Saturday 2 September 2017

এক নম্বর ফরজানা


আশার ফোনটা যখন এল, ইউসুফ তখন অভ্যাগতদের সাথে গল্পে মত্ত ছিল। আজ বকরিদ। সকাল থেকেই দারুণ আবহাওয়া, সমুদ্র নীল রঙের আকাশে ভাসমান পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ, কাঁচা সোনা রোদে ঝকমক করছে কাদখালি গ্রাম। কিন্তু সে রোদ বড় মিঠে, অন্য দিনের মত চামড়া জ্বালানো রোদ নয়, মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। কোরবানি ভালো ভাবেই মিটে যাবার পর, আত্মীয়স্বজন- প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি মাংস বিলি করে সদ্য বাড়ি ফিরেছে ইউসুফ।ওনারাও কয়েকজন দিতে এসেছেন। রামনগর হাইস্কুলের হেড মাস্টার ইউসুফকে নিয়ে কাদখালির গ্রামের একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। শৈশবে যারা পাত্তাও দিত না, আজ তারাই ইউসুফ মাস্টার বলতে অজ্ঞান।

এই রকমই কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিল ইউসুফ, হঠাৎ পাঞ্জাবির পকেটে মৃদু কম্পন অনুভূত হল,আশার ফোন দেখে হাল্কা হাসির রেখা খেলে গেল ইউসুফের ঠোঁটে। রেহানা পাশের বাড়ির খালার সাথে গল্পে মশগুল ছিল, ইউসুফ হাসি চেপে বলল, “রেহানা, আশার ফোন।“ রেহানা, হাসি চেপে বলল, “বলে দাও মাংস খেতে হলে এখানে এসে খেতে হবে।“আশাবরী ইউসুফের সহপাঠী। পাশের রামনগর গ্রামেই বাড়ি, বরাবর একই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে একসাথেই দুজনে  একই সাথে পরীক্ষা দিয়ে প্রধান শিক্ষক হয়। ইউসুফ যেমন পাশের রামনগর হাইস্কুলের হেড স্যার, আশাবরী তেমনি কাটোয়ার একটি মেয়েদের স্কুলের বড়দি।  আশার বয়স পঞ্চাশ হলে কি হবে,বিয়ে থা করেনি এবং সাংসারিক ব্যাপারে এক্কেবারে অপদার্থ। আশার রান্না মুখে তোলা দুষ্কর। তাই প্রতি বকরিদেই রেহানা অর্থাৎ ইউসুফের ঘরণীই মাংস রান্না করে দেয়,আশা আসে, দুপুর বেলায় সবাই একসাথেই খাওয়া দাওয়া করে, রাতেও রেহানা, মাংস-রুটি করে ইউসুফের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় বিশ বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে আসছে, তবু প্রতিবার আশা ফোন করে, চিৎকার করে, “আমার মাংস কোথায়?”

ইউসুফ ফোন ধরে, আশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তরল গলায় বলে উঠল, “ আমি মাংস নিয়েই যাচ্ছিলাম রে, রেহানা যেতে দিল না। তুই চলে আয়-“। ইউসুফ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, আশার গলা শুনে চমকে উঠল, আশাবরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, “ইউসুফ ফরজানা এসেছে।“ মানে? ফরজানা হল ইউসুফ আর রেহানার একমাত্র অষ্টাদশী কন্যা। এ বছরই মেডিক্যালে চান্স পেয়ে কলকাতায় পড়তে গেছে। যথারীতি কলকাতায় এসেই মেয়ের পাখনা গজিয়েছে, বকরিদে একদিনের ছুটিতে তিনি নাকি আসবেন না। সামনেই লম্বা দুর্গা পুজোর ছুটি পড়তে চলেছে, তখন এসে আম্মি-আব্বুকে ধন্য করবেন। তাহলে হঠাৎ কি হল? কাল রাতেও মেয়ের সাথে কথা হয়েছে, সকাল থেকে হয়নি অবশ্য। ফরজানা আশাবরীর মন্ত্রশিষ্য, কিন্তু তাই বলে ঈদের দিন, এভাবে, ব্যাপারটা কিছুতেই ইউসুফের মাথায় ঢুকল না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শুধু বলল, “ফরজানা? কিন্তু বুল্টি যে বলল পুজোর ছুটির আগে আসতে পারবে না?” মেয়ের নাম শুনে রেহানাও অবাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আছে, আশাবরী ক্লান্ত স্বরে বলল, “ঐ ফরজানা নয় ইউসুফ। এক নম্বর ফরজানা।“

সুদূর মুর্শিদাবাদের দুটি ছোট গ্রাম, রামনগর আর কাদখালি। নাম শুনেই বোঝা যায়, একটি হিন্দু এবং অপরটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। শিয়ালদহ থেকে সকাল আটটা নাগাদ ছেড়ে কুঝিকঝিক করতে করতে লালগোলা প্যাসেঞ্জার যখন পলাশী  পৌছয় সূর্য তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই মধ্য গগন ত্যাগ করে। পলাশী ষ্টেশন থেকে রিক্সা বা বাসে করে আম বাগানের ভিতর দিয়ে রামনগর সুগার মিলের পাশ কাটিয়ে পলাশী হাইস্কুলের সামনে দিয়ে গিয়ে সোজা গঙ্গার ঘাট। আগে নাকি বর্ষা ছাড়া  অন্য সময় গঙ্গায় হাঁটু জল থাকত, তবে ফরাক্কা হবার পর, গঙ্গা সব সময়ই টইটুম্বুর। হাতে টানা নৌকায় চেপে ওপাড়ে রামনগর ঘাট। রাক্ষসী গঙ্গা প্রতিনিয়ত একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে রামনগর গ্রামকে, নৌকা থেকেই দূরে রামনগর সুগারমিলের জিএম বাংলো দেখা যায়। সাহেব দের বানানো সাবেকী কুঠি, লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ দিয়ে ঘেরা।এই সুগারমিলই ছিল রামনগর-কাদখালির লক্ষ্মী। মুর্শিদাবাদের উর্বর মাটিতে আখের ফলন হত দেখবার মত, সেই আখেই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ত সুগারমিল। সে সুদিন বহুদিন গত, আশাবরী-ইউসুফের ছোট বেলা জুড়ে শুধু ভাঙনের গল্প। আজব ব্যাপার মিলটা গঙ্গার এপাড়ে হলেও জিএম এবং এজিএম বাংলো কিন্তু ওপাড়ে, রামনগর গ্রামে। সাহেব সুবোদের ব্যাপার স্যাপারই অন্য রকম ছিল। এখন যদিও কেউ থাকে না ঐ বাংলোয়। চাপড়া খসে খসে পড়ছে, লাল কৃষ্ণচূড়ায় প্রতিফলিত পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মনে হয় রক্তাক্ত কুঠি একা দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করছে।

এই রামনগর গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী মজুমদার বাড়ির ছোট মেয়ে আশাবরী, কাদখালির ছোট্ট মুদির দোকানের মালিক এনায়েৎ মোল্লার মেজ ছেলে ইউসুফ আর ঐ গ্রামেরই তালাকশুদা ফাতিমা বিবির একমাত্র কন্যা ফরজানা একই সাথে রামনগর হাইস্কুলে ভর্তি হয়। সবে সত্তরের দশক পড়েছে, পশ্চিম বাংলা তখনও নকশাল দের রক্ত ধুয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু সেই রক্তের ছিটে আশা-ইউসুফ-ফরজানার জীবনে লাগেনি। আশাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল, ওর ঠাকুমা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মজুমদার গিন্নির ভয়ে তৎকালীন হেড স্যার যাকে আড়ালে সবাই মুচি মাস্টার বলত, প্রায় কাঁপছিল। ইউসুফ গিয়েছিল তার বড় ভাই ওয়াসিমের সঙ্গে, ওয়াসিম ঐ স্কুলেই ক্লাশ ফোরে পড়ত। আর ফরজানাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর মা, ফাতিমা বিবি। সেদিনেই ভর্তি, সেদিন থেকেই ক্লাশ। কোন ইউনিফর্মের বালাই ছিল না। বাড়িতে তিনজনেই ইজের পরে ঘুরত হয়তো, স্কুল বলেই ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা করে জামা ছিল। আশার থেকে ইউসুফের জামা একটু মলিন ছিল, আর ফরজানারটা তাপ্পি মারা ছিল। তাতে কি? রামনগর হাইস্কুলের ছারপোকাওলা বেঞ্চ সেদিন সাক্ষী ছিল, “শিশুর সাম্যবাদ।“ প্রথম দিন থেকেই তিনজন হরিহর আত্মা।

