Tuesday 15 August 2017

বাবার ডাইরি থেকে

বাবার ডায়েরি থেকে ৩
এত নিঃশব্দ কালী পুজো কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। শুধু জানলার কাঁচে আছড়ে পড়া ঝমঝমে বৃষ্টির একঘেয়ে শব্দ। জানলার পাল্লার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা হিমেল হাওয়া মাঝেমাঝেই কাঁপন ধরাচ্ছে, এমন দিনে তারে বলাই যায়। বাবাকে ধরলাম, গল্প বল বাবা।সিগারেটে সুখটান দিয়ে বাবা বলল, “কিসের গল্প শুনতে চাও বল-”। ভূতের অবশ্যই। আবহাওয়াটাই তো ঝিম্ ধরানো ভূতুড়ে, বললাম,“ভূতে বিশ্বাস করো তুমি?ভূত আছে না নেই?” সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বাবা বলল, “আমি দ্বিধাগ্রস্ত। দুটি ঘটনা বলব, যা আমার চাক্ষুষ, এরপর তোমার বিবেচনাধীন”।
প্রথম গল্প- সময়টা ১৯৬৭সালের প্রথম দিক। সিপিআইএমের নেতৃত্বে গঠিত ইউনাইটেড লেফ্ট ফ্রন্ট আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে চলেছে। পার্টির নির্দেশে প্রচারের উদ্দেশ্যে তরুণ কমরেডদের ঘুরতে হচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে।অরুণ দত্ত, তাপস ব্যানার্জী,নিতাই ঘোষ এবং বাবা অর্থাৎ শ্রী অলোক চ্যাটার্জী চলেছে  দুর্গাপুর বলে একটা গ্রামের উদ্দেশ্যে।এমনিতে পার্টির ছটা উইং। এঁরা সকলেই পরোক্ষে ভাবে দলের সাংস্কৃতিক শাখা অর্থাৎ আইপিটিএর সাথে যুক্ত। আইপিটিএর প্রত্যক্ষ সদস্য যাঁরা, তারা আগেই চলে গেছেন, উলুবেড়িয়া মহকুমার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে মাঠে ঘাটে নাটক মঞ্চস্থ করছে। বাবাদের পাঠানো হয়েছে ওদের ওপর খবরদারি করার জন্য। সকলেই সুবক্তা,নাটক শেষে দলের হয়ে গণচেতনা গড়তেই ওদের দুর্গাপুর যাত্রা।
হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে বাগনান স্টেশনে নেমে, বাসে নাওলহাট। নাওলহাট থেকে পদব্রজে চাষের জমির আলপথ ধরে হেঁটে দুর্গাপুর। মুস্কিল হল,বিগত দিন চারেক ধরে প্রবল বর্ষণের ফলে আলপথ ধরে হাঁটা প্রায় দুঃসাধ্য। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা গুটিকয় রিক্সাওয়ালা জানালো ৪টাকা ভাড়া দিলে ওরা পৌছে দিতে পারে। ১৯৬৭সালে সেটা অনেক টাকা, কিন্তু শহুরে কমরেডরা নাচার। বাবার ভাষায় এই রিক্সা করে দুর্গাপুর যাওয়াটা বাবার জীবনে অন্যতম ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। পাকা রাস্তা ছাড়িয়ে রিক্সা আলে নামতেই হড়কে জমিতে পড়ল এবং পিছনের দুটি চাকাই আধ হাত কাদাতে ডুবে গেল। চারজন কমরেড, দুটি রিক্সা। দ্বিতীয় রিক্সাওয়ালা নিজের রিক্সা দাঁড় করিয়ে তৎক্ষণাৎ গেল প্রথমের মদত করতে। অতিকষ্টে তুলে কিছু দূরে দাঁড় করিয়ে যেই নিজেরটা গড়াতে গেল, ব্যাস একই গল্প। দু পা যায়, আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। নবীন কমরেডরা কি আর খেটে খাওয়া রিক্সাওয়ালাদের এই দুর্দশা প্রতক্ষ্য করতে পারে? ফলে ওরাও নামে, ছয় জনে মিলে, দুটি রিক্সাকে ঠেলতে ঠেলতে যখন গ্রামে পৌছয় সবকটা কাদা মেখে পাক্কা ভূত।
গ্রামে জনৈক সন্তোষ বোসের বাড়িতে ওদের থাকার কথা। সন্তোষের বাড়ির আলকাতরা মাখানো দরজা ঠেলে ঢুকে দেখে রীতিমত শোকের আবহ, লোকে লোকারণ্য। সন্তোষের বড় দাদা স্থানীয় এক আদিবাসী মেয়ের প্রেমে আকণ্ঠ  নিমজ্জিত ছিল। বাড়িতে লোকের অসবর্ণ  বিবাহে অসম্মতি সহ্য করতে না পেরে সে দিন চারেক আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যেহেতু অপঘাতে মৃত্যু তাই চতুর্থীর দিনই তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হচ্ছে।মাঝে গোল উঠোনকে ঘিরে চতুর্দিকে অনেক গুলি খড়ের চালের ঘর। উঠোনে অনেকে জড় হয়েছে, বিভিন্ন  ঘরের দাওয়ায় বয়স্ক, শিশু এবং মহিলারা বসে আছেন। সন্তোষই শ্রাদ্ধে বসেছে, যে ঘরে দাদা গলায় দড়ি দিয়েছিল,  ঠিক তার সামনের দাওয়ায় হচ্ছে শ্রাদ্ধ। ঘরে করা যায়নি, কারণ ঘরে নাকি ভয়ানক ভূতের উপদ্রব। ঐ দাওয়াতেও শ্রাদ্ধকারীএবং পুরোহিত ছাড়া কেউ বসেনি। পুরোহিত ভীতু চোখে বার কয়েক দরজার দিকে তাকিয়ে একবার বলেই ফেলল,  দরজায় তালা দেওয়া যায় কি না। দরজার দুটি কড়া একটা নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা। বাবারা ঐ দাওয়াতেই ব্যাগ রেখে বসেছে। শ্রাদ্ধ চলছে, হঠাৎ  একটা মৃদু খসখস্ শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সবাই। অভ্যাগতদের মধ্যে শুরু হল মৃদু গুঞ্জন। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ আরো সোচ্চার হয়ে উঠল, তাকে ছাপিয়ে বাড়তে লাগল খসখস গড়গড় মচমচ আওয়াজ। যেন উঁচু ঢালু খড়ের চাল বেয়ে কেউ নেমে আসতে চাইছে।