফেলে লাইনের ধার ধরে ছুটছে, একপাটি সস্তার চটি খুলে গেল, ভ্রূক্ষেপ না করেই ছুটছে ঊষাঙ্গিনি। সম্বিৎ ফিরতেই নবনী তার পাহাড়ের মত চেহারা নিয়ে দৌড়ল, “ঊষাদি, সাবধান।” দৌড়তে দৌড়তে ঊষাঙ্গিনির চটি আর ব্যাগ দুটিও তুলে নিল। লিপি উত্তেজিত হয়ে বলল, “শিলু চল।”  দৌড়তে লাগল ওরাও।
চার জনের সম্মিলিত চিৎকার, হুটোপাটি এবং সর্বোপরি লেভেল ক্রসিং এর কাছে এসে ট্রেনের গতি হ্রাস সে যাত্রা মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিল। ঊষাঙ্গিনি মেয়েটির কাছে যথা সময়ে পৌঁচে টেনে নিলেন লাইনের বাইরে। মেয়েটি অবশ্য তার আগেই কান থেকে ফোন নামিয়ে পিছনে তাকিয়েছিল, এত শোরগোল কিসের দেখতে, মৃদুমন্দ গতিতে ধাবমান যমদুতকে দেখে বোধহয় সাময়িক ভাবে মেয়েটির বাহ্য জ্ঞান লোপ পেয়েছিল, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। দীর্ঘদিনের ডেইলি পাষণ্ড গিরির অভিজ্ঞতা থেকে, এরকম যে হতে চলেছে, তা ঊষাঙ্গিনির অজানা ছিল না। ব্যর্থ হয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল যমদূত। ঊষা তো মেয়েটিকে এই মারে তো সেই মারে, “হারামজাদি, মরার আর জায়গা পাউনি, তুই মরলে ট্রেন বন্ধ হয়ে যেত, বাড়ি ফিরতুম কি করে?’’ মেয়েটির তখনও ঘোর কাটেনি। ঊষা আবার বললেন, “তা এই বয়সে এত মরার শখ কিসের? বাড়িতে বাবা মা নেই? কত কষ্ট করে বড় করেছে, আর মেয়ে এখানে সুসাইড করছে। গুছিয়ে পেদালে ঠিক হয়।” লিপি তাড়াতাড়ি ঊষাকে ঠাণ্ডা করতে উদ্যত হল।এ যা মহিলা, সত্যই না দু চার ঘা দিয়ে বসে মেয়েটাকে।  নবনী আর শিলা মেয়েটিকে নিয়ে পড়ল, মেয়েটি তখনও কাঁপছে। মেয়েটিকে ওরা আগেও দেখেছে। ওদের সাথেই ফেরে। কৃষ্ণা, একটু রোগার দিকে ছিপছিপে দোহারা চেহারা, লম্বা চুলে একটা মোটা বিনুনি বাঁধা। হরিণীর মত দুটি চোখ ক্রমশঃ সজল হয়ে উঠছিল। নবনী বলল, “ ঊষাদির কথায় রাগ করো না। তোমার ভালোর জন্যই বলছেন। কানে মোবাইল দিয়ে রেল লাইন ধরে কোথায় যাচ্ছিলে?”
মেয়েটি কম্পিত এবং ঈষৎ খোনা স্বরে জানাল, “আই আই টি।” শিলা আর নবনী সমস্বরে বলে উঠল, “আই আই টি? সে তো ক্রসিং টপকে ওদিকে। তুমি বাঁ দিকে লাইন ধরে কোথায় যাচ্ছিলে?” ঊষা জল খাচ্ছিল, লিপি অনেকটাই ঠাণ্ডা করেছিল, আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল, “ ও মরতে যাচ্ছিল। নির্ঘাত কোন হারামজাদার চক্করে পড়েছে। প্রেম করেই মরল, বাবা মা কিছু নয়।” মেয়েটিকে ওরা ছাড়ল না, সঙ্গে করে আই আইটি নিয়ে গেল, সেখান থেকে অটো করে স্টেশন। পথে ওরা জানতে পারল, মেয়েটির নাম আরযু চৌধুরী। নাম শুনে ঊষা ফিসফিস করে শিলাকে জিজ্ঞেস করল, “আজ্জু? এ আবার কেমন নাম? মোছলমান নাকি?” শিলা ইশারায় চুপ করতে বলল, আর লিপি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ তাতে কি আসে যায়?”
