Thursday 27 October 2016

বেনারস ডায়রি


আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, তৎকালীন মধ্যহাওড়ার সেরা মেয়েদের স্কুল হিসাবে পরিগণিত হত আমাদের স্কুল।আমরা প্রাক্তনীরা আজো নিজেদের “তারা” বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি।  তারাদের একটা গ্রুপ আছে, ছোট গ্রুপ, সেই গ্রুপে হঠাৎ চৈতালিই কথাটা তুলল, “এই ভূত দেখতে যাবি?” “ভূত” দেখতে? কোথায় যাব? রাখি প্রথমেই উড়িয়ে দিল, “ভাগ শালা। ভূত আবার একটা দেখার মত জিনিষ? গেলে শান্তিনিকেতন চল, মন্দারমনি চল- ও সব ভূত-টুত চলবে না বস।” চৈতালি হাল ছাড়ল না, “বাকিরা কি বলিস? শোন আমার এক সহকর্মীর কাকার বেনারসের বাঙালিটোলায় একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে নাকি ভূত আছে।” অস্মিতা অট্টহাস্য করে উঠল, “ চৈ তুই ঠিক কি খেয়ে চ্যাট করছিস বলতো? এক ছিলিম গাঁজা টেনেছিস নাকি আরো বেশি? আমরা প্রতিবছর বেনারস যাই মামণি, বাঙালিটোলা হল এককথায় বেনারসের বড় বাজার।সারি সারি দোকান, থিকথিক করছে লোকজন, শয়ে শয়ে ধর্মশালা আর সবার ওপর বাবা বিশ্বনাথ, ওখানে আর যাই থাক, ভূত নেই বাপ।” চৈতালি শান্ত ভাবে জবাব দিল, “ইউ আর রাইট। ওটা একটা ভিড়ভাট্টা ওলা বাজার এলাকা, তাই তো? তাহলে ওখানে বিগত ষাট-সত্তর বছর ধরে কোন বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকার কথাই নয়। ট্রাষ্ট মি গার্লস, দ্বারভাঙ্গা ঘাটের কাছে, বাঙালিটোলায় ঐ কোঠা বাড়িটা জনমানব শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে। আমার বন্ধুর কাকা হোটেল বানাবে বলেই কিনেছিল, ওরা মাড়োয়ারি, কোন প্রপার্টি কিনে ফেলে রাখার লোক নয়। ঐ বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না, একজন কেয়ারটেকার রেখেছিলেন,  সে দুরাত কাটাবার পর নাকি উন্মাদ হয়ে যায়। এমনকি কোন দারোয়ান পর্যন্ত থাকে না।” “বাবা গো। যদি সত্যি হয় আমি নেই” বলেই দিল সঞ্চিতা। আর কেউ কোন উচ্চবাচ্য করল না, চৈতালি হতাশ হয়ে বলল, “কেউ যাবি না, তাহলে? আমি কিন্তু যাব। যাবই।”
          চুপচাপ ওদের কথা পড়ছিলাম, কিছু লিখিনি। ফোনটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে অনেক ভাবলাম, বেনারস- হানা বাড়ি- বন্ধুদের সাথে একা একা বেড়াতে যাওয়া- বাড়ির বাইরে একা রাত কাটানো। সব কটার আকর্ষণই প্রবল। কিন্তু মেয়েকে ছেড়ে? নাঃ থাক। দেখি ওরা কেউ যায় কি না। আবার ফোনটা খুলে দেখি, শুধু অন্তরা জবাব দিয়েছে, “কদিনের জন্য যাবি চৈ? ছেলে ছেড়ে বেশীদিনের জন্য যেতে পারব না বাপু।” চৈ উৎফুল্ল হয়ে লিখেছে, “যাবি? সত্যি? বেশীদিনের জন্য কে যাবে বে? আমার বস ছাড়বে? বেড়াতে যাচ্ছি বললে তো হরগিজ ছাড়বে না। সিম্পলি যাব না আর বলব পেট খারাপ। শুক্রবার ট্রেনে উঠব, শনিবার ভুতের বাড়িতে রাত্রিবাস, রবিবার বাবা বিশ্বনাথের দর্শন করে রাতে ট্রেন, সকালে আবার ছুটতে হবে ইয়ের অফিসে-।”অন্তরা জবাব দেবার আগেই আমি বলে উঠলাম, “এই আমি যাব।” চৈতালি বা অন্তরা কিছু বলার আগেই সঞ্চিতার মেসেজ, “সর্বনাশ। শয়তানটা একা থোড়াই যাবে, আমাকে শুদ্ধ টেনে নিয়ে যাবে। অনি আমি কিন্তু যাব না বলেদিলাম, নিজের দায়িত্ব নিজে নিবি।” আমি অন্তরা এবং চৈতালি তিনজনেই বুঝলাম, এ হল, ‘আর একবার সাধিলেই খাইব।” চৈতালি শুধু বলল, “ আমি আজ রাতেই চার জনের টিকিট কেটে নিচ্ছি। শুভরাত্রি।”
প্রচন্ড অপরাধ বোধে জর্জরিত হয়ে, শৌভিককে বললাম, বরকে ছাড়া আমি কোথাও বেড়াতে যাই না। শৌভিক শুধু মাথা নেড়ে বলল, “যাচ্ছিস যা। কিন্তু মাঝ রাতে আমায় ফোন করে যেতে বললে কিন্তু আমি যেতে পারব না।” আমার ভীষণ ভূতের ভয়। যেরাতে শৌভিক ফিরতে পারে না, তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমি টিউবলাইট জ্বালিয়ে শুই। সারারাত বাথরুমের চৌকাট ও ডিঙোই না। এমনকি মেয়েকেও বলি, “চেপে শুয়ে থাক। ভোরবেলা যাবি।” এতদসত্ত্বেও ভূতের ছবি দেখা ছাড়ি না।  ইলেকশন চলাকালীন একবার বাহাশিস কাপুরের ভুতের শর্ট ফিল্ম দেখে এত ভয় পেয়েছিলাম যে, রাত দুটোর সময় শৌভিককে ফোন করে কান্নাকাটি জুড়েছিলাম, খালি মনে হচ্ছিল ভুতটা খাটের তলায় লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পায়ের আঙুল বা হাতের আঙুলের ডগা পেলেই ধরে টানবে। সেই খোঁটাটাই সুযোগ বুঝে দিল আর কি।
          যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা রওনা দিলাম, আমরা চার তারা শুক্রবার সন্ধ্যা বেলার কালকা মেলে চড়ে, গন্তব্য বারানসি। লোকে যায় ভূতনাথের দর্শন করতে, আর আমরা চলেছি স্বয়ং ভূতের সন্ধানে।
রাত পৌনে আটটা নাগাদ ট্রেন ছাড়ল, ভোর সাড়ে ছটায় মুঘলসরাই নামতে হবে, ওখান থেকে অটো বা ট্যাক্সি করে বারানসী। এসি টু টায়ার, কিন্তু চার জনের সিট এক সাথে পড়েনি, শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাদের মতই ভুলভাল সিট পড়া অপর একটি পরিবারের সাথে রদবদল করে তিনজন এক কাট্টা হলাম, আর অন্তরার লাস্যময় অনুরোধ না ফেলতে পেরে এক ওড়িয়া ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় তাঁর সিটটি আমাদের সাথে বদল করে নিলেন। পর্দা টেনে আরাম করে বসে যে যার বাড়িতে ফোন করলাম, সিঙ্গুর নিয়ে শৌভিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য তুত্তুরীকে আমার মা-বাবার কাছে রেখে গেছি। আড়াই দিনের তো মাত্র ব্যাপার, যাই হোক, বাড়িতে ফোন করা মাত্রই তুত্তুরী ধরল, “মা! ভূত দেখলে?” হাসি চেপে বললাম, “সবে তো ট্রেন ছাড়ল মা। আগে পৌঁছই।” “ওঃ” নিতান্ত বিরস গলায় তুত্তুরী জিজ্ঞাসা করল, “মা, রাতে তোমার কাছে কে শোবে? কোন বাচ্ছা?” হাসতে হাসতে বললাম, “ কে আবার শোবে? ট্রেনে কোন বাচ্ছা নেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক।” যা জানার ছিল জানা হয়ে যাওয়াতে তুত্তুরীর আর কথা বলার উৎসাহ রইল না, দায়সারা ভাবে, “এ নাও দাদুর সাথে কথা বল,” বলে বাবাকে ধরিয়ে দিল। বাবা প্রবল উৎসাহে চিৎকার করতে লাগল, “মানা! ট্রেন ছেড়েছে?” উত্তর শোনার সাথে সাথেই বাবা বলে উঠল, “ বাবা ভূতনাথের ওখানে যাচ্ছ, ভূত দেখতে পাও বা না পাও গাঁজা খেতে ভুলো না।” এই না হলে আমার বাবা। ভাল করেই জানে আমি ধোঁয়া টানতে পারি না, জীবনে একবারই সিগারেট টেনেছিলাম তাও বাবারই দেওয়া কাউন্টার, হেঁচে, কেশে কেঁদে সে যা বিকট কান্ড হয়েছিল, সেই প্রথম সেই শেষ। বললাম, “ও সব ছিলিম টিলিম টানা আমার পোষাবে না।” বাবা উল্টে ষড়যন্ত্র মূলক স্বরে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “আরে, ছিলিম টানবি কেন? সিগারেটের পেটটা টিপে টিপে হাফ মশলা ফেলে দিবি- তারপর গাঁজা পাতাটাকে ওর মধ্যে ঠুসে ঠুসে ভরে নিবি। ব্যস। গাঁজা আর বেনারসের রাবড়ি- আহা।” আমি কিছু বলার আগেই শুনতে পেলাম, ওদিক থেকে মায়ের চিল চিৎকার, “ ধিঙ্গি মেয়ে, কচি বাচ্ছা ফেলে রেখে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গিপনা করতে যাচ্ছেন আর বাপ তাকে কি করে গাঁজা খেতে হয় সেই শিক্ষা দিচ্ছেন- কি পাগলের সংসারে পড়েছি বাপু আমি?” বাবা রীতিমত গম্ভীর স্বরে বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে রাখছি। পৌঁছে ফোন করিস” আর ফিসফিস করে বলল, “গাঁজা খেয়ে রাবড়ি খেতে কিন্তু ভুলিস না।” “রাবড়ি খাব কিন্তু গাঁজা খাচ্ছি না” বলে ফোন রাখা মাত্রই চৈতালি বলে উঠল, “খাবই। বাবা বিশ্বনাথের থানে  গিয়ে বাবার প্রসাদ সেবন করবি না কি যে বলিস?”
রাত নটা নাগাদ বর্ধমান ছাড়ানো মাত্রই বাকি প্যাসেঞ্জাররা নৈশাহারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমরা চারজন গল্পেই মশগুল। কি ভাবে চৈতালি পেট খারাপের নাটক করে পাঁচটা নাগাদ অফিস কেটেছে সেই নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি হল এক চোট। তারপর চৈতালি ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্যামেরার সেটিং নিয়ে আর আমরা তিনজন মত্ত হলাম পিএনপিসিতে। সত্যি তো বাবারা যখন বউ বাচ্ছা ফেলে ট্রেক করতে যায় বা বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যায় সমাজ কিচ্ছু বলে না, অথচ আমরা দুই মা নিজেদের বাচ্ছাকে দাদু-দিদাদের কাছে রেখে আড়াই দিনের জন্য বেনারস কি যাচ্ছি, যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্তরা তেঁতো গলায় বলল, “ভালো হয়েছে জানিস। বাচ্ছা গুলোরও একটু বোঝা দরকার, যে মায়েরা ওদের জীবনের কতখানি জুড়ে আছে।” চৈতালি ধড়াম করে ফ্ল্যাশটা বন্ধ করে বলল, “ আমি সাধারণত তোদের এই মেয়েলী ঘ্যানঘ্যানানি গুলো শুনি না মানে পড়ি না আর কি। আজ তো কোন উপায় নেই, কানে ঢুকেই যাচ্ছে, তোদের কত সমস্যা, কত কষ্ট- এর সব কিছুর একটাই সমাধান।” আমরা তিনজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, চৈতালি মুচকি হেসে বলল, “চল মাল খাই।” সঞ্চিতাই জবাবটা দিল, “ তুই খা না চৈ। ভূতের সঙ্গে আসর জমাস। আমরা দেখব খন।” চৈতালি হেসে বলল, “ সে তো খাবই। আর অনির সাথে ভূতের ছবিও তুলব। বেচারার এত সেলফি তোলার শখ।” আড্ডা ফাজলামি আর বৃথা ঘুমের চেষ্টায় রাতটা যে কখন কেটে গেল বোঝার আগেই নেমে পড়লাম মোগলসরাই স্টেশনে। অটোয় চেপে যখন বেনারসের গোধডুলিয়ায় নামলাম তখনও কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যি দেব ওঠেননি। গোধডুলিয়া থেকে সাইকেল রিক্সা করে হরিশ্চন্দ্র বোর্ডিং হাউস(নাম পরিবর্তিত)ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে তিনতলা সাবেকি ধর্মশালা। একতলায় সারি সারি দোকান সবই হিন্দি সাইনবোর্ড। শুধু ধর্মশালাটার নাম টিনের বোর্ডে বাঙলা এবং হিন্দি উভয়েই লেখা, তাও বিবর্ণ। কড়ি বরগা ওলা ছাত, চুনকাম করা দেওয়াল, ঘন সবুজ জানলা দরজা, দোতলা এবং তিনতলায় লম্বা বারান্দা, এবং বারান্দার লাগোয়া সারি সারি ঘর। মালিক বাঙালি, কর্মচারীরাও সকলেই বৃদ্ধ এবং বাঙালি।
