Sunday 15 October 2017

ফেমিনিস্টের ডাইরি


 ফেমিনিস্টির ডাইরী ৩০শে চৈত্র ১৪২৪
হাহুতাশ, প্রতিবাদ, ক্ষোভ, দোষারোপ, অনেক হল, আসুন এবার একটু সচেতন হই। 
প্রথমতঃ বাচ্ছাদের সাথে দয়া করে খোলাখুলি কথা বলুন।যারা পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত  হচ্ছে, তাদেরই সর্বাগ্রে  সচেতন করা প্রয়োজন। 
দ্বিতীয়তঃ ওকে বোঝান, গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ কাকে বলে। শুধু একবার বুঝিয়েই ক্ষান্ত হবেন না, বারবার বলতে থাকুন।গুড টাচ যেমন আপনার স্পর্শ। যাতে শুধু আদর আর ভালবাসা মাখামাখি। আর ব্যাড টাচ? ব্যাড টাচ হল এমন যে কোন স্পর্শ যাতেশিশু কুঁকড়ে যায়, ভয় পায় বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ওকে বোঝান ব্যাড টাচ তার প্রথম চোটে ভালোও লাগতে পারে, কিন্তু পরিশেষে একটা অদ্ভূত অস্বস্তি ছেড়ে যাবে। সেই অনুভূতিটাকেশিশু যেন উপেক্ষা না করে এবং সময় নষ্ট না করে আপনাকে খুলে বলে। আপনাকে যদি বলতে ভয় পায়, তাহলে অন্য কোন গুরুজন, যে শিশুর অত্যন্ত প্রিয় তাকে বলুক। কিন্তু বলাটা জরুরী। 
তৃতীয়্তঃ বোঝান শিশু নির্যাতন কাকে বলে। সাধারণত  নির্যাতন বলতে মারধোর ইত্যাদিকেও বোঝায়।আপনার অবহেলা,যথাযথ সময় দিতে না পারা বা দুচার ঘা চপেটাঘাত ও নির্যাতনের সংজ্ঞায় পড়ে।  তাই আলাদা ভাবে বোঝান যৌন নির্যাতন কাকে বলে। 
যৌন নির্যাতনে যাবার আগে,আরেকবার ঝালিয়ে নিন, ব্যক্তিগত অঙ্গ বা দেহাংশ কাকে বলে। সাধারণতঃ বক্ষ, যৌনাঙ্গ এবং পশ্চাতদেশকেই আমরা ব্যক্তিগত অঙ্গ বলি। তবে আজকাল সুইম সুট রুল বেশী চলে। মহিলাদের সুইমসুটে শরীরের যে অঙ্গসমূহ ঢাকা থাকে, তার সমস্তটুকুই বাচ্ছাদের ব্যক্তিগত। 
এবার আসি কাকে বলে যৌন নির্যাতনে?
১। অবশ্যই ধর্ষণ বা পেনিট্রেশন। 
২। ব্যক্তিগত অঙ্গে বারবার স্পর্শ, আদর, বা চুম্বন করা। যা অনেক ঠাকুমা দিদিমা স্থানীয় মহিলারাও অনেক সময় সস্নেহে করে থাকেন।গুলি মারুন ওমন ভালোবাসায়। শিশুর শরীর তার নিজের সম্পত্তি। তার ব্যক্তিগত অঙ্গে এমনকি বাবা-মায়েরও অকারণে হাত দেবার অধিকার নেই। যদি আপনার নিজের এমন আদর করার  অভ্যেস থাকে, তো এই মুহূর্তে বন্ধ করুন।দুষ্টু লোকেরা যখন ঐ কাজটিই করবে, আপনার শিশু ভাববে আহাঃ আদরই তো। মা বা বাবাও তো হাত দেয়।  
৩। শিশুর সামনে ব্যক্তিগত অঙ্গ প্রদর্শন। খেয়াল রাখুন, শিশুকেও সচেতন করুন। শিশুদের মধ্যে বড়দের যৌনাঙ্গ সম্পর্কে সীমাহীন কৌতূহল থাকে। কেউ যেন তার সুযোগ না নেয়। প্রয়োজনে সেই কৌতূহল আপনি চরিতার্থ করুন। এ কৌতূহল তো অন্যায় কিছু নয়। তাহলে জবাব দিতে সঙ্কোচ কিসের? কাগজে এঁকে বোঝান,নেটে দেখান কিন্তু লুকিয়ে রাখবেন না। শিশুর না মনে হয় এটা অত্যন্ত নিষিদ্ধ কোন এলাকা। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ মানব চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিশুরাও তার ব্যতিক্রম নয়।
 ৪। শিশুকে অশ্লীল ছবি,বই বা সিনেমা দেখানো।  শিশুকে বোঝান, কেউ যদি এমন করে, তৎক্ষণাৎ যেন সেই স্থান পরিত্যাগ করে। শুধু তাই নয়, তখুনি যেন আপনাকে জানায়। 
৫। শিশুকে শেখান যেমন তার ব্যক্তিগত অঙ্গে কেউ হাত দেবে না,তেমনি সেও না কারো ব্যক্তিগত অংশে হাত দেয়। যদি কেউ এই ধরণের কথা বলে বা অনুরোধ করে, তার ত্রিসীমানাতেও আপনার সন্তানকে যেতে দেবেন না। 
 চতুর্থতঃ আপনার শিশু যদি আপনার থেকেও বেশী অন্য কারো অনুরক্ত হয়ে পড়ে, সাবধান হয়ে যান। নজর রাখুন। 
পঞ্চমতঃ শিশুকে জোর গলায় না বলতে শেখান। “না” মানে না। 
বাচ্ছাকে শেখান, যাই ঘটুক, যদি সেটা তার পক্ষে অস্বস্তিকর হয়, তাহলে তার না বলার পূর্ণ অধিকার আছে। ভদ্রতা বা গুড ম্যানার জাহান্নামে যাক। 
ষষ্ঠতঃ বাচ্ছাদের তাদের অ্যানাটমি সম্পর্কে সচেতন করুন। দয়া করে অঙ্গগুলির বিশেষতঃ যৌনাঙ্গগুলির সঠিক নাম শেখান। যাতে অস্বস্তিকর অবস্থায় তারা বুঝতে পারে তাদের সাথে কি হচ্ছে এবং খোলাখুলি ভাবে আপনাকে জানাতে পারে।  সন্টু মন্টু টিটিকাকা ইত্যাদি ন্যাকা আদরের নাম আপনার শিশুকে শুধু বিপদেই ফেলতে পারে। 
সপ্তমতঃ একটু নজর রাখুন, কোন প্রাপ্তবয়স্ক  ব্যক্তি আপনার শিশুর প্রতি অতিস্নেহশীল হচ্ছেন কি না।  শিশুকে কারণে অকারণে মূল্যবান উপহার দেওয়া বা শিশুর সাথে  একান্তে কিছুটা সময় কাটানোর মত ঘটনা ঘটতে দেখলে সাবধান হয়ে যান। 
অষ্টমতঃ শিশুকে কখনই একাকী কোন প্রতিবেশীর বাড়ি যেতে দেবেন না। 
নবমতঃ শিশুকে সচেতন করুন স্কুলেও যেন একাকী কোথাও না যায়। ফাঁকা ক্লাশরুম, ফাঁকা টয়লেট, ছাত অত্যন্ত ভয়ঙ্কর জায়গা। কোথায় যে রাক্ষস খোক্ষস লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। এমনকি কোন শিক্ষকও যদি একান্তে সাক্ষাৎ করতে চায় শিশুর সাথে, সেখানেও যেন দল বেঁধে উপস্থিত হয় শিশুরা। 
এত সাবধানতা সত্তেও ভবিষ্যতের গর্ভে কি লুকিয়ে আছে জানেন শুধু মহাকাল। 
তবু আমার প্রিয়তম কবি নির্মলেন্দু  গুণের ভাষায়, 
“দুঃখকে স্বীকার করো না, মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে ।
যদি মরতেই হয় আনন্দের হাত ধ’রে মরো ।
বলো, দুঃখ নয়, আনন্দের মধ্যেই আমার জন্ম,
আনন্দের মধ্যেই আমার মৃত্যু, আমার অবসান ।"- 
নির্মলেন্দু গুণ
শুভ নববর্ষ ১৪২৫।  যাদের ভালবাসি তাদের জন্য রইল নীরব অফুরন্ত ভালবাসা। আর যাদের বাসি না, তাদের জন্য শুভেচ্ছা  এবং শুভকামনা। খুব ভাল থাকুন সবাই।