এক নম্বর ফরজানা (পর্ব -২)
রামনগর হাইস্কুলের দিনগুলি বোধহয় আশাবরী, ইউসুফ আর ফরজানার জীবনের সবথেকে বর্ণময় দিন ছিল। তিনজনের মধ্যে ফরজানা ছিল পড়াশোনায় সবথেকে ভালো। ফরজানা যেখানে ৭০/৭৫ এর নীচে নামত না, আশা আর ইউসুফ সেখানে কোনমতে পাশ টুকু করত, তাও একে অপরের ভরসায়। আশা ৪৫ পেলে ইউসুফ পেত ৪৪ বা ৪৬। শেষ বেঞ্চে বসে নরক গুলজার করাই ছিল দুজনের মোক্ষ।

কি যে সুন্দর দিল ছিল সে সব, রামনগর গ্রামের সীমানা বরাবর ছিল বিশাল আমবাগান। কথিত আছে এই সেই পলাশীর বিখ্যাত আম বাগান, সেই রক্তাক্ত রণাঙ্গন, যেখানে সুবা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব পরাস্ত হন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে। সেই আমবাগানের আয়তন ছিল নাকি কমবেশি প্রায় এক লক্ষ বিঘা। সিরাজের স্মৃতি বিজড়িত আমবাগানকে কেন্দ্র করে যাতে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সেন্টিমেন্ট না গড়ে ওঠে, তাই যুদ্ধে জয়ী হবার পর, নির্মম ভাবে, ঐ আমবাগান কেটে সাফ করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তী কালে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় ঐ এক লক্ষ বিঘা জমি কিনে নেন, জনৈক রামলোচন ঠাকুর। তাঁর নামেই রামনগর। পরবর্তী কালে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেই পূর্বেকার গঙ্গার খাতটা এখনও আছে, রামনগর আর কাদখালির মাঝে, অশ্বক্ষুরাকৃতি সেই হ্রদের স্থানীয় নাম বাদুরি। গঙ্গার ধার বরাবর আবার গড়ে ওঠে বিশাল আম বাগান। নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর বিশাল বিশাল মহীরুহ, নামে আম বাগান হলেও আসলে সুমিষ্ট আম আর রসালো লিচু গাছের পরিকল্পিত জঙ্গল। গরম কালে সেই আম বাগান ইজারা নিত ব্যবসায়ীরা, তাদের পেটোয়া লোকজন তাঁবু ফেলে বাগান পাহারা দিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই তিন মূর্তিকে আটকায় কার সাধ্যি।ঠাঠা রোদ হোক বা পড়ন্ত বিকেল বাঁদরের মত গাছে গাছে ঝুলে আম পাড়া ছিল দৈনন্দিন রুটিন। মিষ্ট আম লিচুর লোভে গাছ ভরে থাকত ঝাঁক ঝাঁক লাল পিঁপড়েয়, তাই সারা গায়, কেরোসিন তেল মেখে আম চুরি করে বেড়াত তিন মূর্তি।

তারপর আসত ভরা বর্ষা, প্যাচপ্যাচে কাদা মেখে হুড়োহুড়ি খেলা। ফি বছর বন্যা হত, জলে ভেসে যেত মাঠ-ঘাট। স্কুলও বন্ধ থাকত তখন। উপায়ন্তর না থাকলে কিছুদিন অদর্শনেই কাটত ওদের দিন। তারপর পুজোর দামামা বাজাতে বাজাতে আসত শরৎ। শরতে আশাবরীদের বাড়িতে দুর্গা পুজো হত, এখনও হয় যদিও,ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের সাথে সাথে ইউসুফ আর ফরজানারও চারদিন ধরেই নিমন্ত্রণ থাকত। দুর্গা মণ্ডপের সামনে বিশাল খোলা চত্বরে ঠেক বসত, কোথাও আশার বাবা-কাকা এবং তাদের বন্ধুরা বসত, কোথাও বা দাদা-দিদি-বউদি-জামাই বাবুদের ঠেক বসত, আশাদেরও নির্দিষ্ট ঠেকের জায়গা ছিল। পুজোর গান, শারদীয়ার গল্প আর মাস্টার মশাইদের নকলনবিশীতে কোথা দিয়ে যে কেটে যেত চারদিন হদিস থাকত না কারো। দশমীতে ভাসান দেখার আনন্দই ছিল আলাদা, এখানে বলে বাইচ বা বাচ। দুটি নৌকায় করে একচালা প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝ গঙ্গায়, তারপর নৌকা দুটি ক্রমশ আলাদা হতে থাকে, এক সময় ঝুপ করে মায়ের মূর্তি জলে পড়ে যায়। বিভিন্ন প্রতিমার মধ্যে বাচ প্রতিযোগিতা হত, গঙ্গার ঘাটে যেন মেলা বসে যেত ঐ দিনে। কাতারে কাতারে মানুষ, জাতিধর্ম নির্বিশেষে নতুন বা অপেক্ষাকৃত চকচকে পোশাকে ভিড় জমাত বাচ দেখবে বলে। পুজোর পরপরই বেশ ঠান্ডা পড়ে যেত। ডিসেম্বরে থাকত বার্ষিক পরীক্ষা, পরীক্ষা মিটলেই পুরো দমে দুষ্টুমি শুরু হয়ে যেত। ভোর বেলা খেজুরের রস চুরি করা, খেতের টাটকা মুসুর কড়াই, ওরা বলত মুসুরি চিবোতে চিবোতে বাদুরির ধারে আড্ডা, এক সাথে সাইকেল চালাতে শেখা, লুকিয়ে বিড়ি ফোঁকা, তারপর লেবু পাতা চিবিয়ে বাড়ি ফেরা, কি সব স্বর্গীয় দিন ছিল সে সব।

অষ্টম শ্রেণী অবধি রামনগর হাইস্কুলে পড়ার পর, ওরা ভর্তি হল পলাশী হাইস্কুলে। গঙ্গা পেরিয়ে এপাশে এসে, সাইকেলে মিনিট দশ লাগত, আর হেঁটে পনেরো মিনিট। আশা আর ইউসুফের সাইকেল ছিল, লেডিস সাইকেলের বালাই ছিল না, আশা ওর বাবার সাইকেলই নিয়ে যেত। কোনদিন আশা চালাতো ফরজানা সামনে বসত, আবার কোনদিন উল্টে বসত ওরা। তখন ওরা ক্লাশ নাইন, সেদিনের কথা ইউসুফ বা আশা আজো ভোলেনি, বাদুরির ধারে বিশাল পাম্প হাউসের সামনের চাতালে বসে গপ্প করছিল তিনজনে, ইউসুফ মাঝে মাঝে সাইকেলে চড়ে নানা কারিকুরি দেখাচ্ছিল, হঠাৎ কাদখালি থেকে একজন লোক দৌড়তে দৌড়তে এল, “ফজ্জানা!ফজ্জানা জলদি চল, ফাতিমা গায়ে আগুন দিছে।“
(চলবে)

Wednesday 23 August 2017

অনির বাঁকুড়ার ডাইরি


অনির বাঁকুড়ার ডাইরি ১১ই অগস্ট ২০১৭
ঘড়ির কাঁটা  সবে রাত এগারোটার ঘর স্পর্শ করল, বাইরে নিঝুম রাত। ঝিঝি পোকাদের সম্মিলিত কলতান  সেই নিস্তব্ধতাকে আরো মোহময় করে তুলছে। বারন্দার মিটমিটে সিএফএল আলোর পরিধি ছাড়ালেই নিকষ কালো অন্ধকার।শনশনে ভিজে ভিজে হাওয়ার মৃদু আস্ফালনের অস্ফুট শব্দ ভেসে আসছে চতুর্দিকের জঙ্গল থেকে। সব মিলিয়ে  ঘন রহস্যের অবগুণ্ঠনাবৃত এই রাত্রি।

