Monday 16 January 2017

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি January to March 2017

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৪থা জানুয়ারী ২০১৭ #1
যে কোন লোকাল ট্রেনে উঠলেই বোঝা যায় বাঙালীর দুই মারণ ব্যধি- ‘অম্বল-বদহজম-গ্যাস’  আর ‘দাদ-হাজা-চুলকানি’। ঐ রোগেই ঘোড়া ইয়ে মানে বাঙালি মরেছে। মা-- মা গো রক্ষা কর মা🙏🏼🙏🏼🙏🏼

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৫ই জানুয়ারী ২০১৭ #2
লোকাল ট্রেনের সাথে এখনও ঠিক মানিয়ে নিতে পারলাম কই? কাল সন্ধ্যা বেলা ফিরছি, কোথায় কোন নিষ্কর্মার দল অবরোধ করেছিল কে জানে, ট্রেন যেমন লেট তেমন ভিড়াক্রান্ত। ক্ষুধায় নাড়ি জ্বলছে,ব্যাগে সাধের আপেল পচছে, খাব কি? বসেইছি তো অর্ধেক ঝুলন্ত হয়ে। হঠাৎ শুনলাম “এগ চাউমিন। ” চমকে উঠলাম।  আহাঃ ট্রেনে চাইমিন।  ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক মুখপোড়া হকার কি যেন একটা বিক্রি করছে আর বলছে,“এই তো আমি। এসে গেছি। চটপট কিনে নিন। ” ‘এই তো আমি’ কে শুনেছি এগ চাউমিন। হা হতোষ্মি।

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৬ই জানুয়ারী২০১৭ #3
কি ভুলভাল দিন মাইরি। সকাল থেকে ট্রেনের গণ্ডোগোল। সকালে বলল কালিনারায়ণপুরে মালগাড়ি উল্টেছে, তাই কল্যাণীর পর আর ট্রেন যাবে না। এ বেলা কোথায় কি উল্টেছে কে জানে?থিকথিক করছে ভিড়। গুতোগুতি করে তিনজনের সীটে চারজন বসেছি। পুরো নিমপাতা চিবানো মুখ করে বসে আছি।  এমন সময় চতুর্থ জন বলল,“ আর একটু চাপা যাবে না?আমরা কেউই তো তেমন মোটা নই। চারজনের আরামসে ধরে যাবে।” ঠিক শুনলাম কি? কেউই তেমন কি নেই? থাক আর বলতে হবে না।  যতদূর সম্ভব হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বসলাম।
চেপে চুপে বসে আছি, দেখি কে যেন মাথায় হাত বোলাচ্ছে তাকিয়ে দেখি জনৈক বৃহন্নলা! আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল,“সুন্দরী!এ্যাই সুন্দরী দুটো টাকা দে না”। সুন্দরী!!! নাঃ একটু আগেও পরিস্থিতি যতটা নারকীয় মনে হচ্ছিল এখন আর ততোটা লাগছে না। ভালোই তো বেশ। 😊😊😊😊😊

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৯ই জানুয়ারী ২০১৭ #4
যতবার ফোন করতে যাই, নতুন করে খুঁজতে হয়।  কনট্যাক্ট লিস্ট খোলো রে, খোঁজো রে, কোথায় আছে জয়িতা, কোথায় মৃণাল আর কোথায়ই বা সুতপা দি। অভ্যাসবশতঃ প্রতিবার ফেভারিট এর তালিকা  খুঁজি আর হতাশ হই।  সেখানে আলো করে বসে আছেন হক সাহেব, সনাতন স্যার আর অফিস। ধুত্তোর!! এ অফিস সে অফিস নয়।  এ আমার আগের অফিস, পুরাতন প্রেম। কিন্তু সে যে ঢাকা পড়ে গেছে নবপ্রেমজালে, আর যে মনে রাখতে পারলাম না। তাই হ্যাপিলি ম্যারেড এক্স গার্ল ফ্রেণ্ডের মত পাল্টে ফেললাম পুরানো ফেভারিটের তালিকা। হক সাহেবের স্থলে সুতপা দি এএলসি,সনাতন দার স্থলে মৃণাল আইএমডব্লু, অফিসের জায়গায় আরএলও চুঁচুড়া। নির্দয় ভাবে বদলে ফেললাম সবকিছু বিন্দুমাত্র  পিছুটান না রেখে। এই তো জীবন কালি দা!!!!

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ১৪ই জানুয়ারী ২০১৭ #5
মঙ্গলবার শ্রমিক মেলা, শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা তুঙ্গে। সবার ছুটি বাতিল, বড় সাহেব নিজে আসছেন  তদারকি  করতে। যুগলে একসাথেই বেরিয়েছি। শিয়ালদহ-বর্ধমান লোকাল, শম্বুকগতিতে সবে নৈহাটি। শৌভিক দিব্যি ঘুমোচ্ছে,চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারলাম না। মাথায় নানা পরিকল্পনা আর রিপোর্ট গজগজ করছে।  ট্রেন এখনও ছাড়েনি। হঠাৎ ঘোষণা হল, তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে শিয়ালদহ লালগোলা প্যাসেঞ্জার  আসছে। লালগোলা!!! আমার দিদার বাড়ি যাবার ট্রেন। হারিয়ে যাওয়া শৈশব যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভিড়াক্রান্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে।সেই কু-ঝিকঝিক কয়লার ইঞ্জিন, রাণাঘাটে দাঁড় করিয়ে ইঞ্জিন বদল, কৃষ্ণনগর পার হয়ে ধিকধিক করতে করতে দেবগ্রাম-পাগলাচণ্ডী স্টেশন পের হয়ে পলাশী। ঠিক দ্বিপ্রহরে গিয়ে পৌছতাম পলাশীতে।  অতঃপর রিক্সায় গঙ্গার ঘাট, নদী পেরিয়ে ওপারে আমাদের রামনগর।  দিদার বাড়ি, দোতলা, মাটির বাড়ি টালের চাল। বন্যাপ্রবণ এলাকা বলে, রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে হত বাড়ি গুলো। বাড়ির সামনে একটা বিশাল পিটুলী গাছ ছিল।  আর ছিল এক জোড়া নারকেল গাছ। ডাব পড়ে প্রায় দিদার চালের টালি ভাঙত। ছিল দিদার হাতে লাগানো জাম গাছ, সজনে ডাঁটা গাছ, লেবু গাছ,পেঁপে গাছ আর টগর ফুলের গাছ। বাড়ির সামনে একটা লাল বিশাল গরু বাঁধা থাকত। তার নাম ছিল “ববি”। তখন কোথায় মোবাইল, গোটা গ্রামে একটা ল্যাণ্ড ফোন পর্যন্ত ছিল না।  চিঠিথে জানাত মা, যে আমরা অমুক দিনে আসছি। আমরা যাচ্ছি জানতে পারলেই দিদা দিন গোণা শুরু করত।  যাবার দিন উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করত বারন্দায় দাঁড়িয়ে। ছোটখাট সাদা শাড়ি পড়া নিখাদ মিষ্টি একটা মানুষ, সীমাহীন ভালবাসার খনি। কোথায় যে হারিয়ে গেল-- কেন যে প্রিয়জনেরা হারিয়ে যায়-- ভাবতে বসলে শুধু একরাশ মনখারাপ আর কয়েক ফোঁটা চোখের জলই অবশিষ্ট  থাকে। চোখের জল ও এমন অবাধ্য, স্থান কাল পাত্র কিছুই মানে না----

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি, ১৬ই জানুয়ারি ২০১৭ #6
শনিবার, শেষ বিকাল পর্যন্ত শ্রমিক মেলার মিটিং এবং অন্তিম পর্যায়ের তদারকি করে, জয়েন্ট কমিশনার সাহেবকে খুশি খুশি মুডে গাড়িতে তুলে, বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরেছি। যথারীতি ট্রেনে খুব ভিড়, দুইজনার সিটে গোঁতাগুঁতি করে তিনজন বসেছি। সহযাত্রীগণ অত্যন্ত সহৃদয়, আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছেন শ্যামনগরে নেমে যাবেন, নেমে গেলেই জানলার ধারটি আমার। মাথায় মেলা সংক্রান্ত চিন্তা গজগজ করছে, তার সাথে যুক্ত হয়েছে মুঠো ফোনের অত্যাচার। হয় কেউ ফোন করে উপদেশ চাইছে, নয়তো কাউকে ফোন করে নির্দেশ দিতে হচ্ছে। এই ঝামেলায় খেয়াল করিনি, কখন এক বৃহন্নলা ও আমাদের কামরায় সওয়ার হয়েছে। খেয়াল করলাম, যখন তিনি এক সহযাত্রীকে প্রবল ধমক লাগালেন, “বললাম না, আমি একটাকা করে নি।”   বাপরে! এ কে রে? এক টাকা করে নেয়, বেশি দিলে বকে!!!!
সাগ্রহে লক্ষ্য করতে লাগলাম বৃহন্নলাকে। আমার উল্টো দিকে বসা এক গ্রাম্য মাঝ বয়সী মহিলা, কৌতুকের সুরে বললেন, “আমায় আশীর্বাদ করলে না তো? ওর মাথায় হাত দিলে-” । ব্যস আর যায় কোথায়, বৃহন্নলা চোখ পাকিয়ে, ধমকাতে লাগল, “ আমার আশীর্বাদ, আমি যাকে খুশি দেব। আমার মন থেকে যদি আসে, আমি তার মাথায় হাত দেব। না আসলে দেব না। বুঝেছিস। এসব জোর করে হয় না।” বাপরে!!! আবার চমকে উঠলাম।
এতক্ষণ আমার দিকে খেয়াল পড়েনি। এবার আমার সামনে হাত বাড়িয়ে বলল, “দে রে মেয়ে। একটাকা। আমি একটাকার বেশি নিই না।” ব্যাগ হাতড়ে একটা দুটাকার কয়েন উঠল, ভাবলাম, এবার আমার পালা ধমক খাবার। ও বাবা, কিছু বলল তো নাই, উল্টে এক হাতে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “এটা আমার নাতনী হয় গো।” খুব খানিক আদর করে, মাথায় হাত দিয়ে প্রচুর আশীর্বাদ করে (করো বাবা, ভাল করে করো। আমার মেলাটা যেন ভালো ভাবে উৎরে যায়) যখন চলে যাচ্ছে, অভ্যাসবশতঃ বললাম, “থ্যাঙ্কু”। বৃহন্নলা ঘুরে তাকিয়ে বলল, “মেনশন নট। থ্যাঙ্কু  ভেরি মাচ।” আবার চমকালাম। বৃহন্নলা না থেমে বলেই চলেছে, “ আমি ও পড়াশোনা করেছি গো। মহসিন কলেজে পড়তাম। ফার্স্ট ইয়ারে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে সেকেন্ড ক্লাশ। কত জজ বেরিষ্টার ম্যাজিস্টর, আমার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকত জানিস?” মাথা নাড়লাম। সত্যি জানি না। আমার অজ্ঞতায় খুশি হলেন।  “আমার নাম হল আশা মুখার্জী, কি?” “আশা মুখার্জী” উল্টো দিক থেকে অভিভূত স্বরে সেই ধমক খাওয়া সহযাত্রীনীটি বলে উঠলেন। “হ্যাঁ। আমার বয়স হল, সিক্সটি ফাইভ। কত?” তৃপ্ত স্বরে বলল বৃহন্নলা ওরফে আশা।  এবার আর  কাউকে জবাব দিতে হল না, উনি নিজেই নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, “ সিক্সটি ফাইভ।। ওই  যে সুন্দরপানা ছেলেটাকে দেখছিস, ওকে আমি ইয়ে অবস্থায় নাচিয়েছিলাম বুঝলি?” সুন্দরপনা কাউকে পেলাম না দেখতে, তবে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নব্য যুবক মুহূর্তে বেগুনী হয়ে গেল। আশা দেবী পেন্ডুলামের ছন্দে কোমর দুলিয়ে গিয়ে হাজির হল তার সামনে,“দে রে বাবা।একটা টাকা--- ”।
ছেলেটির থেকে আদায় করে পুনরায় এসে হাজির হল আমাদের দিকে, একটু আগে যাকে আশিস্ দিতে অস্বীকার করেছিল আবার তাকে  বলল,“দে রে মা।  একটা---”। বেচারা তুতলে বলল,“দিলুম যে?” “অ। দিলি বুঝি? ” বলে বিড়বিড় করে তার মাথায় হাত বুলিয়েই আমার সামনে হাত পাতল,“দে রে মেয়ে।  একটা--”।  এবার আমি চমকাতেও ভুলে গেলাম, পাশের বৃদ্ধ সহযাত্রী ফিসফিস  করে বলল,“বুঝছনি? নেশা করে আছে কি না। ” হায়রে, তাই যখন আমায় নাতনী বলে আলিঙ্গন করল, ঐ রকম একটা হাল্কা  মিষ্টি -মিষ্টি পচা-পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম---

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৭শে জানুয়ারী ২০১৭ #7

সম্ভবতঃ ২০১১সালের শেষ দিক, মাত্র কয়েক মাস হয়েছে কলকাতায় জয়েন করেছি, হক সাহেব আমাকে আর সঙ্গীতা (মুখার্জী) কে পাঠালেন গণেশ অ্যাভিনিউ বিএসএনএলের অফিস। দীর্ঘদিন ধরে চার্চ লেনের ফোন মৃত, বিল মেটানো সত্ত্বেও তাতে প্রাণ সঞ্চার হয়নি। অগত্যা দু-দুজন মহিলা অফিসারকে পাঠানো হল ঝগড়া করার জন্য। পৌছবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সংযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়ায় ঝগড়া আর করতে হয়নি অবশ্য। কিন্তু নেমে দেখি আমাদের ড্রাইভার কোথাও পার্কিং না পেয়ে আবার অফিসেই ফিরে গেছে।