  ফেমিনিস্টের ডাইরি #১১ ০৩/১২/২০১৭
হতবাক হয়ে যাচ্ছি জনতার উন্মাদনা দেখে।
কেউ বলছেন থানা পুলিশের দরকার নেই, জনতার হাতে ছেড়ে দাও। একজন ধর্ষককে পিটিয়ে হাতের সুখ করেনি দেখবে আর কেউ কোনদিন কিচ্ছুটি করবে না। সত্যি?যিনি বলছেন এবং যিনি শেয়ার করছেন তাঁরা এই স্তোক বাক্যে বিশ্বাস করেন তো?কেউ বলছেন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দাও, অঙ্গচ্ছেদ করে দাও, শরিয়তি আইনে বিচার কর ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে বলুন,বলার পূর্ণ অধিকার তথা স্বাধীনতা আপনার আছে। যদিও সংবিধানে বর্ণিত বাক স্বাধীনতা সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারে স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে, আপনার বক্তব্য যদি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি হিংসা বা দ্বেষমূলক হয়,তাহলে সেই বক্তব্য কখনই মৌলিক অধিকারের অঙ্গ হতে পারে না। সে ছাড়ুন। ঐ লোকটি বা লোকগুলি  মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেছে?। ওরা যে জঘণ্য অপরাধ করেছে,এরপর ওরা সমাজ তথা জনগণের সম্পত্তি। 
এদের যা খুশি বলা যায়, শুধু এদের কেন, এদের পরিবারের সকলকে নিয়ে যাচ্ছেতাই রকমের নোংরা ভাষায় খিস্তিখেউড় করা যায়। বস্ ফেবুতে হেপ হতে হলে এসব করতে হয়। শুধু কি তাই,এবার লোকটিকে ফেবুতে খুঁজে বার করতে হয় এবং তার প্রোফাইলের স্ক্রিনশট সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিতে হয়। তার যেকটি ছবি পাবেন প্রোফাইলে সেগুলোও ছড়িয়ে দিন। ছবিতে যদি তার স্ত্রী থাকে,তাহলে আরো ভালো,শয়তানটার স্ত্রীকেও চিনুক না লোকে।কি অসুবিধা আছে?  দিনকয়েক আগে পাহাড়ে নিহত  পুলিশ কর্মীটির ক্ষেত্রেও অবশ্য আপনারা তাই করেছিলেন। তবে সেবারে গভীর বেদনা ছিল স্টিমুলেটর আর এবারে গভীর বেদনা এবং তজ্জনিত ক্রোধ। ওসব রাইট টু প্রাইভেসি টাইভেসি নেহাৎ বাতেলা মাত্র। 
এই অবধি তাও ঠিক ছিল,জনৈকা ওস্তাদ পরচর্চালোভী মহিলা আবার অভিযুক্ত শিক্ষকের স্ত্রীকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বসলেন। বউটি রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করা মাত্রই মেসেঞ্জারে তির ছুঁড়লেন,“জানো তো তোমার বর কি করেছে?”একেই বোধহয় বলে কাটা গায়ে নুনের ছিটে। আরে ঐ বউটির মানসিক অবস্থা এই মুহূর্তে কি তা অনুমান করা কি এতই দুষ্কর? তারওপর তাকে তার স্বামী সম্পর্কে নোংরা কথা বললে, তিনি কি ভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন?তিনিও জবাবে বললেন,“কুত্তার বাচ্ছা। তুই কি জানিস সত্যি কি?” ব্যস্ উৎসুক মহিলা বউটিকে একগাদা গালমন্দ করে দিলেন স্ক্রীন শট বাজারে ছেড়ে। অমনি পিএনপিসি করা মেসো পিসে মামা কাকা দাদা দিদির দল সম্মিলিত ভাবে শুরু করলেন সম্পূর্ণ অচেনা একটি বউয়ের চরিত্রের গুষ্টি উদ্ধার। আরে আমি তো বলব,বউটি কিছুই বলেনি। আরো তীব্র এবং কটু ভাষা প্রয়োগ করা উচিৎ এই ধরণের চোখে আঙুল দাদাদিদিদের উদ্দেশ্যে। বউটি তার স্বামীকে ত্যাগ করবে কি করবে না সেটা একান্ত ভাবেই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে মাতব্বরী করার অধিকার কে দিয়েছে? নিজের বর্ণহীণ আলুনি জীবনে ঝালনুন ছিটোতে দিয়ে পরের ক্ষতকে রক্তাক্ত  করে দেবেন? প্রতিটি ঘটে যাওয়া অঘটন বিশ্লেষণের পিছনে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকে। একাধিক সত্য। তার কিছুই আপনি জানেন না। জানেন খালি মিডিয়া পরিবেশিত রগরগে কিছু গল্প। 
বুকে হাত দিয়ে বলুন তো,ঘটনাটি যদি কলকাতা শহরে না ঘটে সুদূর কোন মফঃস্বলে ঘটে থাকত, অথবা কোন গ্রামে। আর শিক্ষক যদি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত সঙ্গতিসম্পন্ন হত,তখন?করতেন এই ফেবু বিপ্লব? পুরুলিয়ার বছর তিনেকের বাচ্ছাটি যার মা স্বামী পরিত্যক্তা,গৃহপরিচারিকা এবং শিশুর ওপর নিপীড়ন করে বাড়ির প্রৌঢ় মালিক কচি দেহে ঢুকিয়ে দিয়েছিল একাধিক সূঁচ,তখনও অনেকে ফেবুতে চিল্লিয়ে মাৎ করেছিল। তারপর?

মালদার সেই হতদরিদ্র পরিবারের ধর্ষিত শিশুটিকে কোলে নিয়ে বারো ঘন্টা মেডিকেল টেস্টের জন্য হাসপাতালে হাপিত্যেস করে বসেছিল বাবা,কেন?না অমুক ডাক্তার বাবু আসেননি,তমুক ডাক্তার বাবু ব্যস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। বারো ঘন্টা। চিন্তা করতে পারেন?বারো ঘন্টা পরে আর ধর্ষণের কোন ফরেন্সিক প্রমাণ পাবেন? অসহায় বাপ মেয়ে একই সুরে কাঁদছিল পড়ন্ত বিকালে,তখন যে রাজনৈতিক নেতাদের উদয়াস্ত গাল পাড়েন,  তাদেরই একজন কোন নিকটাত্মীয়কে দেখে বেড়োতে গিয়ে দেখতে পায়। অতঃপর তাঁর চিল্লাচিল্লিতে ডাক্তার এসে দয়া করেন দুগ্ধ্যপোষ্য শিশুটির ওপর। তাকে নিয়ে কেউ এক ছত্রও লিখে থাকলে কুর্ণিস জানাই।

