Friday 17 November 2017

অমিয়ার একদিন

অমিয়ার একদিন #Throwback 17.11.2016

উদাস হয়ে বসেছিল অমিয়া। বিগত কয়েকমাসে জীবনটা যেন ওলটপালট হয়ে গেল।  অমিয়া আজ দিশেহারা ।  সুনন্দ সামন্তের সঙ্গে সখ্যতা তো আজকের নয়, সেই যে যবে সুনন্দের প্রথমা স্ত্রী আত্মঘাতী হল, গোটা অফিস, আত্মীয় পরিজন সকলে বর্জন করেছিল ওকে।  অপ্রয়োজনে কেউ বার্তালাপ ও করত না।  শুধু অমিয়া ছিল, সেই গভীর ডিপ্রেসনের দিনগুলিতে ওরা ছিল নিছক বন্ধু।  অফিস অন্তে নির্ভেজাল আড্ডা,কখনও সাথে ঠান্ডা বীয়র।  আবার কখনও বা নিছক চা সিগারেট।  সুনন্দ বলত ,“ অমিয়া, মাই বাডি। ” কবে যে এই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিল সে কি ছাই অমিয়াও বুঝেছিল? বাবা মারা যাবার পর অমিয়া তখন এ্যাকিউট ডিপ্রেসনে ভুগছিল, দিনের পর দিন   অফিস কামাই।  নিজের চতুর্পাশে দুর্ভেদ্য  প্রাচীর গড়ে তুলেছিল অমিয়া। সেই প্রাচীর উড়িয়ে  টেনে হিঁচড়ে ডিপ্রেসন থেকে বার করেছিল সুনন্দ।  সেই কৃতজ্ঞতাবোধই হয়ে উঠল যত নষ্টের গোড়া।  বিবাহের প্রস্তাব অমিয়াই দেয়।  সুনন্দ ও আপত্তি করেনি।  বিয়ের পরও বছর কয়েক মন্দ কাটেনি। তারপর কি যে হল? সুনন্দ যেন ধীরে ধীরে ভুলে যেতে লাগল যে অমিয়া ওর জীবনে আছে।  প্রথমে ছুঁতোনাতায় আলাদা হল বিছানা।  স্টাডি রুমটাই হয়ে উঠল সুনন্দের শয়ন কক্ষ।  কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের কোন যুৎসই জবাব ওকে দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি সুনন্দ।  তীব্র অভিমানে দিন কয়েক মায়ের কাছে থেকে আসা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি অমিয়া। পরের ধাপে বন্ধ হল বার্তালাপ।  কথা বলতও না।  জবাবও দিত না। তৃতীয় ধাপে বন্ধ করল অমিয়ার মুখদর্শন। অমিয়া ডাইনিং হলে গিয়ে হাজির হলেই সটান উঠে চলে যেত সুনন্দ। অমিয়া কিছু কিনে আনলে বা রান্না করলে খেত না ।  অন্তিম ধাপে ছিল প্রকাশ্যে পরকীয়া।  অমিয়ারই চোখের সামনে ওদেরই দপ্তরের মহিলা সহকর্মীর সাথে রগরগে অ্যাফেয়ার।সেই নিয়ে গোটা অফিসে সে কি কেচ্ছা।  শেষে বীথি বলল,“ অমিয়াদি জানি তুমি সুনন্দ স্যারকে ভীষণ ভালবাস।  কিন্তু সহ্যের ও তো একটা সীমা আছে? উনি চান না এই বৈবাহিক সম্পর্ককে দীর্ঘায়ত করতে।  তুমি কি সত্যি সেটা বুঝতে পারছ না?”

মাস ছয়েক হল মায়ের কাছে আছে।  সম্পর্ক ভাঙা নিয়ে সুনন্দ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। অমিয়াও নয়।  মা, বন্ধুরা বার কয়েক বলেছে উকিলের সাথে কথা বলতে।  বীথি পরিচিত  এক উকিলের নম্বরও যোগাড় করে দিয়েছে।  তাও মাস তিনেক হবে। অমিয়া ফোন করেনি। করতে পারেনি।