আরযু পাশকুড়ায় পেয়িং গেস্ট থাকে, বাড়ি পূর্ব মেদিনিপুরের কোন গ্রামে।খড়্গপুরে কোনও অফিসে কন্ট্রাকচুয়াল স্টাফ। এদিকে কোন কাজে এসেছিল, ফেরার অটো পাচ্ছিল না, কেউ বলেছে আইআইটি থেকে পাবে, তাই পথ ভুলে ঐ কান্ড বাঁধাচ্ছিল। মেয়েটির দুটি বৈশিষ্ট্য প্রথমতঃ ওর চিবুক নেই। মুখটা তলার ঠোঁটে এসে হটাত শেষ হয়ে গেছে। শিলালিপি একদিন দেখেছিল, মেয়েটি বিকালের ট্রেনে বসে টিফিন করছে, মাঝে মধ্যেই খাবার গুলো মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে, মেয়েটি দ্রুত সবার অলক্ষ্যে আঙুল দিয়ে আবার মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। শিলালিপি দ্রুত মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছিল। যাতে মেয়েটি না দেখতে পায়। দ্বিতীয়তঃ ঐ খোনা আওয়াজ। কথা বললেই, হাল্কা নাকি সুরে কথা বলে আরযু।
সেই ঘটনার পর, আরযুর সাথে ওদের প্রায় রোজই দেখা হত, মৃদু হেসে দূরে গিয়ে বসত আরযু। ওরাও জবরদস্তি করত না। চার জনের সুখের সংসার। শীত সে বছর জমিয়ে পড়েছে, সবাই খুশি খুশি।  আড্ডা, হাসি, মজা, রেলওয়ে পার্কে পিকনিক স্বপ্নের মত কাটচ্ছিল দিনগুলো। সেদিন ৩১শে ডিসেম্বর। অফিস টাইমেও ট্রেন ফাঁকা। শিলা ট্রেনে উঠেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, “আজকের দিনে কেউ অফিস যায়। শুধু আজ নয় আবার কাল ও আসতে হবে।” গতকাল রাত্রে সৌরর সাথে এই নিয়ে এক চোট ঝগড়া হয়ে গেছে, ৩১শে ডিসেম্বরও একজন উত্তর আর একজন দক্ষিণ বঙ্গে পড়ে আছে। লিপির অবস্থা আরও খারাপ। রণজয় সেই সুদূর দক্ষিণ ভারতে, শুধু তাই না, তাদের বেসরকারি অফিসে আজ বিরাট পার্টি, নাচাগানা, আকন্ঠ মদ্য পান এর ব্যবস্থা, নামি ডিজে আসবে। সারা রাত নাচাগানা চলবে। নবনী আর ঊষা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে, ওদের ছেলেমানুষি ক্ষোভ আর অভিমান দেখে। গোটা কামরা খালি, একদিকে ওরা চার জন, আর একদিকে আরযু বসে বসে ফোন করছে। ঊষা আর নবনী লম্বা হয়ে শুয়েই পড়ল বেঞ্চে। অকস্মাৎ লিপি বলে উঠল, “ এই আরযু কাঁদছে? নাকি রে?” আরযু মুখের কাছে হাত নিয়ে এসে ফিসফিস করে কথা বলছে, কিন্তু দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে মুক্তোর দানা। শারীরিক বিভঙ্গে পরিষ্কার চরম আর্তি নিয়ে কাউকে অনুনয় করছে। ঊষা মাথা তুলে বলল, “লভ কেস। সেদিনি বুয়েছি। তোদেরই মত মান অভিমান চলছে। ” বলে চোখ টিপে শিলা আর লিপি কে মৃদু খোঁচা দিলেন। লিপি