Saturday 9 September 2017

ফেমিনিস্টের ডাইরি

অনির ডাইরি ২৮শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭
(ফেমিনিস্টের ডাইরি ৫)
শেরিলের গল্প জানেন? পুরো নাম শেরিল অ্যারারুহো। শরীরে পর্তুগিজ রক্ত থাকলেও আদতে ম্যাসাচুসেটস্ এর বাসিন্দা, শেরিল মোটেই ভাল মেয়ে ছিল না। না হলে মাত্র ২১বছর বয়সে কেউ দুটি কন্যা সন্তানের জননী হতে পারে? দিনটি ছিল ৬ই মার্চ,১৯৮৩, শেরিলের বড় মেয়ের তিন বছরের জন্মদিন। ছোট খাটো পার্টিও দিয়েছিল শেরিল, তারপর দুই কন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে শিরিল বের হল সিগারেট কিনতে। বলে ছিলাম ভালো মেয়ে না, না হলে অত রাতে কেউ সিগারেট কিনতে বের হয়?যাই হোক,শিরিলের চেনা দোকান ততোক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অগত্যা বিগ ড্যান বলে একটা বারে পৌঁছল শিরিল সিগারেট কেনার তাড়নায়। এত রাত্রে কোন ভদ্র বাড়ির মেয়ে বারে যায়? তাও সিগারেট কেনার বাহানা করে? ফলতঃ এই সব নষ্ট মেয়েদের সাথে যা হয়, শিরিলের সাথেও তাই হল। প্রথমে দুজন পুরুষ এসে বলল,“আমাদের সাথে চলো। ” কি আমার সতী লক্ষী রে, বলল যাব না? এত বড় সাহস? জোর করে শিরিলকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলা হল, বারের পুল টেবলে,এবং পর্যায়ক্রমে একাধিক ব্যক্তি শিক্ষা দিল শিরিলকে। চরম শিক্ষা। শিরিলের শিক্ষা হচ্ছিল ভরা বারে, শিরিল চিৎকার করছিল, কাঁদছিল, কেউ কিন্তু সাহায্য তো করেইনি উল্টে চিয়ার করছিল শিক্ষাদাতাদের হয়ে।
দাঁড়ান, কি শিরিলের সমুচিত শিক্ষা হল?আজ্ঞে না। এত সহজে কি এমন মষ্ট মেয়েদের ছেড়ে দিতে আছে নাকি?আদালতে কেস উঠল, বিরোধী পক্ষের উকিল বাবুরা ছিঁড়ে ফেলল শিরিলকে, যেনতেন প্রকারে প্রমাণ করেই ছাড়ল শিরিল একটা নষ্ট মেয়ে,  পেমেন্ট নিয়ে মতান্তরের ফলেই শিরিল তার বাবুদের প্যাঁচে ফেলতে এই গ্যাংরেপ ভিকটিম হবার নাটক করছে। কোর্টের ভিতরের খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশে, এমনকি শিরিলের নামটাও জেনে গেল সবাই। বেচারা শিরিলকে ছাড়তে হল তার শহর, মাত্র ২৫বছর বয়সে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেল শিরিল। আর শিরিলের শিক্ষাদাতারা?তাদের জেল হল বটে, যার সর্বোচ্চ সীমা ছিল সাড়ে ছ বছর মাত্র। আদালতও সেভাবে একটা নষ্ট ল্যাটিনার পাশে দাঁড়ায়নি।
শিরিল তথা বিগ ড্যান রেপ নিয়ে ১৯৮৮সালে একটা সিনেমা হয়, যার জন্য জোডি ফস্টার সে বছর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসাবে অস্কার পেয়েছিলেন, নামটা বুঝে গেছেন আশা করি, “দা অ্যাকিউসড্”।
কেন এই গল্পটা আবার বললাম বলুন তো? আজ আর একজন শিরিলকে দেখলাম জানেন তো, আমাদের এই পবিত্র ভূমে।অন্ধ্র্র প্রদেশের প্রকাশম জেলার বাসিন্দা, এই শিরিলেরও বয়স বেশী নয়, ১৯ মাত্র। বছর খানেক ধরে এক নব্য যুবকের সাথে গড়ে উঠেছিল হৃদয়ের সম্পর্ক। যা হয়, অ্যাপো ছিল মেয়েটির সাথে ছেলেটির, এক নির্জন মন্দিরে।সেই মত, ছেলেটি পৌঁছে যায় তার দুই সুহৃদকে নিয়ে,মেয়েটিও উপস্থিত হয় তার এক সহেলীর সাথে। এবার?মধুর মিলন তাই তো?  আজ্ঞে না,হল ঠিক তাই যা শিরিলের সাথে হয়েছিল, কে করল বলুন তো?মেয়েটির সেই বিশেষ বন্ধু, যার সাথে সে প্রেমজালে আবদ্ধ হয়েছিল। তাও বাকি দুই স্যাঙাতের সামনে। তারাও চাৎকার করে চিয়ার টিয়ার করল।  শুধু তাই নয়,পুরো ঘটনাটির ভিডিও তোলা হল, “In the video, the teenager begs, screams and tries to get away as her attacker tries to disrobe and rape her. In desperation, she tries to hold on to another girl who is seen making feeble attempts to stop him.” সেই ভিডিও আবার সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েও দেওয়া হল। এই না হলে প্রেম?
এবার আপনি বলুন তো?দোষ কার?অবশ্যই মেয়েটির তাই না?কোন ভদ্র বাড়ির মেয়ে এভাবে পরপুরুষের সাথে দেখা করতে যায়? তাও আবার এক পরিত্যক্ত নির্জন মন্দিরে?ছিঃ।এভাবে আর কতদিন চলবে বলুন তো? কতদিন, ঠিক কতদিন আর আমরা আমাদের মেয়েদের শেখাবো, যে পুরুষ হল এক ভয়ানক প্রজাতি। ওদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই মঙ্গল। আর ঠিক কতদিন মুখ বন্ধ করে,চোখ বন্ধ করে বসে থাকব? ঠিক যেমন ঐ মেয়েটি বসেছিল। ঘটনাটি অগস্ট মাসে ঘটলেও সোশাল নেটওয়ার্কে ভিডিওটি দেখে মেয়েটির বাবা সদ্য পুলিশে অভিযোগ করেন, তিন পুঙ্গবই আপাততঃ পুলিশ হেফাজতে। বলতে ভুলে গেছি, তিন পুঙ্গবের কেউই কিন্তু অশিক্ষিত নয়, একজন সদ্যস্নাতক,বাকিরা এখনও কলেজে।
অনির ডাইরি ২৭শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭
(ফেমিনিস্টের ডাইরি #4)
আমাদের একটা গ্রুপ আছে,ছোট মহিলা অফিসারদের গ্রুপ। কোন একটা ফেমিনিস্ট পেজে তর্কাতর্কি করতে গিয়ে আলাপ,সেখান থেকেই গভীর বন্ধুত্ব। বলাইবাহুল্য প্রত্যেকেই ফেমিনিস্ট বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। সেই গ্রুপের এক সদস্যা,ধরে নেওয়া যাক তার নাম তৃণা, সাথে তার বসের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। অন্য গন্ধ খুঁজবেন না,স্নেহ মিশ্রিত বন্ধুত্বের সম্পর্ক। মেয়েটি অত্যন্ত সিরিয়াস আর বস্ ছিলেন ততোধিক ফাঁকিবাজ,ফলে নির্ভরশীলতা তৈরি হতে সময় লাগেনি। এহেন বস্ যখন বদলী হয়ে গেলেন,নতুন বস্ ,ধরে নেওয়া যাক তাঁর নাম “দ” বাবু, এসেই তার পুরুষ সহকর্মীদের জনান্তিকে বললেন,“তৃণার এবার কি হবে?ওর “বাবু” তো চলে গেল। ” “বাবু” শব্দটি খেয়াল করলেন? একজন স্বাধীন শিক্ষিতা স্বোপার্জিত অর্থে জীবন অতিবাহিত করা অবিবাহিত মেয়ের কারো সাাথে সুসম্পর্ক থাকার অর্থই হল “বাবু এবং রক্ষিতা” মার্কা কেস্ আর কি।
যাই হোক মজার কথা হল, দ বাবু যে পুরুষ সহকর্মীর সাথে এক গ্লাস বিয়র (নাকি চা) সহযোগে এই রসালো চর্চাটি করলেন,সেই পরদিন তৃণার কানে কথাটি তুলে দিল। ছেলেটি বেশ কিছুদিন যাবৎ তৃণাকে প্রেম নিবেদন করে আসছিল, তৃণার অসাক্ষাতে সে তৃণার নামে কদর্য কুৎসা শুনতে পারে বটে তবে তৃণার কানে তা না তুলে থাকতে পারে না।
তৃণা ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেও আমরা বাকিরা গ্রুপে প্রচুর চিৎকার করতে লাগলাম। এ কি অসভ্য লোক।
গল্প এখানেই থামল না,দ বাবু এবার তৃণার এক ঘনিষ্ট মহিলা সহকর্মী, বিতস্তা,যে কি না আমাদের গ্রুপেরই সদস্যা তার কাছে তৃণার নামে কুৎসা রটাতে বসলেন। দিন কয়েক আগে কলকাতাতে একটা বড় মিটিং হয়,সেখানে তৃণার প্রাক্তণ বস্ ও আসে। যথারীতি তৃণার সাথে হাই হ্যালোও হয়, তারপর মিটিং শেষে তৃণা আর বিতস্তা একসাথে বেরিয়ে মেট্রো ধরে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। দ বাবুর বক্তব্য তৃণা নিজের বাড়ি যায়নি,বরং আগের বসের বাড়ি গেছে এবং দুজনে কি করেছে সে আর বলতে চাইনা। বিতস্তার মেরুদণ্ডের জোর ছিল,বিতস্তা বন্ধুর হয়ে প্রতিবাদ করে এবং বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে তৃণা এবং বিতস্তা এক সাথেই মেট্রো ধরেছিল। দ বাবুর লজিক শুনুন,“তুই ওকে মেট্রো অবধি পৌছে দিয়েছিলি, বাড়ি তো আর ছেড়ে আসিসনি। তুই নেমে যাবার পরই ওরা একসাথে উল্টো দিকের মেট্রো ধরে। আমি জানি। লোকজন দেখেছে। ”সেই লোকজন কে তা আর শতচেষ্টাতেও জানা যায়নি।
একজন মহিলা কলিগের নামে এত কদর্য গসিপ, পরিষ্কার সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের সংজ্ঞায় পড়ে। প্রতি সরকারী দপ্তরে(আদতে সর্বত্রই থাকার কথা যদিও) একটি আইসিসি (Internal Complaints Committee)থাকে, এই ধরণের অভিযোগের নিষ্পত্তি করার জন্য,তৃণাকে আমি বারবার বললাম অভিযোগ জানাতে। তৃণা খুব ক্যাজুয়ালি ইগনোর করে গেল, ওর লজিক ছিল, দ বাবু আসলে তাঁর পূর্বোক্ত পদাধিকারীকে সহ্য করতে পারেন না, তাই তাঁকে বদনাম করার জন্যই তৃণাকে ব্যবহার করছেন। তৃণা যদি এই নিয়ে শোরগোল  করে,তবে ব্যাপারটা আগের বসেরও কানে যাবে। উনি কি ভাববেন?ওণার পারিবারিক  জীবনে নানা সমস্যা তৈরি হবে। তার থেকে তৃণা চেষ্টা চরিত্র করে বদলী নিয়ে চলে গেল সুদূর উত্তর বঙ্গ।
নিজেকে সাময়িক ভাবে মনে হয়েছিল চূড়ান্ত ফেলিওর। তৃণার জীবন,তৃণার সিদ্ধান্ত। সত্যি এই ধরণের নোংরামির সাথে লড়তে গেলে নিজেকেও পাঁকে নামতে হয়। সেটা কজন পারে? আর পারে না বলেই দ বাবুর মত লোকেরা সুযোগ নেয়।  আমি নিজে হলেও পারতাম কি না জানি না,তবে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া তো করতামই। 
আপনাদের কাছেও বিনীত অনুরোধ প্রতিরোধ করুন,না পারলে প্রতিবাদ তো করুন। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুন, আর পাঁচ জন মহিলার সাথে অবশ্যই শেয়ার করে নিন আপনার অভিজ্ঞতা। আর কোন অবস্থাতেই নিজেকে দোষ দেবেন না। দুর্গা পুজো বিকৃতকাম লোকেদের সুবর্ণ সুযোগ,ভিড় আর চাপাচাপির সুযোগ নিতে দেবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন, যারা আপনার পিছনে আপনাকে নিয়ে যৌনোত্তেজক কুৎসা করে, বা আপনার অন্যমনস্কতার সুযোগে আপনাকে স্পর্শ করে, তার আর যাই থাক সাহস বলে বস্তুটি নেই। যে মুহূর্তে আপনি ঘুরে দাঁড়াবেন, লেজয়গুটিয়ে পালাবেই পালাবে। আর একটি অনুরোধ কোন মহিলা যদি এ হেন কোন ঘটনার প্রতিবাদ করেন,পারলে তার পাশে দাঁড়ান, দোহাই তার স্বভাব চরিত্র বা পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসবেন না। একজন দেহপসারিনীর দেহ ও তার বিনানুমতিতে স্পর্শ করা কিন্তু গর্হিত অপরাধ। ভুললে চলবে না। শুভ সপ্তমী। পুজো ভালো কাটুক সকলের।