চা জলখাবার খেয়ে স্নান সেরে দশটা নাগাদ আমরা বেরোলাম হানা বাড়ি দেখতে। বর্তমানে যে বেতনভুক কর্মচারীটি ঐ বাড়ির দেখভাল করে, তাকে বলা ছিল, সেও আসবে, আমাদের দেখে শুনে জানাতে হবে আমরা কোন ঘরটায় রাত্রিবাস করব, তাহলে সেই ঘরটা সাফ করে বিছানার ব্যবস্থা করে দেবে আরো যদি আনুসাঙ্গিক কিছু প্রয়োজন হয় তাকে বললে সে ব্যবস্থা করে দেবে, তবে সব কিছুই দিনের আলো থাকতে থাকতে। সন্ধ্যা বেলায় আমাদের ধরমশালায় এসে আমাদের চাবিটা দিয়ে যাবে, আগে রামভরসা।
বিশাল সাবেকি বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, আসেপাশে থিকথিক করছে দোকান, শুধু ঐ বাড়িটার পাঁচিলের লাগোয়া কোন দোকান নেই। রাস্তা থেকে তিন ধাপ ইট বের করা সিড়ি উঠে গেছে, তারপর বিশাল রঙ জ্বলা সেগুন কাঠের সদর দরজা। দরজায় ইয়া বড় তালা ঝুলছিল।দরজার পাশে ভাঙা শ্বেত পাথরের ফলকে বাড়ির নাম লেখা, প্রায় অপাঠ্য, তবু পড়া যায় বাঙলায় লেখা “শ্রীকৃষ্ণনিবাস”।  দারোয়ানজী তালা খুলে ইশারায় আমাদের ঢুকতে বললেন, ঢুকেই বিরাট উঠোন, উঠোনকে চারদিক দিয়ে ঘিরে বাড়িটা উঠেছে। ভুল বললাম, ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, তিন দিকে একতলা ছোট ছোট ঘর সম্ভবত রান্না ঘর,ভাঁড়ার ঘর, দাসদাসীদের ঘর কলতলা, একটা বড় ইঁদারা ইত্যাদি আর দক্ষিণ কোনে বিরাট দোতলা বাড়ি। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে গেছে, কোথাও কোথাও ছোট ছোট চারা গাছ মাথা তুলেছে। ছাত থেকে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ ক্রমশ শিকড় প্রসারিত করছে। বাইরে বাজারের শোরগোল এই উঠনে যেন ভয়ে সম্ভ্রমে প্রবেশ করতে গিয়েও করতে পারছে না। কি দম চাপা এক নৈশব্দ। দারোয়ানজী সদর দরজার লাগোয়া তালা দেওয়া বৈঠকখানায় রাত্রি বাসের সুপারিশ করছিলেন। চৈতালি রাজি হল না। বড় উঠোনটা যখন আমরা পেরোচ্ছি মহলে ঢুকব বলে, কেন জানি না অজান্তেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বরাবর প্রবল এবং সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার নিষেধ করতে লাগল, আর না, সীমানায় দাঁড়িয়ে আছিস, আর এগোনো উচিত নয়। ফিরব কি? চৈতালি, অন্তরা, সঞ্চিতা ততোক্ষণে একতলার বারন্দায় পা রেখেছে।
অনি আয় রে-” ওদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, উঠোনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে বাড়িটাকে দেখছিলাম। সাবেকি বাংলো প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি। একতলা এবং দোতলায় লম্বা বারন্দা, এবং বারন্দার পিছনে সারি সারি ঘর। বারন্দা গুলো কোন এক কালে কাঠের জাফরি দ্বারা অর্ধাবৃত ছিলদোতলার বারন্দায় কাঠের জাফরি থেকে খসখস জাতীয় কিছু ঝোলানো ছিল, সম্ভবত শীতলতার জন্য এবং কিছুটা আব্রুর জন্য। যা এই দীর্ঘ অবহেলায় বিবর্ণ-ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে এমন ভাবে ঝুলছে যে দেখে এক নজরে মনে হল, আগন্তুকদের খাবার জন্য বাড়িটা হাঁ করে আছে। বাড়িটার আর একটা বৈশিষ্ট্য হল বাড়ির পূর্বদিকে রয়েছে বড় ইঁদারাটা আর পশ্চিমদিকে উঠোন থেকে সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা হয়ে ছাতে। বাড়ির বাইরে দিয়ে এমন সিঁড়ি আমি এর আগে কোন বাঙালি বাড়িতে দেখিনি। একতলায় চারটে ঘর, কোনটাতেই ভাল আলো ঢোকে না, তায় স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। কোনটাই ওদের পছন্দ হল না। পরম উৎসাহে চৈতালি আর অন্তরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে লাগল। আমি আর সঞ্চিতা তখনও উঠোনেই দাঁড়িয়ে। দারোয়ান জী ফিসফিস করে বলল, “মেমসাব, কিঊ আপলোগ খুদখুশি করনে পে তুলে হুয়ে হো? মেরি বাত মানো, আপলোগ মেরে বেহেন জ্যায়সা হো, উপরওয়ালা কামরে কুছ ঠিক নেহি হ্যায় জী।” কিছু বলতে যাব, ওপর থেকে অন্তরার চিৎকার “ সঞ্চি-অনি শিগ্রি আয়।”
          দোতলায় ও চারটে ঘর, সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে আমরা যখন দোতলায় পৌঁছলাম, উত্তরপূর্বের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। “আমরা আজ রাতে এই ঘরটায় থাকব। দেখে যা। এটা এ বাড়ির সেরা ঘর।” লম্বা বারন্দা দিয়ে হেঁটে উত্তরপূর্বের ঘরে যাবার সময় একটা জিনিষ খেয়াল করলাম, এই ধরণের বাড়ির বারন্দা গুলি সাধারণত পায়রাদের পীঠস্থান হয়। পায়রাদের মল জমে জমে পাথর হয়ে যায়, কিন্তু বারন্দায় ধুলো থাকলেও একটিও পায়রার বিষ্ঠা নজরে পড়ে না। কথাটা ফিসফিস করে সঞ্চিতাকে বলাতে ও বলল, যে ব্যাপারটা ও খেয়াল করেছে।
সত্যি ঐ ঘরটা ঐ বাড়ির সেরা ঘর। ঘরের তিনদিকেই বড় বড় জানলা, ভিতরে কাঁচের শার্সি, ধূলিমলিন কিন্তু অটুট। প্রতিটা জানলার মাথায় রঙ বেরঙের কাঁচের আর্চ, সেই লাল-নীল- সবুজ কাঁচের মধ্য দিয়ে সৌরশ্মি ঢুকে মেজে তে চিত্র বিচিত্র আল্পনা কাটছে। ঘরে এখনও কিছু আসবাব পত্র রয়েছে। যেমন একটা পেল্লায় খাট, যার ছত্রি গুলো ভেঙে পড়েছে, খাটে কোন গদি পাতা নেই, ছিল হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। কেবল দুটো ভাঙাচোরা পিসবোর্ড একটার ওপর আর একটা বেখাপ্পা ভাবে চেপে খাটটির লজ্জা নিবারণ করছে। একটা পুরানো দেরাজ, যার একটা পাল্লা কোথায় হারিয়ে গেছে, আর একটা সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিল। নির্ঘাত বিলিতি মাল, আয়নাটা যে আসল বেলজিয়াম গ্লাস তা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমি আর সঞ্চিতা ধুলো পড়া  আয়নায়  মুখ দেখার আর সেলফি তোলার চেষ্টা করছিলাম যখন, চৈতালি আর অন্তরা দারোয়ানজীকে ডেকে সবিস্তারে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে। ঘর ভালো করে সাফ করে, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে একটা তোষক আর গোটা আটেক তাকিয়া (মাথা এবং পা চাপানোর জন্য) দিতে হবে। গোটা চারেক এমারজেন্সি লাইটের ব্যবস্থা করে দিতে হবে আর রাতে যদি কারো ছোট বাইরে যেতে হয় তাই নীচে ইঁদারার ধারে গোটা দুই বালতি জল ভরে রেখে যেতে হবে। আর হ্যাঁ মশা মারার কয়েল আর লিটার তিন চার মিনারেল ওয়াটারও রেখে দিতে বলা হল। এই সব কিছুর জন্য হাজার দুয়েক টাকাও দেওয়া হল, কম পড়লে রাতে নিয়ে নেবে আর বেশি হলে ফেরত দেবার দরকার নেই।
বাকি দিনটা বেনারসের গঙ্গায় নৌকা বিহার, রাবড়ি সেবন, টুকটাক কেনা কাটা, ছবি তোলা আর দিবানিদ্রা দিয়ে কেটে গেল (রাত জাগতে হবে না?)। আমরা যখন নৈশাহার সমাপ্ত করে তালা খুলে শ্রীকৃষ্ণনিবাসে ঢুকলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন সবে রাত দশটাকে ছুঁইছুঁই করছে। বাইরে বাজারের হৈহট্টগোল কিছুটা স্তিমিত, সবাই দোকান গুটোতে ব্যস্ত। তালা খুলে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। বাইরে বাঙালিটোলা রোড নিয়ন লাইটের আলোকে ঝকমক করছে, সেই আলো কিছুটা চুইয়ে ঢুকে উঠোনে নানা রহস্যময় আঁকিবুঁকি কাটছে বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আসল বাড়িটা নিকষ অন্ধকারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। “কি ব্বে? ভয় পাচ্ছে নাকি মামণিরা?” চৈতালি হাসি চেপে জিজ্ঞেস করল। ভয় ভালোই পাচ্ছিল, আর হারামজাদা দারোয়ান চারটে এমাজেন্সি লাইটও জোগাড় করতে পারেনি। সম্বল মাত্র দুটো।
দুটো লাইটে ঘরটা মন্দ আলোকিত হয়নি, কিন্তু চৌকাটের বাইরে নিকষ ঘন অন্ধকার যে ওঁৎ পেতে আছে তা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমায় বারবার বলে চলেছিল। কেবল মনে হচ্ছিল, ঐ দরজাটা খোলা রাখার থেকে বন্ধ রাখলে বিপদকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এড়ানো যেতে পারে। বিপদের কথাটা লুকিয়ে(নইলে সবাই হাসবে যে) দরজা বন্ধ করার কথাটা বলাতে দেখলাম কেউ আপত্তি করল না। উঠে গিয়ে ভেজিয়ে এলাম, খিল ভেঙে পড়েছে। চুপচাপ বসে আছি চারজনে, বাইরে বাজারের কোলাহল ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে ক্রমশঃ। চৈতালি গলা ঝেড়ে বলল, “ব্যস? তোদের চার্জ শেষ? শুরু থেকেই কেলিয়ে পড়লে কি করে হবে? এই সঞ্চিতা ওঠ। একদম শুবি না। শুলেই মাল তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। এই আমি বলে দিচ্ছি যে ঘুমিয়ে পড়বে তার গায়ে আমি ঠাণ্ডা বিয়র ঢেলে দেব।” “বিয়র? বিয়র কোথা থেকে পাবি?” আমরা তিনজন সমস্বরে বলে উঠলাম। “হু হু বাবা। জোগাড় করতে হয়। হানাবাড়িতে ভূতদর্শন করতে হলে ভূতেশ্বরীর আশীর্বাদ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। মা কালির আশীর্বাদ ধন্য এই কারণ পান কর বালিকারা, সব ভয়, ভয় তো কি, ভয়ের বাবা ও জানলা গলে পালাবে।”
সত্যি বিয়রের প্রভাবে কি না জানি না, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা সব ভুলে গল্পে মত্ত হলাম। বাইরে বাজারের হট্টগোল যে কখন স্তব্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ অন্তরা যখন বলল, “ শালা অ্যাডাল্ট ডায়পার আনা উচিত ছিল।” সঞ্চিতা বলল, “হ্যাঁরে আমাকেও যেতে হবে। অনেকক্ষণ থেকে চেপে আছি একা যেতে হবে ভেবে।” চৈতালি বলল, “একা কেন যাবে মামণি? চল সবাই মিলে যাই। যাবি অনি?” যাবার প্রয়োজন না থাকলেও যেতাম, একা ঐ ঘরে কে থাকবে? আর যেতে হবে তো লম্বা বারন্দা টপকে পাক্কা ২৪টা সিঁড়ি ভেঙে আড়াআড়ি উঠোন টপকে কুয়োতলায়। ষষ্ট ইন্দ্রিয় ফিসফিস করে যেন কি সব বলে চলেছে, শুনতে শুনতে উঠে পড়লাম। হাত ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে বারোটা। একটা এমারজেন্সি ঘরে রেখে আমরা আর একটা নিয়ে বেরোলাম। বেরোবার সময় আমার ব্যাগপ্যাকটা আমি পিঠে চাপিয়ে নিলাম। চৈতালি আর সঞ্চিতা খুব হাসতে লাগল, “শালা ইয়ে করতেও পিঠে ব্যাগ নিয়ে যাবি? পালাবার তাল করছিস নাকি বে অনি? চাবি কিন্তু আমার পকেটে।” কিছু বললাম না।