ড্রাইভার সহ দুনিয়ার লোকের মুণ্ডুপাত করছিলাম দোহে,রাজপথের পার্শ্বে দাড়িয়ে, হঠাৎ দেখি পাশেই একজন লিট্টি বানাচ্ছে। জ্বলন্ত  কয়লার উনুনের ওপর গোটা চারেক বর্তুলাকার  লিট্টি পক্ক হচ্ছে, দেখেই জিভে জল এল। সঙ্গীতাও আপত্তি করল না। ইতিপূর্বে কখনও খাইনি কেউই। স্টিলের থালায় চারটে লিট্টি এবং খানিকটা ডাল বা চাটনি জাতীয় কিছু তরল ঢেলে দিল, যাতে তখনও গোটা দুয়েক রসুনের খোলা ভাসছিল। সহর্ষে  মুখে দিলাম, নিজের মুখ না দেখতে পেলেও সঙ্গীতার সেই করুণ মুখ আজো ভুলিনি। কোন মতে   দুবার চিবিয়ে ভয়ানক মুখব্যাদান করে বলল,“আমি মুখেরটা ফেলে দিলে তুমি কিছু মনে করবে?” ঐ অবস্থায় প্রবল হাসি পাচ্ছিল,ঘাড় নেড়ে দুজনে দৌড়লাম ডাস্ট বিনের দিকে। ওয়াক্ থুঃ।  কি জঘণ্য খেতে। কাঁচা আটার ডেলা, মাঝে একটু ছাতুর পুর। সাথে তীব্র রসুন গন্ধী ডাল নাকি চাটনী ভগবানই জানেন।
সেই থেকে সঙ্গীতার আর আমার কাছে লিট্টি ছিল এক বিভীষিকা। কারো ওপর রাগ হলে আমরা বলতাম তাকে আদর করে ধরে এনে জবরদস্তি লিট্টি খাওয়াব। কত লোককে যে আমরা কল্পনায় ঐ লিট্টি ভক্ষণ  করিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
আজ আবার লিট্টি খেলাম। এতদিন বাদে। কিছুতেই খাব না, কিন্তু সুতপা দি করুণভাবে বললেন,“ আমার কথা শুনে একটি বার খেয়ে দেখ। ” মহিলা এত ভাল না, ওণার সাথে আমার মায়ের এত স্বভাবজ মিল, যে ওণার সব কথাই আমি প্রথম চোটে বলি কিছুতেই শুনব না, কিন্তু পর মুহূর্তেই ওণার কথাটা শুনি। আজোও ওণার অনুরোধে গেলাম লিট্টি খেতে। নৈহাটি স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক বাঙালি (?) মহিলা লিট্টি বিক্রি করেন। ছোট ছোট রুটির মত দেখতে। সুতপাদি বললেন,“চাটনী একটু বেশি করে দেবেন।  কেমন?” মহিলা গরম রুটির মত লিট্টিটি নিয়ে ঘ্যাঁচ করে তার পেট ফাটিয়ে এক চামচ আলুর ছোঁকা আর দুই চামচ ধনে পাতার চাটনি ঢুসে শাল পাতায় করে আমার হাতে দিলেন। মুখে দিতেই এক ঝলক রসুনের গন্ধ পূর্ব স্মৃতি জাগাতে গিয়েও ব্যর্থ হল। কি অপরূপ স্বাদ। গরম, কুড়মুড়ে টকটক ঝালঝাল অমৃত। লিখতে লিখতেও জিভে জল আসছে। আহাঃ।
আমার আর সঙ্গীতার লিট্টি ভাল লাগেনি শুনে কে যেন নাক সিঁটকে বলেছিল,“ গরীব মানুষের খাবার তো। তোমাদের মত মেয়েদের ওসব ভাল লাগার কথাও নয়। ” কে যে বলেছিল মনে নেই, তবু মনে মনে তার একচোট মুণ্ডুপাত করে বললাম, “ আর একটা খাব- সুতপাদি। ” আহা নৈহাটির লিট্টি----

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #8

জেলায় কাজ করতে গেলে বেশ রগড় হয়। কিছুদিন আগে এক জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়নের নেতা এসেছিলেন ডেপুটেশনের ডেট চাইতে। তখন আমরা মেলা নিয়ে মারাত্মক ব্যস্ত। ডেপুটেশন কে নেবে? ওণাকে বলা হল একটু দাঁড়িয়ে যান। মেলা মিটলে আগে পাওনাদারদের বিদেয় করি তারপর নেওয়া যাবে আপনার ডেপুটেশন। সব মিলিয়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ডেট দেওয়া হল। ওনারা বলছিলেন ২০জনকে নিয়ে আমার উল্টো দিকে বসবেন, অতি ভদ্র ভাষায় বললাম ৪জনের বেশি ঢুকতে দেব না। ডেট নিয়ে ওনারা বিদায় হবার পর খেয়াল হল, হায় যাঃ ঐ দিন ভ্যালেন্টাইনস ডে । যাক গে ভালবাসার দিনই না হয় ডেপুটেশন খাওয়া যাবে।
চুঁচুড়া লেবার অফিসের বিরুদ্ধে ওনারা ইতিপূর্বেই ওপরমহলে অভিযোগ দায়েব করেছেন। মেলার মধ্যেই সেই চিঠির কপি ধরালেন  ডিএলসি সাহেব। চিঠিতে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। ভাবছিলাম ওনাকে ডেকে বলব লিখিত ভাবে জানান ঠিক কি ধরনের  সহযোগিতা, কবে থেকে পাচ্ছেন না। হঠাৎ  দেখি দরজা ফাঁক করে নেতামশাই  মাথা গলিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন,“ ম্যাডাম আসব। ” হাতে চাঁদ পেলাম। “আসুন। আসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম। আপনাকেই ডাকতাম, একটু লিখিত  ভাবে--”। কথা শেষ করতে পারলাম না। নেতামশাই একা আসেননি। পরপর চারজন ঢুকলেন। সবাই বয়স্ক নেতা টাইপ। অবাক হয়ে বললাম,“ডেপুটেশন তো ১৪তারিখে না?” উনি স্মিত হেসে বললেন,“না আজ ডেপুটেশন দিতে আসিনি। ম্যাডাম ঐ ডেটটা কি চেঞ্জ করা যাবে?আগে বা পরের যে কোন ডেট?” মনে মনে বললাম এমনি তে আমার নামে কমপ্লেন করছ আর এখন বলছ ডেট পিছোও? মুখে বললাম,“ কেন? কত ভাল দিন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। ভালবাসার আবহে ডেপুটেশন দেবেন, বেশ তো-”।  বাকি তিন বৃদ্ধ মুখে হাত চাপা দিয়ে খুকখুক্ করে হাসতে লাগলেন, আর নেতামশাই মাথার উপর দুই হাত তুলে অসহায় ভাবে বললেন,“ আর বলবেন না ম্যাডান। এই নিয়ে গোটা জেলা এমনকি পার্টির ওপরমহলেও হাসাহাসি হয়েছে। যে নতুন ম্যাডাম এয়েছেন,খুব সুন্দর দেখতে, আর--”। ভদ্রলোক ক্রমশঃ বেগুনী হয়ে যাচ্ছেন দেখে কোনমতে হাসি চেপে  ডাইরির পাতা ওল্টাতে লাগলাম। অন্য ডেট নিয়ে ওনারা বিদায় হতেই, ফোন তুলে ওসি ইলেকশন হুগলীকে বললাম,“দ্যাখ ___। তুইই খালি কদর দিলি না ভাই। ”
#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.in

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #9
জেলায় কাজ করার বেশ একটা রগড় আছে। রোজই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। আমার পূর্বসুরির জমানায় এএলসির চেম্বারের দরজা সব সময় খোলা থাকত। আক্ষরিক অর্থেই অবারিত দ্বার। যখন তখন যে সে ঢুকে পড়ে একগাদা প্রশ্ন এবং নালিশ নিয়ে। আমি এসেই আগে দরজা বন্ধ করেছি।  প্রশ্ন অবশ্যই করতে পারেন, কিন্তু সেই প্রশ্ন যার জবাব আমার পিওন, ক্লার্ক বা ইন্সপেক্টর দিতে পারবে না। অহেতুক একই প্রশ্ন পর্যায়ক্রমে সবাইকে করা চলবে না। এতে আপনারও সময় নষ্ট এবং আমাদেরও। একই কথা নালিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । অফিসে একে লোক নেই, আমার পিওন এবং বাচ্ছা ক্লার্ক দুটি নাস্তানাবুদ হয়ে যায় প্রশ্নের চাপে। ইন্সপেক্টরদের অবস্হা অকহতব্য।
অধিকাংশ প্রশ্নের ধরণ দেখে,  বললাম “কোন স্কিমে কি টাকা পাওয়া যাবে এবং পেতে গেলে কি কাগজ পত্র লাগবে,বাইরে সাঁটিয়ে দাও।যারা পড়তে পারেন তাদের বল দেখে নিন।” নির্দেশ মত সমস্ত নিয়মাবলী প্রিন্ট করে বাইরে টাঙানো হল, ও বাবা কে যেন পরদিনই সেটাকে ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। ফলতঃ যথা পূর্বম---
সেদিন আমাদের ইন্সপেক্টর পিয়ালীকে একজন বেপোট দাঁত খিঁছোচ্ছিল, কারণ কি? প্রচন্ড ব্যস্ততার দরুন পিয়ালী তাকে বলেছে একটু বাইরে দাঁড়ান। দশ মিনিট কেটে গেছে পিয়ালী তাকে ডাকেনি। এই হল অপরাধ। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি পিয়ালী ভয়ে সিঁটিয়ে আছে এবং মহিলা প্রবল বিক্রমে ঝগড়া করেই চলেছেন, “ আমাদের কি কাজকর্ম নাই?কতক্ষণ দাঁড়াব?” অবস্থা দেখে গলার স্বর তুলে বললাম, ”অফিসে একদম চ্যাঁচাবেন না। আপনার কাজ আছে, ওর নেই?” মহিলা বোধহয় আমার বিক্রম দেখে একটু দমে গিয়ে বলল, “খাচ্ছে তো।” “তো? খাওয়াটা কাজ নয়? বেলা দুটো বেজে গেছে, জন্ডিস রুগী না খেয়ে উল্টোলে কি আপনি আমার অফিস চালাবেন?” মহিলা থতমত খেয়ে চুপ করে যাওয়াতে, গলার স্বর নামিয়ে বললাম, “ আপনার সমস্যাটা কি?” আবার তেরিয়া হয়ে বলল,“ সাইকেল দিচ্ছেন না।  ঐ দিদি-” অঙ্গুলিনির্দেশ করল পিয়ালীর দিকে। পিয়ালী অপরিসীম অসহায়তার সঙ্গে হাত দুটো উল্টোলো। ব্যাপারটা হল আমাদের নির্মানকর্মী প্রকল্পে এককালে নাম নথিভুক্ত করাতে পারলেই ছয় মাস বাদে সাইকেল কেনার জন্য তিন হাজার টাকা পাওয়া যেত। মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিলেই হাতে গরম সাইকেল। পরবর্তী কালে তা নির্দেশানুসারে সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে।এতে বেচারা পিয়ালী ইন্সপেক্টরের কোন কালো হাত নেই।  আমি বেপোট হাসি চেপে বললাম, “ঐ দিদি কেন? কোন দাদা দিদিই আপাততঃ আপনাকে সাইকেল দিতে পারবে না। ” মহিলা দমে গিয়ে বললেন,“ কবে পাব?” এবার আমার হাত উল্টাবার পালা।
এর জবাব কি আমাদের মত তুচ্ছ এএলসি বা ইন্সপেক্টর দিতে পারে?অগত্যা জানালাম দেওয়া হলে জানতে পারবেন, ফোন নম্বর দিয়ে যান।
সে যাত্রা মিটল বটে, তবে দিন দুয়েক বাদে সবে  টিফিন বক্স খুলেছি, এক ব্যক্তি হুড়মুড় করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এলেন। একমুখ রুটি নিয়ে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে বললাম বাইরে যান, দশ মিনিট পর ডাকছি। সুতপা দি আর আমি একত্রে টিফিন করছিলাম, লোকটি বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। যতই বলি টিফিন করছি, কাজ তো আর বন্ধ হয় না, আমাদের সবেধন নীলমণি  পিওন ধীমানকে পাঁচ বার ডাকতে হচ্ছে না না নির্দেশাবলী দিতে হচ্ছে,চার বার ঢোকার পর পঞ্চম বার ধীমান যখন ঢুকতে যাবে, তাকে কনুই এর গুঁতো মেরে লোকটি ঢুকে এল, ধীমান শশব্যস্ত হয়ে বলল,“ আরে দাদা এখন নয়। একটু দাঁড়ান, ম্যাডামদের খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন। ” লোকটি উল্টে চিৎকার করতে লাগল,“আমি ঢুকবই। আপনি বারবার ঢুকছেন, আমি ঢুকলেই দোষ?”ধীমান তাও ঠান্ডা মাথায় বলল,“আমি তো স্টাফ । অফিসের লোক-”। “তো? আমিও অফিসের লোক। বাইরের লোক নাকি?” অবস্থা দেখে ধীমান ক্রমেই পিছু হটছে দেখে আমায়ই মঞ্চে নামতে হল, বাঁধা গৎ,  “অফিসে চ্যাঁচানো চলবে না। স্টাফের সাথে অভব্য ব্যবহার করলে আপনার কোন কথাই শুনব না। বাইরে দাঁড়ান। যান”। এক ধমকে কাজ হল।
মুখে যাই বলি, যথা সময়ে ডাকলাম ভদ্রলোককে,“কি ব্যাপার বলুন। ”“ক্লেম পাচ্ছি না, অনেক দিন হল। ইন্সপেক্টর সাহেব বদমাশী করে ফেলে রেখেছে”।  বুঝলাম সবই, ক্লান্ত স্বরে বললাম,“ কি ক্লেম?সাইকেল তো?” “হ্যাঁ।  আর যন্ত্রপাতি আজ্ঞে”।  যন্ত্রপাতি অর্থাৎ টুলস্ । নির্মানকর্মী অর্থাৎ রাজমিস্ত্রি যোগাড়ে এদের যন্ত্রপাতি কেনার জন্যও আগে টাকা দেওয়া হত। এখন অন্তর্বতী অর্ডারে বন্ধ আছে। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। আগে ঐ প্রকল্পে নাম লেখালেই ছয় মাস বাদে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যেত নানা খাতে। হঠাৎ  বন্ধ হয়ে যাওয়া তেই সমস্যা। বুঝিয়ে বললাম। লোকটি অবাক হয়ে বলল,“সবাই দিচ্ছে। কত সাইকেল বিলি হচ্ছে আর আপনারা দিবেন না কেন?ব্যাপারটা জানাতে হচ্ছে। ” মাথা নাড়লাম, যাকে পারিস জানা বাপ। মুখে যদিও বললাম,“অর্ডার না এলে-”। লোকটি বলল,“আচ্ছা দেখি। কেমন না দিয়ে থাকেন। দিদিকে জানাব। ”কোন দিদি? প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন। মুখে বললাম,“একদম। এটাই করুন। আপনার সাইকেল অবধারিত।”
গত বৃহস্পতিবার, শেষ বেলা, কাজ করছি, আসলে আমার তিনজন ইন্সপেক্টর হঠাৎ  প্রোমশন পেয়ে চলে গেছে, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও অবধি বিডিওদের জানাতেই পারিনি।কম্পুটার জানা ক্লার্ক (সিকেসিও) নিয়োগ নিয়ে দম ফেলার ফুরসত নেই। কর্মী সংখ্যা এত স্বল্প যে  প্রায় ২০০ জনের ইন্টারভিউ এর চিঠি রেডি করে ছাড়তেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠছে। তাও তো এডিএম ডেভালাপমেন্ট হুগলী আর ডিএলসি চন্দননগর সাধ্যাতীত সহযোগিতা করছেন। ওনাদের সহায়তা ছাড়া নির্ঘাত মারা পড়তাম।  যাই হোক এরই মধ্যে বিডিও দের চিঠি এবং ঐ শূন্যস্থানের চার্জ অন্য ব্লকের ইন্সপেক্টরের ঘাড়ে চাপানোর চিঠিটা কোন মতে টাইপ করিয়ে সই করার আগে শেষবারের  মত পড়ে নিচ্ছি, হঠাৎ দরজা ফাঁক করে একজন মুণ্ডু গলাল,“ ম্যাডাম  আসব?” পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে বললাম, পাঁচ মিনিট দাঁড়ান। ও বাবা লোকটি বলল,“পাঁআচ মিনিট? ঠিক আছে।  আমি তাহলে একটা কাজ করে আসি সেই ফাঁকে-”।  হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম, এ কোন জেলায় এলাম বাপ?
#Aninditas_Blog

