Tuesday 22 December 2015

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৫


ফেসবুকে আমার এক বয়স্ক বন্ধু আছেন, ষাটোর্ধ, অবসর প্রাপ্ত, কৃতি সন্তানের জনক। সাম্প্রতিক বড়ই নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। বয়স্কা স্ত্রী তো ঘরকন্যা, পুজোআচ্ছা আর টেলিভিশনে প্যানপ্যানে বাংলা সিরিয়াল নিয়ে দিব্যি দিনযাপন করেন, কিন্তু আমার বন্ধুটির সময় আর কাটছিলই না। কাঁহাতক বই, পত্র আর খবরের কাগজ পড়ে থাকা যায়, ফলতঃ উনি খুব দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। আচমকা সুগার, প্রেসার, রক্তে স্নেহ পদার্থের আধিক্য দেখা দিল। সাথে দেখা দিল তুমুল গৃহবিবাদ। গিন্নি বাড়িতে মিষ্টি ঢোকা বন্ধ করে দিলেন, বেপরোয়া বন্ধুটি পাড়ার মিষ্টির দোকানে খাতা খুললেন। নিন্দুকে বলতে লাগল, পাড়ার তেলে ভাজার দোকানেও ওনার নাকি খাতা আছে। নিন্দুক গণ শুধু আলোচনা করেই ক্ষান্ত হলেন না, সময় মত গিন্নি মার কানে কথা গুলি তুলেও দিলেন। পরিণাম সহজেই অনুমেয়। ব্যাপারটি যখন বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে এগোচ্ছে, ভদ্রমহিলা আমাকে ঢেকে পাঠালেন, উদ্দেশ্য সাধু। এক স্বঘোষিত নারীবাদীর কাছে, ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের বর্ণনা দেওয়া। কিন্তু মুস্কিল হল, যে, নারীবাদীরা আবার সাম্যবাদীও হন কি না। তাই সব শুনে আমার মনে হল, এ ক্ষেত্রে ভদ্রলোকটিই অধিক অত্যাচারিত। যদিও ভালবাসার অত্যাচার, তবুও-----।
ভদ্রলোকের নিঃসঙ্গতা কাটাতে আমিই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পরামর্শ দি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা বেশ ভালোই ছিল। দ্রত ওনার বন্ধু সংখ্যা বাড়ছিল। গৃহ যুদ্ধ ও সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল, যদিও চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে লাগল। তবে ওটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভাল। ভদ্রলোকটি প্রথম গোল বাঁধালেন, বয়সজনিত সরলতা হেতু কিছু লোককে নিজের মোবাইল নম্বর প্রদান করে। কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন বয়সী সমকামী পুরুষ ওনাকে প্রেম প্রস্তাব পাঠাতে লাগল। কেউ কেউ মোবাইলে ফোন তথা হোয়াটস অ্যাপ এর মাধ্যমে সকাল বিকাল, “হ্যালো ডার্লিং” বলে মেসেজ/ ফোন করতে লাগল। মধ্যবিত্ত মধযব্যস্ক বাঙালির জানা সমস্ত গালাগাল প্রয়োগ করেও নিষ্কৃতি মিলছিল না। অগত্যা আমার শরণাপন্ন হন এবং উকুন বাছার মত করে একটি একটি করে লোককে আমি ব্লক করতে বাধ্য হই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ঐ সমকামী পুরুষ গুলি শুধু যে ভারতীয় ছিলেন তা নয়, আমাদের একাধিক প্রতিবেশী দেশ থেকেও উনি প্রেম প্রস্তাব পান। ইংরাজি হরফে বেশ কিছু দুদ্ধর্ষ উর্দু কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হয় ওনার কল্যাণে। বেশ কিছু দিন অ্যাকাউন্টটি ডিঅ্যাক্টিভেটেড থাকে।
পুজোর পর আমার এবং ওনার অন্যান্য বন্ধু বান্ধব তথা ভাইপো ভাইঝি দের সনির্বন্ধ অনুরোধে উনি পুনরায় ফেসবুকে ফিরে আসেন। তারপর আর খোঁজ নিইনি। মাঝে আবার একদিন উনি  ফোন করে বললেন, আবার উনি প্রেম প্রস্তাব পাচ্ছেন। তবে এবার মহিলা দের থেকে। বুঝতে পারলাম না, এতে আপত্তির কারণ কি? বৃদ্ধ বয়সে ভুরি ভুরি প্রেম প্রস্তাব তো বহু লোকের স্বপ্ন। অভিনন্দন জানাতে গেলাম, বৃদ্ধ গেলেন ক্ষেপে। ওনার বক্তব্য হচ্ছে, একজন বিরল কেশ, স্ফীতোদর, প্রায়অন্ধ লোকের প্রেমে পড়ার কি কারণ থাকতে পারে? শুধু তাই নয়, “প্রেম ছাড়, এদের সাথে দুদণ্ড কথাও বলা যায় না। বাঙালির হল কি?” উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ কেতাবি জ্ঞানের বাইরে এরা কি কিছু পড়াশোনা করে না? এত আকাট?  তুমি কেমন আছ? আমি ভাল আছি এর বাইরে কথা বলতে, আই লাভ ইউ। এর থেকে তো তোর কাকিমার সাথেই প্রেমের চেষ্টা করা ভাল।” হাসি চেপে বললাম, “ আনফ্রেন্ড করে দিন।”
সে যাত্রা বাঁচলেও, আজ আবার ফোন। বেশ রোম্যান্টিক আবহাওয়া। ভাবছি সন্ধ্যা বেলা এক চক্কর হেঁটে আসব, ইচ্ছা দমন করে ফোন ধরলাম। উনি উত্তেজিত ভাবে বললেন, “ আমার অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দে। পাসওয়ার্ড তো জানিস।”
দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম, “আবার কে প্রেম নিবেদন করল? ধন্য ভাগ্য আপনার। এত প্রেম প্রস্তাব তো আমিও পাইনি।” উনি খিঁচিয়ে উঠলেন, “ না না। ও সব প্রেম ট্রেম না। আমি সামগ্রিক ভাবে বাঙালি জাতির ওপর বীতশ্রদ্ধ। এপাড় ওপাড় মিলে, হাতে গোনা কয়েকজনএর লেখা (অর্থাৎ স্ট্যাটাস) পড়লে মনে হয়, সত্যি আমরা বাঙালি। বাকি গুলো অখাদ্য। রোজ সকালে ফেসবুক খুললেই, খালি ছবি (পড়ুন সেলফি)। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সব এক পোজে, ঘাড় হেলিয়ে, চোখ টেরিয়ে, দাঁত কেলিয়ে ছবি।” এই রে প্রমাদ গুনলাম। লাস্ট সেলফিটা যেন কবে দিলাম? আজকেই কি? উনি না থেমে বলেই চললেন, “আর না হলে কবিতা। বাপস্। ও গুলো কি? কবিতা? আর মাঝে মাঝে বামপন্থার মা-বোন এক করা। বিন্দুমাত্র পড়াশোনা নেই। মার্ক্সের নাম ছাড়া কিছু জানে না। সেও নাকি বামপন্থী। জাতটা নষ্ট হয়ে গেছে বুঝলি। সামগ্রিক অবক্ষয়।”
কোনমতে ওনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, হাঁটতে বেরোলাম। হেডফোন লাগিয়ে, রেডিও চালিয়ে হাঁটতে দিব্যি লাগছিল। শিরশিরে হাওয়া। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট। রেডিওতে বিজ্ঞাপন চলছে, আমি হেঁটেই যাচ্ছি।দশ মিনিটের ওপর হয়ে গেল, একটিও গান শোনাল না। বেশ বিরক্তি লাগছে, চ্যানেল পাল্টাতেও ভয় করছে। পরেরটা আবার কতক্ষণ বিজ্ঞাপন দেবে কে জানে। এমনি বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে রেডিওটিরই কোন শো এর বিজ্ঞাপন শুরু হল। এক মহিলা সহর্ষে বললেন, “সঙ্গে থাকবে, আর জে XYZ। যার গলা শুনলে, কাকও নিজের মাথায় পটি করে দেয়।” চমকে উঠলাম, বাপরে! কি সাংঘাতিক। যাই হোক। বিজ্ঞাপন শেষ, আর জে ফিরে এলেন, এক গাদা আজগুবি কথা বলে, একটা ফোন রিসিভ করলেন। সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম, আপনির বালাই নেই। সবাই তুমি। এক মহিলা ফোন করেছেন, আর জে প্রশ্ন করলেন, “আজ সারাদিন কি করলে?”
“চপ বানালাম। ক্যাপ্সিকামকে কেটে”
“কি ভিতরে এঁটেল মাটি দিয়ে নাকি?” আর জের মন্তব্য শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না।
মহিলা অবশ্য লাস্যময় হেসে বললেন, উনি ভিতরে ফুলকপির পুর দিয়েছেন। অতঃপর উনি বললেন, “ জান আমার না খুব ইচ্ছে করছে, কুয়াশায় তোমায় কেমন দেখতে।” স্মার্ট (?) আর জে বললেন, “ আমার একটা ছবি নাও, আর ফটোশপে ব্লার করে দাও। না হলে সিগারেট ধরিয়ে আমার ছবিতে ধোঁয়া ছেড়ে দেখ। না হলে তোমার চশ্মার কাঁচটা ঘষে নাও, নিয়ে আমার ছবি দেখ।” মহিলাও বোধহয় আর নিতে পারলেন না। বোকা বোকা হেসে বললেন, “তাই করি।” ফোনটা কাটাতে আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। এর পরের ফোনটা একটা বাচ্ছা ছেলের (নাকি মেয়ের), সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, “কাকু একটু লুঙ্গিড্যান্স গানটা চালাও না। আমি ওটা শুনতে খুব ভালোবাসি।” আর জে বললেন, “ হে হে তুমি লেপের তলায় বাবার লুঙ্গি ধরে ডান্স কর।” আর সহ্য করতে পারলাম না। রেডিও বন্ধ করে দিলাম। মনে হল আমার বন্ধুটি খুব ভুল কিছু বলেননি।
 