 পূর্ব মেদিনীপুর গ্রামের নিপাট নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির বছর ১৩র মেয়ে দুর্গাপুজোর অষ্টমী বা নবমীর দিন স্নান করতে গিয়ে দেখে,পাশের বাড়ির কয়েকটি ছেলে গাছে উঠে স্নানের ভিডিও তুলছে। মেয়েটির পরিবার প্রতিবাদ করতে যায় যখন, তখন তাদের বেধড়ক পিটিয়ে তাদের চোখের সামনে ১৩আর ১৭বছরের দুই বোনকে টেনে নিয়ে গিয়ে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয় দুষ্কৃতিরা। তারপরের কথা লেখার সাহস বা ক্ষমতা আমার নেই। আর নেই। দু দুবার শেয়ার করেছি তাদের পোস্টটা। ক্ষত বিক্ষত মেয়েগুলির ছবি সমেত। তথাকথিত আমার ফেবুর ভদ্রলোক বন্ধুবান্ধব কেউ একটা মন্তব্য করে সহমর্মিতা  জানাবারও প্রয়োজন বোধ করেননি। কেন?কারণ তারা আপনার আমার শ্রেণী গোত্রীয় নয়। আর এই শিশুটি আমাদের মত বাড়ির মেয়ে। আমাদের বাচ্ছারা যে সব স্কুলে পড়তে যায়, সেখানে পড়ে, সে যখন নির্যাতিত হল,আপনারা প্রতিবাদের ঝড় বইয়ে দিলেন। রোজ কত কিঘটে যায়, কতগুলি কেসের খোঁজ রাখেন? রাখার কথাও নয়। রাখে শুধু বাদী আর বিবাদীর পরিবার। তাদের একটু শান্তি দিন না মশাই।
 ফেমিনিস্টের ডাইরি #১০ ০২/১২/২০১৭
তাহলে?ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?পুরুষ হিসাবে আপনি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না,তাই তো?কিন্তু কেন? কোথায় কোন অনামুখো অপগণ্ডো কি অপকর্ম ঘটিয়েছে, তার জন্য সমগ্র পুরুষ জাতিকে দায়ী করাটা কি যুক্তিযুক্ত?হ্যাঁ যদি লাইক চান, অবশ্যই তাই চান,ফেসবুকে হেপ এণ্ড হ্যাপেনিং থাকতে হলে এই মুহূর্তে ঐ শিক্ষকটিকে বাপ-মা তুলে(আক্ষরিক অর্থেই কত ধরণের জীবজন্তুর বাচ্ছা যে বানালেন আপনারা লোকটিকে) গালাগাল দেওয়াটাই অবশ্য কর্তব্য। হল?পুরুষ হয়ে পুরুষ জাতকে খিস্তি মারলেন,বেশ,এবার শিক্ষক জাতকে গালাগাল দিন। বাপরে বাপ, এ ভাবে একজনের অপকর্মের দায়ভাগ রাতারাতি একটা গোটা পেশার ওপর চাপাতে আমি এর আগে দেখিনি। ভুল বললাম বোধহয়,গুটি কয়েক জালি ডাক্তার ধরা পড়তেই কারা যেন দুর্গা মণ্ডপে ডাক্তারাসুর বানিয়ে সস্তা চমক দিতে চেয়েছিল। এভাবেই শিক্ষকতা পেশাকে খিস্তি খেউর করাও পাতি সস্তা চমক ছাড়া কিছু মনে হয় আপনার? 
আপনি যতই চমকে যান না কেন, যতই আকাশ থেকে পড়ুন না কেন,যতই রবি ঠাকুরের বাণী ঝাড়ুন না কেন রূঢ় বাস্তব কি যানেন?শিশু নির্যাতন আগেও ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ধর্ষকের মধ্যে যে দমন করা বা ডমিনেশনের তীব্র ইচ্ছা থাকে, তা একজন শিশুর ওপর প্রয়োগ করা সবথেকে সহজ। নিষ্পাপ ফুলের মত গোবেচারা শিশুরা(ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই) খুব সহজে ভয় পেয়ে যায়। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম  করতে ব্যর্থ হয়। বাড়িতে খুলে বলতে সাহস পায় না, যতক্ষণ  না বেদনা অসহনীয় হয়ে ওঠে। সমাজ,প্রশাসন, সরকার, পুলিশ, স্কুল কতৃপক্ষ সকলকে কাঠগড়ায় চড়ান,চড়ানোই উচিৎ কিন্তু দয়া করে নিজেরাও একটু সচেতন হন। এ এমন এক ব্যধি যার আপাততঃ কোন চিকিৎসা নেই, সাবধানতাই একমাত্র উপায়। ২০০৭ সালে টাইমস্ অব ইণ্ডিয়ায় প্রকাশিত এক সমীক্ষানুসারে আমাদের দেশে গড়ে ৫৩শতাংশ শিশুই নির্যাতনের শিকার। যদিও রিপোর্টেড কেসের সংখ্যা নগণ্য। তাহলে কি করবেন?
১। শিশুর সাথে খোলাখুলি কথা বলুন। সংবাদ পত্রে যখনই এই ধরণের খবর দেখবেন শিশুকেও জানাতে ভুলবেন না। যাদের ওপর আক্রমণ ঘটছে, তারা যেন অন্ধকারে না থাকে। নিজের ভাষায় সহজ করে বলুন। কিন্তু বলুন অবশ্যই। শিশু যেন বুঝতে পারে ঐ ভুক্তভোগী শিশুটির মত ফাঁদে পা দিলে ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে। 
২। শিশুকে সহজ ভাষায় সেক্স এডুকেশন দিন। বারবার বলতে থাকুন,ওর মনে যেন গেঁথে যায়,প্রাইভেট পার্ট কাকে বলে। প্রাইভেট পার্ট কাকে বলে জানেন তো? না মোটেই শুধু যৌনাঙ্গটুকু না। মেয়েদের সুইমস্যুট পড়লে শরীরের যে অংশটুকু ঢাকা থাকে, অর্থাৎ কাঁধ থেকে উরু সন্ধি পর্যন্ত সবটুকুই হল প্রাইভেট বডি পার্ট। ওখানে বাবা মা এবং ডাক্তার ছাড়া আর কারো হাত দেওয়া গর্হিত অপরাধ। আদর করেও যেন কেউ না ঐ অংশে হাত দেয়। 
৩। শিশুকে বলুন অন্য কারো প্রাইভেট পার্টে হাত দেওয়াও জঘণ্যতম অপরাধ। শত অনুরোধেও যেন কারো বিশেষ অঙ্গে হাত দিতে না রাজি হয়। 
৪।আর যদি কেউ জবরদস্তি  হাত দেয়?শিশু যেন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। আঁচড়ে কামড়ে লাথি মেরে ছুটে পালিয়ে যায় তার কাছ থেকে। 
৫। এই ধরণের ঘটনা ঘটলে শিশু যেন অবশ্যই তার বাবা বা মাকে জানায়। এসব ক্ষেত্রে বলতে যত দেরী হবে, জটিলতা ততো বাড়বে। 
৬। শিশু যদি এই ধরণের কোন কথা আপনাকে বলতে চায়, অনুগ্রহ করে শুনুন। বিশ্বাস করুন। কষ্টকল্পনা বলে উড়িয়ে দেবেন না। 
৭। শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্টু লোকটি শিশুর অতি পরিচিত কেউ হয়। সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখুন এবং শিশুকেও সচেতন করুন, বাড়ির বাইরে যেমন স্কুলে বা খেলার মাঠে বা অন্য কোথাও কেউ ওকে অন্য বাচ্ছাদের থেকে আলাদা ভাবে বেশী খাতির করছে না তো?যদি করে, সাবধান হন।বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্দেহপ্রবণতা মন্দ না। 
৮। বাড়ির বাইরে কেউ ওর সাথে আলাদা করে সময় কাটাতে চাইছে না তো?কেউ ওকে কোন প্রলোভন দেখিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে চায় না তো?যেমন হতভাগ্য  শিশুটিকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে একান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। 
৯। কেউ ওকে আপনার অসাক্ষাতে “পিঠ টিপে দে/ এখানে হাত বুলিয়ে দে”এই ধরণের অনুরোধ করে নাতো?ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে খেলাধূলার ফাঁকে বারবার শিশুর শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ স্পর্শ করে না তো?
১০। শরীরচর্চার  ক্লাশে বা জিমে কেউ  ইন্সপেক্শনের নামে শিশুর গায়ে হাত দেয় না তো?
১১। আপনার অসাক্ষাতে  কেউ কোন লোশন বা ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিতে বলে না তো শিশুকে বা শিশুর গায়ে লাগিয়ে দেয় না তো?
১২। কেউ শিশুকে নরনারীর গোপন সম্পর্ক সম্বন্ধে/ আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্কে/শিশুর যৌন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অশালীন প্রশ্ন করে না তো?বা অশালীন ভিডিও দেখায় না তো?
১৩। কেউ শিশুর সামনে আচমকা একবার বা বারবার নগ্ন হয় না তো?
১৪। এমনকি আপনি ছাড়া কেউ যদি আপনার শিশুকে বলে যে সে তার জীবনে অত্যন্ত সেস্পাল এবং আপনার শিশুই কেবল তাকে বোঝে তাহলেও সচেতন হন। 
১৫। শেষে বলি শিশুকে কখনই কারো সামনে জামাকাপড় বদলাতে বলবেন না/বদলে দেবেন না। খেয়াল রাখবেন শিশুর জামাকাপড় বদলের সময় বা শিশু যখন শৌচাগরে থাকে বা রাতে শিশুর ঘরে(যদি সে একা শোয়)বারবার কেউ গিয়ে হাজির হয় না তো। 
যদি এ রকম কেউ থাকেন তাহলে পরমাত্মীয় হলেও তাকে বর্জন করাই মঙ্গল। সত্যকে গ্রহণ করতে শিখুন। সচেতন থাকুন। শিশুকে সচেতন করুন। প্রতিরোধই প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার। 
  
ফেমিনিস্টের ডাইরি #৯ ১/১২/১৭
একজন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মধ্যবয়সী মাননীয়া সাংসদ সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন,যে মহিলাদের নিজেদের সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত জরুরী। কি ভাবে? দিনকয়েক আগে চণ্ডীগড় শহরে এক  বছর ২২এর মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় এক অটো ড্রাইভার এবং তার দুই সাগরেদ। সেই ধর্ষিতার নজির টেনে মাননীয়া সাংসদ বলেন যে,“মেয়েটি যখন দেখলই যে অটোতে তিনজন অজ্ঞাত পরিচয় পুরুষ বসে আছে, তখন তার ঐ অটোতে চাপার কি দরকার ছিল?অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কেমন মূল্য চোকাতে হল দেখো। ” অর্থাৎ কি ধর্ষিত হওয়া বা না হওয়া সবই মেয়েদের হাতে, সমাজের প্রচলিত নিয়ম তথা সাবধানবাণী মেনে নিলেই হয়। একা বাইরে না বেরোনোই মঙ্গল। অর্থাৎ এতদিন ধরে যে চিৎকার চেঁচামেচি হল,“ডোন্ট টেল আস নট টু গেট রেপড্, টেল ইওর সনস্ নট টু রেপ” -সবই বৃথা। খোদ জনপ্রতিনিধিরাই যদি এই ধরণের দায়িত্ববোধহীন কথাবার্তা বলেন তাহলে জনসাধারণের থেকে কি আশা করবেন?
নাঃ কিচ্ছুই আশা করার নেই। কয়েকদিন আগে পাহাড়ে নিহত যে তরুণ পুলিশ কর্মীর অকালমৃত্যুতে কেঁদে ভাসিয়েছিল সোশাল নেটওয়ার্ক, যার মরদেহের ওপর সদ্য বিধবা স্ত্রীর আছড়ে পড়ে কান্নার ভিডিও শেয়ার করে গ্যালন গ্যালন চোখের জল ফেলেছিল লোকজন, পরশুই দেখলাম তাকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে। কারণ? রিপোর্টে প্রকাশ মৃত বরের চাকরীটি(কমপ্যাশনেট গ্রাউণ্ডে) পাবার পর, সে নাকি তার শ্বশুরবাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখেনি। সেটা সমালোচনামূলক নাকি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বুঝলাম না। একটা পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিৎে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে একটুও বাঁধল না দেখলাম তথাকথিত ডিগ্রীধারী কিছু মানুষজনের। জনৈক সদজান্তা মাসিমা তো বলেই দিল, যে বাজে মেয়ে। বরের চাকরীটা পেল এবার বছর ঘুরতেই ডবকা ছেলে পটিয়ে বিয়েটাও করে নেবে। বর মারা যাওয়াতে ওর লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না জানেন। এরা কি চায়? সহমরণ প্রথা পুনরায় চালু করা হোক? সম্মিলিত ভাবে একজন অপরিচিতা রমণীর চরিত্রহনন করে এদের কি সুখ লাভ হয় বলতে পারেন?
এই প্রসঙ্গে আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি,  জনৈক ব্যক্তি পথেঘাটে অতর্কিতে মেয়েদের অন্তর্বাস দেখা যাওয়া নিয়ে একটি প্রতিবাদমূলক অণুগল্প লিখেছেন। অত্যন্ত কাঁচা এবং পাতি লেখা। তবে সমস্যাটা তুলে আনা এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের এই নিয়ে প্রতিবাদ করাটার জন্য উনি প্রশংসার দাবী রাখেন। সেটা আমার জনাকয়েক ফেবুবন্ধু শেয়ারও করেছেন। তাতে জনৈক ভদ্রলোক বলেছেন, “-----এটাকে পোস্ট করে কি বলতে চাইছেন জানি না। বাট আই বিলিভ সাম কাইণ্ড অব গার্ল/উইমেন গেট রেপড্ বিকজ দে শ্যুড গেট রেপড্। দে ডিজার্ভ” 
মাননীয়া সাংসদও বোধহয় এটাই বলতে চেয়েছেন,বিশেষ ধরণের মেয়েদের ধর্ষিতা হওয়াই উচিৎ। কোন ধরণের মেয়েরা? রাস্তাঘাটে যাদের অন্তর্বাস দেখা যায়? তাহলে বছর তিন, পাঁচ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে কি লজিক দেবেন?আর যাদের আপাদমস্তক ঢাকা থাকে বোরখায়? আচ্ছা ৭০-৮০-১০০ বছরের মহিলারা আবার অনেক সময় ঐ সব পরেন টরেন না, কাজেই তাদেরও-- তারাও ঐ টাই ডিজার্ভ করেন নাকি? দোহাই নিজের বস্তাপচা চিন্তাধারা নিজের মস্তিষ্কেই রাখুন দয়া করে মুখ খুলতে গিয়ে পরিবেশকে পুতিগন্ধময় আর করবেন না। আপনাদের জন্যই নির্মল বাংলা এবং স্বচ্ছ ভারতের বেশী প্রয়োজন। এই ধরণের বুনো ওল মার্কা আবর্জনার সেরা জবাব ঝ্যাঁটা। 