দিনের বেলা, যদিও আকাশের মুখভার তবুও প্রকাশ্য দিবালোকে এক চাপা ভৌতিক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল,“পিণ্ডি খেতে আসছে সে। ”। কয়েকজন সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। আওয়াজ আরো বাড়ছে, ঘড়ঘড়, খড়খড়, ধুপধাপ। আওয়াজের তীব্রতা চরমে উঠতেই হুড়মুড় করে সবাই হাওয়া। পুরোহিত উবু হয়ে বসে “পিণ্ড দদামি” বলে চিৎকার করেই মারল এক লাফ। সন্তোষও লাফাতে উদ্যোগ নিতেই তাপস ব্যানার্জী খপ্ করে তাকে জাপটে ধরল-“ওরে শ্রাদ্ধ ছেড়ে উঠতে নেই বস। ” আর অরুণ দত্ত জাপটে ধরতে গেল পুরোহিতকে। খড়খড় আওয়াজটা তখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত,চার নবীন কমরেড ছাড়া বাড়ি ফাঁকা। সকলে পালিয়ে বাড়ির বাইরে কাঁচা রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুকি মারছে। অরুণ দত্ত চটজলদিতে পুরোহিতকে ধরতে পারেনি বটে চেপে ধরেছে তার টিকি। পুরোহিত আতঙ্কে চিৎকার করছে,“ওরে আমি নই রে। আমি নই।  তোর বিয়ে নিয়ে আমি তোর বাবাকে কিছু বলিনি বাপ। ছেড়ে দে বাপ্ ছাড়। ” ছাড় ছাড় করতে করতে পুরুত ঠাকুর এমন দৌড় মারলেন যে ওণার টিকিটা ছিঁড়ে রয়ে গেল অরুণ দত্তের হাতে আর তিনি পগার পাড়। খড়খড় আওয়াজটা আচমকা ধপাস শব্দে থেমে গেল, মনে হল চাল থেকে সে লাফিয়ে পড়ল। চার কমরেডের হৃৎপিণ্ড প্রায় গলার কাছে উঠে এল। সন্তোষ তখনও তাপসের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে কি দেখল ওরা চারজন? চালের ওপর বহু পুরাণো একটা কুমড়ো ছিল। যেটাকে বীজ কুমড়ো করার জন্য পাড়া হয়নি। সেটা এতদিনে শুকনো গাছের বৃন্তচ্যুত হয়ে গড়িয়ে নামছিল। নামার পথে বিভিন্ন ডালপালায় আটকে থমকে নামছিল বলেই এতক্ষণ ধরে খসখস মচমচ গড়গড় আওয়াজ হচ্ছিল। অতঃপর নিতাই ঘোষ দুহাতে সেই কুমড়োটা তুলে নাচাতে নাচাতে দরজার কাছে গিয়ে চিল্লাতে লাগল,“ওগো ভূত নয় গো, ভূত নয়। বীজ কুমড়ো। তোমরা ফিরে এস। ”  প্রথম গল্প এখানেই শেষ।
এবার দ্বিতীয় গল্প- আমারা বাবা মার প্রেমের গল্প এর আগেও কয়েকবার লিখেছি। কিভাবে এক জেল বন্দী নকশাল নেতার সাথে, সদ্য চাকুরীর সন্ধানে মহানগরে আসা পিতৃহীন এক গ্রাম্য মেয়ের আলাপ, প্রেম এবং পরিণয় হল সে এক রূপকথা। যাই হোক ১৯৭৪সালের পয়লা মে বাবা মার বিয়ে হয়। অসবর্ণ এই ভাবের বিয়ে আমার মামার বড়ির গ্রামে বিশাল আলোড়ন ফেলে।একদিকে যেমন গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা এই বিয়ে মোটেই ভালো চোখে দেখেনি অপরদিকে তেমনি মায়ের খুড়তুতো জেঠতুতো পিসতুতো বোন এবং তাদের বান্ধবীদের চোখে বাবা মা ছিল হিরো। পুজোর সময় বাবামা যখন গ্রামে গেল, সকলে দল বেঁধে এসে ভাব করে গেল জাম্বুর সাথে। বাবা বলল, “ খবরদার কেউ জাম্বু বলবি না। অলোকদা বলে ডাকিস। ” সুদূর মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার দিদার বাড়ি। গঙ্গার ওপারে একটা ইলেকট্রিকের খাম্বা পর্যন্ত ছিল না। যাই হোক এই শ্যালিকা বাহিনীর দৌলতেই অনেক বাড়ির অন্তপুরে প্রবেশাধিকার  পেল বাবা। গ্রামের অন্যতম প্রিয় জামাই। পরের পুজোয় যখন আবার শ্বশুরবাড়ি গেল বাবা,প্রায় রোলকল করার মত করে সব শালিদের খোঁজ নিতে লাগল। তখনই জানতে পারল মাসিদের এক বন্ধু অদিতি হৃদয়ে আঘাত পেয়ে, আগের দিনই নালার ওপাড়ে চাটুজ্জেদের আম বাগানে গলায় দড়ি দিয়েছে।তখন পড়ন্ত বিকাল বাবা মা দৌড়ল মণ্ডল পাড়া অদিতিদের বাড়ি। মা বাবাকে পেয়ে অদিতির বাবা মা উঠোনে বসে কান্নাকাটি করছে, থানায় খবর দেওয়া হয়েছিল,পুলিশ এসে প্রাথমিক তদন্ত করে বলে গেছে মরা পুড়িয়ে ফেলো। একটু আগেই গঙ্গার ধারে আম বাগানে নিয়ে গেছে দহন কার্যের জন্য। বাবারা কথা বলছে,হঠাৎ অদিতির ভাই দৌড়তে দৌড়তে এল,“বাবা দিদিকে ঝিলে তোলা হয়েছে। ” ঝিল হল চিতা। রামনগর অর্থাৎ আমার মামার বাড়ির গাঁয়ে বড় বড় কাঠ ক্রিশ ক্রশ করে সাজিয়ে অনেকটা উঁচু করে তার ওপর শবদেহ শোয়ানো হয়। তাকেই বলে ঝিল। ভাই বলল,“পুরুত ঠাকুর বলছে, গলার দড়িটাও চাই। ওটা সমেত পোড়াতে হবে,না হলে ওটা ঘুরবে যতক্ষণ  না আরো তিনজনের প্রাণ নিচ্ছে। ” অদিতির বাবা চোখ মুছে ঘর থেকে দড়িটা নিয়ে দাওয়া থেকে ছেলের দিকে ছুঁড়ে দিল দড়িটা-“এ নে”। ছেলেটি হাত বাড়াল,কিন্তু দড়ি তার হাতে পৌছল না।  সকলের চোখের সামনে ছোঁড়া দড়ি যে কোথায় গেল, তন্নতন্ন  করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেলনা। বিকাল বেলা হলেও যথেচ্ছ আলো ছিল, সকলে খুঁজল,কিন্তু দড়িটা যেন মিলিয়েই গেল বাতাসে।
ঘড়িতে মধ্যরাত্রি, গাটা কেমন শিরশির করে উঠল। জানতে চাইলাম তারপর, বাবা আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল,“তারপর আবার কি?” জানতে চাইলাম, বাকি তিনজন কেউ গলায় দড়ি দিয়েছিল কি না। বাবা বলল,“আমরা তো দশমীতে ফিরে এলাম। কাজেই কি হয়েছিল জানি না। তবে পরের বছর গিয়ে দেখেছিলাম অদিতির সেই ভাইটা পাগল হয়ে গেছে। জনে জনে জিজ্ঞাসা করে বেড়ায়, হ্যাঁ গো দড়িটা দেখেছো?দিদির গলায় দেওয়া দড়িটা যে কোথায় গেল, দেখেছো কেউ-”

