Saturday 25 February 2017

বেণু-রতন

-হাওয়াটা দারুণ না?
-অ্যাঁ?আমায় বললেন?
-হ্যাঁ । বলছি আজ দারুণ হাওয়া দিচ্ছে।
-ও। হ্যাঁ। মানে রোজই কি এমন হাওয়া দেয় না? সমুদ্রের হাওয়া?
-কি জানি? দেয় কি না। আগে কখনও এই অনুভূতিটা হয়নি কি না।
-কি অনুভূতি? কিছু মনে করবেন না, আমার বোধহয় প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি---
-আরে না না। কিছু এমন অন্যায় হয়নি। আপনি এত সঙ্কুচিত  বোধ করবেন না।
-সঙ্কোচ?সঙ্কোচই তো আমার একমাত্র সম্বল ভাই, এই দেখুন না জীবনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শ্রীক্ষেত্র এলাম, প্রথমবার এসেছিলাম বছর  চল্লিশ  আগে, তখন আমি নবোঢ়া। স্বামী শ্বাশুড়ি আর স্বামীর আগের পক্ষের তিন ছেলের সঙ্গে। যার বড়টি আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট ছিল-।  আর এবার এসেছি আমার মেজবোন,ভগ্নীপতি,তার মা, দাদা-বৌদি,তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে। এখন আমি এক অসহায় নিঃসম্বল গৃহহীন,বিধবা। (প্রৌঢ়া আঁচলের খুঁটে চোখ মুছলেন) মাপ করবেন দাদা আমি আবার আবোলতাবোল  বকতে লেগেছি---
-(প্রৌঢ় গলা ঝেড়ে সঙ্কুচিত  হয়ে বললেন) আরেঃ না না। আপনি বলুন না-- আমার মন্দ লাগছে না। আসলে আমার কথা বলার কেউ নেই জানেন। উত্তরবঙ্গের এক অজ গাঁয়ের এক ছোট্ট প্রাথমিক স্কুলে মাষ্টারি করি। নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না  করি, এখন অবশ্য আর হাত পোড়ে না। হাঃ হাঃ।
-প্রৌঢ়া অল্প হাসলেন। প্রৌঢ় অবাক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, প্রৌঢ়ার গালে গোলাপী রঙ লাগল। দুজনেই চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। সামনে অতল গভীর বঙ্গোপসাগর ছলাৎ-  ছল করে আছঢ়ে পড়ছে তটরেখায়। মহিলা সামলে নিয়ে বললেন,“ তবু ভাল। আপনি স্বনির্ভর। আমি তো লেখাপড়াও তেমন শিখিনি। দাঙ্গার ভয়ে ওপার থেকে পালিয়ে এসেছিল আমাদের পরিবার। পথে বাবাকে ওরা কুপিয়ে খুন করে। মা কোনমতে দুই মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে আসে। খাবারই জোটা দায় ছিল তো পড়াশোনা। আমার বর বয়সে অনেক বড় ছিলেন। বিশাল কারবার। প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন ছেলে রেখে হঠাৎ  মারা যান। ছেলেদের সামলাবেন না কারবার?অগত্যা আমায় বিয়ে করেন। মা জেনেশুনেই দিয়েছিল। আমার ভাইবোনেরা ভাল ভাবে মানুষ হতে পারে যাতে। বিয়ের পর জানতে পারলাম ওনার অপারেশন করানো আছে। আমি আর কখনও মা হতে পারলাম না। আমার আজ তিনকূলে কেউ নেই জানেন। বোনের বাড়ির নিছক আশ্রিতা আমি_---
-(অখণ্ড নীরবতা, শুধু অবাধ্য বঙ্গোপসাগর একাই ছলাৎ ছল করে আওয়াজ করে চলেছে। )
-(ভদ্রলোক গলা ঝেড়ে বললেন) জানেন আমার ও কেউ নেই। আমরাও পালিয়ে এসেছিলাম দাঙ্গার ভয়ে। বাবা এপাড়ে একটা ছোট্ট মণিহারি দোকান দিয়েছিল। মন্দ চলছিল না। দশ ক্লাশ ভালভাবে পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। গায়ে বসন্তের হাওয়া লাগল। কলোনীর জলের লাইনে প্রথম দেখা তার সঙ্গে। গাছকোমর বেঁধে ঝগড়া করছিল। দেখেই বুঝতে পারছিলাম এসবে সে অভ্যস্ত  নয়। হয়তো ওপাড়ে কোন সম্ভ্রান্ত  পরিবারের মেয়ে, এপাড়ে এসে এই পুতিগন্ধময় পরিবেশে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না, তবু ছাড়ছে না। সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট।  হাঃ হাঃ হাঃ