কাজ মিটিয়ে আমরা যখন ফিরছি, চতুর্দিক নিস্তব্ধ, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম, দূরে ঘরটা থেকে রেখে আসা আলোটা লম্বা আলোর রেখাপাত করেছে দোতলার বারন্দায়। আচমকা আমাদের হাতের এমারজেন্সিটা দপ করে নিভে গেল। “কি হল?” বলার আগেই ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, কোথাও কোন হাওয়ার নাম মাত্র নেই। আবার সেই ঘন দম বন্ধ করা অন্ধকার, ঝুপ করে ঘিরে ধরল আমাদের। তৈরি ছিলাম, জানতাম এমন কিছু হবে, কাছে আসার আগেই মুহূর্তের মধ্যে ফস করে জ্বালিয়ে দিলাম মোবাইলের টর্চটা। 
সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে, সঞ্চিতা আর চৈতালিও নিজের নিজের মোবাইলের টর্চ জালিয়ে দিল, দ্রুতপদে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম উদ্দিষ্ট ঘরটির সামনে। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দরজার ওপারে কি অপেক্ষা করে আছে কে জানে? দড়াম করে এক ধাক্কায় দরজা খুলে আগে ঢুকল অন্তরা, ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইল টর্চের আলোয় দেখলাম আমাদের বিছানা এবং জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনি আছে। তড়িঘড়ি চৈতালি আর সঞ্চিতা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এমারজেন্সি দুটো কে নিয়ে, অন্তরা আনমনে গিয়ে দাঁড়াল ড্রেসিং টেবিলটার সামনে, আমি আগে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যদিও ফিসফিস করে বলেই চলেছে বৃথা সবই বৃথা।
মিনিট খানেক ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে ওরা রণে ভঙ্গ দিল। একটা এমারজেন্সিও কাজ করছে না। চৈতালি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কি হবে রে? মোবাইল তো বেশি ক্ষণ চলবে না।” আমি আর সঞ্চিতা প্রায় এক সাথে বলে উঠলাম, “চল বেড়িয়ে যাই এখান থেকে।” সঞ্চিতা আবার বলল, “দেখ এই রকম হানাবাড়িতে আমরা রাত পৌনে একটা অবধি কাটিয়েছি, আমার কাছে এটাই বিরাট অ্যাচিভমেন্ট। সারা রাত কাটাতে গিয়ে কোন বিপদে পড়তে চাই না। আর আমার মন বলছে কোন বড় বিপদ ঘটতে চলেছে।” চৈতালি হতাশ সুরে বলল, “পালিয়ে যাব? বুক বাজিয়ে বলে এলাম আমরা চার তারা ভূতের বাড়িতে-”। “আমি কোথাও যাব না।” অন্যমনস্ক গলায় বলল অন্তরা। মোবাইল ততক্ষণে কাঁপতে লেগেছে। আমরা বোঝাবার চেষ্টা করলাম, সে রকম হলে সদর দরজা খুলে বাইরের সিঁড়িতে বসে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া অধিক নিরাপদ। অন্তরা কোন জবাব না দিয়ে, সটান একটা তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। চৈতালি অসহায় ভাবে বলল, “তাহলে কি হবে? এই অন্ধকারে?”
ব্যাগপ্যাকটা ঐ জন্যই কাছছাড়া করিনি। ব্যাগে চারটে বড় বড় মোমবাতি ও দেশলাই ছিল। আসার আগে শৌভিকই গুছিয়ে কিনে দিয়েছিল, যদি কোন কারণে দেশলাই ভিজে যায় তাই একটা লাইটারও সঙ্গে দিতে ভোলেনি। মনে মনে নিজের বরকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে একটা মোমবাতি ধরালাম। মোমবাতির হলুদ আলোয় ঘরটা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। কোথাও হাওয়ার নাম মাত্র নেই তাও মোমের শিখা থিরথির করে কেঁপেই চলেছে, যেন এখুনি নিভে যাবে। সঞ্চিতা দুহাত দিয়ে শিখাকে আঁকড়ে বিড়বিড় করে কোন মন্ত্র পড়ে চলেছে। আমি আর চৈতালি চুপ করে বসে আছি, অন্তরা সেই যে শুয়েছে আর ওঠেনি। ঘুমোয়নি যদিও চোখ খোলা।
ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছাড়িয়ে পৌনে দুটোর দিকে পা বাড়িয়েছেবিগত পয়তাল্লিশ মিনিটে নতুন কিছুই ঘটেনি। আমাতে আর সঞ্চিতাতে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছি। একটু দূরে চৈতালি এক দৃষ্টিতে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। দম আটকানো পরিবেশকে হাল্কা করতেই যেন ও বলে উঠল, “ হে হে। তিনিই বোধহয় আমাদের ভয় পেয়েছেন জানিস। ভেবেছিল সামান্য আলো নিভিয়ে বা ক্যাঁচ করে দরজা বন্ধ করে আমাদের ভাগাতে পারবে। জানে না তো, আমরা হাওড়ার মেয়ে তায় আবার তারাসুন্দরীর বাচ্ছা।” আমরা অল্প হাসলাম। এবার সিরিয়াস গলায় চৈতালি বলল, “তবে তোদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে ভাই। আমার দোষেই তোদের এই শাস্তি পোয়াতে হচ্ছে।”
“শাস্তি?” অন্তরার গলা শুনে আমরা চমকে উঠলাম। কখন উঠে বসেছে, “শাস্তি কাকে বলে তোরা জানিস না। সবথেকে বড় শাস্তি হল অমরত্ব। মানুষ ভাবে মরলেই সব জ্বালা জুড়োবে, কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদি জ্বালা না জুড়োয়? আর তো কোথাও যাবার নেই? কোথাও পালাবার নেই?” আমরা চুপ। অন্তরা বলেই চলেছে, “একটা গল্প বলি শোন, হৈমবতীর গল্প। সময়টা ১৯৩০ এর দশক। হৈমবতীর বাবা ছিলেন হাওড়ার ব্যাঁটরা এলাকার বেশ ধনী ব্যক্তি।তার ওপর জাতীয় কংগ্রেসের ছোটখাটো নেতাও বটে। হৈম ওনাদের প্রথম সন্তান পরম আদরের দুলালী। হৈমর মামার বাড়ি ছিল আহেরিটোলায়। হৈম তখন আট, মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তখন বেশ রাত, ছোট্ট মামাতো ভাইকে দোতলায় হৈমর জিম্মায় দিয়ে ওর মা-মাসি-মামিরা হেঁসেলে খেতে বসেছে। ভাই ঘুমোচ্ছে, আর হৈম পাশে বসে পুতুল নিয়ে খেলছিল, যদিও মামার বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি আছে, তবে সেদিন লোডশেডিং, খাটের পাশে একটা হ্যারিকেন রাখা আছে। আপন মনে খেলতে খেলতা হৈমর হঠাৎ মনে হল, জানলা দিয়ে কে যেন ওকে দেখছে, চমকে তাকিয়ে দেখে গোটা জানলা জুড়ে একটা প্রকান্ড মুখ, তার জিভটা জানলার গারদ গলে ততক্ষণে ঘরে প্রবেশ করেছে এবং খাটের দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে, ঠিক যেখানে ভাই ঘুমোচ্ছে। তীব্র আতঙ্কে হৈম গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাই দুদ্দাড় করে ছুটে এল, যথারীতি জানলায় কাউকে পাওয়া গেল না। সেই রাতে হৈমর ধুম জ্বর এল আর পরদিন দুপুরে হৈমর ছোট্ট মামাতো ভাইটা দুম করে মরে গেল।
সেই থেকে কেন জানি না কিন্তু হৈম মৃত্যুকে অনুভব করতে পারত। ওর বাবার জেঠিমা, যেরাতে মারা গেল, হৈম সেরাতেও বাড়ির উঠোনে একটা কালো ছায়া দেখেছিল। যেই ঠানদি মারা গেল, ছায়াটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। বললে কেউ বিশ্বাস করত না, তাই হৈম নীরব থাকত। তের বছর বয়সে হৈমর বিয়ে হল, কাশির ধনাঢ্য বাবু মাধব বন্দ্যোপাধায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান বিনোদের সাথে। মাকে ছেড়ে ট্রেনে করে কাশি যাবার সময় কি অসম্ভব কষ্টই যে হচ্ছিল, মাকে ছেড়ে কোনদিন থাকেনি হৈম।
কাশীর বাড়িতে প্রবেশ করার সময় কেন জানি না, হৈমর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, উঠোনে মাঝে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি যখন ওদের বরণ করছিল, তখন হৈম না তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, দোতলার বারন্দায় জমাট বেঁধে আছে একটা কালো ছায়া। বিয়ের পর বরের সাথে ভাব জমতেই হৈম তাকে কথাটা বলল, “ ওগো এ বাড়িটা মোটে ভাল নয়। এখানে কেউ একজন আচে, যে চায় সব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক।” বিনোদ কলকাতার রিপন কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক, এসব বুজরুকি বিশ্বাস করে নাদিনে দিনে হৈমর চারদিকে সেই ছায়া গাড় হচ্ছে, আতঙ্কে হৈমর ঘুম আসে না। সুযোগ পেলেই বিনোদকে কাকুতিমিনতি করে, “ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল। এ বাড়ি আমাদের সবাইকে খাবে।”
এরই মধ্যে হঠাৎ জানা গেল, হৈম গর্ভবতী। বিনোদ খুশি হয়ে বলল, “হৈম এবার যাও, তোমার বাবা আনতে আসচে। বাপের বাড়ি গিয়ে কটাদিন কাটাও আর আমিও দেকি কলকাতায় কোন কাজ জোগাড় করতে পারি না।” ভেবেছিল হৈম আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে, হৈম তাকিয়ে দেখলও না পর্যন্ত, শুধু বলল, “ বড্ড দেরি হয়ে গেছে গো। অত করে বললুম শুনলে না আর পালাবার পথ নেই।”
হৈমর একটা মেয়ে হল, ফর্সা, ফুটফুটে তুলোর বল। বাড়ুজ্জে বাড়ির প্রথম সন্তান, সকলের নয়নের মণি। মেয়ের যখন ছ্ মাস বয়স, একদিন রাতে হঠাৎ ফোঁপানির আওয়াজে বিনোদের ঘুম ভেঙে গেল, কি হল আবার? হৈম তো আজকাল আর ও সব আজেবাজে বকে না। ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে হৈম, এক মুহূর্তের জন্য মেয়েকে চোখের আড়াল করে না। তাহলে? আধো অন্ধকারে পাস ফিরে দেখে, মেয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে হৈম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর বলছে, “আমার কি দোষ ছিল? তবে কেন? কেন-” আর কথা বলতে পারল না মুখে আঁচল গুজে ফোঁপাতে লাগল। হৈম না বুঝলেও মেয়ে বোধহয় বুঝতে পারল যে বাবা জেগে গেছে, তখনি বাবার দিকে ফিরে খিলখিল করে হেঁসে উঠল। হতভম্ব বিনোদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “হৈম কি হয়েচে?” হৈম আর চাপতে না পেরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ ও গো বুজতে পারচ না? ও সে। আমাদের শাস্তি দিতে এয়েছে। কেন এলি তুই? যদি আমার কাচে নাই থাকবি তুই কেন এলি মা? আমি যে তোকে বড় ভালোবেসে ফেলেচি। আমার প্রথম সন্তান তুই।”