ফেমিনিস্টের ডাইরি #৮ ২৫/১১/২০১৭
নাদিয়া মুরাদের নাম শুনেছেন? আসুন নাদিয়ার সাথে আলাপ করিয়ে দি, সম্প্রতি নাদিয়া একটি বই লিখেছেন, যা আপাতত বিশ্বজুড়ে ফেমিনিস্টদের আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু। বইটির সম্বন্ধে বিশদে বলার আগে, একটু নাদিয়ার সম্বন্ধে বলি, “নাদিয়া মুরাদ ওয়াসি তাহা”র জন্ম ১৯৯৩ সালে, উত্তর ইরাকের নিনাভা প্রদেশের সিঙ্গাল জেলার সিঞ্জর  শহরের কাছে কোচো বলে একটি ছোট্ট গ্রামে।মূলত ক্ষুদ্র কৃষক এবং মেষপালকদের শান্ত নিস্তরঙ্গ গ্রাম কোচো। এই গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই ইয়েজেদি ধর্মাবলম্বী।
ইয়েজেদি এক রহস্যময় ধর্মমত,বহু শতাব্দী ধরে নিনাভা প্রদেশে ইয়েজেদিদের বাস। ইয়েজেদিরা কঠোর ভাবে “এন্ডোগ্যামাস” অর্থাৎ নিজ গোষ্ঠীর বাইরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ, যদি কেউ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পুরুষ বা মহিলাকে বিবাহ করে, তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে সে তার স্বামী/স্ত্রীর ধর্মকেই আপন করে নিয়েছে।  ইয়েজেদি ধর্মের শিকড় প্রোথিত আছে সুদূর অতীতের মেসোপটেমিয়ায়। কথিত আছে মেসোপটেমিয়ান ধর্মমতের সাথে পরবর্তীকালে জরাথ্রোষ্টিইয়ান, জুডাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং ইসলামের সঠিক সংমিশ্রণের ফল ইয়েজেদি।৯০এর দশকে উপসাগরীয় সঙ্কট তৈরি হবার পর থেকে বহু ইয়েজেদি ইরাক ত্যাগ করে জার্মানি পাড়ি দিয়েছে, যারা রয়ে গেছে তারা নেহাতই হতদরিদ্র দিনআনা-দিনখাওয়া মানুষ জন যেমন নাদিয়া এবং তার পরিবার।
নাদিয়া স্বপ্ন দেখত শিক্ষিকা হবার, ইতিহাস বড় প্রিয় ছিল তার, বড় হয়ে হয় ইতিহাস পড়াবে নয়তো নিজের বিউটি পার্লার খুলবে ঠিকই করে ফেলেছিল নাদিয়া। ১৫ই অগস্ট, ২০১৪ তারিখটা এক লহমায় বদলে দিল নাদিয়ার জীবন। কোথা থেকে উদয় হল, অসংখ্য বন্দুকবাজ, কোচোর অধিবাসীদের টেনে হিঁচড়ে বন্দুকের বাট আর বেয়নেট দিয়ে পিটিয়ে জমা করা হল স্থানীয় স্কুলে। প্রথমেই আলাদা করা হল পুরুষ এবং নারীদের। শিশুদের ও লিঙ্গভেদে আলাদা করে ফেলা হল। গ্রামের সমস্ত পুরুষকে বন্দুকের ডগায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল দূরের মাঠে, তারপর কান ফাটানো গুলির আওয়াজ পরিষ্কার জানিয়ে দিল আর কোনদিন দেখা হবে না প্রিয় পুরুষের সাথে। এবার মেয়েদের বয়স অনুপাতে দুভাগ করা হল, বয়স্ক মহিলাদের নিয়ে যাওয়া হল মাঠে--- স্তূপীকৃত বেওয়ারিস লাশ গুলিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল ওরা গণ কবরে।  
এক রাতের মধ্যে নাদিয়ার মা এবং ছয় ভাইয়ের স্থান হল বেনামী এক গণ কবর।নাদিয়া আর গ্রামের অন্যান্য বালিকা, তরুণী  এবং যুবতীদের একটি বাসে তুলে দেওয়া হল। বাস থেকেই শুরু হল যৌন দাসীর জীবন।৯ বছরের বালিকা থেকে ৫০-৫৫ বছরের প্রৌঢ়াকে প্রথম ভোগের অধিকার যারা এক রাতের মধ্যে দরিদ্র ইয়েজেদি  গ্রামকে নিকেশ করেছে। ভোগ মানে নিখাদ যৌন নির্যাতন ভেবে থাকলে ভুল করবেন, ভোগ মানে যা-ইচ্ছা-তাই। মারধোর, শরীরের কোমলতম স্থানে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা তো নগণ্য ব্যাপার। প্রাথমিক ভোগবিলাসের পর যৌনদাসীদের নিয়ে যাওয়া হল দাস বাজারে।যেখানে ডলার ফেললেই পাওয়া যায় ক্রীতদাসী। এই একবিংশ শতকেও খোলাখুলি চলে মানুষের বিকিকিনি। সেই সব দিনের কথা বলতে গেলে নাদিয়া আজো কেঁপে ওঠে আতঙ্কে, প্রতি মুহূর্তে নিজের মৃত্যুকামনা করে দিন কাটত। সুযোগ পেলেই আত্মহত্যা করত মেয়েরা, কিন্তু মরে গেলে ঠিক আছে, যদি বেঁচে যেত, তাহলে কপালে জুটত অবর্ণনীয় শাস্তি। নাদিয়া নিজেও একাধিক বার শাস্তি স্বরূপ প্রকাশ্যে দিবালোকে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। মসুল শহরে এক ধনী ব্যক্তির গৃহে যৌন দাসী হয়ে জন্তুর মত দিন কাটছিল নাদিয়ার, পালিয়ে যাবার সব চেষ্টা বারংবার ব্যর্থ হতে থাকে। অবশেষে একদিন পালাতে সক্ষম হয় নাদিয়া। কোনমতে দেওয়াল টপকে, পালিয়ে এক স্থানীয় অধিবাসীর গৃহে সাময়িক আশ্রয় পায় নাদিয়া। তারাই নাদিয়াকে মসুল তথা ইসলামিক স্টেটের বাইরে নিয়ে যায়, অবশ্যই বিনা মূল্যে নয়।নাদিয়ার মুক্তির মূল্য ছিল কুড়ি হাজার ডলার।
প্রাথমিক ভাবে এক রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় পায় নাদিয়া, ২০১৫ সালে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে নিজের এক বিধবা দিদির গৃহে থাকতে শুরু করে নাদিয়া। ২০১৬ সালে ইরাক সরকারের সুপারিশে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয় নাদিয়া। গত ৭ই নভেম্বর নাদিয়ার স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম, “ দা লাস্ট গার্ল- মাই স্টোরি অব ক্যাপ্টিভিটি এন্ড মাই ফাইট এগেন্সট ইসলামিক স্টেট”। বলা হচ্ছে, “ This is likely the most inspiring feminist memoir out this year”- কোচো গ্রামের এক অর্ধশিক্ষিত, ধর্ষিত, নির্যাতিত মেয়ে এত কিছু বোঝে না, সে শুধু বলে চলেছে, “ দয়া করে সাহায্য করুন। আমি মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু এখনও অসংখ্য মেয়ে প্রতিমুহূর্তে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে,বড় অসহায় তারা। তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই।মশুলের কুড়ি লক্ষ্য সাধারণ নাগরিক যদি আমাদের দিকে একটি বার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, তাহলে আমি এবং আমার মত কয়েক হাজার নিরীহ মেয়েকে এই অকথ্য অত্যাচার সইতে হত না।আমরা ভেবেছিলাম আমাদের পুরুষদের মতই আমাদের অন্তিম পরিণতি কোন অজ্ঞাত গণকবর। দিন কয়েক পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে আমাদের মেরে ফেলবে, কিন্তু কার্যত দেখলাম,যে ইউরোপীয়, সৌদি, টিউনিশিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে জেহাদিরা আসে,আমাদের ভোগ করে এবং বেচে দেয়। যে কেনে, সে এবং তার গুষ্টি আবার আমাদের ওপর কিছুদিন নির্যাতন চালায় তারপর আবার বেচে দেয়। ধর্ষিত হও,গবাদি পশুর মত বিক্রি হও এবং আবার ধর্ষিত হও চক্রাকারে আবর্তিত হয় আমাদের জীবন। কিন্তু কতদিন? আর কতদিন?”
নাদিয়ার দুচোখে একটাই স্বপ্ন, একদিন, কোন একদিন, ধর্ষিতা, নির্যাতিতাদের চোখের সামনে চরম শাস্তি পাবে এই ধর্ষকরা। আর একটা স্বপ্ন আছে, সেই কোচো গ্রামে ফেলে আসা ছেলেবেলার একটা অপূর্ণ স্বপ্ন, একটা বিউটি পার্লার খোলার, নাদিয়ার জবানীতে, তাহলে হয়তো, "Maybe people will remember me for being a stylist, not a survivor" of ISIS, they'll forget that."