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #10

উফ্ কতদিন বাদে আবার লিট্টি মাসিকে দেখলাম। সেই যে নৈহাটির লিট্টি মাসি? যার বানানো লিট্টি দেবভোগ্য। হপ্তা দুয়েক আগেই বুঝেছি যে আমি লিট্টি মাসির প্রেমে পড়েছি। সাড়ে পাঁচটা বাজলেই  প্রাণটা হাঁকডাক  করে, আহা কখন যাব, কখন তার দর্শন পাব, কখন বলব ‘মাসি চাটনি বেশি। ঝাল বেশি। ’উলস্।
এই প্রসঙ্গে বলি আমার জীবনের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি ব্যাপার জানাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে, তো মশাই অনুগ্রহ করে এই মুহূর্তে আমায় আপনার বন্ধুতালিকা থেকে দূর করে দিন। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। পারলে শৌভিককেও করে দিন। কারণ আমার জীবনে যাই ঘটুক তার সঙ্গে শৌভিক সবসময়ই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।স্বয়ং ঈশ্বরই যখন দুজনে একসাথে ট্যাগ করেছেন তো আমি কোন ছার। কাজেই ওকে আমি ট্যাগাবোই। আপনারও বিরক্তি উদ্রেক হবে। বিবমিষা জাগবে,অম্ল বদহজম পেটখারাপ খুজলি না জানি আরো কি সব বিভৎস রোগ হবে। তার থেকে ছেড়ে দাও বাবা, কাজ কি? আর একটা কথা মশাই, অ্যাকাউন্টটা যখন আমার তখন আমার দেওয়ালে কি লিখব বা কি সাঁটব সেটা তো আমিই ঠিক করব মশাই।

যাক গে। কথা হচ্ছিল আমার লিট্টি মাসিকে নিয়ে, দুসপ্তাহ ধরে তার দর্শন পাইনি। না না, লিট্টি মাসির কিছু হয়নি, আমি এবং সুতপা দি ফেরার পথে অন্যান্য খাবার ট্রাই করছিলাম। যেমন একদিন খেলাম কটকটে ঝাল আর তেমনি নোনতা ছোলা চেপ্টি। আর একদিন বেশটি করে লেবু নুন লঙ্কা মাখানো ভুট্টা।এছাড়া ঝালনুন ছড়ানো আলুর পাঁপড়, ছোলা মাখা, ডালমুট তো আছেই। মেন লাইনের মত সুস্বাদু ডালমুট আমি আর কোথাও খায়নি। যেমন কুড়মুড়ে,তেমন নুন আর ঝাল। আহাঃ।

আর যেদিন শৌভিকের সঙ্গে ফিরি সেদিন তো ওসব দিকে তাকানোও পাপ---।

কিন্তু আজ আমি একেবারে একা। সাধ্য কি ঐ দুর্বার আকর্ষণ অগ্রাহ্য করি? দীর্ঘ অদর্শনে তথা  অনাস্বাদিত হওয়ায় বোধহয় লিট্টির স্বাদ আরো বেড়ে গেছে।গিয়ে দাঁড়াতেই মাসি একটা গরম কুড়মুড়ে লি্ট্টি নিয়ে চামচের পিছন দিয়ে ঘ্যাঁচ করে দিলেন তার পেটটা ফাটিয়ে,তারপর একচামচ আলু আর দুই চামচ ধনে পাতার চাটনি ঠুসে যখন শালপাতা মুড়ে আমার হাতে দিল--- সারাদিনের খিটখিট, ক্লান্তি, গ্লানি, রক্তচাপ এক লহমায় ফুররর্। আহা আমার লিট্টি মাসি বেঁচে থাক--- সাধে কি বলি লিট্টি মাসির প্রেমে পড়েছি?

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭
দোহে ফিরছি। অফিস থেকে বের হতে বেশ দেরী হয়েছে, লঞ্চ থেকে নেমে আজ আর হাঁটার অবকাশ নেই। অন্যদিন হলে শৌভিক অবশ্যই আমাকে কান ধরে হাঁটাত, কিন্তু আজ আর সেই চেষ্টাও করল না। এই ট্রেনটা ফস্কে গেলে রাত নটাতেও বাড়ি ঢুকতে পারব না।
স্টেশনে পৌছে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।  ও তো রোজই থাকে, তাই বলে লিট্টি খাব না? বললাম সে কথা, এমন দৃষ্টি দিল যে আর একটু হলেই ভস্ম হয়ে যাচ্ছিলাম আর কি। হৃদয়বেদনা গোপন করে সুবোধ বালিকার মত বরের অনুগামী হলাম। মন্দ কপাল আমার, উঠে বসতেই ছেড়ে দিল। অন্য দিন ছাড়ে না কিন্তু। প্লাটফর্ম ছেড়ে যেতে যেতে উদাস ভাবে প্রত্যক্ষ করলাম যে ঐ বসে আছে আমার লিট্টি মাসি। জ্বলন্ত কয়লার উনুনে পরিপক্ব হচ্ছে জিভে জল আনা ছাতুর লিট্টি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জঠরানল। আমার শুকনো মুখ দেখে কি বুঝল কে জানে ব্যাগ থেকে বার করে দিল একটা ইয়া বড় আপেল। ইঃ লিট্টি ছেড়ে আপেল? কি করি বিরসবদনে তাই চিবোতে লাগলাম। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি ছোলা চেপ্টি উঠল কি?নুন-নুন ঝাল ঝাল ছোলা চেপ্টি? ধুৎ। কিচ্ছু ওঠে না। কি বাজে ট্রেন বাপ। মনের দুঃখে আপেল যখন শেষ করে এনেছি, হঠাৎ  দেখি, কে যেন চিৎকার  করছে, “এই তো লিট্টি খান। ছাতুর লিট্টি। পাঁচ টাকা প্যাকেট। বড় প্যাকেট দশ টাকা”--আর আমায় পায় কে? আয় বাবা এদিকে আয়-- আমার জন্যই তো উঠেছিস❤❤❤।  আড় চোখে তাকিয়ে দেখি হিটলারের জামাইটা ঢুলছে, আয়- আয় জলদি আয়, ঢুলুনি ভাঙার আগেই আয় সোনা--- এল বটে, কিন্তু লিট্টি নয় নিমকি। ছাতুর নিমকি। আমার ক্ষুধার্ত বিরহাতুর কান নিমকিকে লিট্টি শুনেছে।  সাধে কি বলি, ব্যাড লাকটাই ইয়ে-_-  লিট্টি মাসি গো মিস ইউ টু মাচ।😢😢

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #11
প্রথম যেদিন অর্ডার বেরোলো এবং জানা গেল আমার পরবর্তী  গন্তব্য চুঁচুড়া, তৎকালীন ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর বর্তমানে এএলসি জয়িতা আমায় প্রবল ভয় দেখালো,“ম্যাডাম, কোথায় যাচ্ছেন?ওখানে কোন লেডিজ টয়লেট নেই জানেন? যেখানে যেতে হয়, সেটায় টিনের দরজা। তাও  পুরো বন্ধ হয় না।  ছ ইঞ্চি ফাঁক থাকে। ”
খারাপ বাথরুম আর আমার কর্মজীবন অঙ্গাঙ্গি  ভাবে জড়িত। ও সব নিয়ে ভয় পেলে আর লেবার গিরি করা যায় না। কার্যক্ষেত্রে দেখলাম, বাথরুম একটা আছে বটে। বেশ পরিষ্কার, সকালে ফিনাইলের গন্ধ পাওয়া যায়। ফাঁক আছে বটে তবে ছ ইঞ্চি নয়, তিন আঙুল মাত্র। খড়্গপুরে আমি যে টয়লেট ব্যবহার করে সাড়ে চার বছর চালিয়েছি তার কাছে থো এটা রূপকথা। কিন্তু একটাই মুস্কিল, মাত্র দু ফুট বাই দু ফুট মাত্র।সর্বোপরি শুধুই ইউরিনাল। পেট কামড়ালে, আমি জানি না---_

দিন দুয়েক বাদে সত্যিই চুঁচুড়ার ইন্সপেক্টর মেসেজ করল,“ম্যাডাম আসতে পারছি না। কারণটা কাল সকাশে বলব। ”বলতে হল না বেশ বুঝলাম কারণটা।
শ্রী আশিস সরকার আমাদের নতুন ডিএলসি চার্জ নিয়েই আমার অফিস পরিদর্শনে এসেছেন, কথা প্রসঙ্গে বাথরুমের কথা উঠল, আমরা সাফ জানিয়ে দিলাম,“স্যার যেদিন যাকে ফোন করে অফিসে পাবেন না, বুঝবেন তার পেটের ইয়ে মানে ইয়ে হয়েছে”। আশিসদা হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে বললেন,“ আগে অফিস পাল্টাও। যেখানে ইয়ে নেই সেখানে কেউ অফিস করতে পারে?”

এতো গেল ইয়ের কথা, আরো আছে, দেখি টয়লেটে কোন লিটারবিন নেই। একিরে বাবা!!বললাম বাথরুমে একটা ডাস্টবিন দাও, তো গ্রুপ ডি গিয়ে একটা প্লাস্টিকের চিটচিটে নোংরা ঝাঁঝরি বালতি নিয়ে এল, কোন ইন্সপেক্টরের টেবলের তলা থেকে। যাঃ বাবা, সে এবার কাগজ, চায়ের কাপ ফেলবে কোথায়? অন্য আরেকজনের পায়ের কাছে রাখা চিটচিটে বালতিতে?বেরোও। দূর হও। যত পাগল কি আমার কপালেই জোটে ভগবান??

অর্ডার দিয়ে ঢাকা ওলা লিটারবিন আনালাম। অফিসে ঢুকে দেখি আমার পূরানো ডাস্টবিনের পাশে সুন্দর করে সেটিকে সাজিয়ে রেখেছে আমাদের নিতাই বাবু। নিতাইবাবু আমাদের সুইপার কাম ওয়াটার কেরিয়ার। কোন অনুমোদন নেই যদিও। কিভাবে যে পয়সাদি তা আমরাই জানি।

যাই হোক আবার এক প্রস্ত চিল্লাচিল্লি করে সেটাকে টয়লেটে রাখার ব্যবস্থা করলাম।গত সপ্তাহে একদিন বাথরুমে গেছি, দেখি কলে জল নেই। হাঁক পাড়লাম,“নিতাই বাবু জল নেই কেন?” নিতাই বাবু ঘাবড়ে গিয়ে বলল,“ ম্যাডাম ছটার পর তো জল থাকে না।”ছটার পর জল থাকে না? ছটার পর কেউ ইয়ে করে না এখানে?এ আমায় কোথায় পাঠাল😈😈!!!নিতাই বাবু আরো এক প্রস্ত হাত কচলে বললেন,“ম্যাডাম বালতিতে জল আছে তো!”বালতি?গোটা অফিস খুঁজেও কোন বালতি পেলাম না।

আজ বালতির রহস্য উন্মোচিত হল। দুফুট বাই দুফুট বাথরুমে টাল সামলাতে না পেরে ঢাকা দেওয়া ডাস্টবিনের লিভারে পা পড়ে গিয়েছিল, মুখ হাঁ হতে দেখি টলটল করছে এক বালতি জল।
সন্ধ্যাবেলা নিতাই বাবু অফিস বন্ধ করতে এসেছেন, আমি আর সুতপাদি তখন ব্যাগ বাগিচা নিয়ে বেরোচ্ছি, খপ করে ধরলাম,“ নিতাই বাবু আপনি ডাস্টবিনে জল ভরে রেখেছেন?”
“ওটা ডাস্টবিন নাকি ম্যাডাম? আমি ভাবলাম ছটার পর জল থাকে না বলে আপনি বাথরুমে একটা বালতি রেখেছেন। ”সুতপা দি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি চাপতে গিয়ে বেপোট হেঁচকি তুলতে লাগল।
হে ভগবান, এ আমি কোথায় এলাম। বলতে গেলাম, “বাথরুমে ডাস্টবিন শুনে কেন আকাশ থেকে পড়ছেন মশাই, বিয়ে থা করেছেন তো নাকি?” বলতে পারলাম না, বৃদ্ধ আমায় বড় ভালোবাসেন, প্রায় বলেন,“আমার ম্যাডাম আছে  আমার কোন চিন্তা নেই”। এ হেন ‘মা-ডামে’র মুখে এই কথা শুনলে না বৃদ্ধের হার্ট অ্যাটাক হয়। শুধু বললাম,“ওটা ডাস্টবিনই। বালতি নয়। বুঝলেন”।

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি #১২, ১৪ই মার্চ ২০১৭
একাই যাচ্ছি। শৌভিক আগের ট্রেনে চলে গেছে। ব্যাগ ঢুঁড়েও এক টুকরো রদ্দি কাগজ পেলাম না, অগত্যা হাতেই টুকছি, গিয়েই কি কি করতে হবে। কয়েকজনকে এখুনি ফোন করতে পারলে ভাল হয়,  কিন্তু --- এই সব সাতপাঁচ ভাবছি, হঠাৎ  চমকে উঠলাম, এক সৌম্য দর্শন হকার কি যেন বিক্রি করছেন, এতক্ষণ খেয়াল করিনি। পার্শ্ববর্তীনী বললেন,“একটু ফ্রি স্যাম্পল দাও তো। ”
লোকটি তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বললেন,“ফ্রি স্যাম্পল? ফ্রি দেবার সময়ই নেই। এ লাইনে এই জিনিস শুধু আমার কাছেই পাবেন। ” চমকে উঠলাম। বাপরেঃ এ লাইনে একথা প্রথম শুনছি যে। কি বিক্রি হচ্ছে? কান করে শুনলাম ভদ্রলোক চিৎকার করছেন,“এই তো আমি এসে গেছি। সঙ্গে নিয়ে,‘মাঞ্চুরিয়ান দিলবাহার আমলা। খাস জয়পুরের মাল। প্যাকেট খুলে শুধু মুখে দেবেন--আর দেখবেন।। পেট ছেড়ে  গ্যাস  পালাতে পথ পাবে না। গ্যাসের যম।  “
বাপরেঃ ।  আমি নেমে যাব----
#অনির_চুঁচুড়ার_ডাইরি
https://amianindita.blogspot.in