“ এই মরেছে! পয়সার ব্যাগটা কোথায় ফেললাম?” জনৈক মহিলা কণ্ঠ বলে উঠল, চমকে বাসে ফিরে এল অমিয়া। উল্টো দিকের সিটে বসে এক মধ্যচল্লিশের মহিলা তার ব্যাগ হাঁটকে চলেছেন, বাতানুকূল ভলভো বাস।  কন্ডাকটর পরম ভদ্র।  বিনীতভাবে বলল, “ আছে নির্ঘাত দিদি।  দেখুন না।  আমি ততক্ষণ অন্য টিকিট গুলো কাটি। ” কন্ডাকটর চলে গেলেও মহিলা ব্যাগ হাঁটকানো থামালেন না। কিছুক্ষণ পরে আবার আর্ত স্বর শোনা গেল,“ পেলাম না তো।  এবার কি হবে? হে ঠাকুর আমার আর কত পরীক্ষা নেবে?” শেষের দিকে মহিলার গলা ভেঙে গেল।  কেউ একজন পাশ থেকে বলল,“ কোথায় যাবেন?”
মহিলা কান্না চেপে জানাল,“ হাইকোর্ট নামব। ” পাশ থেকে অন্য কেউ বলল,“পয়সা  যখন নেই, এখানেই নেমে যান। ” ফিসফিসানি শোনা গেল,“ এসব এদের রোজের কেত্তণ। ” কথাটা মহিলার ও কানে গেল।  চোখের জল চলকে  উঠল।  উনি আর্ত স্বরে বললেন, “ বিশ্বাস করুন, আমি ভদ্র- ” কথা শেষ করত পারলেন না।  ক্ষণিক দম নিয়ে কাতর ভাবে বললেন,“ কেউ অনুগ্রহ করে টিকিটটা কাটিয়ে দেবেন? বিশ্বাস করুন আমার খুব বিপদ।  আমার ভাই আদালতে অপেক্ষা করছে, আমি পৌছেই টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দেব।” অমিয়ার অসহ্য লাগছিল ওণার অসহয়তা। দৃঢ় স্বরে জানাল, “ আমি কাটিয়ে দিচ্ছি। ” টিকিটটা মহিলার হাতে দিতে উনি কৃতজ্ঞ ভাবে জানালেন, “ আপনি একটু হাইকোর্ট চলুন, আমি টাকাটা ফেরৎ দেব। ”
অমিয়া মৃদু হেসে বলল,“ মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকার জন্য আপনাকে হাইকোর্ট অবধি ধাওয়া করব? ছাড়ুন।  আপনি বিপদে পড়েছিলেন, এটুকু আর কি এমন?”
মহিলা নাছোড়বান্দা, “ আপনার নাম ঠিকানাটা দিন অন্তত।  প্লিজ ভাই!” মহিলার কাতর দৃষ্টির সামনে অমিয়া আর না করতে পারল না, দায়সারা ভাবে ঠিকানা দিয়ে নির্দিষ্ট  স্টপে নেমে পড়ল। ওর সঙ্গে রোজ নামেন, এক ভদ্রলোক  শুধু বললেন, “ রোজকার ব্যাপার দিদি।  কতজনকে দেবেন? ও টাকা আর পেয়েছেন?”

মহিলা সত্যিই এলেন না।  মঙ্গল থেকে রবিবার হয়ে গেল, তাঁর টিকিও দেখা গেল না। ভুলেও গেল অমিয়া।  রবিবার ভরপেট জলখাবার  খেয়ে, ছাতে গিয়ে মনের সুখে একটা বিড়ি ধরিয়েছে, হঠাৎ নীচে থেকে মা হাঁক পাড়ল, কে যেন দেখা করতে এসেছে।  দুড়দাড় করে নীচে নেমে দেখে সেই মহিলা একা বসে আছেন।  অমিয়া বাকরহিত। মহিলা সলজ্জ ভাবে বললেন, “ তোমার কবে ছুটি তা তো জানি না ভাই।  যদি দেখা না হয়, তাই -”
অমিয়া হাসবে না কাঁদবে? “ মাত্র কটা টাকা দিতে এত কষ্ট করলেন?”
“ মাত্র হতে পারে, তবে আমার দুঃসময়ে তোমার উপকারটুকু ভুলি কি করে?”
“ বসুন না। চা?” মহিলা মাথা নাড়লেন।  চা হতে যেটুকু সময় লাগে, ততক্ষণ কি কথা বলা যায়? মহিলাও মাথা নীচু করে নিজের হাত দেখছেন।  অমিয়া গলা ঝেড়ে বলল,“ তা আপনার সমস্যা মিটেছে?”
“ হুঁ চিরতরে। ”
“ বাঃ।  তাহলে তো নিশ্চিন্ত। ”
মহিলা মাথা না তুলেই ঘাড় নাড়লেন। নেহাৎ কথা বলার জন্যই অমিয়া জিজ্ঞাসা করল,“ তা কি সমস্যা সেটা কি জানতে পারি? মানে যদি সমীচীন হয়। ”
“ঐ দিন আমার স্বামীকে মুক্তি দিলাম। ”
“ অ্যাঁ?”
“ ডিভোর্স। ” মাথা তুলে করুণ ভাবে বললেন উনি।
“ কিন্তু  কেন?” উত্তেজিত ভাবে জিজ্ঞাসা করেই অমিয়া বুঝতে পারল শালীনতার সীমা লঙ্ঘন  করে ফেলেছে। ক্ষমা চাইতে যাবে, মহিলা বলে উঠলেন,“ সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।  পচা গলা সম্পর্ক আঁকড়ে তাও বসেছিলাম।  শয্যা আলাদা যে কবে হয়েছে আজ আর মনে পড়ে না। শেষের দিকে কথা বলা দূরের কথা, আমার উপস্থিতিও সহ্য করতে পারত না।”