বাবার ডাইরি থেকে #1-১৫ই অগস্ট ১৯৪৭
ঘোষণা তো হয়েছিল এক বছর আগেই। একই দিনে দুইটি দেশ স্বাধীন হবে না। পাকিস্তান স্বাধীন হবে১৪ই আর ঠিক তার পরের দিনই আমরা পেতে চলেছি আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এরপরই এল সেই কালো দিন, “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে”। তখন আমার কতই বা বয়স, পাঁচ সাড়ে পাঁচ  বড় জোর। তাও বেশ বুঝে গেলাম রায়ট কাকে বলে।
বাড়ির পাশেই তৈরি হল হাওড়া মিলনী ক্লাব। এরকম অনেক ক্লাব তখন রাতারাতি গজিয়ে উঠেছিল হাওড়া শহর জুড়ে। ক্লাবের আড়ালে আসলে প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা। ক্লাবে রাখা থাকত লাঠি, পেটো। পাড়ার সমর্থ  ছেলেদের প্রতিদিন শরীরচর্চা করা ছিল বাধ্যতামূলক। দাদা, ছোটকাকা, কেলো মামা এরা লাঠি ভাঁজত, ডন বৈঠক করত, আর আমরা হাঁ করে দেখতাম। মহিষাসুরের মত চেহারা ছিল ওদের। পাড়ার বাচ্ছা ছেলে এবং মেয়েদেরও আত্মরক্ষার নানা কৌশল শেখানো হত। সন্টুদা অর্থাৎ সন্তোষ কুমার বোস ছিল আইএনএ ফেরৎ মিলিটারি ম্যান। সন্টুদা আমাদের ড্রিল করাতো। আর ছিল ভীমদা। অ্যানার্কিস্ট মুভমেন্টের সাথে গভীর ভাবে জড়িত ছিল। পরে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। ভীম দা আমাদের বক্সিং শেখাত। ভজাদা ছিল আইপিটিএর সঙ্গে জড়িত। দারুণ গান গাইতে পারত। আমাদের দেশাত্মবোধক গান শেখাত ভজাদা।
১৯৪৭ এর ১৫ই অগস্ট আসার বহু আগে থেকেই প্রস্তুতি পর্ব শুরু হল। যেমন যেমন গেজেট নোটিফিকেশন বেরোত, বাবা এনে দিত মেজকাকাকে। মেজকাকা ফাইন খাদির কাপড় সেই মাপে কেটে, নির্দিষ্ট গেরুয়া এবং সবুজ রঙে ছুপিয়ে, নিজে হাতে সেলাই করে বানাল তেরঙা। দিনান্তে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে, বড় ফ্রেমে সেই তেরঙা পতাকাকে আটকে সুক্ষ্ম নীল রেশমি সুতো দিয়ে স্বহস্তে বানাল অশোকচক্র। অবশ্য মাঝে মাঝে অবসর পেলে মেজো কাকিমাও বসে যেত সূচিকর্মে।
১৪ই অগস্ট সকাল বেলায়, দাদা আর কেলো মামা একটা ঠেলাগাড়ি যোগাড় করে রওনা দিল বালটিকুরির উদ্দেশ্যে। দাশনগর স্টেশন পেরোলেই তখন আলামোহন দাশের ফ্যাক্টরি । আর ফ্যাক্টরির সীমানা ছাড়ালেই ধনী ব্যক্তিদের বৃহৎ বৃহৎ বাগানবাড়ি। সবগুলি বাগান বাড়িই ছিল একই ছাঁচের। আদতে একতলা ছোট একটা সুদৃশ্য বাড়ি আর একটা মর্মরে বাঁধানো বিশাল টলটলে পুকুর। আর এই বাড়ি এবং পুকুরকে ঘিরে ঘণ বাঁশ এবং দেবদারু গাছের নিরাপত্তার স্বার্থে পরিকল্পিত জঙ্গল। ওখানে শুটিংও হত। কাননদেবী ঐ পুকুর থেকেই স্নান করে উঠতেন, বা ঐ জমিদার বাড়িতেই প্রবিষ্ট  হতেন।
দাদা আর কেলো মামা খুঁজে পেতে সবথেকে লম্বা ঋজু বাঁশ আর প্রচুর দেবদারু পাতা কেটে নিয়ে এল। ঐ বাঁশের গায়ে পাটের দড়ি দিয়ে দেবদারু পাতা বাঁধা হল। অতঃপর যখন  তিনতলার ছাতে নিয়ে গিয়ে জানলার সাথে বাঁধা হল মনে হল এক বিশাল হুইস্পারিং দেওদার গাছ দাঁড়িয়ে আছে। দেবদারু পাতার আড়ালে লুকিয়ে তার টেনে বাঁশের মাথায় একটা বাল্ব লাগানো হল। মেজোকাকা বলত, আন্ডা লাইট। বাল্বের একটু নীচে লাগানো হল মেজোকাকার হাতে বানানো কপিকল। তার মধ্যে দিয়ে মেজোকাকা গলিয়ে দিল খুঁজে পেতে ওয়ার ডিসপোজাল থেকে কিনে আনা প্যারাশুটের দড়ি। যেমন মসৃণ তেমনি হাল্কা ছিল সেই দড়ি। সহজে জট পড়ত না। সেই দড়ি দিয়ে ঝোলানো হল তেরঙা।