-সত্যি বাবা। উফ্ ঐ জলের জন্য সাতসকালে ঝগড়া করা আমারও পছন্দ ছিল না। ঘেন্না লাগত। কিন্তু না করলে উপায় ছিল না। যাই হোক তারপর??
-তার আর পর নেই। পড়াশোনা মাথায় উঠল। বন্ধুর থেকে ধার করা  সাইকেল নিয়ে তার ঘরের চারপাশে ঘোরা---এক ঝলক দেখতে পেলেই দিন সার্থক।
-হ্যাঁ তখন তো ছেলেরা তাই করত। আমাদের কলোনীতেও এমন একজন ছিল। আমার সখীরা বলতো সে নাকি আমায় ----(প্রৌঢ়ার মুখ সিঁদুর বর্ণ ধারণ করল) যত বাজে কথা। বুড়ো বরকে কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হইনি প্রথমে জানেন। শুধু তার কথা ভেবে। অবশেষে একদিন রাতে তাকেই বলেই বসলাম, পারবে না আমার দায়ভার নিতে? তো বলে খাব কি? রাখব কোথায়? আর কথা বাড়াইনি। মুরোদ বোঝা গেছিল।
-প্রৌঢ় হেসে বললেন,“এরম বলবেন না। মুরোদ থাকলে কি কেউ ফেরায়?আমার তিনিও আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন একদিন। তখন গভীর রাত, নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে হাজির হলাম তাদের হোগলার ঘরের পিছনে। সেদিন শুক্লা চতুর্দশী। নোংরা পুতিগন্ধময় কলোনী ভেসে যাচ্ছে শশধরের চাঁদনীতে। বুকে তীব্র কম্পন ধরিয়ে সে এল। জংলা ছাপ শাড়ি ঘরোয়া ভাবে পড়া,  একমাথা কোঁকড়া চুল একটা বিশাল খোঁপায় জড়ানো। দুটো প্রেমের কথা বলব কোথায়, গলা দিয়ে আওয়াজই বের হল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বুঝলাম সে কাঁদছে। মুখ খুলতে যাবার আগেই সে দুহাতে আমার হাত চেপে ধরল। তারপর আমার হাতে মাথা ঠুকতে লাগল। টপটপ করে অশ্রুকণা ঝড়ে পড়তে লাগল আমার হাতে----।
-মহিলা ছটপট করে উঠলেন। “থাক না।শুধু শুধু ও সব কথা”
-হুঁ। ঠিকই বলেছেন। সেও সেদিন বলেছিল তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে---পারিনি। বিশ্বাস করুন। তার জন্যই পারিনি। কোথায় রাখতাম তাকে?কি খাওয়াতাম? একবার তো উদ্বাস্তু হয়েইছে আবার কি ছিন্নমূল  হত আমার জন্য?তাই ফিরিয়ে দিলাম। চোরের মত পালিয়ে এলাম। সারারাত শুধু কেঁদেছি। পরদিন সকালে দৌড়ে গেছি তার কাছে, ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে। কিন্তু -----। আজ এত বছর পর শুধু আপনাকেই বলছি। কেন জানি না।  পালিয়ে গেছি, সবকিছু ছেড়ে। হিমালয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে চেয়েছি,মিশে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারলাম কই?অন্য নারীসঙ্গও তাকে ভোলাতে পারেনি। সেই স্পর্শ, সেই অশ্রুকণার উষ্ণতা, সিক্ততা আজও একই রকম ভাবে অনুভব করি। ভুলতে পারিনি----
-ভোলা যায় না। আমিই কি পেরেছি?শুধু ঐ স্মৃতিটুকুই যা অমৃত বাদবাকি সবই গরল। খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের পর শ্রীক্ষেত্র আসব তার সাথে মধুচন্দ্রিমা যাপনে--- সেই এলাম। কিন্তু  😔😔
-কি আশ্চর্য ওর ও তাই ইচ্ছা ছিল বলে শুনেছি পরে ওর ঘনিষ্ঠ সখীর কাছে----
-ফুল  মাসিইইই ---দূর থেকে কে যেন ডাকল,মহিলা শশব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন। ভদ্রলোক অসাড় হয়ে বসে রইলেন কতক্ষণ, তারপর খেয়াল হল ইশ্ নামটা তো জানা হল না? একই কথা ভাবছিলেন প্রৌঢ়াও-__ বঙ্গোপসাগর ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল এদের নির্বুদ্ধিতায়। “যাক্ কাল আবার আসতে হবে, ঠিক এই সময়” ভাবল প্রৌঢ়। “ইশ্ কালই ফিরে যাওয়া-” ভাবল প্রৌঢ়া।
https://amianindita.blogspot.in