“ ঘেন্না হত নিজেকে।  তোমাদের মত লেখাপড়া  শিখলে কবেই হয়তো বেড়িয়ে  আসতাম।  কোথায় যাব?নিরাপত্তাহীনতা নাকি প্রেম জানি না, হয়তো এই দ্বিধায় কেটে যেত জীবন।  কিন্তু উনি করজোড়ে মুক্তি চাইলেন। জানালেন, উনি শীঘ্রই বাবা হতে চলেছেন। সেই মহিলা ওণার বন্ধু পত্নী। ”
“ ছিঃ। ”ধপ করে বসে পড়ল অমিয়া। 
মহিলা মৃদু হাসলেন,“ওণার জীবন ভাই। যা ভাল বুঝেছেন। মাথা উঁচু করে বেড়িয়ে  এলাম।  খোরপোশ আদায় করার কথা বলেছিল আমার উকিল। নিইনি। ”
“কেন? ওটা আপনার অধিকার।  খাবেন কি? আপনাদের জন্যই এরা এত বাড়ে। ”ক্ষোভে ফেটে পড়ল অমিয়া।  অসহ্য ন্যাকা মেয়েছেলে। মহিলা ঘাড় উঁচু করে বললেন,“বাচ্ছা পড়াব, প্রয়োজনে লোকের বাড়ি বাসন মাজব। কিছু না হলে নিজেকে বেচব।
-----শেষের রেশ রাখব না। ”

মহিলা চলে গেছেন। মায়ের সঙ্গেও কিছুক্ষণ গল্প করে গেলেন।  নিজের ব্যক্তিগত কথা অবশ্য কিছু বলেননি। উনি চলে যাবার পর থেকে অমিয়া গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছে, সেই বীথির দেওয়া উকিলের কার্ডটা কোথায় গেল? মা বা কাজের দিদি নির্ঘাত কোথাও ফেলেছে। ওটা ওর এক্ষুণি চাই।

Monday 13 November 2017

অফিস অফিস

#১ ০৭/১১/২০১৭
সক্কাল সক্কাল তানিয়াদির ফোন, “ওরে মেইল আইডি টা দে রে।” কাল রাতে কথা দিয়েছিলাম,আজ অফিসে ঢুকেই, এক বিশেষ সরকারী দপ্তরের মেইল আইডি পাঠিয়ে দেব। যথারীতি ভুলে গেছি, তড়িঘড়ি মেল খুলে বললাম, “একটু লিখে নেবে প্লিজ।”
“বল”।
“wbhgl”
“ডবলু বি এইচ আর কি বললি বি?”
“বি নয় রে বাবা জি।জি। জি ফর গোয়াল ঘর।”
তানিয়া দি ফোনের ওপাশে হাল্কা হেসে গম্ভীর ভাবে বলল, “আমি বলতে যাচ্ছিলাম গরু আর তুই বললি গোয়ালঘর। কি বিস্ময়কর মিল আমাদের চিন্তাধারায়! ”
কি করব বলুন। দিনরাত্রি সবাই মিলে যে ভাবে গরু, গোমাতা, গোমূত্র, গোময়, গোবলয় নিয়ে পড়েছেন, আমাদের মত দুই তুচ্ছ মহিলাশ্রমিকের মাথাতেও আজকাল তাই জি দিয়ে গরু, গোয়ালঘর এসবই আসে।

Saturday 11 November 2017

শ্রমিক আমি

শ্রমিক আমি (পর্ব-৫)
অনির ডাইরি, ১৫ই নভেম্বর,২০১৯
মোবাইল খুললেই, ফেবুর দেওয়াল জোড়া শুধুই কচিকাঁচার দল। সাধ্যাতীত যত্নে লালিত, ঝিলিক মারা পেলব ত্বক, নিষ্পাপ হাসিতে পূর্ণ চন্দ্রের সুষমা। বড় আদরের ধন আমাদের। নয়নের মণি। এমনি হেসেখেলে ভালোবাসার উত্তাপে কাটুক ওদের  শৈশব।
আর মোবাইল বন্ধ করলে? বলতে পারি, জানিনা শুনবেন কিনা। গরীবগুর্বো খেটে খাওয়া মানুষের গপ্প।  বছর ঘুরে গেল সেই রাতটার। রীতিমতো রোমহর্ষক রাত। আজও মনে আছে দিনটা ছিল ছুটির। হয়তো রবিবার। কড়াইয়ে বুড়বুড়ি কাটছিল আদরের মাংস। প্রজাপতির মত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল তুত্তুরী,“ মা কষা হলেই আমাকে দেবে, কিন্তু।  কেমন?”
গ্যাস কমিয়ে অফিসের ফোনটা যখন ধরলাম, ওপারে এক নাম করা এনজিওর কোঅর্ডিনেটর। “ম্যাডাম একটু হেল্প লাগবে-। ”  একটি হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে হবে, তার মায়ের কোলে। মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে পুলিশ কিন্তু মায়ের খোঁজ নেই। তো? আমি কি করব?যেখানে পুলিশ পারেনি, লেবার দপ্তর কি করবে, অ্যাঁ?  আমার গোটা  পাঁচ-ছয়েক আদুরে ইন্সপেক্টর আছে বটে, কিন্তু হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের কাজ তাদের থোড়াই।