ঠিক রাত বারোটায় গমগমিয়ে উঠল আকাশবাণী। দেশবাসী সাক্ষী রইল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহর লাল নেহেরু দেশবাসীর উদ্দেশ্যে রাখলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। তারপর, লালাকেল্লা থেকে ধীরে ধীরে নামিয়ে নেওয়া হল ইউনিয়ন জ্যাক আর ধীরে ধীরে উঠতে লাগল আমাদের জাতীয় পতাকা। বাবা ইশারা করল, উঠোনে একসাথে বেজে উঠল একাধিক মঙ্গলশঙ্খ।সেই ধ্বনি গুঞ্জরিত হল দূর দূরান্তে। সব বাড়ি থেকে ভেসে আসতে লাগল শঙ্খধ্বনি।  এতদিন শাঁখ বাজত শুধু শত্রুর আগমন বার্তা জানাতে, শাঁখ বাজলেই পাড়ার সমর্থ পুরুষরা দৌড়ত ক্লাবের উদ্দেশ্যে, লাঠিসোঁটা নিয়ে তৈরি হতে। আর আজ শাঁখ বাজল এই বার্তা নিয়ে যে আমরা স্বাধীন।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সব অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা মাঠে জড় হল। মেয়েদের পরণে সাদা ফ্রক, পায়ে সাদা কেটস্ আর মাথায় গান্ধী টুপি। আর ছেলেদের পরণে সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা হাফ শার্ট। সন্টুদা সবাইকে লাইনে দাঁড় করালো। সূর্যের প্রথম রোশনির সাথে বাবা পতাকা তুলতে লাগল। বেজে উঠল শৈলদার বিউগল আর অজিতদার কেটল্ ড্রাম, ভজাদার অঙ্গুলির তালে তালে আমরা প্রাণ খুলে গাইতে লাগলাম,“ জণগণমন”। পতপতিয়ে উড়তে লাগল আমাদের তেরঙা।
এরপর? পাড়ার সব সম্পন্ন বাড়ি থেকে চাঁদা দিয়ে আয়োজন করেছিল, সব বাচ্ছা ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দিল বাটার পেপারে মোড়া দু পিস বাটার ব্রেড, একটা করে সিদ্ধ ডিম,একটা কলা আর কমলালেবু। হ্যাঁ তখন অগস্টে বেশ ঠান্ডাঠান্ডা আমেজ থাকত, কমলালেবুও পাওয়া যেত। এরপর কয়েকটা লরি বোঝাই করে আমাদের নিয়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে হাওড়া শহর পরিদর্শনে বেরোনো হল। জনগণের সে কি উল্লাস। আজ থেকে আমরা স্বাধীন।
সন্ধ্যাবেলা বাবা, মেজোকাকা, ছোটকাকা, দাদা আর কেলোমামা আমায় নিয়ে পায়ে হেঁটে বের হল বেলিলিয়াস রোডের দিকে। এতদিন এই অঞ্চলে আমাদের প্রবেশাধিকার  ছিল না। রায়টের কারণে বেলিলিয়াস স্কুলও বন্ধ ছিল অথবা অন্য কোথাও সরে গিয়েছিল আজ আর মনে নেই। গলি গলি দিয়ে নরসিংহ দত্ত কলেজের সামনে বেরিয়ে, বেলিলিয়াস রোড ভরে ফাঁসি তলার দিকে চলেছি আমরা। এদিকেও খুশির মেজাজ। কি দারুণ আলোর রোশনাই। সব দোকানপাটের সামনে ভারত এবং পাকিস্তানের পতাকা লাগানো। সবাই আজ ফ্রিতে খাবার দিচ্ছে। অনেক পরিচিত হিন্দু দেখলাম, নো বিফ সেকশন থেকে খাচ্ছেও। কেউ কেউ এসে আমাদের হাতে মিষ্টি ধরিয়ে আদর করে চলে গেল। অবাক হয়ে গেলাম, এরা তো বেশ ভালো মানুষ। আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। তাহলে? কেন এত হানাহানি, অহেতুক রক্তপাত?
বাবার ডাইরি থেকে #২