Wednesday 22 February 2017

একূট

প্রচণ্ড ব্যস্ত,সকাল বেলায় ডিএম সাহেবের ওখানে মিটিং করে এলাম, বিকালে যেতে হবে চন্দননগর। ডিএলসি সাহেবের মিটিং।মাঝে নটা গ্রাজুইটি কেসের হিয়ারিং। দুঁদে উকিল বাবুর মনে হয়েছিল গোলুমলু নতুন ম্যাডাম এসেছেন ধমক ধামক দিয়ে কাজ উদ্ধার করবেন, কিন্তু ম্যাডাম ও যে ধমকাতে পারেন এবং ওণার চেয়েও জোরে এটা বোধহয় ভাবেননি। প্রবল মাথা গরম করে উকিল বাবু বিদায় হলেন। মন বলল ধুৎ তেরি। অনেক হয়েছে, অফিসের পাশের সুইমিং পুলে ঝাঁপ মারি--- কিন্তু যা শ্যাওলা, বেঁচে থাকলে দাদ, হাজা, চুলকানি অবধারিত। তার ওপর সাঁতারটাও জানি কি না।
তিতকুটে মুখে বসে আছি, আবার মুঠোফোনের চিৎকার। ধুত্তোর বলে ধরতে গিয়ে মনটা হঠাৎ  খুশি হয়ে গেল--- চৈতালী। পর মুহূর্তে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, অফিস টাইমে তো কোনদিন ফোন করে না। তবে? কি হল রে বাবা?
ভয়ে ভয়ে ধরতেই ওপাশে চৈতালীর কেজো সুর,“শোন না, তোর সীমাকে মনে আছে?  আমাদের সাথেই পড়ত?”  দিব্যি মনে আছে। যোগাযোগ নেই যদিও। ওরা এককালে বিশাল ধনী ছিল, ওদের বাড়িটা ছিল প্রাসাদতুল্য, সামনে একটা কালো গাড়ি রাখা থাকত। আর ছিল একটা জাঁদরেল কুকুর। তার নাম ল্যান্ডো। সীমা অর্থাৎ সীমন্তিকার বাবা মা খুব অল্প বয়সে মারা যান। ওর ঠাকুমাই ওকে মানুষ করেছিল। ঠাকুমা ছিলেন অপরূপ রূপসী। ধপধপে সাদা শাড়ি পরতেন, গায়ের রঙ ছিল মাখন। যাই হোক বললাম,“   হ্যাঁ।  মনে আছে তো। কেন?” চৈতালী বলল, “জানিস তো সীমার ঠাকুমা যেন বীরভূমের কোথাকার একটা রাজকুমারী ছিলেন”।  এটাও জানি। চৈতালী বলেই চলেছে,“ ঠাকুমার ঐ বাপের বাড়ি মানে রাজবাড়িটা ওরা বিক্রি করে দিচ্ছে। ” মনে মনে ভাবলাম,“তো? তুই কিনবি নাকি? না আমায় কিনতে হবে?” মুখে বললাম,“ ঠিক কি বলতে চাস, পরিষ্কার করে বল না বাপু। ”
“শোন না ঐ বাড়িটায় নাকি ইয়ে আছে। পরপর দুটি লোক ওখানে মারা গেছে সাম্প্রতিক কালে। দুটোই অস্বাভাবিক মৃত্যু । একজন মারা গেছেন সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে। তার নাকি ঘাড়টা উল্টোদিকে ঘুরে গিয়েছিল। আর একজন গলায় দড়ি দেন। ”
“সেকি রে?”
“হুঁ। আরো আছে মামা। এই দুজনেই ছিল এক নামি হোটেল চেইনের কর্মচারী। ওরা গিয়েছিল ঐ বাড়িটা দেখতে। ওরা ঠিক রিপোর্ট দিলে বাড়িটা সীমাদের থেকে ঐ হোটেল কোম্পানী কিনে নিত। ”
“বাপস্। তা দুজন কি একই সঙ্গে----?”
“না বে। সেটাই তো রহস্য। প্রথমজন মারা যাবার বেশ কয়েক মাস পর দ্বিতীয় ব্যক্তি যায় এবং সে ও---”
একটু দম নিয়ে চৈতালী আবার বলল,“যাবি নাকি?   আমরা তো বসন্তপূর্ণিমা আর বেনারস ঘুরে এসেছি--। ” হ্যাঁ। এর আগে আমরা দুবার ভূতের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি বটে, তবে কোনটাই তেমন খুনী টাইপ ছিল না। ইতঃস্তত করছি, চৈতালী বিরক্ত  হয়ে বলল,“বল না বে?  তুই বললে আমি অন্তুর (অন্তরা) সাথে কথা বলব, আর তুই সঞ্চির(সঞ্চিতা) সাথে কথা বল। সীমাও যাবে। সরেজমিন তদন্ত করতে। ওর ধারণা এটা ভূত টুত না। কোন দুষ্টু লোকের কারসাজি। ”
“প্রাণটা এতক্ষণ বোধহয় এর জন্যই হাঁকপাঁক  করছিল রে,চল যাই।  তবে এখুনি পারব না বস্। আমার মেয়ে আর অন্তুর ছেলের পরীক্ষা । তার ওপর আমি ডিডিও। মার্চ মাসের মধ্যে সরকারের সব টাকা না খরচা করতে পারলে গর্দান যাবে--- এপ্রিলে চল। ”
“চল্।  ডান” বলল চৈতালী। এবার সঞ্চিকে ফোন করার পালা,“ও সঞ্চিতা যাবি তো?”
https://amianindita.blogspot.in

Wednesday 1 February 2017

অনির পুরুলিয়া ডাইরি


অনির পুরুলিয়া ডাইরি ৩১শে জানুয়ারি ২০১৭

চলেছি পুরুলিয়া। বিকাল ৪টে ৫০ এর পুরুলিয়া এক্সপ্রেস যখন হাওড়া ছাড়ার হুইসেল দিচ্ছে শৌভিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু খাবি? কিনে আনব?চিপস্?” শৌভিক চিপস্ কিনে দিতে চাইছে? প্রথমে বিশ্বাস হল না। আমার স্বাস্থ্য সচেতন বরের কাছে চিপস্ চপ আর বিষে খুব বেশি তফাৎ নেই। বিশেষতঃ খাদক যেখানে আমি।

প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে না বললাম। হকার তো উঠবেই। আর আইআরসিটিসি তো আছেই।  কত রকম চপ, মশলা মুড়ি , সিদ্ধ ডিম, বাদাম চিঁড়ে ডালমুট উঠবে। খেতে খেতে যাব। সাথে চা কফি তো থাকবেই। মদন কটকটিও নির্ঘাত উঠবে। খড়্গপুরে থাকাকালীন কম খেয়েছি?

হাওড়া ছাড়ার একটু পরই বাদাম ওলা উঠল। শৌভিক আবার অনুরোধ করল,“খাবি?” দশ টাকার এক প্যাকেট বাদাম ভাগ করে খাওয়া হল তিনজনে। শৌভিক এত খাবার জন্য অধীর হচ্ছে কেন বুঝতে পারলাম না। ওটা তো সাধারণত আমার দপ্তর। এখনও রাত বাকি পথ বাকি, কত কিছু খাওয়া বাকি। খড়্গপুর তো আসুক।