উনি নাছোড়বান্দা, “দেখুন না একটু। সমত্থ মেয়ে।বছর বারো কি তেরো বয়স।  ইঁটভাঁটার বাচ্ছা। বলছে মায়ের ওপর রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। পথ ভুলে আর ঘরে ফিরতে পারেনি।” ইমোশন্যাল অত্যাচারটা মাইরি দারুণ পারেন উনি। এমন থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে বললেন, একজন মা হিসেবে কেঁপে উঠল বুকটা।
তা খুঁজব কেমনে? কিছু বলেছে মেয়েটা? শুধু তিনটে শব্দ-“ভাট্টা,চাচু আর পাণ্ডওয়া”। ভাট্টা আর পাণ্ডুয়া তো বুইলুম। আমারই এলাকা। চাচু বস্তুটি কি? খায় না মাখে? জবাব নেই ওণার কাছেও।
জনৈক ইন্সপেক্টরের(বিনা অনুমতিতে নাম নিলাম না) এক তুতো কাকার একটি ইঁট ভাঁটা আছে। বেশ কয়েকবার নানা আইনে ইন্সপেকশনও করেছি আমরা। ওকেই ধরলাম। ধরতে কেমন লাগছিল, ছুটির দিনে উটকো আপদ ভাবছে নির্ঘাত। না বেচারার পোস্টিং পাণ্ডুয়া, না ওর কাকার ভাঁটাটা পাণ্ডুয়ায়। তবু ভাবলাম বলেই দেখি না। এত ভালোবাসে এরা আমায়, বললে ফেলবে না নির্ঘাত।