Friday 6 January 2017

শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব) 1-3

শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব) ৩০.১২.১৬
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে, যেদিন অর্ডারটা বেড়িয়েছিল, আজো মনে আছে, পরপর দুটো এসএমএস পেয়েছিলাম। একটা পাঠিয়েছিলেন ডিএলসি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দীপক দা আর একটা আমার সদ্য প্রাক্তন ডিএলসি শৈবাল দা। বক্তব্য একই, শুধু একটা শব্দ, “কলকাতা”। সময়টা অগস্ট ২০১১, আমি তখন এএলসি খড়গপুর। চার অক্ষরের একটা শব্দ যে এত আনন্দবাহী হতে পারে আগে জানতাম না। ট্রান্সফার অর্ডার বেরনোর পর থেকে শুধু দিন গোনার পালা, কবে মুভমেন্ট অর্ডার বেরোবে, কবে যাব কলকাতায়? সাড়ে চার বছর পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটাবার পর মহানগরে প্রবেশের অধিকার পাওয়া গেছে, তাও একা নয়, আমি এবং সুকন্যা দুজনেই কলকাতায় যাচ্ছি, এত আনন্দ রাখি কোথায়? সেই ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দুজনের গাঁটছড়া বাঁধা।
খড়গপুর থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে আমার তৎকালীন এবং প্রাক্তন ডিএলসি তীর্থ দা এবং শৈবাল দা দুজনে একই সঙ্গে সাবধান করে দিলেন, কলকাতা খুব সাংঘাতিক জায়গা। মেপে পা ফেলতে হয়, বুঝে কথা বলতে হয়। দশটা পনেরো বেজে গেলেই লাল দাগ আর তিনটে লাল দাগ পড়ে গেলেই একটা সিএল ঘ্যাঁচ। পৌনে ছটার আগে অফিস ছাড়া যাবে না। আজো মনে আছে শৈবাল দা বলেছিলেন, “দেখ বাপু তুমি একটু হাবলা আছ। বুঝে শুনে চলো।”
কলকাতায় তখন “সু” অর্থাৎ সুকন্যা এবং আমার গুরু হচ্ছেন সুমিতা দি। সু আর আমার কলকাতা পোস্টিং হওয়াতে সুমিতা দি প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন। সুমিতা দি ফোন করে জানালেন, “তোমরা যেন ভুলেও ট্রান্সিট লিভ নিও না। চটজলদি নিউ সেক্রেটারিয়েটে এসে আগে একটা ভাল ঘর জোগাড় কর। দেরী করলে কিন্তু সব ভাল ফাঁকা ঘর গুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে।” সুমিতাদির কথা তখন বেদবাক্য। রিলিজ নেবার পরদিনই সকাল পৌনে দশটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং। ফাঁকা লিফটে চড়ে হুশ করে উঠে গেলাম এগারো তলা। লিফট থেকে নেমে ভয় পেয়ে গেলাম, ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। অধিকাংশ ঘর এবং হলঘরের দরজাই খোলেনিলেবার কমিশনারের ঘরের দরজা অবশ্য খোলা এবং আলো ও জ্বলছে। তখন লেবার কমিশনার ছিলেন শ্রী অমল রায়চৌধুরী। উনি দশটার মধ্যেই এসে যেতেন। কি করি? সেকশনে ঢুঁ মারলাম। মাত্র দুজন সবে এসে ব্যাগ রেখে চা খেতে যাচ্ছেন। ওনাদের থেকে জানতে পারলাম, দশটা পনেরো নয়, সাড়ে দশটার পর খাতা লেবার কমিশনারের ঘরে ঢোকে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক কাল থেকে একটু বেশীক্ষণ ঘুমানো যাবে।
দশটা পনেরোর পর আসতে আসতে সবাই আসতে লাগলেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সুকন্যার জন্য। সুদীর্ঘকাল মেদিনীপুরবাসের পর, নিউ সেক্রেটারিয়েটের সুসজ্জিতা সুন্দরীদের পাশে নিজেকে কি হতকুচ্ছিতই যে লাগছিল তা বলার নয়। গতকাল রাত্রেই এই নিয়ে সুকন্যাতে আর আমাতে একপ্রস্ত বিলাপ করেছি। মেদিনীপুরে আমাদের সাজগোজের কোন বালাই ছিল না, রঙ জ্বলা জামা পরে দিনের পর দিন অফিস করে গেলেও কিছু বলার ছিল না। মূলত অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে কাজ, তাদের সামনে সেজে গুজে পটের বিবি সেজে বসলে না তারা স্বচ্ছন্দ্য বোধ করত, না আমরা। আর সবার ওপর আমরা ছিলাম হদ্দ কুঁড়ে। আবার সাজতে হবে? ভাল জামা কাপড় কিনতে হবে? কেন? বিয়েতে যা পেয়েছি আর পুজো – ভাইফোঁটায় যা আমদানি হয় তাতে তো দিব্যি চলে যায়, এই ছিল আমাদের মানসিকতা। কিন্তু কলকাতায় রঙ জ্বলা জামা? কলকাতায় কারা আছে? প্রথমতঃ সুমিতা দি, যাকে সচেতন ভাবেই আমরা আইডলাইজ করতাম। তার ওপর মনীষা দি, শর্মিলা দি, রুমা দি, যার শাড়ির সম্ভার রীতিমত ঈর্ষণীয়। আর সেকশনে যে অগুন্তি সুন্দর সুন্দর মহিলা আছেন তাদের কথা তো বলেই কাজ নেই। সুদূর পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে যখন আসতাম কোন কাজ নিয়ে, রীতিমত হাঁ করে দেখতাম তাঁদের রূপ এবং বেশভূষা। এত সুবেশা সুন্দরীদের মাঝে রীতিমত অসহায় বোধ করছিলাম সুকন্যাকে ছাড়া। সুকন্যাকে তখন ডাক্তার বাসে চড়তে নিষেধ করেছিলেন, বেচারা সোয়া দশটার মধ্যেই অতি কষ্টে ট্যাক্সি জোগাড় করে ছুটতে ছুটতে এল। একটু পরেই এসে হাজির হল শর্মিষ্ঠা, একই অর্ডারে ও এসেছে শ্রীরামপুর থেকে কলকাতা। ভালোই হল, দল ভারি হল।
অতঃপর? খাতায় নাম তোলা। আর সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ।তখন শ্রী সুবল বিশ্বাস সাহেব অ্যাডিশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ওনার সাথে দেখা করে একে একে রসুল সাহেব, দীপক দা, মনীষা দি, শর্মিলা ম্যাডাম, সুমিতা দির সাথে দেখা করলাম আমরা। সুমিতা দি সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। অনেক প্ল্যান পরিকল্পনা হল একসাথে খেতে যাওয়া, শপিং এর। আমাদের অবশ্য শপিং এই উৎসাহ বেশী ছিল, কারণ দুজনেই যে যার মায়ের শাড়ি ধার করে পড়েছিলাম। পরবর্তী পদক্ষেপ ঘর দখল করা। কোন ঘর দখল করি? সব ঘরেই তো অফিসার রয়েছে, এবং তাঁরা রীতিমত কাজ করছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই এগারো তলা গমগম করছে নানা ট্রেড ইউনিয়ন, ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়ার্কারদের তর্কবিতর্কে। অবশেষে, কোনের একটা সরু ঘর ফাঁকা পেলাম, সেখানেই গিয়ে বসলাম তিনজনে। একটা ঘরে তিনজন অফিসার!! কে নেবে ঘরটা? এ যেন কালনেমির লঙ্কাভাগ।
একফাকে নীচে নেমে মুগল গার্ডেনের এগ রোল খেয়েএলাম তিনজনে।  মুগল গার্ডেনের এগ রোল ছিল তখন আমাদের কাছে এক দেবভোগ্য বস্তু। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখলাম, এত বড় রোল গলদ্ধকরণ মোটেই সহজ কার্য না। টিফিন করে ওপরে এসে তিনজনে গল্প করছি, এমন সময় লেবার কমিশনার সাহেবের জরুরী তলব। তিনজনে একসাথে ওনার ঘরে ঢুকে দেখি, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে গম্ভীর মুখে বসে আছেন, লেবার কমিশনার, আর তাঁকে ঘিরে ততোধিক গম্ভীর মুখে বসে আছেন আমাদের বড় সাহেবেরা, বিশ্বাস সাহেব, রসুল সাহেব, নাসিম সাহেব এবং আমানুল হক সাহেব। বুঝলাম পরীক্ষা সমাসন্ন।
শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব-২) ০১.০১.১৭
বর্তমান লেবার কমিশনার জাভেদ আখতার সাহেব বসেন, ওনার চেম্বারে ঢোকার দরজার ঠিক উল্টো দিকে। যে কেউ দরজা ফাঁক করে উঁকি মারলেই ওনার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে বাধ্য। কিন্তু ওনার পূর্বসূরি রায়চৌধুরী সাহবে বসতেন দরজার বাঁ দিকে দরজার দিকে পিছন করে, ফলে আমরা যখন ওনার চেম্বারে ঢুকলাম, উনি রীতিমত ৯০ ডিগ্রি ঘাড় ঘুড়িয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। ইশারায় বসতে বললেন, আমরা ভয়ে ভয়ে যে যার স্থান দখল করলাম। বসা মাত্রই বিশ্বাস সাহেব অর্থাৎ শ্রী সুবল বিশ্বাস আমাদের পুনঃ পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুকন্যার ভূয়সী প্রশংসা করলেন সকলে এমনকি খোদ লেবার কমিশনার পর্যন্ত (অন্তত ওনার মাথা নাড়ানো এবং অন্যান্য শারীরিক বিভঙ্গে তাই বোধ হয়েছিল)। এবং এই প্রতিটি তারিফের যোগ্য হকদার ছিল সুকন্যা ভট্টাচার্য২০০৮ থেকে ২০১১ অবধি একা ঝাড়গ্রাম আরএলও (Regional Labour Office) চালিয়েছে, যখন ঝাড়গ্রাম শব্দটা শুনলেই অনেকের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যেত। ঝাড়গ্রাম তখনও প্রায় মুক্তাঞ্চল। আর শর্মিষ্ঠা ঘোষের পরিচয় দেওয়া হল গ্রাচুইটি স্পেশালিষ্ট হিসেবে। একা হাতে শ্রীরামপুরের বহু বন্ধ জুটমিল ওয়ার্কারদের ন্যায্য প্রাপ্য গ্রাচুইটির অর্ডার বেরিয়েছে শর্মিষ্ঠার হাত দিয়ে। লেবার কমিশনার শ্রী অমল রায়চৌধুরী (যিনি বর্তমানে পে-কমিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য) প্রীত স্বরে জানতে চাইলেন, “তোমাদের কার কি ভালো লাগে, স্কীম? না কনসিলিয়েশন?” আমার আর সুকন্যার জবাব ছিল “স্কীম” অর্থাৎ অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কীম গুলি শ্রম কমিশনারেট চালায়, যথা- ভবিষ্যনিধি প্রকল্প (সাসফাউ), নির্মাণকর্মী দের জন্য প্রকল্প (বোকয়া) এবং পরিবহন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। স্কীমের কাজ করতে সত্যি ভাল লাগে, কেন জানি না মনে হয়, প্রত্যক্ষ ভাবে কারো উপকারে আসলাম। অন্যদিকে কনসিলিয়েশন আমার কোনদিন ও ভাল লাগে না। এ যেন বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসির ভূমিকা পালন। সত্যি কথা বলতে কি, কনসিলিয়েশন বস্তুটা আমার দ্বারা হয়ও না। মালিক-শ্রমিক বিবাদে আমি বরাবরই শ্রমিকের পক্ষে,তাদের দুঃখে বিগলিত হয়ে যাই। কনসিলিয়েশন অফিসার খোদ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে সেই বিবাদের মীমাংসা কি আদৌ হতে পারে? যাইহোক রায়চৌধুরী সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “তা বললে তো হবে না, কনসিলিয়েশন ও করতে হবে।”
লেবার কমিশনারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শর্মিষ্ঠাকে অবশ্য কি কারণে যেন আবার ডেকে পাঠানো হয়েছিল, কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “বাপরে, তোমরা চলে আসার পরও সবাই তোমাদেরই প্রশংসা করছিল” আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রশংসা করছিলেন খোদ রসুল সাহেব, ডিজিটাইজেশন নিয়ে খুব প্রশংসা করছিলেন।” তখন সদ্য সাসফাউ প্রকল্পটির অনলাইন রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়েছিল, এবং খড়গপুরে কাজটা বেশ ভালই দ্রুততার সাথে চলছিল।
যাইহোক লেবার কমিশনার যে কেন, ঐ প্রশ্নটি করেছিলেন, তা বুঝলাম দিন কয়েক পর, যখন আমাদের জব অ্যাসাইনমেন্টের অর্ডার ধরানো হল। সুকন্যাকে বোকয়া এবং আমাকে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে দেওয়া হল। শর্মিষ্ঠার পোস্টিং হল কলকাতা সেন্ট্রালে কনসিলিয়েশন অফিসার হিসাবে। মাঝের কটা দিন যে কি আনন্দে কেটেছে তা বলার নয়, আমাদের ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছিল যে কলকাতায় কোন কাজ নেই। শুধু প্রজাপতির মত ভেসে বেড়ানো। সুমিতা দি ফ্রি থাকলেই ডেকে নিতেন, আড্ডা গল্প মজা আর কেনাকাটার গল্প করে ফিরে আসতাম নিজেদের ঘরে। মাঝে হঠাৎ একদিন সুমিতা দি বললেন, “আমি কটা দিনের জন্য ছুটি নেব, আমার একটা অপারেশন আছে। ফিরে এসে দেখা হবে।” সুমিতা দি ফিরে আসার আগেই অর্ডার বেরিয়ে আমাকে ঐ বাড়ি পাঠানো হল। ঐ বাড়ি অর্থাৎ ৬ নং চার্চ লেন। নিউ সেক্রেটেরিয়েট ছেড়ে যাকেই চার্চ লেন পাঠানো হয়, তারই বোধহয় প্রথম চোটে কান্না পায়। আমারও পেল, চার্চ লেন? ইশ, কি জঘন্য বাড়িটা। যদিও ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ি, কিন্তু আদৌ কোন সারাইসুরাই হয় না। মালিকদের কি সব কোর্ট কেস চলছে তার জন্য। সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ দিয়ে জল পড়ে, সবথেকে বড় কথা আমার পরবর্তী গন্তব্য হল ঐ বাড়ির পাঁচ তলা, প্রতিটি তলা উঠতে ২৮টি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। দুটি লিফটের একটি এখনও জীবিত, তবে তা মাসের মধ্যে ১৫টি কর্ম দিবসেই মৃতপ্রায় হয়ে থাকেন।লিফট চলে সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত (যেন সবাই পৌনে পাঁচটার মধ্যেই কেটে পড়ে), মাঝে ১-২ টো বন্ধ থাকে। চার্চ লেনের ভাম আর ইঁদুরের উৎপাত তো প্রসিদ্ধ। আর সবথেকে বড় ভয়ের কারণ হলেন আমার হবু বস, ট্রান্সপোর্ট বোর্ডের সিইও মহম্মদ আমানুল হক সাহেব। প্রথমেই আমাকে সবাই সাবধান করে দিল, হক সাহেব কিন্তু ভীষণ স্ট্রিক্ট। ওখানে সত্যি দশটা কুড়িতে লাল দাগ দেবার রেওয়াজ আছে, এবং হক সাহেবের অফিসাররা কেউ ছটার আগে ছাড়া পায় না। উনি নিজেও সন্ধ্যা সাতটা অবধি অফিস করেন। আরো সাংঘাতিক কথা শুনলাম, ও বাড়িতে নাকি ডিসেম্বর মাসে কোন সিএল নেওয়া যায় না, কারণ জানুয়ারি মাসটা আমরা পালন করি সামাজিক সুরক্ষা মাস (Social Security Month) হিসাবে। আরো যে কত কি শুনলাম, আজ আর মনে নেই, তবে মোদ্দা কথায় স্বয়ং হিটলারের অধীনে কাজ করতে যাচ্ছি সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। প্রচন্ড দুঃখ হচ্ছিল সুকন্যাকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু কি করতে পারি? মনখারাপ করে সকলের থেকে বিদায় নিলাম, বিশ্বাস সাহেবের ঘরে বিদায় নিতে গেছি, উনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, “কে বলেছিল তোমাকে বলতে যে স্কীম ভালো লাগে?” বুঝলাম স্বখাত সলিলে ডুবেছি। না বলতাম স্কীম ভালো লাগে, না আমাকে পাঠানো হত --- কিন্তু কি আর করা যাবে, তীর ধনুক ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে। কাল দশটায় চার্চ লেন।
শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব- ৩) ০৪/০১/১৭
মহম্মদ আমানুল হক, বিগত পাঁচ বছর চার মাস যাবত আমার বস ছিলেন, এবং একথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে পারি, আমার বিগত দশ বছরের এএলসি গিরিতে আমি এত ভালো বস কখনও পাইনি। আজো মনে আছে, প্রথম যেদিন চার্চ লেনে গিয়ে জয়েন করলাম, তার কিছুদিন আগেই ওনার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। স্যারের ঘরে ঢুকে দেখি উনি উদাস স্বরে দুজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে এই নিয়েই কথা বলছেন। আমাকে দেখে, সানন্দে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাকি দুজনের সাথে-দুজনেই অত্যন্ত বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, প্রথমজন শ্রী সত্য ঘোষ আর দ্বিতীয়জন হলেন শ্রী নজরুল ইসলাম। সত্য বাবু ছিলেন বিশাল বপু( আড়ে এবং বহরে প্রায় সমান), বাজখাই গলা এবং চোখে কালো চশমা। প্রমোটি এএলসি তথা এগ্রি-মিনি অ্যাসোসিয়েশনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা।সত্য বাবুর সাথে আমার মাঝে মাঝেই ঝামেলা লেগে যেত। কেন যাবে না মশাই? আমাকে এবং সঙ্গীতা মুখার্জ্জীকে (চার্চ লেনের সুন্দরীতম এএলসি) দেখলেই ওনার মনে পড়ে যেত, ডাইরেক্ট অফিসার মাত্রই হোঁৎকা, আইনকানুন জানেও না আর তার ধার ও ধারে না। কোন ডাইরেক্ট এএলসি কে ওনার সংগঠন কোথায় কি ভাবে বংশদণ্ড প্রদান করেছে বা করতে চলেছে একথা আমাদের শোনাতে এলে আমরাই বা কেন ছেড়ে কথা বলব? ফলে লেগে যেত তুলকালাম। আমি আর সঙ্গীতা চিল চিৎকার জুড়তাম, আর সত্য বাবু ফ্লোর কাঁপিয়ে হাসতেন। কিছুদিনের মধ্যেই খেয়াল করলাম, যে উনি আমাদের রাগিয়ে নেহাত মজা পান।

ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে যখন জয়েন করলাম, হক সাহেব, আমি, সত্য বাবু আর নজরুল ইসলাম ছাড়া বোর্ডে আর কেউ ছিল না। কেউ না। না কোন ইনস্পেক্টর, না ক্লার্ক না গ্রুপ ডি। না ছিল কোন কম্পুটর, ফ্যাক্স, ফোন, ব্রডব্যান্ড বা ফটোকপিয়ার মেশিন। হক সাহেব তখন জয়েন্ট কমিশনার, ওনার চেম্বারের বাইরে দুটো ছোট চেম্বার ছিল, যার একটাতে বসত সঙ্গীতা, আর একটিতে বসতেন নজরুল ইসলাম। স্যার নজরুল সাহেবকে বললেন, “আপনার চেম্বারটা আপনি অনিন্দিতাকে ছেড়ে দিন। ওকে অনেক কাজ করতে হবে।” সদ্য আলাপিত হবার পরই ওনাকে আমার জন্য চেম্বার চ্যুত হতে হল, আমি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে বললাম, “না। না। ছি ছি। উনি আমার সিনিয়র। আমি ওনার চেম্বার কি করে দখল করতে পারি?” কিন্তু তাতে না স্যার পাত্তা দিলেন না নজরুল সাহেব। নজরুল ইসলাম অত্যন্ত খুশি খুশি ওনার চেম্বারটা আমাকে ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে তো দিলেন, কিন্তু সে কি চেম্বার? একখানা ঘুণ ধরা সেমি সেক্রেটারিইয়েট টেবিল, যার ওপরে একটা পুঁচকে কাঁচ পাতা আছে। টেবিলের এক দিকের ভেলভেট ছিঁড়ে খানিকটা উঠে এসেছে। ড্রয়ার খুলতেই এক গাদা আরশোলার ডিম আর নোংরা কাগজ। ভয়ে ড্রয়ারটাই বন্ধ করে দিলাম। এতো গেল টেবিল, আর চেয়ার বলতে বিবর্ণ একখানা রাজকীয় কেদারা। যাতে আমার মত ছোট্ট খাট্টো লোক বসলে মাটিতে পা ঠেকে না। ঘরে আর কিছু নেই। না আলমারি, না পেন স্ট্যান্ড, না পেন বা কাগজ। বেল পর্যন্ত নেই। মন খারাপ করে বসে রইলাম, কিছুক্ষণ, টিফিনের সময় হল, গুটগুট করে রওনা দিলাম নিউ সেক্রেটারিয়েটের দিকে। সুকন্যার সাথে এক সাথে টিফিন করে বেশ খানিক ঘ্যানঘ্যান করে ফিরে এলাম। স্যারকে দেখাও দিয়ে এলাম, টেবিলে এক বোতল জল ও দেয়নি কেউ। সদ্য জেলা থেকে এসেছি, সেখানে আর যাই হোক এসব নিয়ে ভাবতে হয় না। স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমায় কে জল দেবে? স্যার ব্যস্ততার মধ্যে একজনকে পাঠিয়ে দিলেন। একে নিউ সেক্রেটারিয়েটে আগে দেখেছি, আমার বরাবর ধারণা ছিল এ মহিলা, আজ দেখলাম না পুরুষ না হলেও ছেলে তো বটেই। এসেই তার বক্তব্য ছিল সে স্ট্যাটের পিওন, ট্রান্সপোর্টের এএলসিকে কেন জল দেবে? বাবা বাছা করে বললাম, জল দে বাপ। কাল তোতে আমাতে গিয়ে লেবার কমিশনারকে এই প্রশ্নটাই করব আপাতত জল দিয়ে প্রাণ বাঁচা। জল দিল। সেপ্টেম্বর মাসের প্রচন্ড গরম, এক লিটার জল কোথা দিয়ে নেমে গেল বুঝলাম না, আর একবার দিতে বললাম, “বলল, ম্যাডাম, কাল থেকে একটা বড় বোতল আনবেন। তাহলে আর বারবার জল দিতে হবে না।” বুঝলাম সত্যি আমার মহানগরে প্রবেশ হয়েছে। জল দেওয়া নিয়ে নিত্য খিচিরমিচির চলতেই লাগল, ও দেবে না, আর আমিও ছাড়ব না। সেকশনে দাঁড় করিয়ে ঝাড়তাম, তখন জল দিয়ে যেত। যেদিন কিছু বলতাম না, সেদিন নির্জলা। এভাবে অন্যদের দমানো গেলেও অনিন্দিতা চ্যাটার্জীকে (এখন ভট্টাচার্য) দমানো যায় না। তারপর থেকে ঠিক করলাম অফিসে এসে আমার প্রথম কাজই হবে ওকে ডেকে আগাপাস্তলা ঝাড়া। কিছুটা সাইজ হল, একদিন এসে বলে, “ম্যাডাম ১০০টা টাকা দিন তো।খুব দরকার।” বেশ দিলাম। নিয়ে সেই যে বেরিয়ে গেল আর তার পাত্তা নেই দিন দুয়েক। দুদিনের পর অঞ্জন দা (শ্রীমান অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন এএলসি স্ট্যাটিস্টিক্স) দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হলেন, আমার ঘরে, “তুমি অমুক চন্দ্রকে টাকা দিয়েছ?” ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। কি করলাম রে বাবা? ১০০টাকা দিয়ে কি আরডিএক্স কিনল নাকি? অঞ্জন দা রাগত স্বরে বলল, “আরে কেন দিয়েছ? ঐ টাকা নিয়ে ও ইয়ে তে যায়।” “কি’য়ে তে?” “ইয়ে মানে খারাপ পাড়ায় যায়।” অঞ্জন দা মুখ লাল করে বললেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না হাসব না কাঁদব। ভগবান! কোথায় এলাম? লোকে আমার টাকায় ইয়েতে যায় আর আমি বসে বসে আরশোলার ডিম গুনি? এঃ 

Sunday 1 January 2017

বীরভূম ডাইরি

বীরভূম ডাইরি ১০/১২/১৬
বীরভূমের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বেশ গভীর। না আমরা কেউই বীরভূমের বাসিন্দা নই, তবে আমার বড় জেঠু শ্বশুর এককালে সিউড়িতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আমার শ্বশুরমশাই এরও প্রবেশন এবং  ব্লক বীরভূমেই। বাবা মহম্মদবাজারের বিডিও ছিলেন, তারপর সিউড়িতেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বীরভূমে ওনারা প্রায় এগারো বছর ছিলেন, বীরভূম জেলা স্কুল থেকেই শৌভিকের ছাত্রজীবন শুরু। আমার দেওরের জন্মও বীরভূমেই। আবার শৌভিক যখন এই চাকরিতে যোগ দিল, ওরও প্রথম পোস্টিং হল সিউড়িসবথেকে মজার কথা হল, আমার দেওর যখন জানালো যে সে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তখন জানা গেল যে তার হবু স্ত্রী বীরভূমেরই ভুমিকন্যা।
যাইহোক টুকলু অর্থাৎ আমার পুঁচকে দেওরের বিবাহের পর ঊমা মানে আমার দেবরানীদের গ্রামে নববিবাহিত দম্পতির জন্য এক বিশাল ভোজের (কলকাতার ভাষায় রিশেপশন) আয়োজন করা হয়, তাতে নিমন্ত্রিত হিসাবেই আমাদের বীরভূম যাওয়া। সেই সময়ে প্রস্তাবটা দেন আমার শ্বশুরমশাই, “তোরা যখন বীরভূম যাচ্ছিসই তখন ছুটি নিয়ে ভালো করে ঘুরে আয়।” কথায় বলে না, ‘একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ’, শুনেই আমরা নাচতে লাগলাম। সিউড়িতে শৌভিকের ব্যাচমেট আছেন, শ্রী বিল্বদল রায়, ডিএনও এনরেগা (১০০ দিনের কাজ)। উনি প্রায়ই বলেন, “শুধু দিনক্ষণটা ঠিক করে আমায় পাঁচ দিন আগে জানাস, বাকি কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।” আমরাও ভাবলাম, এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়। ইতিপূর্বে বহু বন্ধু বান্ধব আমাদের এভাবে ডাকাডাকি করেছে বা বলা ভালো আজো করেই চলেছে যেমন- মেদিনীপুর থেকে সুকন্যা, মালদা থেকে দেবু, বনগাঁ থেকে অঞ্জন দা, পুরুলিয়া থেকে দেবময়দা তথা অতীতে বাঁকুড়া এবং বর্তমানে এগরা থেকে চিত্রদীপদা। কিন্তু আমরা এতটাই অপদার্থ যে কোন সুযোগেরই আমরা সদ্ব্যবহার করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এবারে আমরা কোমর বেঁধে নামলাম, নাঃ এবার আর এ সুযোগ হারাচ্ছি না।
যাব, মনস্থির করে দুরুদুরু বুকে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করেই, প্রথম ফোনটা করলাম, শ্রী শান্তনু সেনকে। শান্তনুদা বর্তমানে বর্ধমান সাউথের এএলসি। আমরা যুগলে শান্তনুদার বিশেষ স্নেহধন্য। শান্তনুদা বহুবার বলেছেন, “যদি কখনও বীরভূমে যাও, ট্যুর প্ল্যানিংটা আমাকে দিয়ে করিও।” প্রায় একসপ্তাহের জন্য যাব, যথাযথ প্ল্যানিং ছাড়া করবটা কি? শান্তনুদা অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রায় একুশ মিনিট ধরে প্ল্যান বাতলে দিলেন। সেই প্ল্যান প্লাস গুগলের ভরসায় সোমবার ৫.১২.১৬ ভোর বেলা আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।
প্রথম গন্তব্য ঊমাদের গ্রাম একূট। লাভপুরের কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রাম। আমরা এবং নবদম্পতি ছাড়াও, ননদ, পিসি-পিসেমশাই, খুড়শ্বশুর, খুড়শাশুড়িরা ছিলেন। মণি কাকা অর্থাৎ শ্রীঅরুণকান্তি ভট্টাচার্য ছিলেন বরকর্তা তথা আমাদের অভিভাবক। গোটা রাস্তা যে কি আনন্দ এবং হইহই করে কাটল তা ভাষায় অবর্ণনীয়। মাঝপথে শক্তিগড়ের কচুরি আর গুড়ের রসগোল্লা, আহা! ভাবলেই জিভে জল আসে। একূটে পৌছতে লাগল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। বহু বছর বাদে এরকম নিখাদ গ্রামে গেলাম গ্রামবাংলার রূপে মন ভরে গেল। মানুষজন এতো সাদাসিধা, শহুরে পালিশবিহীন, যে দুটি কথায় মন জয় করে নেয়। বিশেষত তুত্তুরীর তো আনন্দের সীমা ছিল না। জীবনে প্রথম মাটির বাড়ি, খড়ের গাদা, মোষের গাড়ি দেখল। মণি ঠাম্মার সাথে ছাগলছানার গায়ে হাত বোলানো, ছোট দাদুর সাথে খেয়ে উঠে পুকুরে হাত ধোয়া, মাছ ধরা দেখা আমার কন্যা তো একেবারে পুলকিত হয়ে গেল। ঊমাদের পরিবারের নিয়ম হল, কন্যা যখন শ্বশুরালয়ে যাবে সাথে মাছ, মিষ্টি এবং দই পাঠাতে হয়। ঊমার শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে বলেই বিশাল একটি কাতলা মাছকে বড় করা হচ্ছিল এতদিন ধরে। আজ তাকে জল থেকে তোলা হল। মাছের সাইজ দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম, এত বড় মাছ খাবে কে? আর কাটবেই বা কে? শেষে নিয়মরক্ষার স্বার্থে মাছটি ওনারা কেটেই দিলেন। সেই মাছ কাটা দেখে তুত্তুরীর আনন্দের আর সীমাপরিসীমা ছিল না। মুড়োর সাইজই এক কেজির বেশি হবে, এবং কাটার পর অন্তত আধঘণ্টা মুড়োটি শ্বাস নিচ্ছিল এই গল্প আমার কন্যা আজো করে চলেছে।
সন্ধ্যাবেলা সকলকে কাঁদিয়ে ঊমা চলল শ্বশুরবাড়ি। ঊমার বৃদ্ধা দিদিমা, অশ্রুসজল চক্ষে নিখাদ সরলতার সাথে করজোড়ে বললেন, “একটু দেখ বাবা। সেই দেড়দিন বয়স থেকে আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি।” এত বছর আমরা স্বাধীন, আজোও মেয়ের বাড়ির লোককেই এই সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে হয়। নবদম্পতিসহ শ্বশুর-শাশুড়িদের বাসে তুলে দিয়ে আমরা উঠে বসলাম ডিএনো সাহেবের পাঠানো গাড়িতে, তখন সন্ধ্যা নামছে। পরবর্তী গন্তব্য বোলপুর।