"৭০তম স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিচারণ —

নামটার সাথে আমার বয়সের সংখ্যাটা জুড়ে আছে । আমার পরমাত্মীয়া একমাত্র কন্যা আমার পরমগতির দিনক্ষণ স্থিরিকরণের ব্যাপারে অতিসতর্ক । নিয়মিত  (পশ্চিম) বাংলার সেরা দুই ডাক্তাররের কাছে আমার হাজিরা বাঁধা — দুজন কেন? না আমার হেল্থ রিপোর্ট  ক্রশ চেক করতে হবে যে !

যদিও মালটিপল্ অরগ্যান ফেলিওর , আমার মাথা ছাড়া সর্বাঙ্গই ছুয়ে ফেলেছে, তবুও ডাক্তারবাবুরা যখন উচ্ছাসিত হয়ে বলেন, “এই বয়সে এত ভালো স্বাস্থ্য অসম্ভব, আমরা আগে দেখিনি”— তখন আমি তো খুশি হই-ই,  আমার মেয়ের মুখটাও প্রভাত সূর্য্যের রঙে দেদীপ্যমান  হয়ে ওঠে !

প্রাক স্বাধীনতা যুগের আমার প্রাচীনতম  স্মৃতি হল ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ অভিঘাত । বাড়ি থেকে  পায়েচলা দুরত্বে বৈকুন্ঠ চ্যাটার্জী লেনে তেলিবাড়ীর মাঠে একটা জাপানী বোমা পড়েছিল । ফলে হাওড়ার শিল্পাঞ্চলের ব্যাপক বাসিন্দারা দ্রুত শহরছেড়ে সুদুর গ্রামাঞ্চলে  সরে যায়। আমাদের সম্পুর্ণ পরিবারটা কিন্তু সেই ভূতুড়ে  শহরেই ছিলাম! বাবা/কাকাদের  যুক্তি  ছিল — সসৈন্যে নেতাজী যখন শহরে প্রবেশ করবে , তখন তাঁকে বরণ করার জন্য তো কা‘উকে না কা‘উকে থাকতে হবে !
        ছোটকাকা সাইকেলের সামনে বসিয়ে একদিন বোমা পড়ার জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে এনেছিল। এখনকার আন্দাজে বিস্ফোরণের ফলে ৬০‘লম্বা ,৬০‘চওড়া, ৬০‘গভীর একটা ডোবা হয়েগিয়েছিল  মাঠটা।
     যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের খেলাছিল পুরানো খবরেরকাগজ থেকে কেটে কেটে ফিতের মত ফালি তৈরী  করে ময়দা আঠা দিয়ে কাঁচের শার্সিগুলোতে বাঘবন্দী খেলার ঘর আঁকা— যাতে করে বোমার শব্দে কাঁচগুলো স্প্লিন্টারের মত ভেঙে ছড়িয়ে না যায় ।
       আর সকাল বিকাল আমাদের জমিতে কাটা দুটি বিশাল সর্পিল ট্রেন্চের ভেতর নেমে ছোটাছুটি করা ছিল বাচ্ছাদের চরম আনন্দের বিষয় ।