কিন্তু গলল না, “ না রে। সিরিয়াস কিছু। খুব কাঁদছে মেয়েটা।” লিপির কথা শেষ হতে না হতেই আরযু উঠে পড়ল। ব্যাগ মোবাইল সিটে রেখে, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লিপি আর বসে থাকতে পারল না। বিদ্যুৎ গতিতে গিয়ে আরযুর হাত টা চেপে ধরল। আরযু প্রবল ধস্তাধস্তি শুরু করল, বাকি তিনজনও ছুটে এল, জবরদস্তি আরযুকে এনে সিটে বসানো হল। আজ আরযুর মুখ চোখ সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। আত্মহত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আজ আর ঊষা বকাবকি করলেন না। জড়িয়ে ধরলেন আরযুকে। মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগলেন। নবনীও পিঠে স্নেহের হাত রাখল। বন্য জন্তুর মত ফোঁসফোঁসানি আচিরেই ফোঁপানিতে পরিণত হল। শেষে হাউহাউ করে কান্নায়। চেনা গল্প। প্রেম এবং বিচ্ছেদ। নিয়মিত ঝগড়া, তর্কতর্কি চলছিল, কাল রাতেই ছেলেটি জানিয়ে দিয়েছে সে এই সম্পর্কে জড়াতে আর ইচ্ছুক নয়। ফের ফোন করলে কপালে দুঃখ আছে। তাও আজ আরযু ফোন করেছিল। মন থেকে মানতেই পারেনি, ওদের সম্পর্ক কখনও ভাঙতে পারে। জবাবে কুৎসিত ভাষায় চরম অপমান ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। আরযু কাঁদছে আর বলছে, “আমাকে বলল খানকি মাগী। শুয়োরের বাচ্ছা। বলল আমার মা শুয়োরের সাথে শুয়েছিল তাই আমাকে এরকম দেখতে। আমাকে দেখলে নাকি ঘেন্না করে। ঈশ্বর আমাকে এরকম বানিয়েছে আমি কি করব??” শিলা আর লিপি সমস্বরে বলল, “ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। ও তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ও কি মানুষ???” নবনী বলল, “ফোন করো, করে ঐ গালাগাল গুলো ফিরিয়ে দাও। এ সম্পর্কের  কোন প্রয়োজন নেই।” আরযু অশ্রু সজল চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ঊষার বুকে মাথা গুঁজে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠল, “ওকে ফিরিয়ে দাও কাকিমা। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না।” লিপি কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঊষা ইশারায় ওকে থামিয়ে বলল, “ আচ্ছা। ওকে ফেরাবার জন্য যা যা করার আমি সব করব। কিন্তু তুই কথা দে, আর সুসাইড করতে যাবিনি।” “ফিরিয়ে দেবে কাকিমা? ও ফিরে আসবে?”
“হ্যাঁ রে বাবা। কথা দিলুম তো।”
“আমি ওকে বড্ড ভালবাসি কাকিমা। ওকে ছাড়া বাঁচব না।”
“জানি লো আজ্জু। জানি।” একটু পরেই ঊষার কোলে মাথা রেখে সিটের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আরযু। শিশুর সরলতা মাখানো মুখে পরম নিশ্চিন্ত ভাব। কিন্তু বাকি চার জন? 