অনির ডাইরি ১৭ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
(ফেমিনিস্টের ডাইরি #3)
বিক্ষোভরত একদঙ্গল কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, প্রত্যেকেরই বয়স ১৮-৩৫এর মধ্যে, পরনে একই ধরনের পোলকা ডটেড অ্যাপ্রন, যার নিম্নাংশ গাঢ় রক্ত রঞ্জিত। এক ঝলক দেখেই চমকে উঠেছিলাম। এরা কারা? নতুন কোন নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করছে কি?  নাকি ঋতুচক্রচলাকালীন ছুটির দাবী জানাতে রক্তাপ্লুত অবস্থায়ই বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। অদ্ভুত তো!
ঘড়ির কাঁটা প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই, বর গলা খাঁকরে বুঝিয়ে দিল,  এবার ফোন বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে, নাহলে শৌভিকের ভাষায় কাল সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাকে ঘুম থেকে তুলতে দমকল ডাকতে হবে। ফোন বন্ধ করার আগে এক ঝলকে যা বুঝলাম, কোন একটি স্ট্যাচু সরিয়ে নেবার দাবীতে এই বিক্ষোভ। কার স্ট্যাচু? ডঃ জেমস্ ম্যারিওন সিমস্ নামী কেউ, যাঁকে বলা হয় আধুনিক স্ত্রীশরীরবিদ্যার জনক।
সে রাতের মত ফোন বন্ধ করে দিলেও ঐ রক্তস্নাত কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েগুলিকে ভুলতে পারলাম কই? বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে যা জানতে পারলাম, ডঃ সিমস্ এক যুগন্ধর পুরুষ। উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে ওনার জন্ম। স্বেচ্ছায় ডাক্তারী পড়তে আসেননি, বরং নিজের আত্মজীবনীতে  লিখে গেছেন,“উকিল হতাম না, মন্ত্রী হতে পারতাম না। অগত্যা ডাক্তারিই সই।” জীবনের প্রথম অর্ধে খুব বেশি সফলতার মুখ দেখতে পাননি। 

“ভেসিকোভ্যাজাইনাল ফিসচুলা” এর চিকিৎসা করে পরে  প্রচুর সুনাম এবং অর্থোপার্জন করেন। তৎকালে অধিকাংশ মহিলারই নর্মাল ডেলিভারি হত। সন্তান প্রসবের সময় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত অনেক টিস্যু, নালীকা, এমনকি ইউরিনারি ব্লাডারও অনেক সময় ফুটো হয়ে যেত। ফলে অবর্ণনীয় যাতনা ভোগ করতেন বিত্ত নির্বিশেষে সকল মহিলাই। এর কোন চিকিৎসা ছিল না। ডঃ সিমস্ প্রথম সফল ভাবে এর চিকিৎসা করেন।  নাকি প্রথম গল ব্লাডার অপারেশন ও করেন। এমনকি প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইনসেমেনাশেন এর কৃতিত্ব ও ওনার ঝুলিতে। তৎকালীন বহু ইউরোপীয়  রাজপরিবারের মহিলাদের চিকিৎসার দায়ভাগ ছিল ওনার স্কন্ধে।
তবে? এই প্রতিবাদ কেন?সেখানেই তো গল্প। এই সমস্ত রোগের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি তো আর স্বপ্নদর্শী ছিল না।  আবিষ্কার করার জন্য অবশ্যই ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতির সাহায্য নেন ডঃ সিমস্। যার জন্য ওণাকে বহু বার অস্ত্রোপচার করতে হয়, এই অস্ত্রোপচার উনি কাদের ওপর করেন বলুন তো? না কোন গিনিপিগ টিনিপিগ নয়, ওসবের কি দরকার যদি আপনার হাতের কাছেই কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসী থেকে থাকে।
আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি ১১জন ক্রীতদাসীর ওপর যাবতীয় পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। যাদের বয়স ছিল কারো ১৪ কারো বা ১৮। কথিত আছে একজন ক্রীতদাসীর ওপর উনি ৩০ বার ছুরি চালান। বুঝতেই পারছেন, ক্রীতদাসীদের কনসেন্ট অর্থাৎ অনুমতি নেবার কোন প্রয়োজনই উনি বোধ করেননি। আর হ্যাঁ প্রতিটি অস্ত্রোপচারই হয় বিনা অ্যানেস্থেশিয়ায়, অর্থাৎ বিন্দুমাত্র  অবশ না করে, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে। কারণ ডঃ সিমস্ বিশ্বাস করতেন, কালো মেয়েদের ব্যথাবেদনার বোধ থাকে না।
“J. Marion Sims was a gynecologist in the 1800s who purchased Black women slaves and used them as guinea pigs for his untested surgical experiments. He repeatedly performed genital surgery on Black women WITHOUT ANESTHESIA because according to him, ‘Black women don't feel pain.’ Despite his inhumane tests on Black women, Sims was named ‘the father of modern gynecology’, and his statue currently stands right outside of the New York Academy of Medicine.”