ওঃ যেমন অফিসার তার তেমন ইন্সপেক্টর। গোটা কথাটা শুনলই না। “দাঁড়ান ম্যাডাম। দেখছি। এই চাচু মাল থুড়ি ব্যাপারটাকে কাল্টিভেট করতে হচ্ছে।” কর বাপ। চাষ আবাদ যা ইচ্ছা কর। মেয়েটার মা’টাকে যদি খুঁজে বার করা যায়- ।
ইন্সপেক্টর সাহেবের কাকাবাবুর মাধ্যমেই আলাপ হল, মালিক সংগঠনের তাপস বাবুর সাথে। ইন্ডিয়া ভাঁটার মালিক তাপস বাবু, এমনিতে আমাদের প্রতিপক্ষ। সবসময়ই আমরা ওণাদের আর ওণারা আমাদের সন্দেহের চোখে দেখেন। মানুষটাও বেশ  ঠোঁট কাটা। কাটখোঁট্টা প্রকৃতির। তবে আপাত রূঢ় হৃদয়ের মধ্যে বয়ে চলে স্নেহের ফল্গুধারা। আহাঃ “আমার বাড়িতেও তো বাচ্ছা আছে ম্যাডাম। মাঝে মধ্যে রাগটাগও তো করে। ” বিকাল থেকে ওণারা তল্লাশ  শুরু করলেন, কোথায় আছে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের চাচুবাবু। পাণ্ডুয়া বেশ বড় এলাকা। ভাঁটার সংখ্যাও বেশ বেশী। বেশী বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে বালবাচ্ছা নিয়ে আসা শ্রমিকের সংখ্যাও। কার বাচ্ছা হারালো, কে খোঁজ রাখে বলুন তো? সন্ধ্যে নামলেই জমে ওঠে “দারু দেশী”র খোয়ারি। ততোক্ষণে আমার আর ইন্সপেক্টর সাহেবের বিশ্বাস ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে, মেয়েটা নির্ঘাত অ্যাসল্টেড হয়েই ভেগেছে। কোঅর্ডিনেটর সাহেবকে উত্যক্ত করছি আমরা চেক করান। কেন পালাল একটা সমত্থ মেয়ে? আর চাচুর নামই বা কেন করল? কে রে ব্যাটা চাচু তুই? মালিকপক্ষের অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টা আর আমার ইন্সপেক্টর সাহেবের উদগ্রতার জন্য,
এক রাত আর হাফ বেলার মধ্যেই আবিষ্কৃত হল মেয়েটির মা। চাচু অবশ্য ততোক্ষণে ভাঁটা ডিঙিয়ে পগার পার।
তাপস বাবু খোদ নিয়ে এলেন মাটিকে, আমার চেম্বারে। ডাকা হল এনজিওর লোকজনকেও। মেয়েটি হোমে। এনজিওর রিপোর্টের ভিত্তিতেই মিলন হতে পারে মা-মেয়ের। মহিলা আদিবাসী গোত্রীয়। ভালো বাংলা বলতে পারেন না। চাচু ওণার এজেন্ট।এরা বলে সর্দার। মহিলার বাড়ি উত্তরবঙ্গের এক আদিবাসী এলাকায়। পিতৃ-মাতৃহীন। স্বামী পরিত্যক্তা। ভুল লিখলাম স্বামী পরিত্যাগিনী। কেন? বরকে ছাড়লে কেন? প্রশ্ন করলেই খিঁচিয়ে ওঠে। “কেনে? খাতি দিবে না, কিলাবে। থাকব কেনে? ওমন বিয়ে আর ওমন বরের মুয়ে আমি ইয়ে-”। হারিয়েে যাওয়া মেয়েটি সম্ভবতঃ বিয়ে করা বরের। সঠিক জানেন না মহিলা। ঘরে আরও দুটি বাচ্ছা। তাদের কোনটা চাচুর হতেও পারে। জানেন না মহিলা।
ওনার শৈশবে উনিও আসতেন, ফি বচ্ছর, সেই সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে বাবা-মায়ের সাথে ভাঁটায় খাটতে।একবারই আসেননি। তখন ওণার বয়স  আট বা দশ। নানীর কাছে রেখে গিয়েছিল বাপ-মা। বলেছিল তো ফিরবে, ফেরেনি। দিশী বিষ মদ একসাথে কেড়ে নেয় দুজনকেই। সেই থেকে মামার ঘরেই মানুষ। যৌবনের শুরুতে পছন্দ করা ছেলেকে বিয়া করে ভেগে যাওয়া। আর তারপর-
ছোটখাট খর্বকায় চেহারা,ভাঁটার তাপ আর রোদে ঝামাপোড়া রঙ। আদিবাসী রমণীদের মত গাছকোমর বেঁধে পরা শাড়ি। ছোট এক জোড়া চোখ। হয় ঝিমোচ্ছে,নয় ঝলসে উঠছে। যেন পলকে ভস্ম করে দেবে আমায়। আমিই একমাত্র প্রশ্নকারিনী কি না।তিরতিরে নাক। সরু ঠোঁট। হাড় সর্বস্ব দুই হাতে দুটি সরু সোনালী চুড়ি। কোলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা। চট করে কোন কথাই শুনছে না। পাত্তাই দিচ্ছে না, ‘ইদের ম্যায়ডাম’কে। পারলে বোধহয় বলেই বসে, “এই তু চুপ কর তো। ”
জানতে চাইলাম, মেয়েকে ফেরৎ নেবে তো? গাড়ি নিয়ে আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেব প্রস্তুত। নিয়ে যাবে হোমে। সঙ্গে যাবেন তাপস বাবু আর এনজিও থেকে আসা ছেলেটি। “নাঃ। ” আধা ঝিমানো গলায় উত্তরটা পেয়ে চমকে উঠলাম। কেন?
জবাব নেই। তাপস বাবু ধমকে উঠলেন, বল না মেয়েটা। মালিক না হলেও মালিকশ্রেণীর তো, তাঁকে খাতির করে মেয়েটি।  ঋজু হয়ে বসে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হবে?উ আবার ভেগে যাবে। এর আগেও ভেগে ছিল।” আগেও পালিয়েছিল মেয়েটি। কেন জানেন? তিনটি বাচ্ছাকে নিয়ে নাজেহাল মা, ভাঁটায় কাজ করতে আসার সময় বড়টিকে রেখে এসেছিল তার নানীর ঘরে। মাকে খুঁজতেই পালিয়েছিল মেয়েটি। কিভাবে যেন সেবার খবর পেয়ে ভাঁটার কাজ, মজুরী পেলে দেশে দৌড়য় মা। কিভাবে যেন খুঁজে বার করে দুলালীকে। আর তারপর?
শিলিগুড়িতে এক মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে আবার ভাঁটায় ফিরে আসে মা। ভালো বাড়ি। দুবেলা খেতে দিত। মারধরও করত না। আবার পালায় মেয়েটি। পাণ্ডুয়া নামটা মনে ছিল। বিনি পয়সায় ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে সেই সুদূর শিলিগুড়ি থেকে পাণ্ডুয়া চলে আসে মেয়েটা। মায়ের খোঁজে।
বাস্তব সত্যিই কল্পনার থেকেও বিচিত্র। কি বলেন?