যুদ্ধের শুরুতে আক্ষরিক অর্থে শিশুই ছিলাম,তাই সে হিসাবে ৪০এর মন্বন্তর আর ৫০ লক্ষ নিরন্ন বাঙালির মহানগরীর পথেঘাটে মৃত্যুর  ‘আঁখো দেখা হাল’ কিছু বলতে পারবো না । তবে কর্মক্ষেত্র থেকে বাবা-কাকারা বাড়ি ফিরে যেসব আলোচনা করতো তা শুনে   বুঝতে   পারতাম যাতায়াতের রাস্তায় মৃতদেহে স্তুপ পড়ে থাকতো।
কিন্ত সকাল ৮টার মধ্যেই সামরিক প্রশাসন  ‘ডাম্পার“ দিয়ে মৃতদেহগুলি রাস্তা থেকে চেঁচে তুলে জাতিধর্মনির্বিশেষে গণদাহকার্য্য সম্পাদন  করতো। এদের বলাহত গাদার মড়া । এ কাজের জন্য নির্মিত বিশেষ একধরণের চিমনি  হাওড়ার বাঁশতলা ঘাঠ শ্মশানে অনেক দিন ছিল ।
শোনাকথা ৫০লক্ষ মৃতদেহ দাহ করার জন্য ৫বছর  ২৪ঘন্টা চুল্লিগুলো জ্বলেছিল !
এই সময়টা আমাদের ৩০/৩৫জনের সংসারটাকে খুব একটা খাদ্য-কৃচ্ছতা মধ্যদিয়ে যেতে হয়নি । যুদ্ধের শুরুর প্রথমদিকেই একধরনের বেসরকারী  রেশন ব্যবস্থা চালু হয়। বাবা,মেজকাকা ও ছোটকাকা যে যার কর্মস্থল থেকে ‘ফুল রেশন’ পেতেন ।  এছাড়া আমাদের বসন্তরায়তলা (৭৫) আর বালটিকুরির (২৫) মোট  ১০০বিঘা জমিতে উৎপাদিত মোটা চালের ভাগ পেতাম।
ঘেরা বাড়ির পাকা বিশাল উঠানের পাশে সমপরিমাণ কাঁচামাটির বাগানে দুটি বিশাল উনুন  বানানো ছিল । সাত-সকালে ঘরেবাইরের বাগান-জমি থেকে শুকনো ডাল-পালা পাতা  কুড়িয়ে নিয়ে এসে ও দুটিতে আগুন দেওয়া হত। দুটো বিশাল হান্ডায় টইটম্বুর জল আর পরিমান(কম)  মত খেতের মোটা চাল দিয়ে ফ্যান তৈরি   করা হত । একটা বড় মালশায় থাকতো লবণ ।
সকাল ৮থেকে জীবন্ত  নরকঙ্কালেরদল আর্তকরুণ ক্রন্দনে এসে জমাহত আমাদের সদর দরজার সামনে । ঠাকুমার নির্দেশে বয়স-নির্বিশেষে সবাই পেত এক ডাবুহাতা ফ্যান আর যথেচ্ছ লবণ ।
এ কর্মকান্ড চলতো সকাল ৮থেকে দুপুর ১২টা অবধি কারণ বুভূক্ষু ভিখিরিরাও তখন ‘এথিক্স’ মেনে চলতো — গৃহস্থঘরে সকাল ৮টার আগে ভাতের হাঁড়ি নামে না, আর দুপুর ১২টার  পর ভিক্ষা দেওয়া  অনুচিত !

৮০বছর আগে বাঙালি  মহিলার যথেষ্ট ধর্মপ্রাণ ছিলেন ।  নানা যোগে তাঁরা দলবদ্ধ ভাবে,সূর্য্যোদয়ের আগে গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ(?) হয়ে বাড়ি  ফিরতেন ।  ভোররাত্রে রাস্তায় দলবদ্ধ মহিলাদের পিছনে প্রায়শ বৃটিশ-অ্যামেরিকান-নিগ্রো সেনারা ট্রাক নিয়ে তাড়া করতো। তাঁরা আত্মরক্ষার্থে আসপাশের সরুগলিতে ঢুকে পড়তেন । দু-চার জন ধরাও পড়তো ।
বিবাহবাড়িতে  ফরসা বউএর কোলে কালোছেলে বা কালো বাবার হাতধরে ফরসা মেয়ে দেখলে দাদাশ্রেনীর যুবকরা মুচকি হেঁসে বলতো — “ওয়ার প্রোডাক্ট”।

জমি থেকে সামন্তপ্রভু , কলকারখানা  থেকে পূজিপতির উদ্ভবের কথা আর্থ-সামাজিক  দর্শনে ব্যাক্ষা করা আছে ।  বিশ্বযুদ্ধ  সমাজে ৩য় একশ্রনীর শোষকের জন্মদিল— তারা হল কালোবাজারি । এরাই স্বাধীনতা- উত্তর ভারতের নিয়ামক হয়ে ওঠে ।

পরাধীন  ভারতের শেষ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ  ঘটনা
১) নেতাজীর অন্তর্ধান ও আজাদ হিন্দ ফৌজ। ২) গান্ধীজীর ভারত-ছাড়ো আন্দোলন ।
৩) জিন্নার “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”/ডাইরেক্ট অ্যাকশন । 

এসবই একজন শিশুর কানে শোনা বড়দের আলোচনার প্রতিস্মরণ যা ভবিষ্যতে লেখা  ইচ্ছে রইলো !"
(টুকলি করা)