অনির ডাইরি ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭
(ফেমিনিস্টের ডাইরি #২)
২০০৯ এর মধ্য ভাগ। আমি তখন সহশ্রম কমিশনার খড়গপুর। চেম্বারে বসে আছি, হঠাৎ পর্দা সরিয়ে কে যেন উঁকি দিল। তাকিয়ে দেখি, একটি বছর ২৫-২৬এর মেয়ে ভিতু ভিতু চোখে তাকিয়ে আছে। একেবারে বিশেষত্বহীন চেহারা, মাঝারি উচ্চতা, বেশ কালো গায়ের রঙ, পরনে সস্তা সিনথেটিক শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ, দুহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। চোখে চোখ পড়তে খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, “আসব?” ঘাড় নেড়ে অনুমতি দিলাম। সন্ত্রস্ত হয়ে মেয়েটি যখন ঢুকল, দেখলাম একটা বছর পাঁচ-ছয়ের বাচ্ছাও সাথে আছে।
ইশারায় বসতে বলে জানতে চাইলাম কি ব্যাপার।
মেয়েটি ভিতু ভিতু ভাবে যা বলল, তাতে বুঝলাম যে স্থানীয় একটি নামী কারখানায় কাজ করত মেয়েটি, দিন তিনেক আগে জানিয়ে দিয়েছে, কাল থেকে আর আসার দরকার নেই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্টে আমরাই কন্সিলিয়েশন অফিসার, অর্থাৎ কি না, মিটমাট করিয়ে দেবার দায়িত্ব আমাদের। প্রথম দিন থেকেই এই একটি কাজ আমার ঘোরতর অপছন্দ। আমার সদ্য পরিণত বর, ঠিকই বলত, আমি ঝগড়া করতে পারি, মেটানো আমার পিতৃদেবের ও অসাধ্য।এই কাজে আমার তীব্র অনীহা এবং অপারদর্শিতা দেখে তৎকালীন বড় সাহেব নিজেই অধিকাংশ বিবাদ সামলাতেন।

প্রাথমিক ভাবে মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিলাম, কি করণীয়। যাবার সময় করজোড়ে বলে গেল,”একটু দেখবেন দিদি। বর থেকেও নেই, একা হাতে সংসার টানি, মেয়েকে স্কুলে পড়াই, চাকরী চলে গেলে খাব কি? মরে যাব দিদি আমরা মা-মেয়ে।“ শেষের দিকে চোখের কোণ চিকচিকিয়ে উঠেছিল, অবোধ শিশু হাঁ করে তাকিয়ে ছিল মায়ের দিকে। মেয়েটির কাঁপা হাতে লেখা অভিযোগনামার ফটোকপি পাঠিয়ে কোম্পানিকে বললাম, সাত দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দিন। সাত দিন ছাড়ুন, পরের দিনই ম্যানেজার সাহেব এসে হাজির,” মেয়েটি এক্কেবারে বাজে মেয়ে ম্যাডাম। এত বড় সাহস, আমাদের সুপারভাইজারকে ‘কুত্তা’ বলে? ওকে ফেরত নেবার প্রশ্নই নেই, ম্যাডাম। এই রকম অনুরোধ করে আমাদের বিপাকে ফেলবেন না। আপনার কথা তো আর ফেলতে পারব না। হে হে”।
একটু রুঢ় ভাবেই বললাম, আইন তার পথে চলবে, মেয়েটি যখন আমাদের দ্বারস্থ হয়েছে, আমাকে আমার কর্তব্য করতেই হবে। পরের ধাপ যৌথ মিটিং। এবার ম্যানেজার একা এলেন না, সঙ্গে সুপারভাইজারকেও নিয়ে এলেন। সে কি হম্বিতম্বি সেই সুপারভাইজারের,মেয়েটি ক্রমে ভয়ে কেঁচো হয়ে মনে হচ্ছিল মাটিতে মিশে যাবে। এবারেও বাচ্ছাটি সঙ্গে ছিল, কেন জানি না মনে হল, বাচ্ছাটি থাকাতে মেয়েটি স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না। বাচ্ছাটিকে আমার পিওনের হেফাজতে কিছুক্ষণের জন্য পাঠাতেই দেখলাম, মেয়েটির আস্তে আস্তে গলার জোর বাড়ল। মেয়েটি বারবার একই কথা বলে যাচ্ছিল, “আমাকে রোজ বিরক্ত করত। আমি কতদিন সইব?”
মালিক পক্ষকে বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসতে বলে, মেয়েটিকে একাকী পেয়ে প্রশ্ন করলাম,” কি ভাবে বিরক্ত করত তোমায়?” আচমকা আমাকে চমকে দিয়ে মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, “নোংরা লোক। বেশ করেছি কুত্তা বলেছি। আবার বলব। বার বার বলব।“ প্রায় সাত-আট মিনিট এভাবেই কাটল, মাথার ওপর ঘড়ঘড়ে পাখা আর নীচে মেয়েটির ফোঁপানি ছাড়া আর  আওয়াজ নেই। চোখে আঁচল চেপে কেঁদেই যাচ্ছে মেয়েটি। শেষে বলল, সুপারভাইজারটি নাকি প্রায়ই ওকে বর তুলে নানা অপমান জনক কথা বলত। যেমন  কাজে ভুল করলেই বলত, “এই জন্যই তোর বর তোকে ছেড়ে চলে গেছে।“ কাজে ভুলচুক না করলে বলত, “ মেয়েদের একটু সেজে গুজে থাকতে হয়। একটু নখরা করতে জানতে হয়, তা না হলে বর টেকে না।“ এ গুলো তাও হজম করে নিত মেয়েটি কিন্তু শেষ দিনে এমন কিছু বলেছে, আর সহ্য করতে পারেনি মেয়েটি। কি বলেছে, জিজ্ঞেস করাতে মেয়েটি এমন হিস্টেরিক হয়ে উঠল, যে বললাম, থাক বাবা।
মালিক পক্ষকে ডেকে নিলাম, সুপারভাইজার তখনও ফুঁসছে, “বাজে নোংরা মেয়ে। ওপরঅলাকে কি ভাবে সম্মান জানাতে হয় জানে না-“ । এবার রীতিমত চিৎকার করে উঠতে বাধ্য হলাম, “আপনি একজন মহিলা অফিসারের ঘরে বসে, অপর একজন মহিলার সম্বন্ধে কি ধরণের ভাষা প্রয়োগ করছেন? ও আপনাকে কি বলেছে, তাতো আমরা জানি, এবার বলুন তো আপনি ঠিক কি বলেছিলেন?” জোঁকের মুখে নুন পড়তে দেখলাম। প্রথমে বারবার বলতে লাগল, “কিছু বলিনি।কিছু বলিনি।“ আরো এক প্রস্থ ধমক এবং চিৎকারের পর, বলল, “সামান্য রসিকতা করেছিলাম ম্যাডাম।“ রসিকতা? কি এমন রসিকতা যা একটি মেয়েকে ফুলে ফুলে কাঁদতে বাধ্য করে? বললাম,” কি বলেছিলেন? বলুন শুনি। আমাদের সামনে একবার বলেই ফেলুন।“