#AnirDiary #AninditasBlog http:/amianindita.blogspot.in

Tuesday 8 December 2015

নীলতারা

নীলতারা

বাতানুকূল কফিশপ, তাও কুলকুল করে ঘামছে সাদিক। নার্ভাস লাগছে প্রচণ্ড। ধপধপে সাদা সি থ্রু শার্ট আর সমুদ্র নীল জিন্স পরে, এক তোড়া টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করছে, তারার জন্য। কত বছর পর দেখা হচ্ছে? সতেরো? নাকি আঠারো? ক্লাশ ইলেভেনে ওদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিল তারা, পুরো নাম নীলতারা। ওরা ঠাট্টা করে ডাকত, “হাঁড়িয়া কালী” বলে। ডাকবে নাই বা কেন? ঘোর কৃষ্ণ বর্ণা, স্থূলাঙ্গী, হাঁড়ির মত গোল মুখ, হাসলে চোখ গুলো ঢেকে যেত। তারা অবশ্য কোনদিন রাগ করেনি, বরং হাসি মুখেই মেনে নিত। এমনকি প্রায়ই নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করত। জনপ্রিয় হতে দেরি লাগেনি তারার। অচিরেই সাদিক আর তারা একে অপরের প্রিয়তম বন্ধু হয়ে ওঠে। টুয়েলভ পাশের পর, সাদিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল সেই পুনে। বাকি বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল, তখন কোথায় মোবাইল, কোথায়ই বা ইন্টারনেট। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ল্যান্ড ফোন আর না হলে চিঠি।  চিঠির জবাব দেবার মত অবসর সাদিকের থাকত না, তারা তাই মাঝে মাঝে ফোনই করত। তারাদের বাড়িতে ফোন ছিল না। পিসিও থেকে করত। প্রথম দিকে ভালই লাগত সাদিকের, ক্রমে বিরক্ত লাগতে লাগল। কলেজের অন্যান্য বন্ধুরাও “ভাবির ফোন” বলে খেপাত। ভাবি? ঐ হাঁড়িয়া কালি ওর মানসী? ভাবতেই বিবমিষা জাগত। ঠারেঠোরে বোঝাবার চেষ্টা করত, এত আদিখ্যেতা ওর ভাল লাগে না। একদিন বলেও বসল, বন্ধুরা ওকে নিয়ে বাজে ঠাট্টা করে, তারা পাত্তাই দিল না। বিরক্তি জমছিল, মনে আছে, ফোর্থ ইয়ারে সবে উঠেছে, রেসাল্ট মনোমত হয়নি বলে এমনি মুড খিঁচরে ছিল, উপরন্তু জ্বর আর গোটা গায়ে বেদনার জন্য সেদিন ক্লাশে যেতে পারেনি। ঠিক দুপুর বেলা চোখটা সবে জুড়ে এসেছ, অফিস থেকে খবর দিল, ফোন এসেছে। ভেবেছিল মা, ফোন তুলে দেখে তারা। তেতো স্বরে সাদিক বলল, “তুই, এই অসময়ে?” তারা হেসে জবাব দিল, “ একটা চান্স নিলাম। ভাবিনি তোকে এই অসময়ে পাব, তবু” একটু দম নিয়ে তারা রহস্য করে বলল, “একটা কথা তোকে না বলে থাকতে পারছিলাম না রে।” গা রিরি করে উঠল সাদিকের। গ্লার স্বর উঁচু করেই জিজ্ঞাসা করল,“কি? দেখ তারা একটা কথা আজ পরিষ্কার শুনে রাখ, আমার থেকে কিচ্ছু প্রত্যাশা রাখিস না।” “মানে?” হতভম্ভ হয়ে বলল তারা, “ তুই কি বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে-।” “ন্যাকামি রাখ। সব বুঝিস। শোন সবাইকে দেখে সব কিছু হয় না তারা।” গর্জন করে উঠল সাদিক। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে তারা গ্লা ঝেড়ে বলল, “সাদিক আজ আমাদের রেসাল্ট বেড়িয়েছে। আমি ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছি রে। এই খবরটা তোকে না জানিয়ে থাকতে পারছিলাম না। ভুল বুঝিস না। ভাল থাকিস। ছাড়লাম।” আর কখনও ফোন করেনি তারা।

 অপরাধ বোধ কিছুদিন ছিল। ভাবত চিঠি লিখে ক্ষমা চাইবে। তারপর ধীরে ধীরে ভুলে গেল সাদিক। জীবন তেজিয়ান ঘোড়ার মত দৌড়তে লাগল। চাকরি, লাস্যময়ী প্রেমিকা, বিয়ে, ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট, বড় গাড়ি, পিতৃত্ব সুখময় জীবন। টিনটিন যখন সাত বছরের হঠাত সাদিক আবিষ্কার করল, সবটাই ভাঁওতা। মূর্খের স্বর্গ। রেহানা করজোড়ে অব্যাহতি চাইল। না করতে পারল না সাদিকও। ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আঁকড়ে থাকা আর লাশের শয্যাসঙ্গী হওয়া আর টানা যাচ্ছিল না। কোন তিক্ততা ছাড়াই রেহানা চলে গেল, টিনটিনকে নিয়ে। মস্ত বড় ফ্ল্যাটে রয়ে গেল একা সাদিক। রেহানা না থাকায় যৌথ ই এম আই এর বোঝা টানা হয়ে উঠল দুষ্কর। বেচে দিল বিশাল ফ্ল্যাট, বড় গাড়ি,  ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটে সেই দুঃসহ রাত্রি গুলিতে সাদিক শুধু হিসাব নিকেশ করত। কেন এমন হল? সব অঙ্ক মিলে যাচ্ছিল নীলতারাতে এসে। তবে কি তারার মনস্তাপেই ঘর ভাঙল সাদিকের?
 ফেসবুকের দৌলতে তারাকে খুজে  বার করতে সময় লাগেনি। ভেবেছিল তারা ওর বন্ধুত্বের আহ্বান অগ্রাহ্য করবে, তারা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই গ্রহণ করল ওকে। কলেজে পড়ায়, আজো অনুঢ়া। সাদিক ক্ষমা চাইল, তারা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল ওর অপরাধবোধ, বলল, “পাগল হলি নাকি? আমার কোন অভিমান নেই।তবে বিয়েতে বলিসনি বলে খুব রাগ হচ্ছে। ”পরের তিনটে মাস যেন চোখের পলকে কেটে গেল। সুপ্রভাত থেকে শুভরাত্রি পর্যন্ত ভায়া মোবাইল তারাই হয়ে উঠল সাদিকের সর্বক্ষণের সঙ্গী। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা সব বলা যায় তারাকে। রেহানার সঙ্গে এই নৈকট্য কি ও সত্যি কোনদিন অনুভব করেছে?
 এত বছর পরেও তারাকে দেখেই চিনতে পারল সাদিক। মনটা একটু দমে গেল, রেহানার থেকে বেশ বেঁটে, রঙটাও_---। একটু মেকআপ তো করতে পারত। নিদেনপক্ষে একটু লিপস্টিক। তারা এসেই ওকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রেন্ডলি হাগ। কেমন যেন খুশি হতে পারল না সাদিক। রেহানার পর তারা? তারা বকবক করতে শুরু করল, অল্পকালের মধ্যেই ঢুকে পড়ল সাদিকও। বেশ খানিক পর মনে পড়ল, ফুল গুলোর কথা। পাএর কাছে রাখা কাগজের ব্যাগ থেকে বার করে দিল যখন, তারা যেন ঝিকমিকিয়ে উঠল। এত মূল্যবান রক্ত গোলাপ এর আগে পেয়েছে বলে মনে হল না সাদিকের। ভেবেছিল হাঁটু গেড়ে বসে প্রকাশ করবে নিজের মনের ভাব, কিন্তু—নাঃ থাক। বসে বসেই তারার হাতটা ধরল, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল নীলতারা, সাদিক চোখ বুজে একটু দম নিয়ে বলল, “ তারা, বহুদিন আগে করা একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। বিগত তিন মাসে আমি বুঝে গেছি, তোর থেকে ভাল আমায় কেউ বোঝে না। আমি তোর সঙ্গেই সবথেকে ভাল থাকি-”। ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিল তারা, “ কি করে বুঝলি? হোয়াটস্ অ্যাপে চ্যাট করে?” সাদিক ঘাবড়ে গেল। আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে গেল, কিন্তু ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পরেছে তারা, “ তুই আজো আমায় ভুল বুঝলি সাদিক। সিম্প্যাথেটিক রিলেশনের জন্য আর কাউকে পেলি না রে?” সাদিক ওর হাতটা চেপে ধরে কাতর ভাবে বলল, “তারা আমি সত্যিই তোকে......”
“কি? ভালবাসিস না। আমি জানি। আর যদি বাসিসও আমি বাসি না।”
“কেন তারা?”
“কেন? ভুলে গেলি? সবাইকে দেখে সবকিছু হয় না! চলি। ভালো থাকিস। যোগাযোগ রাখিস না।”
http:/amianindita.blogspot.in