শুরু করেছিলাম, কাল সকাল থেকে। পরিকল্পনা বেশ কয়েকমাস আগের যদিও।  গত ডিসেম্বরে বীরভূম আর ফেব্রুয়ারিতে পুরুলিয়া হয়ে গেছে, এবার গন্তব্য বাঁকুড়া।
দাঁড়ান।  বাঁকুড়া মানে বিষ্ণুপুর নয় কিন্তু। এ অন্য বাঁকুড়া। বিগত এক বছর ধরে আমরা মক্সো করছি, চুঁচুড়া থেকে সড়কপথে কামারপুকুর জয়রামবাটি হয়ে, জয়পুরের জঙ্গলে একটা রাত কাটিয়ে, বিষ্ণুপুর। সেই মোতাবেক কত শত ফোন যে চিত্রদীপদাকে করা হল তার ইয়ত্তা নেই। আমরা যখন মাদপুর, শ্রী চিত্রদীপ সেন তখন ছিলেন বিডিও জয়পুর। বহুবার আমাদের বাঁকুড়া ঘুরতে যাবার নিমন্ত্রণ  করেন, কিন্তু একটি বারও আমরা সাড়া দিতে সক্ষম হইনি। সময়ের সাথে সাথে চিত্রদীপ দা বদলী হয়ে হাবড়া থেকে এগরা ঘুরে কল্যাণী পৌছে গেল, আমাদের আর অবকাশ হয়ে উঠল না। আর ইদানীং যতবার এই নিয়ে চিত্রদীপদাকে ফোন করা হয়, বেচারা শৌভিকের কপালে গালমন্দ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।
১২ থেকে ১৫ই অগস্টের ছুটিতে আবার আমরা প্ল্যান করতে বসলাম। বারবার সব প্রিয়বন্ধুদের অনুরোধ করার পরও দেখা গেল কারো সাথে সময় মিলছে না। কি আর করা? তিনজনেই যাব মনস্থির করা হল। কিন্তু সব পূর্বপরিকল্পনা ঘেঁটে দিল দেবারতী দি। দেবারতী দি এককালে বরজোড়ার বিডিও ছিল, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গিরিও ইতিহাস আছে বাঁকুড়ায়। নিজের পূর্বসুখকর অভিজ্ঞতার নিরিখে দেবারতী দি বলল,“যদি বর্ষাকালেই বাঁকুড়া যাবে বল মনস্থির করে থাকো, তবে নকলী প্রসাধন করা সফিস্টিকেটেড বাঁকুড়া কেন? সেখানে যাও, যেখানে বাঁকুড়ার স্বাভাবিক রূপ, শত অবগুণ্ঠনেও আর ঢাকা যাচ্ছে না।”
শুধু আমাদের ট্যুরের দিক পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত  হল না দেবারতীদি, স্বেচ্ছায় আমাদের ট্যুরের স্বনিযুক্ত গাইড ও হয়ে গেল।

রোড ট্রিপ। দেবারতী দির নির্দেশ ছিল সকাল আটটার মধ্যে বেড়িয়ে পড়া। কিন্তু ঘুমন্ত কন্যাকে ঘুম থেকে তুলে, স্নান এবং ব্রেকফাস্ট করিয়ে চুঁচুড়া সার্কিট হাউস থেকে যখন বেরোলাম, ঘড়ির কাঁটায় পৌনে নয়।দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে যখন উঠলাম, আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি। প্রায় ঝাপসা চরাচর। জিপিএস বলছিল ঘন্টা চারেকের ধাক্কা। রাস্তা পুরো মাখন,হুহু করে দৌড়চ্ছে গাড়ি। হুগলীর সীমানা ছাড়িয়ে বর্ধমানে ঢুকলাম। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল, ফলে শক্তিগড় পেরোলাম কখন আর মনে নেই। ভারী ব্রেকফাস্ট করাই হয়েছিল এই কারণে যাতে শক্তিগড়ে না থামতে হয়। আর থামলেই বা কি হত? যা প্রবল বর্ষণ।

রাস্তা খারাপ হল, বর্ধমানের সীমানায় এসে। মুচিপাড়া থেকে বাঁকুড়ায় দামোদরের ওপরের ড্যাম পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বেশ খারাপ। বাঁকুড়ায় ঢুকে পড়তেই আবার মসৃণ তেলতেলে রাস্তা। রাস্তার নামটাও কি সুন্দর, বাঁকুড়া-বেলিয়াতোড়-বরজোড়া-সোনামুখী-খণ্ডঘোষ রোড। খুব চওড়া রাস্তা নয়। পথ ক্রমশঃ ফাঁকা হতে শুরু করল। বাড়ির  সংখ্যা কমে গাছগাছালি বাড়তে লাগল। দুদিকে দূরে দূরে ছোট বড় জনপদ, আর কি সুন্দর নাম তাদের-বংশল, মালকুড়িয়া, ফুলবাড়িয়া, চিকচিক, ফাগুয়াকানালি, শুনুকপাহাড়ি, নাখির, মাউলাডাঙ্গা, উপারকেচন্দা। এক অদ্ভূত রোমান্টিক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিল তরতাজা অক্সিজেনের মত, ক্লান্ত নাগরিক শিরাউপশিরায়।
নেট প্রায় হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। তবু বরজোড়া বিডিও অফিস দেখে আর সামলাতে পারলাম না, মেসেজ করলাম দেবারতি দিকে, “তোমার প্রাক্তণ কর্মভূমি দেখলাম। ”সঙ্গে সঙ্গে দেবারতিদির মেসেজাঘাত, “আর বেলিয়াতোড়ের জঙ্গল?” হ্যাঁ দেখলাম তো। অসাধারণ, শান্ত, আপাত দৃষ্টিতে ভদ্র মিষ্টি মিষ্টি জঙ্গল। দেবারতি দি বলেছিল কপাল ভালো থাকলে তেনাদেরও দেখা মিলতে পারে। আরে, দলমার দামালদের কথা বলছি। রাস্তায় বোর্ড ও টাঙানো  আছে, এটা হাতিদেরই রাস্তা। ওদের আগে পথ ছাড়তে হবে। কোনভাবেই ওদের রাস্তা আটকানো চলবে না। সর্বোপরি গাড়ির গতি ৩০কিমির ওপর না  রাখাই ভালো। দেবারতি দিকে জানালাম,“চোখের আরাম”।  সত্যি এত ঘণ সবুজ, সদ্য বর্ষণ ধুয়ে দিয়ে গেছে সব মলিনতা। সব কিছুই বড় টাটকা, তরতাজা।
ধ্বনি বলে একটা জায়গা পেরোবার অল্প কিছুক্ষণ পরেই, গন্ধেশ্বরী নদীর সেতু। এরপরই বাঁকুড়া। দেবারতি দি পইপই করে বলে দিয়েছিল, সপ্তপর্ণাতে লাঞ্চ সারতে। কোর্টে হাজিরা দিতে গেলে প্রতিবার ওখানেই দ্বিপ্রাহরিক আহার সারেন উনি। বাঁকুড়া ঢোকার মুখে শৌভিক বলল,“আবার বাঁকুড়ায় ঢুকব? সোজা বেরিয়ে গেলেই তো হয়? ক্ষিদে পেয়েছে কি?” না এত তাড়াতাড়ি ক্ষিদে পায়নি এটাও সত্যি। সবে সাড়ে বারো। আর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মুকুটমণিপুর ঢুকে যাওয়া যাবে। ওখানে পৌছেও লাঞ্চ করা যায়। ড্রাইভার ও বলল,“স্যার এখানে একটু চা বিস্কুট খেয়ে নিলেই চলবে। ”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেবারতি দির মেসেজ ঢুকল,“ এবার সপ্তপর্ণা। কলেজ মোড় হয়ে যাও, চাঁদমারিডাঙায় হোটেল সপ্তপর্ণা। ” গাইড দিদিমণিকে চটিয়ে লাভ নেই। জিপিএসকে বললাম নিয়ে চল- সপ্তপর্ণা।

অনির বাঁকুড়ার ডাইরি ১২ই অগস্ট ২০১৭ (পর্ব-২)