(চলবে)


Wednesday 30 September 2015

অনির ডাইরি ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৫

জাতীয়তাবাদের ঢল নেমেছে। তেরঙ্গায় মুড়ে গেছে ফেসবুক। হাবাগোবা মহিলা শ্রমিক আমি, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ফান্ডাটাই বুঝি না। সকালে কাগজ দেখার সুযোগ হয় না, খুব একটা ঔৎসুক্য ও নেই, ফলে সমসাময়িক ঘটনাবলী সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ।এমনকি তথাকথিত পেজ থ্রী সেলেব দেরও খুব একটা চিনি না। সেদিন এক বন্ধু এক অপরূপার ছবি পাঠাল, রক্তবর্ণ বসনে স্বয়ং ঊর্বশী, কেবল হাতে একটি ত্রিশূল । কোথায় যেন দেখেছি, কোন সিনেমা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, সাধারণত সর্বসমক্ষে নিজের অজ্ঞতা যাতে না প্রকাশ পায়, সে ব্যাপারে আমি অত্যন্ত যত্নশীল কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে সেদিন জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম, যে অভিনেত্রীর নামটা যেন কি? পেটে আসছে বটে তবে --- । বন্ধু বেশ কিছু বাছাই অসংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে জানাল, উনি একজন পুণ্যাত্মা সন্যাসিনী।
যাই হোক, সকাল বেলা ফেসবুক খুলেই চমকে উঠলাম, ব্যাপার কি? হঠাৎ করে সবাই তেরঙা ছবি লাগাচ্ছে কেন? দেশের বাবার জন্মদিন আসতে বিলম্ব আছে, আর দেশের বাবাকে উদোম খিস্তিখেউড় করাটাই তো হেপ এণ্ড হ্যাপেনিং। ওনার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না জেনেও যত বিকৃত ভাষায় ওণার সমালোচনা করতে পারবেন, তত বোদ্ধা হিসাবে আপনার নাম ছড়াবে। মাঝে ঝালনুন হিসাবে নেতাজীর সাথে ওণার একটু তুলনা, আঃ জমে ক্ষীর । আজও কতলোক যে ওণাদের বেচে খাচ্ছে। সেদিন দেখলাম জনৈক গবেষক নানা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেই ছেড়েছেন যে গান্ধীজী ঘোরতর বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন।
মোদ্দা কথা হল, বাপুর জন্মদিন নয়, স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবস ও নয়। তবে কি হল রে বাবা? প্রোফাইল পিকচার তো আমিও ঘনঘন পাল্টাই। নার্সিসিস্ট হওয়া মোটেই দোষের নয়। পরের খুঁত দেখার থেকে নিজেকে নিখুঁত দেখা ভাল। কিন্তু নতুন ছবি কেউ লাগায়নি, পুরানোটাই তেরঙা হয়ে গেছে। ওপরে লেখা “ডিজিটাল ভারতের সমর্থনে । ” ব্যাপারটা কি? যত বেলা বাড়তে লাগল, তেরঙা ছবির সংখ্যা বাড়তে লাগল। কিছুকাল আগে আমেরিকায় সমকামী বিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়াতে বহু লোক এরূপ রামধনু রঙের ছবি লাগিয়েছিল। যে দেশে সম্মান রক্ষার্থে খুনজখম আকছার হয়, যেখানে এখনও গাড়ু নিয়ে লোকে মাঠে ছোটে, সমকামী এবং হিজরার প্রভেদ বোঝাতে চুল ছিড়তে হয়, তারাও আমেরিকান সমকামীদের জয়ের উল্লাসে সাত রঙে রাঙিয়ে ফেলল আননবই। মন্দ কি। যতক্ষণ আপনার পুত্র -কন্যা, ভাই- বোন বিষমকামী থাকছে, হেপ হতে সমস্যা কোথায়। হলে পঞ্চম বেদ তো রইল।
কিন্তু ডিজিটাল ভারতটা কি? খায় না মাখে? বেশ কয়েকজনকে প্রশ্ন করলাম, উত্তর এল না বটে তবে তাদের ছবিগুলি চটপট তেরঙা হয়ে গেল। শেষে আমার এক ভগিনীসম সহকর্মী জানাল যে প্রতিটি গ্রাম কম্পুটর দিয়ে ঢেকে ফেলা হবে। অন্তরজালে মুড়ে যাবে ভারতবর্ষ । দীন ,দরিদ্র , অর্ধউলঙ্গ, পূর্ণ উলঙ্গ ভারতবাসীও আননবই পড়তে পারবে। বাঃ বলতে গিয়েও থমকালাম, পড়বে কি করে? অক্ষরজ্ঞান থাকলে তো? বন্ধু বলল, এসব গাড়ল মার্কা প্রশ্ন করলে তোমাকে আই এস আই এর এজেন্ট বলবে। ঠিক । ঠিক। মুখবন্ধ করে কল্পনা করছি, আমার মামার বাড়ির গ্রাম, সুদূর মুর্শিদাবাদের একটা অখ্যাত গ্রাম, আর অখ্যাত থাকবে না। পাষানী গয়লানী , ইসমাইল মাষ্টার, অশোক মুদি, নারান হাড়ির গৃহপরিচারিকা বউ, খোঁড়া অনাথা সরস্বতী মাসি সবাই ল্যাপটপ নিয়ে ঘুরবে। ট্যাবলেট হাতে বুনো পাড়ার ছেলেগুলো বাগালি করতে যাবে। এমনকি বুনোপাড়ার ঘরে ঘরে যখন ধেনো মদ তৈরি হবে তখনও----- “বড়িয়া হ্যায়”।
‪#‎Anirdiary‬ ‪#‎Aninditasblog‬