Monday 30 November 2015

রক্ত ©


হুহু করে দৌড়চ্ছে গাড়ি, ড্রাইভার বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই তাড়া লাগাচ্ছিল, জঙ্গলে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে, আর সন্ধ্যার পর জঙ্গল বড়ই বিপদ সঙ্কুল। আরোহিণীরা অবশ্য অকুতোভয়। তবে জঙ্গলের গাম্ভীর্য আর রহস্যময়তার মোহেই বোধহয়, এই মুহূর্তে সবাই চুপ। পিছনের সিটে বসে সোমা ঝিমচ্ছিলো, আচমকা গাড়িটা এক ঝাঁকুনি মারাতে চমকে উঠল, গুটি কয়েক বাঁদর আড়াআড়ি রাস্তা পার হচ্ছে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল, সোমা তখনও পিছন ফিরে বাঁদর বাহিনীকেই দেখে যাচ্ছে, আচমকা মনে হল, আধো অন্ধকার জঙ্গল থেকে, মইন বেরিয়ে এল! মইন! হ্যাঁ মইনই তো। হাত নেড়ে কি যেন বলছে। সোমা গাড়ি থামাতে বলবে, ঘুমটা ভেঙে গেল।
 গাড়ি ছুটছে, আনমনা হয়ে পড়ল সোমা। মইন কেন? এত বছর বাদে মইনের স্বপ্ন? মইন ওর সহপাঠী তথা প্রথম প্রেম। ক্লাস সেভেন থেকে মাধ্যমিক অবধি টিকেছিল। তারপর নিজ নিয়মেই ভেঙে গেল। না কোন তিক্ততার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়নি।  গানের ভাষায়, দুজনের দুটি পথ দুই দিকে বেঁকে গিয়েছিল। সোমা তো কলকাতাও ছেড়ে দিল। বর্তমানে দিল্লীতে একটি কলেজে পড়ায়। সহকর্মীনীদের সাথেই বর্তমানে ডুয়ার্স ঘুরতে এসেছে।
 ডুয়ার্স থেকে ফিরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, স্টাফ রুমে বসে সোমা কিছু কাজ করছিল, আচমকা দেখে সামনে মইন দাঁড়িয়ে। “মইন তুই?” বিস্মিত হল সোমা। মইন এভাবে ঢুকল, কি করে? জানলই বা কি করে? “বস।” মইন বসল না। দাঁড়িয়ে কাতর ভাবে বলল, “সোমা আমার খুব বিপদ। একমাত্র তুইই পারিস আমাকে বাঁচাতে।” সোমা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “ কি হয়েছে?”
“এখানে না। তুই কখন বাড়ি ফিরবি?”
 সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ফ্ল্যাটে ফিরে সোমা দেখে মইন সিঁড়িতে বসে আছে। বাড়ির ঠিকানা জানল কি করে? সোমা কি বলেছিল? ঠিক মনে করতে পারল না। “আয়। কি খাবি? চা চলবে?”
“কিচ্ছু না।” ধপ করে সোফায় বসে পড়ল মইন। “বীয়ার চলবে?” হাত নেড়ে না বলে মইন, একটু দুঃখী মুখে বলল, “কদিন আগে হলে বীয়ার দৌড়ত।” বাজে সময় নষ্ট না করে সোমা বলল, “বল”।
“তোকে শুধু একটা ফোন করতে হবে-” মইনকে মাঝপথে থামিয়ে সোমা বলল, “মানে? কাকে?”
“রাবেয়া কে। ওকে বল ও যেন আমার জন্য অযথা কষ্ট না পায়। তৌফিক খুব ভাল ছেলে, ওকে বিয়ে করে।”  “দাঁড়া দাঁড়া। বারেয়া কে? আর এ শালা তৌফিকই বা কে?”অসহিষ্ণু গলায় জানতে চাইল সোমা। মাথা নীচু করে মইন জানাল, “রাবেয়ার সাথে আগামী মাসে আমার বিয়ে। অনিবার্য কারণ বশত বিয়ে করতে আমি অপারগ।”
“বেড়ো। দূর হ। এক্ষণই বেড়িয়ে যা।” উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল সোমা। বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস আর তারপর প্রাক্তন প্রেমিকাকে শিখণ্ডী খাড়া করে কেটে পড়া, তোর দোজখে ও জায়গা হবে না হারামজাদা।” মইন দুর্বল ভাবে বলল, “ না, না তুই ভুল বুঝছিস।” সোমা একটাও কথা শুনতে রাজি হল না। চলে গেল মইন সেদিনের মত, কিন্তু ঘাড় থেকে নামল না। পরবর্তী পনেরো ষোল দিন সোমা বাড়ি ফেরার সময় রোজ দেখত মইন সিঁড়িতে বসে আছে, ক্লান্ত কাতর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই বলে, “প্লিজ। রাবেয়াকে একটু বল। বড্ড কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। একটা ফোন। আর জ্বালাবো না তোকে।”
 অবশেষে মনটা আদ্র হল সোমার। মইন খারাপ ছেলে ছিল না। কার কি অসহায়তা থাকে বলা যায় না। পাঁচন খাওয়া মুখে একদিন বলল, “নম্বরটা দে। একটা ফোন ব্যস। আর আমাকে যা খিস্তি মারবে, সে গুলো সুদ সমেত তোকে দেব।” মইন মৃদু হাসল। সোমা জিজ্ঞাসা করল, “ ও জানে? আমাদের ব্যাপারটা?” মইন ঘাড় নাড়ল, অর্থাৎ না। ফোন লাগল, কলকাতায়, একটি মিষ্টি গলা ধরল, সোমার মনটা খারাপ হয়ে গেল, গলা ঝেড়ে বলল, “রাবেয়া?”
“জী? আপনি?” “আমি সোমা। মইনের সাথে স্কুলে পড়তাম।”
“ও। বলুন।” দাঁতে দাঁত চেপে সোমা বলল, “রাবেয়া আমায় মাপ করো। মইন দিন পনেরো ধরে বিরক্ত করছে বলে ফোন করতে বাধ্য হলাম।”
“মানে? কি যাতা বলছেন?” রাবেয়ার গলা চড়ল। সোমা ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল, “ জানি আগামী মাসে তোমাদের বিয়ে। ও বলছে, ও এই বিয়েতে অপারগ। ও চায় তুমি,” দম নিয়ে বলল,  “তৌফিককে বিয়ে কর।” কথা শেষ করে সোমার ইচ্ছে হল, নিজের পশ্চাৎ দেশে একটি লাথি মারতে। ওদিকে যথারীতি রাবেয়া চিৎকার করতে লাগল, “ ছিঃ। লজ্জা করে না আপনার। একজন মৃত লোককে নিয়ে এই ধরণের বেহুদা--। ” “মৃত? কি বলছ? জানি ও যা করেছে, আমারই ইচ্ছা করছে ওর গলা টিপতে।” সোফায় মাথা নিচু করে বসা মইনের দিকে রক্ত চক্ষু দিয়ে বলল সোমা।
“জী না। মৃত মানে মৃত। হড়কা বানে গাড়ি ভেসে গিয়েছিল, তিন দিন বাদে বডি পাওয়া যায়। আর আপনি তার নামে ছিঃ।” শেষের দিকে কেঁদে ফেলে রাবেয়া। ফোন কেটে যায়, হতভম্বের মত মইনের দিকে তাকিয়ে থাকে সোমা। মইন মাথা নামিয়ে বলে, “ ও ঠিক বলছে।”
“মানে?” ভিতরে কেমন যেন কাঁপুনি লাগছে সোমার। এতদিন কেন খেয়াল করেনি, মইন রোজ একই জামা পড়ে আসে কেন? ওর শার্টের বুকের কাছে ঐ দাগটা কি শুকিয়ে যাওয়া রক্ত? আতঙ্কে জ্ঞান হারাবে নাকি, মইন সোফা থেকে উঠে এসে ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসল, “সোমা আমি কবরে গিয়েও শান্তি পাচ্ছি না। রাবেয়াটা মরে যাবে। খাওয়া-দাওয়া, অফিস যাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছে। বড় ভালোবাসি ওকে। তুই ওকে বাঁচা।”
প্রচণ্ড কাঁপুনি লাগছে সোমার। গলা কাঠ। কোন ক্রমে বলল, “আমি কেন?” মইন মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। বোধহয়, সেই যে হাত কেটে রক্ত বার করে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মৃত্যু ও আমাদের আলাদা করতে পারবে না-”। সোমা কাতর গলায় বলল, “সেতো ছেলেমানুষি ছিল। ঊর্মি কোথায় পড়েছিল, একে অপরের রক্ত মিশিয়ে প্রতিজ্ঞা করলে, সেই জুটি কেউ ভাঙতে পারে না।” মইন হেসে বলল, “ দূর কি গাম্বাট ছিলাম। কিন্তু হয়তো তাই শুধু তোর সাথেই আমি কমিউনিকেট করতে পারছি। রাবেয়ার সাথেও না। হেল্প কর সোনা। ”
মইনের অন্তিম ইচ্ছা রাখতে কলকাতা এসেছে সোমা। রাবেয়াদের বাড়ি পার্ক সার্কাসের ভিতরে। এককালে রাবেয়ারা যে উচ্চবিত্ত ছিল বোঝা যায়। রাবেয়া প্রথমে ওকে চিনতে পারেনি। সোমা পরিচয় দিতে রাবেয়ার মুখ লাল হয়ে গেল, হয়তো ওকে বাড়ি থেকে বার করেই দিত, যদি না মইনের বলা কিছু একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য সোমা ওকে বলত। রাবেয়ার মুখ প্রথমে লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল, পরক্ষণেই নিভে গেল সব আলো। আর্ত চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ল রাবেয়া। শেষ মুহূর্ত অবধি সোমাকে জড়িয়ে রইল রাবেয়া। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব শুনল। শেষে শুধু বলল, “তোমাকে আমার ঈর্ষা হচ্ছে।”
পরবর্তী দুই দিন আর মইন এল না। হাঁপ ছাড়ল সোমা। তৃতীয় দিন ওর ট্রেন। বাই বাই কলকাতা। রাজধানীর এসি টু টায়ারে লোয়ার বার্থ। আরামে ঘুমিয়ে ছিল সোমা। হঠাত মইন ডাকল। সোমা বিরক্ত হয়ে বলল, “ এবার আমার পিছু ছাড় ভাই।” মইন মৃদু হেসে বলল, “ আর জ্বালাব না। তুই অনেক করেছিস। ধন্যবাদ জানাতে এসেছি।” মনটা খুশি হয়ে উঠল সোমার। তবে কি রাবেয়া? মইন হেসে মাথা নাড়ল, “ না। তুই যা ভাবছিস তা নয়।”
“তবে? রাবেয়া?” সোমা অবাক স্বরে বলল। মইন হেসে বলল, “রাবেয়া? রাবেয়া বড় জেদি মেয়ে। রাবেয়া” ডাকল মইন। কামরার অন্ধকার কোনা থেকে হঠাৎ বেড়িয়ে এল রাবেয়া।