যত দিন যেতে লাগল, মেয়ের প্রতি হৈমর অধিকার বোধ সীমা ছাড়াতে লাগল। কিছুতেই মেয়েকে কাছছাড়া করতে চায় না। সব সময় চোখে চোখে রাখাটা প্রায় বাতিকের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। বেচারা বিনোদ, ওদের দাম্পত্য শুধু মাত্র পিতামাতার সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। তাতে বিনোদের খুব একটা সমস্যা না থাকলেও, মাধব বাবু এবং তাঁর গিন্নী ক্রমশঃ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। নাতনী যতই আদরের হোক, এত বড় হয়ে গেল, অথচ এখনও পর্যন্ত আর একটিও  ভাইবোন হল না, ব্যাপারটা ওনাদের কাছে আদৌ সহজপাচ্য ছিল না। বিনোদের প্রতি হৈম  যে কোন কর্তব্যই পালন করে না, বরং বেশ অবহেলা করে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠল। ফলতঃ বিনোদের বাবা-মা প্রায় চেষ্টা করতেন যাতে হৈমকে তার মেয়ের থেকে দূরে রাখা যায়, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও যাতে রাধা বিনোদের সাথে একটু সময় কাটাতে পারে। নাতনীও দাদু-ঠাকুমার একান্ত অনুগত ছিল। মায়ের দম বন্ধ করা শাসনের পাশে দাদু ঠাকুমার অফুরন্ত স্নেহ তথা প্রশ্রয় শিশুকে  বেশি আকর্ষণ করত।  মাধব বাবু পরম আদরে নাতনীর নাম রেখেছিলেন শ্রীরাধিকা। মাধবের নয়নমণি প্রাণাধিকা শ্রীরাধিকা ওরফে রাধু। রোজ সকালে মাধব বাবু যখন সেরেস্তায় গিয়ে কাজে বসতেন, রাধুও গিয়ে বসত দাদুর কোলের কাছে। যথারীতি হৈম আপত্তি করেছিল, কিন্তু সে কথা কেউ কানে তোলেনি।
রাধু তখন পাঁচ, দাদুর কিনে দেওয়া ট্রাইসাইকেল নিয়ে সারাদিন গোটা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেদিন দোতলার দালানে সাইকেল চালানো নিয়ে সকালবেলাই একচোট ঝামেলা হয়ে গেল মা-মেয়ের। রাধু প্রচন্ড জেদি হয়ে উঠছে, হৈম কিছুতেই দোতলায় চালাতে দেবে না, রাধুও কথা শুনবে না। শেষে রাধু কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে নালিশ করল দাদুকে। ঠিক সেই সময় বিনোদ খেয়েদেয়ে আপিসে যায়, মাধববাবু গম্ভীর গলায় হুকুম দিলেন,দিদি তুমি দোতলাতেই সাইকেল চালাও।আমার আর সেরেস্তায় বসে কাজ নেই, খাতাপত্র ওপরের দালানে বসেই দেখে নেব। আমি তোমার কাছে বসছি আর মাকে বল, বাবা  এখুনি খেতে বসবে, মা যেন হেঁসেলে যায়। আমার ছেলেটার দিকে তো কারো কোন নজরই নেই।পুরো নিমপাতা খাওয়া মুখে রান্নাঘরে গিয়ে বিনোদকে খেতে দিল হৈম। বেচারা বিনোদ, দুএকটা কথা বলার চেষ্টা করল বটে হৈমর সেদিকে কানই নেই। খালি রান্না ঘরের জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখছে, হঠাৎ প্রবল আওয়াজ, আর মাধববাবুর হৃদয়বিদীর্ণ চিৎকার,  দিদিইইইইইইইইহৈম পাথরের মত বসে রইল, বিনোদ খাওয়া ফেলে লাফিয়ে উঠে দৌড়ল, রাধু সাইকেল সমেত দোতলার বারন্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছে অজান্তে কখন সাইকেল চালাতে চালতে সিঁড়ির কাছে চলে গিয়েছিল মাধববাবু খেয়াল করেননি।হয়তো সাময়িকভাবে একটু ঝিম লেগে গিয়েছিল।
রাধুর মৃত্যুর শোক সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিল মাধব বাবুর ওপর। চোখের সামনে                নাতনীর  মৃত্যু উনি মেনে নিতে পারেননি, ফলশ্রুতি সান্নিপাতিক রোগে (সেরিব্রাল)একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়লেন মাধব বাবু, চোখের দৃষ্টিও হারালেন সাথে সাথে। বিনোদের হল শিরে সংক্রান্তি, একদিকে পঙ্গু অন্ধ বাবা ওপর  দিকে জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হৈমবতী, স্নান করে না, খায় না, চুল আঁচড়ায় না, কারো সাথে বার্তালাপ পর্যন্ত করে না। ঘর থেকে টেনেও বার করা যায় না। তারওপর পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে বাবার পঙ্গুত্বের জন্য জমি-বাড়ি, দোকান, মামলামোকদ্দমা সবই দেখাশোনা করতে হচ্ছে বিনোদকেই। বিনোদের ইচ্ছা  করে, সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে হৈমকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যায়। কেন যে বিয়ের পর হৈমর কথা শোনেনি? আজ খুব আফসোস হয়, সত্যি যদি সেদিন বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যেত?
দিনগুলো যেমন তেমন ভাবে কেটে যায়, কাটে না রাত গুলো। তীব্র ক্লান্তিও ঘুমকটেনে আনতে ব্যর্থ হয়। সোনার পুতুল থেকে হৈমর দিকে তাকালে ওর চোখ ফেটে জল আসে। বিনোদ রোজ বোঝায়,  সেরাতেও  বিনোদ বোঝাচ্ছিল, “যা ঘটে গেছে, তা মর্মান্তিক, কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে কেন? আমাদের সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে, তোমার কি বা বয়স। আবার কেউ আসবে, হয়তো রাধুই  ফিরে আসবে।” ঠান্ডা শান্ত চোখ তুলে হৈম ওর দিকে তাকালো, তারপর অদ্ভুত শীতল স্বরে বলল, “ রাধু আর কোনদিন ফিরে আসবে না। ও এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কোর লীলা কে?” লীলা আবার কে রে বাবা? বিনোদ আর কথা বাড়ায়নি। হৈমর এসব খামখেয়ালী কথাবার্তার সঙ্গে ওর পরিচয় তো আর অল্প দিনের নয়।
শেষ পর্যন্ত ওর অনুরোধ না ঠেলতে পেরে ওর পাশে শুতে রাজি হয়েছিল হৈম।  বহুদিন বাদে স্ত্রীকে জড়িয়ে হৈমর চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল বিনোদ নিজেও জানে না। ভোর বেলা যখন ঘুম ভাঙল, হৈম ওর পাশে নেই, পরনের কাপড় গলায় দিয়ে ছাত থেকে ঝুলছে। হৈমর মৃত্যু বিনোদ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। হৈমকে দাহ করে ফিরে এসে ফাঁকা ঘরে বসে হুহু করে কেঁদে উঠল বিনোদ। মাত্র কয়েক বছরের দাম্পত্যের স্মৃতি ছাড়া আর তাহলে কিছুই রইল না বিনোদের? কেন এমন হল? কার অভিশাপে বিনোদের জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিনোদের মনে পড়ে গেল, হৈম কি বলছিল? “লীলা?” কে এই লীলা? বাবার যা শারীরিক অবস্থা বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহসে কুলাল না, তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেরেস্তায় ঢুকল বিনোদ। নায়েব মশাই, বহু বছর ধরে ওদের সেরেস্তায় কাজ করছেন, বিনোদের বাবাকেও উনি ছোট থেকে চেনেন। বিনোদ ওনাকে ধরল, “কাকাবাবু আপনি বহু বছর আছেন আমাদের পরিবারে।  বলতে পারেন লীলা কে?” নায়ব মশাই মাথা চুলকে বললেন, “লীলা? কই এ নামে তো কাউকে চিনি না?”  বাবাকে আপনি আশৈশব চেনেন।বাবার সাথে কোন লীলার--? কথাটা শেষ করার আগেই নায়েব মশাই এর দেহের ভাষা পাল্টে গেল। বেশ ভয় পেয়েই উনি বললেন “আমি জানি না ।” নায়েব মশাই চলে যেতে উদ্যত হলেন কিন্তু বিনোদ তার আগেই তাঁর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে, “কাকাবাবু আমাকে জানতেই হবে। অনুগ্রহ করে বলুন। কে এই লীলা? হৈম বলেছিল এই লীলার জন্যই আমাদের সর্বনাশ হল, আগে রাধু তারপর হৈম। আমার কই দোষ বলুন?” নায়েব মশাই শশব্যস্ত হয়ে বিনোদকে তুলে দাঁড় করালেন, “দেখ বাপু বিনু, লীলা যেই হোক সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না,বহু বছর হল সে মৃত।” “মৃত? মানে?” হতভম্ব বিনোদের দিকে তাকিয়ে নায়েব মশাই মাথা নামিয়ে বললেন, “ কর্তাবাবু খুব ভালো মানুষ। দেবতুল্য। কিন্তু যৌবনে জেদের বশে একটা ছোট ভুল করে ফেলেছিলেন। এই বারাণসীর কাছে আখোদা গ্রামে আমাদের কিছু জমি জিরেত ছিল। সেটা দেখতেই বড় বাবু কর্তা বাবুকে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ওনার কিছু বন্ধু-বান্ধব ও গিয়েছিল, কটা দিন গ্রামে কাটিয়ে আসবে, আরাম করে। খাজনাও আদায় হয়ে যাবে আর সাথে শিকারেরও সুযোগ ছিল। ঐ গ্রামেরই কোন প্রজার মেয়ে ছিল লীলা। আমি দেখিনি, তবে শুনেছি দেখতে শুনতে মন্দ ছিল না। দিন কয়েকের মধ্যেই মেয়ের বিয়ে বলে লীলার বাপ অনুরোধ করতে এসেছিল খাজনা যদি কিছু মাপ হয়। গরিবগুর্বো মানুষ জন। কর্তামশাই এর মাথায় কি ভূত চাপল, নাকি বন্ধু রাই ওসকাল, বললেন, মেয়েকে আজ রাতে পাঠিয়ে দিস, তোর খাজনা মাপ হয়ে যাবে। বুড়ো তো শাপ-শাপান্ত করতে করতে চলে গেল, যাবার সময় বোধহয় বাঙালি বলেও কিছু গালি দিয়েছিল। যাই হোক রাতের বেলা কর্তা মশাই পাইক নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে আনলেন। দিন দুয়েক পরে ছেড়ে দেন, তবে তার আগে নিজে এবং ওনার বন্ধুরা-”। বিনোদের মাথা ঘুরছিল, ছিঃ বাবা? নায়েব মশাই চোরের মত মাথা নীচু করে বললেন, “মেয়েটা ফিরে গিয়েছিল মা-বাবার কাছে, কিন্তু” একটু থেমে বললেন, “যা হয় আর কি। নষ্ট মেয়েকে কি কেউ আর গ্রহণ করে? নাকি তাদের বিয়ে হয়। ওর ভবিষ্যৎ বারানসির কোন কোঠাই ছিল হয়তো, কিন্তু মেয়েটা তার আগেই আত্মহত্যা করে। শুনেছি গলায় দড়ি।” বিনোদ আর  পারল না, ধীর পদক্ষেপে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। আর ফিরে এল না। বুড়ো কর্তা গিন্নী এত শোক আর নিতে পারল না, তারাও চলে গেল একে একে। আর যারা ছিল তারাও সব কে কোথায় মরে হেজে গেল। বাড়ি এখন লীলার। লীলা একাই থাকে। লীলা চায় না কেউ এবাড়িতে আসুক। বিশেষত রাতের বেলা-”। “অন্তু প্লিজ চুপ কর।”  চিৎকার করে উঠলাম আমি, ভয়ে গলা ভেঙে গেল, চোখ ফেটে জল আসছে। অন্তু মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, “লীলা আসছে-।” ঘরের বাইরে সত্যি কার যেন পায়ের আওয়াজ, একবার মনে হল কোন বাচ্ছা যেন সাইকেল চালাচ্ছে, পর মুহূর্তেই এক গা গয়না পরে কে যেন মল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে। হে ভগবান কি করি? মোমের শিখা প্রায় নিভু নিভু, সঞ্চিতা আমায় ভয়ে আঁকড়ে ধরেছে, চৈতালি সমানে অন্তরাকে ঝাঁকাচ্ছে, “পিঙ্কি? পিঙ্কি?” ভয়ে আমাদের ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে, সে আসছে, তার পায়ের আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যে কোন মুহূর্তে এক ধাক্কায় খুলে যাবে দরজা, তারপর কি হবে? আমিও জানি না।
[শেষ]