ফেমিনিস্টের ডাইরি #৭ ২৩/১১/২০১৭
নিম্নোল্লিখিত চিঠিটি এক নামি সংবাদ সংস্থাকে লিখেছে জনৈক মা, পড়ে বিষাদ মিশ্রিত তীব্র ক্ষোভ অনুভব করলাম।মনে হল সব মায়েদেরই এটা পড়া দরকারী -
“কোনদিন ভাবিনি যে আমাকেও এই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, ঘটনার তীব্রতা এবং আকস্মিকতা আমি এখনও দিশাহারা। কিন্তু আমায় বলতেই হবে, আর পাঁচজনের মত আমরাও স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আমার মেয়ে একজন সুশিক্ষিত স্বয়ম্ভর সবলা হিসেবে গড়ে উঠবে, তাই একগাদা অর্থদণ্ড দিয়েও তাকে ভর্তি করেছিলাম শহরের এক নামী স্কুলে। যে স্কুলের প্রতিটি অলিগলি এমনকি শৌচাগারেও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেই স্কুলেই গত শুক্রবার আমার মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।শিক্ষিকার অনুপস্থিতিতে ক্লাশেরই একটি ছেলে প্রথমে ক্লাশে এবং পরে বাথরুমে ওর প্যান্ট নামিয়ে ওর ব্যক্তিগত অঙ্গে প্রথমে আঙুল এবং পরে ধারালো পেনসিলের খোঁচা মারে। প্রসঙ্গত ছেলেটি টিফিন খাবার পর হাত না ধুয়েই এই জঘণ্য কাজটি করে।
তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে করতে বাড়ি ফেরে আমার মেয়ে। ওর কষ্ট দেখে আমরা বারবার জানতে চাই কি হয়েছে, কিন্তু একটা চার বছর আট মাসের মেয়ের পক্ষে গুছিয়ে বলা ছিল অসম্ভব। ব্যাপারটার গভীরতাই বোঝেনি সে। সমানে বলে গেছে পেট ব্যথা করছে। শনিবার গভীর রাতে যখন বেদনা অসহনীয় হয়ে উঠেছে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে এসে বলল,‘মা আমার প্রাইভেট পার্টে একটু আর্ণিকা লাগিয়ে দেবে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’
ঘটনার বীভৎসতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম আমরা। সারা রাত ক্রন্দনশীলা কন্যাকে বুকে চেপে কি ভাবে যে আমাদের রাত কেটেছে তা শুধু আমিই জানি। মেয়েটা খালি কাঁদছিল আর বলছিল,‘ও কেন আমায় এত ব্যথা দিল মা?’ একটা চার বছরের শিশুকে কি জবাব দি বলতে পারেন।”
প্রসঙ্গত বলে রাখি পরদিন প্রভাতেই ওণারা মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যান,ডাক্তারবাবু ও জানান যে মেয়েটি যৌন নির্যাতনের শিকার। পুলিশে অভিযোগ জানানো হয়। ওণারা স্কুল কতৃপক্ষকে জানিয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি, স্কুলের তরফ থেকে বিন্দুমাত্র সহযোগীতা বা সহানুভূতি পাওয়া যায় না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে সহানুভূতি প্রকাশ করলে হয়তো পক্ষান্তরে ওণাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়-।
যে শিশুটি এই জঘণ্য কাণ্ডটি ঘটিয়েছে তাকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করার “দাবী” জানাতে হয়েছে, হয়তো সেই দাবী পূরণ ও করা হবে। মেয়েটির মা ইতিমধ্যেই “বিকৃতমনস্ক” বলে দেগে দিয়েছেন ছেলেটিকে। কাল অন্যান্য সহপাঠীদের বাবা মায়েরাও এই দাবী তুলবে। বহিষ্কৃত হবে অথবা হবে না ছেলেটি, কিন্তু তাতে সমস্যার আদৌ কোন সমাধান কি হবে? একটু যদি তলিয়ে ভাবেন তাহলেই বুঝতে পারবেন, যে ছেলেটি যা করেছে তা কোন ব্যধি নয়, বরং ব্যধির বহিঃপ্রকাশ মাত্র।একটা চার পাঁচ বছরের শিশু কি করে জানলো, নির্যাতনের এই ভয়াবহ পদ্ধতি? আঙুল বা পেন্সিলের ব্যবহার সে কোথায় প্রত্যক্ষ করল? যদি জবাব হয় বাবামাকে অসতর্ক অবস্থায় দেখে ফেলা, তাহলে বলতেই হয় শিশুটির সাথে সাথে তার বাবা মায়ের ও মানসিক চিকিৎসার আশু প্রয়োজন। আর যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে নির্ঘাত শিশুটি স্বয়ং যৌন নির্যাতনের শিকার। সেই দোষী ব্যক্তিকে খুঁজে বার করে, কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হোক।
আপনিও জানেন আমিও জানি সবই স্বপ্নকল্পনা মাত্র। গোটা দেশ জুড়ে যা হয়ে চলেছে, তাতে এই ঘটনাটিরও ভবিষ্যৎ সর্বজনবিদিত। মেয়েটি স্কুল ছেড়ে চলে যাবে, আইনি জটিলতা তথা দীর্ঘসূত্রতায় ছেলেটিকে কিছুদিন ভুগতে হবে, অল্পবয়স দেখে বিনা শাস্তিতে ছেড়েও দেওয়া যেতে পারে অথবা অল্পদিনের জন্য সংশোধনাগারে পাঠানো হবে। অতঃপর? যেমন চলছে তেমনি চলবে।

ঐ যে বলে না প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। নিজের শিশুটিকে তৈরি করুন সমস্ত পরিস্থিতির মোকাবিলায়। গুড টাচ-ব্যাড টাচ সম্পর্কে বিশদে জানান। ওকে বোঝান ওর ব্যক্তিগত অঙ্গ কোনগুলি এবং সেখানে হাত দেওয়ার অধিকার ক্ষেত্রবিশেষে মা-বাবা এবং ডাক্তার ছাড়া আর কারো নেই।তেমনি অন্য কারো ব্যক্তিগত অঙ্গে হাত দেওয়াও গর্হিততম অপরাধ।যদি কেউ দেয়, সে যতই পরিচিত, আপনই হোক না কেন, শিশু যেন নিজের মত করে তার প্রতিবাদ করে। আত্মরক্ষার কোন না কোন হাতিয়ার সবসময় হাতের নাগালে থাকে, সেগুলির সুব্যবহার করুক। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুক,আঁচড়ে কামড়ে রক্তারক্তি করে দিক, সর্বোপরি তৎক্ষণাৎ সেই স্থান পরিত্যাগ করুক। সেক্স এডুকেশন এখনও আমাদের দেশে ট্যাবু, কিন্তু প্রয়োজনে আপনার শিশুকে অল্পবিস্তর এই জ্ঞান আপনিই দিন, মনে রাখবেন আয়তনে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন ও একটি মানুষ। স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন ওর মনেও জাগে,যদি তার যথাযথ উত্তর বাড়িতে না পায়, তাহঢ়ে বাইরে এমন বহু বিকৃতকাম মানুষজন রয়েছে,যারা ঐ উত্তর বুঝিয়ে দিতে তৎপর। দোহাই একটু আধুনিক হোন।