Friday 20 November 2015

অনির ডাইরি ১৯শে নভেম্বর ,২০১৫



বছর খানেক আগের কথা,পরিবহন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের টাকাকড়ির ব্যাপারটা আমিই দেখতাম, আজও দেখি অবশ্য। শ্রমিকদের  প্রদেয় নানা অনুদান তথা বিভিন্ন কমিশন, বিল ইত্যাদির জন্য বহু সমপদস্থ  অফিসার আমাকে তাগাদা দিতে আসতেন, চাকুরি জীবনের অন্তিম লগ্নে প্রোমশন পাওয়া এক ভদ্রলোক তাদের মধ্যে অন্যতম।  উনি যখনই আসতেন, নিদেনপক্ষে আধ ঘন্টা গল্প করে যেতেন।ওণার গল্পের কিয়দংশ জুড়ে থাকত সমমর্যাদা এবং অধস্তন কর্মচারীদের কুৎসা।কুৎসা যদি পরকীয়া সম্পর্কিত হত, আমার উৎসাহের অন্ত থাকত না, কিন্তু চুরিচামারী বা ঘুষোঘুষির গপ্পে আমার ঘুম পেত।  সেটি  আমি ঠারেঠোরে ওণাকে জানিয়েও ছিলাম।  কিন্তু উনি এক গলা  জিভ কেটে বলেন, হাজার হোক আমি ওণার কন্যাতুল্য। যাই হোক শেষের দিকে ওণার গল্পের সিংহভাগ জুড়ে থাকত এক অধস্তন মহিলা কর্মচারী, ভদ্রলোকের সাফ কথা মহিলা কেন ঘুষ খাবে? উনি প্রায়ই সবার সামনে সেই মেয়েটিকে বলতেন, “ দেখ বাপু, তুমি যতই তোমার পুত্রকে( নাকি কন্যা) নামি(অর্থাৎ দামি) স্কুলে ভর্তি করাও না কেন, মা যদি অসৎ হয়, সন্তান কোনদিন মানুষ হবে না। ” প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ঘুষ খাবার ব্যাপারে ঐ ভদ্রলোক কিন্তু প্রবাদ প্রতিম। ওণার পুত্র কিন্তু দিব্যি  “ মানুষ ” হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষগণ ঘুষ কেন, নরোবর, গোবর, ছাইপাঁশ যা খুশি খেতে পারে, তাতে কোন দোষ নেই।  অথবা দোষ থাকলেও তা তাদের সন্তানদের মনুষ্যত্ব বিকাশে আদৌ কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, কিন্তু মহিলা খেলেই ছিঃ।

 পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের দায়ভাগ কখনই তাদের জাতের ঘাড়ে চাপে না।  এই যে নির্ভয়া বা হেতাল পারেখ বা ঘরের পাশে কামদুনির অপরাজিতা, এত কাণ্ডের পরও আমরা ধর্ষককে গালমন্দ করেছি। কেউ কি “হে বাবার জাত কি করে তোমরা একটি সংজ্ঞাহীন ধর্ষিত তরুণীকে দুই পা টেনে ছিঁড়ে খুন করতে পারলে” মার্কা বালখিল্যচিত পোস্ট করেছিলেন? বরং উল্টোটাই দেখেছিলাম, কিছু পুঙ্গব পোস্ট করেছিল, “ আমরা পুরুষ।  কিন্তু ধর্ষক নই। ”

প্যারিসে যে হত্যালীলা হল, তারপর আপনারাই বললেন, “এস।  প্যারিসের জন্য প্রার্থনা করি। ” পাছে কেউ আপনাকে ধর্মান্ধ মনে করে আপনি আরো বললেন, “ হত্যাকারীর কোন জাত নেই। কোন ধর্ম নেই।  ” উফ্ কি হেপ মশাই আপনি।  আপনার পোস্টে/ কবিতায় পটাপট ১০০টা লাইক পড়ে গেল। অথচ পরদিন যখন এক অপোগণ্ড পুলিশ এক ব্যক্তিকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল, সঙ্গে- সঙ্গে ভুলে গেলেন আগের দিনের উদারতা।  প্যারিসেরটা আইসিস ছিল, কিন্তু এই খুনটা রেল পুলিশ করেনি।  করেছে একটি মেয়েছেলে। এত সাহস!!! ফেসবুকে বন্যা বইয়ে দিলেন মশাই।  কি সব মারকাটারি পোস্ট। 'লেডিস স্পেশালে যদি একটি পুরুষ শিশু ভূমিষ্ঠ  হয়, তুই কি করবি?' 'মায়ের জাত হয়ে মানুষ খুন করলি? করতে পারলি?'