সাড়ে ছটায় খড়্গপুর এল এবং চলেও গেল। সেই কখন খাওয়া চারটি বাদাম কোথায় হারিয়ে গেছে, আমরা দুই ক্ষুধার্ত মা মেয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে একবার এই দিকের দরজার দিকে তাকাচ্ছি একবার ঐ দিক। কেউ ওঠে না কেন? আই আর সি টিসি ওলারা কি মরে গেল নাকি? ট্রেন গিরিময়দান হয়ে মেদিনীপুর, শালবনী, চন্দ্রকণা রোড, গড়বেতা হয়ে বিষ্ণুপুর ঢুকতে চলল কেউ ওঠে না। মাঝে একজন হকার এল চাল ভাজা নিয়ে, তার হাতে বোধহয় সাকুল্যে চারটি প্যাকেট রয়েছে। তুত্তুরী ক্রমশঃ ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ছে, বললাম ব্যাগে বিস্কুট আছে, আপেল আছে খেতে। তাও খেল না।  চালভাজা ওলাকে দেখে ভাবছে আরো কেউ উঠবে হয়তো। উঠল বটে অনেক পরে তবে উলের মোজাওলা। কি ভাগ্যি শৌভিক জলটা হাওড়া থেকেই তুলে নিয়েছিল, না হলে হয়তো নির্জলা থাকতে হত।
প্রায় বাঁকুড়া ঢোকার মুখে যখন কাঁদো কাঁদো মুখে বিস্কুট খেতে বাধ্য হচ্ছি, একজন হকারের প্রবেশ হল। কি যে বিক্রি করছে বোঝা গেল না, তবে গোটা সি ওয়ান বাতানুকূল কামরার সব যাত্রী প্রায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরাও কিনলাম। চিঁড়ে পোলাও । ছোট্ট চকমকে প্যাকেট দশটি টাকা। খুলে মুখে দিয়ে দেখি, প্লেন ভাজা চিঁড়ে। সাথে গুটি কয় বাদাম। অল্প ঝুড়ি। আর শুকনো বোঁদে। বোঁদের জন্য কি না জানি না কি প্রচণ্ড মিষ্টি। চিঁড়ে পোলাও নয় এর নাম হওয়া উচিত চিঁড়ের হালুয়া। তুত্তুরী এবং তার বাবা যদিও তোফা তোফা করে গেল। একমুখ চিঁড়ে নিয়ে আধো আধো স্বরে আমার কন্যা বলল, “ কি ভালো খেতে মা। ইয়াম্ ইয়াম্ য়াম্ য়াম”

আদ্রা স্টেশনে পৌছবার কথা ছিল রাত নটা কুড়ি, ঘড়ি ধরে সঠিক সময়ে নামিয়ে দিল পুরুলিয়া এক্সপ্রেস। নামার সময় দেখি বাকি ট্রেন থেকে বাতানুকূল কামরায় ঢোকার ভেস্টিবিউলটা বন্ধ।  ওঃ হরি। তাই কোন হকার উঠতে পারেনি। 
গাড়ি তৈরি ছিল। সবই দেবময় দা থুড়ি এসডিও রঘুনাথপুরের আনুকূল্য ।  গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে গাড়ি ছুটল গড়পঞ্চকোটের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব ২৪কিলোমিটার কিন্তু ড্রাইভার সাহেব জানালেন আধ ঘন্টার  বেশি সময় লাগার কথা নয়। কোথায় থাকব, তাও দেবময় দাই ঠিক করে দিয়েছেন। শৌভিকের বক্তব্যানুসারে দেবময় দা নাকি যে রিসর্টটি আমাদের জন্য বেছে দিয়েছেন, সেটি এই মহল্লার আপাততঃ সবথেকে সুন্দর রিসর্ট। একদম যাকে বলে পাহাড়ের কোলে। ঘুটঘুটে অন্ধকার জনমানবশূন্য পথে হুহু করে দৌড়চ্ছে সুইফট্ আর এদিকে আমার বর আর কন্যা  ফিসফিস  করে আলোচনা করছে পথে হঠাৎ  ডাকাত পড়লে কি হবে? এক মুখ ঝামটায় দুজনকে থামালাম, যতঃ অশুভ কথাবার্তা। রীতিমত ভয় করছে আমার।

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি (পর্ব ২) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নিকষ  অন্ধকারে হুহু করে দৌড়চ্ছে সুইফট, হঠাৎ মনে হল দিগবলয় বরাবর  আবছা পাহাড়ের রেখা দেখা গেল। ঠিক ঠাহর  করতে পারলাম না, শুধু মনে হল এক বিশাল সরীসৃপ ক্রমশঃ আমাদের পেঁচিয়ে ধরছে। এক অদ্ভূত অবর্ণনীয়  শিহরণ খেলে গেল মুহূর্তের জন্য। গাড়ি এসে দাঁড়াল এক বিশাল লোহার গেটের সামনে। হর্ণের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই দু তিন জন লোক দৌড়ে এল। এক প্রৌঢ় গায়ে শাল মুড়ি দিয়ে হাতে এক বিশাল সার্চ লাইট নিয়ে এসে চট করে দরজা খুলে দিলেন। ড্রাইভার মধু বাবু, যিনি আবার গাড়ির মালিকও বটে, দৌড়ে আসা একজনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, “স্যার উনি দেবাশীষ দা। ” দেবাশীষ বাবুকেই দেবময় দা আমাদের কথা বলে রেখেছিলেন। ট্রেন থেকে নামার আগেই উনি ফোন ও করেছিলেন। আমাদের খাতির করে নিয়ে গেলেন ভিতরে।

গাড়ি থেকে নেমে দেখি, বিশাল এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের ঠিক পাশেই এক বিশাল ওয়াচ টাওয়ার। বিরাট সুদৃশ্য লন, মাঝে আঁকাবাঁকা কংক্রীটের পথ। গেটের অপর প্রান্তে অর্ধচন্দ্রাকারে তিনটি ছোট ছোট কটেজ। মাঝে একটি দোতলা বাড়ি। প্রতিটি কটেজের রঙ হলুদ, গায়ে না না ছবি আঁকা। কটেজ গুলিতে তিনটি করে ঘর। আমাদের কটেজে তিনটি ঘর, নাম হল ভাদু, টুসু আর ঝুমুর। টুসুটা আমাদের জন্য বরাদ্দ। ঘরে ঢুকে মন ভরে গেল। বেশ বড় ঘর। মেঝেতে চকচকে টাইলস্ পাতা। কিং সাইজ খাটে পরিপাটী করে পেতে রাখা বিছানা দেখেই রাজ্যের ক্লান্তি ভর করল। সোফা, টিপয়‘ বড় টিভি, ওয়ার্ড রোব, দুদিকে বেড সাইড টেবল, কনসিল্ড লাইট ইত্যাদি ইত্যাদি সহ থ্রি বা ফোর স্টার হোটেলের মত ব্যবস্থা । সবথেকে ভালো লাগল ওঁদের আন্তরিকতা । দেবাশীষ বাবু বললেন,“স্যার অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ আর আপনাকে সই সাবুদ করতে হবে না। আগে ডিনার করে রেস্ট নিন। ওসব কাল হবে।” আর ডিনার? ডিনারে ছিল গরম হাতে গড়া রুটি আর দিশি চিকেন কারি। সে যে কি অনবদ্য খেতে কি বলব। একটু ঝাল যদিও।আমরা ছাড়া রিসর্টে আপাতত আর অন্য কোন অথিতি নেই।