অনির ডাইরি ৪ঠা অক্টোবর  ২০১৭
(ফেমিনিস্টের ডাইরি #6)
দিনদুয়েক আগের কথা, এক জন স্ট্যাটাস দিয়েছেন দেখলাম-“সারাবছর যাদের কপালে, সিঁথিতে একফোঁটা সিঁদুর দেখতে দূরবীন লাগে, দুদিন ধরে তাদের সিঁদুর মাখা মুখ দেখতে দেখতে বদহজম হয়ে গেল। ” এরপর রোমান হরফে বাংলা ভাষায় লেখা, “আমার যা মনে হবে, তাই বলব, পছন্দ না হলে আনফ্রেন্ড করে দিতে পারেন। আমি কেয়ার করি না।” চমকে উঠলাম সত্যি বলছি। ফেসবুকে বিগত কদিন ধরে বঙ্গললনাদের সিঁদুর খেলার ছবি দেখে আপনি ক্লান্ত হয়ে যেতেই পারেন, সে ক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে ফেবু থেকে সন্ন্যাস নিলেই তো পারেন,এ কি বৃদ্ধপ্রপিতামহ মার্কা বুলি বাপু। কে সিঁদুর পড়বে আর কে পড়বে না, কে কবে পড়বে আর কবে পড়বে না, কে সেল্ফি তুলবে আর কে পোস্টাবে সে তো তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই না?এরকম ভাবে সামগ্রিক সিঁদুর খেলা বঙ্গললনাকে অসম্মান করার অধিকার ওণাকে কে দিল?
আনফ্রেণ্ড তো সময়ের অপেক্ষা, করতামই, শুধু ভাবলাম একবার দেখি মক্কেলটি কে?দেখলাম আপাতত সবথেকে দামী প্রাইভেট স্কুল চেইনের কোন একটা ব্রাঞ্চের প্রিন্সিপাল। প্রচুর বড় বড় নেতা মন্ত্রী সান্ত্রীকে দাদা দিদিভাই বলে সম্বোধন করে গুচ্ছ গুচ্ছ সেল্ফি পোস্টেছেন। শুধু তাই নয়, ওণাদের পারিবারিক  দুর্গোৎসবের অজস্র ছবিতে ওণার দেওয়াল আলোকিত। সাবেকীয়ানা,বনেদীয়ানার ককটেলে জমজমাট।
যাই হোক সেটা ওণার ব্যক্তিগত ব্যাপার। শুধু একটা ব্যাপারই গভীর ভাবে ব্যথিত করল একজন শিক্ষক তথা শিক্ষাগুরুই যদি এখনও মেয়েদের সারা বছর সিঁদুর পরা না পরা নিয়ে বঙ্কিম কটাক্ষ করেন, তাহলে তার ছাত্রকুল কি শিখবে?বিয়ের পর স্বামীর মঙ্গলের জন্য মেয়েদের সিঁদুর পরতে হয়, হাতে শাঁখাপলা নোঁয়া পরতে হয়,শাড়ি পরতে হয়।হে নারীকুল তোমরা হলে স্বামীর জন্য উৎসর্গীকৃত।
আমি সোশাল মিডিয়ায় ঝগড়া একদম করতে পারি না, ভাবলাম কোন না কোন মহিলা নির্ঘাত প্রতিবাদ করবে, দেখে চূড়ান্ত আশাহত হলাম। না মহিলা না পুরুষ একটিও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর পেলাম না। অনেকে বলেছেন, “ঠিক ঠিক। নির্লজ্জা মেয়ের দল, সারা বছর হায়া জ্ঞান থাকে না। শাড়িটাও পরে না। আর দুর্গা পুজা এলেই শাড়ি সিঁদুরে লটপট। আর ফেবুতে ছবি আপলোডের কি ধুম্”।ঐ প্রিন্সিপাল ভদ্রলোকটি নিজ পোস্টে কমেন্ট করেছেন দেখলাম উনি যেভাবে নিজের মা জেঠিমাকে দেখে এসেছেন আজকালকার মেয়েদেরও সেই ভাবেই দেখতে চান। মানসিকতার এই পশ্চাদপসরণ কিন্তু ভয়াবহ। কেন জানি না মনে হল,এই ভাবেই তো সূত্রপাত হয় নীতি পুলিশগিরির। আজ সিঁদুর নিয়ে পড়েছে, কাল পড়বে আপনার পোশাক নিয়ে, পরশু খাদ্যাভাস নিয়ে,তরশু আপনার প্রিয়জনের জাতধর্ম  নিয়ে।
আজ আবার সেই পোস্টটি দেখতে পেলাম, একজন মহিলা পোস্টেছেন, আড়াই হাজার লোক তোফা তোফা করে হৃদয়ের হলাহলও উগরে দিয়েছেন দেখলাম। আমার ফ্রেন্ডলিস্টেরও কয়েকজন লাইক এবং শেয়ার করেছেন দেখলাম। কেন জানি না হঠাৎ এলফিনস্টোন ব্রীজে পদপিষ্ট সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল,যে বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে হাত বাড়িয়ে ছিল সামনে দাঁড়ানো এক দর্শকের দিকে,সে হাত কোন মরমী হাত স্পর্শ করেনি। তবে তার শরীরের বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্থান স্পর্শ করেছিল কিছু লোলুপ হাত। মেয়েদের ভোগ্যপণ্য মনে করলে শেষ পরিণতি হয়তো এটাই। একটু ভাবুন। ভাবা অভ্যাস করুন।

Saturday 14 October 2017

চাটুজ্জে বাড়ির ইতিবৃত্ত


চাটুজ্জে বাড়ির ইতিবৃত্ত ২
কথিত আছে সুদূর অতীতে দিল্লীর বাদশাহ, গঙ্গার পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূল বরাবর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাট্টা তুলে দেন বর্ধমানের মহারাজাদের হাতে।যাঁরা কালক্রমে আবার কয়েকটি অঞ্চলের পাট্টা তুলে দেন বেহালা সাবর্ণ রায়চোধুরীর পরিবারের হাতে। এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পরবর্তী কালে তিনটি গ্রাম ইজারা নিয়ে কলকাতা মহানগরীর পত্তন করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতার গুরুত্ব তখন ক্রমবর্ধমান, কলকাতাকে অদুর ভবিষ্যতে ইস্টার্ন বৃটিশ এম্পায়ারের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার তোড়জোর শুরু হল পুরোদমে। সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আরো ৫৫টি গ্রাম নতুন করে ইজারা নিল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছ থেকে। যার মধ্যে ৭টি গ্রাম যথা দক্ষিণ ব্যাঁটরা, উত্তর ব্যাঁটরা, কাসুন্দিয়া, শুলকা (শালকিয়া),বেতড় ইত্যাদি ছিল গঙ্গার পশ্চিম উপকুল বরাবর।এই দক্ষিণ ব্যাঁটরাতেই আমাদের বাড়ি।
ভারতবর্ষে রেল লাইন পাতা শুরু হবার সাথেই শুরু হয়ে গেল এক অঘোষিত শিল্পবিপ্লব।সহযোগী শিল্প হিসাবে গঙ্গা তীরবর্তী দুই ব্যাঁটরাতেই গড়ে উঠতে লাগল একের পর এক লোহার কারখানা।ক্রমশ চড়তে থাকল জমির দাম। কিন্তু দক্ষিণ ব্যাঁটরার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জোড়া পুকুর, চার কামরা বাড়ি সহ সাড়ে সাত বিঘা আবাদী জমির কেবল কোন খরিদ্দার জুটছিল না। এটিকে বলা হত “ভূতের ভিটে”।