দাদা এতখানি দ্বিচারিতা? যা ঘটে গেছে তা নিন্দনীয় এতে কোন দ্বিমত নেই।  কিন্তু কোথাকার কোন উন্মাদ রেল পুলিশের অপকর্মের দায়ভাগ নিতে বা জবাবদিহি করতে আমি নারাজ।  আর যদি করতেই হয়, আসুন ফেয়ার প্লে হোক। বেশি নয় রেলের বিগত পাঁচ বছরের ইতিহাস  ঘেঁটে বার করুন কত গুলি এইরূপ নক্কারজনক খুনজখম হয়েছে এবং তার মধ্যে কতগুলি ধাক্কার জন্য আপনার জাত  দায়ী আর কতগুলির জন্য আমার জাত!!!

অমিয়ার একদিন



উদাস হয়ে বসেছিল অমিয়া। বিগত কয়েকমাসে জীবনটা যেন ওলটপালট হয়ে গেল।  অমিয়া আজ দিশেহারা ।  সুনন্দ সামন্তের সঙ্গে সখ্যতা তো আজকের নয়, সেই যে যবে সুনন্দের প্রথমা স্ত্রী আত্মঘাতী হল, গোটা অফিস, আত্মীয় পরিজন সকলে বর্জন করেছিল ওকে।  অপ্রয়োজনে কেউ বার্তালাপ ও করত না।  শুধু অমিয়া ছিল, সেই গভীর ডিপ্রেসনের দিনগুলিতে ওরা ছিল নিছক বন্ধু।  অফিস অন্তে নির্ভেজাল আড্ডা,কখনও সাথে ঠান্ডা বীয়র।  আবার কখনও বা নিছক চা সিগারেট।  সুনন্দ বলত ,“ অমিয়া, মাই বাডি। ” কবে যে এই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিল সে কি ছাই অমিয়াও বুঝেছিল? বাবা মারা যাবার পর অমিয়া তখন এ্যাকিউট ডিপ্রেসনে ভুগছিল, দিনের পর দিন   অফিস কামাই।  নিজের চতুর্পাশে দুর্ভেদ্য  প্রাচীর গড়ে তুলেছিল অমিয়া। সেই প্রাচীর উড়িয়ে  টেনে হিঁচড়ে ডিপ্রেসন থেকে বার করেছিল সুনন্দ।  সেই কৃতজ্ঞতাবোধই হয়ে উঠল যত নষ্টের গোড়া।  বিবাহের প্রস্তাব অমিয়াই দেয়।  সুনন্দ ও আপত্তি করেনি।  বিয়ের পরও বছর কয়েক মন্দ কাটেনি। তারপর কি যে হল? সুনন্দ যেন ধীরে ধীরে ভুলে যেতে লাগল যে অমিয়া ওর জীবনে আছে।  প্রথমে ছুঁতোনাতায় আলাদা হল বিছানা।  স্টাডি রুমটাই হয়ে উঠল সুনন্দের শয়ন কক্ষ।  কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের কোন যুৎসই জবাব ওকে দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি সুনন্দ।  তীব্র অভিমানে দিন কয়েক মায়ের কাছে থেকে আসা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি অমিয়া। পরের ধাপে বন্ধ হল বার্তালাপ।  কথা বলতও না।  জবাবও দিত না। তৃতীয় ধাপে বন্ধ করল অমিয়ার মুখদর্শন। অমিয়া ডাইনিং হলে গিয়ে হাজির হলেই সটান উঠে চলে যেত সুনন্দ। অমিয়া কিছু কিনে আনলে বা রান্না করলে খেত না ।  অন্তিম ধাপে ছিল প্রকাশ্যে পরকীয়া।  অমিয়ারই চোখের সামনে ওদেরই দপ্তরের মহিলা সহকর্মীর সাথে রগরগে অ্যাফেয়ার।সেই নিয়ে গোটা অফিসে সে কি কেচ্ছা।  শেষে বীথি বলল,“ অমিয়াদি জানি তুমি সুনন্দ স্যারকে ভীষণ ভালবাস।  কিন্তু সহ্যের ও তো একটা সীমা আছে? উনি চান না এই বৈবাহিক সম্পর্ককে দীর্ঘায়ত করতে।  তুমি কি সত্যি সেটা বুঝতে পারছ না?”

মাস ছয়েক হল মায়ের কাছে আছে।  সম্পর্ক ভাঙা নিয়ে সুনন্দ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। অমিয়াও নয়।  মা, বন্ধুরা বার কয়েক বলেছে উকিলের সাথে কথা বলতে।  বীথি পরিচিত  এক উকিলের নম্বরও যোগাড় করে দিয়েছে।  তাও মাস তিনেক হবে। অমিয়া ফোন করেনি। করতে পারেনি।

“ এই মরেছে! পয়সার ব্যাগটা কোথায় ফেললাম?” জনৈক মহিলা কণ্ঠ বলে উঠল, চমকে বাসে ফিরে এল অমিয়া। উল্টো দিকের সিটে বসে এক মধ্যচল্লিশের মহিলা তার ব্যাগ হাঁটকে চলেছেন, বাতানুকূল ভলভো বাস।  কন্ডাকটর পরম ভদ্র।  বিনীতভাবে বলল, “ আছে নির্ঘাত দিদি।  দেখুন না।  আমি ততক্ষণ অন্য টিকিট গুলো কাটি। ” কন্ডাকটর চলে গেলেও মহিলা ব্যাগ হাঁটকানো থামালেন না। কিছুক্ষণ পরে আবার আর্ত স্বর শোনা গেল,“ পেলাম না তো।  এবার কি হবে? হে ঠাকুর আমার আর কত পরীক্ষা নেবে?” শেষের দিকে মহিলার গলা ভেঙে গেল।  কেউ একজন পাশ থেকে বলল,“ কোথায় যাবেন?”
মহিলা কান্না চেপে জানাল,“ হাইকোর্ট নামব। ” পাশ থেকে অন্য কেউ বলল,“পয়সা  যখন নেই, এখানেই নেমে যান। ” ফিসফিসানি শোনা গেল,“ এসব এদের রোজের কেত্তণ। ” কথাটা মহিলার ও কানে গেল।  চোখের জল চলকে  উঠল।  উনি আর্ত স্বরে বললেন, “ বিশ্বাস করুন, আমি ভদ্র- ” কথা শেষ করত পারলেন না।  ক্ষণিক দম নিয়ে কাতর ভাবে বললেন,“ কেউ অনুগ্রহ করে টিকিটটা কাটিয়ে দেবেন? বিশ্বাস করুন আমার খুব বিপদ।  আমার ভাই আদালতে অপেক্ষা করছে, আমি পৌছেই টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দেব।” অমিয়ার অসহ্য লাগছিল ওণার অসহয়তা। দৃঢ় স্বরে জানাল, “ আমি কাটিয়ে দিচ্ছি। ” টিকিটটা মহিলার হাতে দিতে উনি কৃতজ্ঞ ভাবে জানালেন, “ আপনি একটু হাইকোর্ট চলুন, আমি টাকাটা ফেরৎ দেব। ”
অমিয়া মৃদু হেসে বলল,“ মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকার জন্য আপনাকে হাইকোর্ট অবধি ধাওয়া করব? ছাড়ুন।  আপনি বিপদে পড়েছিলেন, এটুকু আর কি এমন?”
মহিলা নাছোড়বান্দা, “ আপনার নাম ঠিকানাটা দিন অন্তত।  প্লিজ ভাই!” মহিলার কাতর দৃষ্টির সামনে অমিয়া আর না করতে পারল না, দায়সারা ভাবে ঠিকানা দিয়ে নির্দিষ্ট  স্টপে নেমে পড়ল। ওর সঙ্গে রোজ নামেন, এক ভদ্রলোক  শুধু বললেন, “ রোজকার ব্যাপার দিদি।  কতজনকে দেবেন? ও টাকা আর পেয়েছেন?”