হোটেল সপ্তপর্ণা সত্যিই বেশ ভালো। বেশই ভালো। ডাকবাংলোর ঠিক পাশেই। ঝকঝকে, তকতকে, লজিং এরও ব্যবস্থা আছে। কালো কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে প্রায়ান্ধকার ঝিনচ্যাক বাতানুকূল রেস্তোরা। পরিচ্ছন্ন শৌচাগার। খাবারেরও অনেক অপশন আছে। চাইনিজ-মুগলাই থেকে ডাল-ভাত-চিকেন সব পাওয়া যায়। আমরা ছাড়া সেই মুহূর্তে আর কেউই ছিল না।
খাবারের স্বাদ যথেষ্ট ভালো। শৌভিকের মনপসন্দ চিকেন বিরিয়ানি, একই প্লেটে আপনি ভাত (সুগন্ধী ভাত) মাংস, আলু পাচ্ছেন। পকেট ফ্রেন্ডলি, পেটও ভরবে আর দিল ও। কে বলে বিরিয়ানি ধনীদের খাবার মশাই? অনেক খুঁজেও স্পেশাল বিরিয়ানী পেলাম না। স্পেশালে সাধারণত ভাতটা বেশি থাকে, দু টুকরো মাংস থাকে, আর থাকে একটি ডিম। আহাঃ। সাধারণত তুত্তুরী আর আমার জন্য একটি স্পেশাল বলা হয়। কিন্তু এ যাত্রা নর্মাল বিরিয়ানিই বলা হল। আসতে আনন্দ আর ধরে না, পাত আলো করে আছে একটা জ্বলজ্বলে ডিম। আহা কি আনন্দ।

এক চামচ মুখে তুলতেই অদ্ভুত আমেজে ভরে উঠল মন। দেখুন মশাই, আমাদের বাড়ির চারকোণায় চারটে বিরিয়ানি জায়েন্টের দোকান আছে। সিরাজ, রহমানিয়া, আমিনিয়া এবং আর্সালান।এদের বিরিয়ানির স্বাদ আমাদের ঠোঁটস্থ এতদসত্ত্বেও বলছি, এই বিরিয়ানি অনবদ্য। ভাতে মিশেছে ভাজা পেঁয়াজের  মণ্ড। হাওড়া স্টেশনে কামসামে (নাকি কামবারসাম?) একবার এই বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। ওরা বলে,“হায়দ্রাবাদি দম বিরিয়ানি। ” অসাধারণ খেতে লেগেছিল। তবে দামের তুলনায় পরিমাণে এতই কম। আমার যে কোন বন্ধুই যদি সাউথ ইস্টার্নে ট্রেন ধরে কোথাও বেড়াতে যায়, প্রায় তাদের পিছনে পরে থাকি,“ওরে একটি বার কামসামের বিরিয়ানিটা খাস”।
বিরিয়ানি খেয়ে দু এক চক্কর কম্পাউন্ডে হেঁটে আবার গাড়িতে চাপলাম। এবার সোজা মুকুটমণিপুর। জিপিএস বলছে এক ঘন্টাও লাগার কথা না। মুকুটমণিপুর তো যাব থাকব কোথায়?জানতে ফোন করেছিলাম শ্রী নব্যেন্দু মুখোপাধ্যায়কে। নব্যেন্দু বহু বছর এএলসি খাতরা ছিল। কতশত জন যে নব্যেন্দুর সহায়তায় মুকুটমণিপুর ঘুরে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য ঠিক এই সময়ই নব্যেন্দু খাতরা থেকে বদলি হয়ে গেছে। প্রায় আধঘন্টা ধরে নব্যেন্দু বোঝালো, কোথায় কোথায় থাকা যেতে পারে। কারা কারা চোর এবং কারা ডাকাত। প্রয়োজনে এখনও সবরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন ফোন রাখল, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। শুধু মনে পড়ল, ও বলছিল,“সোনাঝুরিতে থাকতে পারো। ড্যামের ওপর। লোকেশনটা অসাধারণ। একটু কস্টলি, তবে ডাকাত নয়।যদি বুকিং না পাও, জানিও। অন্য ভালো জায়গায় ব্যবস্থা করে দেব।  ” সোনাঝুরি ফরেস্টের ট্যুরিস্ট লজ। অনলাইন বুকিং পাওয়া গেল। বাতানুকূল কটেজ।  নিজেদের সৌভাগ্যে চমকে উঠলাম।

যাই হোক, চলেছি বাঁকুড়া থেকে মুকুটমণিপুর।ফুরফুরে মন, রাস্তা গুলি সোজা থেকে আস্তে আস্তে অল্প উচ্চাবচ হচ্ছে। কি অসাধারণ চকচকে রাস্তা, এই প্রত্যন্ত  অঞ্চলেও। হাল্কা সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কাঁসাই ব্যারেজ টপকে ওপাশে হোর্ডিং দেওয়া আছে সোনাঝুরি। বেশ খানিকটা গিয়ে, ফাঁকা টিলার ওপর জঙ্গলের মাঝে ফরেস্টের পর্যটকাবাস সোনাঝুরি।গাড়ি চড়ে টিলার ওপর উঠে আরো একতলা সমান সিঁড়ি ভেঙে উঠে, রিশেপসন। চতুর্দিকে আরো উঁচু টিলার ওপর ছোট ছোট কটেজ। সবই বোধহয় বাতানুকূল।  আর কি মিষ্টি নাম সব- শাল, পিয়াল, তমাল, হরিতকী, আমলকী,শতমূল, অনন্তমূল। একদম নীচে যেখানে গাড়ি থাকে, তার পাশে কয়েকটা ডর্মিটরি আছে। বড় গ্রুপ এলে তাদের জন্য। সেগুলি অত ভালো কিছু নয়। রিশেপসন তালা দেওয়া। শৌভিক পাশ দিয়ে আরো এক দু তলা সমান উঁচু কটেজে গিয়ে নেমে এল। ওটা ক্যান্টিন এবং ভালো ভিড়। ভাগ্যিস খেয়ে এসেছি। সবকিছু অসম্ভব পরিচ্ছন্ন। একটু পরেই একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছোট্টখাট্ট লোক দৌড়তে দৌড়তে এল,“স্যার আসেন। ” বলে রিশেপশনের দরজা ধরে টানাটানি করে, এক গলা জিভ কেটে দৌড়ল ওপরে, চাবি আনতে।
রিশেপশনটি ছোট। গোছানো। লোকটির নাম বনমালী। সই সাবুদ করিয়ে, কটেজের চাবি দিয়ে বলল,“স্যার এগোন। আপনাদের কটেজের নাম শাল। বোর্ড দেওয়া আছে। আমি মালপত্র আনতি যাই।” পর মুহূর্তে আবার একগলা জিভ কেটে বলল,“স্যার এইগুলা ফরেস্টের তরফ থেকে। উপহার। ” একটা চটের ছোট চেন টানা ভারি ব্যাগ উপহার পেয়ে তুত্তুরী তো মহা খুশি। ঘরে পৌঁছতে জিভ বেরিয়ে গেল। আরো অন্তত তিনতলা খাড়াই লাল পাথরের সিঁড়ি এবং খোয়া ফেলা সুন্দর সরু রাস্তা। অপরূপ সুন্দর গাছের কেয়ারি করা রাস্তার মোহ এক ঝটকায় কাটিয়ে দিচ্ছিল কুকুরের পুরিশের দুর্গন্ধ। একেবারে টঙে আমাদের কটেজ। পৌছে হাঁপাতে হাঁপাতে একটাই শব্দ বেরোল মুখ দিয়ে,“বাঃ। ” পুরো পটে আঁকা ছবি। সামনে ঘন সবুজ বাগান, পিছনে ইউক্যালিপটাস  গাছের জঙ্গল। অল্প দূরে আর একটি বড় চাতাল। সেখানে একটা একলা দোলনা, উদাস হাওয়ায় একাই দুলে চলেছে। আমরা দৌড়লাম তাকে সঙ্গ দিতে।  কাছে পৌঁছে মুখ হাঁ হয়ে গেল। নীচেই কংসাবতীর সুবিশাল নীলচে জলরাশি। জলরাশিকে আটকে রেখেছে একটি আঁকাবাঁকা ড্যাম। ড্যামের চকচকে নিরিবিলি রাস্তা যেন কুহকিনী, ডাকতে লাগল,“ আয়- আয়- আয়। ” ভেজা হাওয়া ফিসফিস করে বলল,“ যা-যা- যা”।
অনির বাঁকুড়ার ডাইরি ১২ই অগস্ট ২০১৭ (পর্ব-৩)