বীরভূম ডাইরি ১০/১২/১৬ (পর্ব ২)
৫ তারিখ রাতটা বোলপুরে কাটিয়ে, ৬ তারিখ সকালে পুরি-সব্জি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে ১০টার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। শান্তনুদা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, “গাইড নিয়ে ঘুরো।” শান্তিনিকেতন আমি ইতিপূর্বে একবারই গেছি, শৌভিক বোধহয় এগারো বছরে পঞ্চাশ বার গেছে, তবু আমরা শান্তনুদার কথার অবাধ্য হতে সাহস পেলাম না। শান্তনুদা বলেছিলেন, গাইড নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা লাগবে, আর মিউজিয়াম দেখতে আরো ঘণ্টা দেড় দুই। গাড়ি তৈরি ছিল, কালকের গাড়িটাই, ড্রাইভারের নাম গণেশ, সিউড়ির বাসিন্দা।
গাড়ি শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক বট গাছের কাছে গিয়ে থামতেই জনা দুই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ওনারাই গাইড। পাঁচশ টাকার বিনিময়ে গোটা শান্তিনিকেতন ভালো ভাবে ঘুড়িয়ে দেবেন। দরদস্তুর করে সাড়ে তিনশত টাকায় রফা হল। বেশ বুঝতে পারলাম, মঙ্গলবার বলেই সাড়ে তিনশ’য় রাজি হলেন। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ভ্রমণপিপাসু ত্রিসীমানায় নেই কিনা। গাইড বললেন, “বেলা একটা অবধি গাছের তলায় ক্লাশ চলে, তখন বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। চলুন আমরা গাড়ি করে অন্যান্য অঞ্চল গুলি ঘুরে আসি।” প্রথম দ্রষ্টব্য ‘প্রতীচী’ অমর্ত্য সেনের বাড়ি। বাইরের দরজা খোলাই ছিল। সারাইসুরাই এর কাজ চলছে। গাইড বললেন, “অমর্ত্য সেন এলে এখনও এখানেই থাকেন। বছরে এক থেকে দুই বার অবশ্যই আসেন এবং এলে সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ান। এখানে কাছেই “কালো”র চায়ের দোকানে ওনার ঠেক। কালো মারা গেছে, তবু উনি ওখানে যান এবং আড্ডা মারেন।” আমরা যুগলে সসম্ভ্রমে দেখছিলাম সবকিছু, তুত্তুরী শুধু বলল, “এই লোকটা এত বকছে কেন?”
শৌভিক কিছু ছবি তুলল, ও যেখানেই যায়, সবকিছুর ছবি তুলে আনে। ওর বাবা এবং মাকে দেখানোর জন্য। শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য বাবা-মা দীর্ঘ দিন কোথাও যেতে পারেন না, আমাদের তুলে আনা ছবিতেই ওনাদের ভ্রমণের স্বাদ মেটে। কিচ্ছু বাদ দেয় না শৌভিক। গাইড বোধহয় ভেবেছিলেন এরা শহুরে দম্পতি সাথে ছোট্ট বাচ্ছা কতটুকু আর দেখবে, তাই কিঞ্চিৎ করুণা ভরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখবেন নাকি?” আমাদের মাথা এসব ক্ষেত্রে কেবল একদিকেই হেলে। যেতে গিয়ে দেখা গেল, পথটা গাইড মশাইয়েরও ভালো জানা নেই। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম আনন্দধারায়। এককালে কণিকা বন্দোপাধ্যায় থাকতেন, এখন গোরা সর্বাধিকারি থাকেন। ফাঁকা নিঝুম লাল মাটির রাস্তার পাশে, ঘুমিয়ে পড়া এক অট্টালিকা। সত্যি এখানে একদিন ধ্বনিত হত, “নিরালায় তোর বনেরও মাঝে, সেথা কি এমন নূপুর বাজে? এমন মধুর গান” ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। অদূরেই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের তালাবন্ধ কুঠি।
পরের গন্তব্য ইস্টার্ন যোনাল কালচারাল সেন্টার। ডিএনও সাহেব পূর্বেই বলেছিলেন, ওটা যেন অবশ্যই দেখা হয়। বিশাল এলাকা সমান ভাগে ভাগ করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, আন্দামান আর নিকোবরের মাঝে। প্রতিটি খন্ডে আবার এক বা একাধিক মাটির কুটির রয়েছে, স্থানীয় আদিবাসী গৃহের ধাঁচে।জুতো খুলে ঢুকতে হয়। প্রতিটা কুটির ভর্তি রয়েছে, স্থানীয় হস্তশিল্প, আদিবাসী পোশাক, গয়না এবং যন্ত্রপাতিতে। ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের মাটির কুঁড়েঘর গুলি অপূর্ব চিত্রাঙ্কিত। তুত্তুরীর আনন্দ দেখে কে? জীবনে প্রথম টোকা, বেতের ঝুড়ি, কুনকে, আদিবাসী তীরধনুক, ছিপ তথা মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম, তাঁতযন্ত্র দেখল। সপ্তাহের শুরুতে বলে কি না জানি না, আমরা ছাড়া আর কোন দর্শকই ছিল না প্রায়। দূরে বিশাল ঝিল, তাতে লম্বা লম্বা গাছের ছায়া পড়েছে, তারই কিনারে বসে এক আনমনা বাউল আপন মনে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। শুনে মনে হল, এখানেই আসনপিঁড়ি পেতে বসে যাই, আর কোথাও যাবার প্রয়োজন কি?
এরপর কোপাই। ফাঁকা ধু ধু কোপাই এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে        , শ্মশানের পাশ দিয়ে। অদূরেই আমার কুটির। গাইড সাহেব বললেন, এই কোপাই দেখেই নাকি রবি ঠাকুর “আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে” লিখেছিলেন। সত্যি মিথ্যা জানি না। উনি আরও শোনালেন, যে সারা বছর নাকি কোপাই নদীতে জল থাকে। তীব্র দাবদাহে যখন বীরভূমের সব নদনদী খালবিল শুকিয়ে যায়, তখনও নাকি কোপাই বইতেই থাকে। বিহারে নাকি এই নদীই “শোন” নামে পরিচিত। যদিও গুগল এই ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করতে পারল না। বরং দেখলাম কোপাই আসলে ময়ূরাক্ষীর এক উপনদী মাত্র। শীতের মিঠে রোদে আঁকাবাকা  কোপাই অপরূপা, আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু সেই মুগ্ধতা আক্ষরিক অর্থে চটকে দিল দালের মেহেন্দি। কর্ণপটহ বিদারক স্বরে, “বোল তারা রা রা” গেয়ে উঠে। মাত্র জনা দুই নব্য যুবক, একটি বক্স আর চার বোতল মদ, কোপাই এর সৌন্দর্যে অ্যাসিড ক্ষত সৃষ্টির জন্য এই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের জাতের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত, “চার বোতল ভদকা”।
[চলবে]    
বীরভূম ডাইরি ১১.১২.২০১৬ (পর্ব-৩)
অতঃপর খোয়াই। খোয়াই মূলতঃ প্রসিদ্ধ শনিবারের হাটের জন্য। যাবার সময়ও আমি মৃদু ঘ্যানঘ্যান করছিলাম, আজ আর খোয়াই গিয়ে কি হবে? শনিবার অবধি তো আমরা এখানে থাকছি না। কিন্তু পৌঁছে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। খোয়াইয়ের আসল রূপ দেখতে হলে শনিবার ছাড়া অন্য যে কোন দিন যাওয়াই ভাল। ধুধু করছে ফাঁকা খোয়াই আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। এখানেও একজন উদাস বাউল আপন মনে গান গেয়ে চলেছে, ইজেডসিসির বাউলের মত অতটা সুরেলা গলা নয় যদিও তবু শুনলে মন ভরে যায়। গাইড বললেন,” যান ঘুরে আসুন, তবে বাচ্ছা সামলে, ধারে না যায়।” বরষার জল ভূমিক্ষয় করে যে এরকম অপরূপ সুন্দর দৃশ্যপট সৃষ্টি করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তার সাথে অপরূপ নিস্তব্ধতা রীতিমত মনকাড়া। সূর্য ইতিমধ্যে মধ্য গগনে, তীব্র গায়ে জ্বালা ধরানো রোদ, তার ওপর তুত্তুরীর কেবল ধারে যাবার প্রবণতা, মুগ্ধতা কাটিয়ে দেবার জন্য অবশ্য এগুলিই যথেষ্ট। গভীর খাদ, নীচে পড়লে, কোন রাস্তা দিয়ে যে তুলে আনব জানি না। তুত্তুরীকে যদিও বা ধমকধামক দিয়ে সামলানো যায়, শৌভিককে সামলাবে কে? ছবি তোলার এমন নেশা, যে রীতিমত আতঙ্কিত বোধ করছিলাম, যে ছবি তুলতে গিয়ে খাদে না নেমে পড়ে।
এরপরের গন্তব্য, বিশ্বভারতী। সেই শদুয়েক বছরের পুরাতন বট গাছ থেকে শুরু করে, পর্যায়ক্রমে দেহলী, নতুনবাড়ি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি, শান্তিনিকেতন কুঠি, সুরুল কুঠি, মহুয়া কুঠি,পূর্ব তোরণ, পশ্চিম তোরণ, ছাতিমতলা, কালো বাড়ি। শান্তিনিকেতন তো শুধু চর্ম চক্ষে দেখার নয়, বরং অনুভবের বস্তু। আমরা যুগলে মন্ত্র মুগ্ধের মত দেখছিলাম এবং শুনছিলাম, কত বছর হয়ে গেল তিনি নেই, অথচ কি ভীষণ ভাবে বিরাজমান। কায়াহীন দাড়িবুড়োর উপস্থিতি অনুভব করে বুঁদ হয়ে ছিলাম আমরা। তিনি নেই, অথচ তার সেই আসনটি যেখানে বসে একদা তিনি ক্লাস নিতেন আজো রয়েছে, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। শৌভিকের অনুমতি নিয়ে ওনার আসনের উল্টোদিকে বসলাম, যেখানে ছাত্ররা বসে। উনি শিক্ষক আমি ছাত্রী কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হলাম, আমার কন্যাকেও বললাম, “বাবু বসো। দেখ ঐ আসনে এককালে রবি ঠাকুর বসতেন।” তুত্তুরী কান্না চেপে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “ আমি আর যাব না। শান্তিনিকেতন বিচ্ছিরি জায়গা। আমি আর হাঁটতে পারছি না। আর ঐ লোকটা এত বকছেই বা কেন?” বেচারা, সেই সকাল থেকে ঘুরছে, এবং এরকম এক লাল মেঠো পথে বাবা মা কেন যে উন্মত্তের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে, তা অনুধাবনের বয়স সত্যি ওর হয়নি। তার ওপর একটু আগে আম্রকুঞ্জে একটি টিয়া পাখি দেখতে পেয়েছিল, যেই তাকে ধরতে গেছে সে ওমনি ফুর করে উড়ে গেছে। তার পিছন পিছন ধাওয়া করার প্রবল বাসনাও চরিতার্থ হয়নি আমাদের উৎপাতে। কাজেই মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।
ফোঁপানি ক্রমেই কান্নায় রূপ নিচ্ছিল, এদিকে ঘড়ির কাঁটাও দেড়টার ঘর ছাড়িয়েছে, ফলে ভগ্ন হৃদয়ে আমরা বিশ্বভারতীকে বিদায় জানাতে উদ্যত হলাম। তবে কলের বাঁশি না দেখে কি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করা যায়? রামকিঙ্কর বেজের একাধিক অমর সৃষ্টি বিশ্বভারতী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। যার কিছু আপাতত সংস্কারের জন্য পর্দাবৃত, যেমন গৌতম বুদ্ধ এবং সুজাতা।  মহাত্মা গান্ধী,কলের বাঁশি আর সাঁওতাল পরিবার  এখনও সংস্কার হয়নি, তবে কেন জানি না দেখে মনে হল আশু সংস্কার জরুরী। সাত বছর পর দেখলাম কেমন যেন বিবর্ণ, ভঙ্গুর লাগল সবকিছু। মহাত্মা গান্ধীর পদতলের করোটির গায়ে যেন শ্যাওলা পড়েছে মনে হল। ২০০৯ এ যিনি আমাদের গাইড ছিলেন, উনি বলেছিলেন, মহাত্মা জী কোপাই নদীর তীরে পরিভ্রমণে গিয়ে না দেখে কোন করোটির ওপর পা দিয়ে ফেলেছিলেন, কাছেই শ্মশান কি না। কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল শুনে। এবারের গাইড বললেন, “নোয়াখালীর দাঙ্গার পর, মহাত্মা জী যখন সেখানে যান, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ পড়েছিল। এখানে নোয়াখালীর সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার স্মৃতিকেই স্মরণ করা হয়েছে।” কে জানে? কোনটা সত্যি, কোনটা নয়। তবে দেশের জনকের চরণতলে নরকরোটি দেখলে কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে।