দৃশ্যত অস্বস্তিতে ভুগছেন ওনারা বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমার পেড়াপিড়িতে শেষে ম্যানেজার হাতটাত কচলে বললেন, “তেমন কিছু নয় ম্যাডাম।আপনার সামনে বলাটা শালীন হবে না।“ কেন? জাঁকিয়ে বসলাম, নিজের সিটে, পথে এস বাছাধন। মেয়েটিও এবার কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠল, “হিম্মত থাকলে বলে দেখা।“ সুপারভাইজার লোকটি তখনও অনড়।“আপনাকে ওসব বলা যায় না। কুলি-কামিনদের ভাষা।“  বাঃবাঃ,কি অসাধারণ লজিক। কুলি-কামিন মেয়ে হলে তাকে সব বলা যায়, এএলসি মেয়ে হলে তার সামনে সতীপনা করতে হয়। কিছুতেই সুপারভাইজার লোকটি বলল না, মেয়েটিই শেষে বলল, “ আমি বলছি ম্যাডাম, ও আমাকে বলেছে, তোর বর যে তোকে ছেড়ে গেছে, তোর শরীরের খিদে লাগে না? লাগলে কি করিস?”
১৯৯২ সালে রাজস্থানের সরকারের নারী উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরতা এক নারী, তার সরকার নির্ধারিত কর্তব্য করতে গিয়ে গণ ধর্ষিতা হন। মহিলার নাম ভাঁওরি দেবী আর কাজটি ছিল বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জনচেতনা জাগরণ করা। সেদিন থেকে আজ অবধি ভাঁওরি দেবী বারংবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, সুবিচারের আশায়। সুবিচার পাননি বটে, তবে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ১৯৯৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট কিছু নির্দেশনামা জারি করে, যার পোশাকী নাম বিশাখা গাইডলাইনস্। এর আরো পনেরো বছর পর আবার একটি মেয়ে গণধর্ষিত হয় দিল্লীর রাস্তায়। যার নাম জ্যোতি সিং। জ্যোতির সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে দেশ ব্যাপী আন্দোলন বাধ্য করে সরকারকে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করতে।  ২০১৩ সালে পাশ হয় সেই আইন।
২০০৯এ, সে ছিল নিছক কষ্ট কল্পনা মাত্র। প্রথম চোটেই আমার মনে হয়েছিল মেয়েটির খিস্তিখেউড়ের ওপর একটি ক্লাশ নেওয়া আবশ্যক। কুত্তা আদপেই  গালি যথোপযুক্ত নয়। হাওড়াকে কোন এককালে কুলি টাউন বলা হত, হাওড়ার মেয়ে হিসেবে আমার গালির ভাঁড়ার উপচে পড়ে, দেবার মত লোক পাই না। সুপারভাইজার এবং ম্যানেজারের ওপর প্রয়োগ করতে পারলে কি ভালোই না হয়। সাথে দু চার ঘা মেয়েটির হাওয়াই চটির বাড়ি, আহাঃ সোনায় সোহাগা হত গো।
কিন্তু সব ইচ্ছা তো আর পূর্ণ হয় না।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যক্টের মধ্যে থেকেই শালীন পরিশীলিত ভাষায় ঝাড়লাম। বরখাস্ত করার আগে মেয়েটিকে সতর্ক করা উচিত ছিল। ওকে সময় দেওয়া উচিত ছিল নিজেকে সংশোধন করার( যেন মেয়েটির সংশোধিত হওয়া আবশ্যক ছিল)।  শো কজ করা উচিত ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। যার কিছুই করেননি। বিনা বাক্য ব্যয়ে পত্রপাঠ বিদায় দেওয়া সাংঘাতিক বেআইনী  কাজ হয়েছে । শেষ পর্যন্ত ওরা মেয়েটিকে ফিরিয়ে নিতে নিমরাজি ও হল। কিন্তু অবলা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েটি থুঃ করে আওয়াজ করে বলল,“আজ মিষ্টি কথা বলে চাকরীতে ঢোকাবে, কাল আপনি যা যা বললেন ম্যাডাম সব সব করে, অল্প কিছু টাকা গছিয়ে আমায় তাড়িয়ে দেবে। কে চায় ওদের চাকরী। লোকের বাড়ি বাসন মেজে খাব, তবু ওদের চাকরগিরি করব না। ওরা মরে না কেন?” উফ্ কাকে অবলা ভাবছিলাম? প্রকৃতপক্ষে সত্যিই কি কেউ অবলা হয়? যদি হতেও চায়, জীবন ছাড়ে না। শিখিয়েই ছাড়ে, লড়াই করতে। আপনার লড়াই আপনাকেই লড়তে হবে। পারলেন তো সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট, নতুবা মহাকালের খাতায় রোজ কত নামই যে লেখা হয়।

অনির ডাইরি ৯ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
(ফেমিনিস্টের ডাইরি #1)

আসুন টেরির সাথে আলাপ করিয়েদি। ২০১২র ডিসেম্বরে যেদিন জ্যোতি সিং বলে একটি মেয়ে তার প্রিয়তমের হাত ধরে ইভনিং শোয়ে লাইফ অব পাই দেখতে গিয়েছিল, তার ঠিক দিনদুয়েক আগেই আমিও গিয়েছিলাম, আইনক্স ফোরামে, আমার বরের সাথে ঐ একই সিনেমা দেখতে। আমরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারলেও জ্যোতি এবং তার বন্ধুর সাথে যা হয়েছিল, তাতে কেঁপে উঠেছিল পুরো দেশ। চিনতে পেরেছেন আশা করি, জ্যোতি সিংকেই আমরা আদর করে নির্ভয়া বলে ডাকি।
নির্ভয়া কাণ্ড আমার মানুষের ওপর বিশ্বাসের ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছিল। এইসময় বিভিন্ন রেপ সারভাইভারের গল্প পড়া প্রায় নেশার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বেনামে বিভিন্ন রেপ সারভাইভার ব্লগ বা ওয়েবসাইটে নিজেদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করত লোকজন। প্রসঙ্গত তাদের মধ্যে বেশ কিছু পুরুষও ছিল। পাঠক এবং অ্যাডমিনরা নিজের নিজের মত কাউন্সেলিং করত। এইরকমই একটা ওয়েবসাইটে কিছুদিন আগে টেরির কথা জানতে পারি।
টেরি আদতে নাইরোবি,কেনিয়ার বাসিন্দা। দিনটি ছিল টেরির বিয়ের দিন। বহু বছরের পুরাণো প্রেমিক হ্যারির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে টেরি। সাধ্যাতীত আয়োজন করেছে টেরির বাবামা। নামি চার্চ বুক করা হয়েছে, দামি গাউন ভাড়া করা হয়েছে। বিয়ের দিন ভোরে টেরি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, তার এক বন্ধুকে বাসে তুলে দিতে, ফেরার পথে নির্জন রাস্তায় তিনজন দুর্বৃত্ত টেরিকে বলপূর্বক অপহরণ করে। টেরি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বারবার বলছিল,“আজ আমার বিয়ের দিন”।
বিয়ের কনেকে বলাৎকার করার মধ্যে বোধহয় বেশ একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে। নেটে সার্চ করে দেখুন, ব্রাইড বা ভার্জিন ব্রাইড রেপড্ অন ওয়েডিং নাইট বলে গাদা গাদা ট্রিপল্ এক্স ভিডিও পাবেন। কিন্তু সেগুলি নিছক রোল প্লে মাত্র। টেরির মত রক্ত মাংসের মানুষ নয়।
বিয়ের সময় পার হয়ে গেল, হ্যারি তার পরিবার অপেক্ষা করতেই থাকল, টেরির আর দেখা নেই। শুরু হয়ে গেল ফিসফিসানি। পরের বিয়ের সময় হয়ে গেল, সব সাজগোজ খুলে ফেলে পরের বিয়ের জন্য সাজতে লাগল চার্চ। হ্যারি তবু আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় বিকালে ফোনটা এল। নাইরোবির বড় সরকারি হাসপাতালের হেড মেট্রনের কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল,নাইরোবির বাইরের রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তাপ্লুত, অর্ধনগ্ন মেয়েটি বোধহয় কোন বিয়ের কনে। চার্চে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, কোন মিসিং ব্রাইড আছে কিনা।
হ্যারি, টেরির বাবামা, আত্মীয়স্বজন দৌড়ে যায়। গণধর্ষিতা টেরি, অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েছিল, নিজের সম্ভ্রমটুকু বাঁচানোর,ফলে শুধু ধর্ষণই নয়, টেরির পেটে ছুরিও মারা হয়েছে। সেই ছুরির ঘা এতই গভীর টেরি আর জীবনে মা হতে পারবে না।
হ্যারির হাতে তখনও ধরা ছিল টেরির ভাড়া করা গাউন। টেরি বলল,“ফিরে যাও হ্যারি। আমি অশুচি, অপবিত্র,নোংরা। দেখছ না আমার এইডসের টেস্ট হচ্ছে। ” হ্যারি তাও হাত ছাড়ল না। এইডস্ এর রেজল্ট নেগেটিভ হওয়াতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ওরা। সাত মাস বাদে বিয়ে হল দুজনের। স্বপ্নের বিয়ে, রেপ সারভাইভারদের জন্য কাজ করা এক সংগঠন স্বেচ্ছায় বহন করল সব ব্যয়ভার। এবার আর ধার করা নয়, একান্ত নিজের গাউন পরে বিয়ে করল টেরি।
বিয়ের ঠিক ২৯দিনের মাথায় টেরিকে ছেড়ে চলে গেল হ্যারি। প্রচণ্ড শীতের রাতে কাঠকয়লার আগুন জ্বালাতে গিয়ে কার্বন মনোক্সাইড পয়সনিং এ মারা গেল হ্যারি। সবাই বলতে লাগল টেরি আসলে অভিশপ্ত। বিষকন্যা। এদিকে টেরির ধর্ষকরাও ধরা পড়ল না। প্রত্যহ পুলিশ স্টেশনে গিয়ে অপরাধীদের সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে নিতে ক্লান্ত টেরি একদিন জানিয়ে দিল, আর নয়।  আর পারছি না। আমায় মুক্তি দাও। উচ্ছন্নে যাক তোমাদের অপদার্থ পুলিশী  ব্যবস্থা।
জগৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল টেরি। সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করা হতে লাগল। অপরিচিতি পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণ থেকে অপরাধীদের না সনাক্ত করতে পারার ব্যর্থতা এবং অবশ্যই হ্যারির মৃত্যু। এই সময় টেরির জীবনে টনি গোবাংগার প্রবেশ। অনিচ্ছুক টেরির সঙ্গে প্রায় বলপূর্বক  কথা বলত টনি। হ্যারির কথা জিজ্ঞাসা করত। টেরি যখন হ্যারির কথা বলতে বলতে হাউমাউ  করে বুক চাপড়ে কাঁদত, টনি চুপ করে বসে থাকত নিজের জায়গায়। কোনদিন আগ বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেয়নি নিজের হাত। যেদিন দিল,সেই হাতে ছিল একটা অঙ্গুরীয়। টেরি কাঁদতে কাঁদতে জানালো, তার সন্তান প্রসবে অক্ষমতার কথা। টনি সেদিন বলেছিল,“আমার কোনদিন সন্তান হবে কি হবে না, সেটা তো স্বয়ং ঈশ্বরের হাতে। Children are a gift from God," he said. "If we get them, Amen. If not, I will have more time to love you."