Monday 7 August 2017

অনির বচন

অনির বচন #৪ পঁচিশে বৈশাখ, ১৪২৫
বলি কি, আজ তেনার জম্মদিন কি না, তাই চলুন না প্রেমঘটিত বিরোধের আজ এখানোই ইতি করি। মুষ্টিমেয় বয়ঃজ্যেষ্ঠ দিন কয়েক আগে, খোদ দমদম ইস্টিশনে যে প্রেমিক যুগলকে দমদম দাওয়াই দিয়েছিলেন, তা নিয়ে যথেষ্ট কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি  তো হল, এবার মুন্নাভাইয়ের ভাষায়, “যানে দে না মামু। ”
প্রথমতঃ সংগৃহীত  ছবিটা যদি ভালো করে দেখেন, তাহলে পক্ক কেশ জনাকয়েক বৃদ্ধের পাশে রীতিমত জ্বাজ্জল্যমান কৃষ্ণকেশ নিত্যযাত্রীকুল।
দ্বিতীয়ত বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, যে কোন কর্মব্যস্ত দিনে, দমদম ইস্টিশনে যতজন বুড়োহাবড়া থাকেন,ঠিক ততজনই অথবা ততোধিক তরুণ-তরুণী থাকেন কিনা? তাহলে ক্রুদ্ধ দাদুরা যখন নাতিনাতনীদের পিটিয়ে ছাতু করছিলেন, তখন স্টেশনে উপস্থিত অন্যান্য তরুণকূল কি করছিলেন?
তৃতীয়্তঃ আমার বদ্ধমূল ধারণা প্রেম নিয়ে উভয় পক্ষেরই কোন বিরোধ নেই। বিরোধ জনসমক্ষে ভালোবাসার প্রকাশের শালীনতা/ অশালীনতার মাত্রা তথা সংজ্ঞা নিয়ে। মাঝেসাঝে মেট্রো চড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,আপনি  দরজা আটকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  হলে যদি আমি নির্দিষ্ট ইস্টিশনে না নামতে পারি, তাহলে কিন্তু আমারও হেব্বি রাগ হবে মাইরি।
তাই বলে আইন স্বহস্তে তুলে নেওয়াটা কোন মতেই মেনে নেওয়া যায় না। ঠিক যেমন মেনে নেওয়া যায় না,বৃদ্ধ মানেই বিকৃতকাম, কনুই খোঁচানো আপদ। মোটেই নয়। হয়তো তাঁরা বলতেন,“রোকে জমানা চাহে, রোকে খুদাই তুঝকো আনা পড়েগা-”। আমরা বলেছি,“শরমানা ছোড় ডাল/রাজ দিলকা খোল ডাল/ আজুবাজু মত দেখ/ আই লাভ ইয়্যু বোল ডাল-” আর আপনারা বলেন,“ জিস অউর তেরি শেহনাই/উস্ অউর ম্যায় ভাগু রে”- মোদ্দা কথা এট্টাই, “ বুঝিতে॥
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,কে মোরে ডাকিবে কাছে,
কাহার প্রেমের বেদনায়/আমারও মূল্য আছে,
এ নিরন্তর সংশয়ে হায়ষপারি নে যুঝিতে--
আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে॥”
তাই আজ বলি সব পুরাতন প্রেম(এবং বিদ্বেষ) ডাকা পড়ে যাক নব প্রেম জালে-থাকুক শুধু প্রেম। আসুন ভালোবাসি এবং অন্যদেরও ভালোবাসার সুযোগ করে দি। সুখে থাকুক সমস্ত রিজওয়ানুর এবং প্রিয়াঙ্কা,সুখে থাকুক পাড়ার খ্যাঁদা এবং বুচি। জ্বলে উঠুক ভালোবাসার আগুন, সোনার মতই সব খাদ ঝরাতে ঝলসে যাক বিষাক্ত ভাগাড়ে বাঙালী।
আর আমার জীবনের সব বুড়ো/বুড়িদের বলি, “আই লাভ য়্যু। তোমরা যেমন তেমনি থেকো। ”