বিশ্বভারতী ত্যাগ করার পর দ্বিপ্রাহরিক আহারের পালা। বিগতবার শান্তিনিকেতন ভ্রমণকালে এই মধ্যাহ্ন ভোজ নিয়ে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার আমরা টুরিস্ট লজেই ছিলাম, টুরিস্ট লজের খাবার যেমন বিস্বাদ, তেমনি দুর্মূল্য। ভ্রমণের অন্তিম দিনে আমরা ঠিক করেছিলাম আজ আর টুরিস্ট লজে খাব না, বাইরে কোথাও খাব। সেই মোতাবেক একটি ভালো হোটেল দেখে সেখানেই মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয়। রান্না এমন কিছু আহামরি ছিল না বটে, তবে আমার বন্ধু সঞ্চিতা তার ভাতের মধ্যে একটি মাছের আঁশ খুঁজে পায়। তার পর সব খাবারেই আমাদের ভয়ানক আঁশটে গন্ধ লাগতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাড়ি ফেরার পথে, গোটা রাস্তা সঞ্চিতার গা গুলাতে থাকে, আর আমার বাবা তো রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বমি করতে বাধ্য হয়। ফলে বোলপুরে খাওয়া নিয়ে আমি বেশ আতঙ্কিত ছিলাম। শৌভিক যদিও বারবার আশ্বস্ত করছিল, “ ওরে ২০০৮ এর পঞ্চায়েত ইলেকশনে আমার বোলপুরে ব্লক অ্যাটাচমেন্ট ছিল। বেশ কিছুদিন ছিলাম। এত খারাপ ও নয়।” তারওপর ডিএনও সাহেব ও ফোন করে বলেদিয়েছিলেন, বোলপুর সার্কিট হাউসের কাছেই একটি ভালো রেস্তোরাঁ আছে, নাম “ঘরে বাইরে” ওখানেই ভোজনপর্ব সারতে। মন্দ নয় রেস্তরাঁটা। বাটিকের পাঞ্জাবি পরা ওয়েটর এসে অর্ডার নিয়ে গেল, সিরামিকের থালা, বাটি, ভাঁড়ের মত দেখতে গ্লাসে জল। খাবারও যথাযথ, বরং পূর্বের অভিজ্ঞতার তুলনায় অভাবনীয়। ড্রাইভার গণেশ বাবুও বললেন, “সরকারী প্রোগ্রাম হলে এখানেই খাওয়া দাওয়া হয় ম্যাডাম।”
লাঞ্চের পর কি করব? এটা আমাদের প্ল্যানে ছিল না। সন্ধ্যার মধ্যে সিউড়ি ফিরতে হবে, সিউড়ি সার্কিট হাউসে রাত্রিবাস। ঘড়িতে সবে তিনটে বাজছে। কি করা যায়? শৌভিক বলল, “কেদুলি যাবি? গণেশ কেদুলি যেতে কতক্ষণ লাগবে?” গণেশ মাথা চুলকে বলল, “স্যার যেতেই পারেন, কিন্তু এখন তো মেলার সময় নয়। জয়দেব পদ্মাবতীর একটা মন্দির ছাড়া ওখানে কিছুই দেখার নেই।” শৌভিক হাল ছেড়ে বলল, “তাহলে তুমিই বল। কোথায় যাওয়া যায়?” “আমখই যাবেন স্যার?” আমখই কি? কোথাও তো শুনিনি এর নাম। গণেশ বলল, “ওখানে কি যেন পাওয়া গেছে স্যার। ডিএম এডিএম সাহেব মাঝে বেশ কয়েক বার গেছেন। ইলামবাজারের জঙ্গলের মধ্যে একটা আদিবাসী গ্রাম।” জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী গ্রাম? আহাঃ। আর কি চাই? “চল” আমরা একসাথেই বলে উঠলাম প্রায়।
বীরভূম ডাইরি ১২.১২.২০১৬ (পর্ব-৪)
আমখই যাবার পথটা ভীষণ সুন্দর। গহীন শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা, খুব চওড়া নয়, যদিও তবু আমাদের গাড়ি বেশ অনায়াসেই  পাকা রাস্তা থেকে ঐ পথে নেমে পড়ল। চারপাশ নিঝুম, অপরাহ্ণের হলুদ সূর্যের আলোয় রহস্যময় প্রকৃতি। বেশ খানিকটা শুনশান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার পর আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আচ্ছা, এই জঙ্গলে কোন জানোয়ার নেই?” শৌভিক হাসি চেপে বলল, “ জানোয়ার মানে? বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার নেই। বেঁজি শেয়াল এই সব থাকতে পারে।” গণেশ বাবু ও ইতস্তত করে বললেন, “আদিবাসী গ্রাম কাছেই, এখানে কোন বড় জন্তু নেই ম্যাডাম।”  সত্যি একটু পরেই দেখলাম, একজন সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন আমাদের পাশ কাটিয়ে।
মিনিট পাঁচ সাত পরে গাড়ি গিয়ে থামল, একটা ফাঁকা জায়গায়। নেমে বেশ হতাশ হলাম, কিছুই তো নেই। কোন ভাঙা মন্দির টন্দির বা মাটি খুঁড়ে পাওয়া কোন মূর্তি, বাসনকোসন বা কোন কিছু। কারণ গোটা পথ শৌভিক গণেশ বাবুকে আমখই নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছে, আর প্রতিবারই গণেশ বাবু টাক চুলকে বলেছেন, মাটির তলা থেকে কি সব নাকি পাওয়া গেছে। পশ্চিমমেদিনীপুরের মোগলমারির মত কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাব আশা করেছিলাম। সে গুড়ে বালি। জায়গাটা খুব সুন্দর, শান্ত, বড় বড় বট, অশ্বত্থ আর কাঁটাল গাছ দিয়ে ঘেরা (ঐ কটি গাছই চিনি কি না)। কাছেই একটা সদ্য খনন করা পুকুর, যার জল এখনও ঘোলা। কয়েকটা ছাগল চরছে দেখে আমার মেয়ের তো আর আনন্দ ধরে না। কি যে কাকিমাদের গ্রাম থেকে ছাগল প্রীতি নিয়ে ফিরেছে। জনা পাঁচেক লোক কাজ করছে, কালো ছোট নুড়ি দিয়ে মার্কা করা আছে, এঁকে বেঁকে রাস্তা তৈরি হবে। বেশ কয়েকটা সিমেন্টের বাঁধানো বেদীর ওপর গাছের গুড়ির টুকরো রাখা আছে। গণেশ বাবু ইশারায় দেখালেন, “স্যার ঐ খানে লিখা আছে।” সত্যি দুটি বড় বড় বোর্ডে বাংলা এবং ইংলিশে লেখা আছে। বাংলাটাই পড়লাম, পড়ে যা বুঝলাম, এখান থেকে পাললিক জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, যার আনুমানিক বয়স দেড় কোটি বছর। দেড় কোটি বছর আগেকার গাছের গুঁড়ি বন্যার জলে ভেসে এসেছিল তৎকালীন রাজমহল পাহাড় থেকে, এবং দীর্ঘদিন মাটির নীচে থেকে তা ফসিলে পরিণত হয়েছে। যার টেকনিক্যাল নাম হল, “পেট্রিফায়েড উড”।
মোটা মাথায় ভালো ঢুকল না, ভাবলাম, যেমন পাথরে জীবাশ্ম পাওয়া যায়, তেমনি হয়তো কাঠে পাওয়া গেছে। যতদূর পারা যায়, মনোযোগের সাথে দেখার চেষ্টা করলাম, কোথাও আরকেওপ্টেরিক্স মার্কা কিছু আছে কি না। নিদেন পক্ষে মাছি, মশা কিছুতো থাকবে। কিছুই খুঁজে পেলাম না, শুধু মাকড়সার জাল ছাড়া, যার বয়স দেড় দিন হতে পারে, কোটি টটি নয়। খুঁজতে গেলে মনঃসংযোগ করতে হবে, আর মন বসাব কি করে? আমার কন্যা ততোক্ষণে ছাগল ছেড়ে, প্রায় ওর সাইজের এক বিশাল মোটকা মুরগীর পিছে ছুটতে লেগেছে। মুর্গীটা প্রবল চিৎকার করে দৌড়চ্ছে, পিছে পিছে আমার মেয়েও। আমি ধরতে না ধরতেই দুবার আছাড় খেল। শখ করে শান্তিনিকেতন ঘুরব বলে শাড়ি পড়েছিলাম, তাও সাদা। মেয়েকে সামলাতে গিয়ে দুজনেই লালচে হয়ে গেলাম।
মেয়েকে ধমকাতে ধমকাতে তকিয়ে দেখি শৌভিক গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছে। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু পেলি? জীবাশ্ম টিবাশ্ম?” শৌভিক অবাক হয়ে বলল, “হু। এগুলোই তো! ফসিলাইজড উড। দেখতে কাঠ, কিন্তু আসলে পাথর।” এতক্ষণে জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হল। সত্যি তো । হাত দিয়ে দেখলাম, সব কাঠের টুকরো গুলি আসলে পাথর। কি অপরূপ দেখতে।
আমখই থেকে পরিতৃপ্ত হয়ে যখন আমরা আবার পাকা রাস্তায় উঠলাম, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে, রোদের রঙ কমলা মেশানো সোনালী। গণেশের প্রস্তাবমত পরবর্তী গন্তব্য হেতুমপুরের রাজবাড়ি। আমরা এটা কাল যাব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু গণেশ বাবু বললেন, আজই সেরে ফেলা যাবে। আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির কে যেন হেতুমপুরের মহারাণী ছিলেন। ছোটবেলায় এই কথাটা শুনলেই আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন খুব হাসতাম। হেতুমপুর? হেতুমপুরের মহারাণী J J Jবড় হয়ে যখন জানতে পারলাম, সত্যি এরকম এক রাজা এবং তাঁর রাজত্ব ছিল, তখন নিজেদের নির্বুদ্ধিতা তথা বালখিল্যপনায় অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলাম। সন্দীপ রায়, তাঁর ফেলুদা সিরিজের “ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা” এখানেই স্যুট করেছিলেন।  টিভিতে হেতুমপুরের রাজবাড়ী দেখে সম্পূর্ণ মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গণেশ বাবুর ভাবভঙ্গীতে মনে হল, খুব একটা দর্শনার্থীদের ভিড় হয় না। অত পোক্ত ড্রাইভারও জানেন না, রাজবাড়ি কোনটা। জোড়া হাতিখচিত একটা তোরণদ্বারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, “স্যার এটাই রাজবাড়ির গেট।” ভালো কথা। রাজ বাড়ি কই? গেটের ভিতর অনেকগুলি হলুদ রঙের একতলা দুতলা বাড়ি। এককালে রাজবাড়ির অংশ হলেও এখন ওখানে স্কুল বসে। আরও খানিকটা এগিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে একটা বড় বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালেন, এখন ঐটি কলেজ। এককালে রাজবাড়ির অংশ ছিল হয়তো, কিন্তু এটা কিছুতেই রাজবাড়ি নয়। আমার চোখে ভাসছে ঘুরঘটিয়ার ঘটনা। এটা সে বাড়ি নয়। শৌভিক হতোদ্যম হয়ে বলল, “চল হয়ে গেছে। এখনও সময় আছে। মামা-ভাগ্নে পাহাড়টা ঘুরে আসা যাবে।” আমি কিছুতেই যাব না।
বীরভূম ডাইরি (পর্ব- ৫) ১৪/১২/১৬
হেতুমপুরের রাজবাড়ি না দেখে যাবই না, আমার এই নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে, ড্রাইভার গণেশ বাবু আসেপাশের আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে অবশেষে একটা লাল দরজার সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন। অনেকটা চার্চের মত দেখতে বেশ বড় লাল দরজা, মাথার ওপর কোন এককালে একটা ঘড়ি ঘর ছিল, আজ শুধু তার কঙ্কালটুকুই অবশিষ্ট আছে। আধভাঙ্গা বিশাল মরচে ধরা বিবর্ণ গ্রীলের গেট, কব্জা থেকে ঝুলে পড়েছে। দরজার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বহুদূরে বিস্তীর্ণ মোরামের মাঠের (এককালে হয়তো বাগান ছিল) ওপারে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে, এই তো সেই বাড়িটা। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। এই তো এই বাড়িটার সামনেই জীপ (খুব সম্ভবত) থেকে লাফিয়ে নেমেছিলেন ফেলুদা আর তপসে। এখানেই একটা টিয়া পাখি ছিল, যে কারণে অকারণে খালি বলত, “ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন, একটু জিরো”
বিশাল অট্টালিকা। সমান দুই খণ্ডে বিভক্ত। সে বিভাজন শরীকি কি না, জানি না। একাংশে কলেজ, সেই অংশটি সযত্নে রক্ষিত। দেওয়ালে জানলায় দরজায় চকচকে নতুন রঙ। তবে ঐ অংশের সামনের মাঠটির অবস্থা চোখে দেখা যায় না। গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ, এত গাড়ি পড়ুয়াদের বলে মনে হয় না। দুই অংশের বিভাজন এককালে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে তারের জাল দিয়ে করা ছিল, যা বর্তমানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন। জাল বরাবর বেশ কিছু গাছও বসানো ছিল, যার অনেকগুলিই আজ মহীরুহে পরিণত।
যে অংশে আমরা প্রবেশ করলাম, সেটি জনহীন। সামনের মাঠের কিছুটা অংশ ঘিরে একটা নির্মীয়মাণ চিল্ড্রেন্স পার্ক। এই ভাবগম্ভীর পরিবেশ যা সাংঘাতিক বেমানান। তবু এই ভেবে শান্তি পেলাম, যে তুত্তুরীর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে সাময়িক ভাবে মুক্তি পাব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা দোলনাও এখনও টাঙানো হয়নি এবং স্লিপ গুলির অবস্থাও অকহতব্য। সমস্ত কিছুই ধুলোর চাদরে আচ্ছন্ন।