হ্যারির সাথে বিবাহের ঠিক তিন বছরের মাথায় টেরি আর টনির বিয়ে হল। যে বিয়েতে টনির বাবাই ছিলেন অনুপস্থিত কারণ এই রকম বহুব্যবহৃত অভিশপ্ত মেয়ের সাথে নিজের পুত্রের বিবাহ তিনি প্রত্যক্ষ করতে চাননি।
বিয়ের ঠিক এক বৎসরের মাথায় টেরিকে আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হল, পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে। ডাক্তার জানালেন, মিরাকল্।  টেরি আসন্ন প্রসবা।
আজ টেরি টনি তাদের দুই কন্যা নিয়ে সুখে সংসার করছে। আসুন টেরি কি বলে শুনি, “Today, I am the best of friends with my father-in-law.

I wrote a book, Crawling out of Darkness, about my ordeal, to give people hope of rising again. I also started an organisation called Kara Olmurani. I have forgiven my attackers. It wasn't easy but I realised I was getting a raw deal by being upset with people who probably don't care. The most important thing is to mourn. Go through every step of it. Get upset until you are willing to do something about your situation. You have to keep moving, crawl if you have to. But move towards your destiny because it's waiting, and you have to go and get it.”

Friday 8 September 2017

স্বপ্ন #৪


স্বপ্ন দেখলাম, আমি আর দেবশ্রীদি একটা পাথরের এবড়োখেবড়ো বেঞ্চে বসে গল্প করছি। আমার ডান আর দেবশ্রী দির বাঁ পাশেই গভীর অতলান্ত খাদ। খাদের ওপাশে ধাপে ধাপে ঘন সবুজ পাহাড়, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। গোল গোল পাকদণ্ডী  নেমে গেছে সেইসব পাহাড়ের গা বেয়ে। দূরের ঐ পাহাড়ের মাথায় মুকুটের মত ভাসছে পেঁজা তুলোর মত মেঘ। মেঘ গুলি ক্রমশ আমাদেরও ঘিরে ধরছে। দুজনের মাঝখান দিয়ে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে গলে যাচ্ছে ধোঁয়ার মত মেঘ। ঠাণ্ডা ভিজে হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের চুল। আমার পিছনে খাড়াই সবুজ পাহাড় বরাবর পাইন গাছের বন, ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ জড়িয়ে ধরছে তাদেরও। দুষ্টু ভিজে হাওয়ায় ঘনঘন মাথা নাড়াচ্ছে পাইন গাছের বন, অদ্ভূত ফিসফিসানির শব্দ ভেসে আসছে পাইনের বন থেকে। ডি দির (ছোট করে এটাই বলি) পিছনে ঢালু পাকদণ্ডী নেমে গেছে।
কি রোমান্টিক আবহাত্তয়া, আমাদের গল্প আর শেষই হচ্ছে না। সূর্যের আলোর রঙ সোনালী থেকে কমলা হবার পথে। আমাদের হুঁশ নেই।আমাদের উচ্চকিত হাসির আওয়াজ বড় বেমানান এই নিশব্দ পরিবেশে, কিন্তু কি করি? শৌভিক আর ত্রিদিবেশদার সবজান্তা হাবভাব, তুত্তুরী আর উজানের নিত্যনতুন দুষ্টুমি এবং সর্বোপরি, আমাদের নতুন প্রেমিকদ্বয়- ডিদির বিল পুলম্যান আর আমার রিচার্ড ম্যাডেন, উফ্ আমি তো ম্যাড ফর ম্যাডেন।
     হঠাৎ একজন বলে উঠল,“উফ্ তোমাদের এই হাসি আর সহ্য হচ্ছে না। ”চমকে তাকিয়ে দেখি, যিনি বলছেন, তাঁর পরণে বিবর্ণ লুঙ্গি,গায়ে আঁটো তাপ্পি দেওয়া ব্লাউজ। বেশ বয়স্ক, মাথার চুল সব পেকে গেছে। মঙ্গোলিয় মুখশ্রী, দাঁত নেই একটাও। সবথেকে আশ্চর্য হলাম, একটা চোখ নেই। শূণ্য  কোটরের ওপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে একটা কাটা দাগ। একটা ধুসর ঘোলাটে চোখে উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি একা নন, আমাদের আসে পাশে আরো অনেক লোক। জনা বিশ পঁচিশ তো হবেই।  সবাই বয়স্ক, সবাই জোড়াজোড়া। আর আশ্চর্যভাবে কেউ অক্ষত নয়। কারো দুহাত কাটা, কারো পা নেই,চাকা লাগানো চেয়ারে বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছে তার সঙ্গী।  দিকে তাকানো যায়, বাকিদের ক্ষত এত ভয়ানক, দেখলে গায়ে কাঁটা দেবে।
একচক্ষু বৃদ্ধা আবার বললেন,“এখানে কেউ জোরে কথাও বলে না, হাসি কাকে বলে আমরা কবেই ভুলে বসেছি।” ডিদি ক্ষমা চেয়ে বলল,“মাপ করবেন।চল অনিন্দিতা। ” আমিও বেমালুম উঠে দাঁড়ালাম। বেঞ্চের পাশে দুজনের কালো রুকশ্যাক কাঁধে নিয়ে এগোে যাব, মহিলা বললেন,“কোথায় যাবে?” তাই তো। কোথায় যাব? কোথায় যেন থাকার কথা আমাদের কিচ্ছু মনে পড়ছে না। ডিদিরও একই হাল। ভ্যাবলার মত বলল,“জানি না তো। ” সর্বনাশ।রাত নামছে,নির্জন পাহাড়িয়া এলাকা,কোথায় থাকব। আমাদের গাড়ি কোথায়? এলাম কি করে?সবজান্তা বরগুলো গেল কোথায়?
মহিলা দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে বলল,“এস। তবে আমাদের খাবারদাবার খুবই সীমিত। ভালো বিছানাপত্র কিছুই নেই। শুধু আজ রাতটুকু থাকতে দেবো। সন্ধ্যা নামছে, চতুর্দিকে জঙ্গল, তায় বষ্টি নামছে। এদিকে খুব হায়না আর নেকড়ের উৎপাত। ” আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বৃদ্ধাকে নীরবে অনুসরণ করলাম। দেখলাম, বাকি লোকজনও আমাদের সঙ্গেসঙ্গেই আসছে। কি কষ্ট করে একজন আর একজনকে বয়ে আনছে। আমরা একজনকে সাহায্য করতে গেলাম, কিন্তু যাকে হেল্প করতে গেলাম, সে আঁ আঁ আঁ করে  চিৎকার করে উঠল। বেচারা মুখগহ্বর দেখে আঁতকে উঠলাম।  জিভটাই নেই।
যেখানে পৌছলাম, সেটা একটা বড় ভাঙা বাড়ি। এতই ভাঙা, এখানে কি সত্যই কেউ থাকে।
বিরাট হলঘর। দেওয়ালে মান্ধাতার  আমলের ফায়ার প্লেসে গণগণে আগুন ছাড়া কোন আলো নেই। হলঘরে গোল করে অজস্র বিছানা। শতছিন্ন, কাপড়ের পুঁটুলি বললে ভালো হয়। তেলচিটে ভ্যাপসা গন্ধ। একটা ওমনি বিছানা আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। প্রতি বিছানায় একজোড়া বৃদ্ধ দম্পতি। খুব সামান্য নৈশাহারের পর ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুতে যাব, একচক্ষু বৃদ্ধা হাঁ হাঁ করে উঠল। “শোবে না। একদম শোবে না। শুলে আমরা কেউ বাঁচব না। তোমরাও না।  ” সে কি। কিছুই বুঝলাম না।
কি অস্বস্তিকর রাত। তীব্র ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। চোখের পাতা বন্ধ করার উপায় নেই।  বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। কাঠের ছাতে পড়ন্ত জলের ফোঁটার আওয়াজে রীতিমত ভয় লাগছে। যেদিকে চোখ ফেরাই, একদল ঘায়েল বুড়োবুড়ি জেগে বসে আছে, যাদের চোখ অবশিষ্ট  আছে, তাদের চোখের পাতায় ধিকিধিকি জ্বলছে ফায়ার প্লেসের আগুন। ডিদি আর পারছিল না। বললাম, “আমার কাঁধে মাথা রেখে বসেই ঘুমোও। দূরের গুলো বুঝতে পারবে না, আর পাশের বৃদ্ধাকে আমি গল্পে মশগুল রাখছি। ”