পরদিন ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল। জানলার কাঁচ সরিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল, গাঢ় কুয়াশার চাদর ভেদ করেও চোখে পড়ে ঘণ সবুজ গড়পঞ্চকোট পাহাড়। একদম রিসর্টের গা ঘেষেই উঠে গেছে। চটজলদি স্নান সেরে লুচি আর ফুলকপি আলু মটরশুটির ঝালঝাল তরকারি খেয়ে দৌড়লাম ওয়াচটাওয়ারের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে গেছে। আজ জাইলো, ড্রাইভার ও নতুন। একটি অল্প বয়সী ছেলে নাম আমানুল।
কোথাও যাবার আগে শৌভিক সেই জায়গাটা সম্বন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করে।  এ ব্যাপারে ওর আদর্শ হল ফেলুদা। আজ্ঞে হ্যাঁ শ্রীমান প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। কোথাও বেড়াতে গিয়ে কবে কি কি দেখব এটা আমার বর আগে থেকেই ছকে রাখে। সেই মত আজ আমরা দেখব বড়ন্তী লেক, কাশিপুর রাজবাড়ি আর জয়চণ্ডী পাহাড়। সেই মোতাবেক আমানুল গাড়ি ঘোরালো বড়ন্তী লেকের দিকে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে দশটা ছুইছুই করছে, চারপাশ তখনও আবৃত হাল্কা-গাঢ় কুয়াশার চাদরে।
অনির পুরুলিয়া ডাইরি (পর্ব ৩) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭
বড়ন্তী পৌছে প্রথম চোটে বেশ হতাশ হলাম। একটা মাঝারি মাপের টিলা,  তার সামনে একটি বিরাট টলটলে লেক। আমার সহপাঠী দেবু অর্থাৎ শ্রীমতী দেবযানী খানের মুখে প্রায় শুনি পুরুলিয়ার ভয়াবহ জলভাবের গল্প। দেবু স্বাস্থ্য দপ্তরে কর্মরতা, আপাততঃ পুরুলিয়াতেই পোস্টেড। প্রতিবছর গ্রীষ্মে দেবুদের কর্ম ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে যায়, কারণ তীব্র জলাভাবে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ডোবার জলে শৌচকর্ম করে, সেই জলই পান করতে বাধ্য হয়। পুরুলিয়ায় এসে দেখলাম, সত্যই ইতিমধ্যেই পুকুর-ডোবার জল প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। যে টুকু আছে তাও ঘোলা, সেখানে এত সুন্দর টলটলে লেক দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বড়ন্তীর যে প্রশংসা শুনেছি, সে তুলনায় কিছুই অনুভব করলাম না। বড় লেক কিন্তু বোটিং এর কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা টিলা যার পোশাকী নাম মুরারড়ি হিলের দিকে নামতে যাচ্ছিলাম, আমানুলই নিষেধ করল, “স্যার ছবি তুলবেন তো? ওদিকে যাই-”।  আড়াআড়িভাবে লেককে অতিক্রম করতে গিয়ে জিভ বেরিয়ে গেল। কি জঘন্য মাটির রাস্তা খানাখন্দে ভর্তি। একদিকে লেক আর একদিকে ঢালু খাত। আমানুল বলল, এই রাস্তা দিয়ে লৌহ আকরিক বহনকারী  ট্রাক যায় বলে রাস্তার এই দশা। ছোট গাড়ি হলে নির্ঘাত উল্টে যেত।  আমার বর এবং মেয়ে যথারীতি আলোচনা করতে লাগল, গাড়ি লেকে উল্টে পড়লে কি হবে, আর খাতে উল্টোলে কি হবে? শুভকথা বলতে তো শেখেইনি দুটোতে----