Thursday 20 October 2016

অনির (পুজোর) ডাইরি

অনির (পুজোর) ডাইরি ৭ই অক্টোবর ২০১৬
একদম ছোট বেলায় পুজো ছিল নিখাদ আনন্দের উৎসব। পুজোয় প্রতিবছর আমরা দিদার বাড়ি যেতাম। আমার দিদার বাড়ি অর্থাৎ মায়ের বাপের বাড়ি ছিল সুদূর মুর্শিদাবাদ। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হলুদ ট্যাক্সি চেপে ফাঁকা হ্যারিসন রোড (এম জি রোড নামটা তখন জানতামই না। )ধরে সাঁইসাঁই করে শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরে ঢিকিধাঁই ঢিকিধাঁই করতে করতে সেই পলাশী। পলাশীতে নেমে বাস (যাতে বাবা কখনই চাপায়নি) বা রিক্সা করে গঙ্গার ঘাট। ঘাট বেড়িয়ে ওপারে ছিল আমাদের গ্রাম, “রামনগর।” আজও মনে আছে মায়ের এক সহপাঠী নিবারণ মামা ঐ ঘাটে নৌকা বাইত। বিত্তগত ভাবে দুজনের মধ্যে যতই তফাৎ থাকুক না কেন, দুজনের বার্তালাপ থেকে তা কখনই বোঝা যেত না।
ঐ সময় দিদার বাড়ি গমগম করত। মায়েরা চার বোন, তিন ভগ্নীপতি, আর আমরা পাঁচ ভাইবোন। এছাড়া খুড়তুতো পিসতুতো মামা মাসী ছিল উনিশ জন। কি হুল্লোড়ে যে কটা দিন কাটত তা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের প্রজন্মের আমি প্রথম কন্যা সন্তান তার ওপর আমার জন্মও রামনগরে, ফলে আমার খাতিরই ছিল আলাদা। মামা মাসিদের কোলে কোলেই ঘুরতাম। সময় থেমে থাকে না। মামাদের অনেকে আর্মিতে যোগ দিয়ে গ্রাম ছাড়ল। মাসিরা বিয়ে করে দূরে দূরে সরে গেল। দাদারাও কবে যেন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেল। বড়দা ছাড়া আর কেউ যেত না পুজোয়। ফলতঃ আমার পুজো হয়ে পড়ল এক নিরানন্দ অত্যাচার বিশেষ। ক্লাশ সিক্সের পর আর পুজোয় রামনগর যাইনি।
পুজোর হাওড়া ছিল অপরূপা। ঐ আলোকসজ্জা, জনসমাগম, বিভিন্ন আঙ্গিকের প্রতিমা, রোল, ফুচকা, চাউমিন- কিন্তু তা সত্বেও আমার পুজো নিরানন্দময়ই রয়ে গেল। মা ছিল পোস্টাফিসের বড়দিদিমণি। পুজোয় ছুটি ছিল মাত্র দুদিন- অষ্টমী আর দশমী। সকাল বিকাল রান্নাঘর এবং আনুসাঙ্গিক গৃহকর্মাদি সামলে অফিস করে বাড়ি ফিরে মা এতটাই ক্লান্ত থাকত যে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা দুটো বার্তালাপ করার মত শক্তিও অবশিষ্ট থাকত না। আর বাবা? বাবার গোটা পুজো জুড়ে থাকত হিরেন কাকু। বাবার সহপাঠী, জাহাজে রেডিও অফিসার ছিলেন। পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসতেন এবং এলেই বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তেন না। আড্ডা মেরে অপরাধীর মত বাবা বাড়ি ঢুকত রাত সাড়ে দশটায়। সন্ধা থেকে ঠাকুর দেখতে যাব বলে সেজে গুজে বসে থাকতাম আর বাবা বাড়ি ঢুকলেই জুড়তাম প্রবল কান্নাকাটি। শেষে রেগেমেগে বাবা হিরেণ কাকুকে বলেই দিল,“ আমাকে পুজোর সময় একদম ডাকবি না। তোর জন্য ওকে সময় দিতে পারি না। ” কিন্তু কাকু ছিল নাছোড়বান্দা। সে বছরই ডিসেম্ব্যার মাসে উনি মারা যান। সেটা ছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার বছর। 
হিরেন কাকুর না থাকা আমার পুজোয় বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মায়ের ক্লান্তি কমে তো নিই, উল্টে মেজাজ আরো খিটখিটে হয়ে উঠতে লাগল। আর বাবাকে দখল করে নিল বাবার স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপ। ২০০২ সাল থেকে আমার পুজোর রাশ আমি নিলাম। এক সিনিয়র দিদির সাথে শুরু হল কলকাতার ঠাকুর দেখা। ষষ্টিতে নর্থ আর সপ্তমীতে সাউথ। বেলা নটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে জড়ো হতাম আর তারপর বাসে করে আর নয়তো পদব্রজে চলত পুজো পরিক্রমা। সন্ধ্যাবেলায় কাতারে কাতারে সুসজ্জিত নরনারী যখন ঠাকুর দেখতে বের হত, কালিঝুলি মেখে ক্লান্ত শরীরে ফোস্কা পড়া পায়ে আমরা তখন বাড়ি ফিরতাম। বছর খানেক পর সঙ্গী বদল হল অপর্ণাদির পরিবর্তে পম্পা কিন্তু রুট বদলাল না। বোসপুকুরের সেই ভাঁড়ের প্যান্ডেল, বিস্কুটের প্যান্ডেল, সিংহীপার্কের কাঁচের চুড়ির প্যান্ডেল এদের সাথেই দেখা। ২০০৮ থেকে বিগত আট বছর শুধুই সঞ্চিতার সঙ্গে-
গত বছর থেকে আমার পুজোয় নতুন সংযোজন অন্তু অর্থাৎ অন্তরা। সারারাত জেগে ঠাকুর দেখার ইচ্ছাটা ছিল আমার কিন্তু অন্তুুর পূর্ণ সমর্থন তথা সহযোগিতা না থাকলে ব্যাপারটা পুরো ঘেটে যেত। ঠাকুর দেখে বেড়িয়ে গাড়ি খুঁজে বের করার ব্যাপারে অন্তুর সুবিশেষ দক্ষতা আছে। আলোকসজ্জিত মধ্য বা ভোর রাত্রে আমার কলকাতার সব রাস্তাকেই একই রকম লাগে তথা সব গাড়িকেই “এই তো আমাদের গাড়ি” বলে বোধ হয়। গত বছর সঞ্চিতা, অন্তরা এবং আমার সাথে চৈতালীর ও যাবার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডেঙ্গুর আক্রমণ সব প্ল্যান কেঁচিয়ে দিয়েছিল। এবছর বিশেষ করে চৈতালীর জন্যই আমরা বেড়োলাম আর সারাদিন অফিস করে রাত দশটায় বাড়ি ঢুকে চৈ বের হল শুধু আমাদের জন্য।
গতবছরের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। চেতলা অগ্রণী হয়ে সুরুচি যেতেই লেগেছিল প্রায় তিন ঘন্টা । তার মধ্যে দেড় ঘন্টা শুধু অভেদ্য জ্যামেই আটকে ছিলাম আমরা। এবার তা হল না, সৌভাগ্যবশত রাস্তা ছিল বেশ ফাঁকা। মিনিট পনেরোর মধ্যেই চেতলা। তুলনামূলক ফাঁকায় দেখে, ওখান থেকে বাদামতলা আষাঢ় সংঘ,৬৬ পল্লী হয়ে, বাঁশের ফাঁক দিয়ে গলে দেশপ্রিয় পার্কের হাজারহাত ও নির্বিঘ্নে হয়ে গেল। আমরা ফাঁসলাম ত্রিধারায়। কি অসম্ভব ভিড়, আর একটিও পুলিশ নেই। লাইনের বালাই নেই, ঠেলাঠেলি, লোকে নির্লজ্জ ভাবে সেল্ফি তথা ঠাকুরের ছবি তুলেই যাচ্ছ, কেউ তাড়া দেবার নেই। বাচ্ছাগুলো ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বিরক্ত হয়ে উঠল, ভিড় আর এগোয় না।
ত্রিধারা দেখে যখন বেড়োলাম তুত্তুরী কাঁদতে লাগল। বেচারা আর হাঁটতে পারছে না। টিনটিন অর্থাৎ অন্তুর পুত্রের যাবতীয় সদুপদেশ আমাদের সম্মিলিত আদর সব বিফল। শেষে অন্তুর কোলে উঠে মুখে আবার হাসি ফিরে এল। অন্তরা মাসির কোলে চেপে বেশ খানিকটা যাবার পর আবার পূর্ণোদ্যমে হাঁটতে লাগল। একটু দূরেই হিন্দুস্তান পার্কে আর আমরা মা মেয়ে নামলাম না। সঞ্চিতাও রয়ে গেল গাড়িতেই। টিনটিনদাদা তুত্তুরীর জন্য ছবি তুলে আনতে ভোলেনি অবশ্য।
পরবর্তী গন্তব্য মুদিয়ালী। মুদিয়ালী, শিবমন্দির, লেক ইয়ুথ ক্লাব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল নির্বিঘ্নে। পরবর্তী গন্তব্য হরিদেবপুর ৪১ পল্লী, অজেয় সংহতী( এইরে নামটা ভুলে গেছি) এছাড়াও বেশ কয়েকটি ক্লাব, যারা মণ্ডপ সজ্জা তথা প্রতিমার নিরিখে কলকাতার অনেক নামি পুজোকে হেলায় হারিয়ে দিতে পারে।