সোনাঝুরি থেকে নেমে একটু এগিয়ে, বাঁদিকে বেঁকে ড্যামে যেতে হয়। পথে অসংখ্য দোকানপাট তৈরি হচ্ছে। মাননীয়া মূখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করে গেছেন, ৫০টি স্টল তৈরি হবে। যার মধ্যে তিন চারটি খুলেও গেছে। ড্যামে গাড়ি যেতে দেয় না। ড্যামের মুখেই গাড়ি থেকে নামতে হয়, যদি না আপনি সরকারি আধিকারিক হয়ে থাকেন। গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেও চিন্তা নেই, বেশ কয়েকটি অটো ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের গাড়ি যদিও আটকালো না।
ড্যামের ওপর দিয়ে গাড়ি করে গেলে মন খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। ঝকঝকে এবং তকতকে সাদা রঙে মার্কা করা মসৃণ রাস্তা। দুটি বৃহৎ গাড়ি আরামসে পাশাপাশি  যেতে পারে। দুপাশে ফুটপাতের সীমানা নীল রঙ করা। ড্যামের দুইদিকে মূর্তিমান  বৈপরীত্য । একদিকে অথৈ জলরাশি। পড়ন্ত বিকালে শান্ত, উদাস প্রাজ্ঞের মত নিশ্চুপ। জলের রঙও টলটলে। যদিও আসার পথে সব নদীনালা, খালবিলের রঙ কাদাগোলা দেখতে দেখতে এসেছি। আর ড্যামের অপর পাড় ঘন সবুজ, উদ্ধত গাছপালা অনভিজ্ঞের মত সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু বাতাসে ঘনঘন মাথা দুলিয়ে রসালাপ করে চলেছে,যে কোন মুহূর্তে ঐ জলরাশি যদি আছড়ে পড়ে,  কি হতে পারে সেই নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কই?
মৃদুমন্দ  গতিতে গড়াতে গড়াতে গাড়ি গিয়ে থামল, বৃহৎ ড্যামের ওপারে। ওদিকে আড়াআড়ি ভাবে উঁচু টিলার ওপর একটা পার্ক আছে, নাম “মুসাফিরানা”।  টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উঠে সুসজ্জিত বাগান, সহজপাঠের মোটিফ দিয়ে সাজানো। পিছনে ইউক্যালিপটাস জাতীয়  বেশ কিছু বড় গাছের হাল্কা জঙ্গল। সামনে লম্বা রেলিং, রেলিং ওপারে টিলাটি খাড়া নেমে গেছে জলাধারে। রেলিং এ ভর দিয়ে ড্যামের দিকে তাকিয়ে দিন কেটে যাবে।
কি অসম্ভব ভ্যাপসা গরম যে ছিল সেদিন। অথচ বৃষ্টি হয়েছে। সাথে মশার উৎপাত। খুদে খুদে মশা, কখন কামড়াচ্ছে বোঝা দায়। মুসাফিরানা থেকে নেমে গাড়িতে উঠতে যাব, ড্রাইভার বলল,“স্যার ফিরে যাবেন? নাকি এগিয়ে দেখবেন?অনেকেই ঐ দিকে ক্যামেরা নিয়ে ভ্যানে করে চলেছে। ” বিকাল হয়ে গেছে যদিও, তবু এগোনো হল। একটু এগিয়েই আর একটা পুঁচকে ড্যাম। একই রকম চকচকে রাস্তা। এই ড্যামের একটা ফোকর দিয়ে অল্প জল ছাড়া হচ্ছে। নালাটার সাইজ গোটা চারেক হাইড্রেনের সমান। ঘোলা কাদা মাখা জল মহানন্দে বাঁধনছেঁড়া হয়ে লাফাতে লাফাতে চলেছে। এই জল ছাড়ার জন্যই এদিকে তৈরি হয়েছে এক ঘূর্ণি। আয়তনে নেহাত শিশু হলে কি হবে, কি শোঁ শোঁ আওয়াজ তার।
সন্ধ্যা নামছে, রাখাল সহ বাঁধের ওপর দিয়ে একদল গরু,  আমাদের পাশ দিয়ে নেমে গেল নীচের গ্রামে। একদল ছাগল এবং  ও ভেড়াও তাদের অনুসরণ করল। মনে হচ্ছিল সত্যিই বুঝি সহজপাঠে বর্ণিত কোন গ্রামে পৌছে গেছি।
পারিপার্শ্বিকে নিসর্গে আমরা মোহিত হয়ে গেলেও তুত্তুরীর একদম ভাল লাগছিল না।  একে তো ভ্যাপসা গরম, তায় বিকট মশা, যখনতখন শুঁয়ো পোকা আর বড় বড় কাঠ পিপড়ের আক্রমণ, জোঁকের ভয়, জলেও হাত দেবার কোন সুযোগ নেই, অভিমান করে তুত্তুরী বাঁধের ওপর বসেছিল। হঠাৎ  কোথা থেকে দুটো ছাগলছানা “মাম্মি মাম্মি” বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের কাছে এসে হাজির। কন্যার পুলক আর ধরে না। কিন্তু স্বনিযুক্ত মাম্মি যখন তার ছানাদের আদর করতে গেল, ছানা দুটো প্রবল বেগে “ব্যাব্যা” শব্দ করে উল্টো দিকে দৌড়ল। সাধে কি আর বলে “ছাগল”। কাজেই যদি তুত্তুরীর অভিমত শোনেন, মুকুটমণিপুর অত্যন্ত বাজে জায়গা, আর সবথেকে বাজে হল ওখানকার ছাগলগুলো। একদম যাবেন না। আর যদি যানও কোন ছাগল মাম্মি বলে ডাকলে কদাচ সাড়া দেবেন না কিন্তু। খুব বদ ওরা।
এরপর আর কি, সন্ধ্যার মুখে সোনাঝুরিতে প্রত্যাবর্তন। সন্ধ্যার স্ন্যাকস্ বলতে চা বা কফি আর পকোড়া। অনিয়ন পকোড়া বলে যেটা ভেজে দিল, খেতে মন্দ নয়। একে তো আগুন গরম, সিদ্ধ আলু, পেঁয়াজ, আদা এবং লঙ্কা কুচি একসাথে চটকে, চ্যাপ্টা বড়ার মত। ওপরে চাট মশালা ছড়িয়ে আর গোল গোল করে পেঁয়াজ কেটে পরিবেশন করে। কফি ও খারাপ নয়। সবথেকে বেশি স্পর্শ করে এদের আন্তরিকতা। এত ভালোবেসে খাওয়ায় যা আমি এর আগে শুধু পুরুলিয়ায় পেয়েছি। যেন মনে হবে আপনি ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত সম্মানীয় অথিতি।
শৌভিক বনমালীকে বলল, একটা লোকাল ছেলে খুঁজে দিতে। ড্রাইভার তো কলকাতার ছেলে, তার পক্ষে খুঁজে খুঁজে দেবারতিদির বলে দেওয়া সব স্পট বার করা অসম্ভব। গড় পঞ্চকোটে আমরা একটা বছর তেরোর কিশোর পেয়েছিলাম,তারই দৌলতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে ভাঙা মন্দির দেখা। ও না থাকলে ঐ মন্দিরে পৌছে নেমে আসা নেহাৎ স্বপ্ন মাত্র ছিল।
বনমালী কান মাথা চুলকে বলল,“কিচ্ছু চিন্তা নেই স্যার। সব বুঝিয়ে দেব ড্রাইভারকে। সোজা রাস্তা স্যার সব জায়গায় বোর্ড পাবেন। কোন সমস্যা হবেনা। এখানকার সব ছেলেই তো ব্যস্ত স্যার কাউকে পাবেননি। আর এই খানের লোকগুলান স্যার, কোথায় বলতে কোথায় নিয়ে যাবে। আপনি কিচ্ছু চিন্তা করেন না স্যার”।
এরপর আর কি?সোয়া নটা নাগাদ নৈশাহারে যেতে হল, ক্যান্টিনে। ব্রেকফাস্ট ঘরে পাওয়া গেলেও লাঞ্চ ডিনার ক্যান্টিনেই খেতে হয়। আগে থেকে বলে রাখতে হয় কি খাবেন, ওরা সেই মত বানিয়ে দেয়। খুব সামান্যই আয়োজন, ভাত বা রুটি বা পরোটা যদি চান। সাথে চিকেন বা ডিম বা মাটন। ডাল ফ্রাই আর স্যালাড। রান্না একদম ঘরের মত। আর এত যত্ন করে খাওয়ায় যে আপনি অভিভূত হয়ে পড়বেন। খেয়ে আধো অন্ধকার সিঁড়ি আর প্রায় অন্ধকার খোয়ার রাস্তা দিয়ে যখন কটেজে ফিরলাম, বাইরে নিশুতি রাত। শুধু ড্যামের উপর নিয়নজ্বলা পথ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ঝিঁঝিঁ পোকাদের কলতান আর মাঝে মাঝে ট্টিইট্টুহু করে কি একটা ডেকে উঠছে। আমরা ছাড়া শুধু এত বড় বড় শামুক গুড়গুড় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোমাঞ্চকর। এবার ঘুমাই। আবার কাল সকালে বেরোতে হবে।
অনির বাঁকুড়ার ডাইরি  ১৩ই অগস্ট (পর্ব-৪)     
   