অনির বচন ৩ ৫ই নভেম্বর  ২০১৭
মাঝেমাঝেই হেব্বি দুঃখ হয় জানেন। তীব্র ক্ষোভ হয়, কেন ভগবান কেন? এত সাধারণ কেন আমি?কোন বিশেষত্ব নেই,মধ্যম মেধা,মধ্যম মানের লোকজনের শেষ পংক্তিতে কোন মতে ঠেসে ঠুসে জায়গা পেতে পারি। চারপাশে সকলেই হয় চোখ ধাঁধানো সুন্দর, নয়তো কি বিস্ময়কর তাঁদের পাণ্ডিত্য, কারো গান কানে মধু ঢালে,কারো আবৃত্তির গুঞ্জন বহুক্ষণ পরেও কানেও গুনগুন  করে,কারো কবিতা মুহূর্তে নিয়ে যায় অন্য পৃথিবীতে, কারো প্রবন্ধ পড়ে নিজের অজ্ঞতায় কান্না পায়, কারো আঁকা ছবি স্তব্ধবাক হয়ে দেখি, সত্যি বলছি মা কালীর দিব্যি আমার ফেবুর টাইমলাইনে যে কয়জনের লেখা ফুটে ওঠে সকলেই  আমার থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ এগিয়ে, কেউ তো আবার একাধিক গুণের অধিকারী। বহুত না ইনসাফি হ্যায়।
কিন্তু মন খারাপ করে বসে থাকব, তার কি উপায় আছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ ফোন করে চারটে কুৎসিত গালি সহযোগে বলবে, তোর সুখের দিনে আমায় ফোন করিস না ভাই কিচ্ছু মনে করব না। কিন্তু সমস্যার কথা যদি না শেয়ার করিস তাহলে বুঝব যে আমাকে বন্ধু বলেই ভাবিস না। পর মুহূর্তে কেউ দৌড়ে জিজ্ঞাসা করবে, মা পায়েসে কি মিশিয়েছো গো?অমৃত? এত ভালো খেতে হল কি করে? কিংবা কেউ বলবে, সর বাপ! অনেক হয়েছে। তোকে আর পেঁয়াজ কেটে কাজ নেই। যে রেটে নাক এবং চোখ দিয়ে জল বার করছিস, ভিআইপি ডুবল বলে। চশমাটা পরে আসি,তারপর আমি কাটছি। অথবা কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফরে যাব শুনেই কেউ জানতে চায়, চিংড়ি খাবি তো? আজ কিন্তু বলিস না ডায়েট করছি, এই রোদে তোর জন্য কত ঘুরেছি জানিস?এত্ত বড় বড় চিংড়ি এনেছি। সেই কদমতলা বাজার থেকে,আর কস্তুরি থেকে এলাচ দেওয়া ঘণ লাল ক্ষীর দই।অথবা কেউ বলে, তোর সংসারটা একবার দেখে আসব, কে জানে আর কটা দিন আছি, চোখ বোজার আগে তোর সংসারটা গুছিয়ে না দিয়ে এলে- শুনতে শুনতে দুজনেই চোখ মুছি একসাথে। হারিয়ে যেতে পারে, যাবেও, তবু আঁকড়ে ধরি নিজের অতীত আর বর্তমানকে, বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস বের হয়, না দিয়েছো তো প্রভু। অনেক দিয়েছো। কানায় কানায় ভরে ওঠে মন।আসলে কি জানেন তো,  আমাদের প্রত্যেকেরই ভাগে একটুকরো আকাশ থাকে। সেই আকাশের আপনিই সূর্য আবার আপনিই ধ্রুব তারা। অন্য কারো সাথে আপনার কি তুলনা? আপনার আকাশ জুড়ে শুধুই আপনি। আপনি অতুলনীয়, তুলনারহিত-
অনির বচন #২ ১লা সেপ্টেম্বর  ২০১৭
ঠিক যেদিন আপনি তিথি নক্ষত্র বিচার করে, আবহাওয়া দপ্তরের যাবতীয় ভবিষ্যৎ বাণী পুঙ্খানু্খ ভাবে পর্যালোচনা করে অবশেষে মনের আনন্দে আপনার সবথেকে প্রিয় ধপধপে পোশাকটি পড়ে অফিস যাবেন, ঠিক সেদিন, সেই দিনই বাড়ি ফেরার পথে মাঝপথে আকাশ ভাঙবে। আকাশকে যেন হিসাব কষে ভাঙতেই হবে সেদিন,ফলতঃ প্রবল হতাশা দমন করে পোশাকের মায়া ত্যাগ করে অন্তত মাথাটুকু (এবং অবশ্যই মোবাইল ফোন)  বাঁচাবার জন্য প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনি কাঁধের বিশাল ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আঁতিপাঁতি  করে ছাতা খুঁজতে যাবেন, এবং আবিষ্কার করবেন  সব কিছু এমনকি হাতড়ালে বাঘ ভাল্লুক ও বেরোতে পারে আপনার ঝোলা থেকে--- শুধু ছাতাটিই যেন যাদুমন্ত্র বলে কোথায় গায়েব হয়ে গেছে।  অগত্যা বৃষ্টি মাথায়, কাদা মেখে এবার বাড়ি ফেরার পালা- আর বাড়ি পৌছলে আপনার কপালে কি জুটতে চলেছে (মানুন বা না মানুন এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ ও হতে পারে ) তা শুধু আপনিই জানেন।
বলাইবাহুল্য এটি মহিলাদের ক্ষেত্রে একটু বেশি প্রযোজ্য।
অনির বচন # ১ ০৭/০৮/০৯
ঠিক যখন আপনি সবথেকে গুরুগম্ভীর মিটিংটিতে বসে বোর হবেন, অথবা উর্ধ্বস্থ কতৃপক্ষ আপনাকে হাত পা নেড়ে বেপোট ঝাড় দিতে উদ্যত হবে, দেখবেন ঠিক তখনই আপনার বন্ধুদের জীবনে সবথেকে মজাদার ঘটনাগুলি ঘটতে থাকবে এবং তারাও অযথা সময় অপচয় না করে তৎক্ষণাৎ তা আপনাকে জানাতে থাকবে। উদ্গত হাই চেপে যদি একটিবার হোয়াটস্অ্যাপ খুলেছেন, তো ঐ যে বলে না “তু শালা কাম সে গ্যায়া। ” না পারবেন হাসতে, না পারবেন হাসি চাপতে। হাসি চাপতে গিয়ে হয় ভয়ানক হেঁচকি  তুলতে বাধ্য হবেন নয়তো প্রবল বেগে নিজেকে চিমটি কেটে রক্তাক্ত করতে উদ্যত হবেন তাও হাসি দমবে না। ফলে মুখটিকে অবিকল প্যাঁচার মত করে বসে থাকবেন এবং ওপরওয়ালা আপনার ঐ চাঁদবদন দেখে বুঝতেই পারবেন,  না তো আপনি ওণার কথা শুনছেন, নাই নিকট ভবিষ্যতে শুনতে ইচ্ছুক। ফলে ঝাড়ের বেগ প্রবল থেকে প্রবলতর হবে।
♥♥পুনশ্চ ইহা মহিলাদের ক্ষেত্রে একটু বেশী মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়।