ওপারে গিয়ে যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম, বেশ ভাল লাগল। লেকের ধার বরাবর লাল মাটির সরু রাস্তা, প্রচুর রঙ বেরঙের ফুল ফুটে আছে। জলে উল্টো দিকের মুরারডি হিলের হাল্কা প্রতিচ্ছবি পড়ছে। আমানুল হতাশ হয়ে বলল, “স্যার এই কুয়াশাটা যদি না থাকত, তাহলে পাহাড়ের প্রতিটা গাছ- পাথরের ছায়া দেখতে পেতেন। ” সত্যি তো কুয়াশার জন্যই অস্পষ্ট লাগছে, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম শুধু পাহাঢ় নয়, ওপাড়ের সমস্ত গাছপালারও নিখুঁত প্রতিবিম্ব পড়ছে জলে। লাল মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম, বেশ লাগছিল। আমরা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পর্যটক নেই। স্থানীয় গ্রামের সদ্যস্নাত মেয়েরা কাঁখে জল নিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে, মাথার ওপর মিষ্টি সোনা রোদ, ঈষৎ  উষ্ণ বাতাসে দ্রুত অপসৃত হচ্ছে কুয়াশা, সব মিলিয়ে স্বপ্নের পরিবেশ। শৌভিক পটাপট ছবি তুলতে লাগল। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আমানুল যেখানে আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়েছিল, ওখান থেকেই সবথেকে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখা যায়। সব মিলিয়ে বড়ন্তী বড় মায়াময়। পরে এসডিও দেবময় দার মুখে শুনলাম শীঘ্রই এখানে বোটিং ও চালু হতে চলেছে।  
বেশ খানিকক্ষণ বড়ন্তীর রূপসুধা পান করে, ওপাশে মুরারড়ি হিলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা রওণা দিলাম কাশিপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে দেখলাম অনেক গরু, পিঠে লাল রঙে তিনটি করে টিপ আর লম্বা লাইন কাটা। গরুগুলোকে এমন সঙ সাজানো হয়েছে কেনর জবাবে আমানুল বলল, ঐ গুলিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশিপুর রাজবাড়ি সংলগ্ন  হাটে। প্রতি বৃহস্পতিবার ওখানে গরুর হাট বসে, যাতে এই গরুগুলি সাধারণ গরুর সাথে না মিশে যায় , তাই লাল রঙে মার্ক করা হয়েছে। অচীরেই কাশিপুর রাজবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়লাম। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রকাণ্ড প্রাচীর রাজবাটীকে ঘিরে রেখেছে, অনেকটা গুণ্ডিচা বাড়ির  (জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি) প্রাকারের মত দেখতে। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। গাড়ি এসে দাঁড়ালো বিশাল গেটের সামনে। গেটে ইয়া বড় তালা। গেটের দুপাশে দারোয়ানদের ঘর। ঘরের সামনে বারান্দা। কিন্তু সব খালি। দরজার দুপাশে উঁচু পাঁচিলের ওপর সশস্ত্র প্রহরী বসার খোপ কাটা গোটা প্রাকার বরাবর। কিন্তু আজ তা অরক্ষিতই পড়ে আছে। আমানুল হর্ণ বাজালো, ডাকাডাকি করল কেউ বেড়িয়ে এল না। আমাদের কোন হেলদোল নেই, শৌভিক বাইরে থেকেই সিংহদুয়ারের ছবি তুলতে লাগল। আমরা ঐ ভাব গম্ভীর পরিবেশে অপার মুগ্ধতা নিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আমানুল অধৈর্য  হয়ে বলল, গাড়ির মালিক মধু বাবু এসডিও সাহেব অর্থাৎ দেবময়দাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছে, এখানে ঢুকতে গেলে অনুমতি লাগে। কারণ এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। দুর্ভাগ্যবশত এসডিও সাহেব ফোন তুলছেন না। আমি শৌভিককে বললাম,“ তুই একবার করবি কি? হয়তো তোর ফোন-”।  শৌভিক হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল। আসলে সে দিন সরস্বতী পুজো, একদিনের জন্য দেবময় দা বাড়ি গেছেন, ঐ দিনই বইমেলায় বৌদির বই প্রকাশিত হবে।  এমতবস্থায় লোকটিকে আর ব্যতিব্যস্ত  করার কোন মানে হয় না। কাশিপুর রাজবাড়ি না দেখা হলেই বা কি????

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি  (পর্ব ৪) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আমরা দাঁড়িয়ে আছি কাশিপুর রাজবাড়ির সামনে, আমানুল তো গেট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু খুলবে কে? বিশাল লোহার গেটের ভিতর দিয়ে যতদূর  চোখ যায় ফাগুন মাসের সোনা রোদে মুখভার করে দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় সম্ভ্রম জাগানো রাজপ্রাসাদ ছাড়া জনপ্রাণীর দেখা নেই। শৌভিক একবার সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে দেবময় দাকে ফোন করেই বসল। কিন্তু বার চারেক রিঙ হতেই কেটে দিল। “নাঃ। এইভাবে ছুটির দিনে লোকটাকে জ্বালাতে পারব না। ” আমারও তাই মত। রাজবাড়ি না দেখা হলেই বা ক্ষতি কি? আর দেবময় দা তো কালই অর্থাৎ  ২রা ফেব্রুয়ারি ফিরেই আসছে, সেরকম হলে আমরা ৩ বা ৪ তারিখে ঘুরে নেব।   কিন্তু আমানুল কিছুতেই নড়বে না। “ না স্যার। আরটু দাঁড়ান। মধু বাবু ফোন করেছেন, বিডিও অফিস থিনি লোক আসছে। ” শৌভিক ক্ষেপে বলল, “ আমরা রাজবাড়ি দেখব বলে ছুটির দিনে বিডিও অফিসের লোকজনকে বিব্রত  করার কোন মানে হয়? চল। ” অগত্যা গাড়ি স্টার্ট দিতে বাধ্য হল আমানুল। এমনিতেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। গেটের লাগোয়া দারোয়ান দে  থাকার ঘর থেকে একটা বিটকেল গন্ধে বমি আসছিল। যা শৌভিকের দাবি মত সুঁটকি মাছের গন্ধ। কিন্তু আমি জানি ঐটা পায়রা/ ঘুঘু এবং পায়রার বিষ্ঠার গন্ধ। আমাদের হাওড়ার বাড়িতে ঐ গন্ধ প্রায় পাওয়া যেত এককালে। এই নিয়ে তর্ক করছিলাম আমরা। আমানুল গাড়ি চালাতে চালাতে হেসে বলল,“ না স্যার। ঐ গুলান হল চামচিকা। নীচের ঘর ভরতি আছে। চিক্ চিক্ আওয়াজ শুনলেননি?”
একটু পরেই দেবময় দার ফোন, “ আরেঃ আমার একদম খেয়াল ছিল না, তোমরা আজই ওখানে যাবে। সকালে ওঁরা আমায় ফোনও করেছিলেন আমার কোন গেস্ট আছে কিনা জানতে। আমি ভুলে বলেছি না।” শৌভিক আশ্বস্ত করল, আমরা পরে যাব খন। শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল ৩ তারিখ  সকাল১১ টায় যাব রাজবাড়ি দেখতে।
পরের গন্তব্য হল জয়চণ্ডী পাহাড়। রঘুনাথপুর লাগোয়া তিনটি ছোট ছোট পাহাড়। যার একটির মাথায় মা চণ্ডীর মন্দির আছে। কিন্তু মন্দিরে উঠতে হলে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সিঁড়ি মানে সুন্দর বাঁধানো গোলাপী সবুজ সিঁড়ি। শৌভিক টরটরিয়ে উঠে গেল।  আমি আর তুত্তুরী টুকটুক করে। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নেবার জন্য সুন্দর বাঁধানো বেঞ্চ রয়েছে। আর সব জায়গায় লেখা আছে,“ বেঞ্চে বসে আড্ডা মারিবেন না। ” এবং সবথেকে ভয়াবহ হল,“জঙ্গলে আগুন লাগাবেন না। ” বাপরে। উঠতে উঠতে দেখলাম বেশ কয়েকটি বেঞ্চে দেবদাস এবং পারোর দল ঘনিষ্ঠ ভাবে প্রেমালাপে মত্ত। আহা দিনটি কি ভাবুন। সরস্বতী পুজো বলে কথা। আতঙ্কিত হলাম দ্বিতীয় সাবধান বাণীটিও না প্রত্যক্ষ করতে হয়। একটু উঠতেই দেখি কয়েকটি জায়গা পুড়ে কালো হয়ে আছে। হরি হরি।