বৃদ্ধার দিকে ফিরলাম,“মাসি!” একটা মার্বেলের গুলির মত চোখ আমার দিকে ফিরল।  পাশে ওণার স্বামী, কুঁজো হয়ে কেশে উঠল। “এখানে কেন ঘুমানো নিষেধ মাসি?তোমরা না ঘুমিয়ে কি করে থাকো?”  ©Aninditasblog©Aninditasblog
বৃদ্ধা নিস্প্রিয় স্বরে বলল,“দিনে ঘুমোই। রাতে ঘুমোলে ও আমাদের খুঁজে বার করে ফেলবে। ” কিছুই বুঝলাম না। যত গাঁজাখুরি। ডি দি ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই কথা চালাবার জন্য বললাম,“কে?” কিছুক্ষণ কোন কথা নেই, তারপর বৃদ্ধার স্বামী জবাব দিল,“আমাদের মেয়ে। আমি নিজের হাতে আগুন লাগিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মরলে অন্তত শান্তি পাব। সব কেড়ে নিয়েছে রাক্ষুসী। চোখের সামনে গোটা গাঁকে শেষ করে দিল।  এই জন্যই কি ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছিলাম? কত স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে। যে মেয়ে গোটা গ্রামের গর্ব ছিল, সেই এই হাল করল আমাদের। কেন? কেন? কেন?” কাশির দমকের সাথে বৃদ্ধ দুলতে লাগল,দমদম করে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
বৃদ্ধা আটকাল না। ক্লান্ত রিক্ত স্বরে বলল,“একদিন এল রাক্ষসী। সঙ্গে একদল লোক। অস্ত্রশস্ত্রের  বাহারে চমকে গেলাম আমরা। দৌড়ে গেলাম, আলিঙ্গন করতে, মেয়ে  দূরে সরিয়ে দিল। সে ধর্মান্তরিত হয়েছে। মিশে গেছে সংখ্যাগুরুর সাথে। এবার বদলে ফেলতে চায় আমাদেরও। আমাদের চোখের সামনে আছড়ে ভাঙল আমাদের দেবতার মূর্তি। প্রসাব করে দিল একটা লোক ভাঙা দেবতার গায়ে।ছিঁড়ে টুকরো  টুকরো করে দিল সব পুরাণো বই পত্র। বুড়োবুড়িরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, চিৎকার করলেই মুখে তরবারির ঘা। আমি গালি দিলাম, হারামজাদি তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম? আমার চোখে একটা ছুরি গেঁথে দিল একটা লোক। ওর বাবাকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে সে কি মার। রাক্ষসী বলল, হয় নতুন ধর্ম গ্রহণ করো, নাহলে তোমাদের চোখের সামনে তোমাদের বাচ্ছাদের জবাই করব। ওর বাবা মাটি থেকে চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দে মা। বাচ্ছা গুলোকে ছেড়ে দে। ছেড়ে দে।” বুড়ি এবার হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল।
বুড়ো ধরল,“ ছাড়ল না।  একটা একটা করে পরিবার ধরে ধরে শেষ করল। রয়ে গেলাম শুধু কয়েকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা।  মেয়ে উঁচু সিংহাসন থেকে বলল, ও ইচ্ছা করেই নিজের গাঁয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এসেছে। যাতে আরো ক্ষমতা পেতে পারে, দেশের রাণী হতে চায় আমার মেয়ে।  এই  আধমরা বুড়োবুড়ি গুলোকে গিনিপিগের মত দেখাবে গোটা দেশে।
চোখের সামনে মৃত সন্তানের রক্তাক্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন  দেহ দেখে কার আর বাঁচার ইচ্ছা থাকে? ওদের কারো ছিল না, ওরা মরতে প্রস্তুত ছিল। আমি তাও করজোড়ে রাক্ষসীকে বললাম, আজ রাতটা দে মা।  কাল আমরা সবাই তোর ধর্ম নেব। বিশ্বাস করল মেয়ে। রাতে সে কি মোচ্ছব। আমরা কয়েকজন বিধ্বস্ত পরাজিত বুড়োবুড়ি শোনিত সিক্ত মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি, বুক চাপড়ে কাঁদছি, আর আমাদেরই গৃহ লুন্ঠিত  ভোজ্যদ্রব্য মদ্যে সে কি উল্লাস রাক্ষসী আর তার সহচরদের। ভোরের ঠিক আগে সব থেমে গেল, মদের বোতলের মতই গড়াগড়ি যাচ্ছে সব। আমরা উঠলাম, বিলাস গৃহের দরজা বন্ধ করে দিলাম, বাইরে থেকে।  তারপর আগুনননন----
জ্বলন্ত যতুগৃহ পিছনে ফেলে আমরা পালালাম, বাঁচব বলে। এত কিছুর পর বেঁচে থাকাই হবে আমাদের প্রতিবাদ।  কিন্তু রাক্ষসী মরেও পিছু ছাড়েনি।  যখনই রাতে কেউ ঘুমোয়, রাক্ষসী তার স্বপনে এসে হানা দেয়। এমন ভয়ানক অত্যাচার চালায়, যাতে সে বলতে বাধ্য হয় আমরা কোথায় লুকিয়ে আছি। আর জানতে পারলেই এসে হানা দেয়। পালাতে হয় আবার। কিন্তু সবাই পালাতে পারি না।  কতজনকে যে খেল শয়তানি তার ইয়ত্তা নেই”।
আমার কাঁধে ডিদির মাথা, হঠাৎ ভয়ানক কাঁপতে লাগল। “না- না-না” ডিদির চিৎকারে সবাই আঁতকে উঠল। “ওকি ঘুমিয়ে পড়েছে?” আঁতকে উঠল বৃদ্ধ বৃদ্ধা। হামা দিয়ে এগিয়ে এসে প্রচণ্ড ঝাঁকাতে লাগল, ডিদিকে। “ছেড়ে দে।  ছেড়ে দে ওকে শয়তানি। ওকে ছাড়।” ডিদির মুখে বরফ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল একজন, যার ছিটেয় কেঁপে উঠলাম আমি। ডি দি তাও চোখ খুলছে না। ওরা বলল, “পালাও। ওকে নিয়ে পালাও। যেভাবে পারো পালাও।  আমরা ওর শত্রু।  তোমরা নও। পালালে হয়তো ও তোমাদের ছেড়ে দেবে। ” পালাই? কি করে পালাই। বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার, বৃষ্টি, হায়না, সর্বোপরি কনকনে ঠান্ডা। ডিদিকে চাগিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ওঠো। ওঠো ডিদি।  ওঠো। হঠাৎ ডিদি চোখ খুলল, দুচোখে সাংঘাতিক আতঙ্ক। আঙুল দরজার দিকে দেখিয়ে বলল,“ও এসে গেছে। ” দড়াম করে একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া নিয়ে যে ঢুকল, তার গোটা শরীর পুড়ে ঝলসে কালো। মুখের চামড়া গলে জুড়ে গেছে গলার সঙ্গে। মাথাটা একদিকে বেঁকানো। মাথার চুল আধপোড়া। দুটি গলে যাওয়া চোখ সাক্ষাৎ আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। 
প্রবল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে দেখি, নিজের ঘরেই আছি। ঘর অন্ধকার, এসি চলছে, মৃদু সবুজ রাত আলোয় অদ্ভুত ঘরোয়া উষ্ণতা। শৌভিক ক্লান্ত ঘ্যানঘেনে স্বরে বলছে,“ আবার? তোর এই স্বপ্নের ঠেলায় আমি এবার গৃহত্যাগ  করব মাইরি”। একটু ভালো করে জড়িয়ে ধরলাম বর আর মেয়েকে, স্বপ্নই তো।  সত্যই কি কারো আসার ক্ষমতা আছে।
পরদিন সকালে ডিদির মেসেজ পেয়ে চমকে গেলাম,ডি দি লিখেছে,“ অফিসে এসে ঢুলছি। কালরাতে একদম ঘুম হয়নি। কি সাংঘাতিক ভূতের স্বপ্ন দেখলাম, ভাবলেই ভয় লাগছে। মেয়ে ভূত। চোখ গলা মেয়ে ভূত বাপরে। তুমিও ছিলে স্বপ্নে অনিন্দিতা। ”
©Aninditasblog