Monday 28 September 2015

গোধূলি



ধুলো পুরু আস্তরনে আবৃত আমি,
ছুঁয়েও দেখো না,
গলা জড়াই  কাতর আবদারে, ভালবাসবে একটু?
বিরক্ত তুমি, “কি করে বাসতে হয়”?
সরে আসি নীরব বেদনায়,
জানি প্রেম আছে, শুধু হারিয়ে  গেছে
সেই কবোষ্ণতা ।
আঙুলের  ফাঁক দিয়ে দ্রুত চুঁইয়ে পড়ছে সময়।

Thursday 24 September 2015

মন ভালো নেই

মন ভালো নেই, আমিও না।
কিন্তু কেন? যা চেয়েছি, তাই তো পেয়েছি,
দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তা, অনেক হিসাব-নিকাশ কষে, তবেই তো চেয়েছিলাম।
কেমনে আজ বলি, সব ভুল?
জানতাম, তুমি কেমন, আমারই মনের মত,
শত বিনিদ্র যামিনীর স্বপ্ন- কল্পনা ওপর পরতে পরতে জমা রক্ত, মাংস, চামড়া, রোমরাজি।
বড় প্রিয়, বড় আপন, প্রতিটি রোমকূপ,আমারই তো প্রতিচ্ছবি ।
তবে কেন এ বিষাদ, কার তরে মন উদাস? কার প্রতি অবহেলা?

সবই বুঝি অলস মায়া, নিখাদ দুঃখবিলাস।
image courtesy- Google

সহযাত্রী (পর্ব -৪)