কি ভালো যে ঘুমিয়েছি গতকাল রাতে, একেই বোধহয় নিশ্ছিদ্র  ঘুম বলে। একঘুমেই রাত কাবার। সব ক্লান্তি ফুৎকারে উড়িয়ে ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির কাঁটা সদ্য ছয়ের ঘর স্পর্শ করেছে। গতকাল রাতে বোধহয় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেছে, আকাশের মুখ ভার, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ  করে মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে, হীরের মত জলকণা। পিছনের জঙ্গলের ভিজে গাছগুলি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাটি থেকে ভেজা সোঁদা গন্ধ উঠে আসছে। কুয়াশাচ্ছন্ন ড্যামের পথ। নিস্তব্ধ চরাচর। হলুদ হলুদ একদল পাখি অদূরে গাছের ওপর ভিজে গায়ে রোম ফুলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। একেই বোধহয় নাগরিক ডিটক্স বলে। মাঝে মাঝে মোবাইল টাওয়ারের লুকোচুরি যেন এই ডিটক্সকে আরো ফলপ্রসু করে। কিছুই জানতে পারছি না, চতুর্দিকে প্রতিমুহূর্তে কোথায় কি ঘটে যাচ্ছে। এযেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্বেচ্ছা নির্বাসন।
স্নান করে, জলখাবার  খেয়ে পৌনে দশটা নাগাদ আমরা বেরোলাম। আজকের জলখাবার ছিল লুচি, আলুর তরকারি, সিদ্ধ ডিম আর রসগোল্লা। এক প্লেটে পাঁচটা লুচি থাকে। তুত্তুরী দুই আর আমি তিনটি লুচি খেয়ে হাঁপিয়ে গেলাম। ভাজা জিরেগুঁড়ো দেওয়া আলুর তরকারিটিও বেশ ভালো ছিল। বলাইবাহুল্য রসগোল্লাটিও খাসা ছিল।
প্রথম গন্তব্য ঝিলিমিলি। দেবারতি দি এবং বনমালী দুজনেই জানালো সোজা রাস্তা। দূরত্ব  তিরিশ কিলোমিটার মাত্র।মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগার কথা। রাস্তা খুব ভালো।
আজ আমাদের দিদিমণির নির্দেশ ছিল তিনটি স্থান পরিভ্রমণের- ঝিলিমিলি, তালবেড়িয়া ড্যাম এবং সুতান। সবই প্রায় রাণীবাঁধ এলাকায়। কয়েক বছর আগেও ওদিকে কোন পর্যটক যেতে সাহস পেত না। সুতানের বন বাংলো তো পুড়িয়েই দিয়েছিল তেনারা। এখন অবশ্য কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বনমালী বারবার বলতে লাগল, “সুতান যাবেন নে স্যার। ওখানে এখন এই বর্ষাকালে প্রচুর জঙ্গল হয়ে গেছে, দেখার মত কিছুই নাই।” বারবার একই কথা শুনে সত্যি বলছি  একটু
ভয় ভয় করতে লাগল। তবে কি অন্য গল্প আছে? সেটা বলার সাহস নেই বলেই জঙ্গলের বাহানা করছে বনমালী? জঙ্গল দেখতেই তো এসেছি। জঙ্গলে ভয় কি?
গাড়ি ছাড়তেই, নেট একবার মুখ দেখাতে এল। সঙ্গে সঙ্গে দিদিমণির মেসেজ,“ আজকের প্ল্যান কি?” বললাম। সুতান যেতে নিষেধ করছে তাও বললাম। মেসেজ ডেলিভার হবার আগেই নেট হাওয়া। একটু পরে নেট ঢুকতেই দেবারতী দির মেসেজ-“ কেন?সুতান যেতে বারণ করছে কেন? কালই তো এসডিও সাহেব গিয়েছিলেন, বিডিওদের নিয়ে। ফেবুতে ছবি দিয়েছেন। ” শৌভিক বলল,“দেখা যাক। ”
ঝিলিমিলির রাস্তাটা অপূর্ব। জিপিএস নির্দেশিত পথ ধরে চলেছি আমরা। মাঝে মাঝে জিপিএস ও ডোবায়, যেমন একটা চকচকে ব্রীজের কাছে এসে জিপিএস বলল, বাঁপাশের ভাঙাচোরা রাস্তা ধরতে। গাঁইগুঁই করতে করতে ড্রাইভার গাড়ি নামালো নীচে, একটু পরেই বোঝা গেল ওপর দিয়ে চকচকে ব্রীজটা গিয়ে যে রাস্তায় পড়েছে, নীচু মাটির রাস্তাটিও তাতেই মিশেছে। অর্থাৎ নতুন রাস্তার হদিশ জিপিএস এখনও পায়নি।
ঝিলিমিলি আসলে একটা বাজার। দর্শনীয় বিশেষ কোন স্থান আপনি পাবেন না। রাস্তাটাই অসাধারণ সুন্দর। দুই পাশে ঘন জঙ্গল, মাঝে চওড়া ঢেউ খেলানো রাস্তা। সেই রাস্তা আবার মাঝে মাঝে ঢালুতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। ওপাশে আবার শুরু হয়েছে নতুন রাস্তা। আর এই দুই রাস্তাচে জুড়েছে খানিক ঢালাই রাস্তা। বোঝাই যায়, ঐখান দিয়ে জল যায়। কোথাও সত্যি জল যাচ্ছেও। এযেন দক্ষিণ বঙ্গের নিজস্ব ঝোরা।
ঝিলিমিলি বাজার টপকে বেশ খানিক চলে যাবার পর আর জঙ্গল নেই, বরং চাষের জমি। ড্রাইভার তাও বলে চলেছে,“না স্যার, আগে নির্ঘাত কিছু আছে। ” জনমানুষশূন্য মেঠো  রাস্তা, দুপাশে চাষের জমি আর খেজুর গাছ। শেষে শৌভিক ফোন লাগাল দিদিমণিকে,“আর কিছু কি দেখার আছে ঝিলিমিলিতে?” জবাব এল নাঃ। এবার গন্তব্য তালবেড়িয়া ড্যাম। গাড়ি ঘুরিয়ে জিপিএস অন করতে দেখা গেল জিপিএস মৃত।
অনির বাঁকুড়ার ডাইরি (পর্ব -৫) ১৩ই অগস্ট ২০১৭