শেষ গন্তব্য সুরুচি সংঘ। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে ৫টা ছুয়েছে। আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে আকাশের রঙ। বিমোহিত হয়ে দেখছিলাম আমরা, হঠাৎ পিছন থেকে অন্তরা জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁরে অনি তোর বর কবে আসবে?” চমকে উঠলাম আমি, ‘বর’? আমার বর? তার তো পুজো বলে কিছু নেই। সে তো ওসি ডকুমেন্টেশন। তার কাজ আপাততঃ সিঙ্গুরের টাটাদের কারখানা ভাঙাভাঙির ছবি তোলা, অ্যালবাম বানানো এবং আর কি তা সে নিজেও জানে না। কাল দুপুর পৌনে চারটে থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অবধি চুপ করে একাকী বসেছিল সিঙ্গুরের বিডিওর ফাঁকা চেম্বারে কখন অ্যালবাম প্রিন্ট হয়ে আসবে তার প্রতীক্ষায়। কি চুড়ান্ত মন খারাপের সঙ্গে তাকে তারই এককালে বলা কথাগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম, “চাকরী মানেই চাকরগিরি”। আবার কি?সব পেশারই কিছু দাবী থাকে। এই আমাদের চৈতালী কাল রাত দশটায় বাড়ি ঢুকে সাড়ে দশটায় আমাদের সাথে বেড়িয়ে ভোর সাতটায় বাড়ি ঢুকবে। বাড়িতে পদার্পণ করে নাওয়া খাওয়া সেরেই সকাল আটটায় দৌড়বে, বেলা দশটায় ক্লায়েন্ট মিটিং তারপর পাহাড় প্রমাণ কাজ। আর পুলিশ গুলো? আমার এক সদ্য পরিচিত পুলিশ বন্ধুকে (দাদাই বলা যায়) মজা করে বলেছিলাম,“পুজোয় ডিউটি করেন বলেই তো পুজোর লেটেস্ট ফ্যাশন তো আপনারাই সর্বাগ্রে দেখতে পান। ” উনি বিমর্ষ ভাবে বলেছিলেন, “বিশ্বাস কর, কিচ্ছু রেজিস্টার করে না মাথায়। যন্ত্র হয়ে যাই। নিষ্প্রাণ রোবট। ” আজ আনন্দময়ীর শুভাগমনে আশা করব এদের পুজোও ভাল কাটুক। শুভ ষষ্ঠী
(চলবে গোটা পুজো জুড়ে, আশা করি)


অনির(পুজোর) ডাইরি ১০ অক্টোবর ২০১৬
ঘুম পাচ্ছে, কি প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। পুজোর ধকল কি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ইচ্ছা ছিল মেয়ে নিয়ে আজ সকালে শোভাবাজার রাজবাড়ি যাব। সাথে চৈতালীর প্রস্তাবিত পাথুরিয়াঘাটার খেলাৎ ঘোষের বাড়িটাও ঘুরে নেব। গাড়ি নেই, বাস বা ওলাই ভরসা। সেই মত ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলামও কিন্তু তুত্তুরীকে কিছুতেই ঘুম থেকে তোলা গেল না। চেষ্টা করা মাত্রই আমার মেয়ে এমন হাঁউমাউ জুড়ে দিল, সাথে যথাযথ সঙ্গতে আমার মা। অবশেষে মায়ের ফরমান,“মেয়েকে নিয়ে যাবি না।” ভাল কথা। তাহলে আমি একা যাই? “মেয়েকে ছেড়ে কোথাও যাবি না।”
অবস্থা সুবিধার নয় বুঝে পরিকল্পনা বাতিল করলাম। এমনিতেই কাল থেকে যা অশান্তি চলছে। আমার নতুন মূল্যবান লিপস্টিকটির পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটিয়েছে আমার কন্যা। শখ করে কিনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সারা বছর আর লিপস্টিক না কিনলে উশুল হয়ে যাবে, গোটা মাসই চলল না। এই নিয়ে পঞ্চম লিপস্টিক ভাঙার জন্য বেশ কয়েক ঘা (আড়াই ঘার বেশি নয়) উত্তমমধ্যম দিলাম। ফলশ্রুতি মেয়ের থেকেও প্রবল বেগে আমার মা কাঁদতে লাগল এবং বাবা পাঞ্জাবি চড়িয়ে গৃহত্যাগে উদ্যত হল। শৌভিকের সাথে ফোনে গৃহযুদ্ধের কথাটা আর বলছি না।
তাই আজ আর অবাধ্য হতে সাহস হল না। মা আর মেয়ের সাথে ঝগড়া নিয়ে কোন চাপ নেই, রোজ হয়। কিন্তু আমার বাবা এবং আমার বর আমার সবথেকে বড় সমর্থক। এদের আমি কখনই চটাই না। বর তো ১৫ মিনিট বাদে সরি বলতেই মাপ করে দিল। কিন্তু বাবা দেখি সকাল থেকে একটাও বার্তালাপ করছে না। থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। গায়ে পড়েই ভাব করতে গেলাম।
১৯৫৮ সালে হাওড়ার আইজ্যাক রাফায়েল বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল( তখন ম্যাট্রিক ছিল কি? এই রে ভুলে গেছি) পাশ করেছিল বাবারা ৩৬ জন। কমতে কমতে বর্তমানে জীবিত আছেন মাত্র ৮ জন। যাদের মধ্যে তিন জন বাইরে থাকেন এবং তাঁরা আদৌ জীবিত নাকি কোন অঘটন ঘটে গেছে এ সম্পর্কে বাকিরা অন্ধকারে। এককালে বাবাদের বিশাল গ্রুপ ছিল। যারা ঐ বছর স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিল এবং যারা পাশ করেননি বা বিভিন্ন ক্লাশে অকৃতকার্য হয়ে পিছিয়ে পড়েছিল সকলকে নিয়ে জমাটি আড্ডা বসত পুজোর কটা দিন। নাওয়া খাওয়া ভুলে আড্ডায় দৌড়ত বাবা। বিত্তগত বা রাজনৈতিক মতাদর্শগত ফারাক বাবাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারেনি। রোজ একাধিক ব্যক্তি কিছু না কিছু খাওয়াত। সুগার প্রেশার প্রস্টেট কোলেস্টরল হওয়া প্রৌঢ়- বৃদ্ধের দল নিজ নিজ গৃহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন পূর্বক কদিন সর্বভূক হয়ে উঠত- চিংড়িমাছের চপ, বড় বড় বেগুনী, মোচার চপ, বাগনানের ছানাপোড়া, রসগোল্লা, আমতার পান্তুয়া, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, হাওড়ার বিখ্যাত দুলাল ঘোষের রাবড়ি, ভুরভুরে ঘিয়ের গন্ধ ওঠা মোহনভোগ, ভীম নাগের সন্দেশ, শেঠ সুইটসের কালো গজা, খাস্তার গজা, খাস্তার কচুরী টক মিষ্টি চাটনী দিয়ে,প্যাটিস, পেস্ট্রী, কোল্ড ড্রিক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। সব একদিনে হত না বটে তবে হত অবশ্যই। যে যেমন পারত, সাধ্য তথা সামর্থ্য অনুসারে নিয়ে আসত এবং পরম তৃপ্তি ভরে বাকিরা তা সেবন করত। বাবা যখন বাড়ি ফিরে খোশ মেজাজে গল্প করত, ঈর্ষায় আমি আর মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতাম।
সে আড্ডা আজ আর নেই। কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র আট জনে। সকলেই পচাত্তর ঊর্দ্ধ। বাবার ভাষায় একে একে নিভিছে দেউটি(ভুল হলে মাপ করবেন। আমি কোটেশন ব্যবহারে বিশেষ দড় নই )। কিন্তু এই আট জন বৃদ্ধ জেদের বশে আজো পুজোর প্রতিটা দিন আড্ডা দেয়। সময় হলেই ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে একসাথে বাবার মোবাইল এবং বাড়ির ল্যাণ্ডফোন। এক যোগে একাধিক বৃদ্ধ ডেকে ওঠে,“ কি রে অলোক,আয়? তুই না এলে জমছে না যে”। বাবাও ওমনি গুটি গুটি পুজোর জামা বা পাঞ্জাবি গলিয়ে চুলে ব্যাক ব্রাশ করে নিজের অভিমানিনী স্ত্রী তথা নাতনীকে বলে, “যাই সোনা(তুত্তুরী অবশ্যই। মাকে সোনা বললে তৎক্ষণাৎ জবাই)। এবছর আট সামনের বছর কজন থাকি? ”
বাবাদের সেই সাধ্য বা পাচন ক্ষমতা আর নেই। খাবার বহর ও অনেক কমে গেছে তবু পালা করে রোজ কেউ কিছু আনে। আজ বাবার পালা। বন্ধুরা প্যাটিস খেতে খেয়েছে। দশটায় সবাই সমবেত হবে, তাই সাতটায় বাবা বেরোচ্ছিল সুগার এণ্ড স্পাইস থেকে আটটা প্যাটিস কিনতে। ফিরে এসে চান করে দাড়ি কামিয়ে সেজেগুজে বেরোবে।
ভাব করার তাগিদে বললাম আমিই কিনে এনে দিচ্ছি। তবে সুগার এণ্ড স্পাইস কেন? খাওয়ালে মিও আমোরে বা ক্যাথলিন খাওয়াও। বাবা অনেক মাথা চুলকে বলল, “ ঠিক আছে। এনে দিলে তো খুব ভালই হয়। তোর যা ইচ্ছে কিনে আন। তবে আটটা এক জিনিস আনিস। ”
তৈরি হয়ে যখন বেড়োলাম ঘড়ির কাঁটা সোয়া আটটা দেখাচ্ছে। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট। কে বলবে কাল গলির মুখ থেকে আমাদের বাড়ি ঢুকতে চার মিনিটের রাস্তা তুত্তুরী আর আমি বারো মিনিটে পেরিয়েছি এবং তাও গোটা পনেরো লোককে দুহাতে ঠেলে বা কনুইয়ের গুঁতো মেরে। বাবা টাকা দিয়েছিল রিক্সা করে যাওয়ার(মহানন্দে হাত পেতে নিলাম, ডি এর যা হাল আর পুজোর মাসের যা খরচা) জন্য। একটাও রিক্সা নেই। ভুল বললাম, রিক্সা আছে রিক্সাওয়ালা নেই। একটি রিক্সা দেখতে পেলাম যার চালক লম্বা ঠ্যাং বার করে রিক্সায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে, বেশ কয়েকবার ,“ দাদা? ভাই? এই? ভাড়া যাবে?” বলাতেও সাড়া শব্দ করল না।


হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বড় রাস্তায়। অন্য সময় টোটো আর বাইকের ভিড়ে রাস্তা পেরোনো যায় না। তাজ্জব হয়ে গেলাম সাড়ে আটটা বাজছে আজ একটাও বাইক নেই। মিনিট পনেরোয় মাত্র দুটি টোটো গেল। এবং দুটিই সংরক্ষিত। বয়স্ক ঠাকুমা দিদিমাদের নিয়ে ভোরবেলা নাতনীদের দল(আজ্ঞে হ্যাঁ একটিও ছেলে ছিল না। বাবুরা বোধহয় সারারাতের ধকল সামলে কেউ ঘুম থেকেই উঠতে পারেননি)। আরো দশ মিনিট পর একটি বাস পেলাম। ৬৩ নম্বর ডোমজুড় গামী বাস হাওড়ার বাসিন্দাদের কাছে সাক্ষাৎ বিভীষিকা। ব্যস্ততম মুহূর্তেই ওদের যা গতি থাকে, বিরক্ত অফিস যাত্রীরা চিৎকার করে কন্ডাকটরের গুষ্টি উদ্ধার করে দেয়, “ আর বাস চালিয়ে কাজ নেই। গামছা পেতে ভিক্ষে কর গে যা। কিরে ? হাওড়া হাওড়া করলি তাও উঠল না? যা কোলে করে তুলে নিয়ে আয়”। কখনও কখনও যাত্রী নিজেরাই লোক ডাকে, “ আসুন দাদা আসুন। দেখছেন না আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে? আপনি দয়া করে বাসে উঠে এদের উদ্ধার করুন” ইত্যাদি কত যে মজার সংলাপ শোনা যায় ৬৩ নম্বর বাসে উঠলে। আমার কপালে সেই ৬৩ই জুটল?
শম্বুকে লজ্জিত করে বাস যখন নামালো কপালে করাঘাত করে দেখি মিও আমোরে বন্ধ। এটা হাওড়ার ব্যস্ততম মিও আমোরে, আমার দৈহিক বিভঙ্গে হতাশা লক্ষ্য করে এক বয়স্ক প্রাতঃভ্রমণকারী বললেন, “ সারা রাত ধরে লোকে এত খেয়েছে-”। বাস টোটো কিচ্ছু নেই। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ক্যাথলিন। এটা খোলা। সত্যিই হাট করে খোলা। এসি চলছে না। একটা ফ্যান ঘুরছে মাত্র। এবং দোকানে কেউ নেই। দোকানদার ও না। সারি সারি শোকেশ ভর্তি খালি ট্রে। কেবল গোটা তিনেক শুকনো কেক আর গোটা দশেক ক্রীম রোল পড়ে আছে। দেখেই অভক্তি হয়। বুঝলাম কেন বাবা সুগার এণ্ড স্পাইসে যাচ্ছিল। উল্টো দিকেই দোকান, খোলা এবং বন্ধ। অর্থাৎ দোকান খোলা কিন্তু দরজা বন্ধ, বাতানুকূল যন্ত্র চলছে। রাস্তা পেরিয়ে যাব কি? লম্বা লাইন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাইক স্কুটার সাইকেল সহ লাইন দিয়েছে রেয়াজী খাসির মাংস কিনবে বলে। দোকানটা ৫০০মিটার দূরে তো হবেই বা আরো বেশি। আজ নবমী কি না? রাত তিনটে থেকে ঐ দোকানে লাইন পড়ে।

লাইন টপকে চিকেন প্যাটিস এবং মায়ের ফরমাইশ অনুসারে এক ব্যাগ মিষ্টি কিনে যখন বাড়ি ফিরলাম বাবা তৈরি হয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। আপাততঃ যা এনেছি তাতে উভয়েই খুব খুশি বাবা গরম প্যাটিশ আর মা পান্তুয়া (আজ্ঞে হ্যাঁ খাঁটি বাঙালি রস জবজবে কালো পান্তুয়া ঐ খোট্টা গুলাবজামুন নয়), খাস্তার গজা আর তুত্তুরীর প্রিয় মিষ্টি চাউমিন ( সীতাভোগ) পেয়ে। আপাততঃ শান্তিপূর্ণ গৃহকোণ, যদিও কতক্ষণ এই শান্তি স্থায়ী হবে আমি জানি না। কারণ আমরা চাটুজ্যেরা খুব একটা শান্তিপূর্ণ হই না কি না !😈