কি ভেবেছিল মেয়েটা কে জানে? মা খুব আদর করবে? সাবাস সাবাস করবে? কেউ কোনদিন ওর মাকে আদর করেছে? সাবাস বলেছে? ওর মা ওসব শিখবে কি করে? ঘরের কাজে লাগিয়ে দেয় মেয়েটিকে মা। দুই ছোট ভাইবোনের দেখভাল,রসুই। করত। করত না,তা নয়। শুধু চটে যেত, কাজের পর মা আর চাচুর ঘনিষ্ঠতা দেখলে। এক টুকরো ঝুপড়িতে আর কি অবগুণ্ঠন? সবই তো খুল্লামখুল্লা। এই নিয়ে অশান্তি। চাচুও বোধহয় লাগিয়েছিল ঘা কতক। মা যদিও চাচুর কোন দোষই দেখতে পায় না। চাচু নৌকরি দিয়েছে বলেই না খেয়ে পরে বেঁচে আছে। চাচু তো একটু ইয়ে করতেই পারে। তাই বলে ঘর ছেড়ে ভাগবি তুই? ওকে আর নেবে না মা। থাক ও হোমেই থাক। দুবেলা খেতে তো পাবে। পড়ালিখাও শিখবে হয়তো। ভাঁটার শিশু হয়ে তো বাঁচবে না-

বছর ঘুরে গেল। কেমন আছে মেয়েটা কে জানে? আবার তো ভাঁটার মরশুম শুরু হল, মা'টা কি এবারও এসেছে? কে উত্তর দেবে বলুন তো? বড় আশা ছিল, মধুরেন সমাপয়েৎ এর। তবে সব গল্প তো আর মিলনান্তক  হয় না-। জীবন বড়ই বিচিত্র বাবুমশাই।