রাজবাড়ির রূপ এবং গাম্ভীর্য ভাষায় প্রকাশে আমি অপারগ। অপার মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসার সময় শুধু দুঃখ হচ্ছিল, যে আমাদের রাজ্যে এত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা রয়েছে, এগুলিকে হেরিটেজ হোটেল বানিয়ে প্রমোট করতে পারলে কি ভালোই না হত। দিনের শেষ দ্রষ্টব্য, দুবরাজপুরের মামা-ভাগ্নে পাহাড়। শ্বশুর মশাই নিষেধ করেছিলেন যদিও তবুও ড্রাইভার গণেশ বাবুর উৎসাহেই যাওয়া। গিয়ে মনে হল, না গেলেই ভাল হত, বুঝি। মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের যে রূপ অভিযান সিনেমায় দেখেছিলাম, আদপে তার সিকি ভাগও সুন্দর নয় জায়গাটা। বেশ কিছ ক্ষয়প্রাপ্ত গোল গোল পাথর, যেমন নোংরা, তেমনি জনাকীর্ণ। প্রতিটি পাথরের গায়ে, প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের নাম খোদাই করে গেছে। সামনেই দুটি মন্দির, একটি সংকটমোচন হনুমানজীর অপরটি পাহাড়েশ্বর শিবের। মন্দিরগুলির নাকি এ বছরেই দ্বারোদঘাটন হয়েছে, এবং ফলতঃ মোদোমাতালের উৎপাত নাকি একটু কমেছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই আমরা রওনা দিলাম, সিউড়ির উদ্দেশ্যে। সিউড়ি সার্কিট হাউসেই রাত্রিবাস। গাড়িতে ওটার আগেই ডিএনও সাহেবের ফোন, অভিভাবকের মত জানালেন যে সার্কিট হাউসে সব বন্দোবস্ত করা আছে, প্রশ্ন করলেন রাতে আমরা কি খেতে চাই, সেই মত ব্যবস্থা হয়ে যাবে এবং পরিশেষে জানালেন, যে অফিস থেকে নিস্তার পেলেই উনি আসছেন, সার্কিট হাউসের লাউঞ্জে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে। আমরা দুজনেই অনুরোধ করলাম যদি উনি একা না এসে সপরিবারে আসেন, তাহলে একজন বন্ধু পেয়ে তুত্তুরীর ঘ্যানঘ্যানানি যদি কমে। ডিএনও সাহেবের গিন্নী অর্থাৎ প্রিয়াঙ্কার সাথে বেশ কয়েকবছর আগে সুন্দরবন ভ্রমণকালে দেখা হয়েছিল এবং বেশ ভাব জমে গিয়েছিল। তুত্তুরীর সাথে ওনার কন্যা “কেটলু” ওরফে “প্রিয়দর্শিনীর”ও জব্বর দোস্তি জমে গিয়েছিল। জানতাম প্রিয়াঙ্কা অবশ্যই আসবে, এবং প্রিয়াঙ্কা ও কেটলু আমাদের আশাহত করেনি। সেদিন সিউড়িতে গানের বড় অনুষ্ঠান ছিল, একাধিক নামী  শিল্পীর আসার কথা, কিন্তু আমাদের সাথে আড্ডা মারার জন্য কেটলু এবং তার জননী সেই অনুষ্ঠান মাঝ পথে ত্যাগ করেই এসে হাজির। প্রাণ খুলে আড্ডা হল প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত, রাত দশটায় আমাদের নৈশাহার সাজিয়ে দেওয়া হল টেবিল, ডিএনও সাহেব স্বয়ং তদারকি করলেন। বেচারা কেয়ারটেকার(?) একচোট বকুনিও খেল রাতে বাঁধাকপির তরকারী রান্নার জন্য, যদিও তা খেতে বেশ ভালোই লাগল। অবশেষে আমাদের খেতে বসিয়ে তদারকি করে কেটলু এবং তার পিতামাতা বিদায় নিল। আমরাও তৃপ্ত উদর তথা ততোধিক পরিতৃপ্ত হৃদয়ে গেলাম শুতে। কাল সকালে ম্যাসাঞ্জোর। নাকি বিকালে? সেটা কাল সকালেই ভাবব, সারাদিনের ক্লান্তিতে আপাতত চিন্তা এবং চেতনা আচ্ছন্ন।  
বীরভূম ডাইরি ১৫/১২/১৬ (পর্ব- ৬)
বীরভূমে সেই অর্থে আজ আমাদের তৃতীয় দিন। আজ বুধবার, ৬/১২/১৬। আজকের গন্তব্য মাসাঞ্জোর। ডিএনও সাহেব এবং ওনার গিন্নী উভয়েই জানিয়েছিলেন, যে মাসাঞ্জোর যদি যেতেই হয়, তাহলে বিকাল বেলা যাওয়াই ভালো। ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর একটা বাঁধের নাম মাসাঞ্জোরমাসাঞ্জোরে সূর্যাস্ত নাকি অত্যন্ত মনোরম। কিন্তু ড্রাইভার গণেশ বাবু এবং আমার শ্বশুরমশাই এর মতে মাসাঞ্জোরে সকাল বেলায় যাওয়াই ভালো। বাবা বললেন, “মাসাঞ্জোরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। চেতাকে (অর্থাৎ তুত্তুরীকে) নিয়ে গেলে, গোটা অঞ্চল তথা আসেপাশের পাহাড়গুলি ঘুরে দেখার আগেই অন্ধকার নেমে যাবে।” যুক্তি অকাট্য, কাজেই আমরা সকাল সকাল লুচি তরকারী দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম মাসাঞ্জোরের উদ্দেশ্যে। সার্কিট হাউসের লুচির একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, বহু বছর পর, আটার গুঁড়ি দিয়ে বেলা লুচি খেলাম। তেলে কড়করে করে ভাজা লুচির গায়ে গুড়িগুড়ি ভাজা আটা বা ময়দা, আহাঃ।
 যারা মাইথন গেছেন, তাদের মাসাঞ্জোরকে একনজর দেখলেই মনে হবে মাইথনের ছোট ভাই। তবে দুই পাড় ঐ রকম পাথরের বোল্ডার দিয়ে বাঁধানো নয় (যতটুকু মনে আছে)। বাঁধের ওপর চওড়া ব্রীজ। ব্রীজের ওপর দিয়ে গাড়ি যায় না। পায়ে হেঁটে ব্রীজ পেরোতে হয়। ব্রীজের ওপর দাঁড়ালে একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, ওপরদিকে শুকনো খাত। সব কটা লকগেট বন্ধ কি না। ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে গেলে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হল, রাশি রাশি টিয়া পাখি। ঘন সবুজ ডানা মেলে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়ে যাচ্ছে।  কখনও কখনও ব্রিজের রেলিং এর ওপর ও এসে বসছে। তুত্তুরী যেই ধরতে গেল ওমনি ফুরররর।
যত জনসমাগম সবই এই পাড়ে, ওপারে তেমন কিছুই নেই। গোটা দুয়েক চায়ের দোকান, যাদের বয়ামে রাখা লেড়ো বিস্কুট গুলিকে দেখেই বিক্রি বাটা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। আর আছে এক ফটোগ্রাফার (ক্যামেরা দেখলাম না যদিও), যিনি নকল ফুলের নানা ফ্রেম সাজাচ্ছিলেন, যা দেখেই বোঝা যায়, যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের সেলফি তোলার জন্য। হেঁটে ব্রীজ পেরোতে গিয়ে প্রচণ্ড রোদে প্রায় ঝলসে গিয়েছিলাম আমরা, ওপারে ক্ষয় প্রাপ্ত পাহাড়ের ঢালে গিয়ে বেশ আরাম লাগল। উচ্চাবচ সরু পিচ ঢালা রাস্তা, দুপাশে লাল মোরাম উকি মারছে। একটু হাটার পর দেখি একদল ছেলে মেয়ে একটা টিলার ওপর থেকে নামল। শৌভিক ছবি তোলা থামিয়ে ওদের জিজ্ঞাসা করল, “এই ওপরে কি আছে গো?” ওরা জানালো তেমন কিছুই নেই। শুধু জঙ্গল। ওরা দৃষ্টির অগোচর হতেই শৌভিক বলল, “যাবি?” পরেছি তো লং স্কার্ট এবং চপ্পল, এই পরে আর যাই হোক পাহাড়ে চড়া যায় না। তবু সাহস করে রাজি হয়েই গেলাম। বেশ চড়াই, ধরারও কিছু নেই। অনেকটা উঁচুতে ওঠার পর দেখলাম আর পায়ে চলা পথ নেই, এবার ঘন জঙ্গল। ওপর থেকেও দৃশ্য এমন কিছু আহামরি নয়, তবুও চড়তে পেরে বেশ আনন্দ হচ্ছিল, এই চেহারায়, এই ঝলঝলে জামা কাপড় এবং শৌখিন চটি পরেও যখন পাহাড়ে চড়তে পারলাম, আর কে আমায় ট্রেকিং করা থেকে আটকাচ্ছে। আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু তথা ব্যাচমেট শ্রীমান দেবু কর, মাঝেমাঝেই ওসকায়, “চল অনি, ট্রেকিং করে আসি।” মন তো চায়, কিন্তু যতবার প্রসঙ্গটা ওঠে, তুত্তুরী সাফ জানায়, “বাবা যাক। তুমি যাবে না।”
চড়া তো হল, এবার নামার পালা। নামতে গিয়ে দেখলাম, নামাটা বেশ কঠিন। শৌভিক এবং তুত্তুরীর বাঁধা জুতো,ওরা টরটর করে বেশ খানিকটা নেমে গেল। আমি গেলাম আটকে, কিচ্ছু ধরার নেই, নামতে গেলেই ভয় হচ্ছে গড়িয়ে যাব এবং গড়াতে গড়াতে সোজা খাদে। জানতাম আওয়াজ দেবে, তবু প্রাণ বাঁচাতে শৌভিকেই ডাকলাম, “একটু হাতটা ধরবি। জাস্ট একটা স্টেপ।” শৌভিক গজগজ করতে করতে হাতটা তো বাড়িয়ে দিল, মুখে শুধু বলল, “তুই করবি ট্রেক? দেখছিস তো ব্যাপারটা যত রোম্যান্টিক মনে হয়, আদপে অতটা নয়।”
নীচে নেমে আমরা আরো খানিকটা হাঁটাহাঁটি করলাম, ফাঁকা ঢেউ খেলানো রাস্তা দিগন্ত রেখা অবধি বিস্তৃত। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পর্যটক নেই। সত্যি ঝাড়খণ্ড অপরূপা।
আবার রোদে পুড়তে পুড়তে ব্রিজ পেড়িয়ে গাড়িতে ওঠা। গণেশ বাবু বললেন, “জলের কাছে যাবেন স্যার?” সদ্য তৈরি ইউথ হোস্টেলের পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা সটান নেমে গেছে জলের কাছে। চোখ ধাধিয়ে গেল, মাসাঞ্জোরের সৌন্দর্যে, যতদূর চোখ যায় জল আর জল, দুদিকে দুটি ব্রীজ অনেকটা এগিয়ে গেছে জলের মধ্যে, ব্রীজের শেষে সাবেকি লাইট হাউসের মত দেখতে দুটি কুঠি,তবে অত উচু নয়। একনজরে মনে হবে, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডে এসে গেছি। প্রচুর ছবি তুলে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে রওনা দিলাম সিউড়ি সার্কিট হাউসের দিকে। সূর্য তখন মধ্য গগনে, এবার লাঞ্চের পালা, লাঞ্চ সেরে বিকালে যাব রাজনগরের মসজিদ আর ভাঙা রাজবাড়ি দেখতে।
বীরভূম ডাইরি ১৬/১২/১৬ (পর্ব- ৬)
মাসাঞ্জোর থেকে সিউড়ি ফিরে, বেশ একটা জম্পেশ লাঞ্চ আর আধ ঘণ্টার একটা ছোট্ট দিবানিদ্রা দিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ আমরা রওনা দিলাম, রাজনগরের উদ্দেশ্যে। ইন্টারনেট ঘেঁটে রাজনগরকে খুঁজে বার করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার। সপ্তাহব্যাপী বীরভূম ট্যুরে কি কি দেখা যেতে পারে, তাই নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি রাজনগরে এক বহু পুরানো মসজিদ আছে। তার ভাঙা প্রবেশদ্বারের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বীরভূমে পৌঁছে দেখলাম, স্থানীয় বাসিন্দারা কেউই রাজনগরের মসজিদের খবর জানে না। তবে আমার এক খুড় শ্বশুর জানালেন, যে রাজনগরে নাকি বিশালাকৃতি রসগোল্লা তৈরি হয়, ঠিক যেমন গুপি-বাঘা খেত।
গণেশ বাবু আমাদের নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন, এক বিশাল মাঠের মাঝে, মাঠের এক পাশে বিশাল জলাশয় এবং সেই জলাশয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, সদ্য চুনকাম করা এক ইমামবাড়া। হুগলী ইমামবাড়ার কাছে, তা নেহাত দুগ্ধপোষ্য শিশু। সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। আমরা যখন উঠছি, একদল বাচ্ছা মাঠে ফুটবল খেলছিল, চেঁচিয়ে বলল, “জুতো খুলে।” আমরা সসম্ভ্রমে জুতো সিঁড়ির ওপর রেখে ঢুকলাম। খোলা ছাদ, অত্যন্ত নোংরা, নুড়ি পাথর, প্লাস্টিকের প্যাকেট পড়ে রয়েছে। বেশ অদ্ভুত ইমামবাড়াটা। দুই দিকে প্রাচীর, প্রাচীর গাত্রে মুখমুখি বড় বড় তিন জোড়া খিলান, কিন্তু দুই প্রাচীরের মাঝে কোন ছাত বা মেঝে নেই। একদম ফাঁকা। কোনকালে কোন স্থাপত্য থাকলেও আজ তার ভগ্নাবশেষটুকুই অবশিষ্ট রয়ে গেছে এবং তা বেশ রহস্যময়।  

ইমামবাড়াটা খুবই সুন্দর, বিশেষত বিশাল ঝিলের ধারে, ঝিলের নাম বড় কালিদহ। কিন্তু যে মসজিদের টানে আমরা ছুটে এসেছি, সেটা কই? ইমামবাড়ার সামনের বিশাল মাঠে নাকি বাজার বসে। অসম্ভব ধুলো। ঐ মাঠের এক কোনে একটা ভাঙা গেট আছে বটে, কিন্তু তার সাথে ইন্টারনেটে দেখা মসজিদের গেটের সাদৃশ্য থাকলেও তা অত্যন্ত সাধারণ। চূড়ান্ত হতাশ হয়ে আমরা ঐ ধুলোয় ভরা মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যখন চক্কর কাটছি, গণেশ বাবু বললেন, স্যার ঐ বড় কালিদহের মাঝে রাজাদের হাওয়ামহলের ধ্বংসাবশেষ আছে, আর ঐ দিকে রাজাদের ভাঙা বাড়িটাও দেখতে পাবেন। আদপে তুত্তুরী    (চলবে)