সিরিয়াসলি? যে জিপিএসের ভরসায় ঝিলিমিলি পৌছলাম, সেই দেহ রক্ষা করল? এবার কি হবে? মোবাইলেও টাওয়ার নেই। শৌভিক বলল, কোই পরোয়া নেই।সোজা যে রাস্তায় এসেছি, সেই পথেই ফিরে যাই। পথে বোর্ড দেওয়া আছে। কোন সমস্যা নেই। ঝিলিমিলি বাজারে এসে রাস্তা ওয়াই এর মত দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বাঁদিকের পথ ধরে এগোতে থাকা হল। ঝিলিমিলি যাবার পথে বেশ ঘন জঙ্গল পড়েছিল। কিন্তু এই পথে দুপাশে ধান ক্ষেত আর জনবসতি। ঠিক পথে এলাম তো? টাওয়ার অল্প মুখ দেখাতে,জিপিএস অন করে দেখা গেল তালবেড়িয়া ১৪১কিমি। এমনকি মুকুটমণিপুরের রাস্তাও দেখাতে অসমর্থ হল জিপিএস।  

রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা। প্রশ্ন করার মত লোক নেই কয়েকটা অর্ধ উলঙ্গ শিশু ছাড়া।  খুঁজে পেতে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করে ড্রাইভার মাথা নেড়ে ফিরে এল। বৃদ্ধ প্রকৃতিস্থ ছিল না। অতিকষ্টে এক দোকানদারের সহযোগিতায় অবশেষে আমরা আবার সঠিক পথে ফিরলাম।
তালবেড়িয়া বা তালবেড়া ড্যাম যেমন নির্জন তেমনি সুন্দর। আমরা ছাড়া আর গোটা দুই গাড়ি ছিল। জল স্বচ্ছ, টলটলে, আকাশের নীল রঙ জলে মিলেমিশে একাকার। চতুর্দিকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। ড্যামের মাঝে মাঝে দু একটা চর জেগেছে। তাতে দুই এক জন স্থানীয় বৃদ্ধ বসে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। কারো মাথায় ছাতা, কারো বা টোকার মত বড় টুপি। একটিও প্লাস্টিক বা আবর্জনা চোখে পড়ল না। পাশের জঙ্গলে একটা সরু পায়ে চলা পথ ঢুকেছে, সেই পথ ধরে অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেলাম আমরা। পথ ক্রমশঃ সরু হয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। তুত্তুরী ভয় পাচ্ছে দেখে আর এগোলাম না আমরা। এবার গন্তব্য সুতান।
দেবারতি দি ছাড়াও আরো কয়েকজন শৌভিকের কাছে  সুতানের সৌন্দর্যের সুখ্যাতি করেছিল। সুতান ভয়ানক সুন্দর তেমনি বিপদসংকুল। কয়েকবছর আগেও এ পথ মাড়ানো যেত না। এখনও সকলে পইপই করে বলে দিয়েছিল কোন মতেই বিকাল তিনটের পর যেন আমরা সুতানে না থাকি। দেবারতির সতর্কীকরণ ছিল, একবার ও পথে ঢুকে পড়লে আর গাড়ি ঘোরানো যাবে না। কাজেই বুঝে শুনে ঢোকাই ভাল।
সুতানের উচ্চাবচ পথে যখন গাড়ি ঢুকল, এক লহমায় মনে হল জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা। জনমানবশূন্য সরু পথ, দুপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল। জঙ্গলের বুক চিরে সরু মসৃণ পিচের রাস্তা। বর্ষার জল পেয়ে পিচের রাস্তার দিকেও হাত বাড়াচ্ছে জঙ্গুলে গুল্ম।  আকাশে সূর্য মধ্যগগনে, তাও কেমন গা ছমছমে আবহাওয়া।
জঙ্গলকে আরো ভালোভাবে অনুভব করার জন্য গাড়ি থামানো হল। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হবার সাথে সাথেই একরাশ নিস্তব্ধতা ঝাঁপিয়ে পড়ল কানের ভিতর। সে যে কি ভয়ানক দমচাপা স্তব্ধতা, একটা পাখিও ডাকছে না। এই জঙ্গলে পায়ে চলা পথ খুব বেশি নেই। বা থাকলেও সর্বত্র নেই।

তামিলনাড়ু কর্ণাটক সীমান্তে বন্দীপুর মুদুমালাই এর জঙ্গল দেখেছি, মনে হয়েছিল সফিস্টিকেটেড খেলনা জঙ্গল। বিশাল মাঠ জুড়ে ছড়ানো ছেটানো কিছু গাছপালা। জঙ্গল ছড়ানো ফাঁকফোকর ওলা হলে তবেই নাকি জঙ্গলের বাসিন্দাদের দেখতে পাওয়া যায়। ডুয়ার্সের জঙ্গল দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এর পাশে সেই জঙ্গল অনেক ভাবগম্ভীর, সমীহ জাগানো। কিন্তু সুতানের জঙ্গল কেমন যেন হিংস্র। গেরিলা যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত। তাই হয়তো তাঁরা এই জঙ্গলে লুকিয়ে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাত। এই জঙ্গলে একবার লুকালে জিপিএসের বাবাও আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে না। সবথেকে বড় কথা আমরা প্রায় যতক্ষণ  ছিলাম দ্বিতীয় কোন গাড়ি যায়নি ঐ পথে।
আবার গাড়ি রওনা দিল। এবার লক্ষ্য পুড়ে যাওয়া বন বাংলো। 
পিচের রাস্তা থেকে লাফিয়ে নামতে হল লাল মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তায়। বেশ খানিকটা যাবার পর, গাড়ি আর গেল না। ধ্বস নেমেছে। এদিকে নাকি হড়কা বানও হয়, বনমালী ভয় দেখিয়েছিল। সত্যিই তেমনি বানে হয়তো ধ্বসে গেছে রাস্তা। গাড়ি থেকে নেমে দূরে দেখাগেল ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে পোড়া বন বাংলোর দগ্ধাবশেষ। ঢুকতেই বাঁ দিকের প্রথম বাড়িটির গায়ে অসংখ্য বুলেটের দগদগে ক্ষত, দেখে গায়ে কাঁটা দেবে। ডানহাতে একটা নাতিদীর্ঘ ওয়াচটাওয়ার, পুড়ে কালো হয়ে গেছে। বড় বাড়িটির চাল ধ্বসে পড়েছে। আমরা ছাড়াও কয়েকজন ছিলেন। তাঁরা বললেন অদূরে আর একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। একটা ছোট ঝোরা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে, একটা শ্যাওলা ধরা জলাশয় পেরিয়ে আবার গহিন জঙ্গলে ঢুকলাম। এবার সত্যিই ভয় করছিল। শুধু আমরা ছাড়া আর জনমানুষ নেই। কোন বিপদ হলে চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। তুত্তুরি আর আমার করজোড় অনুরোধ না ফেলতে পেরে অবশেষে শৌভিক প্রত্যাবর্তনে সম্মত হল।
আবার সেই হিংস্র জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফেরা। পথে আর একবার গাড়ি থামানো হল। নামলাম না যদিও শুধু ফুসফুসে ভরে ধরে নিলাম ঐ নিস্তব্ধতা।