প্রপিতামহ কালীপদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেটিয়াবুরুজের ওয়াটগঞ্জ জুটমিলের অফিস মাস্টার। উনবিংশ শতাব্দী শেষের দিক, কিন্তু তখনও নেটিভদের ম্যানজার স্টেটাস দেওয়া হত না। প্রপিতামহ ছিলেন অত্যন্ত ডাকাবুকো নিরীশ্বরবাদী ব্যক্তি। উনি ঐ পরিত্যক্ত “ভূতের ভিটে” কিনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। স্থানীয় জমিদার কেশবচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ঠাকুর দালানে প্রতি শনিবার স্থানীয় মাতব্বরদের(বাবার ভাষায় নিওবুর্জোয়া) আসর বসত। সেখানেই ভূতের ভিটের তৎকালীন মালিক জনৈক চৌধুরী মাত্র ১৬০১তঙ্কায়( ৪কিস্তিতে প্রদেয়) এই সম্পত্তি প্রপিতামহের নামে লিখে দিলেন।
প্রপিতামহ বাস্তুভিটের যথাবিহিত সংস্কারসাধন করে, নিজের সদ্য যৌবনা স্ত্রী, দুই শিশু পুত্র,এক শিশু কন্যা এবং মাতা গোলাপসুন্দরী দেবী সহ নতুন গৃহে স্থিতু হলেন। 
কর্মব্যস্ততার জন্য প্রপিতামহ নিজে থাকতে পারতেন না, প্রায়শঃ শনিবার সন্ধ্যাবেলা কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে গঙ্গা পার হয়ে শিবপুর বোটানিকাল গার্ডেনে নামতেন এবং সেখান থেকে ঝাঁজুর ঘোড়ার গাড়ি চড়ে যখন বাড়ি ঢুকতেন তখন গভীর রাত।এই বিশাল বাস্তু সহ পরিবারেরর দেখাশোনা করার জন্য ৪জন গৃহপরিচারিকা এবং ৬জন অবাঙালি পরিচারক রেখেও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রন্থ থাকতেন প্রপিতামহ।
মিলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হ্যামিলটন সাহেবের অত্যন্ত  স্নেহভাজন ছিলেন প্রপিতামহ। হ্যামিলটন সাহেব ওণার দুশ্চিন্তা দূরীকরণ হেতু একটি উপহার দিলেন। ছয় সপ্তাহের একটি বিলায়েতী কুকুর বাচ্ছা। নাম-জ্যাক।
জ্যাকের দেখাশোনা করার জন্য এক নতুন পরিচারক রাখা হয়, নাম হরিয়া। হরিয়ার উপযুক্ত পরিচর্যায় মাত্র ৬মাসেই জ্যাক হয়ে উঠল একটি হাতির বাচ্ছার সমতুল বিশাল এবং বলশালী। সন্ধ্যের পর হরিয়া জ্যাককে ছেড়ে দিত খোলা জমিতে। সারা রাত যথেচ্ছ বন্যপ্রাণী শিকার তথা ভক্ষণ করে জ্যাক হয়ে উঠেছিল পুরোপুরি মাংসাশী। “ভূতের ভিটের”ভূতেরাও সম্ভবত জ্যাককে ভয় পেত।
এ হেন জ্যাককে হঠাৎ একদিন সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। কারণ অজ্ঞাত। প্রপিতামহীর মতে কোন ঈর্ষাপরায়ণ প্রতিবেশী নির্ঘাত বিষাক্ত মাংসখণ্ড খাইয়ে হত্যা করে জ্যাককে।
পূর্বদিকের জোড়া পুকুরের উল্টো দিকে ছিল ২০০বছরের পুরোণো এক অতিকায় বট গাছ।শোকাতুর প্রপিতামহ যথোচিত সমাদরে ঐ বট গাছের নীচে জ্যাককে সমাহিত করার উদ্যোগ নেন। বট গাছের তলার মাটি খোঁড়া শুরু হয়, অচীরেই খনন কার্য থমকে যায়, আবিষ্কৃত হয় মাটির নীচে একটি পাকা দেওয়াল। প্রপিতামহ ইতস্ততঃ করে হুকুম দেন ঐ দেওয়াল ভেঙে ফেলার। দেওয়াল কিছুটা ভাঙা মাত্রই খননকারীরা খনন বন্ধ করে আতঙ্কে উপরে উঠে আসে। দেওয়ালের ওপাশে রয়েছে একটি  বিশাল গুপ্ত কক্ষ। আর সেই গুপ্তকক্ষ জুড়ে পড়ে আছে এক বিশাল নরকঙ্কাল। যার দুই হাত এবং দুই পা লোহার শিকল দিয়ে দেওয়ালের সাথে বাঁধা। ঐ ভয়ানক দৃশ্য দেখা মাত্র প্রপিতামহ নির্দেশ দেন যত দ্রুত সম্ভব যেন ঐ দেওয়াল পুন: গেঁথে দেওয়া হয়। ঐ দেওয়ালের সামনে আর একটি গর্ত খুঁড়ে জ্যাককে কবর দেওয়া হয়।
প্রপিতামহীর মতে ঐ কবর ভাঙার পর থেকেই আমাদের পরিবারে শুরু হয় নানা বিপর্যয়। হতভাগ্য  ব্যক্তিটি কে ছিল তা আজো এক রহস্য। কানাঘুষো  যে কবর ভাঙার অব্যবহিত পর থেকেই নাকি পূব দিকের পুকুর সংলগ্ন খালি আবাদী জমিতে এক অতিকায়  আলখাল্লা পরিহিত ছায়া পুরুষকে এক বিশাল কুকুর সহ মাঝে মাঝেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। দুজনেই ছিল মূর্তিমান অমঙ্গল। দেখেছেন কি ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আপনার পরিবারের কেউ না কেউ মারা যাবেই। বাবার সবথেকে ছোট পিসিমা পিকোরাণী ছিল তার প্রথম শিকার। শুধু আমাদের নয় আসেপাশের তৎকালীন প্রতিবেশীরাও ভয়ে সন্ধ্যের পর ঐ দিকের জানলা বন্ধ করে রাখত।
মূল সম্পত্তি কবেই তিরিশটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বিক্রি হয়ে গেছে। জনসমাকীর্ণ পাড়া,বৈদ্যুতিন আলোতে উজ্জ্বল পথঘাট। বহু বছর সেই অশরীরীর দর্শন পায়নি কেউ। কিন্তু গভীর রাতে জ্যাক মাঝে মধ্যে ডাকে। রক্তজল করা সে ডাক।পাড়ার কুকুরদের শোরগোল মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। গোটা পাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গুমরে ওঠে এক রক্তজল করা কুকুরের ডাক। কয়েক বার মাত্র, তারপরই সব চুপ। বেশ কিছুক্ষণ কাটলে আকুল কান্না জোড়ে পাড়ার সারমেয়কূল। তীব্র অসহায় ভয়ার্ত সে কান্না।যে বাড়ির সামনে জমায়েৎ হয়ে কান্না জোড়ে কুকুরগুলি ঠিক সেই বাড়ির কেউ না কেউ ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ---
আর একটা কথা বলে শেষ করব, মানবেন কি না মানবেন আপনার ব্যাপার,আমার কাজ গল্প বলা, ঐ বিশাল দেহী পুরুষের রহস্য সম্ভবত মৃত্যুর পূর্বে প্রপিতামহ আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। উনি বলে যান প্রপিতামহীকে, যিনি আমৃত্যু এই রহস্য বুকে চেপে রাখেন পরিবারের মঙ্গলার্থে। মৃত্যুশয্যায় প্রবল বিকারের সময় উনি বলে যান আমার ঠাকুমাকে। ঠাকুমাও তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বলে গিয়েছিল ছোট কাকুকে। ছোট কাকু ঠিক করেছিল গল্পের আকারে ঘটনাটি লিখবে। সেই মত বাবা এবং জেঠুর কাছে নানা খবরাখবরও যাচাই করে নেয়। সবিস্তারে কিছু বলে না, শুধু বলে লিখলে জানতে পারবি। যেরাতে ওণার লেখা শুরু করার কথা ছিল, আচমকা সেই রাতেই স্বাস্থ্যের ভয়াবহ অবনতি ঘটে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ও অবকাশ পাওয়া যায়নি।
শুভ ভূত চতুর্দশী।
চাটুজ্জে বাড়ির ইতিবৃত্ত ৯ই অক্টোবর ২০১৭
(১)
আমাদের হাওড়ার বাস্তুভিটা সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত বিঘা। সবই প্রপিতামহের মেহনত তথা দূরদৃষ্টির ফল। ঐ দূরদৃষ্টির কণামাত্র আমার দাদুর ছিল না। দাদু ছিলেন অনেকটাই আমার মত আবেগসর্বস্ব, বাস্তব বুদ্ধিহীন। প্রপিতামহ নরমপন্থী  কংগ্রেসের মোটামুটি ছোটখাটো নেতা গোছের ছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, সে যুগের ক্ষমতাবান রাজনৈতিক  দলের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে অত বড় সম্পত্তি রাখা যেত না। সম্পত্তি মানে শুধু বাস্তুভিটা নয়, আরো বহু জমি জায়গা,সুন্দরবনে বিশাল আবাদযোগ্য জমি, অতিকায় বজরা ইত্যাদি। যখন প্রপিতামহ সম্পত্তির পরিমাণ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করতে ব্যস্ত ছিলেন,আমার দাদু তখন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজ বিতারনের পরিকল্পনায় মত্ত। প্রপিতামহ জানতেন, কিন্তু আমাদের পরিবারে কখনই কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হত না।
ফলতঃ ঠাকুরদাকে হিংস্র ছাত্র আন্দোলন করার অপরাধে কলকাতার সাধের কলেজ থেকে বিতাড়ন করা হল।
কুছ পরোয়া নেহি। প্রপিতামহ তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলেন, মেদিনীপুর কলেজে। ও বাবা!ধন্যি ছেলে। পড়াশোনা চুলোয় গেল, অস্ত্র আমদানী করার জন্য জাহাজের খোলে লুকিয়ে পালাল সোজা  ব্রহ্মদেশ। মান্দালয় জেলে ঘানি ঘুরিয়েই জীবন কাটত হয়তো, যদি না প্রপিতামহের কাছে খবরটা পৌছাত। বংশের জেষ্ঠ্য পুত্র, কতই বা বয়স?১৭-১৯বড় জোর, কিন্তু ছেলেকে মুচলেকা  ফিরিয়ে আনতে হলে যে কালাপানি পেরোতে হবে? ধোপা- নাপিত বন্ধ, মেয়েদের কেউ বিয়ে করবে না, একঘরে হয়ে পচে মরতে হবে।
প্রপিতামহ ছিলেন আদ্যন্ত নাস্তিক।  নিজেকে চার্বাক পন্হী বলে দাবী করতেন। সেই যে ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। সমাজের কঠোর অনুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে  ড্যাং ড্যাং করে কালাপানি পেরোলেন। বন্ধ হল ধোপা নাপিত। টিকিওয়ালারা বিধান দিলেন গোময় ভক্ষণ আর দানের মাধ্যমে আবার সমাজে প্রবেশের অনুমতি পেতে পারেন।
ছোঃ। গোবর খাবে কালিপদ চাটুজ্জে?দেখা যাক। স্বয়ং জেষ্ঠ্য পুত্রের জন্য বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে হাজির হলেন  হাওড়ার প্রবল প্রতিপত্তিশালী প্রগতীশীল নেতা গঙ্গাধর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। ওণার একমাত্র কন্যা নাম স্বর্ণলতা। দেশবন্ধু থেকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ অবধি গঙ্গাধর বাবুর বাড়ি কে আসেন না?
গঙ্গাধর বাবু ছিলেন সে যুগে রিপন কলেজ অর্থাৎ বর্তমান সুরেন্দ্র নাথ কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তারওপর নামী হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ওণাকে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী বলত দীনদরিদ্র মানুষজন। ওণার মৃত্যুর পর বাঁশতলা শ্মশানের সামনের রাস্তাটির নামই রাখা হয়েছিল গঙ্গাধর মুখার্জী রোড, এই অন্ধবিশ্বাসে, যে  চাইলে মৃত মানুষকেও জীবিত করতে পারেন। ওণার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন স্বর্গীয় রাধানাথ শিকদারের  কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীনাথ শিকদারের কন্যা। আহিড়িটোলার বিখ্যাত শিকদার বাড়ির মেয়ে। কাদম্বরী দেবী সেনেট হলে বসে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং লর্ড কার্জনের হাত থেকে সার্টিফিকেট পান। সেই সার্টিফিকেট বাঁধিয়ে রাখা ছিল মুখোপাধ্যায় বাড়িতে।
গঙ্গাধর বাবুর ছিল সনাতনী টিকিওয়ালা ধর্মের ধ্বজাধারীদের ওপর অখণ্ড ক্রোধ। কারণ হল ওণার পিতা ঈশ্বর বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়।
বেণীমাধব বাবুর সম্পর্কে শোনা একটা গল্প আজ না বলে পারছি না। বেণী বাবু গিয়েছিলেন গঙ্গায় স্নান করতে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন ডাচ এবং একজন দিনেমার সাহেবের মধ্যে চুলোচুলি  বেঁধে যায়। ব্যাপারটা আদালত অবধি গড়ায়, ঝগড়ার অন্যতম সাক্ষী হিসেবে বেণীমাধব বাবুকে কাঠগড়ায় উঠতে হয়।বৃটিশ জজ জানতে চান,“বাবু তুমি জানো এদের কি নিয়ে মারামারি হয়েছে?” বেণীমাধব বাবু তখন বলতে থাকেন, “ ধর্মাবতার ডাচটি এই বলেছে এবং তার জবাবে দিনেমার সাহেব এই বলেন----_”। উনি সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন ভাষার খিস্তিখেউড় ন্যাজামুড়ো সমেত আদালতে উগড়ে দেন। না ডাচটি প্রতিবাদ করে না দিনেমার। জজ সাহেব চমৎকৃত হয়ে জানতে চান,“ বাবু তুমি এদের ভাষা জানো?” বেণীবাবু ঘাড় নেড়ে জানান, না উনি ঐ ট্যাঁশ ভাষা জানেন, না বলতে পারেন। ওণার সামনে যে বার্তালাপ হয়েছে উনি শুধু সেটুকুই বিবৃত করেছেন মাত্র।