কষ্ট করে উঠলাম যেমন, জয়চণ্ডী পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে মন ভরে গেল। দূর দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সে দৃশ্য বড়ই মনোরম।

নীচে নামার পর আমানুল আমাদের জয়চণ্ডী পাহাড়ের পিছন দিকে নিয়ে গেল। বিশাল ফাঁকা প্রান্তর। পিকনিক স্পট বোঝাই যায়। প্রচুর শোলার থালা এবং আনুষঙ্গিক আবর্জনা যত্রতত্র  পড়ে আছে। ঐ টুকু দৃশ্য দুষণ বাদ দিলে এক কথায় অপূর্ব। মাটি থেকেই পরপর তিনখানি খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। কখনও হয়তো ধস নেমেছিল গোটা কয়েক বিশাল শিলা খণ্ড পড়ে আছে। মনোরম জনমানবশূন্য প্রকৃতি।
দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে এলাম আমাদের রিসর্টে। কফি আর কড়কড়ে গ্রিল্ড বাটার টোস্ট খেয়ে নিছক অবকাশ যাপন। তুত্তুরী ছোটা ভিম দেখতে লাগল। আমি অনির ডাইরি লিখছিলাম , শৌভিক বের হল হাঁটতে।  একটু পরে আমিও বেরিয়ে এলাম কটেজ ছেড়ে। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন আবাসিক নেই। রিসর্টের মুখ্য দুয়ারে তালা দিয়ে বৃদ্ধ দারোয়ান নিদ্রা যাচ্ছে। বিশাল কম্পাউন্ড জুড়ে গুটি কয়েক টিউব লাইট জ্বলছে। যা আঁধার কাটাতে ব্যর্থ হলেও সমগ্র পরিস্থিতিকে আরো রহস্যময় করে তুলছে। পিছনেই পঞ্চকোট পাহাড়, প্রগাঢ় অন্ধকারে নিদ্রিত সরীসৃপের মত ঝিম মেরে পড়ে আছে। নিস্তব্ধ চরাচর।  ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে তাল মেলাচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসা ধামসার সুর। মাঝে মাঝে কি  একটা পাখি যেন ট্টিহিট্টিহু করে ডেকে উঠছে। শীতল বাতাস ছুটে এসে আলিঙ্গন করে গেল। সে আলিঙ্গন বড় আরামের, আবেশে চোখ বুজে আসে। শিউরে উঠে আকাশের দিকে তাকালাম ঠিক মাথার ওপরেই সপ্তর্ষিমণ্ডল জ্বলজ্বল করছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং কালপুরুষ ।  শৌভিক এসে হাতটা ধরল- তৃপ্তির কলস যেন উছলে পড়ল।

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি (পর্ব ৫) ২রা ফেব্রুয়ারি
আজ আমরা অযোধ্যা পাহাড় যাব। ৩১শে জানুয়ারি রাতে আমাদের গড় পঞ্চকোট পৌছবার সময়ই মধু বাবু বলছিলেন,“স্যার আজ এতদূর থেকে এলেন, কাল কাছাকাছি ঘুরে নিন। পরশু না হয় অযোধ্যা যাবেন। অযোধ্যা ঘুরতে সারাদিন লাগবে। যেতেই দুই আড়াই ঘন্টা তো লাগবে। সকাল সাতটা নাগাদ বেরোতে পারলে খুব ভালো হয়। ” সকাল সাতটায় বেরোনো মানে অন্তত ছটায় ঘুম থেকে ওঠা। আর অত সকালে তুত্তুরীকে তুলে স্নান করিয়ে রেডি করা বিশাল চাপের ব্যাপার। জয়চণ্ডী পাহাড় থেকে ফেরার পথে আমানুল অবশ্য আশ্বস্ত করল যে সাড়ে আটটায় বের হলেই চলবে। রাস্তা ভীষণ ভালো। হু হু করে গাড়ি দৌড়য়। ক্ল্যাচ নাকি ধরতেই হয় না।