Saturday 2 September 2017

এক নম্বর ফরজানা


আশার ফোনটা যখন এল, ইউসুফ তখন অভ্যাগতদের সাথে গল্পে মত্ত ছিল। আজ বকরিদ। সকাল থেকেই দারুণ আবহাওয়া, সমুদ্র নীল রঙের আকাশে ভাসমান পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ, কাঁচা সোনা রোদে ঝকমক করছে কাদখালি গ্রাম। কিন্তু সে রোদ বড় মিঠে, অন্য দিনের মত চামড়া জ্বালানো রোদ নয়, মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। কোরবানি ভালো ভাবেই মিটে যাবার পর, আত্মীয়স্বজন- প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি মাংস বিলি করে সদ্য বাড়ি ফিরেছে ইউসুফ।ওনারাও কয়েকজন দিতে এসেছেন। রামনগর হাইস্কুলের হেড মাস্টার ইউসুফকে নিয়ে কাদখালির গ্রামের একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। শৈশবে যারা পাত্তাও দিত না, আজ তারাই ইউসুফ মাস্টার বলতে অজ্ঞান।

এই রকমই কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিল ইউসুফ, হঠাৎ পাঞ্জাবির পকেটে মৃদু কম্পন অনুভূত হল,আশার ফোন দেখে হাল্কা হাসির রেখা খেলে গেল ইউসুফের ঠোঁটে। রেহানা পাশের বাড়ির খালার সাথে গল্পে মশগুল ছিল, ইউসুফ হাসি চেপে বলল, “রেহানা, আশার ফোন।“ রেহানা, হাসি চেপে বলল, “বলে দাও মাংস খেতে হলে এখানে এসে খেতে হবে।“আশাবরী ইউসুফের সহপাঠী। পাশের রামনগর গ্রামেই বাড়ি, বরাবর একই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে একসাথেই দুজনে  একই সাথে পরীক্ষা দিয়ে প্রধান শিক্ষক হয়। ইউসুফ যেমন পাশের রামনগর হাইস্কুলের হেড স্যার, আশাবরী তেমনি কাটোয়ার একটি মেয়েদের স্কুলের বড়দি।  আশার বয়স পঞ্চাশ হলে কি হবে,বিয়ে থা করেনি এবং সাংসারিক ব্যাপারে এক্কেবারে অপদার্থ। আশার রান্না মুখে তোলা দুষ্কর। তাই প্রতি বকরিদেই রেহানা অর্থাৎ ইউসুফের ঘরণীই মাংস রান্না করে দেয়,আশা আসে, দুপুর বেলায় সবাই একসাথেই খাওয়া দাওয়া করে, রাতেও রেহানা, মাংস-রুটি করে ইউসুফের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় বিশ বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে আসছে, তবু প্রতিবার আশা ফোন করে, চিৎকার করে, “আমার মাংস কোথায়?”

ইউসুফ ফোন ধরে, আশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তরল গলায় বলে উঠল, “ আমি মাংস নিয়েই যাচ্ছিলাম রে, রেহানা যেতে দিল না। তুই চলে আয়-“। ইউসুফ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, আশার গলা শুনে চমকে উঠল, আশাবরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, “ইউসুফ ফরজানা এসেছে।“ মানে? ফরজানা হল ইউসুফ আর রেহানার একমাত্র অষ্টাদশী কন্যা। এ বছরই মেডিক্যালে চান্স পেয়ে কলকাতায় পড়তে গেছে। যথারীতি কলকাতায় এসেই মেয়ের পাখনা গজিয়েছে, বকরিদে একদিনের ছুটিতে তিনি নাকি আসবেন না। সামনেই লম্বা দুর্গা পুজোর ছুটি পড়তে চলেছে, তখন এসে আম্মি-আব্বুকে ধন্য করবেন। তাহলে হঠাৎ কি হল? কাল রাতেও মেয়ের সাথে কথা হয়েছে, সকাল থেকে হয়নি অবশ্য। ফরজানা আশাবরীর মন্ত্রশিষ্য, কিন্তু তাই বলে ঈদের দিন, এভাবে, ব্যাপারটা কিছুতেই ইউসুফের মাথায় ঢুকল না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শুধু বলল, “ফরজানা? কিন্তু বুল্টি যে বলল পুজোর ছুটির আগে আসতে পারবে না?” মেয়ের নাম শুনে রেহানাও অবাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আছে, আশাবরী ক্লান্ত স্বরে বলল, “ঐ ফরজানা নয় ইউসুফ। এক নম্বর ফরজানা।“

সুদূর মুর্শিদাবাদের দুটি ছোট গ্রাম, রামনগর আর কাদখালি। নাম শুনেই বোঝা যায়, একটি হিন্দু এবং অপরটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। শিয়ালদহ থেকে সকাল আটটা নাগাদ ছেড়ে কুঝিকঝিক করতে করতে লালগোলা প্যাসেঞ্জার যখন পলাশী  পৌছয় সূর্য তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই মধ্য গগন ত্যাগ করে। পলাশী ষ্টেশন থেকে রিক্সা বা বাসে করে আম বাগানের ভিতর দিয়ে রামনগর সুগার মিলের পাশ কাটিয়ে পলাশী হাইস্কুলের সামনে দিয়ে গিয়ে সোজা গঙ্গার ঘাট। আগে নাকি বর্ষা ছাড়া  অন্য সময় গঙ্গায় হাঁটু জল থাকত, তবে ফরাক্কা হবার পর, গঙ্গা সব সময়ই টইটুম্বুর। হাতে টানা নৌকায় চেপে ওপাড়ে রামনগর ঘাট। রাক্ষসী গঙ্গা প্রতিনিয়ত একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে রামনগর গ্রামকে, নৌকা থেকেই দূরে রামনগর সুগারমিলের জিএম বাংলো দেখা যায়। সাহেব দের বানানো সাবেকী কুঠি, লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ দিয়ে ঘেরা।এই সুগারমিলই ছিল রামনগর-কাদখালির লক্ষ্মী। মুর্শিদাবাদের উর্বর মাটিতে আখের ফলন হত দেখবার মত, সেই আখেই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ত সুগারমিল। সে সুদিন বহুদিন গত, আশাবরী-ইউসুফের ছোট বেলা জুড়ে শুধু ভাঙনের গল্প। আজব ব্যাপার মিলটা গঙ্গার এপাড়ে হলেও জিএম এবং এজিএম বাংলো কিন্তু ওপাড়ে, রামনগর গ্রামে। সাহেব সুবোদের ব্যাপার স্যাপারই অন্য রকম ছিল। এখন যদিও কেউ থাকে না ঐ বাংলোয়। চাপড়া খসে খসে পড়ছে, লাল কৃষ্ণচূড়ায় প্রতিফলিত পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মনে হয় রক্তাক্ত কুঠি একা দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করছে।