অনির বাঁকুড়ার ডাইরি(পর্ব ৬) ১৪ই অগস্ট ২০১৭

আজই বাঁকুড়ায় শেষ দিন। দিদিমণি বলেছিলেন, আজ শুশুনিয়া পাহাড়ের দিকটা ঘুরে আসতে। চাইলে বিষ্ণুপুর ও ঘুরে আসতে পারি। কিন্তু গতকাল রাতে নৈশ ভোজের সময় বনমালী দিল মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করে,“স্যার, শুধু শুধু কেন আবার অতটা উজিয়ে যাবেন আবার ফিরবেন, খামোকা তেল পুড়বে। আপনেরা বাঁকুড়া হয়েই তো কলকেতা ফিরবেন, ওখেন থেকে শুশুনিয়া এইটুখানি স্যার। ”
কাল বিকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যেই বর্ষাতি পরে বনমালী এন্ড কোং কটেজে কটেজে সান্ধ্যকালীন স্ন্যাকস্ অর্থাৎ আগুন গরম গোল গোল নরম তুলতুলে চিকেন পকোড়া আর কফি পৌছে দিয়েছে। আমাদের কটেজে এসে বনমালী খানিক গল্প করে গেল, হাত কচলে জানাল, বাজারে আনাজপাতি আর কিছুই নেই প্রায়। যা আছে আগুন দাম। তাই তরকারি সব্জি আজ আর হবে না। বদলে  খাসির মাংস আর নরম হাতে গড়া আটার রুটি দিয়ে নৈশ ভোজ সারতে হবে। একেই কি বলে তপ্ত পায় না আবার পান্তা? খাসির মাংস পুরুলিয়াতেও খেয়েছি এবার বাঁকুড়াতেও গেলাম, অনবদ্য। কোলকাতায় মাটনে ঐ স্বাদ আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
যাই হোক পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল, বৃষ্টি শেষে ঝকঝক করছে চতুর্দিক। শুশুনিয়া যখন যাবই না তখন কোন তাড়া নেই জলদি শয্যা ত্যাগ করার। আয়েস করে গড়াগড়ি খেয়ে, চা, আলুর পরোটা আর আলু চচ্চড়ি (আচার শেষ বলে বনমালী অন্তত ত্রিশ বার হাত কচলালো যদিও) আর গরম রসগোল্লা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরোলাম নৌকা বিহারে।
মুকুটমণিপুর থেকে নৌকা ছাড়ে। বোট বা লঞ্চ নয়, পাতি বড় ছাউনি দেওয়া কাটা তেল বা কেরোসিনে চলা নৌকা। ভাড়া ছয় শত টাকা।বনপুকুরিয়া স্পটেড ডিয়ার পার্ক, পরেশনাথের মন্দিরে নিয়ে যাবে। যেতে আসতে একঘন্টা কুড়ি মিনিট আর আপনি ঘুরতে যা সময় নেবেন। যদি মাইথনে নৌকা চেপে থাকেন, তাহলে এ অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। অথৈ জলের মধ্যে দিয়ে গুটগুট করতে করতে চললাম আমরা। চালক বলল, কুমারী এবং কংসাবতী নদীর মিলিত প্রবাহকেই বাঁধ দিয়ে আটকানো হয়েছে, এই গভীর জলরাশির মধ্যেই কোথাও মিলিত হয়েছে দুইটি নদী। প্রায়  আধ ঘন্টা পৌনে একঘন্টা পর, একটি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা চরে নামিয়ে দিল। এবার ভ্যানে চড়ে যেতে হবে বনপুকুরিয়া। গোটা কয়েক ভ্যানো দাঁড়িয়ে ছিল, একটি মারুতি ভ্যানও দাঁড়িয়ে ছিল।
ভ্যানেই চড়ে বসলাম তিনজনে। তুত্তুরী জীবনে প্রথম বার ভ্যানে চড়ল। মাথার ওপর গনগনে  সূর্য, তাও ছাতা খুলতে ইচ্ছে করছে না। পথ বড় কম নয়। দেড় দু কিলোমিটার তো বটেই, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু পিচের রাস্তা ধরে চলল ভ্যান। যতদূর চোখ যায় জঙ্গল আর জঙ্গল। তবে সুতানের সাথে কোন ভাবেই তুলনীয় নয়, অভয়ারণ্য টাইপ জঙ্গল। ভ্যান গিয়ে হাজির হল, একটা জাল দিয়ে ঘেরা বিশাল পার্কের সামনে। কয়েকটা অর্ধনগ্ন শিশু আমাদের ভ্যানের পিছন পিছন দৌড়ে এল, হাতে ব্যাগ। ব্যাগের ভিতর গাছের পাতা। হরিণকে খাওয়াতে চাইলে কিনতে হবে। বিক্রেতাদের দেখে ক্রয় নয় বরং আদর করতে ইচ্ছে করবে। বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক ও রাণীবাঁধেই অবস্থিত। প্রত্যন্ত অঞ্চল। বিশাল এলাকা নিয়ে পার্কটি। ভিতরে এবং বাইরে বেশ ঘন গা ছমছমে জঙ্গল। ট্যুরিস্ট খুব কম। যে কজন ছিলেন, সামনাসামনি পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল শিঙওয়ালা দুটি হরিণ দেখেই তাঁরা পুলকিত হয়ে গেছেন। 
আমরা এগিয়ে চললাম। গোল করে পার্কটিকে ঘোরার ইচ্ছে ছিল, ভিতরের দিকে আরো কয়েকটা হরিণ দেখলাম। তুত্তুরী গাছের পাতা ছিঁড়ে ডাকাডাকিও করল, কিন্তু তারা পাত্তাও দিল না। একজন করুণা ভরে পাতাটা শুধু শুঁকে দেখল। এতকাছ থেকে এতবড় শিঙওলা হরিণ এত অনায়াসে দেখতে পাওয়া বেশ ভাগ্যের কথা।
এরপর আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভ্যানে করে ফেরা। নৌকা এরপর যেখানে আমাদেরনিয়ে গেল, স্বচ্ছন্দে গাড়ি করেই যাওয়া যেত, কিন্তু এই নৌবিহারের থ্রিলটা অনুভব করা হত না। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ি ভেঙে উঁচু টিলার ওপর  পরেশনাথের মন্দির। পরেশনাথ আসলে শিব। বিশাল শিবলিঙ্গ কথিত আছে মাটি ফুঁড়ে উঠেছে। পাশেই কালো কষ্টি পাথরেরে একটি মূর্তি। একনজরে মনে হল, আদতে কোন জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি। এখানে সম্ভবত শ্রীবিষ্ণু রূপে পূজিত হচ্ছেন। ঠিক বলতে পারব না, কারণ ঐ দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের সোমবার। ঘড়া ঘড়া দুধ এবং জল ঢালা হচ্ছে শিবলিঙ্গের মাথায়, একাধিক পুরোহিত পুজোয় বসেছেন।  পূণ্যার্থী মহিলাদের ভিড়ে দাঁড়ানো দুষ্কর। পরেশনাথের মন্দির থেকে ড্যামটি আরো ভালো দেখা যায়। চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়।
নৌকাবিহার শেষ হলে, গাড়িতে চড়ে যাওয়া হল, দেবী অম্বিকার মন্দিরে। ১৩২০সালে তৈরি স্থানীয় কোন রাজা তাঁর রাণীর জন্য বানিয়েছিলেন। আহামরি কিছু নয়। অতঃপর সোনাঝুরিতে প্রত্যাবর্তন।
স্নান করে দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করে যখন উঠতে যাব, বনমালী এন্ড কোং এসে হাতটাত কচলে বলল,“স্যার, আমরা কাল একটু পতাকা তুলব। আপনি যদি তুলে দেন, খুব ভালো হয়। সব অথিতিদেরই বলা হয়েছে স্যার, সবাই থাকবেন, এই ধরেন আটটা নাগাদ যদি--”। শৌভিক দুর্বল লজিক দিল,ছয় বছর বিডিও থাকাকালীন বেশ অনেকবারই পতাকাত্তোলন করেছে, আর কেন? অন্য কোন সম্মানীয় অথিতি এবার তুললেই তো পারেন। কিন্তু তুত্তুরীর প্রবল উৎসাহের সামনে সেই লজিক খড়কুটো ছিল।
১৫তারিখ  ভোরে,শেষ মুহূর্তের প্যাকিং শেষ করে স্নান করে, কাচা জামাকাপড় যা অবশিষ্ট ছিল পরে, আমরা রেডি। ঠিক আটটায় বনমালীর ফোন, কি অপরূপ সাজিয়েছিল ওরা। সব কর্মচারীরা মিলে আবির আর ফুল দিয়ে সুন্দর সাজানো বেদীর ওপর বিশাল ডান্ডায় দড়ি দিয়ে নীচে ঝুলছে পতাকা। তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ বনফুল ভরছে একজন। সব অথিতিরাও হাজির। পতাকা উঠতে লাগল ধীরে ধীরে, কয়েকজন চিৎকার করে উঠল বন্দেমাতরম্। তারপর শুরু হল সম্মিলিত ভাবে জনগণমন। তুত্তুরীর বিস্ফোরিত  দৃষ্টি আর সোচ্চার  জাতীয় সঙ্গীত  কেমন যেন কানায় কানায় ভরিয়ে দিল ভাললাগার মধুর আবেশ। শুধু একটাই বেদনা এবার ফিরতে হবে--
(শেষ)