সুমি আর কলির দৌলতে দাশনগর থেকে কোলাঘাট যেতে মন্দ লাগত না, কোলাঘাটে ওরা নেমে যাবার পর আবার দুঃসহ একাকীত্ব। মোবাইলে টাওয়ার থাকত না। এফ এমও ধরা যেত না। টাইমস অব ইন্ডিয়া মুখস্ত করতে করতে কোন মতে খড়গপুর পৌঁছত শিলালিপি। ফিরতি ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবার অদম্য ইচ্ছেটাকে কবর দিয়ে, চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম প্লাটফর্ম পার হয়ে, সম্ভবত খাড়াইতম ওভার ব্রিজ টপকে, হাফ মাইল হেঁটে অটো স্ট্যান্ড। স্টেশনের সামনেই রিক্সাস্টান্ড, তবে রিক্সাওয়ালা গুলিকে স্বচ্ছন্দে ডাকাত বলা যায়,  প্রত্যহ ওদের সাথে দরাদরি অথবা বচসা করা শিলালিপির দুঃস্বপ্ন মনে হত। সুতরাং অটো ছাড়া গতি ছিল না। অটোতে অবশ্য মিনিট সাতেকের বেশি লাগত না অফিস পৌছতে।
পোঁছেই বা কি লাভ হত? কোন অজ্ঞাত কারণে, সমস্ত কর্মযজ্ঞ থেকে শিলালিপি ছিল বঞ্চিত। কাজ বলতে এক আধো অন্ধকার ড্যাম্প ধরা, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে সারাদিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা। মাসে একবার একটা রিপোর্ট সই করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া ছাড়া এক কথায় শিলালিপি সম্পূর্ণ বেকার। ঘরটিতে তিনটি জানালা, যার মধ্যে দুটি বাইরে থেকে ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করা। তৃতীয় জানলাটি খোলে বটে, প্রচণ্ড বর্ষা আর তীব্র শীতেও তাকে খুলেই রাখতে হয়, উপায়ন্তর নেই, পাল্লা ভাঙা। চেম্বারে একটা ফোন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, মাঝে মাঝে শিলালিপির মনে হত জগত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে ওকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।
বিকাল পৌনে পাঁচটা বাজলে, বন্দী দশা ঘুচত। সারা দিন বসে থাকার ক্লান্তি আর চূড়ান্ত হীনমন্যতা নিয়ে গুটি গুটি বেড়িয়ে পড়ত শিলালিপি। ফেরার মেদিনীপুর লোকালে সহযাত্রী বলতে যারা ছিল, প্রায় সকলেই ডাই ইন হারনেস কেসে চাকরী পাওয়া বিভিন্ন বয়সী রেলের চতুর্থ শ্রেণীর মহিলা কর্মচারী। অতি সাধারণ বেশভূষা, কাঁধে বা হাতে সস্তার ব্যাগ অথবা বাজারের চটের থলে। ট্রেন ছাড়লেই প্রত্যেকের ঝোলা থেকে বের হত, মস্ত এক প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ভর্তি মুড়ি। একটু পড়েই ঝালমুড়ি, চপ আর চা ওয়ালারা উঠত। কেউ চপ কিনে, চটকে মেখে নিত মুড়ির সাথে, কেউ বা মুড়ি ওয়ালাকে পয়সা দিয়ে মাখিয়ে নিত, সাথে গরম চা। প্রাতকালে শিলালিপি যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন ওরা ট্রেন ধরে। দুপুরে রেলের ক্যান্টিনের ভাত আর সকাল বিকাল মুড়ি, বাঁধাধরা রুটিন। পরে একজন শিলালিপিকে জানিয়েছিল, শুধু দুই বেলা মুড়ি আনবার জন্য ওরা নিয়মিত প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট কেনে। যাইহোক, আপাত সাদাসিধে মানুষ গুলির সাথে শিলালিপির খুব কমই ভাব বিনিময় হত। ফেরার পথে মন খারাপ করে বসে  থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি, সবে ট্রেন খড়গপুর প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়েছে, মহিলারা যে যার মুড়ির প্যাকেট বার করবে করবে করছে, হটাৎ তীব্র গোলযোগ। হইচই, চিৎকার, সপাটে চড় মারার শব্দ এবং অবশেষে ভেউভেউ কান্না। কৌতূহলী হলেও সিট ছেড়ে উঠল না শিলালিপি, পার্শ্ববর্তীনী নিত্যযাত্রীরা দৌড়ল। মহিলা কামরায় ঝগড়াঝাঁটি কালেভদ্রে হয় না। নারদের নিত্য বসবাস। তবে মারামারি আজ অবধি দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি শিলালিপির। একটু পরেই  মহিলারা যে যার সিটে ফিরল, সাথে এক ক্রন্দনশীলা তরুণী। দেখলেই বোঝা যায়, নির্ঘাত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, নতুবা হবু ছাত্রী। সেদিন ট্রেনে বেশ ভিড় ছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিন জনের জায়গায় চার জন কষ্টেসৃষ্টে বসেছিল। এই নিয়েই ঝগড়া এবং হাতাহাতি। জনৈক ডেইলি পাষণ্ড মহিলা ঐ তরুণীকে সাঁটিয়ে এক চড় কশিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে বেচারি মেয়েটি রণে ভঙ্গ দিয়ে করুণ সুরে কাঁদছিল। “আমাকে আমার মা বাবাই কোনদিন মারেনি। সামান্য একটু সিটের জন্য এভাবে কেউ মারে?” শিলালিপির আশে পাশের সহযাত্রীরা নানা ভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। একজন চা কিনে দিল, মেয়েটি তবু ফুঁপিয়েই চলেছে, শিলালিপি, খানিক পরে অবিশ্বাসের সুরে পার্শ্ববর্তিনীকে জিজ্ঞাসা করল, “সত্যই মেরেছে?কে মারল দিদি?”