এই রামনগর গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী মজুমদার বাড়ির ছোট মেয়ে আশাবরী, কাদখালির ছোট্ট মুদির দোকানের মালিক এনায়েৎ মোল্লার মেজ ছেলে ইউসুফ আর ঐ গ্রামেরই তালাকশুদা ফাতিমা বিবির একমাত্র কন্যা ফরজানা একই সাথে রামনগর হাইস্কুলে ভর্তি হয়। সবে সত্তরের দশক পড়েছে, পশ্চিম বাংলা তখনও নকশাল দের রক্ত ধুয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু সেই রক্তের ছিটে আশা-ইউসুফ-ফরজানার জীবনে লাগেনি। আশাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল, ওর ঠাকুমা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মজুমদার গিন্নির ভয়ে তৎকালীন হেড স্যার যাকে আড়ালে সবাই মুচি মাস্টার বলত, প্রায় কাঁপছিল। ইউসুফ গিয়েছিল তার বড় ভাই ওয়াসিমের সঙ্গে, ওয়াসিম ঐ স্কুলেই ক্লাশ ফোরে পড়ত। আর ফরজানাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর মা, ফাতিমা বিবি। সেদিনেই ভর্তি, সেদিন থেকেই ক্লাশ। কোন ইউনিফর্মের বালাই ছিল না। বাড়িতে তিনজনেই ইজের পরে ঘুরত হয়তো, স্কুল বলেই ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা করে জামা ছিল। আশার থেকে ইউসুফের জামা একটু মলিন ছিল, আর ফরজানারটা তাপ্পি মারা ছিল। তাতে কি? রামনগর হাইস্কুলের ছারপোকাওলা বেঞ্চ সেদিন সাক্ষী ছিল, “শিশুর সাম্যবাদ।“ প্রথম দিন থেকেই তিনজন হরিহর আত্মা।

এক নম্বর ফরজানা (পর্ব -২)
রামনগর হাইস্কুলের দিনগুলি বোধহয় আশাবরী, ইউসুফ আর ফরজানার জীবনের সবথেকে বর্ণময় দিন ছিল। তিনজনের মধ্যে ফরজানা ছিল পড়াশোনায় সবথেকে ভালো। ফরজানা যেখানে ৭০/৭৫ এর নীচে নামত না, আশা আর ইউসুফ সেখানে কোনমতে পাশ টুকু করত, তাও একে অপরের ভরসায়। আশা ৪৫ পেলে ইউসুফ পেত ৪৪ বা ৪৬। শেষ বেঞ্চে বসে নরক গুলজার করাই ছিল দুজনের মোক্ষ।

কি যে সুন্দর দিল ছিল সে সব, রামনগর গ্রামের সীমানা বরাবর ছিল বিশাল আমবাগান। কথিত আছে এই সেই পলাশীর বিখ্যাত আম বাগান, সেই রক্তাক্ত রণাঙ্গন, যেখানে সুবা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব পরাস্ত হন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে। সেই আমবাগানের আয়তন ছিল নাকি কমবেশি প্রায় এক লক্ষ বিঘা। সিরাজের স্মৃতি বিজড়িত আমবাগানকে কেন্দ্র করে যাতে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সেন্টিমেন্ট না গড়ে ওঠে, তাই যুদ্ধে জয়ী হবার পর, নির্মম ভাবে, ঐ আমবাগান কেটে সাফ করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তী কালে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় ঐ এক লক্ষ বিঘা জমি কিনে নেন, জনৈক রামলোচন ঠাকুর। তাঁর নামেই রামনগর। পরবর্তী কালে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেই পূর্বেকার গঙ্গার খাতটা এখনও আছে, রামনগর আর কাদখালির মাঝে, অশ্বক্ষুরাকৃতি সেই হ্রদের স্থানীয় নাম বাদুরি। গঙ্গার ধার বরাবর আবার গড়ে ওঠে বিশাল আম বাগান। নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর বিশাল বিশাল মহীরুহ, নামে আম বাগান হলেও আসলে সুমিষ্ট আম আর রসালো লিচু গাছের পরিকল্পিত জঙ্গল। গরম কালে সেই আম বাগান ইজারা নিত ব্যবসায়ীরা, তাদের পেটোয়া লোকজন তাঁবু ফেলে বাগান পাহারা দিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই তিন মূর্তিকে আটকায় কার সাধ্যি।ঠাঠা রোদ হোক বা পড়ন্ত বিকেল বাঁদরের মত গাছে গাছে ঝুলে আম পাড়া ছিল দৈনন্দিন রুটিন। মিষ্ট আম লিচুর লোভে গাছ ভরে থাকত ঝাঁক ঝাঁক লাল পিঁপড়েয়, তাই সারা গায়, কেরোসিন তেল মেখে আম চুরি করে বেড়াত তিন মূর্তি।

তারপর আসত ভরা বর্ষা, প্যাচপ্যাচে কাদা মেখে হুড়োহুড়ি খেলা। ফি বছর বন্যা হত, জলে ভেসে যেত মাঠ-ঘাট। স্কুলও বন্ধ থাকত তখন। উপায়ন্তর না থাকলে কিছুদিন অদর্শনেই কাটত ওদের দিন। তারপর পুজোর দামামা বাজাতে বাজাতে আসত শরৎ। শরতে আশাবরীদের বাড়িতে দুর্গা পুজো হত, এখনও হয় যদিও,ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের সাথে সাথে ইউসুফ আর ফরজানারও চারদিন ধরেই নিমন্ত্রণ থাকত। দুর্গা মণ্ডপের সামনে বিশাল খোলা চত্বরে ঠেক বসত, কোথাও আশার বাবা-কাকা এবং তাদের বন্ধুরা বসত, কোথাও বা দাদা-দিদি-বউদি-জামাই বাবুদের ঠেক বসত, আশাদেরও নির্দিষ্ট ঠেকের জায়গা ছিল। পুজোর গান, শারদীয়ার গল্প আর মাস্টার মশাইদের নকলনবিশীতে কোথা দিয়ে যে কেটে যেত চারদিন হদিস থাকত না কারো। দশমীতে ভাসান দেখার আনন্দই ছিল আলাদা, এখানে বলে বাইচ বা বাচ। দুটি নৌকায় করে একচালা প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝ গঙ্গায়, তারপর নৌকা দুটি ক্রমশ আলাদা হতে থাকে, এক সময় ঝুপ করে মায়ের মূর্তি জলে পড়ে যায়। বিভিন্ন প্রতিমার মধ্যে বাচ প্রতিযোগিতা হত, গঙ্গার ঘাটে যেন মেলা বসে যেত ঐ দিনে। কাতারে কাতারে মানুষ, জাতিধর্ম নির্বিশেষে নতুন বা অপেক্ষাকৃত চকচকে পোশাকে ভিড় জমাত বাচ দেখবে বলে। পুজোর পরপরই বেশ ঠান্ডা পড়ে যেত। ডিসেম্বরে থাকত বার্ষিক পরীক্ষা, পরীক্ষা মিটলেই পুরো দমে দুষ্টুমি শুরু হয়ে যেত। ভোর বেলা খেজুরের রস চুরি করা, খেতের টাটকা মুসুর কড়াই, ওরা বলত মুসুরি চিবোতে চিবোতে বাদুরির ধারে আড্ডা, এক সাথে সাইকেল চালাতে শেখা, লুকিয়ে বিড়ি ফোঁকা, তারপর লেবু পাতা চিবিয়ে বাড়ি ফেরা, কি সব স্বর্গীয় দিন ছিল সে সব।

অষ্টম শ্রেণী অবধি রামনগর হাইস্কুলে পড়ার পর, ওরা ভর্তি হল পলাশী হাইস্কুলে। গঙ্গা পেরিয়ে এপাশে এসে, সাইকেলে মিনিট দশ লাগত, আর হেঁটে পনেরো মিনিট। আশা আর ইউসুফের সাইকেল ছিল, লেডিস সাইকেলের বালাই ছিল না, আশা ওর বাবার সাইকেলই নিয়ে যেত। কোনদিন আশা চালাতো ফরজানা সামনে বসত, আবার কোনদিন উল্টে বসত ওরা। তখন ওরা ক্লাশ নাইন, সেদিনের কথা ইউসুফ বা আশা আজো ভোলেনি, বাদুরির ধারে বিশাল পাম্প হাউসের সামনের চাতালে বসে গপ্প করছিল তিনজনে, ইউসুফ মাঝে মাঝে সাইকেলে চড়ে নানা কারিকুরি দেখাচ্ছিল, হঠাৎ কাদখালি থেকে একজন লোক দৌড়তে দৌড়তে এল, “ফজ্জানা!ফজ্জানা জলদি চল, ফাতিমা গায়ে আগুন দিছে।“
(চলবে)