Friday 30 September 2016

অনির পুজোর ডাইরি ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৬


শুভ মহালয়া। মহালয়া এলেই ছোট বেলার কথা বড় বেশি মনে পড়ে। আমাদের সেই পুরানো দেড়-দুশো বছরের ভাঙা বাড়ি, সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই তিন দিক রোয়াক দিয়ে ঘেরা বিশাল উঠোন। উঠোনের পূবে আর পশ্চিমে খোলা বাগান, যা আমাদের ছোটবেলায় প্রায় জঙ্গলে পর্যবসিত হয়েছিল। কি গাছ ছিল না আমাদের সেই বাগানে? আম, কাঁঠাল, নাগকেশর, বেল, যজ্ঞিডুমুর, নিম, বট আর অশ্বত্থ গাছ যুগলে জড়াজড়ি করে উঠেছিল। কৃষ্ণ এবং রাধাচূড়া দুটোই ছিল পুবের বাগানে। পেয়ারা গাছ ছিল গোটা দুয়েক। এত মিষ্টি পেয়ারা বাজারে পাওয়া যেত না, আজোও যায় না। এছাড়াও জেঠাইমার লাগানো কত যে ছোট ছোট গাছ ছিল- যেমন তুলসি, দোপাটি, অপরাজিতা, কৃষ্ণকলি, সন্ধ্যামণি, পয়সাপাতা (যাকে এখন বলি মানিপ্ল্যান্ট)। কলকে ফুলের গাছ, বাসক পাতার গাছ ও ছিল, আমরা ভাইবোনেরা ছোট বেলায় কলকে আর বাসক ফুল পেড়ে পিছনের মধুটা সুড়ুত করে চুষে খেতাম। সাবধানে খেতে হত, অনেক সময় লাল পিঁপড়ের দল আমাদের আগেই ঢুকে বসে থাকত। পাঁচিলে পাঁচিলে হয়ে থাকত ডুমুর গাছ। কারো সামান্য শরীর বিগড়লেই জেঠাইমা ডুমুর পাড়িয়ে রাখত- আর বেশ কিছুদিন ধরে তাকে হয় ডুমুরের ঝোল, নয়তো ডুমুর ভাজা আর  নাহলে ডুমুর সিদ্ধ খেতে হত।  উত্তরের পাঁচিলের লাগোয়া ছিল একটা জবা গাছ, লাল টকটকে জবা। থোকা থোকা ফুটে থাকত, তবে পাড়তে হলে পাঁচিলে উঠতে হত, ভিত হীন নড়বড়ে পাঁচিল আর কেউ উঠলেই পাশের বাড়ির জন দাদার মা প্রবল হল্লা জুড়ে দিতেন। “ওগো তোমাদের দেবী আর ঝুনু পাঁচিলে উঠেছে গো। পড়ে মরবে গো।” অনেক বছর হল মারা গেছেন ও বাড়ির জেঠাইমা, দীর্ঘ দিন পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন- জবা গাছটাও অবশ্য কেটে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৫-৯৬ এ।
আজ কেন যে ছোট বেলার জন্য এত মন খারাপ করছে? কত লোক ছিল আমাদের বাড়িতে- ঠাকুমা, মেজ পিসি (যাকে আমরা সবাই ডাকি দিদি বলে) জেঠু, জেঠাইমা, ছোট কাকু, কাকিমা, বাবা, মা, আর আমরা তিন ভাইবোন। দিদিভাই অর্থাৎ আমাদের জেঠতুতো দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সেই আশির দশকের শুরুতে। পড়েছিলাম আমি আর আমার দুই খুড়তুতো ভাই অয়ন আর অনিন্দ্য। মা-কাকিমা  দুজনেই অফিস বেরিয়ে না যাওয়া অবধি আমরা ভিজে বেড়াল হয়ে থাকতাম, যেই ওঁরা বেরিয়ে যেতেন, আমাদের আর পায় কে? ঠাকুমা বলত, “বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর।” কি প্রবল দুরন্তপনা করতাম আমরা, ঠাকুমা-পিসি হিমশিম খেয়ে যেত। সারা দুপুর কেউ ঘুমতাম না, আর যেই মায়েরা এসে পড়তে বসাত, অমনি চোখ ঢুলঢুল। বেদম ঠ্যাঙানি খেতাম, ভাইয়েরা একটু বেশি, আমি একটু কম, কারণ ঠাকুমার ভয়ে সকলের মায়েরাই করত কি, বাচ্ছাদের নিজেদের ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে পেটাত। আমার দুই ভাই দাঁড়িয়ে মার খেত, আর আমি প্রবল চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিশাল সাবেকি খাটটাকে ঘিরে গোল গোল ঘুরতাম। মা লাফিয়ে খাটে উঠলে আমি খাটের তলায় ঢুকে যেতাম। এত সাবধানতা সত্ত্বেও দু এক ঘা স্কেল বা হাতপাখার ডান্ডার বাড়ি পড়েই যেত। চিৎকারের কারণ ছিল আমার জেঠু। দোতলার বিশাল দালানে একটা খাট পাতা ছিল, ওখানে অফিস থেকে ফিরে এসে বা ছুটির দিনে জেঠু শুয়ে শুয়ে বই পড়ত। মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প তার দিয়ে বাঁধা থাকত। আমার কান্নার আওয়াজ দরজা টপকে জেঠু অবধি ঠিক পৌঁছত, আর তৎক্ষণাৎ উনি বারন্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করতেন, “ওগো শুনছ। মেয়েটাকে সরমা বোধয় মেরেই ফেলল।” জেঠিমা ছিল চিরদিন আমার বিশাল আশ্রয়। জেঠুর গলা শোনার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জেঠিমা এসে ধড়াম ধড়াম করে দরজা পিটত। “খোল। দরজা খোল। মেয়েটাকে মেরে ফেলবি নাকি?” বাধ্য হয়ে মা দরজা খুলে দিত আর প্রতিবার একই মিথ্যা কথা বলত, “বিশ্বাস কর দিদি, মারিনি। শুধু মারব বলে স্কেলটা দেখিয়েছি।”
ইশ কি সব দিন ছিল, স্বপ্নের দিন। ভাবিনি মৃত্যু কোনদিন আমাদের বাড়িতেও থাবা বসাবে,  প্রথমেই গেল আমার দিদা সেটা ১৯৯৮ সাল।  তারপর বড় পিসেমশাই, ২০০৪,বয়সে উনি ঠাকুমার থেকেও বড় ছিলেন অবশ্য। তারপর ঠাকুমা ২০০৫ এ, ঐ বছরই সেজো পিসেমশাই, ২০০৬ এ বড় পিসি, তারপর ২০০৯ এ ছোট পিসেমশাই, ২০১২-১৩এ বড় মেসোমশাই আর ছোট কাকু আর ২০১৪ এ আমার জেঠু। বাকিরা ঠুকঠুক করে ব্যাটিং করছে বটে, কিন্তু ক্রীজে থাকার ইচ্ছা কারোরই নেই।
জেঠু সেই ১৯৮২ থেকে হাইসুগারের রুগী ছিলেন, ২০০১-০২ এ পেসমেকার বসাতে হয়েছিল। কি কষ্ট করে যে জেঠাইমা ওনাকে বাচিয়ে রেখেছিলেন, জেঠিমার জীবনটাই ঘুরত জেঠুকে কেন্দ্র করে। সকাল থেকে জেঠু কখন কি ওষুধ খাবে, কি দিয়ে প্রাতঃরাশ সারবে, দুপুরে ক-রকম পদ রান্না হবে ( তেতো, ডাল, একটা ভাজা, একটা পোস্ত, মাছ/মাংস নাকি ডিম, টক দই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার), দুপুরে কি ফল খাবে (সুগার রুগীর সব ফল চলে না, আবার একই ফল রোজ দিলে জেঠু খেতে চাইবে না), রাতে কি খাবে সব ছকা থাকত জ্যাঠাইমার। এ ছাড়া ছিল চা, কত বার যে চা খেত আমার জ্যাঠামশাই তার ইয়ত্তা নেই। এত যত্নের পরেও জেঠুর কোষ্ঠ পরিষ্কার হল কিনা এটা ছিল জ্যাঠাইমার সবথেকে বড় উদ্বেগের কারণ। সব কাজ স্বহস্তে করত, এমনকি বাজার –দোকান, বিল দেওয়া পর্যন্ত। সেই জেঠিমা, জেঠুর মৃত্যুর পর কেমন যেন জবুথবু হয়ে পড়ল। জ্যাঠাইমার শরীরেও যে এত রকম রোগ বাসা বেঁধেছে জানতই না কেউ। সব দুধ টুকু ছানা কাটিয়ে জেঠুকে খাইয়ে, চিরদিন দেখতাম জ্যাঠাইমা চামচ দিয়ে বাটি চেঁচে সর টুকু খাচ্ছে, তাও আমাদের দেখতে পেলে হাঁ করিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিত। আর আজ ডাক্তার বলছে, ক্যালসিয়ামের অভাবে সব হাড় ক্ষয়ে গেছে, যে কোন মুহূর্তে দেশলাই কাঠির মত ভেঙে পড়তে পারে।
একই রকম ভালোবাসা দেখেছিলাম বড় মাসি আর মেসোমশাইয়ের মধ্যে। মেসোমশাইয়ের পারকিনসন্স আর অ্যালজাইমারস দুটো মারণ ব্যাধিই ছিল। ভুলে যেতেন সবকিছুই, রাতবিরেতে প্রকৃতির আহ্বানে উঠে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতেন। বাথরুম খুঁজে পেতেন না, নাই নিজের শোবার ঘর। দাদারা বাড়ির দেওয়ালে, বাথরুমের দরজায় কাগজ মেরে রাখত, তাও পারতেন না। সেই উদ্বেগে রাতে বড় মাসির ঘুম আসত না। আর দিনের বেলায়ও ওনাকে চোখের আড়াল করা যেত না, পলকের মধ্যেই দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে যেতেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষটা হঠাৎ হয়ে উঠেছিলেন একান্ত অপরিচিত এক ব্যক্তি। নিজের সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য-সাধ্য নিকড়ে দিয়েও ওনাকে বাঁচানো গেল না। মেসোমশাইয়ের মরদেহের পায়ের কাছে বসে সেদিন সম্মিলিত উচ্চ শোকের মাঝে গুনগুণ করে বড় মাসি একটা কথাই বলছিল মা আর মাসিদের, “আমি কি করব? কাল থেকে আমি কি নিয়ে থাকব? আমার তো আর কোন কাজ রইল না বল?”
আজ মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে কেন যে এদের জন্য এত মনখারাপ লাগছে? না যারা চলে গেছেন তাদের জন্য নয়, বরং যারা রয়ে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের মৃত্যুকামনা করছেন তাদের জন্য। এই মনখুশি সোনালি রোদ, চকচকে নীল আকাশ আর মায়ের আগমনী তাদের জীবনকেও উজ্জ্বল করে তুলুক। উৎসবের আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠুক সকলের জীবন। ভালোলাগা আর ভালোবাসার রেশ ছড়িয়ে পড়ুক ঘরের এবং মনের প্রতিটি কোনে, যেখানে অন্য সময় হয়তো সূর্যেরও প্রবেশ নিষেধ।

(চলবে গোটা পুজো জুড়ে, আশা করি)   

Wednesday 28 September 2016

lekha 3

Working in a nationalized bank has its toll, who understands it better than her, in the last seven/eight years she was transferred from Jhajjar Haryana to Junagarh Gujrat to Bilaspur Chattishgarh… finally she is posted in her home state but its almost 650 km from Kolkata. So what? She fell in love with this small hill town. Before/after duty hours she wanders alone through the deserted roads, through the partly dense forests. The denizens are too innocent to heckle a lonely woman. But today she is not feeling comfortable, as if she is not alone, somebody is watching her for sure. She looked around and found a big lens capturing her moves, must be a stupid Bong tourist is behind that. Getting furious she was about to leave the spot, when a familiar voice said, “Finally! Finally I got you!”
The man was smiling at her, for a moment or two she was dazed by his good looks… how many years 7/8/9 or 10? Oh my gosh!!! Its been so long since she’d last seen him… it’s like ages… but she still remembers…. She remembers everything…. He is her bestie’s cousin. When they first met, he was in his early 20s, a bright student. He was in 2nd or 3rd year of engineering degree. And she was in the wrong side of 20. It was her friend’s birthday where she first saw him… he was a tall, fair and lean boy, with newly and unevenly shaven beard and a pair of geeky glasses. The party ended really late that night and on her friend’s repeated request he walked her home… they talked, no actually he talked and she listened… she was so ordinary… so mediocre compared to him….but he treated her with too much respect…. She was actually started weaving dreams of future together, until he said, “Okay Di. Goodnight.”
“Di?” so he considered her as an older sister? But it failed to dissuade her from her stupid dreams…. Dreams of a colourful future together… she asked her friend a lot of questions about him,he had all the qualities of her prince charming…. She was totally engrossed into their dreamy future when she suddenly discovered that her Prince did have a princess… a far better looking, much younger girl, whose father is ten times wealthier than her father…. She was shattered…. But it was fair enough, a prince is supposed to be with a princess… only with a princess not a commoner like her. She made up her mind and concentrated on her career…. On the night of her friend’s engagement she witnessed them, her Prince and his Princess to break off… no she had nothing to do with it…. It’d been their decision…
It was her friend’s wedding, she met him for the last time…. Again on her friend’s repeated requests he went to drop her on foot, it was a full moon night, the roads were totally deserted…. They were alone… he hadn’t said anything, neither did she…. After bidding her goodbye…he suddenly called her, by her name, she had goose bumps but before he said anything she stepped into the house, looked into his eyes and said, “Goodnight Bro”.
He is visibly elated, hugged her so tight and kept on saying, “OMG! Where have you been? I searched you everywhere from FB to Twitter to Linkedin… ….”. Her heart is about to get blown… she tried to free herself and said, “ Listen Br”…. “Oh! Fuck it…. Im not your brother…..” he said angryly
#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.in

Lekha 2

He was married to someone else. So was she. They were colleagues.when they met he was in his late 30s and she was mid 40. He was overwhelmed with her simplicity.. the attraction was imminent. He made the first move, but met with resistance. To her falling for another man was a sin... she was quite content with her life. All she ever wanted was someone to talk to... husband, kids were too busy with their lives...

He stopped where she wanted him to... they become buddies... she talked talked and talked... he was such a good listener. He was her open window.

Days passed... they came closer... she met with an accident and lost her mother.... he wanted to drop in to her place... to console her... he wanted to hug her... wiping out every single drop of tears from her weeping eyes was all he wanted. But she refused to let him in... she called him a sexstarved animal.. all his feelings and emotions were branded as mere sexual desires. Otherwise why would a happily married man cherish feelings for other woman? She eventually blocked his no... he pleaded for one last hearing but she was adament.

Its been seven months since he quit the job and left the city... she was happy at the begining. But these days she wanders alone through the lonely streets where they used to wander together...touches the benches they used to sit and talk....relives every moment they spent together...she still loves her husband very dearly but something has changed.... yes deep down she misses him... his feelings were precious... those moments were priceless.

She unblocked his no in whatsapp but he last logged in seven months ago.... she tried to call him but phone was switched off... facebook was the last option but he deactivated his account long ago.
#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/