শ্রমিক আমি (পর্ব-৪)
মনে করুন আপনি কোন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত একজন শ্রমিক,এবার মালিকপক্ষ হঠাৎ করে একদিন আপনাকে বলে দিল কাল থেকে আর কাজে আসতে হবে না, কোনরকম নোটিশ ধরালো না, শোকজ করল না, এক মাসের অগ্রিম বেতন দিল না, কিছুই করল না, শুধু বলল, “বাপু অনেক হয়েছে, ভালোয় ভালোয় বিদায় দিলাম, আলোয় আলোয় চলে যাও”। তখন আপনি কি করবেন?
আপনাকে আসতে হবে আমাদের কাছে, আপনার মহকুমায় যে অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডেপুটি লেবার কমিশনারের দপ্তর আছে, আপনাকে সেখানে গিয়ে সাদা কাগজে তিন কপি দরখাস্ত দিতে হবে। আপনি অবশ্যই মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রেও আদালত জানতে চাইবে আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন কি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদালত আবার ঘুরিয়ে আপনাকে আমাদের কাছেই পাঠাবে।
যাইহোক এবার আমরা কি করব? ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট, ১৯৪৭ অনুসারে আমরা হলাম কন্সিলিয়েশন অফিসার, আইনে আমাদের অসীম ক্ষমতা দেওয়া আছে, ডিসপিউটের মীমাংসা করার জন্য আমরা আক্ষরিক অর্থেই যা খুশি করতে পারি, এমনকি তেমন ত্যাঁদড় মালিক পক্ষকে দরকার হলে সমন পাঠিয়ে ধরে আনার অধিকারও আমাদের আছে। বাবা-বাছা করে হোক, ধমক-ধামক-হুমকি দিয়ে হোক, দুপক্ষকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি, পেরে গেলে ভালো, কিন্তু আদালতের মত কথা না শুনলে শাস্তি দেবার ক্ষমতা তো বেচারি কন্সিলিয়েশ্ন অফিসারের থাকে না, হাতে কোন ডাণ্ডা থাকে না যে গোঁয়ার গুলোকে দুঘা দিতে পারি, তাই যখন দেখা যায় এই কেসটার আর কোন মেরিট নেই, বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুল মার্কা কানা গলিতে ঢুকে পড়েছি, তখন বাধ্য হয়ে ফেলিওর রিপোর্ট করতে হয় ওপরতলায়।গুরুত্ব বুঝে যা কালক্রমে কোর্টে পাঠানো হবে কি হবে না, সে সিদ্ধান্ত নেয় সদর দপ্তর।
আমার এই এগারো বছরের চাকরী জীবনে এরকম যে কটি কেসের সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রতিটিকে নিয়েই একেকটা গল্প লেখা যায়। যেহেতু নিখাদ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তাই কন্সিলিয়েশন অফিসারের চেয়ারে বসেও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে পারি কই? অধিকাংশ সময়ই আমি নিজেই শ্রমিকের হয়ে সওয়াল জবাব করি এবং মনে মনে মালিক পক্ষকে শূলে চড়াই। এত বড় সাহস? এক কথায় একটা লোকের চাকরী খেয়ে নাও? কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে মালিকেরও তেমন দোষ থাকে না, মালিক পক্ষ চায়, বাবা অন্যায় হয়ে গেছে, না জেনে করে ফেলেছি এসো মিট্মাট করে নি- কিন্তু বলে না বাঁশের থেকে কঞ্চি দড়, শ্রমিক নিমরাজি হলেও তার হিতাকাঙ্ক্ষীরা কিছুতেই রাজি হয় না।
সময়কাল বা স্থানকাল সম্বন্ধে নীরব থাকছি, একদিন এক ভদ্রমহিলা এলেন আমার কাছে, “নমস্কার ম্যাডাম। আমি অমুক স্কুলে পড়াই।“ দিদিমণির বরের একটি কেস চলছিল আমার তৎকালীন দপ্তরে। ফাইল থেকে যা বুঝলাম, ভদ্রলোক একজন কনট্রাক্টরের অধীনে একটি আপৎকালীন সরকারী দপ্তরে মোবাইল ভ্যান চালাতেন, কোন কারণবশতঃ উনি একদিন এমারজেন্সি ডিউটিতে যেতে পারেননি, ফলে ওনার চাকরী চলে যায়। কেসটা এসেছিল আমার পূর্বসূরির জমানায়, মালিক পক্ষকে এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য লিখিত ভাবে জানাতে বলার পরই সে বেচারা বদলী হয়ে যায় এবং যাবার সময় দিদিমণিকে বলে যায় যে, “ম্যাডাম আসছেন। উনি ঠিক ধমকে ধামকে আপনার স্বামীর চাকরী ফিরিয়ে দেবেন।“যদিও বন্ধু মানুষ, তবু মনে মনে পূর্বসূরির মুণ্ডপাত করলাম, খুব ভালোই জানে, যে, ম্যাডাম তো দুরস্থান ম্যাডামের পিতৃদেবও কাউকে চাকরীতে পুনর্বহাল করার ক্ষমতা রাখেন না।
মালিক পক্ষকে উদোম ঝাড়লাম, লিখিত জবাব দেননি কেন? বৃদ্ধ মালিক ভয়ে ভয়ে বলল, “ম্যাডাম আমার শরীর ভালো নয়, ভেলোরে গেছিলাম, এই ফিরেছি, আপনি যেদিন ডাকবেন আসব।“ ডাকলাম দুপক্ষকে। শ্রমিকের সাথে সাথে দিদিমণিও এলেন।আলোচনা শুরু হল,মালিক জানালেন, ঐ ড্রাইভারের জন্য সেদিন সরকারের আপৎকালীন পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়,সরকারী দপ্তর ওনাকে শোকজ করে, এবং দপ্তরের আধিকারিক হুমকি দেন,ঐ ড্রাইভারকে না সরালে ওনার কন্ট্রাক্ট বাতিল করে দেবেন। নিঃসন্তান বৃদ্ধ মালিক, কন্ট্রাক্ট গেলে ওনার খাওয়া পড়ার অভাব হবে না, কিন্তু ওনার অধীনে কর্মরত বাকি ছেলে গুলোর কি হবে, এই ভেবে উনি এই ড্রাইভারটিকে বরখাস্ত করেন। এ গল্প আমার বহু পরিচিত। সব কেসেই মালিক এমনই কিছু ফাঁদে, যদিও এই লোকটিকে খুব একটা প্যাঁচালো মনে হল না।