মহিলা সত্যিই এলেন না।  মঙ্গল থেকে রবিবার হয়ে গেল, তাঁর টিকিও দেখা গেল না। ভুলেও গেল অমিয়া।  রবিবার ভরপেট জলখাবার  খেয়ে, ছাতে গিয়ে মনের সুখে একটা বিড়ি ধরিয়েছে, হঠাৎ নীচে থেকে মা হাঁক পাড়ল, কে যেন দেখা করতে এসেছে।  দুড়দাড় করে নীচে নেমে দেখে সেই মহিলা একা বসে আছেন।  অমিয়া বাকরহিত। মহিলা সলজ্জ ভাবে বললেন, “ তোমার কবে ছুটি তা তো জানি না ভাই।  যদি দেখা না হয়, তাই -”
অমিয়া হাসবে না কাঁদবে? “ মাত্র কটা টাকা দিতে এত কষ্ট করলেন?”
“ মাত্র হতে পারে, তবে আমার দুঃসময়ে তোমার উপকারটুকু ভুলি কি করে?”
“ বসুন না। চা?” মহিলা মাথা নাড়লেন।  চা হতে যেটুকু সময় লাগে, ততক্ষণ কি কথা বলা যায়? মহিলাও মাথা নীচু করে নিজের হাত দেখছেন।  অমিয়া গলা ঝেড়ে বলল,“ তা আপনার সমস্যা মিটেছে?”
“ হুঁ চিরতরে। ”
“ বাঃ।  তাহলে তো নিশ্চিন্ত। ”
মহিলা মাথা না তুলেই ঘাড় নাড়লেন। নেহাৎ কথা বলার জন্যই অমিয়া জিজ্ঞাসা করল,“ তা কি সমস্যা সেটা কি জানতে পারি? মানে যদি সমীচীন হয়। ”
“ঐ দিন আমার স্বামীকে মুক্তি দিলাম। ”
“ অ্যাঁ?”
“ ডিভোর্স। ” মাথা তুলে করুণ ভাবে বললেন উনি।
“ কিন্তু  কেন?” উত্তেজিত ভাবে জিজ্ঞাসা করেই অমিয়া বুঝতে পারল শালীনতার সীমা লঙ্ঘন  করে ফেলেছে। ক্ষমা চাইতে যাবে, মহিলা বলে উঠলেন,“ সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।  পচা গলা সম্পর্ক আঁকড়ে তাও বসেছিলাম।  শয্যা আলাদা যে কবে হয়েছে আজ আর মনে পড়ে না। শেষের দিকে কথা বলা দূরের কথা, আমার উপস্থিতিও সহ্য করতে পারত না।”

 “ ঘেন্না হত নিজেকে।  তোমাদের মত লেখাপড়া  শিখলে কবেই হয়তো বেড়িয়ে  আসতাম।  কোথায় যাব?নিরাপত্তাহীনতা নাকি প্রেম জানি না, হয়তো এই দ্বিধায় কেটে যেত জীবন।  কিন্তু উনি করজোড়ে মুক্তি চাইলেন। জানালেন, উনি শীঘ্রই বাবা হতে চলেছেন। সেই মহিলা ওণার বন্ধু পত্নী। ”
“ ছিঃ। ”ধপ করে বসে পড়ল অমিয়া।
মহিলা মৃদু হাসলেন,“ওণার জীবন ভাই। যা ভাল বুঝেছেন। মাথা উঁচু করে বেড়িয়ে  এলাম।  খোরপোশ আদায় করার কথা বলেছিল আমার উকিল। নিইনি। ”
“কেন? ওটা আপনার অধিকার।  খাবেন কি? আপনাদের জন্যই এরা এত বাড়ে। ”ক্ষোভে ফেটে পড়ল অমিয়া।  অসহ্য ন্যাকা মেয়েছেলে। মহিলা ঘাড় উঁচু করে বললেন,“বাচ্ছা পড়াব, প্রয়োজনে লোকের বাড়ি বাসন মাজব। কিছু না হলে নিজেকে বেচব।
-----শেষের রেশ রাখব না। ”

মহিলা চলে গেছেন। মায়ের সঙ্গেও কিছুক্ষণ গল্প করে গেলেন।  নিজের ব্যক্তিগত কথা অবশ্য কিছু বলেননি। উনি চলে যাবার পর থেকে অমিয়া গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছে, সেই বীথির দেওয়া উকিলের কার্ডটা কোথায় গেল? মা বা কাজের দিদি নির্ঘাত কোথাও ফেলেছে। ওটা ওর এক্ষুণি চাই।
#amiani #Aninditasblog

সেই টেলিফোন



আজ কালিপুজো। সারা শহর উৎসবে মেতেছে। আলোর রোশনাই  এ ঝলমলে কানাগলি থেকে রাজপথ। আদালতের নির্দেশ মান্য করেও বাজি-পটকা ফাটাতে পিছিয়ে  নেই নগরবাসী।
বিকট বিরক্ত লাগছে অলক্তার।  মা- কাকিমা,  আর বোন সূর্য- তারাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বের হল।  সূর্য - তারা ওর যমজ পুত্র কন্যা । এমনিতে ওরা দিল্লীবাসী। কোন অবাঙালি পরিবার তাদের পুত্রবধূকে দেওয়ালিতে বাপের বাড়ি যাবার অনুমতি দেয়? কিন্তু বেদ এবং তার পরিবার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম । নাহলেও অলক্তা চলে আসত।  যদিও কাকার ছেলে, তবু ভাইফোঁটার দিন ও কলকাতায় নেই তা অলক্তা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না।
যাই হোক এই মুহূর্তে বাড়িতে ও একা।  ঠিক একা নয়, একতলায় ঠাকুমা টিভি দেখছে। ঐ প্যানপেনে বাঙলা সিরিয়াল দেখলে অলক্তার গ্যাস হয়।  খানিক ছাতে পায়চারি করল, ভাল লাগল না।  কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।  কিন্তু কে? বেদকে ফোন করল, ফোনটা কেটে দিল বেদ।  নির্ঘাত রাস্তায় আছে।  আর কে? বন্ধু অসংখ্য ।  কিন্তু ফেসবুকে।  আজ সবাই খুব ব্যস্ত।  কত রঙ-বেরঙের পোশাক পরে ছবি দিচ্ছে সবাই।  কেউ রঙ্গোলী বানাচ্ছে তো কেউ বাজি পোড়াচ্ছে।  শুধু অলক্তাই যেন নিষ্কর্মা এবং নিঃসঙ্গ । কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে সোফায় গড়াগড়ি  খেতে খেতে এক আজব খেলা শুরু করল অলক্তা, স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া ফোন নম্বরগুলি মনে করার খেলা।  আচ্ছা বাবার অফিসের নম্বর কি ছিল? আর মায়ের? কাকিমার বাপের বাড়ির নম্বর? কিছু মনে পড়ল, কিছু পড়ল না।  একটা নম্বর অলক্তা কিছুতেই মনে আনতে চাইছিল না, তবু বারবার মাছের মত ঘাই মারতে লাগল। বোধহয় অলক্তার জীবনে এককালে সবথেকে বেশিবার ডায়াল করা নম্বর ঐটাই ছিল। বিগত আট নয় বছরে একবারও ডায়াল করেনি।  তবে আজ কেন?
রঙ্গীতই ধরল ফোনটা, “ হ্যালো”।  বুকের মধ্যে অসহ্য কাঁপুনি।  গলা শুকিয়ে কাঠ।  পেটের মধ্য ডানা ঝাপটাচ্ছে কয়েক হাজার প্রজাপতি। কেটে দেবে কি? আজকাল সবার বাড়িতেই সিএলআই লাগানো থাকে। এখুনি ঘুরিয়ে ফোন করে যাতা বলবে।  সামান্য কিছু কথা বলে রেখে দেওয়াই ভাল।  গলা ঝেড়ে অলক্তা বলল, “ হ্যালো। ”
“ অলক্তা? অনেকদিন পর?” এক লহমায় চিনে নিল রঙ্গীত। তবে কি, মরে হেজে যাওয়া গাছের শিকড়ে আজও প্রাণ অবশিষ্ট আছে? কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে রইল।  রঙ্গীতই প্রথম কথা বলল, “ একটু ধর।  ছাতে গিয়ে কথা বলছি। ” ঝটকা খেয়ে বাস্তবে ফিরে এল অলক্তা। মনে পড়ে গেল বেদের কথা।  ছিঃ, একি করে বসেছে। এ তো বেদের সঙ্গে দ্বিচারিতা।  বেদ হয়তো কিছুই মনে করবে না, হেসে উড়িয়ে দেবে,কিন্তু এ কি করল অলক্তা।  ফোন কাটতে যাবে, ওদিকে গুঞ্জরিত হল রঙ্গীতের আবেশ মাখা কণ্ঠ, “ কেমন আছিস?”
“ ভাল। ” আড়ষ্ট স্বরে বলল অলক্তা। “ তুই? ছেলেমেয়ে কটি? কত বড় হল?” সন্তর্পণে  বউ এর কথা জিজ্ঞাসা করল না অলক্তা। রঙ্গীতের গলা থেকে আবেশ খসে পড়ল, কেজো গলায় বলল,“ বছর খানেক হল বিয়ে করেছি।  এখনও হয়নি। তোর?”
“ দুটি।  যমজ ছেলে-মেয়ে। ”
“ও।  কি নাম?”
“সূর্য - তারা। ”
“বাঃ। ”আবার নীরবতা।  অখণ্ড নীরবতা।  কলকাতা কি শান্ত হয়ে গেল? শ্মশানের নীরবতা কেন? আবার রঙ্গীতই কথা শুরু করল,“ সব ভুলে আমরা কি আবার বন্ধু হতে পারি না?”
অলক্তা মনে মনে বলল,“ শেষ আট নয় মাসের সম্পর্ক টুকু ছাড়া, আমরা তো বন্ধুই ছিলাম। সম্পর্ক শেষ করলি, সাথে সাথে বন্ধুত্বটুকুও।  হাতে পায়ে ধরেছিলাম, ঐটুকু থাক। শুনেছিলি?”
রঙ্গীত অধৈর্য হয়ে উঠল,“ হ্যালো?অলক্তা?”
“হুঁ। ”
“শুনলি? কি বললাম?”
“হুঁ।  এত বছর পর সেটা আর হয় না”।
“কেন হয় না? শেষ আট মাস আমরা ভূলে যাব। ”বলল রঙ্গীত।
অলক্তা বলল,“ ভুলেই তো গেছি। নতুন করে ভুলতে গেলে দেখবি, শেষ আট মাস টুকুই রয়ে গেল।  পূর্বের আট বছরটাই বিস্মৃত হলি। কাজেই” কথা শেষ করল না অলক্তা।
“ হুঁ। আমরা” দুঃখী গলায় বলল রঙ্গীত,  “কেন এমন হল অলক্তা? এত ভাল বুঝতাম একে অপরকে। কি করে যে-। ”
শান্ত গলায় জবাব দিল অলক্তা, “ কারণ আমাদের সব কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত শুধু ঝগড়া করতাম আমরা। আহত হতাম এবং আঘাত করতাম। ” রঙ্গীতের উদাস শ্বাসপ্রশ্বাস  শোনা যাচ্ছে, অলক্তা আবার বলল, “ যা হয়েছে সেটাই হওয়া উচিত ছিল।  শুধু ঐ তিক্ততা আর গালিগালাজটুকু না হওয়াই বাঞ্ছনীয়  ছিল।  মাঝখান থেকে বিদায় বলার অবকাশটুকু আর হয়নি। ”
“হুঁ। ”সম্মতি জানাল রঙ্গীত।
“রাখি।  ভালো থাকিস। ” বলল অলক্তা। “তুইও ভালো থাক। পারলে যোগাযোগ রাখিস। শোন তুই ফেসবুকে আছিস?”
“নারে। ও সব পারি না। ”মিথ্যা বলল অলক্তা। মনে মনে আবার বলল, “ পাগল।  যোগাযোগ তোর সঙ্গে? পাগল না পুলিশ। ”
“গুডবাই অলক্তা। ” গাঢ় স্বরে বলল রঙ্গীত। “ পারলে ফোন-” ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে অলক্তা।
দ্রুত হাতে ডায়াল করছে বেদের নম্বর, “কেয়া হ্যায় বিবি?আয়াম ড্রাইভিং না” অসহিষ্ণু গলায় বলল বেদ।  গলায় একরাশ অভিমান ঢেলে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল অলক্তা, “তো? মেরা ফোন নেহি উঠা সাকতে? ভাগ যাউঙ্গি তো পতা চলেগা। ”
ওপাশে বেদের অট্টহাস্য, “কব? কিসকে সাথ? ভাগনে কি ক্যায়া জরুরৎ? ম্যায় খুদ ছোড় আউঙ্গা জী। পর ও শুভ্ দিন আয়েগা কব?” এদিকে হেসে উঠল অলক্তা ও,মনে মনে বলল, “উফ।  ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই--”।
#love #Kolkata #blog #blogger #banglablog #bengali_blogger #AmiAni #Aninditasblog #Hope_you_like_it