সাড়ে সাতটায় সপরিবারে রেডি হয়ে প্রাতঃরাশ সেরে কটেজ দেখে বের হয়ে দেখি পুরু কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন চরাচর। অদূরে ওয়াচ টাওয়ারটিকে ও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটা নিজ স্বভাবে এগিয়ে চলেছে। নটা নাগাদ মধু বাবু ফোন করে জানালেন যে এত কুয়াশা যে গাড়ি ছাড়তেই পারেনি। একটু কুয়াশা কাটলেই আমানুল আসছে। আমাদের তাতে কোন হেলদোল ছিল না অবশ্য। কুয়াশাচ্ছন্ন ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে আবছা পাঞ্চেত পাহাড় আর ঘষা কাঁচের মত ধোঁয়াটে প্রকৃতি দারুণ উপভোগ্য । অযোধ্যা পাহাড় না দেখলেই বা কি?
গাড়ি ছাড়ল সাড়ে নটায়। তখনও কুয়াশা ভালো কাটেনি। আমানুল ইশ্ ইশ্ করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছিল। কারণ হল এত কুয়াশা থাকলে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের কোন ভিউই পাওয়া যাবে না। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই রোদ উঠছিল। কেটে যাচ্ছিল কুয়াশা। মাঠার ঘণ শালের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দূরে দেখা গেল বিশাল ঘুমন্ত পাহাড়। আমার ধারণা ছিল অযোধ্যা পাহাড় হয়তো পাঞ্চেত হিলস্ এর সাইজের হবে। শুনলাম এবং প্রত্যক্ষ করলাম যে অযোধ্যা পাহাড় বিশাল। ঐদিকে নাকি রাঁচি অবধি চলে গেছে।
প্রথমেই পড়ে পাখি পাহাড়। ছোট, গাছপালা বিবর্জিত পাথুরে টিলা। ঠিক উল্টানো বাটির মত। তবে শিখরটা বেশ খাড়াই। গায়ে অনেক গুলি মইয়ের মত বস্তু আটকানো। শুনলাম ওখানে রক ক্লাইম্বিং কোর্স হয়। আসে পাশে প্রচুর রঙ বেরঙের বুনো ফুল সোচ্চারে ঘোষণা করছে ঋতুরাজের আগমনের বারতা। সোনা রোদে নিখাদ অলসতায় বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম পাখি পাহাড়ের আসে পাশে। তুত্তুরী প্রচন্ড খুশি হল এক পাল ছাগল দেখে। জনৈক আদিবাসী বৃদ্ধ নিতান্ত অলস ভঙ্গীতে একপাল ছাগল নিয়ে যাচ্ছিলেন।  অলসতার ছোঁয়াচ বুঝি ছাগল গুলিকেও ছাড়েনি, কি রাজকীয় ভঙ্গীতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে গদাই লস্করী চালে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। একটির গলায় আবার বড় স্টিলের গ্লাস বাঁধা। গ্লাসের ভিতর একটি ভাঙা সাঁড়াশির ডাঁটি ঝুলছে। প্রবল ঢং ঢং শব্দ করে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। পিছন পিছন আমার কন্যাও দৌড়ল।
অযোধ্যা পাহাড়ের মূল আকর্ষণ হল তিনটি বাঁধ। যাদের পোশাকি নাম হল -  লোয়ার, মিডল্ এবং আপার ড্যাম। লোয়ার ড্যামটি ভাল তবে আহামরি কিছু নয়। মুগ্ধ হয়ে যেতে হ্য়, মিডল ড্যামটি দেখে। ঘন সবুজ আর লাল পাহাড়ের (যদিও আদতে হয়তো টিলা) মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে ঘন নীল জলের ধারা। মাঝে মাঝে ধাঁধা লাগে, হিমালয় বলে ভ্রম হ্য়।

আপার ড্যাম বলতে একটি বিশাল জলাশয়। জলের রঙ এখানেও গাড় নীল। চতুর্দিক শান বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ঘেরা। এক প্রান্তে ন্যাড়া খাড়া পাহাড়, বাকিটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা জলাশয়, লেখাও আছে, জলে নামিবেন না। আমরা ছাড়া যে মুষ্টিমেয় ভ্রমণ পিপাসু সেই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন, তাদের সবাই প্রায় রেলিং টপকে জলে নামছিলেন। একজন হড়কে পড়েও গেলেন। আমানুল হতাশ হয়ে বলল, “এ তো কিছুই নয় স্যার, জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে এখানে এত লোকের ভিড় হয়, এত লোক স্নান করে কি বলব—।” পরবর্তী গন্তব্য বামনী ফলস। আমানুল মাথা চুলকে বলল, “নামতে পারবেন কি? বিশাল খাড়াই, ধাপ কাটা আছে অবশ্য। পাথরে পা দিয়ে দিয়ে নামতে হয়।” কি আর এমন ব্যাপার? কাল জয়চণ্ডী পাহাড়ে উঠলাম, আর আজ পারব না?
বামনী ফলস সত্যিই বিশাল খাড়াই। নামার সিঁড়ি বলতে পাথরের ধাপ কাটা, কোথাও বা আড়াআড়ি গাছের শিকড়ই সিঁড়ির কাজ করে, জয়চন্ডী হিলের মত, পাশে কোথাও বসার জায়গা নেই। থাকবে কি করে? দুপাশে খাড়া পাহাড় আর জঙ্গল। মাঝে দু জায়গায় খাদের ধারে, গাছের সরু সরু ডাল একত্রে বেঁধে, তলায় দুটি বাঁশ আর ওপরে কাঠের তক্তা দিয়ে বেঞ্চের মত করা আছে। হাজার ক্লান্তি থাকলেও তার অপর বসতে আতঙ্ক হয়। নামা ওঠার রাস্তা এত সরু, যে এক সাথে দুই বা তার বেশি লোক নামতে বা উঠতে পারবে না। শৌভিক তুত্তুরীর হাত ধরে  নামতে লাগল, মুস্কিল হল আমার, নামতে গেলেই ভয় লাগে। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও আবার নড়বড়ে পাথর। মাঝে মাঝেই শৌভিককে ডাকতে হচ্ছে, ‘এই, একটু হাত টা ধর-।” শেষে আমানুল বলল, “স্যার আমি বাচ্ছাকে নামাচ্ছি, আপনি ম্যাডামের সঙ্গে নামুন।” সঙ্গে মানে, পাশাপাশি নামা নয়। শুধু চোখের সামনে থাকা, যাতে প্রয়োজনে হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারে।
(চলবে)