এহেন শ্রুতিধর বেণী বাবু শেষ বয়সে ধর্মের মোহে পড়েন। পুজো আচ্ছা সাধনার উৎপাত বাড়তে থাকে। স্ত্রীকেও বলেন, সংসার অসাড়। আমার সাথে সাধনায় ব্রতী হও। সাধাসিধে গ্রাম্য অশিক্ষিত স্ত্রী নিজ সন্তান সংসার ফেলে স্বামীর ধর্মানুরাগী হতে অস্বীকৃত হন। তখন ক্রোধে বেণীমাধব বাবু সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাহির বাটিকেই নিজের সাধন ক্ষেত্র বানিয়ে তোলেন এবং দুজন ভৈরবীও রাখেন।

মায়ের এই অসম্মান তথা মনোকষ্টই গঙ্গাধর বাবুর বড় হবার মূলধন ছিল। ফলতঃ সনাতন ধর্মের প্রতি ওণার বিরাগ সর্বজনজ্ঞাত ছিল।
এমতবস্থায় প্রপিতামহের পাঠানো বিবাহের প্রস্তাব উনি লুফে নেন। আরো একটি গল্প ছিল। ঠাকুমা অর্থাৎ স্বর্ণলতা দেবীর গায়ের রঙ ছিল ঘণশ্যাম। বর্ণবিদ্বেষ ব্যাপারটি বাঙালীর জীবনে নতুন না। সে যুগেও তের বছর বয়সেও সুযোগ্য মনোমত পাত্র পাননি গঙ্গাধর বাবু। বলতে ভুলে গেছি দাদুর গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতা।
বিয়ে হল। তেরো বছরের ধেড়ে মেয়ে মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এল। আর একঘরে করে রাখে কে? দাদুর বড় বোনের বিয়ে হল এক বিশাল ধনী বাঙালি বিচারকের কনিষ্ঠ পুত্রের সাথে। অভিজাত্যের যাবতীয় কুফল অচীরেই দৃশ্যমান হল। মদ আর রেসের মাঠেই খেয়ে নিল বড় জামাইকে। আদরের বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন রাণী। রাণী যেদিন বিধবা হয়ে তিন মেয়ের হাত ধরে ফিরে এল, বাপের দেওয়া একটা গয়নাও আর আস্ত নেই। সব গিলেছে রেসের ঘোড়া।
রাণুর দুঃখ নাকি অন্য কিছু জানি না মাত্র ৩৯বছর বয়সে দেহত্যাগ করলেন  কালীপদ চট্টোপাধ্যায়। ফেলে রেখে গেলেন বিশাল বাড়ি, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, ধন সম্পত্তি। ঠাকুরদার বয়স তখন ২১ মাত্র। 
চোখের নিমেষে হু হু করে নিঃশেষ হয়ে গেল সব সম্পত্তি।মামলা আর দেনার দায়ে বিক্রি করতে হল বিঘার পর বিঘা জমি জলের দরে। বাস্তুসংলগ্ন জমিও বেচে দেওয়া হল। রয়ে গেল সাড়ে সাত কাটা জমি সমেত বিশাল দোতলা বাড়ি। আগের তুলনায় যদিও তা অতি ক্ষুদ্র। কিন্তু আমাদের চোখে বিশাল।
দোতলা বাড়ির উত্তর পশ্চিম কোণের ঘরটি কোন এককালে ছিল প্রপিতামহ এবং প্রপিতামহীর। পরবর্তী  কালে ঠাকুরদা ঠাকুমা থাকতেন। বাবামার বিয়ের পর ঐ ঘরটিই বরাদ্দ হয় ওদের জন্য। আমার ছোট বেলাতেও আসে পাশে তেমন কোন দোতলা বাড়ি ছিল না। ফলে উত্তরের তিনটে আর পশ্চিমের একটা বিশাল খড়খড়িওলা জানলা  অবারিত ছিল রোদ, ঝড় আর বৃষ্টির জন্য। বর্ষা বরাবরই আমার প্রিয় ঋতু।
সে বর্ষা, বর্ষাই নয়, যা আপনাকে স্মৃতিচারণে বাধ্য না করে। আজ যেমন খালি মনে হচ্ছে সেই ছোট্ট বেলার বর্ষার কথা। বাবার গায়ে লেপ্টে গল্প শোনা, মাথার ওপর বিশাল ডিসি পাখা ঘুরতে ঘুরতে আচমকা ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। বাবা ওমনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত,“যাঃ।  আজ রাতের জন্য নিশ্চিন্ত। ” বাইরে তখন ঝরঝর বাদল ধারা, আকাশের রঙ ময়ূরকন্ঠী  কালো, ঝিলিক দিয়ে উঠল বিজলি, শনশন করে মাথা নাড়াল বৃদ্ধ পেয়ারা গাছ।ওপাশ থেকে যোগ্য সঙ্গত করল যমজ বেল আর যজ্ঞি ডুমুর গাছ। একতলার দালানে ঝটপটিয়ে উঠল জেঠিমার পোষা তথা নিজের হাতে ধরা একগুচ্ছ টিয়া পাখি। বন্ধ কাঁচপাল্লার বাইরে  খোলা জানলার খড়খড়িতে এসে বলল একটা আখাম্বা ভিজে কাক। কুচকুচে গোল চোখে দেখার চেষ্টা করল আমাদের, দক্ষিণে বিশাল লম্বা দালান, দালানের দিকের জানলা দিয়ে টুক্ করে উঁকি মেরে গেল মেজ পিসি। আহা বড় ভালবাসে ঝুনুকে গো। সেই কোন দুধের শিশুকে ফেলে যখন ঝুনুর মা অফিস চলে যেত, কে বুকে পিঠে করে বড় করেছে? আর ঝুনু যে মিটমিটে শয়তান, কোথায় খাটের নীচে বসে দেশলাই জ্বালছে, নয়তো বাবার গোঁফ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে মায়ের ছাপা শাড়ি কেটে পুতুলের শাড়ি বানাচ্ছে। উফ্ কি ঠ্যাঙান ঠেঙিয়েছিল ঝুনুর মা সেবারে। যদিও আজ বাবা আছে,  তবুও মানুষ করার টান বড় টান বাপু, তোমরা বুঝবে না। আমরা কিন্তু কিছুই খেয়াল করছি না,তখন বড় ব্যস্ত, ঘর ভর্তি পিতৃপুরুষগণ, আর তাদের হাজারো রসালো গল্প। যার কতটা বাস্তব আর ই কতটা পরাবাস্তব সে নিয়ে কে মাথা ঘামায় মশাই। আমার বাবা যদি একবার গল্প বলতে শুরু করে, বিশ্বাস করুন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়, বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা।ঠিক যেমন এই মুহূর্তে পথের জ্যামে আটকে হারিয়ে যাচ্ছি ক্রমেই নিজের ছোটবেলায়। সাধে কি বলি বর্ষা যদি  নস্টালজিকই না করে তুলতে পারে, সে বর্ষা বর্ষাই নয়।