মহিলা ঠোঁট মুচড়ে বলল, “ঐ দেখছু না, ঐ মেয়েছেলেটা। কেউ মারে বল? আহা কেমন ফোঁপাচ্ছে দেখছনি। ওকে কাঁদতে দেখে, আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ছে গো।” বৃদ্ধার অঙ্গুলি অনুসরণ করে শিলালিপি দেখল, দূরে এক ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ মহিলা, আহত জন্তুর মত, ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে কপালে লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে, দেখেই মনে হবে, স্বয়ং মা শিতলা, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গা ছমছমিয়ে উঠল শিলালিপির।
দিন কয়েক পরের কথা, সকালের ট্রেনটা সবে মেচেদা ছারিয়েছে,মহিলা কামরা মোটামুটি খালি, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে, কিছু নিত্যযাত্রী বসে আছে, শিলালিপি যথারীতি টাইমস মুখস্ত করার বৃথা চেষ্টা করছিল, অকস্মাৎ সেদিনের সেই রণচণ্ডী মহিলা এসে ধপ করে ওর পাশে বসল। এই সিটে সাধারণত আট জন বসে, বর্তমানে মাত্র শিলালিপিকে নিয়ে মাত্র জনা তিনেক মহিলা বসে আছেন। ঠেসাঠেসি বা মারামারি হবার সম্ভবনা ক্ষীণ তবু শিলালিপি একটু জানলার দিকে চেপে বসল। মহিলা অবশ্য দিব্যি খোশ মেজাজে উল্টো দিকে বসা নিত্যযাত্রীনীর সাথে গল্প জুড়লেন। না না বিষয়ে কথা হচ্ছে, হাসির ফোয়ারা ছুটছে মাঝে মাঝেই, হঠাৎ মহিলা ওকে কনুই এর খোঁচা মেরে বলল, “ কি বল, ভাই তাই না?”
“অ্যাঁ? তাই কি? শুনিনি সরি।” মারের ভয়ে সরি বলল বটে, মনে মনে বলল, তোমাদের ভ্যাজোর ভ্যাজোর খামোখা শুনতে যাব কেন বাপু।  মহিলা হাসতে হাসতে  বলল, “এই সব রঙ, তোমাদের মানায়, আমাদের বয়সে কি চলে? কি করব ভাই, ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে পুজোয় দিয়েছে, তাই পরা।” শিলালিপি জবাবে দেঁতো হাসি হাসল। কিছু পরে ট্রেন আরও ফাঁকা হয়ে গেল। উল্টো দিকের নিত্যযাত্রীনীও নেমে গেলেন। খড়গপুর আসতে তখনও এক ঘণ্টা, মা শীতলা বকেই চলেছে, শিলালিপিরও মন্দ লাগছিল না, বেশ গ্রাম্য সরল মনে হল মহিলাকে। এক চপওয়ালা উঠল, প্রায় খালি ঝুড়ি নিয়ে, মা শীতলা তার সাথে দরাদরি করে, ঠাণ্ডা ডিমের চপ কিনল, আলুর চপের দরে। মুড়িও কেনা হল এক ঠোঙা, অতঃপর ওনার উপরোধে শিলালিপিকে খানিক খেতেও হল, মন্দ লাগছিল না, সময়টা বেশ দ্রুত কাটছিল। ট্রেন যখন খড়গপুর ধুকছে, শিলালিপি অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “ দিদি আপনার নাম কি?’’
মহিলা লাজুক হেসে বলল, “ঊষাঙ্গিনি। সবাই ঊষাদি বলেই ডাকে। তুই এত দূর থিকে আসিস, আমার নম্বরটা রেখে দে, দরকারে বলিস।” এভাবেই ঊষাঙ্গিনির সাথে, শিলালিপির আলাপ, তবে বন্ধুত্ব দ্রুত জমেনি, জমতে সময় লেগেছে। লিপিলেখার সাথে দেখা হয়েছিল, এরও বেশ কিছুদিন পর, সৌজন্য ঊষাঙ্গিনি। লিপিলেখা ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করার দিন দুয়েকের মধ্যেই কি ভাবে যেন, ঊষাঙ্গিনির সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলে, শিলালিপি তখন ছুটিতে। ঊষাঙ্গিনি লিপিলেখাকেও নিজের নম্বর দিয়ে একই ভাবে বলেছিলেন, বিপদে আপদে ওনাকে ফোন করতে। ওনার এই আপেক্ষিক উদারতায়, শিলালিপি না গললেও লিপিলেখা গলে যায়। ঊষাঙ্গিনি অচিরেই হয়ে ওঠে লিপিলেখার ঊষা কাকিমা।পরে যদিও শিলালিপি এবং লিপিলেখা আবিষ্কার করে, যে ঊষাঙ্গিনি ওদের নম্বর তো দিয়েছিল, কিন্তু ফোনটা সঙ্গে না এনে প্রায়দিনই বাড়িতেই রেখে আসেন, এই নিয়ে শিলালিপি এবং লিপিলেখার যুগ্ম আক্রমণের সামনে, উনি অসহায় ভাবে শুধু বলেছিলেন, “কি করব বল? নাতির আব্দার কি ফেলা যায়। তাতে কি? তোরা আমার অফিসে ফোন করবি, বড় সাহেবের ঘরে বটে ফোনটা, ও উনি ডেকে দিবেন। ”

(চলবে)