এবার শ্রমিকের পালা, মালিকের বক্তব্যের মধ্যেই দিদিমণি অন্তত বার পাঁচেক মিথ্যা কথা, মিথ্যাবাদী, বাজে বকছে এসব করেছেন। বার কয়েক ধমক দিলাম, তাও শোনে না। শ্রমিককে যখন বলার সুযোগ দেওয়া হল, দিদিমণি, আগ বাড়িয়ে বললেন, “আমি বলছি, তুমি থামোঃ।“ আবার ধ্মকালাম,কে কার কথা শোনে, অচিরেই বুঝতে পারলাম না আমি দিদিমণির ক্লাশে বসে আছি, না দিদিমণি আমার চেম্বারে। তবে দিদিমণির প্রবল ধমক হুমকি অভিযোগের যা সারমর্ম বুঝলাম, শ্রমিক চায় ক্ষতিপূরণ সহ তাকে আবার পুনর্বহাল করা হোক। মালিক পক্ষ জানালো, আপাতত কোন কাজ ফাঁকা নেই,ড্রাইভার একজন নেওয়া হয়ে গেছে, যেহেতু মোবাইল ভ্যানটি সচল থাকা আবশ্যক। দিদিমণি লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিৎকার জুড়লেন, “ঐ ছেলেটাকে নেয় কোন সাহসে? ওকে আজই তাড়িয়ে দিয়ে আমার স্বামীকে নিতে হবে।“
এবার দেখলাম দিদিমণির ক্লাশ না নিলে চলছে না, ওনার চার গুণ চিৎকার করে বললাম, “আপনি শ্রম কমিশনারের অফিসে এসে,আর একজনকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার দাবী করছেন? অনেক ক্ষণ থেকে আপনার বকবক শুনছি, মুখ বন্ধ করে না বসলে, চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।“ জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত উনি শান্ত হয়ে বসলেন। মালিককে আলাদা করে বললাম, বিনা নোটিশে এভাবে ছাড়িয়ে দেওয়া বেআইনি কাজ, মিটমাট করে নিন। ঐ কাজ না দিতে পারেন, অন্য কোন কাজে লাগিয়ে দিন। একদিন যেতে পারেনি, হতেই পারে। এমন কিছু গর্হিত অপরাধ তো করেনি।
মালিক নিমরাজি হল, অন্য একটি চাকরী দিতে কিন্তু শ্রমিক কিছু বলার আগেই ওনার জাঁদরেল দিদিমণি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, “ না নেব না। আমরা কিছুতেই অন্য চাকরী নেব না। নতুন ছেলেটাকে দূর করে আমার বরকে তার পুরানো চাকরী ফেরত দিতে হবে। ও ভেবেছেটা কি? ওকে আমি কোর্টে টেনে নিয়ে যাব। জেলের ঘানি ঘোরাব।“ দিদিমণিকে বুঝিয়ে বললাম, কোর্টে টেনে নিয়ে যাবেন সে তো ঠিকই আছে, কিন্তু এই অপরাধে কারো জেল হয় না। মাত্র কয়েকটা মিটিংয়েই যখন মিটে যাবার সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে, তখন অনুগ্রহ করে তা নষ্ট করবেন না। কিন্তু কোন কথাই ওনারা শুনতে রাজি নন। ক্রমাগত দিদিমণির বাক্যবাণে আহত হতে হতে এবার বুড়ো মালিকও বেঁকে বসল।
অবস্থা আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ডিএলসি সাহেবের শরণাপন্ন হলাম, স্যারের ঘরে মিটিং ডাকা হল যতদিনে, ততদিনে চাকরী যাবার পর থেকে দশ মাস অতিক্রান্ত। প্রস্তাবিত ফাঁকা চাকরিটাও ইতিমধ্যে একজনকে দিয়ে দিয়েছেন বুড়ো মালিক। দিদিমণির দাবী সেই এক। স্যার খুব ভালো ভাবে বোঝালেন,এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিপূরণই একমাত্র উপায়। মালিককে বাইরে পাঠিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন শ্রমিককে, “দিদিমণি আপনি চুপ থাকুন। ভাই সত্যি বলতো, দশ মাস ধরে তুমি তো বসে নেই, কিছু করছ তো?” প্রসঙ্গত ওনারা যদিও বলেননি, কিন্তু আমরা জানতাম যে লোকটি টুকটাক কাজ করছে। ব্যাপারটা ওনাদের কাছে ইগোর পর্যায়ে চলে গেছে, মালিক শ্রমিক একই পাড়ার বাসিন্দা, একজন আর একজনকে বসিয়ে দিয়েছে, এবার এ শ্রম দপ্তরের সাহায্যে বুড়োকে উচিৎ শিক্ষা দিতে চায়, তাই ঐ চাকরিটাই ওদের চাই। স্যারের সামনে যদিও তা স্বীকার করল না, লোকটি বলতে গেল, “ঐ আর কি-“। দিদিমণি হাত নেড়ে বললেন,”সেটা কথা নয়। নতুন ছেলেটিকে ছাড়িয়ে...”।
অনেক ধস্তাধস্তির পর স্যার উভয় পক্ষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে এবং নিতে রাজি করলেন। ঠিক হল, পরের মিটিং এ এসে এরা জানাবে, কত চায়, ওদের ওটা দিতে হবে, যেহেতু দোষ মালিকেরই।
নির্দিষ্ট দিনে এলেন সকলে, স্যার আগে সস্ত্রীক শ্রমিকের সাথে কথা বললেন, ওরা কোন টাকা ঠিক করে আসেনি, স্যার যা বলবেন তাই নেবে। স্যার বললেন, তিন মাসের বেতন যাতে ও পায় উনি সেই দাবীই জানাবেন, শ্রমিক রাজি হয়ে ঘাড় নাড়াতে লাগল, দিদিমণি শক্ত হয়ে বসে রইলেন, মালিক এল, স্যার কথা পাড়তে যাবেন, দিদিমণি ফোঁৎ করে বলল, “ঐ কটা টাকায় কি হয়? নতুন ছেলেটাকে দূর করে আমার বরকে তার পুরানো চাকরী ফেরত দিতে হবে।“স্যার হতাশ হয়ে বললেন, “অনিন্দিতা ১২/৪ করে দাও।এর কোন মীমাংসা হওয়া সম্ভব নয়।“ ১২/৪ হল ফেলিওর রিপোর্ট। হয়ে যাওয়া কেস দু- দুবার এভাবে কেঁচে যেতে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল, ক্লান্ত হাতে নোটশিট লিখছি, আড়চোখে দেখলাম, শ্রমিকটি মাথা নিচু করে বসে আছে্‌, একবার চোখ তুলে তাকালো এক রাশ হতাশা নিয়ে প্রশ্ন করল, “এবার কি হবে? কোথায় যাব?” কি জবাব দেব? সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করার পর যদি হেরে যেতে হয়, তাও যার জন্য লড়াই তারই নির্বুদ্ধিতায়, কিই বা বলার থাকে-