Friday 6 November 2015

অনির ডাইরি ৫ই নভেম্বর  ,২০১৫

অনির ডাইরি ৫ই নভেম্বর  ,২০১৫

তখন আমি এ এল সি খড়্গপুর। শৈবাল দা ডি এল সি।  মেদিনীপুর অফিস তখনও হয়নি।  দুই মহকুমা মিলে ১৫টি ব্লক আর দুটি মিউনিসিপ্যালিটি ।  মাত্র চার জন ইন্সপেক্টর।  প্রত্যেক কে একাধিক ব্লকের চার্জ দিয়েও সমস্যা মিটত না।  অগত্যা কোথাও পিসি পি এস, কোথাও অবসর প্রাপ্ত ইন্সপেক্টর সাহেবরাই কাজ চালাতেন।  কোথাও বা বিডিও সাহেবরা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে অন্য কোন এক্সটেনশন অফিসারকে চার্জ দিতেন।  সব মিলিয়ে অবস্থা সঙ্গীন।  দুটি মিউনিসিপ্যালিটি এবং পাঁচটি ব্লকের দায়িত্বভার ছিল একান্তই আমার। ওপরমহলে এ নিয়ে কান্নাকাটি করতাম বটে, ব্যাপারটা মন্দ ছিল না।  যদিও তৎকালে মাত্র দশ দিনের গাড়ি, তাও প্রচুর ঘুরতাম।  চকচকে ৬নং বা ৬০ নং সড়ক দিয়ে উড়ে যেত গাড়ি। কাঁচ ভেদ করে হু হু করে ছুটে আসত মাতাল হাওয়া।  এক, এক ঋতুতে বয়ে আনত এক, এক সুবাস ( মাঝে সাঝে দুর্গন্ধ ও)।  চারিপাশে নয়নাভিরাম প্রকৃতি ।  কোথাও সারি সারি ইউক্যালিপটাস, কোথাও বা শাল, কখনও ঘন সবুজ ধান ক্ষেত, কখনও হলুদ বা চুনেহলুদ গাঁদাফুলের ক্ষেত।  আবার কখনও চারপাশ জল থৈ থৈ। একদিনে গোটা দুই ব্লক ঘুরে অফিস ফিরতে গেলেই মোটামুটি ১০০ কিমির বেশি হত। এত দীর্ঘ পথ একা পরিভ্রমণ করা বেশ দুষ্কর । আমার নিত্যসঙ্গী ছিলেন বাগ বাবু আর নজরুল। বাগ বাবু পূর্বে পি ডব্লু ডি তে চাকরি করতেন।  অবসর গ্রহণের পর আমাদের দপ্তরে সামান্য কমিশনের বিনিময়ে সাসফাউ এর খাতা লিখতেন। আর নজরুল ছিল পিওন।  আজ ভাবতে অবাক লাগে কেন যে,ওনারা আমার ঐ বেয়াড়া আবদারে রাজি হতেন! আমরা শুধু ঘুরে বেড়াতাম তাই নয়, উদরের উপাসনাও হত। কোথায় কি ভালো  পাওয়া যায়, বাগ বাবুর নখদর্পণে ছিল। কিচ্ছু না পাওয়া গেলে পুরাতন বাজারের বাদাম লস্যি!! গ্লাস ভরা অমৃত।  ঘন দইয়ে প্রচুর কাজু দিয়ে বানানো হত।  চামচ দিয়ে ছাড়া খাওয়া যেত না। ওপরে একটা গোলাপ গন্ধী লাল সিরাপ ঢেলে দিত।  তীব্র গা জ্বালানো গরমে, এক চামচ খেলেই জন্নৎ দর্শন।

সেবার নজরুল হঠাৎ করে রোজা রাখতে শুরু করল, আমরাও উৎফুল্ল  হয়ে উঠলাম রোজা রাখার অর্থ বড় করে ইদ পালন এবং আমাদের ভুঁড়ি- ভোজ।  মুস্কিল হল এরই মধ্যে  একদিন হঠাৎ করে ব্লকে যাবার প্রয়োজন দেখা দিল, বাগ বাবু এবং আমি সম্মিলিত ভাবে নজরুলকে বোঝালাম , “এবারের মত ক্ষ্যামা দাও।  রোজারত অবস্থায় এতটা পথ যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ” নজরুল নিমরাজি হল।  আমি মজা করে বললাম,“ এবারের মত বাদাম লস্যি তাহলে বাগ বাবু আপনি আর আমিই---”। পরের দিন বাগ বাবুকে নিয়ে গাড়ি এসেছে, কোয়ার্টর থেকে আমায় নিতে, গাড়িতে উঠে দেখি, ড্রাইভারের পাশের আসনে শ্রীমান নজরুল।  আঁতকে উঠলাম, “ একি? কাল যে বললে? এতটা ধকল নিতে পারবে?” নজরুল একগাল হেসে প্রায় নব্বুই ডিগ্রী ঘাড় হেলালো। “কিন্তু বাদাম লস্যি তো গেল?” হতাশ ভঙ্গীতে বললাম।  নজরুল সোৎসাহে জানাল, “খাবো ম্যাডাম।  আজ রোজা রাখিনি। ”
“ একি রে বাবা! একদিন রোজা রাখছ, একদিন রাখছ না। ”
“ সারা মাস তো রাখিনি ম্য্যাডাম। মাঝে কয়েকদিনের জন্য _”।
বাগ বাবু বিরস বদনে ছদ্ম গাম্ভীর্যসহকারে  বললেন, “ কাজটা কি ঠিক করলেন ম্যাডাম? বাদাম লস্যির লোভ দেখিয়ে এক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের রোজা ভাঙালেন। ” নজরুল আমি তো বটেই  আমাদের মণিপুরী ড্রাইভার শুদ্দু হাসিতে ফেটে পড়েছিল। আজকালকার এই অসহিষ্ণুতার বাজারে ভাবতেও অবাক লাগে সেই  দিনগুলির কথা।  আমরা- ওরা এই দ্বি- জাতি তত্ত্ব আসছে কোথা থেকে? ওরা কারা? সবাই তো আমরা ।

 কলকাতায় এসে পেলাম দুই অভিন্নহৃদয়  বন্ধু তথা শুভাকাঙ্ক্ষী নজরুল ইসলাম আর নাজিমুদ্দিন সাহেবকে। সেই দিনগুলিতে চার্চ লেনে রমজানের উন্মাদনাই ছিল অন্যরকম ।  খড়্গপুরের নজরুলের মত এই নজরুল ইসলাম সাহেবও নিয়মিত রোজা রাখতেন না।  নাজিম সাহেব আবার অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি।  ওণাদের থেকেই শিখলাম, “ মাহে রমজান” হল রমজান মাস। মাহে রমজান আসার আগে থেকেই কত শত জল্পনা শুরু  হয়ে গেল, কত টাকার ফল কেনা হবে, আত্মীয় স্বজনের জন্য কি কি উপহার কেনা হবে।  সে বছর ইদের মাস খানেকের মধ্যেই দুর্গোৎসব ছিল, ফলে একত্রে পরিকল্পনা হত।  দেখতে দেখতে রমজান এসে গেল।  নজরুল সাহেবও অনুপ্রাণিত হয়ে কঠোর রোজা রাখতে শুরু করলেন।  অফিসে ঢুকেই আমার প্রথম কাজ ছিল গতকাল কে কি খেয়ে রোজা ভেঙেছেন এবং সকালে কি  সেরগি সেরেছেন তার বিস্তারিত  বিবরণ নেওয়া। আমার উৎসাহ দেখে নাজিম সাহেব ঠাট্টা  করে বলতেন, “ এক কাজ করেন, আপনিও বৃহস্পতি আর শনিবার উপবাস শুরু করেন। তাতে ওজন টাও কমে!!!” একদিন চা ওয়ালা চা দিয়ে গেছে, আমরা তিনজন একত্রে কাজ করছিলাম, কথা বলতে বলতে যেই চা টা মুখে তুলেছি, নজরুল সাহেব হাঁহাঁ করে উঠলেন, “ কর কি? রোজাদারের সামনে কিছু খাওয়া কিন্তু গুণাহ। ” বাকি মাসটা আমাকে একাই টিফিন করতে হয়েছিল।

 দেখতে দেখতে এসে গেল প্রকৃত খুশির ইদ।নাজিম বউদি ইদের পর আমাদের জন্য
মিষ্টি পরোটা আর চিকেন পাঠালেন।  সাথে সরু সুতোর মত সিমুই।  ঘিয়ে ভাজা, কাজু কিশমিশে সম্পৃক্ত।  সে স্বাদ আজো মুখে লেগে আছে।  দুর্ভাগ্যবশত অঞ্জনদা সেদিন অনুপস্থিত ছিল।  পরের দিন সব শুনে এক প্রস্থ কপাল চাপড়ে, নাজিম সাহেবকে ধরলেন, ‘বড়খাসি’ খাওয়াতে হবে। নাজিম সাহেব কিছুতেই  রাজি নন।  অঞ্জনদাও নাছোড়বান্দা।  শেষে নাজিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,“ধুর মশাই ।  আপনার ধর্মে তো একটি জিনিসই খাওয়া নিষেধ।  সেটা মানুন না।  তাছাড়া কোন মুসলমান বাড়িতে আপনাকে গরুর মাংস দেওয়া হবে না। ”
আমি আর অঞ্জনদা সমস্বরে  বলে উঠলাম, “কেন?”
“ কারণ আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে। কারো ধর্মে নিষেধ থাকলে, তাকে ঐ জিনিস খেতে দেওয়ার অর্থ গুণাহ। ”
যেদিন পড়লাম গোমাংসের  জন্য আমাদের দেশে সংগঠিত নরহত্যা হচ্ছে, হতভম্ব  হয়ে গিয়েছিলাম।  কি হচ্ছে? এসব কি হচ্ছে?
হুসেন মিঞা আমাদের অবসর প্রাপ্ত ক্লার্ক।  রিএমপ্লয়মেন্টে আছেন। আমি বলি উনি আমার অভিভাবক। রোজ কিছু না কিছু ফেলে আসি অফিসে।  পেন ড্রাইভ, চশমা, হেড ফোন মায় হাতঘড়ি পর্যন্ত ।  হুসেন মিঞা যত্ন করে তুলে রাখেন।  অনেক রাত পর্যন্ত ফাঁকা অফিসে একা কাজ করি জানি হুসেন আছে।  চার বার দেখে যাবে, কি করছি। অথচ পান থেকে চুন খসলে কি বকুনি না খায়।  ক্ষমা চাইলে বলে, “ধুর বাবা।  আপনি আমার মেয়ের মত।  কতবার বলব? আপনার কথায় কি মনে করব। ” সেদিন বকরিদ্ এর পর হুসেনের সাথে কথা হচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করলাম,“কোরবানিতে কি দিলেন? ”
“ঐ যে বড় বড় খাসি গুলা হয় না। ”
“অ।  গরু?”
“না।  না।  খাসি-খাসি।  গ্রামের দিকে বড় বড় খাসি হয় না? ঐ গুলা”
“ দুম্বা ? ঐ গুলোকে দুম্বা বলে তো?”
“উফ।  আপনি কিচ্ছু চেনেন না।  বলছি খাসি।  গরু, দুম্বা কি সব বলছেন” হাসতে হাসতে বললেন হুসেন মিঞা।
“ মানে, ছাগল তাই তো?”
“ হ্যাঁ রে বাবা। ”
“ না খাওয়ালে বুঝব কি করে?” হেসে উঠলাম উভয়েই।  জিজ্ঞাসা করলাম,“গরু কেউ দেয়?”
“ দেয় ম্যাডাম।  গরিব মানুষ দেয়।  দুচারজন মিলে দেয়।  মাংসটাও অনেকটা হয় কি না”। মনটা হঠাৎ ভারি হয়ে উঠল।  যে দেশে মানুষ অনাহারে মরে, তারা লড়ে যাচ্ছে কি নিয়ে? কোথায় যেন দেখেছিলাম, এই সরকারের আমলে আমাদের দেশ বিফ এক্সপোর্টে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে, অর্থাৎ গরু মারলে দোষ নেই, শুধু মুসলমানেরা গরু খেলেই দোষ।  গোটা দেশ মাথা ঘামাচ্ছে অসহিষ্ণুতা নিয়ে, উন্নয়নের দিকে আর কার নজর যাবে বলুন? একদল নীচু তলার রাজনৈতিক  নেতা আবার এই মওকায় কেরিয়ার বানানোর চেষ্টায় ব্যাপৃত।  কি বিস্ফোরক মন্তব্য মশাই , শাহরুখ খান নাকি পাকিস্তানী।  আরে ভাই শাহরুখ পাকি হলে, আমি কি,আমার গোটা গুষ্টি পাকি।
#Anirdiary #AmiAni #Aninditasblog #blogger #banglablogger